প্রতি বছর নভেম্বর মাসের শেষদিকেই পরের বছরের শারদীয়া বা পুজো সংখ্যার জন্য যাবতীয় কাজ শুরু হয়ে যায়। পঞ্জিকার ক্ষেত্রেও কার্যত তাই। এভাবেই কাজ হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এটাই দস্তুর।
বাঙালির আদি পঞ্জিকা ছিল ‘নবদ্বীপ পঞ্জিকা’। ঐতিহাসিকদের অনুমান তার প্রতিষ্ঠাতা সম্ভবত ছিলেন স্মার্ত রঘুনন্দন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের (১৭১০–১৭৮২) আমলে রামরুদ্র বিদ্যানিধি নতুন করে গণনা আরম্ভ করেন। আগে তালপাতার পুঁথিতে এসব লেখা হত। প্রথম ছাপার অক্ষরে শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে ১৮৬৯ সালে।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন পঞ্জিকার স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদকদের বক্তব্য, বছরভর পণ্ডিতমণ্ডলী পুনর্মার্জন ও সংশোধন করে চলেন। ফাঁকি দিলে নিজেদেরই ফাঁকে পড়তে হয়। সামান্য ভুলচুক থাকলেই পুরুতমশাইরা মুখ ঘুরিয়ে নেবেন, সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ গেরস্থ। ৫–৬টা পঞ্জিকার মোট বিক্রি প্রায় ৫০ লাখের ওপর। এক শ্রীম–র ‘কথামৃত’ ছাড়া আর কোনও বাংলা বই এর ধারেকাছে কোনওদিন পৌঁছয়নি। শুধু বেণীমাধব শীলের যে বিভিন্ন সাইজের, পৃষ্ঠার, দামের সাত–সাতটা সংস্করণ ফি বছর বেরোয়, তার সম্মিলিত বিক্রি বছরে ১২ লাখ। তাঁরই বড় ছেলে মোহনচাঁদ শীল- এর থেকে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে।
৬৬ বছর বয়সি মোহনচাঁদ জানান, আমাদের ৭টি বিভিন্ন পঞ্জিকা আছে। সব ক’টির নামের শুরুতে রয়েছে বেণীমাধব শীল, তার পর ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা, সচিত্র পঞ্জিকা, ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা, পূর্ণাঙ্গ পঞ্জিকা, গার্হস্থ্য পঞ্জিকা ও পকেট পঞ্জিকা। মোহনচাঁদ আরও জানান যে, আজ থেকে ১৬০ বছর আগে হাওড়ার মাকড়দা থেকে মোহনচাঁদের প্রপিতামহ দ্বারিকনাথ শীল চাকরির খোঁজে এসেছিলেন কলকাতায়। দ্বারিকনাথ আশ্রয় পেয়েছিলেন, উত্তর কলকাতায় অবস্থিত আজকের জয় মিত্র স্ট্রিটে। তিনি চাকরি পান পোস্তার পুরনো ট্যাঁকশালে। পরে তাঁর ছেলে পূর্ণচন্দ্রও কাজ পান এই ট্যাঁকশালে। এই পূর্ণচন্দ্রই প্রথমবার বার করেন ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা। কিন্তু উনি ছিলেন সরকারি চাকুরে। তাই পঞ্জিকার ব্যবসা চালাতেন মা মনমোহিনী দেবীর নামে। পূর্ণচন্দ্রের ছেলে বেণীমাধব আর চাকরি নয়, আজীবন ব্যবসা করেন পঞ্জিকা নিয়ে। বেণীমাধব প্রয়াত হন ১৯৮৯ সালে। এখন ওই সব পঞ্জিকার মালিক বেণীমাধবের দুই পুত্র, তিনি এবং অভিজিৎ। আরেক ভাই শশাঙ্ক শীল ১৯৯৯ সালে মারা যান। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের প্রায় গা লাগোয়া অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটে পাঁচতলা বাড়িটিই তাঁদের অফিস ও বাসস্থান। মোহনচাঁদ বলেন, তাঁর এক মেয়ে, পৌলোমী শীল ভট্টাচার্য এবং অভিজিতের দুই ছেলে, অভিদেব ও অভিরণ। এই তিন ভাইবোন মিলে এখন বাবা-জ্যাঠার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন।
বিক্রির পরিমাণই জানান দিচ্ছে যে, পঞ্জিকা ছাড়া এখনও বাঙালির জীবন অচল। সাধভক্ষণ, অন্নপ্রাশন, পৈতে, বিয়ে, মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধ— সবেতেই চাই পঞ্জিকা। কারণ মল মাসে কী কী নিষেধ, কোন লগ্নে শুভকাজ হবে, কোন তিথিতে কী খাওয়া নিষেধ সেসবই জানা যায় পঞ্জিকায়। এমনকি সূর্যের উদয়-অস্ত থেকে নদীতে জোয়ার-ভাটাও হয় পাঁজি মেনেই। তাই খুব কম সময়ের জন্য হলেও, স্মার্টফোন থেকে চোখ সরিয়ে বাঙালির নজর পড়ে পাঁজির পাতায়।
তবে বেণীমাধব ছাড়া আর কোনও পঞ্জিকায় থাকেনা দামের উল্লেখ। তা যত পাতারই হোক না কেন। এর কারণ জানতে চাওয়ায় এক দোকানদারের উত্তর, আমার যাতে নিজেদের ইচ্ছেমতো দামে বেচতে পারি, সেই সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্য। তাঁর থেকেই জানা গেছে, প্রায় সারাবছরই রমরমিয়ে চলে পঞ্জিকার বিক্রি।