১৯৬২ সালের ২৮শে নভেম্বর ৬৯ বছর বয়সে ভারতীয় সঙ্গীত জগতের এক মহীরুহের পতন ঘটেছিল। যিনি না থাকলে সঙ্গীতপ্রেমীরা হয়ত সঙ্গীতের অপর এক কিংবদন্তী ‘মান্না দে’কে পেতেন না। একই সঙ্গে, তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে সঙ্গীত সাধনার এক বর্ণময় যুগও বিলীন হয়ে গিয়েছিল মহাসিন্ধুর ও পারে। মানুষটির নাম – কৃষ্ণচন্দ্র দে।
কৃষ্ণচন্দ্র সম্পর্কে একটি স্মৃতিচারণায় পরিচালক ‘অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়’ জানিয়েছিলেন, প্রবীণ বয়সে এক বার একটি গান রেকর্ড করানো হয় তাঁকে দিয়ে। গানটি কর্তৃপক্ষের পছন্দ না হওয়ায়, আবার সেটি ‘হেমন্ত মুখোপাধ্যায়’কে দিয়ে নতুন করে গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হেমন্ত জানতেন না, গানটি আগে কৃষ্ণচন্দ্র গেয়েছেন। কিন্তু রেকর্ডিংয়ের আগে কোনও ভাবে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন এবং আগের রেকর্ডিংটি শুনতে চান। কৃষ্ণচন্দ্রের গাওয়া গানটি তাঁকে শোনানো হলে, তিনি কিছু ক্ষণ নিবিষ্ট মনে বসে থাকেন এবং শেষে বলেন, যে গান আগে কৃষ্ণচন্দ্রবাবু গেয়েছেন, সে গান তিনি কিছুতেই গাইতে পারবেন না।
মঞ্চের গান আর রেকর্ডের গান আলাদা আলাদা শৈলীতে গাইতেন কৃষ্ণচন্দ্র। এও শিল্পী হিসেবে তাঁর বাস্তববোধ এবং অন্তর্দৃষ্টির পরিচয়। ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’ নামক গ্রন্থে ‘সুধীর চক্রবর্তী’ লিখেছেন, কৃষ্ণচন্দ্র দে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে ‘ঘন তমসাবৃত অম্বর ধরণী’ গাইতেন ‘টিপিকাল নাটুকে’ ভঙ্গিতে, ‘একেবারে মঞ্চ কাঁপিয়ে’। আবার রবীন্দ্রনাথের ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’ গানটি রেকর্ডে গেয়েছিলেন অন্য ভাবে, আত্মনিবেদনের আর্তি মিশিয়ে।
… ‘‘ভবের খেয়া এবার বাওয়া হইল আমার শেষ;
এবার তরী ভাসিয়ে দিলাম পরপারের দেশ।।’’ …
কৃষ্ণচন্দ্র ‘জন্মান্ধ’ ছিলেন না। প্রথম শৈশবে তিনি আর পাঁচটি শিশুর ন্যায় ছিলেন। তারপরে হঠাৎই একদিন এক দুর্বিপকে তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর চোখের দৃষ্টি। বড়ই করুন সেই আখ্যান। তখন গ্রীষ্মের ছুটি ছিল। সিমলে পাড়ার কৃষ্ণচন্দ্র ওরফে ‘বাবু’ সকাল থেকেই বাড়ির ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে ব্যস্ত ছিল। মাঝেমাঝে ছেলের উপরে বিরক্ত হয়েই মা বলতেন, ‘‘ছেলেটার ওই এক মহাদোষ! সারা দিন শুধু ঘুড়ি আর ঘুড়ি।’’ কাঠফাটা রোদ যখন আকাশটাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, সেই জ্বলন্ত আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে ঘুড়ি ওড়ানোয় মত্ত ছিল তেরো বছরের সেই কিশোর। এমনই একদিন বিকেলে ছাদ থেকে নেমে এসে মা’কে কৃষ্ণচন্দ্র বলেছিলেন, চোখটা কেমন জ্বালা জ্বালা করছে। সব কিছুই কেমন ঝাপসা দেখছেন। ডাক্তার দেখানো হল। ক্রমেই তার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দেখানো হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, চোখের যা অবস্থা, তাতে অন্ধ হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবুও চোখের ড্রপ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রাতে শোয়ার আগে চোখে দিতে। তবুও যা হওয়ার তাই-ই হয়েছিল! রাতে শোয়ার আগে চোখের ড্রপ দেওয়ার পরেই কৃষ্ণচন্দ্র আর চোখে দেখতে পেলেন না। পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। আকস্মিক তাঁর দু’চোখে নেমে এসেছিল অন্ধকার! সারা জীবন পরনির্ভরশীল এবং সহানুভূতির পাত্র হয়েই কাটাতে হবে ভেবে মেধাবী, ডানপিটে কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন এক অন্তহীন তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। এ ভাবেই দিন কাটছিল ভয়ঙ্কর বিষণ্ণতায়।
কিন্তু যার প্রতিভা প্রায় সীমাহীন, তাঁকে রুখবে কে?
ছোট থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র একটি বিশেষ গুণের অধিকারী ছিলেন। যে কোনও গান এক বার শুনলে হুবহু তা গাইতে পারতেন। সে সময়ে সিমলে পাড়ায় খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাইতে আসতেন বৈষ্ণব ভিক্ষুকরা। সে দিনও তাঁরা এসেছিলেন। সদ্য দৃষ্টিশক্তি হারানো কৃষ্ণচন্দ্রের কানে সেই সুর যেতেই তিনি কেমন অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সারা শরীরে অনুভব করেছিলেন শিহরন। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাড়ির দরজা খুলে সেই বৈষ্ণব ভিক্ষুককে বাড়ির ভিতরে নিয়ে এসে বলেছিলেন পুরো গানটি গাইতে। সেই গান শুনে তাঁর মুখে ফুটে উঠেছিল এক স্বর্গীয় তৃপ্তি। তার পরে নিজেই গাইতে লাগলেন সেই গান। সে দিন হয়তো কেউ অনুমান করতে পারেননি যে, পরবর্তীতে সেই দৃষ্টিহীন কিশোরই হয়ে উঠবেন দেশের এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সুরসাধক।
সিমলে পাড়ার মদন ঘোষ লেনে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল ২৪শে অগস্ট ১৮৯৪ (মতান্তরে ১৮৯৩) সালে। জন্মাষ্টমীতে জন্ম বলেই তাঁর নামকরণ হয়েছিল ‘কৃষ্ণচন্দ্র’। তাঁর বাবা ‘শিবচন্দ্র দে’ এবং মা ‘রত্নমালা দেবী’। মা লক্ষ করেছিলেন ছেলের সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ। তাই মায়ের উৎসাহেই শুরু হয়েছিল তাঁর সঙ্গীতচর্চা। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র আঁকড়ে ধরেছিলেন সঙ্গীতকে। প্রথমে ‘নাড়া’ বেঁধেছিলেন সে কালের বিখ্যাত খেয়ালিয়া ‘শশীভূষণ দে’-র কাছে। এর পরে টপ্পার শিক্ষা নিয়েছিলেন ‘সতীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের’ কাছে। পরবর্তী সময়ে কৃষ্ণচন্দ্র সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন ‘কেরামতুল্লা খান’, ‘বদল খান’, ‘দবির খান’, ‘জমিরউদ্দিন খান’ এবং ‘মহেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের’ কাছে। এ ছাড়াও কীর্তন শিখেছিলেন ‘রাধারমণ দাসের’ কাছে। তিনি ‘কণ্ঠে মহারাজের’ কাছে তবলাও শিখেছিলেন। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং তেজস্বী ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। যে কোনও কাজে দক্ষ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত তা শেষ করতেন না। পরবর্তী সময়ে হিন্দি ও উর্দু উচ্চারণ সঠিক করার জন্য তিনি মৌলবির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। চোখের জ্যোতি হারালেও ক্রমেই সজাগ হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রের ‘মানসনেত্র’।
সে কালের বহু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মতোই ‘নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের বেচারাম চন্দ্রের বাড়ি’তেও বসত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। ১৯১৬ নাগাদ সেই বাড়িতেই আয়োজিত এক আসরে ছিলেন ‘কেরামতুল্লা খান’, ‘আবিদ হুসেন খান’ আর ছিলেন এক তরুণ বাঙালি শিল্পী। গৌরবর্ণ, পরিপাটি বেশভূষা, সুশ্রী, সুগঠিত দেহ, কিন্তু বিবর্ণ পলকহীন দু’টি চোখ। তাঁকে আসরে নিয়ে এসেছিলেন ‘কেরামতুল্লা খান’। এক সময় কেরামতুল্লা তাঁকে গান শুরু করতে বলেছিলেন। সে দিন খেয়াল গেয়ে আসর মাতিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেই থেকেই কলকাতা এবং মফস্বলের বিভিন্ন আসরে তিনি আমন্ত্রণ পেতে থাকেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় এইচ এম ভি থেকে। ‘হরেন শীলের বাড়ি’তে গ্রামোফোন কোম্পানির ‘ভগবতীচরণ ভট্টাচার্য’ তাঁর গান শুনেছিলেন। তিনিই কৃষ্ণচন্দ্রকে গান রেকর্ড করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। গান দু’টি ছিল ‘আর চলে না চলে না মোগো’ এবং ‘মা তোর মুখ দেখে কি’। পরবর্তী কালে তিনি যখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে, গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রতি মাসে একটি করে রেকর্ড বেরোত। ১৯১৭ সনে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়, তারপরের নিস্তরঙ্গ ছয়টি বছর যায় সঙ্গীত সাধনায়। এরপর সঙ্গীতে ‘ম্যাচিউরড’ কৃষ্ণচন্দ্রের আবির্ভাব হয়, অপর প্রবাদপুরুষ, ‘শিশির ভাদুড়ি’র থিয়েটারে। শুরু হয় গান ও অভিনয় দিয়ে থিয়েটার জয়। একের পর এক নাটক সফল হতে থাকে অন্ধ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গীত ও অভিনয়ের উপর ভর করে।
কৃষ্ণচন্দ্রের গলায় ছিল এক ঐশ্বরিক আকর্ষণ। এমন দরাজ অথচ মিষ্টি গলা সঙ্গীত জগতে খুব কম শিল্পীই পেয়েছিলেন। তাঁর গানে একাধারে যেমন ছিল এক পুরুষালি বলিষ্ঠতা, তেমনই মিষ্টতা। শুধু ‘রাগসঙ্গীত’ নয়, ‘আধুনিক বাংলা গানে’ও কৃষ্ণচন্দ্র বৈচিত্র দেখিয়েছিলেন। ‘পঙ্কজকুমার মল্লিকের’ কথায়, ‘‘সে যুগের শ্রেষ্ঠ পুরুষ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে।’’ কালক্রমে কৃষ্ণচন্দ্র নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতিষ্ঠান।
কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন দরদি মনের মানুষ। সৌম্যকান্তি, সদাহাস্য, মিষ্টভাষী। বাড়িতে হোক বা বাইরে, তিনি সব সময়ে পরিপাটি বেশভূষায় থাকতেন। ব্যাক ব্রাশ চুল, গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, কোঁচানো ধুতি।
কৃষ্ণচন্দ্রের প্রথম মঞ্চে অভিনয় ১৯২৪ সালে, শিশির ভাদুড়ীর আমন্ত্রণে অ্যালফ্রেড থিয়েটারে ‘বসন্তলীলা’ নাটকে বসন্তদূতের ভূমিকায়। ‘সীতা’ নাটকে তাঁর গাওয়া ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রু বাদল ঝরে’ গানটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এর পরে ১৯৩৩ সালে এই গানটি ‘সীতা’ ছবিতে গেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। এ ছাড়াও ‘জয় সীতাপতি সুন্দর তনু’ গানটিও জনপ্রিয়তা লাভ করে। অন্যান্য নাটকের মধ্যে ‘প্রফুল্ল’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘বিসর্জন’, ‘জয়দেব’, ‘দেবদাসী’ উল্লেখযোগ্য। এক সময়ে শিশিরকুমার ভাদুড়ী রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ মঞ্চস্থ করেছিলেন। তাতে অন্ধ ভিখারির চরিত্রে অভিনয় করেন কৃষ্ণচন্দ্র। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র গান শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছেই।
১৯৩১ এ কৃষ্ণচন্দ্র নিজের থিয়েটার কোম্পানি খোলেন। এবার তিনি একইসাথে সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেন। তাঁর নতুন থিয়েটারে ‘শিশির ভাদুড়ি’ও অভিনয় করেন। বাংলা থিয়েটারের উন্নতিই তখন কৃষ্ণচন্দ্রের ধ্যান জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। এর মধেই শুরু হয় সিনেমার যুগ।
থিয়েটারের পাশাপাশি তিরিশের দশক থেকেই চলচ্চিত্রে তাঁর গান গাওয়া শুরু। তখন সবাক ছবির যুগ। ‘দেবকী বসু’র পরিচালনায় ‘চণ্ডীদাস’ ছবিতে তার কণ্ঠে ‘সেই যে বাঁশি বাজিয়েছিলে’, ‘ফিরে চল আপন ঘরে’, ‘শতেক বরষ পরে’, ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বধূ’ বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
১৯৩১-এ, নাটকে ব্যাস্ত কৃষ্ণচন্দ্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রথম ‘টকি সিনেমা’য় দুটি গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৩২ সালে নির্মিত ‘চণ্ডীদাস’ সিনেমার মাধ্যমেই কৃষ্ণচন্দ্রের সিনেমা অভিযান শুরু হয় – চণ্ডীদাসে তিনি নাম ভুমিকায় অভিনয় ও কণ্ঠদান, এই দুইই সাফল্যের সাথে করেন। এই সাফল্য থেকেই একজন ‘এনটারটেইনার’ হিসাবে তাঁর প্রকৃত বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার শুরু হয়। পরবর্তী দশক জুড়ে তিনি অভিনেতা, গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে সাফল্যের পর সাফল্যের মুকুট পড়তে থাকেন। একইসাথে চলে মঞ্চে, সঙ্গীত সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন।
‘চণ্ডীদাস’ ছবিতে নায়ক ‘দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ কণ্ঠে কোনও গান ছিল না। কারণ ‘দুর্গাদাস’ গায়ক ছিলেন না। সে জন্য ওই ছবির পার্শ্বচরিত্র ‘অন্ধ শ্রীদামের ভূমিকায়’ কৃষ্ণচন্দ্রকে দিয়ে অভিনয় ও গান করানো হয়। নায়কের মুখে গান না থাকলেও সে অভাব পূর্ণ হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রের গানে। অন্যান্য ছবিগুলির মধ্যে ‘ভাগ্যচক্র’, ‘দেবদাস’, ‘গৃহদাহ’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘চাণক্য’, ‘আলোছায়া’, ‘পূরবী’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘মীনাক্ষী’ উল্লেখযোগ্য।
কৃষ্ণচন্দ্রের গাওয়া গানগুলি জনপ্রিয় হওয়ার নেপথ্যে সুরকার ও গীতিকারদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘নজরুল’, ‘হেমেন্দ্রকুমার রায়’, ‘চণ্ডীদাস’, ‘বাণীকুমার’, ‘অজয় ভট্টাচার্য’, ‘শৈলেন রায়’, ‘প্রণব রায়’ প্রমূখ গীতিকারের লেখায় এবং ‘রাইচাঁদ বড়াল’, ‘পঙ্কজকুমার মল্লিকের’ সুরে গানগুলি আজও অবিস্মরণীয়। কৃষ্ণচন্দ্র নিজেও সুর করেছিলেন বহু ছবিতে। তাঁর নিজস্ব মালিকানায় ‘কে সি দে প্রোডাকশন্সের’ ‘পূরবী’ এক উজ্জ্বল নজির। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন কৃষ্ণচন্দ্র এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ‘প্রণব দে’। গানের ছবি ‘পূরবী’তে ‘সঙ্গীতাচার্য চন্দ্রনাথের ভূমিকা’য় অভিনয় করেন তিনি। তাঁর অগাধ সঙ্গীতের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন তিন ভ্রাতুষ্পুত্র ‘প্রণব দে’, ‘প্রবোধ দে’ (‘মান্না দে’) ও ‘প্রভাস দে’। যাঁদের ডাকনাম ছিল যথাক্রমে ‘নীলু’, ‘মানা’ ও ‘ভেলু’। কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে গান শিখেছিলেন ‘শচীনদেব বর্মণ’ও!
কৃষ্ণচন্দ্র দে সম্পর্কে একটি লেখায় ‘কাননদেবী’ স্মৃতিচারণা করে লিখেছিলেন – ‘‘নিউ থিয়েটার্সে ‘বিদ্যাপতি’ ছবির কাজ করবার সময়ই অন্ধগায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে-র সংস্পর্শে আসবার সুযোগ ঘটে। বিস্মিত হয়ে দেখতাম, বাইরের চোখ দিয়ে দেখতে না পেলেও তার অনুভূতি এমন আশ্চর্য রকমের জাগ্রত যাকে বলা যায় – মানসচক্ষু অথবা তৃতীয় নেত্র। কোন্ দৃশ্যে, কোন্ সময় সাথীশিল্পীর কতটা কাছে, কোন্ দিকে যেতে হবে বা দাঁড়াতে হবে, পরিচালক একবার দেখিয়ে দিলেই তিনি এমন নির্ভুলভাবে তা পালন করতেন যে, অনেক চক্ষুওয়ালারাও তাঁর কাছে হার মেনে যেত। গভীর বিস্ময়ে লক্ষ্য করতাম অন্ধগায়ক আপন মনে পদক্ষেপ দিয়ে অথবা হাত দিয়ে চলাফেরার পরিধিটুকু মেপে নিতেন। দু’-চার মুহূর্ত নীরব থেকে ভেবে নিয়ে আপন ভূমিকা সম্বন্ধে অবহিত হতেন। তারপরই ফাইনাল ‘টেকে’ তাঁকে দেখতাম সসম্মানে উত্তীর্ণ হতেন।
শুধু কি তাই? ঘরের মধ্যে বসে আছেন, হঠাৎ বাইরে কোনো কিছু ঘটলে অথবা পরিচিত কেউ এলে কেমন করে যেন টের পেয়ে যেতেন। অমনই ত্রস্তপদে বাইরে এসে তার সঙ্গে হাসি-তামাশার মজলিশ চলত। … ‘বিদ্যাপতি’তে কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মুখে আমার নাম ছিল রাধে। মনে পড়ে, রঙ্গরহস্যের মেজাজে থাকলে সেটের বাইরেও উনি আমায় ওই নামেই ডাকতেন। আবার কোনো বিষাদস্তব্ধ মুহূর্তে হঠাৎ যদি তাঁর মুখোমুখি হতাম কেমন করে জানি না আমার মনটা যেন তিনি দেখতে পেতেন বাইরের প্রত্যক্ষ দৃশ্যবস্তুর মতোই। বলতেন, ‘রাধে হৃদয়-বৃন্দাবন আঁধার রাখলে তিনি এসে বসবেন কোথায়’?’’
১৯৪২-এ কৃষ্ণচন্দ্র বম্বেতে আবাস গড়ে হিন্দি সিনেমায় মনোনিবেশ করেন। যথারীতি, হিন্দি সিনেমায় অভিনয়, কণ্ঠদান, সঙ্গীত পরিচালনা সবই তিনি আগের মতোই সফলভাবে করতে থাকেন। তাঁর গানগুলো লোকসঙ্গীত আশ্রিত হওয়ায়, সহজেই সকল শ্রেণীর শ্রোতার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, তাঁর ‘কীর্তন’, ‘বাউল’ ও ‘ভাটিয়ালি’ গানগুলো ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। হিন্দি গানের পাশাপাশি তাঁর গাওয়া ‘উর্দু গজল’ও জনপ্রিয় হয়। তাঁর হাত ধরেই বাংলা গানে ‘ঠুমরি’, ‘দাদরা’ ও ‘গজলের’ প্রচলন হয়। চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে কৃষ্ণচন্দ্র মুম্বই গিয়েছিলেন হিন্দি ছবির গানে সুর করতে। তাঁর সঙ্গে ছিল দুই ভ্রাতুষ্পুত্র ‘প্রণব দে’ এবং ‘প্রবোধ’ তথা ‘মান্না দে’। কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন ‘পারফেকশনিস্ট’। ‘মান্না দে’-র স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, মুম্বইয়ে থাকাকালীন অবসর সময়ে দুই ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে আরব সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চেয়ে থাকতেন আছড়ে পড়া ঢেউয়ের দিকে। দুঃখের বিষয়, মুম্বইয়ে তিনি নানা ভাবে ‘প্রতারিত’ হয়ে চোখের জল ও বুকের ব্যথা চেপে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন।
বাংলা গানের জনপ্রিয়তার পরে কৃষ্ণচন্দ্র চেয়েছিলেন হিন্দি গান রেকর্ড করতে। শোনা যায়, হিন্দি গান রেকর্ড করা নিয়ে দীর্ঘ দিন যাবৎ একটি রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে তাঁর ঠান্ডা লড়াই চলেছিল। কেননা কোম্পানি কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র জেদ ধরলেন হিন্দি গান রেকর্ড না করলে তিনি আর বাংলা গানও গাইবেন না। শেষে রেকর্ড কোম্পানির উদ্যোগে ভাষা বিশেষজ্ঞরা এসেছিলেন তাঁর গান শুনতে। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁদের সঙ্গে নির্ভুল উর্দুতে কথা বলতে তাঁরা অবাক হয়ে যান। তাঁর উর্দু গজল শুনে তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন। এর পরে রেকর্ড কোম্পানি অবশ্য তাঁর হিন্দি গান রেকর্ড করেছিল।
গায়কিতে এবং সঙ্গীত সৃজনে নতুন এক ধারার প্রবর্তন করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। ‘ধ্রুপদ’, ‘ধামার’, ‘খেয়াল’, ‘লোকগান’ কিংবা ‘কীর্তনের’ সুর ভেঙে তিনি সৃষ্টি করলেন বাংলা গানের নতুন এক সম্পদ। রাগাশ্রয়ী গানের পাশাপাশি তাঁর কণ্ঠে কীর্তন যেন শ্রোতাদের অন্তরকে স্পর্শ করত। কীর্তন প্রসঙ্গে কৃষ্ণচন্দ্র লিখেছিলেন – ‘‘আমাদের ঘরের নিজস্ব সম্পদ হল কীর্তন। কীর্তনের মতন অমন মধুর গান আর হয় না। হয়তো এর ভিতরে রাগ রাগিণী তেমন কিছু না থাকতে পারে। তবুও বলব, কীর্তনের মত জিনিস নেই। কণ্ঠসঙ্গীত সব থেকে কঠিন জিনিস।’’ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর গানের মধ্যে কাব্যরস এবং ভাব প্রকাশের দিকে বিশেষ নজর দিতেন। তাঁর গাওয়া দেশাত্মবোধক ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ গানটি সে সময়ে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। তাঁর গাওয়া রাগাশ্রয়ী গানগুলির মধ্যে ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’, ‘ঘন তমসাবৃত ধরণী’, ‘মেঘ হেরি নীল গগনে’, ‘ঘন ডম্বরু বাজে’, ‘স্বপন যদি মধুর এমন’ আজও ভোলেনি বাঙালি।
তাঁর গীত, বাংলা গানগুলো ছিল সযত্নে বাছাই করা, প্রায় ক্ষেত্রেই, সুরকার থাকতেন তিনি নিজে আর গীতিকার হতেন কোনও বিখ্যাত কবি যেমন – ‘হেমেন্দ্র কুমার রায়’, ‘শৈলেন রায়’, ‘অজয় ভট্টাচার্য’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ প্রমুখ। ১৯৪৭-এ কৃষ্ণচন্দ্র আবার বাংলা সিনেমায় ফিরে আসেন, যথারীতি অভিনেতা, গায়ক হিসাবে, বাড়তি যোগ হয় সিনেমা প্রযোজনা। পরপর বেশ কয়েকটি সফল সিনেমার পর, ১৯৫৭ সালে ‘একতারা’ সিনেমায় অতিথি শিল্পী হিসাবে জীবনের শেষবারের মতো পর্দায় আবির্ভূত হন।
উদ্বোধনের দিন থেকেই কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল কলকাতা বেতারকেন্দ্রের। যে দিন বেতারকেন্দ্র স্থাপিত হল, তিনি ছিলেন দ্বিতীয় শিল্পী যিনি একটানা ধ্রুপদী সঙ্গীত গেয়েছিলেন। বেতারকেন্দ্রে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ‘চারুচন্দ্র বসুর কন্যা’ ‘রমা’ ওরফে ‘তারকবালা’র। তিনিই ‘মিস লাইট’ নামে পরিচিত ছিলেন। এক সময়ে ‘স্টার থিয়েটার’ ছেড়ে ‘তারকবালা’ রংমহলে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সময়ে রংমহলের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সেই সময়ে তাঁরা ‘টুরিং থিয়েটার’ খুলেছিলেন। সেই দলে অভিনয় করতেন ‘মিস লাইট’।
একান্ত ব্যাক্তিগত জীবনে, সবাই তাঁকে ‘ব্যাচেলর’ হিসাবে জানলেও, তিনি তাঁর সহ-অভিনেত্রী, ‘তারকবালা’ (‘মিস লাইট’) কে বিয়ে করছিলেন, ‘শাস্ত্রমতে’, কিন্তু ‘গোপনে’। বিয়ের পর, ‘তারকবালা’র নাম হয়, ‘রমা দে’। পরে তাঁদের একটি পুত্রসন্তানও হয়েছিল। তবে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সেই পুত্রের মৃত্যু হয়। এই শোক, কৃষ্ণচন্দ্র, বাকী জীবন পাথর চেপে রাখেন। কৃষ্ণচন্দ্র একইসাথে, ‘রমা দে’র ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত ছিলেন এবং নিজের মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তাঁর আত্মীয়দের অনুরোধ করেন, যেন তাঁর অবর্তমানে, রমার দেখভাল করা হয়। তা শেষ পর্যন্ত আর হয়নি এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর ‘রমা দে’ নিভৃত নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
কৃষ্ণচন্দ্র বরাবরই ছিলেন নিরহঙ্কার। একটি ঘটনা থেকে তা আরও স্পষ্ট হয়। সেই সময়ে ভারতী পত্রিকার দফতরে মাঝেমধ্যেই আড্ডা বসত। সাহিত্যিক ‘হেমেন্দ্রকুমার রায়’ ছিলেন তার মধ্যমণি। আসতেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। এক দিন তেমনই এক আড্ডায় এসেছিলেন ‘মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়’, ‘দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এবং ‘বাণীকুমার’। আড্ডা চলছিল। এমন সময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী ‘বলাইবাবু’র কাঁধে হাত রেখে। সঙ্গে এনেছিলেন একটি ‘পোর্টেবল গ্রামোফোন’। কৃষ্ণচন্দ্র ঘরে প্রবেশ করে ‘হেমেন্দ্রকুমার রায়’কে বলেছিলেন, ‘‘হিমুদা, তোমার সেই গানের রেকর্ডটা বেরিয়েছে। তোমায় শোনাব বলে নিয়ে এলাম।’’ ঘরে ঢুকেই কৃষ্ণচন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘দিনুবাবু’ (‘দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর’) কোথায়? এর পরে তিনি তাড়াতাড়ি রেকর্ডটি গ্রামোফোনে চালাতে বলেছিলেন। গানটি ছিল ‘বঁধূ চরণ ধরে বারণ করি’, যেটি লিখেছিলেন ‘হেমেন্দ্রকুমার রায়’। যথা সময়ে গান শেষ হয়েছিল। সকলেই প্রশংসা করলেও শুধু নীরব ছিলেন ‘দিনেন্দ্রনাথ’। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনার কেমন লাগল দিনুবাবু?’’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘কই লাগেনি তো।’’ কৃষ্ণচন্দ্র থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। এরপরে হেমেন্দ্রকুমার দিনেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, কৃষ্ণচন্দ্র জানতে চাইছে গানটি আপনার কেমন লাগল? দিনেন্দ্রনাথ সে বারও বলেছিলেন, ‘‘লাগেনি তো।’’ বোঝা গিয়েছিল গানটি তাঁর ভাল লাগেনি। এর পরে একদিন দিনেন্দ্রনাথ কৃষ্ণচন্দ্রকে বলেছিলেন, তাঁর গান ভাল, তবে গায়কি অন্য রকম হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আপনি তো বধূয়াকে চরণ ধরে বারণ করছেন, তা হলে মাঝে মাঝে ‘অ্যা বধূয়া’ করে এমন ধোবির পাট ছেড়েছেন কেন? একটা নম্র ভঙ্গি, একটা ব্যাকুলতা আবেদন তো এ গানে থাকা উচিত।’’ এ কথা শুনে কৃষ্ণচন্দ্র দু’কানে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ঠিক কথা, এটা তো আগে ভাবিনি। ভুল হয়ে গিয়েছে। এমনই ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র!
অর্থের প্রতিও তাঁর কোনও লোভ ছিল না। সেই সময়ে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (বর্তমানে বিধান সরণি) রাধা সিনেমার পাশে একটি ক্লাবে মাঝেমধ্যেই ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসত। সেখানে গান করতে গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তরুণ কবি ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত’ এবং তাঁর ভাই ‘সুনীল দত্তের’। এই নিয়ে রয়েছে এক মজার ঘটনা। এখানে কৃষ্ণচন্দ্র বেশ কয়েক বার গান গেয়েছিলেন। ক্লাবের ফান্ড অনুযায়ী প্রথম অনুষ্ঠানের পরে তাঁকে একশো টাকা এবং পরবর্তী অনুষ্ঠানে মাত্র পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হয়েছিল। এর পরে আরও একটি অনুষ্ঠানে যখন তাঁকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, সকলেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো আর আসবেন না। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র এসেছিলেন। গানও গেয়েছিলেন। খামে ভরে তাঁকে যে টাকা দেওয়া হত, কৃষ্ণচন্দ্র কখনও কোনও অনুষ্ঠানে তা খুলেও দেখতেন না। এ ভাবেই সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। নানা বিষয়ে তাঁরা আলোচনাও করতেন। এমনই একদিন সুধীন্দ্রনাথ কৃষ্ণচন্দ্রকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন রবীন্দ্র কবিতায় সুর দিতে। সুধীন্দ্রনাথ কবিতা পড়ে শোনাতেন আর কৃষ্ণচন্দ্র তাতে সুর দিতেন। যদিও সেই সব গান ঘরোয়া আসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। তবু এর পর থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুরাগী হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। যেমন – ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’, ‘আমার যাবার বেলা পিছু ডাকে’, ‘তোমরা যা বল তাই বল’, ‘হে মহা জীবন’।
প্রত্যেক দিন ব্রহ্মমুহূর্তে উঠে তিনি রেওয়াজ করতেন এবং বেশির ভাগ সময়ই তা তাঁদের বাড়ির সেই বিখ্যাত বাইরের ঘরটিতে। এক এক সময়ে ভোরের দিকে মদন ঘোষ লেনের বাড়ি থেকে বেহালার সুর শোনা যেত। একদিন কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর ভাইপো ‘প্রভাস দে’-কে বলেছিলেন সেই বেহালা বাদকের খোঁজ নিতে। পরদিন ভোরবেলা হেদুয়া পার্কে গিয়ে ‘প্রভাস দে’ দেখেছিলেন, সুইমিং পুলের কাছে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক বসে বেহালা বাজাচ্ছেন। প্রভাসবাবু তাঁকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন বাড়িতে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সেই ভদ্রলোকের নাম ছিল ‘মি. টাওয়ারিস’। জমে উঠেছিল তাঁদের বন্ধুত্ব। পরে টাওয়ারিসের বেহালার সঙ্গে একটি গানও রেকর্ড করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র।
তাঁর জীবন ছিল নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভরা। তবু রাগ, অভিমান, ঘৃণা এগুলিকে তিনি ত্যাগ করতে পেরেছিলেন অন্তরের মহত্ত্ব দিয়ে। একদিন হেদুয়ার ফুটপাত দিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র একজনের কাঁধে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাঁর নাতিকে তাঁকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ওই দ্যাখ, কানাকেষ্ট যাচ্ছে।’’ কথাটা কৃষ্ণচন্দ্র শুনতে পেয়েছিলেন। তবু তাঁর মুখে ছিল সেই সৌম্য স্মিত হাসি। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ঠিক বলেছ ভাই, আমি কানাই বটে, তবে শুধু আমি একাই নয়। উপরে যে ব্যাটা বৈকুণ্ঠে বসে বসে মৌজ করছে, সেই কেষ্ট ব্যাটাও তো কানা!’’
(তথ্যসূত্র:
১- সুরের সূর্য কৃষ্ণচন্দ্র: মান্না দে, দেশ পত্রিকা, বিনোদন বিভাগ, আগস্ট ১৯৭১ সাল।
২- জীবনের জলসাঘরে, মান্না দে, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩- সুরের সুর্য কৃষ্ণচন্দ্র মান্না দে, অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন।
৪- গায়ক নায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে, আশিসতরু মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স।
৫- সুধীর চক্রবর্তী রচনাবলি, সুধীর চক্রবর্তী, লালমাটি প্রকাশন।
৬- শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত