ঘুরে এলাম সুন্দরী গাছের জঙ্গলে ঘেরা- “ভয়ংকর সুন্দর” সুন্দর বন৷বহু আগে এই জঙ্গল বাদাবন নামে পরিচিত ছিল৷ সারা পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম ম্যানগ্রোভের জঙ্গল দেখা যায় শুধুমাত্র সুন্দরবনে ৷ আর এই জঙ্গলেই আছে বিখ্যাত হিংস্র বাঘ- রয়েল বেঙ্গল টাইগার৷
সুন্দরবন ভ্রমণের প্রকৃষ্ট সময় হল- শীতকাল ও গ্রীষ্মকাল৷এই সময় জঙ্গলে মিষ্টি জলের সংকট দেখা দেয়৷ তখন বন্যপ্রাণীরা জল পানের জন্য ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের কাটা পুকুরে আসে ৷ ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে তাদের দর্শণ মিলতে ও পারে৷ তাছাড়া শীতকালে নদী অনেক শান্ত থাকে৷ তাই এই সময় সুন্দরবন ভ্রমণ অনেক নিরাপদ৷
সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক দর্শনের জন্য প্রথমে ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস সজনেখালি থেকে পারমিশন নিতে হয়৷পারমিশন নিয়ে ঢুকে পড়লাম ফরেষ্ট অফিসের মধ্যে৷এখানেই
আছে বিশাল মিষ্টি জলের পুকুর৷ পুকুরেই দেখা মিলল কচ্ছপ ও কুমিরের৷ শীতের নরম রোদে পুকুরের পাড়ে চলছিল কয়েকটি বানরের খুনসুটি৷ তারা দর্শকদের খুশি করার জন্য কিছু অঙ্গভঙ্গি ও করে যাচ্ছিল৷
সজনেখালি রিজার্ভ ফরেষ্ট ঘুরে দেখার পর আমরা আমাদের ভ্রমণসঙ্গী ময়ূরপঙ্খীতে ফিরে এলাম৷ এখানে লুচি আর ছোলার ডাল সহযোগে প্রাতঃরাশ চলছিল৷ দুদিকে ঘন সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল৷ মাঝখানে সরু নদী দিয়ে আমরা ভেসে চলেছি৷ হঠাৎ দেখি ময়ূরপঙ্খীর গতি কমে গেল৷ আমাদের অবাক করে ময়ূরপঙ্খীর এক সহকারী বলে উঠল..”আস্তে কথা বলুন, আস্তে কথা বলুন৷’
খাবার প্লেট থেকে চোখ তুলে দেখি সামনে একপাল চিতল হরিণ৷ আপন খেয়ালে তারা নদীর চরে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ দুচোখ ভরে বুনো হরিণের সৌন্দর্য্য দেখলাম৷
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল সুধন্যখালি ও দোবাঁকী৷ জঙ্গলপ্রেমীদের জন্য দুটি জায়গা অসাধারণ৷ বিশেষ করে দোবাঁকী৷ ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের উপর দিয়ে সুদীর্ঘ নেট ঘেরা হাঁটার পথ- এককথায় অসাধারণ৷ আমরা খাঁচার মধ্য দিয়ে হেঁটে চলেছি৷ আর খাঁচার বাইরে আছে হিংস্র বন্য জীবজন্তু৷ চিড়িয়াখানার ঠিক উল্টো ব্যাপার৷
সুন্দরবনের আর একটি দর্শণীয় স্হান হল ঝিঙেখালি রিজার্ভ ফরেষ্ট৷ এর উল্টোদিকেই আছে সমসেরনগর গ্রাম৷ এটি সুন্দরবনের দক্ষিণ সীমান্তের শেষ গ্রাম৷ একটা ছোট্ট নদী গ্রাম আর জঙ্গলকে আলাদা করেছে৷ যে নদীতে ভাটার সময় খুব কম জল থাকে৷ বাঘেরা যখন তখন লোকালয়ে চলে আসে খাবারের সন্ধানে৷
সুন্দরবন ভ্রমণে বেশীরভাগ মানুষই হতাশ হয়, কারণ তারা বাঘ বা কোনো হিংস্র জন্তু দেখতে পায় না বলে৷ বাঘ দেখতে না পাওয়ার একটা বড় কারণ হল- অন্যান্য জঙ্গলের মতো সুন্দরবনের জঙ্গলে দর্শনার্থীদের প্রবেশের অনুমতি নেই৷ তারা শুধুমাত্র রিজার্ভ ফরেষ্টে যাওয়ার অনুমতি পায় বা জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী দিয়ে ঘুরতে পারে৷ সেসব জায়গায় এখন যা কোলাহল দেখলাম- সেখানে বন্য প্রাণী কেন ,একটা পরিযায়ী পাখি ও কারো নজরে পড়বে না৷
বন্য প্রাণীরা আমাদের হতাশ করলেও সুন্দরী গাছ ও ম্যানগ্রোভ আমাদের মন ভরিয়ে দিল৷ ভয়ংকর প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে মাথা উঁচু করে তারা দাঁড়িয়ে আছে৷ সারাদিন সবুজ ম্যানগ্রোভের জঙ্গল দেখতে দেখতে ভাবছিলাম প্রতিকূলতাকে সঙ্গে নিয়ে কিভাবে এগিয়ে চলতে হয় তা এদের দেখেই শেখা যায়৷
সুন্দরবনে যে কটি রিজার্ভফরেষ্ট আছে তার সবগুলোতে থাকার সুবন্দোবস্ত আছে৷ পশ্চিমবঙ্গ ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে সেগুলো বুকিং করা যায়৷ সন্ধ্যার পর সেখানে অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য স্থানীয় কলাকুশলীরা নানা অনুষ্ঠান পরিবেশন করে৷ পরিবেশিত অনুষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হল ..”দুখে যাত্রা”৷ সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের নিত্য জীবন সংগ্রামের কাহিনী বর্ণিত হয় এতে৷জঙ্গলে সন্ধ্যার নিস্তব্ধতার মধ্যে তাদের জীবন সংগ্রমের কাহিনি মন ভারাক্রান্ত করে৷দুখে যাত্রার কাহিনী থেকেই জানা যায় ..হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সুন্দরবনের মানুষ যে দেবীর স্মরণাপন্ন হয়..তিনি হলেন দেবী বনবিবি৷ সর্বধর্মের মানুষ এসে মিলিত হন মা বনবিবি থানে৷কারণ তিনি যে জঙ্গলের দেবী৷
আগেও কয়েকবার সুন্দরবন গিয়েছি৷ কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা অন্যরকম৷ আগে সুন্দরবন পৌঁছানো একটা বিভীষিকা মনে হত৷রাস্তাতে দু তিন ঘণ্টা পথ পেরোলে নিজেকে অর্ধমৃত বলে মনে হত৷ এবারে দেখলাম বেশ মসৃন ঝকঝকে রাস্তা৷ এমনকি সুন্দরবনের গ্রামের ভিতরেও রাস্তাঘাট বেশ মসৃন৷ কয়েক বছর আগেও সেখানে বিদ্যুৎ ছিলো না, পানীয় জলের ব্যবস্থা বলতে ছিল পুকুর ও গভীর নলকূপ৷ সেখানে এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে বিদ্যুৎ ৷ হয়েছে মিষ্টি জলের ও ব্যবস্হা৷ সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও আজ নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে৷
আর একটা জিনিস আমাকে অবাক করেছে তা হল প্লাষ্টিক মুক্ত সুন্দরবন৷ সুন্দরবন ভ্রমণের দিন শুরুতেই ময়ূরপঙ্খির মালিক বিনীতভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন-“দয়া করে নদীতে কিছু ফেলবেন না৷ আমাদের বোর্ডে ডাষ্টবিন রাখা আছে৷ বাচ্চাদের বলে দেবেন কিছু ফেলতে হলে যেন ওখানে ফেলে৷”মনে পড়ে গেল কয়েকবছর আগে ব্যাংকক বেড়াতে গিয়ে এই ব্যাবস্থাই দেখেছিলাম৷ মনে মনে ভেবেছিলাম আমরা কেন পারি না৷ কোলকাতার যত আবর্জনা দেখি গঙ্গাতেই ফেলা হয়৷কিন্তু সুন্দরবন আজ প্লাষ্টিক বর্জন করে দেখিয়েছে৷ বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বাঁচানোর জন্য যে সচেতনতা তা মুগ্ধ করল৷ রক্ষা পাক সুন্দরবন – বেঁচে থাক রয়েল বেঙ্গল টাইগার৷