পর্দার নেপথ্যে থেকেই ইতিহাস গড়েছেন তিনি। জলপাইগুড়ির অচেনা গলির অপরিচিত মুখটি এখন টিভির পর্দায় বা লাইমলাইটে। এশিয়ান গেমসে হেপ্টাথেলনে সোনা জিতে গোটা বাংলা তথা দেশের এক স্বপ্নকে উস্কে দিয়েছেন স্বপ্না বর্মন। সেই স্বপ্ন, অলিম্পিকে স্বর্ণপদকের। এই একই স্বপ্ন যে স্বয়ং স্বপ্নাও দেখছেন, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতিমধ্যেই এক নতুন স্বপ্নের কথা উঠে এল। আজ থেকে ৫ বছর আগে মুক্তি পেয়েছিল ‘ভাগ মিলখা ভাগ’। যা ছিল মিলখা সিং- এর বায়োপিক। অভিনয় করেছিলেন ফারহান আখতার। সেই বছরই জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতার সাই-এ এসেছিলেন স্বপ্না। মিলখা সিং-এর বায়োপিক স্বপ্নার মনে অন্য এক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, কোনও দিন ট্র্যািকে যদি অসাধারণ কিছু করতে পারেন, তাহলে হয়ত তাঁকে নিয়েও বায়োপিক তৈরি হবে একদিন। এবার সেই স্বপ্নই বাস্তব হওয়ার দোরগোড়ায়; যা হতে পারে পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়- এর হাত ধরে। স্বপ্নাকে নিয়ে বায়োপিক তৈরির ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন এই বিশিষ্ট পরিচালক।
গত কয়েক বছর ধরেই বলিউডে বায়োপিক ছবি তৈরির প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে কিংবদন্তী অ্যাথলিট মিলখা সিং, সকলের জীবনের নানা অজানা কাহিনী ফুটে উঠেছে বড়পর্দায়। সাফল্যের সিঁড়ি চড়তে কীভাবে প্রতিপদে জয় করতে হয়েছে প্রতিকূলতাকে, তা অনুপ্রেরণা দিয়েছে আগামী প্রজন্মকে। মেরি কম থেকে গীতা-ববিতা ফোগাটের জীবনযুদ্ধের কাহিনি মন ছুঁয়ে গেছে দর্শকদের। এসব ছবি বক্সঅফিসেও সুপারহিট। এবার এই একই পথেই হাঁটতে চলেছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক সৃজিত।
সত্যি ঘটনাকে নিজের শৈল্পিক ছোঁয়ায় রুপোলি পর্দায় তুলে ধরতে বরাবরই ভালবাসেন সৃজিত। ব্লকবাস্টার ছবি ‘উমা’ হোক কিংবা আসন্ন ছবি ‘এক যে ছিল রাজা’; প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাস্তবের ছোঁয়া থাকে সৃজিতের সিনেমায়। আর বাংলার এই সফল পরিচালকই এবার স্বপ্নাকে নিয়ে ছবি তৈরির আগ্রহ দেখিয়েছেন। শোনা যাচ্ছে, অনুমতি চেয়ে ইতিমধ্যেই নাকি সোনার মেয়ে স্বপ্নাকে ফোনও করে ফেলেছেন তিনি। জানান, স্বপ্নার জীবনের চড়াই-উতরাই আম জনতার কাছে পৌঁছে দিতে চান তিনি। কী বললেন স্বপ্না? পরিচালককে নাকি হাসি মুখেই সম্মতি জানিয়েছেন জলপাইগুড়ির মেয়ে। নিজের চরিত্রে কাকে দেখতে চান পর্দায়? স্বপ্না অবশ্য নির্দিষ্ট করে কোনও নাম বলেননি। শুধু জানিয়েছেন, তিনি বাংলার বিখ্যাত জুটি উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখতেই ভালবাসতেন। বর্তমানে সেভাবে কারও ভক্ত নন। তাই অভিনেত্রী বাছাইয়ের ভার পরিচালকের উপরই ছেড়ে দেবেন তিনি। তবে সুযোগ পেলে তিনি নিজেও অভিনয় করতে আগ্রহী বলে জানান স্বপ্না।
এশিয়ান গেমসের হেপ্টাথলনে প্রথম ভারতীয় সোনা জয়ী স্বপ্না। তাঁর জীবন সংগ্রামের গল্পটা রীতিমতো মেলোড্রামাটিক, সিনেমাতেও খুব একটা এমন দেখা যায় না। জলপাইগুড়ির বছর একুশের মেয়ে স্বপ্না, বাকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো বেড়ে ওঠেননি। নিজেদের জমি-বাড়ি নেই স্বপ্নাদের। সেখানকার পাতকাটা কালিয়াগঞ্জ ঘোষপাড়ায় পঞ্চায়েত সমিতির বানিয়ে দেওয়া ঘরেই থাকেন তাঁর পরিবার। বাড়িতে বাবা-মা ও দাদা অসিত থাকেন। স্বপ্নার বাবা পঞ্চানন বর্মণের ভ্যানরিক্সায় ভর করে চলত সংসার। আর ওদিকে মা বাসনা বর্মণ চা বাগানের শ্রমিক। তবে আট বছর আগে স্বপ্নার বাবার ব্রেন স্ট্রোক হয়, তারপর থেকে স্বামীর দেখভাল করার জন্য বাসনা কাজ ছেড়ে দেন। স্বপ্নার বড় দিদি চন্দনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পবিত্র স্বপ্নার বড় দাদা। তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। যদিও স্বপ্নাদের সঙ্গে থাকেন না। অন্যত্র পরিবার নিয়ে বাস তাঁর। অসিতও পেশায় রাজমিস্ত্রী। এরকম একটা পরিবারই স্বপ্নার সঙ্গী। আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার নেই যে অভাব তাঁদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছিল। তবে এই অভাবকে জয় করেই স্বপ্না, গত ২৯ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় গায়ে দেশের পতাকা জড়িয়ে বাংলা তথা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করলেন। ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়ালেন তিনি, গলায় উঠল সোনার পদক। এরকমই অনেক নাটকীয় মুহুর্তে ভরা স্বপ্নার জীবন।
তবে বায়োপিক তৈরির ক্ষেত্রে সমস্যা একটাই। স্বপ্নার কোচ সুভাষ সরকার এ বিষয়ে এখনও সবুজ সংকেত দেননি। তিনি চান না অলিম্পিকের আগে কোনও ভাবেই ফোকাস নষ্ট হোক তাঁর ছাত্রীর। তিনি বলেন, ‘এশিয়াডে সোনা পাওয়ার পরেই স্বপ্নাকে ফোন করেছিলেন সৃজিত। উনি স্বপ্নাকে নিয়ে সিনেমা করতে চান। নিঃসন্দেহে এটা ভাল প্রস্তাব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি এইসব নিয়ে ভাবতে চাই না। স্বপ্নার স্পোর্টস কেরিয়ারেই ফোকাসটা রাখতে চাই। সত্যি বলতে, এই সেলুলয়েডের চমক থেকে ওকে দূরে রাখতে চাই। ও গ্রাম থেকে আসা একটা মেয়ে। এসব গ্ল্যামারে ওর মাথা ঘুরে যেতে পারে’। আপাতত স্বপ্নার গুরুর অনুমতির অপেক্ষায় সৃজিত। তিনি সম্মতি দিলেই বায়োপিক নিয়ে কাজ শুরু করবেন বলে জানিয়েছেন। সৃজিত বলেন, ‘একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে কথাবার্তা হয়েছে। এর বেশি এই নিয়ে কিছু বলব না’।