আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লা রশিদি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন স্রেফ সন্দেহের কারণে অন্যায়ভাবে পিটিয়ে মারা তার ছেলে সিবতুল্লার আততায়ীদের। একই পথে হেঁটেছেন এখন নিউজিল্যান্ডবাসী বাংলাদেশের ফরিদ আহমেদ। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জঙ্গিহানায় নিহত স্ত্রীর আততায়ীদের তিনিও ক্ষমা করে দিয়েছেন। এটাই ধর্মের শিক্ষা, সভ্যতার শিক্ষা। হিন্দু, ইসলাম, খৃস্ট, বৌদ্ধ, শিখ সব ধর্মবিশ্বাস এই ক্ষমা ধর্মকেই শেখায়। ওয়া আলাইমকুম সালাম ওয়া রাহামাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতু মানেই তো শান্তি, ক্ষমা এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদ সবার সঙ্গে থাকুক। কিন্তু আসানসোলের ইমাম কিংবা নিউজিল্যান্ডের ফরিদরা একথা বুঝলেও সত্যটা সবাই বোঝেন না। মঙ্গলবার দক্ষিণ দমদমের কালিন্দীর কাছে চাষিপাড়ায় চোর সন্দেহে এক যুবককে নৃশংসভাবে পিটিয়ে মারার ঘটনা সেকথা আবার প্রমাণ করে দিল। ছেলে ও স্ত্রীর আততায়ীদের উপরোক্ত দুজন ক্ষমা করে দিলেও চোর সন্দেহে ধরা পড়া যুবকটিকে এলাকার বাসিন্দারা কিন্তু ক্ষমা করেননি।
গ্রাম নয়, এ ঘটনা ঘটেছে বৃহত্তর কলকাতার আলোকপ্রাপ্ত এবং বহু আন্দোলনের স্মৃতিবিজরিত দক্ষিণ দমদম এলাকায়। প্রকাশ্য দিবালোকে পৈশাচিক উল্লাসে বাঁশ, লোহার রড দিয়ে লাইটপোষ্টে বেঁধে পিটিয়ে মারা হল চোর সন্দেহে এক যুবককে। চাষিপাড়া, গয়লাবাগান, বসাকবাগান এসব জায়গাগুলো আগে খবরের কাগজে আসতো পিনাকী ও দিলীপ নামে দুই সমাজবিরোধীর লড়াইয়ের কারণে। খুন, জখম তখন ছিল এ এলাকায় রোজকার ব্যাপার। এখন সেই হিংস্রতা আপাতভাবে চাপা পড়লেও তলায় তলায় যে তার চোরাস্রোত বয়ে চলেছে এ ঘটনায় তা আবার সামনে এল। গণধোলাইয়ের সময় স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ এই ঘটনার বিরোধিতা করেননি। �ভোর থেকে সকাল ৭টা অবধি দফায় দফায় পিটিয়ে মারা হল এক যুবককে কিন্তু চারপাশের মানুষজন শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন! কেউই ছুটে যাননি থানায়। মার সহ্য করতে না পেরে অভিযুক্ত যুবক ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন।
আমাদের প্রতিবাদ শুধুই এখন সিরিয়াল, সিনেমা আর প্রগতিশীল নাটকেই আটকে আছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সুবাদেই জানি এই এলাকার ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনগুলি পুজো, মেলা, রক্তদান শিবির, হেলথ ক্যাম্প ও সাংস্কৃতিক অনুস্থান নিয়ে বছরভর সক্রিয় থাকে। এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা এমন একটা নৃশংস ঘটনার কোন খোঁজখবর তারা কেন পেলেন না, তারা কেন প্রতিবাদ করলেন না তা ভেবে আমার অবাক লাগছে। এলাকার জনপ্রতিনিধি কিংবা পুরপিতাদের তো মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, তারাই বা কোন খোঁজখবর পেলেন না কেন এটাও খুব আশ্চর্যজনক! তারা এগিয়ে এলে এমন ঘটনা আটকানো যেতে পারতো।
কোথায় চলেছি আমরা? এই ক্ষমাহীনতার মনোভাব ও অসহিষ্ণুতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? এ ঘটনায় এলাকার কোন মানুষই তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। আমি নিজে যদি ঐ চাষিপাড়ার বাসিন্দা হতাম তাহলে আমি নিজেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। মানুষের এই নৃশংসতা এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা সত্যিই একটা ভাববার ব্যাপার। এ একটা বিশ্বজনীন ঝোঁক। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হল মুখে আমরা নানারকম প্রগতিশীলতার কথা বললেও কার্যত আমরা উপযুক্ত সময়ে কোন প্রগতিশীলতার পরিচয় দিতে পারিনা। কাজেই এই অপরাধের দায় আমাদের সবাইকে স্পর্শ করে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছি দায়িত্ব এড়ানো যেন আমাদের একটা সংক্রামক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঘটনাতেও তার পুনরাবৃত্তি হল। ঘটনাস্থলের সংলগ্ন দুটি থানা লেকটাউন ও দমদম থানা খবর পাওয়ার পর এই ঘটনার কোন দায় নিতে চায়নি। তারা বল ঠেলে দিয়েছেন অন্য থানার কোর্টে।
নৃশংস এই পৃথিবীতে দূরের তারার মত জেগে থাকেন ইমদাদুল্লা ও ফরিদদের মত মানুষরা। আমরা তাদের জয়ধ্বনি করি, সন্মান জানাই কিন্তু তাদের কাছ থেকে সহনশীলতার শিক্ষা এবং বোধ রপ্ত করি না। তাহলে এই ঘটনা কমতো। পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুটি মানুষ ক্ষমাশীল বলেই তাদের সন্তান ও স্ত্রীর আততায়ীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। দুটি ঘটনাই সাম্প্রদায়িক বিভেদের ফল। কিন্তু দুজনের কারোরই আততায়ীদের ধর্মের প্রতি কোন বিদ্বেষ তৈরি হয়নি। যেকোন মৃত্যুই বেদনাদায়ক, যেকোন অপরাধই অন্যায় কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় কোন হত্যা বা সন্ত্রাস বা হানাদারির ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়। মনের ভেতরে পুষে থাকা বিদ্বেষই হিংসাকে প্রশ্রয় দেয়। ভালবাসাই নৃশংসতা বন্ধ করতে পারে, ফেরাতে পারে শান্তি। আমরা কথায় কথায় হজরত মহন্মদ, চৈতন্যদেব, বুদ্ধ, যিশু, রামকৃষ্ণদেবের বাণী আওড়াই কিন্তু তাদের সেই বাণীর মর্ম আমরা বুঝিনি। বুঝলেও বিশ্বাস করিনা। তাই পৃথিবী বারবার নৃশংসতা, গণহত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গি হামলায় আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের মধ্যে কোন ব্যাপারে সমালোচনা, মতভেদ, আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। সেটা সামাজিক মাধ্যমের বাইরে রাস্তায় নামিয়ে এনে আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে তুলে নেওয়াই অস্বাভাবিক।
আজ আমরা দোলের আনন্দে মেতে উঠছি। পরস্পরকে রাঙানোর এই উৎসবেরও মূল সুর কিন্তু প্রেম, ভালবাসা আর বিশ্বাস। আমরা উৎসব করি, কিন্তু উৎসবের উদ্দেশ্যটাকে ভুলে যাই। ইমদাদুল্লা, ফরিদদের মত মানুষেরা নিজেদের ব্যক্তিগত দুঃখকে দূরে সরিয়ে রেখে ক্ষমা ও সহিষ্ণুতার শক্তিকে আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিলেও তার থেকে আমরা কোন শিক্ষা নিইনা। তাই বারবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একেকটা চাষিপাড়া তৈরি হতে থাকে। হিংসার এই পুনরাবৃত্তি কতদিন চলবে এবং তার শেষ কোথায় আমরা তা জানিনা।
অনেকে বলবেন, আপনি বাঁচলে বাপের নাম। ওসব সহিষ্ণুতা, ক্ষমাটমার কথা ভেবে কি হবে? ভুলে যাই প্রহার সহ্য করতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পরা যুবকটির কথা। এমনই হবে, কারণ ইমদাদুল্লা আর ফরিদের কাছ থেকে আমরা কিছুই শিখিনি।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত