(ছবিতে – বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের প্রতিষ্ঠিত ও আরাধ্যা মৃন্ময়ী মাতা। দেবীর সাথে লক্ষী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক অনুপস্থিত এবং দেবীর বাহন সিংহ নয়, গোধা। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃন্ময়ী মাতা রূপে দেবী দুর্গা বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে পূজিত হয়ে আসছেন।)
দেবীর হাতে নানা আয়ুধ— বাঁ দিকে ত্রিশূল, খড়্গ, চক্র, তির ও শক্তি; ডান দিকে ঢাল, ধনু, পাশ, অঙ্কুশ ও ঘণ্টা (বা পরশু)। রণরঙ্গিণী সিংহবাহিনী দেবী মহিষ নামের অসুররাজকে নিধনে রত।
দুর্গার এই রূপকল্পনা এক দিনে হয়নি, শত শত বছর ধরে তাঁর মূর্তির নির্মাণ ও বিবর্তন হয়েছে। গোড়ার দিকে তিনি দ্বিভুজা হলেও পরাক্রম দেখাবার জন্য তাঁকে চতুর্ভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা, দ্বাদশভুজা, ষোড়শভুজা বা অষ্টাদশভুজা রূপে দেখানো হয়েছে। ক্রমবর্ধমান শত্রুসংখ্যা ও অসুরশক্তির সঙ্গে মোকাবিলার জন্য তাঁর হাতের সংখ্যা আয়ুধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে চলেছে। একদম প্রাচীন কালে তাঁর না ছিল বাহন সিংহ, না কোনও অনুচর, তিনি একাই বিশাল মহিষকে লেজ ধরে ঘুরিয়ে ছুড়ে ফেলেছেন।
ক্রমশ পরিবারদেবতা হিসেবে তাঁর সঙ্গে সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ ও কার্তিক সন্নিহিত হলেন। রূপান্তরিত হলেন পরিবারের সদস্য পুত্রকন্যা হিসেবে। মহাদেবও স্থান পেলেন, তবে পিছনের চালচিত্রে দুর্গার মাথার উপর। অর্থাৎ হিন্দুধর্মের প্রায় সব মুখ্য দেবদেবী একত্রিত হয়ে চলে এলেন পূর্ব ভারতে শরৎকালের দেবীপক্ষে। দশভুজা মহামায়ার রণরঙ্গিণী রূপ যেন অনেকটা নিষ্প্রভ হল— কারণ এখানে তিনি আসছেন অসুরপীড়নে বিজয়িনী হয়ে, ভক্তদের হর্ষ-উল্লাসের জন্য। তাঁর বাহন সিংহের রূপেও পরাক্রমের চিহ্ন নেই, বরং অনেকটাই পোষ-মানা, ঘরোয়া ভাব। দেবীর বাহন সিংহকে নিয়ে বেশ কিছুটা ধোঁয়াশাও রয়েছে।
● নানা রূপে মহিষমর্দিনীর মূর্তি:
মহামুনি মেধা মেধসের বর্ণনানুযায়ী মহিষমর্দিনীর তিন প্রকার মূর্তি প্রচলিত।
১) অষ্টাদশভুজা (কাত্যায়নী)
২) ষোড়শ ভুজা (চন্ডী)
৩) দশভুজা (দুর্গা)
বঙ্গদেশে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পাথরের মূর্তিতেই মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হয়েছে। আর এই তিনপ্রকার মূর্তিই বঙ্গদেশে পাওয়া গেছে। এই সকল মূর্তিগুলি তে লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ কার্তিক অনুপস্থিত।
১২০০ খ্রিস্টাব্দের পর রাজা কংসনারায়ণ শরৎ কালে প্রথম মাটির মূর্তি গড়ে পুজোর আয়োজন করেন। তার আগে বাংলাতে মহিষমর্দিনী কে শুধু কুলদেবী রূপেই আরাধনা করা হতো। কংসনারায়ণই প্রথম শারদীয়া পুজো করেন। রামের দুর্গা পূজার গল্পটার একেবারে মিথ্যা। কংসনারায়ণ যে বছর শারদীয়া পুজো করেন সেই বছরই রাজা সূর্যনারায়ণ বাসন্তী পূজা করেন। যদিও শোনা যায় রাজা সূর্যনারায়ণ নাকি রাজা সুরথের বংশধর। কথিত আছে রাজা সুরথ নাকি প্রথম দুর্গোৎসব করেন।
রাজা কংসনারায়ণই সপরিবারে দুর্গা পূজার অর্থাৎ সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, লক্ষী সহ দুর্গাপূজার প্রবর্তক। সেই মূর্তি ছিল একচালা। সিংহ ছিল ঘোড়ামুখী। বাকি মূর্তি গুলো ছিল কাঠের পুতুলের মত। এই মূর্তি এখন শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে পাওয়া যায়। কৃষ্ণনারায়ণের এই শারদীয়া পূজাকেই কৃত্তিবাস ওঝা নিজের রামায়ণে নথিভুক্ত করেন, বঙ্গসমাজে তাঁর লিখিত এই নতুন রামায়ণকে জনপ্রিয় করে তুলতে। বাল্মীকি রামায়ণে দুর্গাপূজার কোনও উল্লেখ নেই। রাম কস্মিনকালেও দুর্গাপূজা করেন নি।
তাহলে ঋতুভিত্তিক দুর্গাপূজার ইতিহাস ৮০০-৯০০ বছরের পুরানো। রাজা কংসনারায়ণের এই শারদীয়া পুজোকেই নদীয়া রাজ, মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র দেব জনপ্রিয় করে তোলেন। একই বছর নবকৃষ্ণদেবও শারদীয়া দুর্গোৎসব করেন। মানে ১৭৫৭ সালে। সেটাই উত্তর কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা। দক্ষিণ কলকাতায় শারদীয়া পূজোর ইতিহাস আরোও প্রাচীন। আমরা বর্তমানে মাটিতে গড়া দুর্গামূর্তিতে আরাধানা করি সেটা ওই কংসনারায়ণ ঘরানা। বাংলায় আরোও এক ধরণের মূর্তিতে পুজোর প্রচলন রয়েছে সেটা হলো বিষ্ণুপুর ঘরানা।
● বাংলায় প্রচলিত দেবী মূর্তির দুটি ভিন্ন শৈল্পিক ঘরানা:
বিষ্ণুপুর ঘরানা এবং কংসনারায়ণ ঘরানা উভয় ঘরানাই ৯০০ বছরের প্রাচীন এবং স্বাতন্ত্র ভাবে উদ্ভাবিত। কংসনারায়ণ বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তাহেরপুরের রাজা ছিলেন। শোনা যায় সূর্যনারায়ণ ছিলেন রাজা সুরথেরই বংশধর। এই জায়গাটি বাংলাদেশ সরকার হেরিটেজ করেছে। প্রত্যেক বছর স্থানীয় হিন্দু জনগণের প্রচেষ্টায় ও সরকারি সাহায্যে এখানে দুর্গোৎসব হয়। তাঁর প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ এখনও তাহেরপুরে আছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের দাবিতে সেটি এখন জাতীয় সম্পত্তি ঘোষিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।
এবার রাজা সুরথের প্রসঙ্গে আসি। মেধস মুনির আশ্রমে এসে রাজা দুর্গাপূজার আদেশ পান। এই মেধসের আশ্রম বর্তমান চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হিন্দুদের বৃহত্তম তীর্থ স্থান। এই আশ্রমটি এখনও আছে। সুরথের বংশধর হলেন সূর্যনারায়ণ। তবে এর রাজপ্রাসাদ বা ভিটের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। রাজা সুরথকে নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বীরভূমের লোকেদের দাবি রাজা সুরথের বাসস্থান নাকি বীরভূমের বোলপুরে। রাজা সুরথ ১০০১টি পাঁঠা বলি দিয়েই প্রথম দুর্গোৎসব করেন, তাই ওই অঞ্চলের নাম বলিপুর হয়ে যায়। আর এই বলিপুর থেকেই আজকের বোলপুর নাম।
এবার আসি বিষ্ণুপুর ঘরানায়। এটা কংসনারায়ণের থেকেও প্রাচীন। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মল্ল রাজারা বিষ্ণুপুরে মাতৃ মূর্তি গড়ে শারদীয়া দুর্গা পূজা করেন। এটি সম্পূর্ণভাবে রাঢ় বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। মল্লরাজারা প্রথমে শাক্ত ছিলেন। কুলদেবী মৃন্ময়ীমাতার মন্দির গড়ে উপাসনা করতেন। সেই মন্দির এখনও আছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে। মল্লরাজারা চৈতন্য প্রভাবে বৈষ্ণব হয়ে গেলে ওই পূজার জৌলুস কমে যায়। বিশুদ্ধ শাক্তাচারগুলি বৈষ্ণব প্রভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে।
● বাংলার প্রতিমাশিল্পের চালি:
প্রাচীন বঙ্গদেশে দুর্গাপ্রতিমায় ধ্রুপদী চালা ও চালচিত্র ব্যবহার করা হত। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জমিদার ও রাজবাড়িতে এবং বেশকিছু সাবেকি পুজো মণ্ডপে ধ্রুপদী চালা এবং চালচিত্রের ব্যবহার করা হয়। বাংলাহাজার হাজার বছরের শক্তি উপাসনার পীঠস্থান। বঙ্গীয় শিল্পরীতিতে শক্তি উপাসনার বারংবার প্রতিফলন ঘটেছে। বঙ্গদেশে প্রতিমাশিল্প ও মৃৎশিল্পে প্রতিমার চালি ও চালচিত্রের ব্যবহার এই শাক্ত শিল্পরীতির একটি অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাতেই কাদামাটি দিয়ে দেবী পূজার প্রতিমা নির্মাণ হয়। কাজেই প্রতিমার তৈরিতে চালির ব্যবহার সম্পুর্ন বাংলার সংস্কৃতির নিজেস্ব উপাদান। প্রাচীন কালে শুধু একচালার প্রতিমা নির্মাণ হত। তখন শুধু মাত্র এক ধরনের চালির ব্যবহার হত যার নাম “বাংলা চালি” কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে ও শিল্পীর ভাবনায় তৈরি হলো ধ্রুপদী রীতির নতুন নতুন চালি। বর্তমানে সাবেকি প্রতিমায় যে সব চালির ব্যবহার হচ্ছে তার অধিকাংশই সেই প্রাচীন ধারা অনুসরণ করছে।
● চালির প্রকারভেদ
বাংলার প্রতিমায় চালি গুলি শিল্পসৌকার্সের পাশাপাশি পৌরাণিক উপাখ্যান শ্রীশ্রীচণ্ডী এর শাক্তদর্শন অনুসরণ করছে। আকার আকৃতি,প্রাচীনত্ব ও শাক্তদর্শন অনুযায়ী এই চালি গুলিকে অনেক গুলো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে প্রাচীন চালি হলো “বাংলা চালি”। পরবর্তী কালের আছে “মঠচৌরি চালি” ও “টানাচৌরি চালি”। এরপর আসে “মার্কিনি চালি”। ছাড়াও রয়েছে ইত্যাদি চালি।
১) বাংলা চালি – বঙ্গদেশের সর্বাধিক পুরোনো চালি। মনে করা হয় কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা এই চালির আবিস্কারক। এই চালি কিছুটা অর্ধচন্দ্রাকার যা একচালার প্রতিমার মূল কাঠামোয় ডিবিপ্রতিমার পেছনে উপরের দিকে সংযুক্ত থাকে। এই চালি কিন্তু প্রতিমার একচালার কাঠামোর চেয়ে অনেক বড় হয়। এতটাই বড় যে অর্ধচন্দ্রাকার এই চালি কাঠামো ছাড়িয়ে কাঠামোর বাহিরে দুই পাশে কিছুটা ঝুলে থাকে। চালিতে যে চালচিত্র ব্যবহার করা হয় তাতে মহাদেব ও শ্রীশ্রীচণ্ডী বর্ণিত কাহিনী অঙ্কন করা থাকে। শুধুমাত্র “বাংলা মুখ” আদলের প্রতিমায় এই চালি ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে মূলত কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দুর্গাপ্রতিমায় এই “বাংলা চালি” ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কৃষ্ণনগরের রায়বাড়ির দুর্গাপ্রতিমায় “বাংলা চালি” ব্যবহার করা হয়। “বাংলা চালি” ব্যবহৃত হয় এমন প্রতিমা গুলি নির্মিত হয় প্রাচীন বাংলা রীতিতে। কখন সম্পুর্ন মাটিতে তৈরি হয় দেবীর পরনের শাড়ি। সেই শাড়িতে সোনার গহনার কাজ করা হয়। দেবীর বহন হিসেবে থাকে দেবসিংহ বা গোঘটক বা গোধা।
২) মঠচৌরি চালি – এই চালি অনেকটাই স্থাপত্য ঘেঁষা। একচালার দেবী প্রতিমার পেছনে তিন শিখর বিশিষ্ঠ চালার নিচের দিকে আবার তিনটি অর্ধচন্দ্রকার চালা থাকে। পেছনের শিখর তিনটি কিছুটা দ্রাবিড় স্থাপত্যএর আদলে তৈরি মন্দিরের গোপুরমের বা প্রবেশ তোরণের মত। “বাংলা চালি”তে কোনো পৃথক তিন শিখরের অস্তিত্ব নেই। পরিবর্তে একটানা একটি অর্ধাচন্দ্রাকার চালি ছিল। কিন্তু, এই চালিতে তিন শিখর যুক্ত তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালি বর্তমান। এই তিন শিখর বিশিষ্ট চালা শাক্তশাস্ত্র গুলির সত্য-রজ-তম গুনকে ইঙ্গিত করছে। শ্রীশ্রীচণ্ডী তে দেবীকে “ত্রিগুনাতিকা” বলা হয়েছে। এই ত্রিগুন হলো সত্য, রজ এবং তম। এই ত্রিগুনে দেবীর তিনটি পৃথক পৃথক রূপ রয়েছে যথাক্রমে লক্ষী, সরস্বতী ও দুর্গা। শাক্তদর্শন অনুযায়ী একত্রে ত্রিদেবীর আরাধনায় হলো দুর্গোৎসব। বঙ্গদেশে দুর্গোৎসবের ক্ষেত্রে, এই ত্রিদেবীর আরাধনা একচালার প্রতিমাতে অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু মঠচৌরি চালিতে এই তিনটি পৃথক শিখর বিশিষ্ট তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালির মাধ্যমে ত্রিদেবীর উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কলকাতার হাটখোলার দত্তবাড়িতে মঠচৌরি চালির ব্যবহার দেখা যায়। যে সকল দুর্গাপ্রতিমায় এই চালি ব্যবহার করা হয় সেই সব প্রতিমার প্রাচীন বাংলা রীতিতে নির্মিত। দেবীর মুখ “বাংলা মুখ” আদলের। প্রতিমার পরনে মাটির শাড়ি থাকে। পটুয়ার তুলিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে এই শাড়ি। রং তুলি দিয়ে শাড়িতে আঁকা শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনী। সাবেক ডাকের সাজের প্রতিমায় দেবীর বহন হিসেবে থাকে দেবসিংহ বা গোঘটক (গোধা)।
৩) টানাচৌরি চালি – তিন শিখর বিশিষ্ট মঠচৌরি চালি থেকে তিনটি অর্ধচন্দ্রাকার চালা সরিয়ে ফেললে যে নতুন চালা তৈরি হয় তাকে বলে টানাচৌরি চালি। অর্ধচন্দ্রাকার অংশটি থাকে না পরিবর্তে পরপর তিনটি শিখর একটানা একটি সরলরেখায় বসানো থাকে বলেই এই চালির নাম “টানাচৌরি”। এই চালির তিনটি শিখরও শাক্তদর্শনের সত্য রজ ও তম গুণের প্রতীক। শুধুমাত্র বাংলার “চৌধুরী” উপাধি যুক্ত জমিদার বাড়ীগুলি এই চালি ব্যবহার করে বলে এটাকে “চৌধুরী”দের নিজেস্ব চালি বলা হয়। তাই এর অপর নাম “চৌধুরী চালি”। কলকাতার সাবর্ন রায় চৌধুরী পরিবারের ৮ টি দুর্গাপুজোর মধ্যে অধিকাংশ পুজোর প্রতিমা এই চালি ব্যবহার করে। এছাড়া হাওড়ার আন্দুল রাজবাড়ী এই চালি ব্যবহার করে।
৪) মার্কিনি চালি – পশ্চিমবঙ্গের বর্তমানে পারিবারিক ও সার্বজনীন সাবেকি পুজো গুলির অধিকংশ পুজোর প্রতিমাই এই চালা রীতি অনুসরণ করে। এই চালি অনেকটাই আধুনিক স্থাপত্য ঘেঁষা। একচালার প্রতিমার পেছনে অর্ধবৃত্তাকার একটি চালা থাকে, অর্ধ অর্ধবৃত্তকার চালা শেষ হলে দুইপারে দুটি থাম শুরু হয়ে ভূমি স্পর্শ করেছে। ব্রিটিশ আমলে চালির ব্যবহার সর্বাধিক বেড়েছিল। কলকাতার বিখ্যাত বাগবাজার সার্বজনীন পুজোর প্রতিমা এই চালারীতি অনুসরণ করে।
● চালচিত্র:
চালচিত্র হল সাবেকি দুর্গা প্রতিমার উপরিভাগে অঙ্কিত দেবদেবীর কাহিনিমূলক পটচিত্র, যা প্রধানত অর্ধগোলাকৃতি হয়। চালচিত্রে পঞ্চানন শিব, মহিষাসুর বধ, নন্দীভৃঙ্গী, শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ প্রভৃতি কাহিনির ধারায় বর্ণিত থাকে। এই চিত্রকলার একটি নিজস্ব রূপরেখা ও শৈলীগত দৃঢ় বুনিয়াদ রয়েছে। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র হল ‘‘পট লেখা’’, যা বাংলার পটচিত্রের একটি বিশেষ ধারা।
চালচিত্র শব্দের ‘‘চাল’’ শব্দের অর্থ আচ্ছাদন। প্রতিমার চালির উপরে আঁকা হয় বলে এর নাম চালচিত্র। বীরভূমের দুর্গা পটের উপর আচ্ছাদন হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র হল আসলে ‘‘পটলেখা’’। এটি দুর্গা চালা বা দেবীচাল নামেও পরিচিত।
প্রতিমার চালির বিভিন্নতার উপর নির্ভর করে প্রতিমার চালচিত্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন বাংলা চালি, খোপচালি, টানাচৌড়ি, মঠচৌড়ি ও মার্কিনিচালিতে চালচিত্রের বিভিন্নতা দেখা যায়। আবার চালচিত্রের বিষয়বস্তু অনুসারে একে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়, যেমন কৈলাসী, দশাবতারী, বৃন্দাবনী, রামচন্দ্রী ইত্যাদি। তবে বাংলার বনেদি বাড়ির প্রতিমায় কৈলাসী ও দশাবতারী চালচিত্রের অধিক প্রচলন।
চালচিত্রের মূল বিষয়বস্তু হল শিবদুর্গা, কৈলাস, শিব অনুচর নন্দীভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ, দশাবতার ইত্যাদি। বীরভূম জেলার হাটসেরান্দির সূত্রধর সমাজে এই ধরনের এক বিশেষ চিত্রসম্ভার দেখা যায়, যাকে দুর্গা পট বলা হয়। তবে এখানে দুর্গা প্রতিমার বদলে দুর্গা পটেই পূজার্চনা করা হয়। দুর্গা পটের উপর অর্ধবৃত্তাকার চালচিত্র থাকে। এই ধরনের চালচিত্রে রাম, সীতা, শিব, নন্দীভৃঙ্গী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শুম্ভ-নিশুম্ভ অঙ্কিত থাকে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গার চালচিত্রের মধ্যে অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। এখানকার চালচিত্রে মাঝখানে থাকে পঞ্চানন শিব ও পাশে পার্বতী, তার একপাশে থাকে দশমহাবিদ্যা ও অন্য পাশে দশাবতার। ভারতীয় সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা বলেছেন- বাংলায় বিভিন্ন ধরনের চালচিত্রের প্রয়োগ আছে ও তাদের মধ্যে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মঠচৌরি চালির চালচিত্রে দেবীর অবয়বগুলি থাকে উপর থেকে নিচে, একটির নিচে অপরটি। আবার সাবেক বাংলা চালিতে সেগুলো থাক থাক করে আলাদা আলাদা ভাবে থাকে। অন্য দিকে, মার্কিনি চালিতে পটচিত্রগুলি থাকে পাশাপাশি।
● প্রাচীনত্ব খুজতে গিয়ে:
পাল আমলে (৭৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১১২৬ খ্রিস্টাব্দ) বাংলায় পাথরের মূর্তি নির্মাণে প্রভূত উন্নতি হয়েছিলো। পাল আমলে বেলেপাথরের মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে। সেটাই প্রমান করে যে পাল যুগে মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হত। আজ থেকে ১২০০ বছর আগে মহিষমর্দিনীর আরোধনা হত মূলত কুলদেবী রূপে। আজকের মত ঋতুভিত্তিক দুর্গোৎসবের প্রচলন ছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়।
● টেরাকোটায় মহিষমর্দিনী:
টেরাকোটায় মহিষমর্দিনীর মূর্তি বাংলার মন্দিরের দেওয়ালে পাওয়া যায়। এই ধরনের শিল্পরীতির সর্বাধিক বিকাশ হয় চৈতন্য মহাপ্রভুর সমসাময়িক কালে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর, কিংবা দিনাজপুরের কান্তজিউ এবং সারা বাংলায় ছড়ানো নানান টেরাকোটার মন্দিরে খোদিত পৌরাণিক কাহিনী ছাড়াও রয়েছে মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি। সপরিবারে (যদিও সপরিবারে কথাটা একেবারেই ভুল, কারণ সরস্বতী বা লক্ষ্মী কেউই দুর্গার দুহিতা নন বা গনেশ ও কার্ত্তিক দুর্গার পুত্র নন) মহিষাসুরমর্দিনীর যে সকল মূর্তি পাওয়া যায় তার সিংহভাগই চৈতন্য সমসাময়িক কালে নির্মিত। টেরাকোটা শিল্পে সপরিবারের মহিষাসুরমর্দিনী অধিকাংশই ৫০০-৭০০ বছর আগে নির্মিত। ঋতুভিত্তিক দুর্গোৎসব জনপ্রিয় হয়েছে কিন্তু এরও পরে।
● দুর্গাপূজায় নবদ্বীপ ও চৈতন্যদেব:
অধিকাংশ ঐতিহাসিকই নবদ্বীপের বৈষ্ণব দিকটা নিয়ে আলোচনা করেন, কিন্তু নবদ্বীপের সংস্কৃতিতে যে একটি সুস্পষ্ট শাক্ত প্রভাব আছে তা অনেকেই খেয়াল করেন না। একদা নবদ্বীপ ছিল বঙ্গসংস্কৃতির প্রাণ কেন্দ্র, একা চৈতন্য মহাপ্রভুই নয় বহু শাক্ত পন্ডিতের চারণ ভূমি ছিল নবদ্বীপ ধাম। চৈতন্য মহাপ্রভু নিজেই শাক্ত প্রভাবমুক্ত ছিলেন না বলেই অনেক গবেষক মনে করেন। এই চৈতন্য মহাপ্রভুই ওড়িশা ভ্রমণ কালে শরৎকালে ভুবনেশ্বরে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন এবং একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে চৈতন্য মহাপ্রভুর পুজোই ওড়িশার প্রথম দুর্গাপুজো। তার আগে উৎকলবাসীদের মধ্যে দুর্গাপুজোর কোনো চল ছিল না। চৈতন্য পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক কালে নবদ্বীপের প্রধান উৎসব ছিল পট পূর্ণিমা, যা কালক্রমে রাসকালি পূজো নামে খ্যাতি লাভ করে। আজও সেই ধারা অব্যাহত। এই উৎসব আজও স্বমহিমায় নবদ্বীপে অনুষ্ঠিত হয় প্রতি রাসপূর্ণিমায়। এটি সম্পূর্ন একটি শাক্ত উৎসব। ৫০০-৬০০ বছর ধরে নবদ্বীপের পন্ডিতরা কার্ত্তিক পূর্ণিমায় (যাকে বর্তমানে রাসপূর্ণিমা বলে) কুলদেবীর বাৎসরিক আরাধনায় করে আসছেন। নবদ্বীপের সেই কুলদেবীরা আর কেউ নয় মহিষাসুরমর্দিনী ও শ্যামাকালি, যাঁরা কিনা বিভিন্ন নামে পূজিতা হন। সেই রকমই একটি দেবী হলেন ডুমুরেশ্বরী মাতা ও মহিষমর্দিনী মাতা, যাঁরা নবদ্বীপে নবদ্বীপে ৭০০ বছরের অধিক সময় ধরে পূজিতা।
● দুর্গার বাহন সম্পর্কে কিছু ভ্রান্তি ও সত্যতা অনুসন্ধান:
এবার আসি দেবীর বহন প্রসঙ্গে। কংসনারায়ণ যখন মাটি দিয়ে মূর্তি গড়ে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তখন বাংলার মৃৎশিল্পীদের মধ্যে সিংহ বলে কোনো পশুর ধারণাই ছিল না। বাংলার মৃৎশিল্পীরা কস্মিনকালেও সিংহ দেখেননি। মহিষাসুরমর্দিনীর বাহন রূপে সিংহের আবির্ভাব একেবারে আধুনিক কালে মানে একশো থেকে দেড়শো বছরের মধ্যে।
তাহলে দেবীর বহন কি ছিল?
বাংলার প্রাচীন মূর্তি গুলো খেয়াল করলে দেখা যায় যে, দেবীর বাহন ছিলো ড্রাগন জাতীয় পশুর মুখ ওয়ালা ঘোড়া সাদৃশ্য একটি পশু। যাকে গোধা বলা হয়। আসলে পশুটির মুখবায়বের গো-সাপের ও দেহ ঘোড়ার।
বাস্তবে মহিষাসুরমর্দিনী প্রাচীন শস্যের দেবী। যাঁর আরাধনা বঙ্গভূমিতে ৪০০০ বছর ধরে হয়ে আসছে, সেই অস্ট্রিকদের সময় থেকে। বাঙালি সংস্কৃতির একটি বড় অংশ দখল করে রয়েছে অস্ট্রিকরা। কৃষি প্রধান বাঙালি জীবন ওই অস্ট্রিকদের থেকেই পাওয়া। অস্ট্রিকরা প্রকৃতি শক্তির আরাধনা করতেন। গাছ, শস্য, নুড়ি, শীলা ইত্যাদির আরাধনা হত কিন্তু মনুষ্য বা পশু সাদৃশ্য মূর্তির পূজা করতেন না। নগর সভ্যতা ও স্থাপত্য, মূর্তি নির্মাণ এইসবই আদি দ্রাবিড়দের থেকে পাওয়া। অস্ট্রিকদের শস্যের দেবী কালক্রমে দ্রাবিড় প্রভাবে মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠেন। লক্ষণীয়, এখনও দুর্গোৎসবে নবপত্রিকা (কলাবউ) আবশ্যিক। অস্ট্রিকরা এই নয়টি শষ্যকেই দেবীরূপে আরাধনা করতেন। আর দেবীর বাহন ছিল গো-সাপ। যাকে কিনা কৃষিকাজের উপকারী জীব হিসেবে ধরা হত। দ্রাবিড়রা নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তোলার পর, যুদ্ধ বিগ্রহ ও রাজা, রাজত্বের ব্যাপার চলে আসে। রাজার রাজকীয়তা ও যুদ্ধবিগ্রহে সঙ্গী হলো ঘোড়া। যুদ্ধের দেবী ও শস্যের দেবী মিশে আজকের মহিষাসুরমর্দিনী। আর তাঁর বাহন গোঘোটক বা গোধাও উভয় সংস্কৃতির মিশ্রণ তৈরি। যা তৈরি হয়েছিলো খ্রিস্টপূর্বে। আজও বনেদি বাড়ি গুলো সেই ধারা বহন করে আসছে।
ভারতবর্ষে এখন সিংহ গুজরাতের গির অভয়ারণ্যের বাইরে দেখা না গেলেও, উনিশ শতকেও রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, এমনকী ঝাড়খণ্ডের পলামৌ অঞ্চলে সিংহ পাওয়া যেত। কিন্তু প্রাচীন কালে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে (যার মধ্যে আছে গুজরাতের ধোলাবিরা, লোথাল ও রাজস্থানের বেশ ক’টি জনপদ) কোথাও সিংহের উপস্থিতির প্রমাণ নেই। অসংখ্য সিলমোহরে নানা জীবজন্তুর প্রতিকৃতি দেখা গেলেও সিংহ অনুপস্থিত। দিব্যভানু সিংহ তাঁর ‘দি স্টোরি অব এশিয়া’জ লায়ন্স’-এ লিখেছেন, পশ্চিম এশিয়া থেকে ইরান হয়ে পূর্ব-মধ্য ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত তৃণারণ্যে যে সিংহ ছিল, আফ্রিকার তিনটি প্রজাতির সঙ্গে তার অনেক অমিল। আবহাওয়ার পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে পশ্চিম এশিয়া, ইরাক, ইরান ও সিন্ধু নদীর পশ্চিম অঞ্চল থেকে ক্রমশ তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ‘ইগজোটিক এলিয়েন্স: দি লায়ন অ্যান্ড দি চিতা ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে রোমিলা থাপার প্রায় একই উপাদানের বিচার করে সিংহ আদপেই এ দেশের নয়, সুদূর অতীতে পশ্চিম এশিয়া, ইরান থেকে সিংহকে এ দেশে আনা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন। আবার ঋগ্বেদে সিংহের, সিংহনাদের উল্লেখ আছে, বাঘের উল্লেখ নেই। অথর্ববেদে বাঘ, সিংহ দুই-ই আছে। তবে কি ঋগ্বেদের রচনাস্থল এমন কোথাও যেখানে সিংহ আছে কিন্তু বাঘ নেই?
মৌর্য শিল্পকলায় সিংহের উপস্থিতি নজরকাড়া। সম্রাট অশোকের স্থাপিত স্তম্ভশীর্ষে সিংহ দেখা যায়, রাজশক্তির প্রতীক সে। ব্যাকট্রিয়ান, ইন্দো-গ্রিক, পশ্চিম ক্ষত্রপ ও গুপ্ত যুগের ও পরবর্তী কালের মুদ্রায়, ভারহুত, সাঁচি, পশ্চিম ভারতের গুহায়, স্তম্ভশীর্ষে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সুলতানি আমলে ও মুঘল দরবারের ছবিতে সিংহের ছড়াছড়ি, যদিও সম্রাট ছাড়া অন্য কারও সিংহ শিকারে অনুমতিও ছিল না।
দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহ তাই শৌর্য-বীর্যের প্রতীক। তাঁর বাহন সিংহ এসেছিল পিতা হিমালয়ের কাছ থেকে, অথচ হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, উত্তর ভারতের কোনও কোনও জায়গায় দেবীর বাহন সিংহ নয়, বাঘ। আমাদের এখানে মহামায়া সিংহারূঢ়া হয়েই আসেন, কখনও সে থাকে শান্ত হয়ে। এখানে তো যুদ্ধ নয়, আনন্দের, শান্তির, উৎসবের বাতাবরণ।
● পালযুগে ধাতুশিল্পে মহিষমর্দিনী:
বর্তমানের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঢাকা শহরটি ঢাকার ঈশ্বরী (ঢাকেশ্বরীর) নামে নামাঙ্কিত। পুরোনো ঢাকার কেন্দ্রস্থলে যে ঢাকেশ্বরীর মন্দির রয়েছে সেটি বল্লাল সেনের প্রতিষ্ঠা করা। বল্লাল সেন ঢাকা ভ্রমণ কালে মাটিতে গাছের পাতায় ঢাকা অবস্থায় সপরিবারে মহিষাসুরমর্দিনী একটি মূর্তি খুঁজে পান। এই মূর্তিটি অষ্টধাতুর নির্মিত যার স্থাপত্য শৈলী প্রমান করে সেটিও পাল আমলে নির্মিত। পাল আমলে যে বাংলার সর্বত্রই মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হত ঢাকেশ্বরী মাতা তার অনন্য নজির। কারণ পাল আমলে নির্মিত মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি গুলি বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল (গৌড়, রাঢ়, সমতট, বঙ্গ) থেকেই উদ্ধার হয়েছে। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতার কুমোরটুলিতে ঢাকেশ্বরীমাতার মন্দিরে রক্ষিত আছে।
● অকাল বোধন, প্রচলিত ধারণা ও সত্যতা:
এবার আসি রামের আকালবোধন প্রসঙ্গে। পূর্বেই বলেছি, রাম যে কখনই আকালবোধন (দুর্গাপূজা) করেননি তার যথাযথ প্রমান রয়েছে।
প্রথমেই যেটা বলা দরকার সেটা হলো বাল্মীকি রামায়ণে কোথাও আকালবোধন উল্লেখ নেই। অকালবোধন পুরোটাই কৃত্তিবাস বর্ণিত কাহিনী। সুতরাং রামই প্রথম দুর্গাপুজো করেছেন সেই দাবিও অসার। শ্রী শ্রী চণ্ডী থেকে জানা যাচ্ছে বাঙলার রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যই নদী তীরে মাটি দিয়ে প্রথম দুর্গাপূজা করেছেন।
কৃত্তিবাসের দেওয়া দুর্গাপূজার ফর্দতেও চরম অসঙ্গতি। বাংলার কবি কৃত্তিবাস রামের দেবীপুজোয় বাংলার হরেকরকম ফুলকে এনে হাজির করেছেন, আসলে যা হওয়ার কথা ছিল দক্ষিণ ভারতে।
বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায়, শরৎকালে দেবীপুজো করে রাবণবধের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ রাবণ বধের সময় রামের বয়স ছিল আটত্রিশ বছর দশ মাস। চৈত্রের শুক্লা নবমী তিথিতে যাঁর জন্ম, সেই রাম কি ভাবে কি করে শরৎকালে আটত্রিশ বছর দশ মাস পূর্ণ করবেন? এই থেকেই প্রমান হয় বাল্মীকি রাম কখনই দুর্গাপূজা করেননি, কারণ রাম রাবণ বধ করেছেন মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে।
তবে, শরৎকালে দুর্গাপূজাটা কৃত্তিবাসের মনগড়া নয়, রামের আকালবোধন ব্যাপারটাই শুধু মনগড়া ছিলো। কারণ, শরৎ কালে দুর্গাপূজা কংসনারায়ণও প্রথম করেন নি। তবে রাজা কংসনারায়ণ যে দুর্গাপূজা করেছিলেন সেটা শরৎকালেই ছিলো। কৃত্তিবাস শরতের পুজোর ধারণাটা সেখান থেকেই পেতে পারেন। এমন কি মল্লরাজারাও ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিষ্ণুপুরে মহিষমর্দিনীর মূর্তি ও মন্দির গড়ে শরৎকালে বাৎসরিক দেবীপুজো করে আসছেন।
● দুর্গা মূর্তির বিবর্তন:
একটি বিষয় খুব গুরুত্ত্বপূর্ণ সেটা হলো মূর্তির বিবর্তন। পূর্বেই উল্লেখ করেছি মাটির মূর্তিতে সপরিবারে দুর্গার আরাধনা নয়শো থেকে হাজার খ্রিস্টাব্দে মধ্যে সূচনা হয়েছিলো। কিন্তু পাল যুগে যে সকল মহিষাসুরমর্দিনীর মুর্তি পাওয়া সবই সন্তানসন্ততী ছাড়া অর্থাৎ লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ অনুপস্থিত। মূর্তিগুলিতে দেবী রয়েছেন তাঁর দুই সখী জয়া-বিজয়ার সাথে। কালক্রমে ওই জয়া-বিজয়াই লক্ষী-সরস্বতীতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু, বাংলার একচালার মূর্তি শিল্পে গণেশ-কার্তিকের আবির্ভাব বিষয়ে এখনও আলোকপাত করা যায় নি। মেধস মুনিও মহিষমর্দিনীর সাথে আরও দুই দেবী লক্ষী-সরস্বতী মতান্তরে জয়া-বিজয়ার আরাধনা অর্থাৎ ত্রিদেবীর আরাধনাকেই দুর্গোৎসব বলে উল্লেখ করেছেন। নবদ্বীপ রাস উৎসব এখনও সেই প্রাচীন ধারাটাকেই বহন করে চলেছে। নবদ্বীপের রাস উৎসবের এখন যে সকল মহিষাসুরমর্দিনীর আরাধনা হয় সেসকল স্থানেই গণেশ ও কার্ত্তিক অনুপস্থিত। গবেষকদের মতে, আধুনিক কালে, বাংলার লোকসংস্কৃতি ও লোকায়ত গল্পগুলি (যেমন- হরপার্বতী, উমাগিরিনন্দিনী) প্রাচীন মহিষমর্দিনী দেবীর উপর প্রভাব ফেলেছিল। কিংবা, উত্তরভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে বাংলার মহিষাসুরমর্দিনী কালক্রমে উমা, পার্বতী, গিরিনন্দিনী ও গণেশজননীতে রূপান্তরিত হন এবং ওই সব লোকায়ত গল্পকে আশ্রয় করে আধুনিক যুগে গণেশ ও কার্ত্তিক ক্রমশ দেবীর সাথে একই কাঠামোয় জায়গা করে নিতে থাকে।
● অনার্য ও অস্ট্রিক প্রভাব:
বাংলার মৃৎশিল্পে প্রতিমার চালচিত্র একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ জায়গা নিয়েছে। শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে প্রতিমা শিল্পে ডাকের সাজ (শোলার) ব্যবহার কিন্তু একেবারে আধুনিক যুগে (ব্রিটিশ আমলে)। বাঙালি প্রতিমার সাজপোশাক তৈরিতে শোলার ব্যবহার জানতো না। ইউরোপ থেকে ডাকের মাধ্যমে এই সাজ আসত, সেই থেকেই শোলার সাজের এমন নাম। কিন্তু প্রতিমার চালচিত্র বাঙালির সংস্কৃতির জীবনের এক অন্য ইতিহাসের নিদর্শন। অস্ট্রিক প্রভাবিত বাঙালি ধর্মীয় জীবনে আলপনা ও চিত্রের খুব প্রাধান্য ছিল। তাই পূর্বে বাঙালির বাৎসরিক পূজাপার্বনগুলিতে পটপুজোর প্রচলন ছিল। কিন্তু, রাজা কংসনারায়ণের আমল থেকে মাটির মূর্তিতে পূজার প্রচলন শুরু হলে পটের গুরুত্ত্ব ক্রমশ কমতে থাকে। কালক্রমে পট বিবর্তিত হয়ে চালচিত্র রূপে দেবী প্রতিমার পেছনে স্থান করে নেয়। দেবী প্রতিমার পেছনের এই পটচিত্র ও আল্পনা আরও একবার প্রমান করে দুর্গোৎসব একটি পূর্ন অনার্য উৎসব। অর্যাবর্তের সংস্কৃতির সাথে তার দূরত্ব অনেক।
● দুর্গাপুজো সম্পর্কে ভ্রান্ত আর্য-অনার্য তত্ব ও আবহমান কালের প্রচলিত মিথ্যাচার সম্পর্কে কয়েকটি কথা:
বাংলায় মৃৎশিল্পে সর্বাধিক প্রভাব রয়েছে কংসনারায়ণ ঘরানায়। পূর্বেই বলেছি এই ধরনের ঘরানার মৃৎশিল্পের প্রতিমা এখন শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতেই দেখা মেলে। কিন্তু কেমন ছিল এই ৯০০ খ্রিস্টাব্দেরর সেই কংসনারায়ণ ঘরানা?
আদি বাংলার মৃৎশিল্পে প্রতিমার মুখ হতো ত্রিকোণকার, দুই গালচাপা। কিছুটা চুয়াড় দেশের পুতুলের মত। পাতলা ঠোঁট, উন্নত চিবুক, ঘন কালো ছড়ানো দুই ভুরুতে বঙ্কিম টান, রুদ্রানীর ভুরু যুগল কান স্পর্শ করেছে। হটাৎ দেখলে মনে হয় দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের ‘টুসু’র প্রতিরূপ কিংবা ‘ছৌ’।
এবার আসি চুয়াড় দেশের কথায়। আদি বাঙলার যে অংশটি ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের একেবারে পশ্চিম অংশই হলো লাল মাটির চুয়াড় দেশ। বাংলার এই অংশের মানুষের হলেন মূলনিবাসী বাঙালি, যাঁদের সংস্কৃতি সম্পুর্ন অনার্য অস্ট্রিক প্রভাবিত। বিশুদ্ধ বাংলার মূর্তির আদলটা এখন ওই দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার আদিবাসীদের (মূলনিবাসী বাঙালি) টুসু এবং ছৌ এর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। টুসু আরণ্যক বাঙলার প্রাণের দেবী। ঝাড়খন্ডি মূলনিবাসী বাঙালি (আদিবাসী) তাঁদের সাথে অসুর-যোগের ভ্রান্ত ধারণা সম্পুর্ন খণ্ডন করে জানান ‘মহিষমর্দিনী’ দুর্গা তাঁদেরই লৌকিক দেবী। কারণ তাঁদের শারদোৎসব শুরু হয় শরৎ শুরুর সাথে সাথেই। তাঁরা দাবি করেন, নয়’শ শতকে রাঢ় বাঙলার একদল চুয়াড় শিল্পীই নাকি পূর্ব বাংলার কংসনারায়ণের গৃহঙ্গনে দুর্গাপ্রতিমা গড়েছিলো আরণ্যক বাঙলার ‘টুসু’ ও ‘ছৌ’ এর আদলে। তবে তাঁদের এই দাবি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য প্রাচীনকাল থেকেই অনার্য অস্ট্রিক মানুষের কাঁধে কাঁধেই বয়ে আসছে।
(তথ্যসূত্র:
১- দুর্গোৎসবের উৎস সন্ধানে, অব্জ কেশব কর, দে’জ পাবলিশিং।
২- বাল্মীকি রামায়ণ, রাজশেখর বসু, নবযুগ প্রকাশনী (২০১৬)।
৩- গদ্যে বাল্মীকি রামায়ণ, জ্যোতিভূষণ চাকী, দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড (২০১৪)।
৪- রামায়ণম, শ্রীমন্মহর্ষি বাল্মীকি, বেণীমাধব শীল’স লাইব্রেরী (সর্বশেষ সংস্করণ) (২০১৯)।
৫- বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
৬- কৃত্তিবাস বিরচিত সচিত্র সপ্তকাণ্ড রামায়ণ, কৃত্তিবাস ওঝা, দে’জ পাবলিশিং (২০০০)।
৭- ইতিহাসের আলোকে রামায়ণ, সূধাময় দাস, দিব্য প্রকাশ (২০০৫)।
৮- কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও বাংলার লোকঐতিহ্য, তনিমা চক্রবর্তী, পুস্তক বিপণি (২০১১)।
৯- অধ্যাত্ম রামায়ণ: মূল সংস্কৃত থেকে শ্লোকানুযায়ী বঙ্গানুবাদ, শ্রীব্যাসদেব, ভারতী বুক স্টল (২০১১)।
১০- মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড (২০১০)।
১১- বাংলায় পটের দুর্গা, দীপঙ্কর ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৫)।
১২- দুর্গা রূপে রূপান্তরে, পূর্বা সেনগুপ্ত,মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১৬)।
১৩- দুর্গা পূজা পদ্ধতি, নন্দী কেশ্বর পুরাণোক্ত, বুক চয়েস (২০০৮)।
১৪- কালী পূজা ও কিছু কথা, সনজিৎ ঘোষ, অর্পিতা প্রকাশনী (২০০৬)।
১৫- ২২শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে বর্তমান পত্রিকায় ‘শীতেই শুরু হয় বনেদি বাড়ির পুজোর প্রস্তুতি’ শিরোনামের প্রবন্ধ।
১৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল।
১৭- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা অক্টোবর ২০০৭ সাল।
১৮- দুর্গাপূজা ও কিছু কথা, সনজিৎ ঘোষ, অর্পিতা প্রকাশনী (২০১৬)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত