● কারাগারতীর্থ আন্দামান:
আন্দামান ও নিকোবর যেন ছবির মতো এক পোস্টকার্ড। এক দিকে সমুদ্র, নারকেল গাছ, জঙ্গল। যেন কালিদাস উদ্ধৃত বঙ্কিমের লেখায় ‘তমালতালীবনরাজিনীলা’। অন্য দিকে সেখানেই সেলুলার জেল, বন্দি স্বাধীনতা সংগ্রামীর দল।
ডেনমার্কের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৫-’৫৬ সালে নিকোবরের দ্বীপে ঘাঁটি বাঁধে। দ্বীপগুলিতে তখন শুধু ম্যালেরিয়া, পেটখারাপ এবং নারকেল গাছ। আর ছিল একটি বিশেষ প্রকারের ম্যালেরিয়া ভাইরাস। ব্রিটিশরা আন্দামানে নৌসেনা-ঘাঁটি তৈরি করে তারও পরে, ১৭৮৯ সালে। ইতিহাসের পর্দা ফের উঠল ১৮৬৪ সালে। ডেনমার্ক ব্রিটিশদের কাছে নিকোবরের দ্বীপগুলি বিক্রি করে দিল। পাঁচ বছর পরই ব্রিটিশ ভারতের অধীনে সমগ্র আন্দামান ও নিকোবর।
আন্দামান-নিকোবর সতেরোশো ও আঠারোশো শতাব্দীতে দূরপাল্লার জাহাজদের টাটকা পানীয় জল এবং ফলমূল সরবরাহ করত। নাবিকদের কাছে ডাব ও নারকেল ছিল বিশেষ লোভনীয় বস্তু। কেপ অব গুড হোপ, মরিশাস ইত্যাদি জায়গাগুলোও প্রায় একই কারণে বিশ্বের নৌ-ইতিহাসে অপরিহার্য। কারণটা সহজ। সুদূরপ্রসারী ঔপনিবেশিক বাণিজ্যে প্রচুর নাবিক মারা যেত। একটা বিশেষ রোগে, ‘স্কার্ভি’। যদিও আগে থেকে এই সব তাজা রসদ ব্যবহৃত হত, ১৭৬৩-তে জেমস লিন্ড বিস্তর গবেষণার পর প্রকাশ করেন স্কার্ভির প্রতিকার, টাটকা জল, ফলমূল, বিশেষত ভিটামিন সি তার উপশম।
ক্যাপ্টেন বুশ্ তাঁর রিপোর্টে জানান, বিদেশি বণিকেরা আন্দামান ও নিকোবরের উপকূলে আবদ্ধ। দ্বীপের ভিতরে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। আন্দামান ও নিকোবর তখন সারা বছর গড়ে পঁচিশটা জাহাজে এক লক্ষের বেশি নারকেল রফতানি করত। পরিবর্তে নিত ব্লান্ডারবাস, মাস্কেট, ফ্লিন্টলক, ম্যাচলক প্রভৃতি বন্দুক। তা ছাড়াও তলোয়ার, দা, বিভিন্ন কাপড়, বিশেষ বর্মি সামগ্রী ও চিনে তামাক। রুপোর চামচ ছিল তাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।
১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের পর কামানের মুখে বিদ্রোহীদের বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হত। কিন্তু কামানের গোলা ও বারুদের বিস্তর দাম। ক’জনকেই বা ওড়ানো যাবে? টেলিগ্রাফ পোস্টে ফাঁসি দিয়ে টাঙিয়ে রাখতে রাখতে ব্রিটিশরাও ক্লান্ত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্রমশ বুঝতে পারছিল, সর্বসমক্ষে মৃত্যুর সার্কাস রচনায় হিতে বিপরীত হতে পারে। তার থেকে জনসাধারণের চোখের আড়ালে নিভৃতে হত্যাই কাম্য। তত দিনে ফোটোগ্রাফির প্রচলন ঘটেছে। টেলিগ্রাফের সূচনা হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন এবং দ্রুত সংবাদ সংক্রমণের বিশ্ব। অতএব বাকি বিদ্রোহীদের আন্দামানে পাচার।
১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের সময় ওয়াহাবি মুসলিমরা দিল্লিতে সিপাহিদের পাশে ছিল। সিতানা থেকে পটনা অবধি তাঁদের বিস্তার। ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ পর্যন্ত ব্রিটিশরা সিতানা ও অন্যান্য ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে ওয়াহাবিদের দমন করার চেষ্টা করে। যারা প্রাণে বেঁচে গেল, তাঁদের পাঠানো হল আন্দামানে। তবুও ওয়াহাবি আক্রমণ থেকে মুক্তি পায়নি ব্রিটিশ রাজ। ১৮৭২-এ বড়লাট লর্ড মেয়ো আন্দামান পরিদর্শনে আসেন। সেখানে আফ্রিদি উপজাতির ওয়াহাবি শের আলি তাঁকে হত্যা করে। পরে জানা গিয়েছিল, পটনার ওয়াহাবিদের সঙ্গে শের আলির যোগাযোগ, চিঠিপত্র লেনদেন ছিল।
আন্দামানের সেলুলার জেল ১৮৯৬ থেকে ১৯০৬-এর মধ্যে তৈরি হয়। সেলুলার জেল অনেকটা দেহের সেল-এর মতো, একে অপরকে নজরে রাখে। জেরেমি বেনথাম-এর প্রস্তাবিত ‘প্যানঅপ্টিকন’-এর আদলে একটা আদর্শ কারাগার তৈরির চেষ্টা। কিন্তু বেনথাম-এর মডেলে প্রথম জেলখানা আন্দামানে নয়, তৈরি হয়েছিল বেলজিয়ামে।
সেলুলার জেল বরং একটা বিষাক্ত মাকড়সার মতো। শুধু তার সাতটি পা, মাঝখানে একটা লম্বা টাওয়ার। পুলিশের চোখ সর্বত্র। প্রত্যেক কুঠরি থেকে অপর কুঠরির ভিতর দেখা যায়। অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই বারীন্দ্র ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত এবং অন্যান্য সঙ্গীরা যখন মানিকতলা বাগানবাড়ি ও আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেন, সেলুলার জেল যেন ওত পেতে ছিল। এতগুলো শিক্ষিত রাজনৈতিক বন্দিদের শিরদাঁড়া ভাঙার এ এক বিশাল গবেষণাগার। তা ছাড়া দ্বীপান্তরে থাকলে বাকি দেশও ভুলে যাবে তাঁদের কথা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে ইতিহাস মুছে দেওয়ার সুবর্ণসুযোগ।
যখন কলকাতার আদালতে মামলা চলছিল, একটা গান বাঁধা হয়েছিল,
“একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি
হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী।”
ক্ষুদিরাম বসু ছাড়া এই স্বপ্নপূরণ কারওরই হল না। বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত এবং তাঁদের সহযোদ্ধারা আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাবাসে দণ্ডিত হলেন। তিন জনই ১৯২০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁদের আন্দামান-অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন।
উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’-র প্রথমেই লেখেন যে তাঁরা অ্যানার্কিস্ট অথবা নিহিলিস্ট নন। তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী। খুব সহজ করে বলতে গেলে, অ্যানার্কিজম রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সব ধরনের শাসন বিরোধী। নিহিলিজম হল সমাজ ও সামাজিক সব সংগঠন ও বন্ধন বিরোধী— ধ্বংসের মাধ্যমে পুনর্জন্মের পূজারী। উপেন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে দেন, তাঁরা চান ভারতের স্বাধীনতা ও ঐক্য।
তিন বাঙালি বিপ্লবী, তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি ও তিনটি স্বতন্ত্র লেখা। ‘দ্বীপান্তরের কথা’-য় নেতা হিসেবে বারীন স্পষ্ট করে দেন তাঁদের লক্ষ্য। ভারতবর্ষ এবং তার বাইরেও বৃহৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়া। মানিকতলা বাগানবাড়ির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রোপাগান্ডা এবং বিজ্ঞাপন। বারীন মানিকতলা গোষ্ঠীর অন্যতম মাথা। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের ক্রয়ডন-এ। সে জন্যই তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। অতএব তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, বন্ধ দরজার পিছনে ইউরোপিয়ান আদালতে ইংরেজ উকিল ও বিশেষ বিচারপতি দিয়ে তাঁর বিচার করা হবে। বারীন বললেন, তিনি বাকিদের সঙ্গে একই আদালতে পেশ হতে চান। তাঁর নেতৃত্বেই পরে আন্দামানের রাজনৈতিক বন্দিরা একাধিক বার ধর্মঘট করে, অনেকাংশে সফল হয়।
দ্বীপভূমিতে বন্দিদের জীবনে তখন প্রবল অত্যাচার। ঘেমো গরম, নুনের অভাব এবং কঠিন শ্রম। কাকভোরে উঠে দু’গ্রাস খাওয়া। মূল খাদ্য ভাতের মাড়। কোনও কোনও দিন সবজি মিলত। তার পর নারকেল ঘানিতে কাজ। নারকেল থেকে প্রত্যেক বন্দিকে কুড়ি থেকে পঁচিশ কিলো তেল বানাতে হত। ক্লান্তিতে, চাবুকে পরিমাণ অপূর্ণ থাকলে মিলত আরও ডান্ডা। কুঠরির দেওয়াল থেকে ঝুলিয়ে লাঠি মারা দৈনন্দিন ঘটনা। দুপুরের খাওয়ার পর এক ঘণ্টা বিশ্রাম এবং রাতে গরম ও মশার কামড়ের ফাঁকে কয়েক ঘণ্টা ঘুম। এটাই জেলে রোজকার জীবন।
ওয়াহাবির পরে এবং স্বদেশিদের আগে আর একটা আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল আন্দামানের জেলে। তাঁরা হলেন ১৮৮৫-র তৃতীয় বর্মি যুদ্ধের বন্দিরা। ওই সালেই ভারতীয় কংগ্রেস পার্টি স্থাপিত হয়। উপেন্দ্রনাথ ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’-য় লেখেন,
‘‘জেলে ঢুকলে প্রথমেই নজরে পড়ে বহু জাতির সমাবেশ। বাঙ্গালী, হিন্দুস্থানী, পাঞ্জাবী, মারাঠী, পাঠান, সিন্ধি, বর্মী, মাদ্রাজী সব মিশিয়া খিচুড়ি পাকিয়া গিয়াছে।’’
সেখানে ছিল আর্যসমাজিরা, ওয়াহাবিরা, স্বদেশিরা, শিখ, ১৯১৫-র পরে গদর পার্টির সদস্যরা, ছিল বর্মি স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিভিন্ন মতাদর্শের স্বদেশি বাঙালি এবং বিনায়ক সাভারকর। হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যা প্রায় সমান এবং ১৮৮৫-র পর বর্মিরাও যথেষ্ট সংখ্যায় মজুত। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং স্বভাবতই রেষারেষি। বারীনদের লেখায় এটা ফুটে ওঠে। দ্বীপান্তরের কারাগারে বহু জাতি ও চিন্তার এই সমাগম, বিরোধিতা, আপস ও সংলাপ সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং সমগ্র ও স্বতন্ত্র দেশ সম্বন্ধে চিন্তার কি আর একটা উৎস?
একটা মজার তথ্যের উল্লেখ করেছেন বারীন— তাঁরা সুযোগ পেলে নিজেদের মধ্যে দেওয়ালে টোকা মেরে একটা সরল টরেটক্কার মাধ্যমে কথোপকথনের চেষ্টা করতেন। কারাগারের প্রশাসন বাঙালির পাশে রাখত মাদ্রাজিকে, তার পাশে পাঠান ও বর্মিকে। সঙ্গোপনে কথাবার্তা তাই ছিল অত্যন্ত কঠিন।
উল্লাসকরের ‘কারাজীবনী’ বইটি পড়তে গিয়ে একটা ধাক্কা লাগে। উনি ইটের গোলায়, জেলের বাইরে প্রচণ্ড গরমে অবিরত কাজ করতে করতে অসুস্থ হন। উল্লাসকরের জবানিতে,
‘‘এতদিনকার হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর যখন দেখিলাম যতই খাটি না কেন ঐ খাটুনি হইতে আর উদ্ধার নাই, তখন একেবারে মরিয়া হইয়া বলিলাম যে, আর কাজ করিব না।’’
ভারতীয় জুনিয়র ডাক্তার জেলের মধ্যেই কাজের পরামর্শ দেন। তা বড়সাহেব মানবেন কেন? ওঁকে আবার ইটের গোলায় পাঠানো হয়। উল্লাসকর কিছু দিন পর ফিরলেন প্রচণ্ড জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে। জানালেন, তিনি আর কাজ করতে অক্ষম। ধুম জ্বর, ১০৪-১০৬ ডিগ্রির আশেপাশে। তাঁকে ভাতের মাড় খাইয়ে দেওয়াল থেকে হাতকড়ি পরিয়ে চেনে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় সারা রাত। বারীন লেখেন,
‘‘ভোর হলে পেটি অফিসার দেখিল যে, উল্লাসকর জ্বরে অজ্ঞান হইয়া হাতকড়ি হইতে ঝুলিতেছে।’’
উপেন্দ্র ও বারীনের লেখায়,
‘‘জ্বর ছেড়ে যখন উল্লাসকর কুঠরি থেকে বেরোলো, উল্লাসকর আর সেই উল্লাসকর নাই। আসন্ন বিপদের মধ্যেও যিনি নির্বিকার, তীব্র যন্ত্রণায় যাঁহার মুখ হইতে কখনো হাসির রেখা মুছে নাই, তিনি আজ উন্মাদ।’’
উল্লাসকর লিখেছেন, কী ভাবে জেলের হাসপাতালে তাঁকে বারবার ‘ব্যাটারি চার্জ’ বা ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। ‘‘সমস্ত শরীর বিদীর্ণ করিয়া, সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া ঐ তড়িৎ নির্গত হইতে থাকে’’। কিছু সময় আন্দামানের জেল হাসপাতালে কাটিয়ে তাঁকে মাদ্রাজের উন্মাদাগারে পাঠানো হয়। এই প্রচণ্ড নির্যাতনের পরে উন্মাদ হওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক। তবে একটা খটকা রয়েই যায়। তা হলে তিনি ১৯২০-র পর কী করে ‘কারাজীবনী’ লিখতে পারেন? উল্লাসকর কি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন? নাকি তিনি অসাধারণ অভিনেতা? তাঁর লেখায় এক জন ইউরোপীয় ডাক্তার তাঁকে পরামর্শ দেন পাগল সাজতে। কঠিন শ্রম এবং জ্বরে মৃত্যু থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। ওই ডাক্তারের কাছ থেকে লাভ তাঁর উন্মাদনার প্রথম পাঠক্রম। কোনটা সত্যি, অভিনেতা না উন্মাদ, এই রহস্য থেকেই যায়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের হাজার হাজার বর্ণময় চরিত্রকে ‘কালাপানি’ পেরিয়ে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল সেলুলার জেলে। যাঁদের মধ্যে এক বড় অংশই ছিলেন বাঙালি বিপ্লবী। সুশীল সেন, যতীন্দ্রনাথ দাস, বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত – তালিকা অনেক লম্বা। ছিলেন সুবোধ রায়, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর মতো চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের আগুনখেকো নায়করা।
সারা দেশের মধ্যে সেলুলার জেলে নির্বাসিত বিপ্লবীদের মধ্যে সিংহভাগই ছিলেন বাঙালি।
সম্প্রতি ভারত সরকারের সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রক এবং দ্য ডাইরেক্টরেট অফ আর্ট অ্যান্ড কালচার, আন্দামান, নিকোবর প্রশাসনের কাছে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ১৯০৯-১৯৩৮ সালের মধ্যে মোট ৫৮৫ জন বিপ্লবীকে সেলুলার জেলে পাঠানো হয়েছিল। এঁদের মধ্যে ৩৯৮ জনই ছিলেন অবিভক্ত বাংলার।
এছাড়া রাজ্যভিত্তিক যে সব বিপ্লবীদের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে উড়িষ্যা থেকে ৫ জন, অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ৮ জন, কেরালা থেকে ১৪ জন, উত্তর প্রদেশ থেকে ১৮ জন, বিহার থেকে ১৭ জন, মহারাষ্ট্র থেকে ৩ জন, পাঞ্জাব থেকে ৯৫ জন এবং হিমাচল/ উত্তর পশ্চিম ফ্রন্টিয়ার/ তামিলনাড়ু ও নাম জানা যায়নি এমন রাজ্য থেকে সেলুলার জেলে পাঠানো বিপ্লবীদের সংখ্যা ২৭ জন।
পরিশেষে এই কারাবাসের আর একটি দিক। পিনোলজি বা কারাবিজ্ঞান এবং জেল পরিচালনার ওপর প্রথম সুপরিকল্পিত বই লেখেন মার্কি সিজারে বিক্কারিয়া। ১৭৬৪-তে প্রকাশিত ‘অন ক্রাইমস অ্যান্ড পানিশমেন্টস’ একটা গভীর সত্য প্রকাশ করে যে সব অপরাধ একই ভাবে দণ্ডনীয় নয়। লঘু ও গুরুর মধ্যে তফাত অত্যন্ত প্রয়োজন। মার্কি-ই প্রথম জেলখানাকে সংশোধনাগার হিসেবে দেখার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ব্রিটিশ রাজ এই ধারণা ভারতে কার্যকরী করতে আরও একশো বছর লাগিয়ে দেয়। ১৮৬০ সালে ইন্ডিয়ান পিনাল কোড তৈরি হয়। তার ৪০ বছর পরে, ১৯০০ সালে বেলজিয়ামে ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক পিনোলজি সম্মেলন। সম্মেলনের রিপোর্ট তৈরি করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যামুয়েল ব্যারোস। যেহেতু সেলুলার জেলের মডেল বেলজিয়ামে প্রথম প্রতিষ্ঠিত, তাই বেলজিয়ামের সম্মেলনে সেলুলার জেলের পক্ষে পাল্লা ছিল ভারী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্ডিয়ান জেল কমিটি গঠিত হয়। জেল কমিটি ১৯১৯-’২০ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালায় এবং রিপোর্টে বলে, সেলুলার বা সলিটারি কারাবাস দশ বছর ও তার বেশি হলে তা শারীরিক ও মানসিক ভাবে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। দিনের পর দিন একই কাজ। অখাদ্য ও অপুষ্টিকর খাবার। এই সব তথ্য তুলে বারীনরাও জেল কমিটির কাছে আবেদন পেশ করেন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট জেল কমিটির রিপোর্ট, তাঁদের বয়ান এবং আন্তর্জাতিক মত মেনে ১৯২০ থেকে আন্দামান কারাবন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করে।
সেলুলার জেল তাই শুধু আরএসএস-এর গুরু গোলওয়ালকরের বন্দিত্বের ইতিহাস নয়। সিপাহি বিদ্রোহ, আধুনিক কারাবিজ্ঞান, অনেক কিছু মিলেমিশে রয়েছে সেখানে। আন্দামানে প্রথম যুগে তিন বন্দি বাঙালির আত্মকথা তাই আজও গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
● কারাগারতীর্থ আলিপুর:
আলিপুর জেলের বাইরে তখন দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ। উদ্বেলিত জনতার কণ্ঠে মুহুর্মুহু ধ্বনি, ‘জয় কানাই, বন্দেমাতরম্’। জেলের ভিতরে প্রশাসনের তরফে হাজির রয়েছেন খোদ কলকাতার পুলিশ কমিশনার হ্যালিডে সহ বেশ কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। একটু আগেই কানাইয়ের ঝুলন্ত শরীরটা ফাঁসিমঞ্চ থেকে নামিয়ে এনেছে ডোম। নিয়মমাফিক ডাক্তারি পরীক্ষার পর ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি। এবারে কানাইয়ের আত্মীয়-পরিজনদের হাতে বডি তুলে দেওয়ার পালা। চন্দননগর থেকে কানাইলালের দাদা ডাঃ আশুতোষ দত্ত, অকৃত্রিম সুহৃদ মতিলাল রায় এবং আরও কয়েকজন যুবক জেল-ফটকের ভিতরে এসে অপেক্ষা করছেন। তাঁদের হাতে দেশি লালপেড়ে ধুতি-চাদর, গোড়ের মালা, ধূপ-চন্দন, গীতা, গঙ্গাজলের মেটে-হাঁড়ি।
তিরিক্ষে মেজাজে হ্যালিডে ডাঃ আশুতোষ দত্তকে বললেন, “আমরা মাত্র দু’জনকে জেলের ভিতরে ঢুকতে দেব। আপনারা কে কে যাবেন আগে ঠিক করুন।”
আশুবাবু মতিলাল রায়কে দেখিয়ে বললেন, ‘উনি এবং আমি যাব।”
ভিতরে গিয়ে কী দেখা গেল?
মতিলাল লিখেছেন, “ধীরে ধীরে লৌহকবাট উন্মুক্ত হইল, আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম। যন্ত্রপুত্তলিকার মতই শ্বেতাঙ্গ কর্ম্মচারীটির অনুসরণ করিতেছি। সহসা সেই ব্যক্তি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া একটি কামরা দেখাইয়া দিল। সেই অনতিপ্রশস্ত কক্ষের এক পার্শ্বে কালো কম্বলে আপাদমস্তক ঢাকা, কানাইলালের মৃতদেহ পতিত অবস্থায় রহিয়াছে।… একখানি নতুন বস্ত্রে কানাইয়ের সর্ব্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করিয়া, আমরা জেলের বাহিরে আসিতে প্রস্তুত হইলাম। জেল প্রহরী আমাদের যে পথ দেখাইয়া দিল তাহা অতি অপ্রশস্ত, একদিকে সারি সারি পায়খানা, অন্যদিকে আদি গঙ্গার খাল, সরু পুলের উপর দিয়া অতিকষ্টে আমরা অগ্রসর হইতে লাগিলাম, সম্মুখে সমুদ্রতরঙ্গের মত নরমুণ্ড দৃষ্টিপথ আকর্ষণ করিল, সাগর গর্জনের মত ‘বন্দেমাতরম্’ শব্দে আমাদের কর্ণপটাহ ছিন্ন হইবার উপক্রম করিল— দেখিতে দেখিতে আমরা জনসমুদ্রে ডুবিয়া গেলাম।”
একটুও বাড়িয়ে বলেননি মতিলাল রায়। বীর কানাইলালের একচিমটে চিতাভস্মের জন্য কেওড়াতলা শ্মশানে সাধারণ মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গোয়েন্দা পুলিশের ডিআইজি এফসি ড্যালি তাঁর গোপন রিপোর্টে যা লিখেছিলেন তাতে সরকারের উদ্বেগ বেড়েছিল বই কমেনি! ড্যালি লিখেছিলেন,
“দাহকার্যের পরে কানাইলালের চিতাভস্ম কলকাতায় বিক্রি করা হয়েছিল। আধ ছটাক চিতাভস্মের জন্য কোনও কোনও অত্যুৎসাহী পাঁচ টাকা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। চাহিদা অনুযায়ী ভস্মের জোগান দিতে হয়েছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। কারণ কানাইলালের চিতাভস্ম বলে কলকাতায় যা বিক্রিবাট্টা হয়েছিল, তা বাস্তবে চিতাভস্মের প্রকৃত পরিমাণের চেয়ে অন্তত পঞ্চাশগুণ বেশি।”
বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে আলিপুর জেলের (অধুনা যা আলিপুর সেন্ট্রাল জেল) ভিতরে খুন করেছিলেন কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বিচারে তাঁদের দু’জনেরই ফাঁসির সাজা হয়েছিল। কিছু আইনি জটিলতার কারণে কানাইয়ের ফাঁসির দিনকয়েক পরে সত্যেনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। কিন্তু শহিদ কানাইলালকে নিয়ে মানুষের মাত্রাছাড়া উন্মাদনা সরকারের চোখ খুলে দিয়েছিল। আর নয়! আর কোনও বিপ্লবীর ফাঁসির পরে তাঁর মৃতদেহ নিকটাত্মীয়দের হাতে ছাড়া যাবে না। মৃতদেহ নিয়ে কোনও শোভাযাত্রা করা চলবে না। জেলের চার-দেওয়ালের ভেতরেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে হবে। জনৈক এ সি রায় বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোকে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘‘সত্যেন্দ্রের মাতা আমার কুণ্ডু লেনস্থিত বাসায় আসিয়া বলিলেন যে, সত্যেন্দ্রর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জ্ঞানবাবু কঠিন জ্বরে শয্যাগত। সত্যেন্দ্রর সৎকারের জন্য আর কাহাকেও পাওয়া যাইতেছে না। অতএব আমাকে ঐ গুরুভার স্কন্ধে লইতে হইবে।… আমি ভীষণ লালমুখো, অতীব গম্ভীর, স্বল্পভাষী আলিপুরের ম্যাজিস্ট্রেট বোম্পাসের নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি কয়েকটি শর্তে দাহ করিবার অনুমতি দিলেন। ইহা বোধহয় প্রাণদণ্ডের পূর্ব-দিবস।
প্রথম শর্ত — জেলের বাহিরে দাহ নিষেধ।
দ্বিতীয় শর্ত — কোনও আড়ম্বর ও আন্দোলন নিষেধ।
তৃতীয় শর্ত — কোনও স্মৃতিচিহ্ন লইয়া যাওয়া নিষেধ।
চতুর্থ শর্ত — জেলের মধ্যে কর্তৃপক্ষের সম্মুখে দাহ করিতে হইবে।
পঞ্চম শর্ত — লোকসংখ্যা ১৪/১৫ জনের অধিক হইবে না।’’
সুতরাং কলকাতার বুকে কোনও বিপ্লবীর ফাঁসির পর তাঁর শবদেহ সৎকারের প্রকাশ্য সমারোহের প্রথম এবং শেষ দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন কানাইলাল দত্ত।
কারাগারের লৌহকপাটের অন্তরালে স্বাধীনতার বেদিমূলে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছিলেন অনেকগুলি তরতাজা বাঙালি যুবক। কতগুলি? সে হিসাবটাও কি আমরা ঠিকঠাক রেখেছি? পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে বা কারা দপ্তরের তরফে কি কোনও সঠিক হিসাব রাখা হয়েছে? মনে তো হয় না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের অঙ্গ হিসাবে ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে এবং মহাজাতি সদন কর্তৃপক্ষের দৌলতে যে একটিমাত্র গ্রন্থ ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছেন এমন মাত্র পঁচিশ জন বাঙালি বিপ্লবীর নাম পাওয়া যায়। অথচ প্রকৃত সংখ্যাটি এর চেয়ে ঢের বেশি। হিসাব কষে দেখা গিয়েছে, সারা দেশে ফাঁসিতে প্রাণদানকারী বাঙালি বিপ্লবীর মোট সংখ্যাটা হল ৪১ জন। এর মধ্যে বাংলার বাইরে ফাঁসি হয়েছিল ১৭ জনের। আর সারা বাংলার মধ্যে (পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে) সবচেয়ে বেশি ফাঁসি হয়েছিল কলকাতায়। কতজনের? মোট ১০ জনের। এবং এদের সবার ফাঁসি হয়েছিল আজকের আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর পরে কলকাতায় আবারও এক বিপ্লবীর ফাঁসি!
এবারে চারুচন্দ্র বসু।
কানাই কিংবা সত্যেনের মতন তিনি অতটা পরিচিত নন। কানাইলাল ও সত্যেন ছিলেন মানিকতলা বোমার মামলার সঙ্গে যুক্ত আসামি। শ্রীঅরবিন্দ থেকে শুরু করে বারীন ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হেমচন্দ্র কানুনগো, এমনকী অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য—প্রত্যেকের স্মৃতিচারণার সঙ্গে এই দু’টি নাম যুক্ত। কিন্তু চারুর যখন ফাঁসি হল এঁরা সকলেই তখন (অরবিন্দ বাদে) সাগরপারের অন্ধকারায় বন্দি। সেলুলার জেলে বসে এঁরা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি যে মানিকতলা বোমার মামলার সরকারি আইনজীবী আশুতোষ বিশ্বাসকে খুন হতে হবে এক অপরিচিত যুবকের হাতে! যে যুবকটির আবার ডান-হাতটাই নাকি পঙ্গু! আলিপুর জেলের ভিতরে বসে সেই যুবক তাঁর নিকটাত্মীয়দের তিনখানি চিঠি লিখেছিলেন। খুবই মামুলি চিঠি। এই তিনটি চিঠির মধ্যে দু’টি নিজের দুই দাদাকে এবং একটি লেখা তাঁর শ্যালক ছত্রধারী ঘোষকে। ছত্রধারীকে লেখা চিঠি বড় মর্মস্পর্শী। তাতে তিনি কি লিখেছিলেন?
তিনি লিখেছিলেন, ‘‘অভাগা জীবনের এই শেষ পত্র। আর নয়দিন পরে আমার অস্তিত্ব জগৎ হইতে লোপ পাইবে। তাহাতে আমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত নই। কেবলমাত্র একটির জন্য দুঃখিত। একটি অভাগিনীর তের বৎসর বয়স্কা বালিকাকে দীনহীন অবস্থায় এই সংসার সমুদ্রে ভাসাইলাম। কিন্তু আশান্বিত প্রাণে আজ তাহাকে আপনাদের কাছে অর্পণ করিলাম। তাহার প্রতি যেন আপনাদের দৃষ্টি থাকে।’’
নিজের দাদার কাছে লেখা চিঠিতে তাঁর মনের শেষ বাসনার কথা রয়েছে। সেই বাসনাটি খুবই ব্যক্তিগত। যাওয়ার আগে শুধু একটিবারের জন্য আলিপুর জেলে সে অভাগিনী কিরণময়ীর সঙ্গে ক্ষণিকের তরে হলেও দেখা করতে চায়।
তাঁর সেই শেষ আশা পূরণ হয়েছিল কি?
চারুর ফাঁসির পর এক বছরও কাটতে পারে নি, আবারও ফাঁসি হয়েছিল আলিপুর জেলে। এবারে বীরেন্দ্রনাথ দত্তগুপ্ত নামে ঢাকার মুন্সিগঞ্জের এক যুবকের। কলকাতা হাইকোর্টের ভেতরে সে খুন করেছিল মানিকতলা বোমার মামলার তদন্তকারী গোয়েন্দা অফিসার শামসুল আলমকে। বাঘাযতীনের বড় স্নেহের পাত্র ছিল সে। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর বাদে বাঘাযতীনের ছোটছেলের জন্ম হল। যতীন তাঁর নাম রেখেছিলেন বীরেন্দ্রনাথ!
বীরেন্দ্রনাথের ফাঁসির ১৪ বছর পরে ফাঁসি হয় গোপীনাথ সাহার। ওই আলিপুর জেলেই। গোপীনাথের ফাঁসির পর কলকাতার ছাত্র-যুবরা যখন তাঁর মৃতদেহ সৎকারের দাবি তুলে জেলগেটের বাইরে পিকেটিং শুরু করল, তখন তাতে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভিঁজে নি। উদ্ধত ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ জেলের ভিতরেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছিল।
বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত জেলের ওয়ার্ডারদের সঙ্গে কথা বলে জানতে চেয়েছিলেন ফাঁসির আগে গোপীনাথের মনের অবস্থা কেমন ছিল? তাঁর প্রশ্নের উত্তরে একজন ইউরোপীয় ওয়ার্ডার তাঁকে বলেছিল, “হি ওয়াজ এ মা-আ-আ-ন (He was a man)।”
এরপর ভূপেন্দ্রকুমার লিখছেন, “ফাঁসির জন্য ডাকতে গেছে, দেখে গোপী ঘুমুচ্ছে। এক কথাতেই উঠে সঙ্গে চলল। কী সে পা ফেলার ভঙ্গি। বুক ফুলিয়ে ফাঁসির কাঠে দাঁড়াল, নিজেই যেন সাহায্য করতে চায় ফাঁসির রশিটা গলায় বাঁধতে। কিন্তু ওর হাত দুটো তখন পিছনে বাঁধা। দেওয়ালের কাছে লোক গেলে ওই ওয়ার্ডাররাই দেখিয়ে দেয়, গোপীনাথের শবদেহ এখানে দাহ করা হয়েছিল। ওদের কাছেও ওটা যেন তীর্থক্ষেত্র।”
গোপীনাথের পর অনন্তহরি মিত্র আর প্রমোদরঞ্জন চৌধুরি। প্রথমজনের বাড়ি নদীয়ার শান্তিপুরের বাঘআঁচড়া গ্রামে, দ্বিতীয়জনের সুদূর চট্টগ্রামের কেলিশহরে। দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় অনন্তহরির দশ বছরের আর প্রমোদের পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই সাজা চলতে চলতেই বিপ্লবীরা জেলের ভিতরে গোয়েন্দা অফিসার ভূপেন চট্টোপাধ্যায়কে খুন করার ষড়যন্ত্র করে। ভূপেন নিয়মিত জেলে আসত বিপ্লবীদের কারও কারও সঙ্গে একটু বেশি মাখামাখি ও মেলামেশা করে গোপন খবর সংগ্রহের আশায়। সুযোগের সন্ধানে ছিল বিপ্লবীরা। একদিন সুযোগ পেয়ে তাঁকে পিটিয়ে খুন করল বিপ্লবীরা। এই খুনের দায়ে অনন্তহরি আর প্রমোদের একসঙ্গে ফাঁসি হয়েছিল।
আলিপুর জেলে বন্দি এক প্রত্যক্ষদর্শী সহবিপ্লবীর সাক্ষ্যে রয়েছে তাঁদের ফাঁসির বিবরণ,
“ক্রমে ফাঁসির দিন এগিয়ে এল। আমরা দরখাস্ত করলাম, অন্য জেলে ফাঁসির ব্যবস্থা হোক। দরখাস্ত মঞ্জুর হল না।… তখন আমরা পরামর্শ করে স্থির করলাম, সরকার যখন মনে করেছে, আমাদের সামনে ওদের ফাঁসি দিয়ে আমাদের ভয় দেখাবে, তখন আমরা এই বর্বরতার জবাব দেব এইখানে থেকেই। আমরা জয়ধ্বনি করব, পুষ্পবৃষ্টি করব, দেখাব, আমরা ফাঁসি দেখে আরও সাহসই সঞ্চয় করেছি, তাঁদের বর্বরতা ব্যর্থ হয়েছে।…
‘ফাঁসির আগের রাত্রে সারারাত বন্দেমাতরম্ ধ্বনি এবং স্বদেশী গান চলল। ওরাও বন্দেমাতরম্ ধ্বনি করে মাঝে মাঝে সাড়া দিয়ে চলল। আমরা ফুল সংগ্রহ করে তোড়া বেঁধে রেখেছি। ভোরবেলা ওদের স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরানো হয়েছে। এদিকে ফাঁসির মঞ্চের উপর লোহার বিম বসিয়ে দড়ি খাটানো হয়েছে—এক ইঞ্চি মোটা ম্যানিলা, রোপ, ডগায় একটা ফাঁস। পাশাপাশি দুটো দড়ি ঝুলছে। কিছু সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছেন। আমরা দোতলার বারান্দার সামনে জানালায় জানলায় ভিড় করে দাঁড়িয়েছি।…
‘ওদের ওখান থেকে সমবেত কণ্ঠে আকাশ কাঁপিয়ে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি উঠল। আমরা সাড়া দিলুম। দেখতে দেখতে বন্দেমাতরম্ ধ্বনি এগিয়ে এল নিকটে। তার পরের দৃশ্য অপূর্ব, অভাবনীয়। পিছনদিকে হাতকড়া-লাগানো দুই জোয়ান দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে মঞ্চে উঠে পাশাপাশি দুই গহ্বরের ঢাকনির উপর বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল—মুখে মুহুর্মুহু বন্দেমাতরম্ ধ্বনি। আমরাও প্রতিধ্বনি করে চলেছি এবং জানলা থেকে পুষ্পবৃষ্টি করছি।…
‘দেখতে দেখতে জহ্লাদ এগিয়ে এসে ওদের মাথা-মুখ ঢেকে গলা পর্যন্ত টুপি পরিয়ে তার উপর দড়ির ফাঁস এঁটে দিল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট মালেয়া রুমাল নেড়ে ইশারায় আদেশ দিয়ে চোখে রুমাল চাপা দিয়ে চলে গেলেন। জহ্লাদ একটা হাতল টেনে দিল, গহ্বরের ঢাকনি দুটো নেমে গেল। ওদের দেহ দুটো ঝপ করে গহ্বরের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। দড়ি দুটো টান হয়ে ঝুলতে লাগল।…
‘সব শেষ হয়ে গেল। আমরাও যেন অবসন্ন হয়ে শয্যাগ্রহণ করলাম। বিরাট উত্তেজনার পর নেমে এল যেন এক রিক্ত নিস্তব্ধতা। নীরব কান্না ছিল সকলেরই চোখে। শুধু চট্টগ্রামের নির্মল সেন কেঁদেছিল মেঝেয় লুটোপুটি করে। প্রমোদ ছিল তার ছোট ভাইটির মতন।”
আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পাশাপাশি সেলে বন্দি ছিলেন দুই যুবক।
দু’জনই ফাঁসির আসামি।
প্রথমজন চট্টগ্রামের যুবক, মেধাবী ছাত্র এবং মাস্টারদার একনিষ্ঠ ভক্ত।
দ্বিতীয়জনের বাড়ি ঢাকায়; বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস্ অর্থাৎ বিভি নামক গুপ্ত সংগঠনের সক্রিয় সদস্য।
দু’জনে দুটি আলাদা বিপ্লবী গোষ্ঠীর সদস্য হলে কী হবে একে অপরের অনুরক্ত ছিলেন। দ্বিতীয়জন ভাবছে আর তো মাত্র কটা দিন, তারপরই পাশের সেল ফাঁকা হয়ে যাবে! প্রথমজনেরও ভাবনা দ্বিতীয়জনের অনুরূপ। চিরদিনের মতো বিদায় নেবে তাঁর বিপ্লবী-বন্ধু। অথচ পাশের সেলের তাঁর ওই বন্ধুর এ জীবনে কত কী-ই না করার ছিল! তাঁর কণ্ঠে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো ঝলকে উঠল রবীন্দ্রনাথের কবিতা। বন্ধুর উদ্দেশে উদাত্ত কণ্ঠে সে তখন আবৃত্তি শুরু করল,
“যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে,
যে নদী মরুপথে হারাল ধারা।
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।”
যার উদ্দেশে এ আবৃত্তি সে তখন তার সেল থেকে জবাব দিল রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই,
“যাবার দিনে এই কথাটি
বলে যেন যাই—
যা দেখেছি, যা পেয়েছি,
তুলনা তার নাই।”
প্রথমজনের নাম রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। মাস্টারদার নির্দেশে চাঁদপুর স্টেশনে পুলিশের আইজি ক্রেগকে খুন করতে গিয়ে যিনি ভুলক্রমে পুলিশ ইনসপেক্টর তারিণী মুখার্জিকে খুন করে ফেলেছিলেন।
দ্বিতীয়জন বিনয়-বাদল-দীনেশ খ্যাত ত্রয়ী বিপ্লবীর অন্যতম এবং ঐতিহাসিক রাইটার্স অভিযানের একমাত্র জীবিত সদস্য দীনেশ গুপ্ত।
দীনেশের ফাঁসি হয়েছিল ৭ জুলাই, ১৯৩১।
আর রামকৃষ্ণের ফাঁসি হয়েছিল তার মাত্র ২৮ দিন পরে, অর্থাৎ ৪ আগস্ট, ১৯৩১। স্থান: আলিপুর সেন্ট্রাল জেল।
আরও এক দীনেশের ফাঁসির রক্তে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের মাটি ভিজে আছে।
ইনি দীনেশচন্দ্র মজুমদার। বাড়ি ছিল চব্বিশ পরগনার বসিরহাটের এক গ্রামে। টেগার্টকে খুনের চেষ্টায় দীনেশের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেল ভেঙে দীনেশ পালিয়ে এসেছিলেন চন্দননগরে। সেখানেও পুলিশের তাড়া। চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার মঁসিয়ে ক্যঁ একদিন নিয়ে তাকে ধাওয়া করলেন। দীনেশ গুলি চালালেন। মারা গেলেন মঁসিয়ে ক্যঁ। দীনেশ আবার আত্মগোপন করল কলকাতায়। অতপর একদিন ভোররাতে পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ গুলির লড়াই চালিয়ে অবশেষে রণক্লান্ত দীনেশ ধরা দিয়েছিলেন। ফাঁসির সাজা হয়েছিল তাঁর। সেই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।
স্বাধীনতার পর সাত সাতটা দশক কেটে গেল। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল আজও ইতিহাসের মূক সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মনে পড়ে সেই সব আগুন-ঝরা দিনগুলির কথা, যখন বন্দেমাতরম্ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠত তার ভেতরের প্রাঙ্গণটা। ওই তো অরবিন্দের কক্ষ যেখানে তিনি দিব্য জীবনের প্রেরণা লাভ করেছিলেন। ওই তো সেই লাল বাড়ি যেখানে একদিন বন্দিজীবন যাপন করেছেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ ভূপেন দত্ত, বারীন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, অবিনাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ বিপ্লবী। ওই তো সেই ঘরখানি যেখানে একদিন রাত কাটাতে হয়েছে বাঘাযতীনকে! ওই তো সেই ওয়ার্ড যেখানে একদিন সুভাষচন্দ্রকে পর্যন্ত অকথ্য অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে! কত বিপ্লবী, কত স্বদেশপ্রেমিক, কত স্বাধীনতা-সংগ্রামী তার কোলে ঠাঁই পেয়েছে। দেশবন্ধু থেকে সুভাষচন্দ্র—কে নেই সেখানে বলতে পারেন? আলিপুর সেন্ট্রাল জেল মনে মনে গর্ব অনুভব করতে থাকে। আবার কখনও কখনও শোকে-দুঃখে, লজ্জায়-অপমানে সে যেন দিশাহারা হয়ে যায়! কীসের শোক, কীসের জন্য তার দুঃখ? আলিপুর জেল মনে মনে ভাবে, কী অকৃতজ্ঞ এই রাজ্যের মানুষ! আজও কেন তাকে জাতীয় স্মারকের সেই মর্যাদা দেওয়া হল না, যা পেয়েছে আন্দামানের সেলুলার জেল?
মহান বিপ্লবী ও ভারতের সেরা স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের যে জেলে দিনের পর দিন বন্দিদশায় কাটাতে হয়েছে সেই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলকে কেন স্বাধীনতার সত্তর বছর পরেও জাতীয় স্মারকের মর্যাদা দেওয়া হল না? কেন সেখানে গড়ে তোলা হল না ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে কোনও চিত্রশালা? কেন সেখানে আলো ও শব্দের ঝংকারে ফুটিয়ে তোলা হল না স্বাধীনতার আখ্যান? কেন আজও স্বাধীনতা-তীর্থ আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের লৌহকপাট সাধারণ মানুষের জন্য অবারিত হল না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কোনও দিন কি পাওয়া যাবে?
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ই আগস্ট ২০১৭ সাল।
২- বর্তমান পত্রিকা, ৩০শে জুলাই ২০১৭ সাল।
৩- কানাইলাল, মতিলাল রায়।
৪- Terrorism in Bengal by A.K. Samanta, Vol-I.
৫- বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র কানুনগো।
৬- বিপ্লবের পদচিহ্ন, ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত।
৭- বিপ্লবের সন্ধানে, নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
৮- সবার অলক্ষ্যে, ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত-রায়।
৯- অগ্নিযুগের ফাঁসি, শুভেন্দু মজুমদার।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত