সময়টা বৈশাখ মাস। কিন্তু সেই প্রবল গরমে কলকাতার স্পেনশাস হোটেলের একটি ঘরে ঠকঠক করে কাঁপছেন ইংরেজ জজসাহেব। কাঁপছেন ভয়ে। তাঁর কাছে খবর এসেছে পাওনাদারেরা তাঁকে জেলে দেবার বন্দোবস্ত করেছে। ঘটনা হল জজসাহেব অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন ছুটি নিয়ে দেশে (অর্থাৎ বিলাতে) ফিরে যাবার আয়োজন করছেন। কিন্তু তিনি যে ফিরে আসবেন এই কথায় ভরসা রাখতে না পেরে পাওনাদারেরা তাঁর বিলেত যাওয়া বন্ধ করে তাঁকে ১ নং চৌরঙ্গিতে বন্দি করে রাখতে বাধ্য করবে—সেই চেষ্টা চলছে। পাওনাদারদের কাছে তাঁর ধারের পরিমাণ এক লক্ষ টাকা। এই বিপজ্জনক অবস্থায় একজনের কথা সাহেবের মনে পড়ল। যদিও তাঁকে জজসাহেব চেনেন না—তবু নাম শুনেছেন, বিপদে পড়ে তাঁর শরণাপন্ন হলে তিনি সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেন। জজসাহেব তাঁর শরণাপন্ন হয়ে সমস্ত বৃত্তান্ত জানিয়ে তাঁকে চিঠি লিখলেন। আর অপ্রত্যাশিত ভাবে ক’দিনের মধ্যেই উত্তর এসে গেল। জজসাহেবের উত্তমর্ণদের এক লক্ষ টাকা পরিশোধ করে তাঁদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতির দলিলপত্র ফিরিয়ে নিয়েছেন তিনি। সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে জজসাহেবের সঙ্গে দেখা করে দলিলপত্রগুলি তাঁর হাতে তুলে দিলেন এবং বললেন জজসাহেব এখন নিশ্চিন্তে বিলাতে যাত্রা করতে পারেন।
কৃতজ্ঞতায় জজসাহের কেঁদে ফেললেন। জজসাহেব কিন্তু আবার ভারতবর্ষে ফিরে এসেছিলেন এবং তাঁর ঋণ শোধ করেছিলেন। ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন উপযুক্ত সময় আসে, তখন আবির্ভাব হয় ঐতিহাসিক ব্যক্তির। মনুষ্য-জাতির কল্যাণের জন্য ভগবৎ প্রেরিত দূত হিসেবে এঁরা আসেন। সেই ভগবৎ প্রেরিত দূত ছিলেন দ্বারকানাথ। দ্বারকানাথকে সাধারণ মানুষ চেনেন রবীন্দ্রনাথের পিতামহ হিসাবে অথবা ধনী অভিজাত এবং বিলাসী ‘প্রিপ্স’ হিসেবে। কিন্তু তাঁর জীবন খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে যে তিনি কত বড় প্রেমিক, কতটা দরিদ্রের বন্ধু।
দ্বারকানাথ জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৪ সালে। পিতা রামমণি ঠাকুর। শুধু ভাষা শেখা নয়, শুধু সাহিত্য চর্চাও নয় যাকে বলে আধুনিকমনস্ক হয়ে ওঠা শিক্ষক শেরবোর্ন সে ভাবেই তাঁকে রপ্ত করে তুললেন। শেরবোর্নের প্রতি দ্বারকানাথ এত শ্রদ্ধাসম্পন্ন ছিলেন, সে যতকাল তিনি বেঁচে ছিলেন, শিক্ষক শেরবোর্নকে পেনশন দিয়ে গিয়েছিলেন। অত্যাশ্চর্য একটি বৈপরীত্য দ্বারকানাথের মধ্যে। একদিকে ঐশ্বর্য এবং তীব্র মর্যাদা বোধ। মানুষের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য চূড়ান্ত বিলাসিতা, চূড়ান্ত অর্থব্যয়, অন্য দিকে তাঁর চিত্তলোক প্রসারিত—সেখানে মানুষের প্রতি গভীর ভালবাসা ও অতুলনীয় সহানুভূতি।
ভল্টেয়ার-এর একটা উক্তি—মানুষ তার প্রতিভার দ্বারা জীবনে যতটা উন্নতি করতে পারে, তার চেয়ে বেশি পারে চরিত্রের দৃঢ়তার দ্বারা- দ্বারকানাথ যেন এই উক্তির মূর্ত বিগ্রহ। পিতৃব্য রামলোচনের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে যে সব সম্পত্তি তাঁর হাতে আসে তার মধ্যে একটি হল পাবনা জেলার অন্তর্গত বিরাহিমপুরের জমিদারি। জমিদারি পরিচালনায় তিনি তুখোড় হয়ে ওঠেন। ব্যবসা শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি জমিদারি কিনে ফেললেন রাজসাহিতে কালীগ্রাম, পাবনায় শাহজাদপুর, রংপুর-এর স্বরূপপুর। যশোরে মহম্মদশাহী, কটকে শেরগড় এবং আরও কয়েকটি।
একটা প্রবাদ আছে ‘দুঃসাহস না করলে লাভ করা যায় না’ এটাই হয়ে উঠল দ্বারকানাথের মোটিভ। বলতে গেলে ‘বাণিজ্যেতে যাবই’ বাণিজ্যে লক্ষ্মীর অকৃপণ দাক্ষিণ্য তাঁর উপর ঝরে পড়েছিল। কিন্তু উপার্জন করেও তিনি কখনও ইন্দ্রিয় সম্ভোগে মত্ত হননি। বিলাসিতা দেখিয়েছেন, কিন্তু তারও একটা উদ্দ্যেশ্য ছিল ‘আমাকে সবার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। আবার মানুষের প্রতি ছিল তাঁর সীমাহীন করুণা ও সহানুভূতি। ১৮৩৫ খ্রিঃ ১লা জুন মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই দ্বারকানাথের সাহায্যের হাত এর প্রতি প্রসারিত ছিল। তখনকার দিনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনে ‘মর্গে’ বা শবব্যবচ্ছেদাগারে যাওয়ার ব্যাপারে এত আপত্তি ছিল যে সন্তানকে ডাক্তারি পড়তে দিতে তাঁরা সংকুচিত হতেন। সেই সময়ে মানুষের মনে এই সব কুসংস্কার দূর করবার জন্য দ্বারকানাথ প্রায় প্রতিদিন শবব্যবচ্ছেদাগারে উপস্থিত থাকতেন।
ঠাকুরদাদা নীলমণির মতো দ্বারকানাথ প্রথম জীবনে ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। পূজা হোম এ সব করতে ভালবাসতেন। কিন্তু রামমোহন রায়ের সংস্পর্শে এসে তাঁর মানবিকতার পরিবর্তন হল। ধ্যান ও উপাসনার মধ্য দিয়ে পূজা করতে লাগলেন তিনি। রামমোহন রায়ের প্রতি দ্বারকানাথের গভীর শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস ছিল। রামমোহনের প্রতিটি সমাজসংস্কারমূলক কাজে সক্রিয় ভাবে যোগ গিয়েছেন তিনি। তখনকার দিনে সমাজের প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সতীদাহ প্রথা নিবারণে রামমোহনের পাশে দাঁড়ালেন তিনি। রামমোহন ও দ্বারকানাথের যুগ্ম আবেদন এতই মর্মস্পর্শী হয়েছিল যে উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কেঁদে ফেলেছিলেন। তখন সতীদাহ প্রথা দূর করার জন্য আইন প্রণয়ন করা হল। প্রত্যেক সভ্য মানুষের মনে আজও এই স্মৃতি অম্লান।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দ্বারকানাথের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথাও মনে রাখতে হবে। বেঙ্গল হরকরা, জন বুল, ক্যালকাটা ক্যুরিয়র ইত্যাদি ইত্যাদি নানা ভাবে নানা পত্রিকা তখনকার দিনে প্রকাশিত হতে লাগল। এই সব পত্রিকার প্রসারের জন্য তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা, কারণ দ্বারকানাথ এটা বিশ্বাস করতেন যে দেশের উন্নতির জন্য সংবাদপত্রের বিকাশ প্রয়োজন এবং সংবাদপত্রের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতাও প্রয়োজন। সাংবাদপত্রের স্বাধীনতা যখন বাস্তবে রূপায়িত হল, তখন দ্বারকানাথ বললেন, ‘মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার পথে যে সমস্ত বাধা নিষেধ ছিল, সেগুলো দূর করার জন্য সব সময়ই আমি আগ্রহান্বিত—তাই মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমি অংশ নিয়েছি।’
দ্বারকানাথকে বলা হয় রাজভক্ত। সেটা সত্যি। কিন্তু তার পিছনে তখনকার দিনের সমাজ। দেশের মুক্তির জন্য প্রগতির জন্য এই সময়ে ইংরেজদের শাসন ব্যবস্থা প্রয়োজন এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। আবার যখন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হল, তখন তিনি ইংরেজদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলেন অকুণ্ঠ ও দৃঢ়ভাবে।
তাই বলে দ্বারকানাথের চরিত্র ত্রুটিমুক্ত নয়। নীল চাষ সমর্থন (দ্বারকানাথ নিজেই কিছুকাল নীল চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন), চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমর্থন—এগুলি যেমন তাঁর চরিত্রের ত্রুটি, তেমনই ব্যক্তি জীবনের উচ্চাশা, আড়ম্বর প্রিয়তা, অত্যন্ত বিলাসপ্রিয় জীবন, ‘সোসাইটি’র একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হয়ে ওঠার বাসনা এগুলোও তাঁর চরিত্রে অন্যতম ত্রুটি। তা সত্ত্বেও সমাজ বা ব্যক্তি মানুষের উন্নতি কামনায় যাঁরা ব্রতী ছিলেন, সেই সমস্ত মহৎ ব্যক্তিদের তালিকায় দ্বারকানাথকে একটি বিশিষ্ট স্থান দিতেই হবে। এ কথা বোঝা দরকার যে, যে সমস্ত প্রগতির চিহ্ন আজ আমাদের চারপাশে ছড়ানো দ্বারকানাথও ছিলেন তার পথিকৃৎ।
১৮২২ সালে কলকাতায় প্রবাসী ব্রিটিশদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। স্বদেশে তাঁদের যা যা ছিল, তাঁরা সেগুলো এই কলকাতাতেও চাইছিলেন। চাইছিলেন ইংরেজি খবরের কাগজ, থিয়েটার হল। সাহেবদের এই প্রয়োজনগুলোকে কেন্দ্র করে যে বিপুল এক বাজারের সম্ভাবনা আছে, দ্বারকানাথ তা বুঝতে পেরেছিলেন।
এই দ্বারকানাথকেই ১৮২৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ‘বোর্ড অব কাস্টমস, সল্ট অ্যান্ড ওপিয়াম’-এর দেওয়ান নিযুক্ত করল। পরের বছর, ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’। প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংক, যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা অন্য কোনও বাণিজ্যিক সংস্থার অধীন ছিল না। পরে এই ব্যাংকের অন্যতম ডিরেক্টরও হয়েছিলেন। জাহাজের ব্যবসাসহ বাংলায় নতুন গড়ে ওঠা ব্যবসায়িক প্রচেষ্টায় দ্বারকানাথের ব্যাংক ঋণ দিয়ে সাহায্য করত। ব্যবসা ছড়ালেন পত্রপত্রিকার জগতেও। ১৮৩০-এর মধ্যেই দ্বারকানাথ তখনকার শ্রেষ্ঠ সংবাদপত্রগুলোর (যার মধ্যে ছিল ‘বেঙ্গল হেরাল্ড’, ‘দি ইংলিশম্যান’, ‘বঙ্গদূত’ এর মতো কাগজ) ব্যবসায়িক অংশীদার হলেন।
তার চার বছর পর, ১৮৩৪ সালে তৈরি হল ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’। ব্রিটিশ পার্টনারদের সঙ্গে যৌথ অংশদারিত্বে কোনও সংস্থার নির্মাণ সেই প্রথম। এর আগে ব্রিটিশরা পার্সিদের বিজনেস পার্টনার করেছে, কিন্তু বাঙালিদের এই প্রথম। সে দিক থেকেও এই সংস্থা ছিল ব্যতিক্রম। তখন নীলচাষের যুগ, নীলই ছিল এই সংস্থার প্রধান পণ্য। নীল ব্যবসায় সংস্থার বিশাল লাভ হয়েছিল, কারণ ইউরোপের ফ্যাশনদুরস্ত সমাজে নীল ছিল জনপ্রিয় রং। ক্রমে ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ হয়ে ওঠে নীল-ব্যবসার মুখ। দ্বারকানাথের ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল, ব্রিটিশরা তাঁকে চিনে আফিম সরবরাহের জন্য জাহাজ নিয়ে যাওয়ারও অনুমতি দিল। এই অনুমতিও ব্যতিক্রমী, কেননা ব্রিটিশরা এত দিন আফিম আর চায়ের ব্যবসা রেখেছিল নিজেদের হাতেই। শুল্ক, নুন, চা, কয়লা, জাহাজ, নীল, আখ, আফিম— কীসের না ব্যবসা ছিল দ্বারকানাথের! ১৮৪০-এর মধ্যেই দ্বারকানাথের বাণিজ্য-সাম্রাজ্য অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, আর ব্যবসার বিপুল মুনাফা তিনি ব্যয় করেন ভূসম্পত্তি কেনায়। ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে, রানিগঞ্জে খনি থেকে কয়লা তোলানোর কাজ শুরু করেন তিনি। তৈরি করেছিলেন ‘স্টিম টাগ অ্যাসোসিয়েশন’, ভারতের নদীগুলো দিয়ে ‘স্টিম নেভিগেশন’-এর প্রচলনও তাঁর হাতেই। কলকাতার খিদিরপুরে ডক বানিয়েছিলেন জাহাজ মেরামতের জন্য। তিনিই ছিলেন প্রথম ভারতীয়, যিনি এই সমস্ত কাজে এগিয়ে এসেছিলেন।
ছিলেন সমাজ সংস্কারেও। সতীদাহ প্রথা রদের ব্যাপারে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন খোদ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক। দ্বারকানাথ ছিলেন রাজা রামমোহনের রায়ের বন্ধু ও তাঁর সংস্কার আন্দোলনের সমর্থক। হিন্দু স্কুল, জেলা দাতব্য হাসপাতাল, ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি-র মতো প্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থদান করেছিলেন তিনি।
তাঁর সমাজ-সংস্কারে উৎসাহ ইউরোপ-সফরেও বিদ্যমান ছিল। লন্ডনের এলিট সমাজে ওঠাবসা যেমন করতেন, তেমনই তৎকালীন ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীদের কথাও সমান আগ্রহে শুনতেন। লন্ডনে দেখা করেছিলেন দাসপ্রথার প্রবল বিরোধী, বাগ্মী জর্জ টমসনের সঙ্গে। ইংল্যান্ড থেকে আয়ারল্যান্ড গেলেন, সেখানে তখন ভয়ংকর খরা আর দুর্ভিক্ষ চলছে। সেখানে দেখা করেছিলেন বিখ্যাত আইরিশ ক্যাথলিক নেতা ড্যানিয়েল ও’কনেল-এর সঙ্গে। প্যারিসে তিনি রাজা লুই ফিলিপের সম্মাননীয় অতিথি, আবার লন্ডনে ‘বোনাপার্টিস্ট’ গোষ্ঠীর সদস্যদেরও বন্ধু।
১৮৩৩ সালে ব্রিস্টলের কাছে স্টেপলটনে রাজা রামমোহন রায় মারা যাওয়ার পর দ্বারকানাথই বন্ধুর স্মৃতিতে সমাধিসৌধ তৈরি করে দেন। তারও দশ বছর পর, রামমোহনের দেহ তুলে এনে ফের সমাধিস্থ করলেন ব্রিস্টলের আর্নস ভেল সমাধিক্ষেত্রে। উইলিয়াম প্রিন্সেপ-এর বানানো বিখ্যাত সেই সমাধিসৌধের যাবতীয় খরচপত্র দিয়েছিলেন দ্বারকানাথই।
দুটো ঘটনায় তাঁর মনে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। প্রথমটি দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে। দ্বারকানাথ দেবেন্দ্রনাথকে প্রথম থেকেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে ব্রতী হলেন। এবং নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে একটি ছোট পদে নিযুক্ত করলেন। দেবেন্দ্রনাথের পারদর্শিতা সম্বন্ধে যখন তিনি নিশ্চিন্ত হলেন তখন তাকে একদিকে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর নিযুক্ত করলেন অপর দিকে কোম্পানির অন্যতম অংশীদার নিযুক্ত করলেন। কিন্তু হঠাৎ তখনই দেবেন্দ্রনাথের মনে চরম পরিবর্তন ঘটে গেল। শিল্প নয়, সংসার নয়, তাঁর মন গেল ঈশ্বরের চরণে। হতাশ দ্বারকানাথ খেদোক্তি করলেন ‘এখন সে ব্রহ্ম ব্রহ্ম করিয়া বিষয়কর্মে কিছুই মন দেয় না’ (সূত্র- আত্মজীবনী দেবেন্দ্রনাথ)।
দ্বারকনাথের জীবনে আর একটি মনস্তাপ স্ত্রী দিগম্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর মানসিকতার আকাশ পাতাল ব্যবধান। মুখশ্রী অতিসুন্দর। কথিত আছে, জগদ্ধাত্রীর মূর্তি নির্মাণের সময় তাঁর মুখটি দিগম্বরী দেবীর আদলে গড়া হত। পতিভক্তি, পতিসেবা এই-ই তাঁর জীবনের আদর্শ। কিন্তু তিনি রক্ষণশীল। দ্বারকানাথ যে ভাবে সমাজের উচ্চশ্রেণির সুপ্রতিষ্ঠিত হবার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, স্ত্রী কাছে তা ‘ম্লেছ’দের সঙ্গে মেলামেশা বলে মনে হতে লাগল। স্ত্রী হয়ে এটা তিনি কী করে মেনে নেন? আবার বিদেশিদের জন্য দ্বারকানাথ যে বিজাতীয় পানীয় ও নিষিদ্ধ মাংস গ্রহণ করছেন, নিষ্ঠাবতী হিন্দু নারী হয়ে দিগম্বরী সেটাই বা মেনে নেন কী করে? সুতরাং সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ততায় পৌঁছল। জীবনাদর্শে দুজনে দু’প্রান্তে। প্রবৃত্তির সঙ্গে কর্তব্যের এই সংঘর্ষ লাগল দিগম্বরীর মনে।
এর পরেই ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে দিগম্বরী সংসার থেকে চিরজন্মের জন্য বিদায় নিলেন। মৃত্যুশোকে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিলেন দ্বারকানাথ। যখন তিনি ফ্রান্স দর্শনে গিয়েছিলেন তখন তিনি সম্রাট লুই ফিলিপের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। একটি মজার ঘটনা—মহামান্য সম্রাট তাঁকে যে অভ্যর্থনা করেছেন এবং সম্মান দিয়েছেন, তাতে বিস্মিত বহু লোক পল্লি অঞ্চল থেকে তাঁকে দেখতে উৎসুক হল। রাজা যে অভিজাত ব্যক্তিটিকে এক সম্মান দেখাচ্ছে, তিনি কে? ফ্রান্সের বৈদেশিক দফতরের সেক্রেটারি মঁসিয়ে ফুরে বলে উঠলেন, ‘এই বিশিষ্ট আগন্তুকটি হলেন স্বার্গরাজ্যের রাজা’। এ কথা শুনে জনতা চিৎকার করে উঠল ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’
১৮৪২ সালের জুন মাসের সেই দিনটায় ইংল্যান্ডেও বেশ গরম। উইন্ডসর ক্যাস্ল-এ একটা আয়েশি প্রাতরাশ সেরে, তেইশ বছর বয়সি রানী ভিক্টোরিয়া অপেক্ষা করছিলেন এক ‘বিশেষ দর্শনপ্রার্থী’-র। নামজাদা এক ভারতীয় আসছেন রানীর কাছে। আর তাঁর ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে আসা মানুষজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের শখ রানীর বরাবরই।
এগারোটা বাজার খানিক পরে, লেফটেন্যান্ট ফিটজেরাল্ড, রানীর অধস্তন এক রাজকর্মচারী, তাঁর সামনে নিয়ে এলেন ‘ভিজিটর’কে। তাঁর নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর। লম্বা, সুভদ্র, সুদর্শন ব্রাহ্মণ ক’দিন আগেই ইংল্যান্ডের ডোভার বন্দরে এসে পৌঁছেছেন, তাঁর নিজের জাহাজে চেপে। জাহাজের নাম ‘দি ইন্ডিয়া’। ১৮৪২ সালের ৯ই জানুয়ারি কলকাতা থেকে জাহাজ ছেড়েছিল। আর তার ঠিক ছ’মাস পর, ৯ই জুন দ্বারকানাথ ইংল্যান্ডে পৌঁছন— যাত্রাপথে নেপলস সহ ইউরোপের অনেকগুলো শহর ঘুরে। লন্ডন পৌঁছে ক’দিনের বিশ্রাম সেরে, ১৬ই জুন তিনি এসেছেন রানীর দর্শনে।
রানী বসে ছিলেন সেই ঘরটায়, যেখানে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশ থেকে ইংল্যান্ডে সফরে আসা হোমরা-চোমরাদের দর্শন দিতেন। ঘরের দেওয়ালে তাবড় সব ইংরেজ রাজাদের ছবি— ‘উইলিয়াম দ্য কংকারার’ থেকে শুরু করে তৃতীয় জর্জ হয়ে রানী শার্লট অবধি। মাথার ওপর লম্বা, বিরাট একটা ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি। দ্বারকানাথকে রানীর সামনে নিয়ে আসা হলে, রানী তাঁর চেয়ারে বসলেন। দ্বারকানাথও মাথা নুইয়ে, প্রথামাফিক রানীর হাতে চুম্বন করলেন।
এই সাক্ষাতের পরে, রানী তাঁর জার্নালে একটা ছবি এঁকেছিলেন। দ্বারকানাথের স্কেচ। সঙ্গে লেখা পরিচয়: ‘Tagore Zemindar’। রানী ডায়রিতে আরও যা লিখেছিলেন, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘লেফটেন্যান্ট ফিটজেরাল্ড এক ব্রাহ্মণকে নিয়ে এলেন, যিনি হাতে চুমু খেলেন। তাঁর পরনে ছিল তাঁর জাতীয় পোশাক, সোনালি-আর-লাল সুতোর কাজ করা পাজামা, অপূর্ব শাল, আর ঠিক এই ছোট্ট ছবিতে যেমন আছে, তেমনই দেখতে পাগড়ি।’
উইন্ডসর ক্যাসল থেকে রানী আর প্রিন্স আলবার্ট বাকিংহাম প্রাসাদে ফিরেছিলেন সে দিন। রানীর লেখাতেই পাওয়া যায়, প্রাসাদের বাগানে বসে তিনি কিছু ক্ষণ ডায়রি লিখেছিলেন। ‘তার পর নৌকোয় উঠলাম, আর আলবার্ট লেকের ওপর দিয়ে নৌকো চালাল বেশ কিছু ক্ষণ। দারুণ লাগল।’
ভারতীয় বণিক দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে এই ছিল রানীর প্রথম সাক্ষাৎ। কেবল দেখাই নয়, দুর্দান্ত এক বন্ধুত্বেরও শুরুয়াত ছিল সেটা। যে বন্ধুত্ব অটুট ছিল পরের চার বছর, ১৮৪৬ সালের ১লা অগস্ট দ্বারকানাথের অকালমৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
রানীর সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই লন্ডনের ‘হাই সোসাইটি’তে দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রবেশাধিকার মিলে গেল। ভারত থেকে আসা দ্বারকানাথ বিলাসবহুল সব পার্টি দিতেন, অতিথিদের দিতেন বহুমূল্য উপহার। দান-খয়রাত করতেন অকাতরে। ৪৮ বছর বয়সি দ্বারকানাথ বিশেষ প্রিয় হয়ে ওঠেন ইংরেজ ‘লেডি’দের। বহু ডিউকের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু হয় তাঁর, ডাচেসরা ছিলেন তাঁর বিশেষ অনুরক্ত। শিল্প, সংগীত ও সাহিত্যের সমঝদার দ্বারকানাথ টেমসের জলে একটা নৌকো রেখেছিলেন, যেখানে চার্লস ডিকেন্স, উইলিয়াম মেকপিস থ্যাকারে সহ সে সময়কার দিকপালদের নেমন্তন্ন করতেন তিনি। ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’-এর লেখক থ্যাকারে তো আবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন এই কলকাতাতেই।
পরের পাঁচ মাসে দ্বারকানাথের সঙ্গে রানীর কয়েক বার দেখা হয়েছিল। রানী তাঁর বন্ধুপ্রীতির নিদর্শন স্বরূপ দ্বারকানাথকে একটি মেডেল দিয়েছিলেন, আলাদা করে অর্ডার দিয়ে তৈরি করা। তাতে রানীর ও প্রিন্স আলবার্টের ছবি আঁকা ছিল। এই দ্বারকানাথের অনুরোধেই রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স আলবার্ট বসেছিলেন ছবি-আঁকিয়ের সামনেও। প্রমাণ সাইজের সেই ছবি পাঠানো হয়েছিল কলকাতায়, টাঙানো হয়েছিল টাউন হল-এর দেওয়ালে।
১৮৪২-এর এই ইংল্যান্ড সফরের সময়েই দ্বারকানাথ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালকদের কাছ থেকে একটা সোনার মেডেল পেয়েছিলেন। সঙ্গে একটা চিঠিও, সেখানে প্রশস্তিসূচক অনেক কথা লেখা। ভারত আর গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যেকার সম্পর্ক শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দ্বারকানাথের প্রচেষ্টা যে কোম্পানির সমূহ প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে, চিঠির বয়ানে স্পষ্ট।
ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসা দ্বারকানাথ ঠাকুরকে সবাই চিনত প্রভাবশালী জমিদার ও ট্যাক্স-কালেক্টর হিসেবে। ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা তাঁকে একটা স্পেশাল ট্রেন পর্যন্ত দিয়েছিলেন। সাদা রঙের সেই ট্রেনের গায়ে লেখা থাকত তাঁর নামের আদ্যক্ষর— ডিএনটি।
১৮৪৫ সালের ৮ই মার্চ ফের ইংল্যান্ডে ফিরলেন, ‘দ্য বেন্টিংক’ নামের জাহাজে চেপে। ২১শে জুন পৌঁছলেন ডোভারে। রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স আলবার্ট স্বাগত জানালেন তাঁদের ‘পুরনো বন্ধু’কে।
১৮৪৫ সালের ২৪শে জুন দ্বারকনাথ লন্ডনে এসে পৌঁছলেন। সঙ্গে পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নে নবীনচন্দ্র। দ্বারকানাথ রানীর জন্য মূল্যবান উপহার দ্রব্য নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যে থেকে রানী বেছে নিলেন কতকগুলি বিচিত্র ধরনের চিনা অলংকার এবং দিল্লিতে তৈরি কতকগুলি সোনার তাগা আর সোনার বালা। প্রিন্স অ্যালবার্ট গ্রহণ করলেন একটি সুন্দর শালের চোগা। বাকিংহাম প্যালেসে অভ্যর্থনা হল দ্বারকানাথের। তাঁকে উপহার দেওয়া হল অটোগ্রাফ করা মহারানী ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি।
দ্বারকানাথের সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য একেবারে মধ্যগগনে। তিনি ছিলেন হাতে-গোনা কয়েক জন ভারতীয়ের অন্যতম, ব্রিটিশদের সঙ্গে যাঁদের সরাসরি যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল। আজকের টাটা-মিত্তলদের মতো পশ্চিমি জগতেও প্রভাব-ফেলা ভারতীয় শিল্পসংস্থা তখন কোথায়! দ্বারকানাথই প্রথম ভারতীয় যিনি বিদেশভ্রমণে গিয়েছিলেন, আর তুলে ধরেছিলেন পশ্চিমি সংস্কৃতির ভাল দিকগুলো।
নিজের ব্যবসায়িক দক্ষতা ও সমাজ-সংস্কারক মন দিয়ে দ্বারকানাথ বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ রাজত্ব ভারতে পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, উনিশ শতকের ভারতকে কুরে কুরে খাচ্ছে যে জাতপাত, সরকার ও প্রশাসন যুক্তিনির্ভর হলে সে-সব নিজে থেকেই এক দিন দূর হয়ে যাবে। পাশাপাশি, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা যাতে আরও বেশি সুযোগসুবিধা পান, সেটাও তিনি চেয়েছিলেন।
এই সফরই ছিল তাঁর শেষ সফর। দ্বারকানাথের একটা পুরনো অসুস্থতা ছিলই (সম্ভবত ডায়াবেটিস)। হাওয়াবদলের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হল সমুদ্রতীরের শহর ওয়ার্দিং-এ। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জার্মান সঙ্গীতকার বন্ধুকে, যিনি তাঁকে তাঁর প্রিয় সোনাটাগুলো বাজিয়ে শোনাতেন। দ্বারকানাথ তখন খুব অসুস্থ, অনেক সময়ই থাকেন অর্ধচেতন অবস্থায়।
পরবর্ত়ীতে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, ‘দ্বারকানাথের সর্বশুদ্ধ ১৭ জন অনুচর ছিল। তার মধ্যে দুই জন দেশীয় ভৃত্য। তাছাড়া একজন সেক্রেটারি, একজন ইন্টারপ্রিটার, সঙ্গীত উস্তাদ জার্মান একজন, চিকিৎসক ডা. মার্টিন এবং অপর একজন মিলে এই পঞ্চ সহচর সর্বদা কাছ থেকে তাঁর আবশ্যকমতো কাজকর্মে নিযুক্ত ছিল। আমার পিতামহের শরীর ভেঙে পড়ল। রোগের জ্বালায় বড় অশান্তি, ছটফটানি হয়েছিল। ৬টার সময়ে উঠে গাড়ি করে বেরিয়ে ফিরে এসে অল্প নিদ্রা যেতেন—তারপর আহার, তাঁর ভৃত্য হুলির তৈয়ারি কারি-ভাত আর একটু কমলালেবুর জেলি, এই মাত্র আহার। …..তাঁর শরীর ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ল, তিনি আপনার আসন্ন মৃত্যু আপনি বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। কেমন আছেন কেহ জিজ্ঞাসা করলে গভীর স্বরে বলতেন ‘আমি শান্তিতে আছি।’ (আমার বাল্যকথা ও বোম্বাই প্রবাস)।
১৮৪৬ সালের ১লা অগস্ট, বাহান্ন বছর বয়সে দ্বারকানাথ মারা গেলেন সেন্ট জর্জেস হোটেলে। খুব ঝড়বৃষ্টির একটা রাত সেটা, থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে সেন্ট জর্জেস হোটেল এক মাইলেরও কম পথ। সে দিন দ্বারকানাথের সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছোট ছেলে নরেন্দ্রনাথ আর ভাগ্নে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।
একজন হিন্দুর সৎকার কী ভাবে হবে তা নিয়ে সকলের ভিতরেই উদ্বেগের অন্ত নেই। একদিকে তাঁর পূর্বপুরুষদের সকলকেই দাহ করা হয়েছে, আবার তাঁর বিশিষ্ট শ্রদ্ধার পাত্র রামমোহন রায়কে এখানেই সমাধি দেওয়া হয়েছে। তাঁর পুত্র এবং ভাগ্নে দুজনেই অল্পবয়স্ক। তাঁরা বললেন যেটি যুক্তিযুক্ত সেটাই করা হোক। শবযাত্রায় পুত্র নগেন্দ্রনাথ, ভাগ্নেয় নবীনচন্দ্র ছাড়াও যাঁরা অংশ নিলেন স্যার এডওয়ার্ড রিয়ান, মেজর হেন্ডারসন, মিস্টার প্লাউডেন ও আরও অনেকে। এ ছাড়া যে সমস্ত ছাত্র দ্বারকানাথের অর্থানুকূল্যে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করছিলেন তাঁরাও ছিলেন এই শবযাত্রায়। শবাধারের ঢাকনির উপর ছিল দুখানা রুপোর পাত। একখানিতে বাংলায় লেখা দ্বারকানাথের নাম পরিচয়। দ্বিতীয়টি একই বিষয় ইংরাজিতে লেখা।
চার দিন পর, কেনসাল গ্রিন সেমেটরি-তে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। শুধু তাঁর হৃৎপিণ্ডটা কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল, সৎকার-অনুষ্ঠানে প্রথামাফিক সেটির দাহ করা হয়। সে দিন শোক-অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর ছেলে, ভাগ্নে, ইংল্যান্ড-সফরে তাঁর সঙ্গে যাওয়া চার জন ডাক্তারির ছাত্র আর তাঁর এক কালের কর্মসঙ্গী মেজর হেন্ডারসন ও উইলিয়াম প্রিন্সেপ। খোদ মহারানী ভিক্টোরিয়া একটা শববাহী ঘোড়ারগাড়ি পাঠিয়েছিলেন সে দিন অনুষ্ঠানে। দ্বারকানাথের সমাধিফলকে লেখা ছিল: ‘Dwarkanauth Tagore of Calcutta. OBIIT 1st August 1846’। লেখা ছিল তাঁর নামের আদ্যক্ষরও। ৭ই অগস্ট তারিখে বিখ্যাত লন্ডন মেল পত্রিকা দ্বারকানাথের স্মরণে শোকবার্তা প্রকাশ করেছিল।
কলকাতায় দ্বারকানাথের মৃত্যু সংবাদ এসে পৌঁছেছিল দেড়মাস পরে। দেবেন্দ্রনাথ পারলৌকিক ক্রিয়া করলেন ব্রাহ্মধর্ম মতে, আর তাঁর ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন হিন্দুতে। ইংল্যান্ডের একটি নির্জন পরিবেশে তিনি আজ নিদ্রিত, সে নিদ্রা কোনও দিন ভাঙবে না। ‘হয়তো তাঁর সমাধির উপরে বিশাল কোনও স্তম্ভ রচিত হয়নি, কিন্তু অদৃশ্য হাতে পিরামিডের থেকেও স্থানীয় এবং গভীর একটি স্তম্ভ সেখানে প্রোথিত হয়ে রয়েছে। সে স্তম্ভটি হল ভারতের চিরকৃতজ্ঞ হৃদয়।’
ওই একই সেমেটরিতে সমাধি আছে উইলিয়াম থ্যাকারে ও অ্যান্টনি ট্রলপ-এর মতো লেখক, টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল-এর মতো শিল্পী, ইসামবার্ড কিংডম ব্রুনেল-এর মতো প্রযুক্তিবিদ-স্থপতি, কুইন ব্যান্ডের বিখ্যাত রকস্টার ফ্রেডি মার্কারিরও। আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের প্রথম প্রতিনিধি দ্বারকানাথ— ভিক্টোরিয়ার কলমে আঁকা দ্বারকানাথ শুয়ে আছেন শুধু সমাধিতে নয়, তাঁর স্বদেশের বিস্মৃতির অন্ধকারেও।
(তথ্যসূত্র:
১- ডারলিং ডোয়ার্কি (প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে হত্যার কাহিনি), রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন (২০১৮)।
২- Memoir of Dwarkanath Tagore, Kissory chend mittra, Parul Prakashani Pvt. Ltd.
৩- আসামে চা-কুলি আন্দোলন ও দ্বারকানাথ, অমর দত্ত, গ্রন্থমিত্র (২০০৯)।
৪- ঠাকুরবাড়ির কথা, হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩রা ডিসেম্বর ২০১৬ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৪ই মে ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত