হাসপাতালের রোগশয্যায় বসে নিজের ডায়রিতে লিখেছিলেন তিনি। তাঁকে দেখতে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রত্যক্ষ করেছেন বাঁধভাঙা দুর্বার প্রাণশক্তি। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “শরীর তাহাকে আপনার সমস্ত অস্থি-মাংস, স্নায়ু-পেশী দিয়া চারিদিকে বেষ্টন করিয়া ধরিয়াও কোনো মতে বন্দী করিতে পারিতেছে না, ইহাই আমি প্রত্যক্ষ দেখিতে পাইলাম।”
অসম্ভব খোলা প্রাণের এই মুক্ত মানুষটির নাম রজনীকান্ত সেন। অবিভক্ত বাংলার কান্তকবি। জন্মের দেড়শো বছর পরের আজকের বাংলায় তিনি বিস্মৃতপ্রায়। ক্ষান্ত ও আপাত শান্ত এই বঙ্গভূমে, মুক্তমনা কান্তকবি প্রায় বিস্মৃতির অতলে চলে গিয়েছেন। অথচ একদিন দেশের ভালোবাসার কাছে নিজেকে আকুল করে দিয়েছিলেন কবি। রোগশয্যায় থেকেও আবেগ ভরা লেখায় লিখেছিলেন, ”আমার গুণটা কি? আমি দেশের কি করেছি? দেশ আমাকে বড়ো ভালোবেসেছে, বড়ো সাহায্য করেছে।”
রজনীকান্ত সেনের জন্ম অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামে। চোদ্দ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর বন্ধু তারকেশ্বর চক্রবর্তীর। রজনীকান্তের কন্যা শান্তিলতা দেবীর একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘এক অর্থে এই তারকেশ্বর চক্রবর্তীই হলেন রজনীকান্তের সঙ্গীতগুরু— যদিও ঠিক নিয়ম মেনে প্রথাগত সঙ্গীতাভ্যাস রজনীকান্ত করেননি।’ গীতিকাব্যচর্চা ও সংগীতচেতনায় সব্যসাচী রজনীকান্ত সেন প্রকৃত অর্থেই ছিলেন বিস্ময়কর এক প্রতিভা। রাজশাহি শহরে ওকালতি ব্যবসা শুরু করলেও তাতে তিনি মনোনিবেশ করতে পারেননি। স্বভাবকবি ও গীতিকার এই মানুষটি বাল্যকাল থেকেই গ্রন্থকীট ছিলেন না। তাঁর নিজের কথায় – “আমি গান গেয়ে হেসে নেচে পাশ হয়েছি।” – ”দাবা, হারমেনিয়াম, তাস, ফুটবল – এই নিয়ে কাটিয়েছি।”
১৯০২-এ প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘বাণী’। শান্তিলতা দেবী একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০টি। যদিও এটি সম্পূর্ণ সংখ্যা নয় বলেই গবেষকদের অনুমান। ভক্তিমূলক, দেশাত্মবোধক, হাস্যরসের গান এবং জীবনের গান – রজনীকান্তের গানকে মোটের ওপক এই কয়েক ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গানে মুগ্ধ হয়ে হাসির গান লিখতে শুরু করলেও, রজনীকান্তের হাসির গানের ধরণ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গানের থেকে স্বতন্ত্র ও সমান্তরাল। প্রমথনাথ বিশীর ভাষ্যে ”দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান যদি শুক্ল শীতের বাতাস হয়, রজনীকান্তের হাসির গান বর্ষায় জলভারাক্রান্ত পূবের বাতাস।” এদেশের ঐতিহাসিক গবেষণার প্রতি প্রচ্ছন্ন শ্লেষাত্মক হয়ে পুরাতত্ত্ববিৎ কবিতায় রজনীকান্ত লিখেছিলেন,
“রাজা অশোকের কটা ছিল হাতি,
টোডরমল্লের কটা ছিল নাতি,
কালাপাহাড়ের কটা ছিল ছাতি,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।
আকবর শাহ কাছা দিত কিনা,
নূরজাহানের কটা ছিল বীণা,
মন্থরা ছিলেন ক্ষীণা কিম্বা পীনা,
এসব করিয়া বাহির, বড় বিদ্যে করেছি জাহির।”
যেমন অপূর্ব তাঁর হাসির গান, তেমনি অসাধারণ ছিল ভক্তিরসাত্মক গানে তাঁর আকুতি। তৃষিত মরু ছেড়ে রসাল নন্দনে যাওয়ার অকৃত্রিম আকুতিই তিনি সার্থক গীতিকারের মতো তুলে ধরে ছিলেন। নিজের জীবনে মৃত্যুর মিছিল দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা কবি ঈশ্বরনির্ভর ও ভক্তিমূলক গানে তাই ঢেলে দিয়েছিলেন যুগপৎ আবেগ ও দরদ।
“তোমারি দেওয়া প্রাণে তোমারি দেওয়া দুখ,
তোমারি দেওয়া বুকে, তোমারি অনুভব৷
তোমারি দুনয়নে তোমারি শোক-বারি,
তোমারি ব্যাকুলতা তোমারি হা হা রব৷”
তাঁর সমকালীন কবিদের মতো তিনি হাজারখানেক গান লেখেননি। অথচ কথা ও সুরের সারল্যের জন্য তাঁর সঙ্গীত রসিক শ্রোতার মন ছুঁয়ে যায়।
১৯০৫-এ ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন স্থায়ী করতে যাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম রজনীকান্ত সেন। স্বদেশি আন্দোলনের যুগের কবি রজনীকান্ত দেশের জন্যে মানুষের জন্যে লিখেছিলেন সময়ের গান। প্রাণের সুরে দেশ সেদিন কান্তকবির কথাতেই গেয়ে উঠেছিল বিখ্যাত সেই গান,
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই,
দীন দুখিনী মা যে মোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই।’
দিলখোলা চলিষ্ণু এই মানুষটিই জীবনের মাঝ ভাগে আক্রান্ত হয়েছিলেন গলার ক্যানসারে। কলকাতায় এসে ভর্তি হয়েছিলেন মেডিক্যাল কলেজে। কাব্য ও সংগীত রচনায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার প্রাণের কবি। রোগশয্যায় তাই তাঁকে দেখতে ছুটে এসেছিলেন শরৎকুমার লাহিড়ী, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নলিনীরঞ্জন পন্ডিত থেকে শুরু করে বিচারপতি সারদা মিত্র, নাটোর-কাশীমবাজার, দীঘাপতিয়া-দুবলহাটির রাজা-মহারাজ ও কুমারগণ।এমনকি স্কুল কলেজের ছাত্রযুবরাও রজনীকান্ত রচিত ‘অমৃত’ গ্রন্থ হাতে হাতে বিক্রি করে কান্তকবির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। রোগশয্যার কান্তকবি লিখেছিলেন,
” বঙ্গদেশ আমাকে ছেলের মত কোলে করে আমার শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষুধা নিবারণ করেছে, সেই জন্যে আমি ধন্য মনে করে ম’লাম।”
এতো আন্তরিক আয়োজন ও উদ্বেগকে ব্যর্থ করে দিয়ে ১৯১০-এর ১৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৫ বছর বয়সে রজনীকান্ত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর দু-মাস আগে দেখতে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সমকালীন কবিদের মতো তিনি হাজারখানেক গান লেখেননি। তবুও সমকালীন সময়ে তিনি ছিলেন বহুজনপ্রিয়। বিংশ শতকের বাংলা গানের যে সকল পথিকৃৎদের নাম আজও উচ্চারিত হয় তাঁদের মধ্যে অবিস্মরণীয় রজনীকান্ত সেন। দেশের মানুষের দরদভরা কন্ঠে আহ্বান করে রজনীকান্ত লিখেছিলেন,
“আমরা নেহাত গরীব, আমরা
নেহাত ছোট,-
তবু আছি সাতকোটি ভাই,-জেগে ওঠ!”
উনবিংশ ও বিংশ শতকের বঙ্গজীবনের এই সকল উজ্জ্বল চরিত্রদের ভুলে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই, আমাদের সোনার বাংলার জেগে ওঠা সার্থক কি না, এ প্রশ্নই আজকের স্বঘোষিত আধুনিকতা ও উন্নয়নের যুগে সবচাইতে বেশি করে বিচার্য ও স্মর্তব্য।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত