মোদী জমানায় দলের চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠেছে ব্যক্তি। বিগত ৫ বছর ধরেই একনায়কতন্ত্রের শিকার গোটা দেশ। তা দেখে এতদিন চুপ করে থাকলেও অবশেষে নীরবতা ভেঙে মুখ খুললেন ভারতীয় রাজনীতির ‘লৌহপুরুষ’ লালকৃষ্ণ আডবাণী। এবং তা ঠিক লোকসভা ভোটের একেবারে দোরগোড়ায়। নিজের ‘মন কি বাত’ জানানোর জন্য তাঁর ব্লগকেই বেছে নিয়েছেন আডবাণী। তিনি জানিয়েছেন, রাজনীতিতে যাঁরা আমাদের বিরোধী, আমরা তাঁদের কখনও শত্রু হিসাবে দেখিনি, দেখেছি প্রতিপক্ষ হিসাবে। বিজেপি শুরু থেকে সেই দর্শনেই বিশ্বাস করেছে। এর সঙ্গেই নাম না করে মোদী-শাহর উদ্দেশ্যে তাঁর বার্তা, কেউ রাজনৈতিক ভাবে দলের বিরোধিতা করলেই তাঁকে অ্যান্টিন্যাশনাল বলতে হবে, এই ঐতিহ্য বিজেপির নয়। তাঁর মতে, বিজেপির রাজনৈতিক মতপার্থক্য রয়েছে এইরকম কাউকেই দেশদ্রোহী বলা উচিৎ নয়। উল্লেখ্য, পুলওমার হামলা নিয়ে যারাই বিজেপির নীতি বিরুদ্ধ কথা বলেছে তাদেরকেই ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়েছে বিজেপি।
প্রসঙ্গত, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটির হাতে বিজেপির কর্তৃত্ব যাওয়ার পর থেকেই দলের মধ্যে একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন আডবাণী। এই নির্বাচনে যে নিজের গান্ধীনগর কেন্দ্র থেকে তাঁকে আর টিকিট দেওয়া হবে না, তা জানানো হয়েছিল একেবারে শেষ মুহূর্তে। শুধু আডবাণী নন, এই নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের কানপুর থেকে টিকিট দেওয়া হয়নি দলের আর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মুরলীমনোহর জোশীকেও। এই সিদ্ধান্ত যে তাঁর পছন্দ নয়, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন জোশী, কিন্তু কোনও ভাবেই মুখ খোলেননি আডবাণী। সেই নীরবতাই শেষ পর্যন্ত তিনি ভাঙলেন নিজের ব্লগে। শুধু তাই নয়। তাঁর ব্লগে ৫০৯ শব্দের মাধ্যমে তিনি যা তুলে ধরলেন তা গেরুয়া শিবিরের বর্তমান নীতির সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। দলের ঐতিহ্য এবং গণতন্ত্র জারি রাখার উপদেশও দিয়েছেন বিজেপির এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
আডবাণী নিজের ব্লগে ওই লেখাটির নাম দিয়েছেন, ‘নেশন ফার্স্ট, পার্টি নেক্সট, সেলফ লাস্ট’, অর্থাৎ ‘প্রথমে দেশ, তার পর দল, শেষে ব্যক্তি’। যাকে মোদী-শাহদের উদ্দেশ্যে বার্তা বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ব্লগে ৯১ বছরের বর্ষীয়ান নেতা লিখেছেন, ‘দলের মধ্যে এবং দলের বাইরে গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রক্ষা করা বিজেপির অন্যতম সম্পদ।’ পাশাপাশি, তিনি লিখেছেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বৈচিত্রকে সম্মান জানানোই ভারতীয় গণতন্ত্রের সম্পদ। মতের অমিল হলেই তাঁকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, জন্মলগ্ন থেকে কোনও দিন এই মতবাদে বিশ্বাসী ছিল না বিজেপি।’ তাঁর কথায়, ‘রাজনৈতিক ভাবে এবং ব্যক্তিগত স্তরেও প্রত্যেক নাগরিকের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে চিরকালই উদ্যোগী ছিল বিজেপি।’ এরপরেই তাঁর লেখার সব থেকে বিস্ফোরক অংশটি। তিনি লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক ভাবে কেউ মতের বিরোধী হলেই তাঁকে অ্যান্টিন্যাশনাল বলা হবে, এই বিশ্বাস কোনও দিন ছিল না বিজেপির মধ্যে।’
বিজেপি সূত্রের খবর, ষোড়শ লোকসভাতেও প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল আডবাণীকে। তাঁকে যে এই নির্বাচনে প্রার্থী করা হচ্ছে না, সেই খবরও দলের সভাপতি অমিত শাহ তাঁকে নিজে জানাননি। দলের এক জন কর্মীকে দিয়ে এই খবর পাঠানো হয়েছিল তাঁকে। অথচ তাঁর কেন্দ্র থেকেই নির্বাচনে লড়ছেন শাহ। পাশাপাশি বর্তমান কালে মোদী-শাহ যে নীতিতে দল চালাচ্ছেন তাতেও তিনি অসন্তুষ্ট। বিগত ৫ বছর ধরে জমতে থাকা সেই ক্ষোভই এবার নিজের ব্লগে উগড়ে দিলেন বিজেপির পিতা ভীষ্ম। এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অন্যদিকে, আডবাণীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরাবরই সৌজন্যের রাজনীতিতে বিশ্বাসী মমতা টুইটারে লেখেন, গণতান্ত্রিক সৌজন্যের বিষয় নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন বর্ষীয়ান নেতা, প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা।