১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে, নয় মাস ব্যাপী ইউরোপের বৈজ্ঞানিক মিশন শেষ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন জগদীশচন্দ্র। ইউরোপে তাঁর বৈজ্ঞানিক সাফল্যের কাহিনী কলকাতার সংবাদপত্রেও প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় বিজ্ঞানীর ইউরোপ জয়ের কাহিনী বাঙালির জন্য তো বটেই, যে কোন ভারতীয়র জন্য গৌরবের। বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করা এই বিজ্ঞানীর সাথে পরিচিত হয়ে অভিনন্দন জানানোর জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিদেশ থেকে ফিরে জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু তখন থাকতেন ধর্মতলা স্ট্রিটে আনন্দমোহন বসুর বাড়িতে। একদিন রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রের সাথে দেখা করার জন্য গেলেন সেই বাড়িতে। অভিনন্দন জানানোর জন্য সাথে নিয়ে গেলেন একটি ম্যাগনোলিয়া ফুল। কিন্তু জগদীশচন্দ্র তখন ভীষণ ব্যস্ত, বাড়িতে ছিলেন না সেই সময়। রবীন্দ্রনাথ টেবিলের উপর ম্যাগনোলিয়া ফুলের তোড়া ও একটা চিরকুটে একটা কবিতা রেখে চলে আসেন। ইউরোপের প্রথম বৈজ্ঞানিক মিশনের সাফল্যে সেই চিরকুটে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের প্রতি’ শিরোনামে কবিতা –
“বিজ্ঞান-লক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিমমন্দিরে
দূর সিন্ধুতীরে,
হে বন্ধু, গিয়েছ তুমি; জয়মাল্যখানি
সেথা হতে আনি
দীনহীনা জননীর লজ্জানত-শিরে,
পরায়েছ ধীরে।”
তারপর তাঁদের দু’জনের মধ্যে পরিচয় কীভাবে গাঢ় হলো এবং কীভাবে তা বন্ধুত্বে পরিণত হলো তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসেব নেই। জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক সাফল্যকে তুলে ধরার জন্য বারে বারে কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বের সূচনাকালের নিদর্শন পাওয়া যায় লন্ডন থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্রের চিঠিতে। ১৯০০ সালের ২রা নভেম্বর তিনি লিখেছিলেন –
“তিন বৎসর পূর্বে আমি তোমার নিকট এক প্রকার অপরিচিত ছিলাম। তুমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ডাকিলে। তারপর একটি একটি করিয়া তোমাদের অনেকের স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ হইলাম। তোমাদের উৎসাহ-ধ্বনিতে মাতৃস্বর শুনিলাম।”
প্রথমবার দেখা করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্রের দেখা পাননি রবীন্দ্রনাথ। দ্বিতীয়বার যখন দেখা করতে যান সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ন’বছরের শিশুপুত্র রথীন্দ্রনাথকে। এ প্রসঙ্গে ‘আচার্য জগদীশচন্দ্র আমার বাল্যস্মৃতি’ প্রবন্ধে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন –
“আমি তখন ন-বছরের শিশু, তবু কেন জানি না, পিতা আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই বন্ধুতে কী কথাবার্তা হয়েছিল তা বুঝতে পারা বা মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, এইটুকুই কেবল মনে পড়ে। জগদীশচন্দ্র উচ্ছ্বসিত ভাবে ইওরোপ-ভ্রমণের কাহিনী অনর্গল বলে যাচ্ছেন আর আমার পিতা সাগ্রহে তা শুনছেন এবং মাঝে মাঝে দুজনে মিলে খুব হেসে উঠছেন।”
প্রবাসী পত্রিকায় ১৩৩৩ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথকে লেখা জগদীশচন্দ্রের চিঠিগুলো যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে তখন তার ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
“সেই তার ধর্মতলার বাসা থেকে আরম্ভ করে আমাদের নির্জন পদ্মাতীর পর্যন্ত বিস্তৃত বন্ধুলীলার ছবি।”
কবি ও বিজ্ঞানীর দুর্লভ মিলনকে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
“চলা আর পথ বাঁধা এই দুই উদ্যোগের সব্যসাচিতায় জীবন ছিল সদাই চঞ্চল। এমন সময়ে জগদীশের সঙ্গে আমার প্রথম মিলন। তিনি তখন চূড়ার উপরে উঠেননি। পূর্ব উদয়াচলের ছায়ার দিক্টা থেকেই ঢালু চড়াই পথে যাত্রা করে চলেছেন, কীর্তি-সূর্য আপন সহস্র কিরণ দিয়ে তাঁর সফলতাকে দীপ্যমান করে তোলেনি। তখনো অনেক বাধা, অনেক সংশয়। কিন্তু নিজের শক্তিস্ফুরণের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের যে আনন্দ সে যেন যৌবনের প্রথম প্রেমের আনন্দের মতই আগুনে ভরা, বিঘ্নের পীড়নে দুঃখের তাপে সেই আনন্দকে আরো নিবিড় করে তোলে। প্রবল সুখদুঃখের দেবাসুরেরা মিলে অমৃতের জন্য যখন জগদীশের তরুণ শক্তিকে মন্থন করছিল, সেই সময় আমি তার খুব কাছে এসেছি।”
রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের পর জগদীশচন্দ্র আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে বাস করেছিলেন বেশ কিছুদিন। সেই বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে জগদীশচন্দ্রের। রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ডাক্তার নীলরতন সরকার, লোকেন পালিত প্রমুখ এই বাড়িতে নিয়মিত আসতেন। রবীন্দ্রনাথ একাধিক চিঠিতে এই সার্কুলার রোডের বাড়িতে জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুর বন্ধুত্বপূর্ণ সাহচর্যের উল্লেখ করেছিলেন। ইংল্যান্ড-প্রবাসী জগদীশচন্দ্রকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
“কলকাতায় আমার সুখ নেই। পূর্বে এখানে যখন আসতুম তোমাদের ওখানেই সর্বপ্রথম ছুটে যেতুম। এবারে সেরকম আগ্রহের সঙ্গে কোনখানে যাবার নেই। আজ প্রভাতেই তোমার চিঠিখানি পেয়ে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হলো। তোমার সেই ছোট ঘরটি থেকে তোমার আলাপ গুঞ্জন যেমন আমি হৃদয়ে পূর্ণ করে নিয়ে আসতুম নিজেকে আজও সেই রকম পূর্ণ বোধ করচি।”
আরেকটি চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন –
“তোমার সার্কুলার রোডের সেই ক্ষুদ্র কক্ষটি এবং নীচের তলায় মাছের ঝোলের আস্বাদন সর্বদাই মনে পড়ে।”
দেশে পল্লীশিল্প পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে রেশম শিল্পের ব্যাপারে উৎসাহী হন রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহের বাড়িতে তিনি রেশম-কীটের চাষ শুরু করেন। তাঁর উৎসাহে জগদীশচন্দ্র তাঁর সার্কুলার রোডের বাড়িতে রেশম-কীটের চাষ শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথের রেশম-চাষে সহায়তা করতেন তাঁর ছেলেমেয়েদের গৃহশিক্ষক লরেন্স। কিন্তু জগদীশচন্দ্রকে সাহায্য করার কেউ ছিল না। তিনি রেশম-চাষে তেমন সুফল পাচ্ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথকে এ ব্যাপারে তিনি লিখেছিলেন –
“কয়দিন হইল একটি প্রজাপতি সুস্থ শরীরে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল। তাহার পর ২/৩টি অর্ধমৃত অবস্থায় জন্মিয়াছে, আর কয়টি অর্ধেক বাহির হইয়া রহিয়াছে। এরূপ অবস্থায় কী করিতে হইবে জানি না। যে একটি সুস্থ শরীরে বাহির হইয়াছিল, তাহাকে কী আহার দিতে হইবে জানি না। অনেক পুষ্প সংগ্রহ করিয়া দিয়াছি, কিন্তু মধু সঞ্চয় করিতে তাহার কোন আগ্রহ নাই। কোন বন্ধু আমের চাট্নি দিতে বলিয়াছেন।”
পরে শিলাইদহে বেড়াতে গিয়ে রেশম-কীট পালনের তত্ত্বাবধায়ক লরেন্স সাহেবের সাথে আলোচনা করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। সেখান থেকে ফিরে এসে রবীন্দ্রনাথকে তিনি লিখেছিলেন –
“প্রজাপতিগুলি এখনও জন্মগ্রহণ করে নাই। গত শনিবার হইতে প্রত্যহ গুটিগুলিকে নাড়িয়া দেখিতেছি, ভিতরে যেন পূর্ণতর হইয়া আসিতেছে। আশঙ্কা হয়, এত ঘন ঘন কম্পনে প্রাণবায়ু হয়ত বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহা হইলেও একরূপ নিশ্চিন্ত হইতাম, কারণ যে এরন্ড বৃক্ষের কথা বলিয়াছিলাম তাহার পাতাগুলি একেবারে নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে। সুতরাং এই দুর্ভিক্ষের সময় সহসা প্রজাবৃদ্ধি মনে করিয়া ভীত আছি। বিশেষত লরেন্স সাহেবের নিকট আমি কি করিয়া মুখ দেখাইব জানি না।”
জমিদারি দেখার কাজে প্রায়ই শিলাইদহে যেতেন রবীন্দ্রনাথ। শীতের সময় পদ্মায় বোটে বসে লিখতেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময় প্রতি শনিবার রবীন্দ্রনাথের অতিথি হয়ে সেখানে যেতেন জগদীশচন্দ্র। তাঁর জন্য একটা বজরা সবসময় প্রস্তুত থাকতো সেখানে। দু’রাত শিলাইদহে কাটিয়ে সোমবার সকালে কলকাতা ফিরতেন জগদীশচন্দ্র। সেই সময় রবীন্দ্রনাথকে ছোটোগল্প লেখার উৎসাহ দিতেন তিনি। অনেকটা জোরই করতেন বলা চলে। প্রতি শনিবার একটা করে নতুন গল্প লিখতে হতো তাঁর জন্য। ঠিক ঠিক বন্ধুদের সঙ্গ পেলে রবীন্দ্রনাথ উদ্দীপিত হয়ে উঠতেন, তাঁর নতুন নতুন রচনার স্ফূর্তি আসত। বন্ধুদের অনুরোধ মতনও তাঁকে বিচ্ছিন্ন আঙ্গিকে লিখতে হত। যেমন জগদীশ বোস শিলাইদহে এসেই তাঁকে বলতেন, ‘‘বন্ধু, আজ সন্ধেবেলা কিন্তু একটা গল্প শোনাতে হবে। নতুন গল্প চাই।’’ এর ফলে রবীন্দ্রনাথের অনেক ছোটগল্প লেখা হয়ে গিয়েছিল। কাহিনীমূলক কবিতা শুনতেও ভালোবাসতেন জগদীশ, তাই তাঁর অনুরোধে রবীন্দ্রনাথের কলমেও এসে গিয়েছিল বিভিন্ন আখ্যান অবলম্বনে কবিতা। একবার উড়িষ্যা যাবার সময় নৌকায় বসে এক ঝড়ের রাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘দেবতার গ্রাস’, আর সেটা লেখার পরই তাঁর মনে হয়েছিল এটা জগদীশকে শোনাতে হবে। তারপর লেখা হয়েছিল ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’। এরকম আরও।
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রও তখন জড় ও উদ্ভিদ সম্পর্কে ঝুঁকেছিলেন, কবি তাঁর কাছ থেকে সেই সব বিষয়ে শুনতে চাইতেন। আর জগদীশচন্দ্র কলেজের ছুটি হলেই সেখানে চলে আসেন সাহিত্য রস-তৃষ্ণা মেটাতে। রবীন্দ্রনাথের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও তাঁর বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। বেশি রাত্রে পানাহারের সময়টুকু বাদে, অন্যান্য সময় সাহিত্যের আড্ডায় রবীন্দ্রনাথ ছেলেমেয়েদের দূরে সরিয়ে রাখতেন না। তিনি চাইতেন তাঁর সন্তানরাও শুনুক, শিখুক, যতটা বুঝতে পারে বুঝুক। তিনি নিজেই বলতেন, এখন সবটা না বুঝলেও পরবর্তী জীবনে এই সব কথা ওদের মনে পড়বে।
বালক রথীন্দ্রনাথও শিলাইদহে যেতেন মাঝে মাঝে। কলকাতায় ল্যাবরেটরিতে জড় পদার্থ, গাছপালার বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও শিলাইদহ এসে জগদীশচন্দ্র মেতে উঠতেন কচ্ছপের ডিম খোঁজায়। সেখানে কচ্ছপ ছিল প্রচুর, তারা নদী থেকে উঠে এসে উঁচু ডাঙায় বালি খুঁড়ে ডিম পেড়ে যেত। ঠাকুর বাড়ির লোকেরা কচ্ছপের মাংস কিংবা ডিম খেতে জানতেন না, কিন্তু জগনীশচন্দ্র ছিলেন পূর্ববঙ্গীয়, তিনি তো ওসব খেতে ভালবাসেনই, এমনকি তিনি রবীন্দ্রনাথের বাড়ির সবাইকে সেই উত্তম খাদ্যের স্বাদে দীক্ষা দিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথকে তিনি শিখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে কচ্ছপের ডিমের সন্ধান পেতে হয়। বিজ্ঞানী হিসেবে দেশবিদেশে যাঁর নাম ছড়িয়েছিল, তিনি সেখানে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে, খালি পায়ে, হাতে একটা খুরপি নিয়ে বালির মধ্যে ঘুরে বেড়াতেন। নদী থেকে কচ্ছপগুলো যখন উঠে আসত তখন বালির ওপর তাদের পায়ের ছাপ পড়ত। সেই ছাপ অনুসরণ করতে করতে গেলে এক জায়গায় দেখা যেত, সেই ছাপ থেমে গেছে। লোকচক্ষুর আড়াল দেবার জন্য কচ্ছপরা সেখানে গর্ত খুঁড়ত, সেই গর্তের মধ্যে ডিম পেড়ে আবার বালি চাপা দিয়ে দিত। সারাদিন রোদের তাপে বালি উত্তপ্ত হয়ে থাকত, তাতেই আস্তে আস্তে ডিম ফুটত। জগদীশচন্দ্র রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে বসে খুরপি দিয়ে বালি খুঁড়তেন। প্রচুর কচ্ছপের ডিম পাওয়া যেত। একদিন রথীন্দ্রনাথ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা মনোযোগ দিয়ে বালি খুঁড়ছিলেন, এমন সময় পেছনে খসখস শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেছিলেন, দুটো শেয়াল এসে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। জগদীশচন্দ্র হেসে রথীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, ‘‘ভয় পাসনি। আমরা যে-জন্য এসেছি, ওরাও সেই জন্য আসে। মানুষ আর কটা ডিম পায়, এই শেয়ালই কচ্ছপের ডিম বেশি চুরি করে। আমরা চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে এসেছি।’’ এক একদিন তাঁদের আরও উপরি লাভ হত। ডিম খুঁজতে গিয়ে কচ্ছপ মাতাকেও তাঁরা দেখতে পেতেন। কচ্ছপের কামড় অতি ভয়ংকর, একবার আঙুল কামড়ে ধরলে মেঘ না ডাকলে নাকি ছাড়ে না। কিন্তু জগদীশচন্দ্রের সাথে থেকে রথীন্দ্রনাথও একটা সময়ে কচ্ছপ ধরায় পারদর্শী হয়ে গেছে। তিনি শিখেছিলেন, পেছন দিক থেকে কচ্ছপটাকে একবার উল্টে দিতে পারলেই সে একেবারে অসহায়, চিত হওয়া কচ্ছপ কিছুতেই আর উপুড় হতে পারে না, তখন অনায়াসেই তাকে বেধে ফেলা যায়। এছাড়া জগদীশচন্দ্র ভালোবাসতেন পদ্মার চরে বালির মধ্যে শরীর ডুবিয়ে শুয়ে থেকে গরমে আধসেদ্ধ হবার পর পদ্মার জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তিনি বলতেন, “পদ্মাচরের মতো এমন সুন্দর স্বাস্থ্যকর স্থান পৃথিবীতে কোথাও নেই।”
এছাড়া সেখানে সাহিত্যপাঠ ও সঙ্গীতের আসর বসত সন্ধের পর। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মাঝে মাঝে আসতেন, তাঁর হাসির গানের ভান্ডার ছিল অফুরন্তু, তিনিই সেদিন মাতিয়ে রাখতেন, সেই সব দিনে রবীন্দ্রনাথ নিজে গান করতেন না। অন্যান্য দিনে গল্প-কবিতা ও আড্ডার পর রবীন্দ্রনাথকে গান গাইতেই হত। পদ্মাবোটের ছাদে চাঁদের আলোয় সেই গানের লহরীতে বাতাস ভরে যেত। সঙ্গে কোনও বাদ্যযন্ত্র থাকত না, নাটোরের মহারাজ উপস্থিত থাকলে তিনি শুধু পাখোয়াজে সঙ্গত করতেন। রবীন্দ্রনাথের ভরাট গলায় গান শোনার জন্য দুর দূর নৌকোর মাঝিরাও কাজ থামিয়ে দিতেন। জগদীশচন্দ্রের কয়েকটি প্রিয় গান ছিল, তিনি সেগুলি শুনতে চাইতেন বারবার। রবীন্দ্রনাথ নতুন গানও শোনাতেন মাঝে মাঝে। বেশির ভাগ দিনই আগে থেকে ঠিক করা থাকত না, যে-গানটা মনে আসত, রবীন্দ্রনাথ সেটাই ধরে ফেলতেন। এমনই একদিন রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন, ‘ওগো কাঙাল, আমারে কাঙাল করেছ, আরো কী তোমার চাই।’ বেশ গেয়েও চলেছিলেন আপন মনে, হঠাৎ অন্তরায় এসে, ‘আমি আমার বুকের আঁচল ঘেরিয়া তোমারে পরানু বাস’ এ পর্যন্ত গেয়ে থেমে গিয়েছিলেন। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসেছিলেন মুখ তুলে। উপস্থিত সবাই উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। জগদীশচন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘থামালে কেন বন্ধু? বড় খাসা গান, বুকে ঘা দেয়।’’ রবীন্দ্রনাথ লাজুকভাবে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ভুলে গেছি।’’ জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘নিজে লিখেছ, তবু ভুলে গেছ?’’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘কথা মনে আছে। কিন্তু সুরটা, আমি নিজেই বুঝতে পারছি, অন্তরায় অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।’’ জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। সুরটা তো ভৈরবী!’’ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘অন্য সুরেও গেয়ে নিতে পারতুম। কম গান তো লেখা হল না। এখন সব সুর নিজের মনে থাকে না। এখন সুর বেঁধেই চট করে অন্য কারুকে শিখিয়ে দিতে পারলে ভাল হয়।’’ এরপরে রথীন্দ্রনাথের উপরে ভার পড়েছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলাকে ডেকে নিয়ে আসার। অমলা তখন সেখানেই থাকতেন, তিনি ছিলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর অন্তরঙ্গ বান্ধবী। তবে অমলা আসার আগেই জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন সেই গানের সুর।
(তথ্যসূত্র:
১- প্রবাসী, আষাঢ়, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ, পৃ-৪১২।
২- পত্র পরিচয়, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।
৩- চিঠিপত্র, ষষ্ঠ খন্ড, পৃ- ১৫।
৪- আচার্য্য জগদীশচন্দ্র, ডক্টর শ্রী ফণীন্দ্রনাথ বসু।
৫- বিজ্ঞানসাধক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ড. ডি সি হাজারী, মাতৃভূমি প্রকাশনী (২০১৫)।
৬- আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, মনি বাগচি, চারুলিপি প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত