মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলে খেলা দুর্ধর্ষ ফুটবলার, ৭০’রের এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জয়ী ভারতীয় দলের সদস্য সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদারের জীবনাবসান। বয়স হয়েছিল ৬৮।
পেটের ব্যথা নিয়ে রবিবার দুপুরে বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন প্রাক্তন এই ফুটবলার। হঠাৎই রাত আটটা নাগাদ প্রবল হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় আইটিইউ–তে। পরে অবস্থার অবনতি হলে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। রাত ১০টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সুকল্যাণ।
তাঁর মৃত্যুর খবর সকালে প্রাক্তন ফুটবলার কানাই সরকার, মানস ভট্টাচার্য ও বিদেশ বসু মারফত গোটা ক্রীড়ামহলে ছড়িয়ে পড়ে। শোকাহত সকলেই। খবর পাওয়া মাত্র মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলের পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় প্রয়াত ফুটবলারকে শ্রদ্ধা জানাতে। সুকল্যাণের বড় মেয়ে রূপমঞ্জরী কলকাতায় থাকেন। তাঁর ছোট বোন ইয়র্কশায়ারে থাকেন। খবর পেয়ে লন্ডন থেকে বিমান ধরেছেন। কলকাতা এসে পৌঁছবেন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে আটটায়। তিনি এলে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবেন। তবে এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে সুকল্যাণের মরদেহ বেসরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হবে কালীঘাটের বাড়িতে। সেখান থেকে মোহনবাগান, ভেটারেন্স ক্লাব হয়ে সুকল্যাণের প্রিয় আড্ডার জায়গা অ্যাভিনিউ সম্মিলনী হয়ে শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে।
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির ছেলে হয়েও কলকাতায় খেলতে এসে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন সুকল্যাণ। খিদিরপুরে যোগ দিয়েছিলেন ভূতনাথ বিশ্বাসের হাত ধরে। ’৬৮–তে রাজস্থান ক্লাবে সুভাষ, সুকল্যাণ ও তপন নাগ রায়ের ত্রিফলা আক্রমণ অনেক ক্লাবের ঘুম কেড়ে নেয়। ’৬৯–এ সুভাষ ভৌমিক ইস্টবেঙ্গলে আর সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদার মোহনবাগানে চলে গেলেও দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব নষ্ট হয়নি। বরং সেই সম্পর্ক মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সূত্রপাত জুনিয়র বেঙ্গল স্কুল খেলতে গিয়ে। ’৬৮–তে উত্তরবঙ্গের প্রবল বন্যার সময় সুকল্যাণের বাড়িতে দিনের পর দিন কাটিয়েছিলেন সুভাষ। কলকাতাতেও এক বাড়িতে থেকেছেন অনেক দিন। ’৬৯–এ আইএফএ শিল্ড ফাইনালে প্রণব গাঙ্গুলি আর সুকল্যাণের গোলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহনবাগান। সে বছর লিগও জেতে মোহনবাগান। রোভার্স কাপে মোহনবাগানকে ’৬৮, ’৭০, ’৭১, ’৭২ সালে চ্যাম্পিয়ন করার কৃতিত্ব তাঁরই। ১৯৭৪ সালে মোহনবাগানের ডুরান্ডজয়ী দলেও তিনি ছিলেন। ’৭৩ সালে মোহনবাগানের অধিনায়ক হন। ’৭০–এ এশিয়াডে ব্রোঞ্জ জয়ী ভারতীয় দলের সদস্য সুকল্যাণ। সোনা না জেতার আক্ষেপ ছিল। ৭২–এ ভারতের প্রি–অলিম্পিক দলে তিনি ছিলেন। বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে খেলেছেন ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত। এর মধ্যে বাংলা ’৬৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়। ’৬৮ থেকে ’৭৪ মোহনবাগানে খেলার পর ’৭৫–এ ইস্টবেঙ্গলে যান।
খেলা ছাড়ার পর সেভাবে ময়দানমুখো হননি কখনও। বলতে গেলে এই জগতের মায়া কাটালেন একরকম নিঃশব্দেই। সকালে ইস্টবেঙ্গল অনুশীলনে খবরটা পেয়ে মর্মাহত সুভাষ ভৌমিক বলেন, ‘মৃত্যু আমাকে আর ছোঁয় না। কারণ এটা অবশ্যম্ভাবী। আমার থেকে বয়সে ছোট কেউ চলে গেলে সেটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। সুকু আমার থেকে দু’ বছরের বড়ই হবে। তবে একসঙ্গে যে বন্ধুর সঙ্গে বসে একথালায় ভাত খেয়েছি, তার চলে যাওয়ার খবরে তো খারাপ লাগছেই। জুনিয়র বেঙ্গল স্কুল খেলার সময় থেকে বন্ধুত্ব। কত সুখ–দুঃখের সাথী। উত্তরবঙ্গে ভয়াল বন্যার সময় সুকুর বাড়িতে কাটানো থেকে পরে বিভিন্ন সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা একসঙ্গে আড্ডা মেরেছি। সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে।’ সুধীর কর্মকারের প্রতিক্রিয়া, ‘সুকল্যাণের মৃত্যুর খবরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও মাঠে খেলত খুব চুপচাপ। কাউকে কিছু বলা বা হাঁকডাকের ধার দিয়ে যেত না। এখন একটা কথা খুব মনে পড়ছে। সুকল্যাণ ইনসাইডে খেলছে। আমি উল্টোদিকে রাইট ব্যাকে। হঠাৎই দৌড়ে এসে সুকল্যাণ আমাকে তলপেটে একটা সজোরে লাথি কষায়। খুব রাগ হয়েছিল। সুযোগ খুঁজছিলাম পাল্টা মার দেওয়ার। পারিনি, ও আমার ধারেকাছে ঘেঁষেনি। খেলার পর বলেছিলাম, আমার কাছে এলে মার খেতিস। ও শুধু হেসেছিল।’
শ্যাম থাপা জানালেন, ‘আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। অনেকটা ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মতো। পারফেক্ট জেন্টেলম্যান। বাড়িতে যাতায়াত ছিল। একসঙ্গে ব্যাঙ্কে কাজ করেছি। এই তো সেদিন ২৯ জুলাই মোহনবাগান দিবসে দেখা হল। দু’জনে মিলে অনেক গল্প করলাম। হাঁটুর অপারেশনের কথা বলল। মজা করে বললাম, তাহলে আবার আগের মতো জোরে শটে গোল করতে পারবি তো? হাসল। তখনও ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ফেলে চলে যাবে।’ সমরেশ চৌধুরির মনে পড়ছে শিলংয়ে জুনিয়র বেঙ্গল স্কুল খেলতে গিয়ে সুকল্যাণের সঙ্গে পরিচয়ের কথা। বললেন, ‘৬৫ সালের কথা। শিলংয়ে গেছি খেলতে। সুভাষ আর সুকল্যাণও গেছে। তখনও তো সেভাবে পরিচয় হয়নি। আমি পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে ছিলাম না। যাওয়ার সময় মা আমাকে তিন টাকা দিয়েছিল হাতখরচ হিসেবে। শিলংয়ে পৌঁছে সকালে প্র্যাকটিসের পর বিকেলে ঘোরাঘুরির সময় দেখি সুকল্যাণ আর সুভাষ একটা দোকানের সামনে লম্বা সুতোর মতো কী এটা খাচ্ছে। আমি কাছে যেতে বলল, কী রে খাবি? আমি বললাম, এর দাম কত? ভাই আমার কাছে মাত্র দু’টাকা আছে। সুকল্যাণ বলল, আরে দূর, তোকে পয়সা দিতে হবে না। তুই খাবি কিনা বল। সেই প্রথম চাউমিন খেলাম ওদের পয়সায়। পরে যতদিন ওখানে ছিলাম, রোজ ওরা আমাকে খাওয়াতো। এসব কথা এখন খুব মনে পড়ছে।’
সুরজিৎ সেনগুপ্তর কথায়, ‘অত্যন্ত স্বল্পভাষী, ভদ্রলোক, দক্ষ একজন ফুটবলারকে হারালাম। আমার থেকে বয়সে সামান্য বড় হলেও এটাকে অকালমৃত্যু ছাড়া কিছু বলা যাবে না। খিদিরপুরে থাকতেই আমাদের ভারতীয় দলের ট্রায়ালে মুম্বই পাঠিয়েছিলেন কর্তা ভূতনাথ বিশ্বাস। যাতে আমাদের দখলে নিতে না পারে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল। সেটা ৭১–এর শেষ, ৭২–এর শুরু। ওখানে কোনও মোহনবাগানের কর্তা ছিলেন না। সুকুদা ও তরুণদা (তরুণ বসু) মোহনবাগানের হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। পাকা কথা সেরেও নেয়। হাতে কলকাতা ফেরার প্লেনের টিকিট ধরিয়ে দেয়। আমি কলকাতায় এসে মোহনবাগানে সই সেরে আবার মুম্বই গিয়েছিলাম। সেই থেকে সুকুদার সঙ্গে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একসঙ্গে খেলেছি। অনেক কিছু শিখেছি। মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারতাম সুকুদা আমাকে খুব স্নেহ করে। খুব ডাউন টু আর্থ মানসিকতার মানুষ ছিল সুকুদা। ৭২–এ বড় ম্যাচে দূরপাল্লার দুরন্ত শটে ইস্টবেঙ্গলের জালে বল জড়িয়েছিল সুকুদা। ম্যাচটা বৃষ্টিতে শেষপর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়ে যায়। তবু সুকুদার ওই গোলটা আজও আমার মনে আছে। আরও বেশি করে মনে করাচ্ছে, কারণ সেদিন ম্যাচের পর বাগানের এক কর্তা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে। সুকুদাকে সেদিন দেখেছিলাম ওইরকম একটা দুরন্ত গোলের পর আশ্চর্যরকম স্বাভাবিক থাকতে। যেন কিছুই করেনি। এমন একটা মানুষের চলে যাওয়ার খবর শুনে বুকে বেশ জোরালো ধাক্কা খেলাম।’