একুশের বিধানসভা ভোটের আগেই ডুয়ার্সের ‘টাইগার’কে টেনে নিয়েছে শাসকদল তৃণমূল। সোমবার ভারতীয় মূলনিবাসী আদিবাসী বিকাশ পরিষদের সেন্ট্রাল কমিটির প্রেসিডেন্ট রাজেশ লাকড়া তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূল ভবনে তাঁর হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেন রাজ্যের শ্রম ও আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক ও দলের রাজ্য সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। লাকড়ার যোগদানের পরই তৃণমূল দাবি করেছে, এই যোগদানের ফলে চা বাগান শ্রমিকদের মধ্যে তৃণমূলের সংগঠন আরও শক্তিশালী হবে।
উল্লেখ্য, শুধুই চা বাগান নয়, রাজেশের তৃণমূলে যোগদানে গোটা তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলেই রাজ্যের শাসক দলের ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। উত্তরবঙ্গে তরাই-ডুয়ার্সে ব্যাপক প্রভাব ভারতীয় মূলনিবাসী আদিবাসী বিকাশ পরিষদের। এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ রাজেশ। তিনি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতিও। ডাকাবুকো স্বভাবের জন্য এলাকায় তাঁকে টাইগার নামে ডাকা হয়। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে চা বাগান শ্রমিকদের উন্নয়ন করেছেন, মূলত তা দেখেই তৃণমূলে যোগ দিলেন মমতায় মুগ্ধ লাকড়া।
নব্বইয়ের দশকে ছাত্রাবস্থায় সিপিআইএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রাজেশ। তারপর সিটুতে কাজ শুরু করেন। চা বাগানে শ্রমিক আন্দোলনের একেবারে প্রথম সারির নেতা টাইগার প্রথম প্রচারে আসেন ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ। গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে পাহাড় ছাড়িয়ে আন্দোলনের আঁচ এসে পৌঁছয় তরাই-ডুয়ার্সে। বিমল গুরুংরা দাবি করেন, তরাই-ডুয়ার্স গোর্খাল্যান্ডের অংশ। আগুন জ্বলে ওঠে অবিভক্ত জলপাইগুড়ি জেলায়।
গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই শুরু হয় স্থানীয় আদিবাসীদের। সেই সময় আদিবাসীদের হয়ে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন আদিবাসী বিকাশ পরিষদ নেতা রাজেশ লাকরা।
বাংলা ভাগ রুখতে বদ্ধপরিকর আদিবাসীদের এক ছাতার তোলায় এনে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করেন টাইগার। তরাই-ডুয়ার্সের দাবি থেকে মোর্চা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তারপর থেকে যখনই রাজ্য ভাগের দাবি উঠেছে টাইগারের নেতৃত্বে শক্তিশালী গণ আন্দোলন গড়ে উঠেছে তরাই-ডুয়ার্সে। বিগত ১ দশক ধরে আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ির চা বাগান এলাকায় রাজেশ লাকরার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এবার সেই জনপ্রিয়তার ফসল ঘরে তুলতে চলেছে তৃণমূল। ২০০৬ সালে আদিবাসী বিকাশ পরিষদের প্রথম সারির নেতা হিসেবে উঠে আসনে রাজেশ। পরবর্তীতে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ ছেড়ে তৈরি করেন ভারতীয় মূলনিবাসী আদিবাসী বিকাশ পরিষদ। সোমবার তা মিশে গেল তৃণমূলের সঙ্গে।
উল্লেখ্য, গত ৬ মাস ধরে উত্তরবঙ্গে সংগঠনের কাজ করছেন ঋতব্রত। এদিকে, রাজ্যের শ্রম ও আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক বিগত ১ বছরে প্রতি মাসে ২ বার করে উত্তরবঙ্গে সংগঠনের কাজে যান। মূলত তাঁর কৃতিত্বে এবং শ্রমমন্ত্রকের মধ্যস্থতায় গত ৮ মাসে ৯টি বন্ধ চা বাগান খুলেছে। এছাড়াও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মস্তিষ্কপ্রসূত চা-সুন্দরী প্রকল্পের সৌজন্যে কমপক্ষে ৩ লক্ষ গৃহহীন শ্রমিক পাকা বাড়ি পাচ্ছেন।
প্রথম পর্যায়ে সেই বাড়ির সংখ্যা ৫ হাজারের কাছাকাছি। যা আর কিছুদিনের মধ্যেই শ্রমিকদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। মলয়-ঋতব্রতর এই ‘টিমওয়ার্ক’ চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাঁরা স্বভাবতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই থাকতে চাইছেন। সূত্রের খবর, বিগত কয়েকমাসে এই উত্তরবঙ্গ সফরের মধ্যেই রাজেশ লাকড়ার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসেছিলেন মন্ত্রী মলয় ঘটক। সেই বৈঠকগুলিতে হাজির ছিলেন ঋতব্রতও। বৈঠকগুলি যে বিফলে যায়নি, এদিনের যোগদান তারই প্রমাণ।
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, রাজেশ লাকরা তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় তরাই-ডুয়ার্সে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়াতে পারবে তৃণমূল। লোকসভা ভোটে এই এলাকার সবকটি আসনেই বিপুল ভোটে পিছিয়ে তৃণমূল। কিন্তু টাইগারের যোগদানের জেরে এই সমীকরণে বিরাট বদল আসবে বলে আশাবাদী তৃণমূল। কুমারগ্রামের লুইস কুজুরও কিছুদিন আগে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এবার এলেন টাইগার। ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুরনো যোগাযোগ আর মলয় ঘটকের ক্ষুরধার মস্তিস্ক- এই দুইকে কাজে লাগিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চলে তৃণমূল যে নির্বাচনের আগে একপ্রকার বাজিমাত করল, তা বলাই বাহুল্য।