এনআরসির নামে স্রেফ দলীয় আধিপত্য বিস্তার করার যে ঘৃণ্য রাজনীতি বিজেপি শুরু করেছে তা এই মুহূর্তে দেশের মানুষের সামনে সবচাইতে বড় বিপদ। কোন দল নয়, সম্প্রদায় নয়, ধর্ম নয়, বর্ণ নয় – এর বিরুদ্ধে সব মানুষ এক না হলে এই অপচেষ্টাকে রোখা যাবেনা। এটা বিজেপির বহু পুরনো খেলা, বিশেষ করে আসাম, দার্জিলিং সহ উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলিতে হিন্দি আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা এই রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার নামে এই ঘৃণ্য খেলাকে সরকারি উদ্যোগে পরিণত করেছে বিজেপি।
অন্যায়ভাবে মানুষকে দেশছাড়া করার রাজনীতিকে রুখতে এখন কে কোন দলের লোক তা আমাদের ভুলে যেতে হবে। এখন সেসব দেখার সময় নয়। এনআরসি রুখতে হবে, রুখতে হবে মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে তোলার রাজনীতি। যারা এর শিকার হলেন কিংবা হতে চলেছেন সেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের। দীর্ঘদিন এদেশে বাস করা মানুষদের নাগরিকত্বের অধিকার নাকচ করার কুৎসিত রাজনীতিকে না রুখতে পারলে ভারত নামক ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।
বলা হচ্ছে প্রকৃত নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়ার জন্য সরকার নির্ধারিত উপযুক্ত প্রমাণপত্র দিতে হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষের তথ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। চাওয়া মাত্র বার্থ সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র অনেকেই পেশ করে উঠতে পারবেন না। সরকারের তরফ থেকেও এগুলি ঠিকমত দেওয়া এবং নিয়মিত নবীকরণ করার ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। গুরুত্ব বোঝেন না বলে অনেকে নিতেও যান না। অনেকে জন্মেছেন হাসপাতালে নয়, বাড়ির আঁতুড়ঘরে। আমরা তিন ভাই বর্ধমানে গ্রামের বাড়িতেই জন্মেছিলাম। এই ধরণের প্রসবগুলিতে বার্থ সার্টিফিকেটের কোন ব্যাপারই নেই। এখনও দেশের বহু জায়গায় দাইমা প্রসব করান। অনেক লোক শিক্ষার সুযোগ পান নি, অনেকেই অসংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরি করেন তাই সেখানকার প্রমাণপত্র তারা দেখাতে পারবেন না। নাগরিকত্বের তথাকথিত প্রমাণপত্রহীন, এমনকি এসব কাগজের গুরুত্ব না বোঝা মানুষগুলোকে স্রেফ বিরোধী ভোট কমানোর জন্য দেশছাড়া করার রাজনীতি যারা করেন তাদের রাজনীতিবিদ বলা তো দূরের কথা, মানুষ বলাও উচিৎ নয়। এই রাজনীতিবিদদেরই চক্রান্তে আসামে ১৯ লাখ মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়েছে।
আরেকটা কথা এখানে বলে রাখা ভাল, আমরা ভারতীয়রা কাগজপত্র, দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষণের চাইতে নিজেদের পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত জিনিসগুলি বেশি যত্নে রাখি। ঠাকুরদার হুঁকো, ঠাকুমার তৈরি কাঁথা, পুরনো বাসনকোসন বুকে আগলে রাখলেও প্রয়োজনীয় নথিপত্র সংরক্ষণ করতে ভুলে যাই। নিঃসন্দেহে এটা একটা বদভ্যাস, এই অভ্যাস বদলাতে হবে। কিন্তু রাতারাতি কাউকে এই জিনিসগুলি হাজির করতে বললে এবং তা না করতে পারলে একজন ভূমিপুত্রকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মত বড় অন্যায় আর কিছু নেই।
এনআরসির বিরুদ্ধে লড়াই তাই অসহায় মানুষকে বাঁচানোর লড়াই। এটা একটা সামগ্রিক ব্যাপার, একটা অখণ্ড বিষয়। কাগজে দেখলাম কংগ্রেস, সিপিএম বলেছে পুজোর পর তারা আন্দোলন করবে। এ আন্দোলনে তারা অন্যদের ডাকেনি। দেশের এই সঙ্কটে তাদের রাজ্যসরকার বিরোধী দলীয় রাজনীতি বড় হয়ে উঠেছে। বিজেপির দু কোটি বাংলাদেশি তাড়ানোর হুমকি যদি সফল হয়, তাহলে তাদের আর কোন আন্দোলন করার লোক থাকবে না। বিপদ এখন ঘাড়ের কাছে। বাংলায় এনআরসির কাজ শুরু হওয়ার আগেই তা রুখতে হবে। অমুক দল থাকলে আমি যাব না, তমুক ডাক দিলে আমি মানবো না এই জাতীয় বিভেদপন্থার কোন পরিসর এখন নেই। সরকার বিরোধী দলগুলি এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই তাদের দলের মঙ্গল। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই এ বিষয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। খোলাখুলি ঘোষণা করেছেন এ রাজ্যে এনআরসি করতে দেবেন না, তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
সাংবাদিকদের এব্যাপারে একটা বিরাট ভূমিকা আছে। তাদের কলম এবং ক্যামেরা এই চক্রান্তের স্বরূপ উন্মোচন করুক। প্রতিবাদে গর্জে উঠুন তারা, না উঠলে তারা নিজেরাও এই চক্রান্তের শিকার হতে পারেন। কারণ এই পরিকল্পিত চক্রান্তটি আদতে বিজেপি যাদের নিজেদের ভোটার বলে মনে করে না এমন সব মানুষের বিরুদ্ধে। ভূমিকা রয়েছে রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদেরও। দেশভাগ, ছিন্নমূল মানুষের দুর্দশা তাদের কলমে বারবার জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। এখন তারা নীরব কেন? তারা কী সরকারি দাক্ষিণ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় করছেন? পুরষ্কার, স্বীকৃতি, সরকারি দায়িত্ব না পাওয়ার ভয়ে নীরবতা পালন করছেন? এই নীরবতা বড়ই বেদনাদায়ক! জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার নামে আবার বঙ্গভঙ্গের চক্রান্ত রুখতে তাদের একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। দেশহীন মানুষের দুর্দশা তাদের থেকে ভাল আর কে তুলে ধরতে পারবে? প্রতিবেদন, ছবি, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, চলচ্চিত্র সব মিলিয়ে তৈরি হোক মানুষকে দেশছাড়া করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রাচীর।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত