নকশাল নিধন যজ্ঞের মূল কারিগর দুটি দল কংগ্রেস এবং সিপিএম এখন নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদে বিজেপির বিরুদ্ধে তাদের নিয়ে বাম ঐক্য গড়ে তোলার কথা বলছে। নকশালপন্থীদের পুলিশ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। একই কাজ কিন্তু করেছে কংগ্রেস এবং সিপিএম দুটি দল। কাশীপুর-বরাহনগর গণহত্যায় দুটি দল একসঙ্গে অপারেট করেছিল। এই চমকপ্রদ ঐক্যের আওয়াজ উঠেছে বৃহস্পতিবার নকশাল নেতা সন্তোষ রাণার স্মরণসভায়। সন্তোষদা কিন্তু বরাবর দেশের গরিব মানুষদের মূল শত্রুদের বিরুদ্ধে সমমনোভাবাপন্ন সমস্ত দল তো বটেই আদিবাসী জনজাতি ও অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এক বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলতেন। দলীয় রাজনীতি কণ্টকিত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাঁর সে কথা খুব একটা কল্কে পায়নি। আজ বিজেপির লাগামছাড়া আগ্রাসী রাজনীতি যখন একটা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে তখন বাধ্য হয়েই সিপিএম, কংগ্রেস সহ সব দল রাজনৈতিক ঐক্যের কথা বলছে। আমার মনে পড়ছে বিজেপির বিরুদ্ধে দেশের মানুষের এক বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার কথা কিন্তু সন্তোষদাই প্রথমে বলেছিলেন।
কথায় আছে স্বভাব যায়না মলে, ইজ্জত যায়না ধুলে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও বিমানদারা স্বভাব বদলান নি। তারা বলছেন সব কমিউনিস্টদের ঐক্যের কথা। কেন শুধু কমিউনিস্টদের ঐক্য? মানুষের ঐক্য নয় কেন? বিজেপির ধর্মান্ধ রাজনীতি ও বিভেদপন্থা, ডিমনিটাইজেশন, এনআরসি’র মত জনবিরোধী সিদ্ধান্তের ফল ভুগছে তো গোটা দেশ। তাহলে তারা লড়াইয়ের বাইরে থাকবেন কেন? রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারানো দেশের দুটি পুরনো দল এখন বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যের কথা বলছে স্রেফ রাজনীতিতে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্য। নিজেদের শক্তিক্ষয় হয়েছে এরা তা মানতে চান না। সঙ্গে মানুষ নেই তবুও এদের মাতব্বরি করার স্বভাব যায়নি। তাই এরা ঐক্যের কথা বললেও দেশের মানুষ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো তা বিশ্বাস করেনা।
গোটা দেশজুড়েই বিজেপির আগ্রাসী রাজনীতি এখন ফ্যাসিবাদের চেহারা নিয়েছে। এখনই সবাই এক হয়ে প্রতিবাদ না করলে দেশে আর কিছুদিন পর কোন প্রতিবাদের অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা বলা কঠিন, তাই ঐক্য জরুরি। আমার অনুরোধ, বিজেপি বিরোধী ঐক্যের নামে নিজেদের মত ও পথ অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। তাহলে ঐক্য তো ভাঙবেই, আপনাদের অফিস খোলারও লোক পাওয়া যাবেনা। আন্দোলন হাইজ্যাক করা যাবেনা বলেই সিপিএম বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে কিছুতেই জায়গা দিতে রাজি নয়। তাদের ভয় তৃণমূল ঢুকলেই তারা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন। তাই যেনতেন প্রকারে তারা তৃণমূলকে রুখতে চায়।
বিজেপিকে রুখতে শুধু কমিউনিস্টরাই যথেষ্ট নয়। সত্যি বলতে কী জীবনে কোনদিন প্রকৃত লড়াইয়ের ময়দানে না থাকা সিপিএমের পক্ষে বিজেপির মোকাবিলা করা আদর্শ, সংগঠন, লোকবল সবদিক থেকেই অসম্ভব। তবুও তারা বিজেপি বিরোধিতার কথা বলছেন স্রেফ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে। শুধু বৃহত্তর বাম ঐক্য দিয়ে আজ আর বিজেপির রাজনীতির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে আজ দরকার একটা নুন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে দেশের সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, এবং অনুন্নত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের নিয়ে একটা বৃহত্তর ঐক্য। শুধু কংগ্রেস ও সিপিএম একাজটা করতে পারবে না। তাদের সংগঠন, জনবল, লড়াইয়ের ক্ষমতার প্রায় আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
রাজনীতির খোঁজখবর যারা রাখেন তারা সবাই জানেন সিপিএম এবং কংগ্রেস নিজেদের প্রবল বিজেপি বিরোধী বলে দাবি করলেও বিজেপি কিন্তু তাদের মূল বিরোধী বলে মনে করেনা। তারা তাদের প্রধান শত্রু বলে মনে করে বাংলার শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। শুধু বাংলা নয়, গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে এক করার ব্যাপারে তিনিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছেন। গোটা দেশ চষে ফেলছেন তিনি। তিনিই মোদি-অমিতদের সবচেয়ে বেশি আক্রমণের লক্ষ্য। কংগ্রেস, সিপিএমের রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা ও অস্তিত্বের সঙ্কট এতই প্রবল যে তাদের তথাকথিত বিজেপি বিরোধী ঐক্য গড়ার সময় তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসের নাম মুখেও আনেন না।
একাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠতে পারে তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু কংগ্রেস, সিপিএম স্রেফ হীনমন্যতায় ভুগে একাজ থেকে তাদের বাদ দিতে চাইছে। অথচ তৃণমূল ছাড়া শুধু রাজ্যে কেন গোটা দেশে বিজেপি বিরোধী কোন লড়াই সম্ভব নয়। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া থেকে শুরু করে ট্র্যাডিশনাল ক্যাম্পেন সর্বত্র বিজেপির নেতাদের তো বটেই মোদি-অমিতদেরও আক্রমণের মূল লক্ষ্য হল তৃণমূল কংগ্রেস এবং তার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্যরা নিজেদের বিরাট গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও বিজেপি কিন্তু তাদের মোটেই গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। তারা কিন্তু মনে করে গোটা দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাদের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ। সিপিএম, কংগ্রেসের তথাকথিত ডাকসাইটে নেতাদের তারা ধরে না। এখনও সময় আছে, গোঁড়ামি ছেড়ে বাস্তব অবস্থাটা বুঝুন। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একে নিতে হবে, ওকে বাদ দিতে হবে এমন ছুঁৎমার্গ আর করবেন না, করলে এমন একটা সময় আসবে যখন আপনাদের সাইনবোর্ড ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান মুখ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাকে বাদ দিয়ে কোন ঐক্যই কিন্তু অসম্ভব। অথচ সিপিএম এবং কংগ্রেস মুখ ছেড়ে মুখোশ নিয়ে পড়েছে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত