এ যেন মগের মুলুক! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য সফর। আর সেই কারণে নাকি ২২ ও ২৩ জানুয়ারি পাঠকদের জন্য দরজা বন্ধ জাতীয় গ্রন্থাগারের! হ্যাঁ, এবার এমনই নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী থাকল গ্রন্থাগারের তামাম পাঠক। বুধবার মাঝরাতে জাতীয় গ্রন্থাগারের ওয়েবসাইটে গিয়ে শুক্রবার রিডিং রুমে যাওয়ার অনলাইন অনুমতি নিতে গিয়েছিলেন জয়ন্তী মুখোপাধ্যায়। কিন্তু অনুমতি পাননি। খোঁজ নিয়ে জানলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের জন্য ২২ ও ২৩ জানুয়ারি পাঠকদের জন্য জাতীয় গ্রন্থাগার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ১৯৫৬ সাল থেকে নিয়মিত জাতীয় গ্রন্থাগারের রিডিং রুমে যাতায়াত অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। ৮৫ বছর বয়স্ক সাহিত্যের এই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এখন মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরের জন্য গ্রন্থাগারের রিডিং রুমে ঢোকার অনুমতি পাননি তিনিও।
২০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের প্রকাশ করা একটি নির্দেশিকা নিয়ে এখন রীতিমতো ক্ষোভ গ্রন্থাগারের নিয়মিত পাঠকদের মধ্যে। ওই নির্দেশিকায় গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক কে কে কোচুকোশি জানিয়েছেন, ২৩ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রক গ্রন্থাগারের বেলভেডিয়ার হাউসে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছে। ওই সেমিনারের আগত ‘ভিভিআইপি’দের নিরাপত্তার জন্য ২২ ও ২৩ জানুয়ারি রিডিং রুম পাঠকদের জন্য বন্ধ রাখা হবে। করোনা সংক্রমণ রুখতে বহু দিন বন্ধ থাকার পর জাতীয় গ্রন্থাগার খোলা হলেও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের জারি করা নিরাপদ দূরত্ব-বিধি বজায় রাখতে পাঠকদের প্রবেশের উপর এমনিতেই যথেষ্ট কড়াকড়ি করা হয়েছে এখানে। এখন পাঠকদের আসার অন্তত ২৪ ঘণ্টা আগে অনলাইনে গ্রন্থাগারে ঢোকার অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু শুক্রবার রিডিং রুমে আসার অনলাইন অনুমতি পাননি কেউই।
গ্রন্থাগারের পুরোনো পাঠকদের একাংশের মনে পড়েছে ২০০৫-এর জানুয়ারির স্মৃতি। সেবার গ্রন্থাগারে একটি বণিকসভার সম্মেলনে অতিথি হিসাবে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। তাঁর নিরাপত্তার কারণে সেই সময় রিডিং রুম কিছুক্ষণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। এই কথা জানার পর পাঠকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন মনমোহন। ওই বছরেরই শেষে ফের জাতীয় গ্রন্থাগারে একটি সেমিনারে আসার কথা হয় প্রধানমন্ত্রীর। এবার তিনি সরাসরি সেমিনারের স্থান পরিবর্তনের জন্য নির্দেশ দেন। ২০০৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম জাতীয় গ্রন্থাগার পরিদর্শনে আসেন। কিন্তু সেই সময়ও রিডিং রুম পুরোদস্তুর চালু ছিল। গ্রন্থাগারের বর্ষীয়ান পাঠক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় অতীতের এই উদাহরণ দিয়ে বলছেন, ‘আমি যা শুনেছি তাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেমিনার হবে বেলভেডিয়র হাউসে। তা হলে ভাষা ভবনটি কেন দু’দিন বন্ধ রাখা হলো, জানি না!’
গ্রন্থাগারের পাঠিকা জয়ন্তী মুখোপাধ্যায় ‘সমকালীন সংবাদপত্রে শ্রীঅরবিন্দ’ বিষয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেন, ‘করোনার জন্য গ্রন্থাগারে আমরা সপ্তাহে দু’দিনের বেশি যাওয়ার অনুমতি পাই না। তাতেই কাজের যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ অন্য কোনও উপায় ভাবতে পারতেন।’ গ্রন্থাগার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, ‘যখন পুরোনো বাড়ি থেকে ভাষা ভবনে লাইব্রেরি চলে গেল, তখনও একদিনের জন্যও রিডিং রুম বন্ধ থাকেনি। অতীতে অনেকে এসেছেন, তখনও হয়নি। এখন কেন? আর নেতাজীর জন্মদিনের সঙ্গে ন্যাশনাল লাইব্রেরির কী সম্পর্ক এটা বুঝলাম না। নেতাজীর বাড়িই তো রয়েছে!’ আবার পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী জাতীয় গ্রন্থাগার বন্ধ রাখার এই সিদ্ধান্তকে ‘স্বেচ্ছাচার’ বলে উল্লেখ করেছেন। ‘এর পিছনে কোনও যুক্তি নেই, আছে খালি স্বেচ্ছাচার। এর পরিণতি ভয়ানক।’ এমনটাই জানিয়েছেন তিনি।