আদালতে ২৪ পরগণা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বাম্পসকে লক্ষ্য করে জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী এই বিপ্লবী বলেছিলেন,
“না কিছুই আমি চাইনে। সেশন-টেশনের প্রয়োজন নেই। বিচার করে কালই আমাকে ফাঁসি দাও। এটা ভবিতব্য যে, আশু বাবু আমার গুলিতে নিহত হবেন এবং আমি ফাঁসি কাঠে প্রাণ দেব।”
তিনি জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন।
তাঁর ডান হাতটি ছিল হাঁসের পায়ের পাতার মতো মোড়ানো।
কিন্তু খর্বকায়, অসুস্থ, ছিপছিপে পাতলা দেহগড়নের এই তরুণ স্বভাবে ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার ও প্রতিবাদী।
তিনি ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দেওয়া চতুর্থ তরুণ বাঙালি বিপ্লবী তথা অবিভক্ত বঙ্গের খুলনা জেলার প্রথম শহীদ।
তিনি বিপ্লবী শ্রী চারুচন্দ্র বসু।
ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামে বৃটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সম্ভবপর নয় মনে করে যখন প্রবীণরা স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন, তখন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষ করে যুবক সম্প্রদায় পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে থাকেন অটল। ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’, ‘ব্রতী সমিতি’, ‘আত্মোন্নতি সমিতি’ প্রভৃতি সংগঠনের মাধ্যমে যুবকরা সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দেশমাতৃকার বিপ্লবী সূর্য-সন্তানরা সেদিন বৃটিশদের এদেশ থেকে বিতাড়নের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকীদের আত্মোৎসর্গের ঘটনায় সারা দেশের অসংখ্য তরুণের চেতনায় জেগেছিল বৃটিশের অধীনতা থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে তাঁরা ছিলেন অকুণ্ঠ। সেই রকম এক মহান বিপ্লবী, দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে যিনি হাসিমুখে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছিলেন, তিনি শহীদ চারুচন্দ্র বসু।
আজ তিনি হারিয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়।
১৮৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চারুচন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেছিলেন খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম ছিল কেশবচন্দ্র বসু।
চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় চারু বসু জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। তাঁর ডান হাতটি ছিল হাঁসের পায়ের পাতার মতো মোড়ানো। খর্বকায়, অসুস্থ, ছিপছিপে পাতলা দেহগড়নের এই তরুণ স্বভাবে ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, ক্ষুরধার ও প্রতিবাদী।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই অগ্নিগর্ভ দিনগুলোতে সারা ভারত জুড়ে বিপ্লবীদের বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডে ইংরেজ সরকার ভীষণভাবে ব্যতিব্যস্ত। জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের অগ্নি শপথে বলিয়ান বাঙালি তরুণ যুবকের দল বৃটিশ সরকারের উপর নানাভাবে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে তাদেরকে তটস্থ করে রেখেছিল। একই সঙ্গে ইংরেজদের অনুগত বাহিনীর দমন-পীড়ন এবং তাঁদের কিছু এদেশীয় দোসরদের অপতৎপরতা সমানভাবে বাড়তে থাকে।
আলীপুর ও মুরারীপুকুর বোমা হামলাসহ অন্যান্য মামলার ইংরেজ সরকার পক্ষের উকিল ছিলেন আশুতোষ বিশ্বাস। তিনি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন বিপ্লবীর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে সহায়তা করতেন। ব্রিটিশ সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক এই আইনজীবী নিজেই আগ্রহী হয়ে তাঁর দাপ্তরিক কর্মের বাইরে গিয়েও স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে বৃটিশ পুলিশকে বিভিন্ন রকম সহায়তা দিয়ে যেতেন স্বদেশী আন্দোলনকারীদের ধরার জন্য। তিনি পরিচিত ছিলেন ‘আশু উকিল’ নামে।
আশু উকিলের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে স্বাধীনতা বিরোধী ভূমিকা হিসেবে পরিগণিত হয়। তিনি বিশ্বাসঘাতক বলে বিপ্লবী মহলে পরিচিতি পান। তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন কুখ্যাত বৃটিশ-দালাল আশু উকিলকে হত্যা করা হবে।
ভারত তথা বাঙালির জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, চারুচন্দ্রের জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। কি ভাবে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও কি ভাবে রিভলবার ছোঁড়ার শিক্ষা নেন, কোন বিপ্লবী সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন, কি ভাবে তিনি কলকাতায় উপস্থিত হলেন, তিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলেন, এসব কোনও তথ্যই তাঁকে নিয়ে পাওয়া যায় না।
শুধুমাত্র জানা যায় যে, স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবক চারু বসু সানন্দে বিশ্বাসঘাতক আশু উকিল কে হত্যার ভার গ্রহণ করেন।
১০ই ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সাল।
চারু বসু তাঁর পঙ্গু ডান হাতে খুব শক্ত করে রিভলবার বেঁধে নিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে আলিপুর আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। সকাল থেকে আদালতে তিনি তাঁর লক্ষ্য ও উপযুক্ত সময়ের জন্য প্রবল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছিলেন।
তাঁর সারাটা দিন কেটেছিল আলিপুর আদালতে ঘোরাঘুরি করে।
অবশেষে, বিকাল বেলা এল তাঁর সেই অপেক্ষিত মুহূর্ত।
আলিপুর আদালতের পশ্চিম প্রান্তে তিনি তাঁর লক্ষ্যবস্তু আশু উকিলকে পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে বাম হাত দিয়ে চাদরের নীচে শীর্ণ পঙ্গু ডান হাতে বেঁধে রাখা রিভলবারের ট্রিগার চাপেন।
চাদরের নীচে থাকা রিভলবার গর্জে উঠলো। বুলেট গিয়ে বিঁধলো আশু উকিলের ডান কাঁধে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে হতচকিত ও আহত আশুতোষ বিশ্বাস প্রাণভয়ে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ রবে, তারস্বরে চিৎকার করতে করতে দ্রুত দৌড়াতে থাকেন।
কিন্তু কে বাঁচবে তাঁকে?
ঘটনার আকস্মিকতায় ও প্রাণভয়ে আদালতে থাকা ব্যক্তিরা তখন নিজেরাই পালাতে ব্যস্ত।
দ্রুত পদে চারু বসুও আশুতোষ বিশ্বাসের পিছু নেন।
বেশি দূর দৌঁড়াতে পারেন নি বিশ্বাসঘাতক আশু উকিল।
আবার গর্জে উঠেছিল চারু বসুর চাদরের নীচে শীর্ণ পঙ্গু ডান হাতে বেঁধে রাখা রিভলবার।
এবারে অব্যর্থ লক্ষ্যে।
দ্বিতীয় বুলেট আশু বিশ্বাসের পিঠ দিয়ে ঢুকে তাঁর হৃদপিন্ড ফুঁড়ে দেয়। মাটিতে আছড়ে পড়ে তাঁর দেহ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে বিশ্বাসঘাতক আশু উকিলের।
চারু বসুর মুখে তখন তৃপ্তি আর যুদ্ধ জয়ের হাসি।
ততক্ষণে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ঢুকে পড়েছে আদালত চত্বরে। চারু বিশ্বাস পালানোর বা পাল্টা আক্রমণের কোনও চেষ্টা করেন নি। হয়ত তাঁর সমস্ত জীবনীশক্তি তিনি নিয়োজিত করেছিলেন এই মহান কাজের জন্যই। ঘটনাস্থলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এবারে ফিরে যেতে হয় এই ঘটনার ঠিক দুই দিন আগে।
৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯১০ সাল।
চারু বসুর বিয়ের জন্য দিন হিসাবে স্থির হয়েছিল এই দিনটি। বিয়ে তিনি করেন নি। কিন্তু এটাও চান নি যে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় এক অপরিচিতা নারীর উপরে কোনও কলঙ্কের দাগ লাগুক বা কেউ তাঁর দিকে আঙ্গুল তুলুক। তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। সংসারী হবার কোনও বাসনা তাঁর ছিল না। হবু স্ত্রীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিন পথে চলার কথা বলে বিয়ের নির্ধারিত দিনের আগেই তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
১০ ফেব্রুয়ারি সকলে জানতে পারলো, সরকারি উকিল আশু বিশ্বাসকে হত্যা করেছেন সেই ঘর পালানো তরুণ চারু বসু।
বৃটিশ সরকার চারু বসুকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করে। তাঁকে গ্রেফতার করা গেলেও তাঁর মুখ থেকে অস্ফুট হাসির রেখাটিকে কখনও দমন করা যায়নি। বিপ্লবীদের সম্পর্কে তথ্য বের করার জন্য জেলখানায় তাঁর উপর ভয়ানক রকম অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল। শারীরিক প্রতিবন্ধী চারু বসু সেই নির্মম শারীরিক নির্যাতন মুখ বুঁজে সহ্য করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কোনও সহকর্মী এবং সংগঠন সম্পর্কে একবিন্দু তথ্য তাঁর মুখ থেকে বের করা যায়নি। শারীরিক দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কোন রকম অনুকম্পা প্রার্থনা না করে বরং সর্বদা নিজের আদর্শের প্রতি সুগভীর আস্থা রেখেছিলেন।
চারুচন্দ্র বসুর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি।
আদালতে ২৪ পরগণা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বাম্পসকে লক্ষ্য করে চারু বসু চিৎকার করে বলেছিলেন,
“না কিছুই আমি চাইনে। সেশন-টেশনের প্রয়োজন নেই। বিচার করে কালই আমাকে ফাঁসি দাও। এটা ভবিতব্য যে, আশু বাবু আমার গুলিতে নিহত হবেন এবং আমি ফাঁসি কাঠে প্রাণ দেব।”
আদালতের কার্যবিবরণী শেষ হয় ১৯০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি।
মামলার বিচারের রায়ে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর সাজা দেওয়া হয় এবং ঠিক তার পরদিনই তাঁর মৃত্যুদণ্ডের কথা শোনানো হয়। সেদিনও ভেঙে পড়া তো দূরের কথা, উল্টে তিনি তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বলেন।
তাঁর বাড়ির লোকেরা শেষ একটা চেষ্টা করেছিলেন।
২রা মার্চ ১৯০৯ সালে, তাঁর বিচার হাইকোর্টে তোলা হয়।
তাঁর পক্ষের উকিল তাঁকে জন্মগত শারীরিক প্রতিবন্ধী দেখিয়ে এই হত্যাকাণ্ড তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় বলে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু চারুচন্দ্র ছিলেন নিজের বক্তব্যে অটল। কিছুতেই তিনি তাঁর বক্তব্য পরিবর্তন করেন নি।
হাইকোর্টও আলিপুর আদালতের রায় বহাল রাখে।
১৯০৯ সালের ১৯ মার্চ, আলিপুর কেন্দ্রীয় জেলখানায়, ঊনিশ বছর এক মাস বয়সে এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী শতভাগ দেশপ্রেমিক মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীকে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।
(তথ্যসূত্র:
১- বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি, আহমদ শরীফ, আগামী প্রকাশনী (২০১৫)।
২- অগ্নিযুগের বিপ্লবী মামলা, চিন্ময় চৌধুরী, দীপ প্রকাশন।
৩- নিঃসঙ্গ: অগ্নিযুগের বিপ্লবীর স্মৃতি কাহিনী, সতীশ চন্দ্র দে, অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স (২০১২)।
৪- অগ্নিযুগের স্বাধীনতা সংগ্রাম, রূপময় পাল, তরুলতা (২০১২)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত