জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সকলের যা-ইচ্ছে-তাই লেখার একটা খাতা ছিল। ‘পারিবারিক খাতা’। ১৮৮৮-র নভেম্বরে ‘হিতেন্দ্রনাথ’ সেখানে লিখেছিলেন, তাঁর রবিকাকার মেয়ে হবে না। হবে মান্যবান, সৌভাগ্যবান, রবীন্দ্রনাথের চেয়েও গম্ভীর একটি ছেলে। সে-মাসেরই ২৭শে নভেম্বর, মৃণালিনী আর রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গায়ের রং সেই তখন থেকেই ছিল চাপা। পেরিয়ে যাওয়া যাক বছর কয়েক। সাত-আট বছর বয়সে একবার শিলাইদহ থেকে রথী ফিরে এসেছিলেন রোদে জলে পুড়ে। যেন আরও একটু ‘কালো’ হয়ে। পাশেই ‘গগনেন্দ্রনাথ’দের বাড়িতে জ্যাঠাইমাকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘ছিঃ, রবি তাঁর ছেলেকে একেবারে চাষা বানিয়ে নিয়ে এল।’’ কথাটা সে দিন খুব মনে লেগেছিল রথীন্দ্রনাথের। এতটাই যে, তার পর থেকে ওই বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর এমনই কাণ্ড, বাংলার পল্লিমঙ্গলের স্বপ্ন দেখে, সেই ‘চাষা’ হয়ে ওঠার পাঠ নিতেই, ছেলেকে তার পর একদিন সত্যি-সত্যি বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ! ১৯০৬ সাল, স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ তখন তুঙ্গে। রথীন্দ্রনাথ আর আশ্রমে তাঁর সহপাঠী ‘সন্তোষচন্দ্র মজুমদার’কে রবীন্দ্রনাথ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ছাত্রদের এক দলের সঙ্গে জাপানে। কিছু দিন পর দু’জনে পৌঁছেছিলেন আমেরিকার আর্বানায়, ইলিনয়ের স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই হয়েছিলেন কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক। ১৯০৭ সালে আমেরিকা থেকে রথী বাবাকে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে লিখেছিলেন ‘একবার ফসল দিয়ে ঝিমিয়ে-পড়া মাটি’। জানিয়েছিলেন, বিদেশে তিনি যে কেবল মাটিই ‘বিশ্লেষ’ করছেন তা নয়, পরীক্ষা চলছে শস্য এবং পশুখাদ্য নিয়েও। ২১শে জুন ১৯০৮ সালে, ছেলেকে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘‘… আমাদের দেশের হাওয়ায় কী চাষা কী ভদ্রলোক কোনও মতে সমবেত হতে জানে না। তোরা ফিরে এসে চাষাদের মধ্যে থেকে তাদের মতিগতি যদি ফেরাতে পারিস তো দেখা যাবে।’’ বাবাকে নিরাশ করেন নি রথী। রবীন্দ্রনাথের ডাকে জমিদারি দেখাশোনার কাজে ১৯০৯ সালে ফিরে এসেছিলেন শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ যেন এই সময় একেবারে আঁকড়ে ধরেছিলেন রথীকে। তাঁকে চিনিয়েছিলেন বাংলার পল্লিসমাজ। ছেলের মুখে কৃষিবিদ্যা, প্রজননশাস্ত্র, অভিব্যক্তিবাদের কথা শুনতেন খুব মন দিয়ে। রথীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছিলেন, ‘‘১৯১০ সালের সেই সময়টাতে আমরা পিতাপুত্র পরস্পরের যত কাছাকাছি এসেছিলাম তেমন আর কখনো ঘটে নি।’’ শিলাইদহে রথীন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন প্রশস্ত খেত, তৈরি করেছিলেন মাটি পরীক্ষার গবেষণাগার। বিদেশ থেকে আমদানি করেছিলেন ভুট্টার এবং গৃহপালিত পশুর খাওয়ার মতো ঘাসের বীজ। তৈরি করিয়েছিলেন দেশের উপযোগী লাঙল, ফলা, আর নানা যন্ত্রপাতি। ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের’ কাছ থেকে ‘পাতিসরের’ জন্য চেয়ে এনেছিলেন একটা ট্রাক্টর। চালাতেন নিজেই। বাংলার কৃষি আর কৃষকের হাল ফেরাতে যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রথী, তখন আবার এসেছিল রবীন্দ্রনাথের ডাক। এ বার নাকি তাঁর বিয়ে!
প্রতিমা ছিলেন ‘ঠাকুরবাড়িরই মেয়ে’ আবার ‘ঠাকুরবাড়িরই বৌ’ হয়েছিলেন। আসলে প্রতিমা ছিলেন ‘বিনয়িনী ঠাকুরের কন্যা’। ‘বিনয়িনী’ ছিলেন ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বোন’ – তাঁর বিবাহ হয়েছিল ‘শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায়ের’ সঙ্গে। ‘শেষেন্দ্রভূষণ ও বিনয়িনীর কন্যা’ ছিলেন প্রতিমা। সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটিকে দেখে ‘কবিপত্নী মৃণালিনী’র খুব ভাল লেগেছিল। অন্তরঙ্গদের বলেছিলেন, ‘‘এই সুন্দর মেয়েটিকে আমি পুত্রবধূ করব। আশা করি ছোটদিদি তাঁর নাতনীটিকে আমায় দেবেন।’’ কিন্তু অতি অকালে চলে যাওয়ায় ‘মৃণালিনী’ তাঁর ইচ্ছেকে কাজে পরিণত করতে পারেননি। তাই মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই প্রতিমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ‘গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের’ সঙ্গে। তখন প্রতিমার বয়স সবে এগারো বছর হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের একটু ছোট বয়সেই বিয়ে হত, প্রতিমারও তাই হয়েছিল। এক ফাল্গুন মাসে ‘প্রতিমা ও নীলানাথের’ বিয়ে হয়েছিল। বৈশাখ মাসে শুভদিন দেখে প্রতিমাকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নিয়ে গিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন যেতে না যেতেই, গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল ‘নীলানাথের’। শ্বশুরবাড়ি থেকে ‘অপয়া’ অপবাদ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন প্রতিমা। এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে, রথীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরলে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমার পুনর্বিবাহ দেবার প্রস্তাব করেছিলেন। স্ত্রীর মনোবাসনা তাঁর অজ্ঞাত ছিল না, তাছাড়া ঠাকুরবাড়িতে ‘বিধবা বিবাহের প্রতিবন্ধক’ ‘মহর্ষি’ তখন ছিলেন পরলোকে। কবিও বাল্যবিধবাদের অবহেলিত জীবন ও দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করছিলেন। ঠিক একই সময়ে ‘ঢাকার গুহঠাকুরতা পরিবারের মেয়ে’ ‘লাবণ্যলেখা’ও বিধবা হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কন্যাসমা সেই মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে আবার সংসারে ফিরিয়ে আনা যাবে না-কি? কবি ঠাকুরবাড়ির পূর্বসংস্কার ভাঙবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং তখনই স্থির করেছিলেন নিজের ছেলের বিয়ে দেবেন বিধবার সঙ্গে। এছাড়া সমাধানের কোন পথ তিনি পাননি। তাঁর যুক্তি ছিল, তিনি নিজে যদি নিজের ছেলের বিয়ে কোন বিধবার সঙ্গে না দেন তাহলে অন্য লোকে দেবে কেন? তিনি ‘গগনেন্দ্র’কে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলেন – ‘‘তোমাদের উচিত প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়া। বিনয়িনীকে বলো যেন অমত না করে। ওর জীবনে কিছুই হল না। এ বয়সে চারিদিকের প্রলোভন কাটিয়ে ওঠা মুস্কিল। এখন না হয় মা বাপের কাছে আছে। এর পরে ভাইদের সংসারে কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকবে সেইটাই কি তোমাদের কাম্য? না, বিয়ে দেওয়া ভাল, সেটা বুঝে দেখ।’’ উদারহৃদয় ‘গগনেন্দ্র’ তখনই রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু সমাজ রয়েছে। সমাজের কি সম্মতি পাওয়া যাবে? এ তো ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নয়। ‘বিদ্যাসাগর’ ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহকে কাগজে-কলমে বৈধ করে গিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারের হিড়িকে কিছু বিধবার বিবাহও হয়েছিল, কিন্তু সাধারণ ভাবে তখনো সমাজে কেউ বিধবা বিবাহ মেনে নিত না। ‘বিনয়িনী’ ভয় পেয়ে জানিয়েছিলেন – ‘‘আমাকে যে সমাজে একঘরে ঠেলবে। আমার আরও ছেলেমেয়ে আছে তাঁদের বিয়ে দিতে হবে।’’ ভয় পাননি ‘গগনেন্দ্র’। বলেছিলেন – ‘‘তোমাদের ভয় নেই। তোমাদের পেছনে আমি আছি। তোমায় সমাজ ত্যাগ করলে আমিও সমাজ ত্যাগ করব।’’ ২৭শে জানুয়ারি ১৯১০ সালে সমাজকে অগ্রাহ্য করে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রথীন্দ্রনাথের সাথে প্রতিমার বিয়ে দিয়েছিলেন ‘গগনেন্দ্র’। সেটাই ছিল ‘ঠাকুরবাড়িতে প্রথম বিধবা বিবাহ’। রথীন্দ্রনাথ নিজের বিয়ে নিয়ে স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, ‘‘আমাদের পরিবারে এই প্রথম বিধবা বিবাহ।’’ অবশ্য ঠিক ঠাকুরবাড়ি বলা চলে না। এর মাত্র কয়েকমাস আগে ‘পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়ির মেয়ে’ ‘ছায়া’র বিধবা বিবাহ হয়েছিল। ‘জোড়াসাঁকোতে’ প্রথম বিয়ে হয়েছিল রথীন্দ্র ও প্রতিমার। কবি এর পরে ‘লাবণ্যলেখা’র বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্য ‘অজিত চক্রবর্তী’র সঙ্গে। ‘গগনেন্দ্র’র প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর নিজের বিধবা পুত্রবধূ ‘গেহেন্দ্রের স্ত্রী’ ‘মৃণালিনী’রও আবার বিয়ে দেবেন। ‘মৃণালিনী’র প্রবল আপত্তিতে সেটা সম্ভব হয়নি। প্রতিমার বিয়েতে ‘সামাজিক বাধা’ কিছু এসেছিল। ঠাকুর পরিবারের কোন শরিক নিজের বাড়ির উৎসবে ‘রবীন্দ্ৰপরিবারকে’ নিমন্ত্রণ করেননি এই সব। সেদিকে বেশি মনোযোগ না দেওয়ায় সব ঝড় কেটে গিয়েছিল। রবীন্দ্রপরিবারে ‘গৃহলক্ষ্মী’ হয়ে প্রবেশ করেছিলেন প্রতিমা; সত্যিই তিনি ছিলেন মূর্তিমতী লক্ষ্মীশ্রী, রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের ‘মা-মণি’, তাঁর আদরের ‘ব্রাইড মাদার’ (বৌমা)। নিজের থেকে বয়সে পাঁচ বছরের ছোট প্রতিমার গুণে যে তিনি পাগল, সে-কথা জানিয়ে ভগ্নিপতি ‘নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়’কে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘প্রতিমা এখন আমার … সে কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী করে লিখি।’’ আর একবার খোদ প্রতিমাকেই লিখেছিলেন, ‘‘আমি কখনই একজন কুশ্রী মেয়েকে সম্পূর্ণ ভালবাসতে পারতুমনা – আমার সে দুর্ব্বলতা আমি স্বীকার করছি।’’
বিয়ের কয়েক মাস পর প্রতিমাকে শিলাইদহে নিয়ে এসেছিলেন রথী। এর পর হঠাৎ একদিন আবার ডাক এসেছিল রবীন্দ্রনাথের! শান্তিনিকেতনে আশ্রমবিদ্যালয়ে তাঁর দরকার পড়েছিল রথীকে! কুঠিবাড়ির চার দিকের গোলাপ বাগিচা, একটু দূরে সুদূরবিস্তারী খেত, সেই পদ্মা নদী, সেই কত সুখদুঃখের কাহিনি মোড়া বজরা … বাবার এক ডাকে সব ছেড়ে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘এই-সব যা কিছু আমার ভাল লাগত— সেই সব ছেড়ে আমায় চলে যেতে হল বীরভূমের ঊষর কঠিন লাল মাটির প্রান্তরে।’’ ২রা মে ১৯১০ সালে লেখা এক চিঠিতে অনভিজ্ঞ, ‘ছেলেমানুষ’ প্রতিমার প্রতি রথীন্দ্রনাথের কর্তব্য তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন, ‘‘… তাঁর চিত্তকে জাগিয়ে তোলবার ভার তোকেই নিতে হবে – তাঁর জীবনের বিচিত্র খাদ্য তোকে জোগাতে হবে। তাঁর মধ্যে যে শক্তি আছে তার কোনোটা যাতে মুষড়ে না যায় সে দায়িত্ব তোর।’’ কিন্তু ভিতরে-ভিতরে কোথাও মুষড়ে পড়েছিলেন যেমন রথী, তেমনই প্রতিমা। এতটাই যে, এক চিঠিতে স্ত্রীকে রথীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, ‘‘কতদিন বোলপুরের মাঠে একলা পড়ে যে কেঁদেছি তা কেউ জানে না। তুমিও না।’’ চাইলেও নিজেকে মেলে ধরতে না পারার অক্ষমতার কথা জানিয়ে লিখলেন, ‘‘ভগবান আমাকে বোবা করে জন্ম দিয়েছেন।’’ প্রতিমাকে লেখা রথীন্দ্রনাথের তারিখবিহীন কয়েকটা চিঠিতে বোঝা যায়, দু’জনের বোঝাপড়ার এক সময় কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছিল। মন খুলে দু’জনে আসতে পারছিলেন না কাছাকাছি। রথী প্রতিমাকে লিখেছিলেন, তাঁর শুষ্ক, শূন্য সত্তার ভিতরেও আছে, ‘‘আর একটাকেও যে খুব ভালোবাসতে চায়, যে খুব সুন্দর হতে চায় … কিন্তু তার একটি দোষ আছে সে ভারী লাজুক।’’ তার পর প্রতিমাকেই রথী দিয়েছিলেন সেই লাজুক মানুষটার আড়াল থেকে তাঁর প্রকৃতিকে টেনে বের করে আনার ভার। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘আর তা যদি না পারো তো চিরকাল তোমাকে কষ্ট পেতে হবে – তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করো।’’ আর একবার লিখেছিলেন, ‘‘তোর মনটা সম্পূর্ণ পাবার জন্যে আমি কিরকম ব্যাকুল হয়ে থাকি তা তুই জানিস না।’’ ১৯২২ সালে দু’জনের সংসারে এসেছিলেন ‘নন্দিনী’, তাঁদের ‘পালিতা কন্যা’ হয়ে। ‘দাদামশায়’ রবীন্দ্রনাথের রাখা আদরের নাতনি নন্দিনীর অনেক নামের মধ্যে একটা ছিল ‘পুপে’। ‘সম্ভাব্য নাতি’র জন্যও একটা নাম আগলে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তেইশ বসন্ত অপেক্ষার পর ‘রাসভেন্দ্র’ নামটা কবি দিয়ে দিয়েছিলেন প্রিয়ভাজন ‘সুরেন্দ্রনাথ কর’কে। ‘ইলিনয়ে’ ছাত্রজীবনে রথীর সঙ্গে পরিচয় হওয়া ‘ভাষার অধ্যাপক আর্থার সেমুর’-এর স্ত্রী ‘মেস সেমুর’কে রথীন্দ্রনাথ আগেই লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার পর তাঁর মূল কাজ ছিল, বিশ্বভারতীর ভাঙন ঠেকিয়ে রাখা। এক সময় তিনি চেয়েছিলেন, বাবার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানকে একটা স্থায়িত্ব দিয়ে যেতে। ১লা নভেম্বর, ১৯৪৮ সালে ইংরেজি এক চিঠিতে ‘মেস সেমুর’কে তিনি লিখেছিলেন, বিশ্বভারতীর কাজ তাঁকে আর আনন্দ দেয় না, নৈতিক কর্তব্য পালনের তাগিদেই সে কাজ করে থাকেন শুধু। বহু বছর ছিলেন ‘কর্মসচিব’। ১৯৫১ সালে ‘বিশ্বভারতী’ ‘কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ হলে, রথীন্দ্রনাথ হয়েছিলেন তার প্রথম উপাচার্য। তার পরই বুঝেছিলেন, ‘কবির আশ্রম’ থেকে ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে’ বদলে যাওয়াটা আসলে এক বিপর্যয়! ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ ছিলই, তার সঙ্গেই সে বার বিশ্বভারতীতে জুড়ে গিয়েছিল ‘নিয়মের ঘেরাটোপ’! তার মধ্যেই ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ আর ‘কুৎসায়’ নাজেহাল হয়ে গিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ‘আর্থিক অনিয়মের মিথ্যে অভিযোগে’ ফাঁসানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল তাঁকে। বাঁচিয়ে দিয়েছিল আদালত।
আর প্রতিমা? দীর্ঘ বত্রিশ বছর ধরে ‘রবীন্দ্র সান্নিধ্যে’ থেকে তাঁর সেবা করে গিয়েছিলেন প্রতিমা। সেই সঙ্গে চালিয়েছিলেন আশ্রমের দেখাশোনা আর অতিথি সেবার কাজ। কবির সেবা করা খুব সহজ কাজ ছিল না। প্রতিমা সেটা করেছিলেন অসীম ধৈর্য নিয়ে। শুধু সেবা নয়, প্রতিমা শিল্পক্ষেত্রে রেখে গিয়েছেন অনেক কিছু। তাঁর যা কিছু শিক্ষা রবীন্দ্রনাথের কাছেই। সেই শিক্ষা তাঁর প্রতিভার স্পর্শে নতুন রূপ নিয়েছিল। চলে যেতে যেতে রেখে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ির মেয়ের আরো কিছু অসামান্য দান। প্রতিমা দুই পরিবারের শিক্ষা সংস্কৃতি নিয়ে এসেছিলেন। নিয়ে এসেছিলেন কল্যাণশ্রীর সঙ্গে আশ্চর্য নিরাসক্তি। তিনি ভাল লিখতে পারতেন, পারতেন ভাল ছবি আঁকতে। তাঁর লেখা, গুরুদেবের ছবি, রবীন্দ্রনাথের চিত্র বিচারের মাপকাঠি ছিল। বাস্তবিক চিত্র বিচারে প্রতিমা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলাকে তিনভাগ করে প্রতিমা দেখিয়েছিলেন কবির আঁকা প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জীবজন্তু যেমন ফরাসী জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল তেমনি মানুষের মুখের প্রতিকৃতি মনোহরণ করেছিল জার্মানদের। কিন্তু আসলে এসব ছবিকে বিশ্লেষণ করা যায় না। সৃষ্টির এমন এক সত্যকে এরা অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করছে যার ব্যাখ্যা চলে না। দিব্যদৃষ্টি দিয়ে কেউ যদি সে জিনিষ ধরতে পারল তো বুঝল, নইলে খনির ভিতর মণির মতো তার দীপ্তি রইল ঢাকা। রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে ছবি এঁকেছিলেন দু’হাজারেরও বেশি। ছবি তাঁর শেষ বয়সের প্রিয়া – জীবন-সায়াহ্নে যে নায়িকা আসে সে যেন সবচেয়ে বেশি অভিনিবেশ দাবি করে। চোখের সামনে বুঝি ফুটে উঠেছিল আর একটা জগৎ, রঙে-রেখায় কবি তাঁকে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের এই ছবি আঁকার কথা লিখেছিলেন প্রতিমা। তাঁর মতে, রবীন্দ্রনাথ কবিতায় যেমন একটা সৃষ্টির সম্পূর্ণ চেহারা দিয়েছিলেন, চিত্রেও তেমনি বস্তু প্রবাহের আবর্তনের ইতিহাস এঁকেছিলেন। গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে যে ঘূর্ণমান গতি তেজের চাপে রচনার কাজে নিরন্তর নিযুক্ত, তারি জোয়ার ভাটার টানে রেখা হতে রেখান্তরে প্রাণী ও জড়জগতের চেহারা ছাঁচে ঢালাই হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। শিল্পীর মনে লেগেছিল সেই স্রোতের ঢেউ। ব্যক্তিত্বের রসে মজে তাই তুলির টানে বেরিয়ে এসেছিল রূপ হতে রূপান্তরে সৃজিত অপরূপ মানুষ পশুপক্ষী ও দৃশ্য। এ তো গেল প্রতিমার চিত্র সমালোচনার কথা। প্রতিমা নিজেও ভাল ছবি আঁকতেন। কিছু শিখেছিলেন ইতালিয়ান শিক্ষক ‘গিলহার্ডি’র কাছে। কয়েকটি ছবিতে তাঁর দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। ছবির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছিল কথার ছবি আঁকা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছদ্মনাম দিয়েছিলেন ‘কল্পিতাদেবী’। এই নামে প্রতিমা অনেক কবিতা লিখেছিলেন ‘প্রবাসী’তে। প্রতিটি কবিতা লিখেই তিনি দেখাতে যেতেন কবিকে। বুক ঢিপঢিপ করত ভয়ে। কি জানি হয়ত হয়নি। অথচ না দেখিয়েও তৃপ্তি পেতেন না। কবি বেশ মন দিয়েই দেখতেন। মাঝে মাঝে কলম চালিয়ে তাতে এনে দিতেন ঔজ্জ্বল্যের দীপ্তি। আবার কখনও কখনও প্রতিমার লেখা কবিতাটাকেই ভেঙেচুরে নতুন করে লিখে দেখাতেন কাব্যভাষা বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটাই কেমন নতুন হয়ে ওঠে। যেমন ধরা যাক, ‘স্মৃতি’ কবিতাটা প্রতিমা লিখেছিলেন –
‘‘এই গৃহ এই পুষ্পবীথি
যারে ঘেরি একদিন তোমার কল্পনা
গড়েছিল ইমারত দীপ্তি গরিমার,
উত্তপ্ত কামনা তব যার প্রতি ধূলির কণায়
জীবন্ত করিয়াছিল তব মুহূর্তেরে।
যে বাসনা মনে ছিল পুরিল না।
অবসন্ন প্রাণ
গেল চলে ছায়া ফেলে অঙ্গনে প্রাঙ্গণে।’’
রবীন্দ্রনাথ সেটার ভাষা বদলে লিখেছিলেন –
‘‘এই ঘর এই ফুলের কেয়ারি
একে ঘের দিয়ে তোমার খেয়াল
বানিয়েছিল পরীস্থানের ইমারৎ।
তোমার তপ্ত কামনা।
রাঙিয়েছিল তার প্রত্যেক ধূলিকণাকে
তার প্রত্যেক মুহূর্তকে করেছিল তোমার আবেগ দিয়ে অস্থির।
তুমি চলে গেলে,
অকৃতার্থ আকাঙ্ক্ষার ছায়া ভেসে বেড়াচ্ছে
অঙ্গনে প্রাঙ্গণে।’’
কবির সঙ্গে কল্পিতার এই ধরনের কবির লড়াই প্রায়ই হত। তাঁর গদ্য রচনাতে চোখে পড়বে লিপিকার বিশিষ্ট ভঙ্গি। সে যেন গদ্য নয়, গদ্য কবিতা। ‘নটী’, ‘মেজবৌ’ ‘১৭ই ফাল্গুন’, ‘সিনতলা দুর্গ’ সবই এক সুরে বাঁধা। প্রতিমার লেখা ‘স্বপ্নবিলাসী’ পড়ে কবি মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন ‘মন্দিরার উক্তি’। পুত্রবধূকে অনুরোধ করেছিলেন তার পরের অধ্যায় ‘নরেশের উক্তি’ লিখতে। অর্থাৎ কবি লিখবেন ‘নারীর উক্তি’ আর প্রতিমা লিখবেন ‘পুরুষের উক্তি’। কিন্তু কবির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গল্প লেখা? কল্পিতা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন। এছাড়া প্রতিমা লিখেছিলেন কিছু স্মৃতিকথা। তাঁর মায়ের ডাইরির কাহিনী অবলম্বনে লেখা হয়েছিল ‘স্মৃতিচিত্র’। এতে বেশ পাঁচ নম্বর বাড়ির মেয়েদের কথা আছে। যেমন আছে মেয়েদের উৎসবের সাজের কথা। দেবেন্দ্ৰপরিবারে মূর্তি পূজো বন্ধ হয়ে গেলেও গায়ে লাগানো পাশের বাড়িতে বেশ ঘটা-পটা করেই দোলদুর্গোৎসব হত। হবে নাই বা কেন? তখনকার কলকাতায় সেটাই তো ছিল দস্তুর। প্রতিমা লিখেছিলেন –
‘‘প্ৰতি, উৎসবেই মেয়েদের তখন বিশেষ সাজ ছিল। বাসন্তী রঙে ছোপানো কালো পেড়ে শাড়ি, মাথায় ফুলের মালা, কপালে খয়েরের টিপ – এই ছিল বসন্ত পঞ্চমীর সাজ। দুর্গোৎসবে ছিল রঙবেরঙের উজ্জ্বল শাড়ি, ফুলের গয়না, চন্দন ও ফুলের প্রসাধন। দোল পূর্ণিমারও একটি বিশেষ সাজ ছিল, সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর অতির গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন শাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে আবিরের লাল রঙ শাদা ফুরফুরে শাড়িতে রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।’’
প্রতিমার বিবরণে গয়নার কথা নেই। গগনেন্দ্রর ছোট মেয়ে ‘সুজাতা’র লেখা থেকে জানা যায়, ‘‘সে সময় দিনে সোনার গয়না, বিকেলে মুক্তোর গয়না এবং রাতে হীরে জহরতের জড়োয়া গয়না পরার রেওয়াজ ছিল। বিয়েবাড়িতে কিংবা উৎসবের দিনে তারা এভাবেই সাজতেন। দিনের সোনালি আলোয় সোনার জৌলুষ বাড়ে, রাতের আলো হীরে জহরতে ঠিকরে পড়ে, শুধু মুক্তোর ভূমিকাঁটাই তেমন স্পষ্ট হল না। বিকেলের আলো-আঁধারি আর মন-কেমনকরা গোধূলি আলোয় মুক্তোই বোধহয় সবচেয়ে ভাল দেখায়।’’
প্রতিমার আসল দান কিন্তু ছবি আঁকা বা লেখা নয়, আসল দান হল শান্তিনিকেতনে মেয়েদের জন্যে নাচ শেখাবার ব্যবস্থা। যদিও বাঙালীদের মধ্যে নাচ শেখার একেবারেই কোন ব্যবস্থা ছিল না। সেকালে স্টেজের ওপর তাল রেখে দু’পা চলাও ছিল রীতিমতো লজ্জার কথা। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ বা ‘মায়ার খেলা’র সবটাই ছিল অভিনয়, সামান্য হাত নেড়ে একটু আধটু নাচের ভাব আনার চেষ্টা করা হত। তবে দিন বদলে যাচ্ছিল। মেয়েরা এগিয়ে আসছিলেন সব কাজে উৎসাহ নিয়ে। নাচেই বা পিছিয়ে থাকলে চলবে কেন? শান্তিনিকেতনে এই পরীক্ষা চালানোও অপেক্ষাকৃতভাবে সহজ ছিল। তাই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন প্রতিমা। নিজে তিনি মঞ্চে উপস্থিত হয়েছিলেন খুব কম। তাঁর বিয়ের অল্প পরেই শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় হয়েছিল ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’, প্রতিমা তাতে সেজেছিলেন ‘ক্ষীরি’। এরপর নিজে অভিনয় না করলেও যে কোন রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের তিনিই ছিলেন প্রাণ। রবীন্দ্রনাথের নিজের মনেও ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘পরিশোধ’ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার কোন পরিকল্পনা ছিল না। প্রতিমাই একটা খসড়া খাড়া করে কবির কাছে নিয়ে গেলে কবি এই নতুন শিল্পরূপ সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু নাচ কে শেখাবে? শান্তিনিকেতনে কিভাবে শেখান হবে? এ দেশের চোখ নাচ দেখতে অভ্যস্ত ছিলনা। তাতে কি? প্রতিমা শুরু করেছিলেন এক দুরূহ সাধনা। তিনি নিজে নৃত্যশিল্পী ছিলেন না, কোনদিন নাচ শেখেননি। অসাধারণ শিল্পবোধের সাহায্যে তাঁকে এগোতে হয়েছিল। তবে বাঙালীরা যে সেই সময় নৃত্য-সচেতন হয়ে উঠেছিলেন তার ইতস্ততঃ প্রমাণ দেখা যেতে শুরু হয়েছিল ‘উদয় শংকরের’ আবির্ভাবে। অবশ্য তখনও তাঁর নৃত্যসঙ্গিনী কোনো ভারতীয় ছিলেন না, ছিলেন বিদেশিনী ‘সিমকি’। ভদ্রঘরের বাঙালী মেয়েদের নাচের পথ দেখিয়েছিলেন ‘রেবা রায়’। ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে ঋতুচক্রের আয়োজন করেছিলেন ‘সৌম্যেন্দ্রনাথ’ ও আরো অনেকে। উৎসবের শেষ গান ছিল – ‘‘যে কেবল পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায় ডাক দিয়ে যায় ইঙ্গিতে’’, গান শুরু হতেই ‘রেবা’ হঠাৎ গানের দল থেকে বের হয়ে এসেছিলেন উল্কার মতো স্টেজের মাঝখানে, গানের হালকা ছন্দের সঙ্গে শুরু করে দিয়েছিলেন চপল নৃত্য! কাণ্ড দেখে সবাই তাজ্জব! চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। ছি ছি ছি! ভদ্রঘরের মেয়েরা আবার নাচে নাকি? বিষোগারে কান পাতা দায় হয়েছিল। এর উত্তর দিয়েছিলেন ‘সৌম্যেন্দ্র’, আরো কয়েকদিন পরে। জোড়াসাঁকোর বাড়ির উঠোনে, ‘‘নূপুর বেজে যায় রিণি রিণির’’ সঙ্গে নেচেছিলেন তিনটি মেয়ে – ‘চিত্রা’, ‘নন্দিতা’ ও ‘সুমিতা’। এর বছরখানেক পরে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চস্থ করেছিলেন ‘নটীর পূজা’। এই সময় ভদ্রঘরের মেয়েদের নাচার পথ আরো সুগম করে দিয়েছিলেন ‘কেশবচন্দ্র সেনের নাতনীরা’। ১৯২৮ সালে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের সাহায্যের জন্যে মঞ্চস্থ করা হয়েছিল ‘শ্রী কৃষ্ণ’! কৃষ্ণের বাল্যরূপ দিয়েছিলেন ‘নীলিনা’ আর তাঁর পরবর্তী জীবন রূপায়ণের ভার পড়েছিল ‘সাধনা’র ওপর। ‘সাধনা’ পরবর্তী জীবনে ‘মধু বসু’কে বিয়ে করেছিলেন ও মঞ্চে-পর্দায় অনেকবার নর্তকীরূপে উপস্থিত হয়েছিলেন। ‘সাধনা’ শিখেছিলেন ভালো কত্থক নাচ। ‘আলিবাবা’, ‘রাজনৰ্তকী’, ‘দালিয়া’ – তাঁর অভিনয়ের সাক্ষ্য হয়ে আছে। ‘রেবা রায়’ও নিয়মিত ভাবে নাচ শেখাতে শুরু করেছিলেন সঙ্গীত সম্মিলনীতে। বড় বড় নৃত্যনাট্যের অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন কিছুদিন পরে। যাক সে কথা। প্রতিমা শান্তিনিকেতনে যা শিখিয়েছিলেন তাকে ‘ভাবনৃত্য’ বলাই উচিত। ‘বর্ষামঙ্গলের’ দু-একটা নাচে কিছু রূপ দেবার পর প্রতিমা কবিকে ‘পূজারিণী’ কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি ঠিক করেছিলেন শুধু মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করবেন কবির জন্মদিনে। লেখা হয়েছিল ‘নটীর পূজা’। দিনরাত খেটে প্রতিমা মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছিলেন। ‘শ্ৰীমতী’র ভূমিকায় অপূর্ব নৃত্যাভিনয় করে চিরস্মরণীয় হয়ে রইলেন ‘নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরী’। অবশ্য এ অভিনয় আরো পরের ব্যাপার! দীর্ঘ চোদ্দ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রতিমা রাবীন্দ্রিক নৃত্যনাট্যের পাকা রূপ ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। এর আগে এসেছিল ‘শাপমোচন’। নৃত্য নিয়ে প্রতিমা যে কত ভেবেছিলেন তার পরিচয় আছে তাঁর লেখা ‘নৃত্য’ বইখানিতে। ‘চিত্রাঙ্গদা’তে যে বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছিল তা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ‘চণ্ডালিকা’তে। এই বৈশিষ্ট্য কি? যা অন্য থেকে ‘রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য’কে পৃথক করে রেখেছে। ‘উদয়শংকরের নাচ’ তখন অনেকে দেখেছিলেন, দেখেছিলেন ‘রেবা রায়’ ও ‘সাধনা বসু’র নাচের ধারা। এমন কি ‘শ্ৰীমতী’ও মডার্ণ ড্যান্সের আঙ্গিকে পরীক্ষামূলকভাবে রবীন্দ্র কবিতার সঙ্গে পরিবেশন করেছিলেন তাঁর ‘ভাবনৃত্য’। ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রথম মঞ্চায়িত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে ‘নিউ এম্পায়ারে’। এর পর ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ‘চিত্রাঙ্গদা’র অভিনয় হয়েছিল চল্লিশবার। এ হিসেব ‘শান্তিদেব ঘোষের রচনা’ থেকে পাওয়া যায়, তিনি থাকতেন নাচ ও গান উভয় দলেই। ‘অর্জুন’, ‘কুরূপা ও সুরূপা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ সাজতেন ‘নিবেদিতা’, ‘যমুনা’ ও কবির দৌহিত্রী ‘নন্দিতা’। অন্তরালে থাকতেন প্রতিমা। সমস্ত ‘পোশাক-পরিচ্ছদ-সাজ’ তাঁর নির্দেশেই বানানো হত। ‘মঞ্চ-সজ্জা’তেও তিনি ‘শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য’ গ্রহণ করেছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাটক ও নৃত্যনাট্যে’ ‘দৃশ্যসজ্জা ও রূপসজ্জায়’ যে একটি শালীন সৌন্দর্য আছে প্রতিমা সেটি কঠোর ভাবে মেনে চলতেন। তাই নারী চরিত্রগুলির সুরুচিসম্মত রূপসজ্জা রচনায় তাঁর নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। শেষ দিকে কবির নির্দেশে তিনি ‘নাটকের মঞ্চসজ্জা’ কেমন হবে তার স্কেচ করে রাখতেন। কবি তাঁর অনুরোধে আর উৎসাহেই যে নৃত্যনাট্যগুলির খসড়া করেছিলেন সেটা আগেই বলা হয়েছে। ‘মায়ার খেলা’রও নতুন রূপ দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিমা আবার ‘কথা ও কাহিনীর সামান্য ক্ষতি’, ‘গল্পগুচ্ছের ক্ষুধিত পাষাণ ও দালিয়া’ গল্পকে ‘ট্যাবলো ধরনের মূকাভিনয়’ আকারে রূপায়িত করে কবিকে দেখিয়েছিলেন। তাতেও অবশ্য অভিনয়ের চেয়ে ভাবনৃত্যের প্রাধান্য ছিল। প্রতিমার নিজের মতে রাবীন্দ্রিক নৃত্যনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য ‘সংমিশ্রণ’। তিনি শান্তিনিকেতনের নৃত্য কোন বিশিষ্ট নৃত্যকলার আঙ্গিককে গ্রহণ করেনি। ‘মিশ্র তল ও ভঙ্গির সহযোগে’ বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হয়েছিল। তাই ‘মণিপুরী আঙ্গিকে’ গড়ে ওঠা ‘চিত্রাঙ্গদা’র নাচ সমস্ত মণিপুরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ‘দক্ষিণী আঙ্গিকে’ তৈরি ‘চণ্ডালিকা’কে চেনা যাবে না দক্ষিণী নাচের মধ্যে। মিশ্রণের এমনি গুণ। এর পর সেই ‘মিশ্র নৃত্যকে’ দাঁড় করান হয়েছিল সঙ্গীতের ভিত্তির ওপর। সেটাই হয়েছিল শান্তিনিকেতনের নতুন দান। এই ‘সঙ্গীতযোগে নৃত্যের পূর্ণবিকাশ’ আমাদের প্রাচীন নৃত্যে দেখা যায় না। ‘রবীন্দ্র-নৃত্যের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্য’ রক্ষার কথাও ভেবেছিলেন প্রতিমা। তাই ‘গানের স্বরলিপি’র মতো ‘নৃত্যলিপির কথা’ও তার মনে এসেছিল। শিল্পী হারিয়ে যাবে। শিল্প হারাবে না। শিল্প যে অবিনশ্বর! রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে যে শিল্প ‘নৃত্যরূপ’ লাভ করেছিল, তার মধ্যে ছিল ‘আপন স্বকীয়তা’। একে যদি ধরে না রাখা হয় তাহলে যে হারিয়ে যাবে সেই ‘নয়ননন্দন ভঙ্গিমা’। তাই প্রতিমা আশ্রমের নতুন মেয়েদের নিয়ে নাচের ক্লাস করতেন। মেয়েদের দিয়ে নাচ তৈরি করিয়ে কবিকে দেখাতেন। কবির অনুমোদন না পেলে সন্তুষ্ট হতেন না। চলত অনুশীলনের পর অনুশীলন। তখন অবশ্য সব নৃত্যই ছিল ‘ভাবনৃত্য’। ‘গানের ভাব’ই প্রকাশ পেত ‘নৃত্যভঙ্গিমায়’। প্রতিমা নিজেই ‘নাচের মুদ্রা’ দেখিয়ে দিতেন; পুরোপুরি নাচ তৈরি করে দিতেন সুন্দরভাবে গানের সঙ্গে গলা মিলিয়ে। ‘নাচের বোল’ ছাত্রীদের লিখে রাখতে বলতেন এবং কলা ভবনের শিল্পীদের দিয়ে ‘নৃত্যের ভঙ্গি’ আঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথকে প্রতিমা যত গভীরভাবে বুঝতেন ততখানি বোধহয় কেউ বোঝেননি! রথীন্দ্রের সঙ্গে কবির আদর্শগত মতবিরোধ হত, কিন্তু প্রতিমার সঙ্গে নয়। তাই ‘কবির শেষজীবনের অনুপুঙ্খ ঘটনার পূর্ণ নির্বাণ’ প্রতিমার হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল। এমন নির্লিপ্ত মৌখিক ভঙ্গিতে তিনি কবির সর্বশেষ পর্যায়টি বর্ণবিরল পরিচ্ছন্ন কয়েকটি হালকা রেখার টানের মতো ফুটিয়ে তুলেছেন যা নিজে না পড়লে বোঝা যায় না। শান্তিনিকেতনে তিনি ‘নারীশিক্ষা’ ও ‘নারীকল্যাণের দিক’টাও দেখতেন। মেয়েদের নিয়ে গড়েছিলেন ‘আলাপিনী সমিতি’। ‘আলাপিনী সমিতি’র নিজস্ব কাগজ ছিল ‘শ্রেয়সী’। ‘শ্রেয়সী’ পত্রিকার সব কটা সংখ্যা আর পাওয়া যায় না। ‘ইন্দিরা’ ও ‘হেমলতা’ ছাড়াও ‘আলাপিনী সমিতি’তে ছিলেন ‘সুকেশী’, ‘কমলা’, ‘মীরা’ ও আরো অনেকেই। মাঝে মাঝে ঘরোয়া এবং পুরোপুরি মেয়েলি অনুষ্ঠানে তাঁরা লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেরাই নানারকম নাচের মুদ্রা অভিনয় করতেন, গান গাইতেন। আবার কখনো কখনো শান্তিনিকেতনের তেঁতুলতলায় ছোট চৌকি পেতে বসে তাঁরা বোলপুরের মেয়েদের শেখাতেন গান, বলতেন গল্প। চারপাশের গ্রামে কাজ করা পছন্দ করতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই প্রতিমার ব্যবস্থায় আশ্রম থেকে মেয়ের পালা করে যেতেন গ্রামে – কখনো হেঁটে কখনো গরুর গাড়ি চড়ে। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েদের তাঁরা শেখাতেন, কি করে স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি করা যায়, শরীর ভাল করা যায়, কিংবা টুকিটাকি হাতের কাজ করে তা থেকে দু’পয়সা উপার্জন করে সংসারের সাশ্রয় হয় – এইসব! কবির সমস্ত ইচ্ছেকেই সাগ্রহে রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন প্রতিমা।
এহেন রূপবতী ও গুণী স্ত্রী থাকতে, কি কারণে রথীন্দ্রনাথ বন্ধুপত্নীর সাথে গৃহত্যাগ করেছিলেন – সেই প্রশ্নের উত্তর আজও অজানা। এই কাহিনীর শুরুটা ঠিক কোথায়, বা কী ভাবে, তা খুব স্পষ্ট করে বলা কঠিন। অনুমান করা চলে শুধু। অনুমান করা চলে, তিনি দেখেছিলেন, দিগন্তে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। দুপুরবেলার নিঃসঙ্গতার মতো মেঘ। বাবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রয়াত হয়েছিলেন প্রায় দশককাল হয়ে গেল। পড়ে ছিল ‘বিশ্বভারতী’। তখন সেই বিশ্বভারতীর রাশ ছিল তাঁরই হাতে, অথচ, তিনিই কি না ছিলেন ঘোর একলা। না কি, একলা নন! রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নামসংক্ষেপে ‘রথী ঠাকুরের রক্তে’ ছিল একটি মায়া। তিনি এস্রাজে ছড় টানটান, সুর উঠত। সেই সুর কি বাতাসে ভেসে ‘উত্তরায়ণ’ থেকে ধেয়ে যেত ‘শ্রীপল্লী’র দিকে? বিশেষতঃ ‘শ্রীপল্লীর পাঁচ নম্বর বাড়ি’টির দিকে? ‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’, ‘গুরুদেব’ এমন নানা বিশেষণের পুষ্পরাজি যাঁর পায়ে সমর্পিত, সেই ‘মহামহিম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিলাভের পরে ‘প্রথম উপাচার্য রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ক্রমে ক্ষয়ে যেতে শুরু হয়েছিলেন ‘একটি গোপন টানে’। ‘‘বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিল, সে কি আমারি পানে ভুলে পড়িবে না’’ – একটি গানে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রথী ঠাকুর যেন দেখতে পেয়েছিলেন, সেই গান যেখানে সত্য, সেখানে বয়ে চলে শীর্ণ কোপাই, পথপাশে ঘন ছায়া, আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে, তাঁর পরনে ঢাকাই শাড়ি, এবং কপালে সিঁদুর! সিঁদুরের কথা মনে পড়তেই এস্রাজে সুর উতলা হত! ‘সীমন্তচিহ্ন’ই প্রমাণ, সেই নারীটি পরস্ত্রী। ‘শান্তিনিকেতনে প্রথম যুগের আশ্রমিক’ এবং পরবর্তী কালে ‘বিশ্বভারতীর শিক্ষক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ ছিলেন তাঁর দীর্ঘকালের পরিচিত। সেই ‘নির্মলচন্দ্রের’ই তরুণী স্ত্রী, ‘মীরা’। পূর্বনামে ‘মীরা বিশী’, এবং ‘নির্মলচন্দ্রের’ সঙ্গে বিবাহের পরে ‘মীরা চট্টোপাধ্যায়’। সেই বিবাহ নিয়ে তখন শান্তিনিকেতনে কিছু বাধাও এসেছিল, পরে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে তা দূর হয়েছিল। ১৯১৮ সালে ‘নির্মলচন্দ্র’ ছিলেন ‘আশ্রমের ছাত্র’, এর পর রবীন্দ্রনাথের ডাকে ১৯৩৮ সালে সেখানেই ফিরে এসেছিলেন ‘ইংরেজির শিক্ষক’ হিসেবে। রথীন্দ্রনাথের দীর্ঘশ্বাসও সম্ভবতঃ তাঁর এস্রাজের সুরে মিশে যেত। কেন যে তাঁর মন ভুলত, তা তাঁর নিজের মন জানত না। তিনি শুধু এটুকু জানতেন যে সেই মুহূর্তে তাঁর মানসপটে আর কেউ নেই। কিছু নেই। ছিল দু’টি উজ্জ্বল, ঘনকৃষ্ণ চক্ষু। ‘মীরা’। ছিল বিচিত্র একটি সম্পর্ক। যে সম্পর্কের দাবিতে ‘উপাচার্যের লেটারহেডে’ই ছোট্ট একটি হাতচিঠিতে তিনি লিখেছিলেন –
‘‘মীরা,
ডাক্তার বাবু বলেছিলেন আজ sponging নিতে। সুপূর্ণা ঠিক পারে না তাই তোমার যদি অসুবিধা না থাকে তবে কি একবার ১১টার কাছাকাছি এসে এটা করতে পারবে? আমি সকালে জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলুম। জানি না তোমার অভ্যাস আছে কি না যদি অসুবিধা না থাকে তো এস মিনিট দশ-পনেরোর জন্য। তোমার উপর খুবই অত্যাচার করছি।
রথীদা।’’
হাতচিঠি এখানেই ফুরোয় না, নীচে জুড়ে ছিল আরও একটি বাক্য, এই প্রস্তাব একটু বিসদৃশ ও অস্বস্তিকর তাই হয়ত লিখেছিলেন – ‘‘যদি অভ্যাস না থাকে তো জানিও আমি নিজে ম্যানেজ করে নেব। সঙ্কোচ কর না।’’
কিন্তু, আসলে ঠিক কাকে বিহ্বল করে সঙ্কোচ? পত্রলেখককেই কি নয়? পুনশ্চের মতো একটি বাক্য জুড়ে দিতে হয় কেন? বিশ্বভারতীর উপাচার্যের লেটারহেড-এ এক প্রৌঢ় পুরুষ তাঁর ‘অঙ্গ-চর্যার’ জন্য ডেকেছিলেন সদ্য ত্রিশ-পেরোনো এক যুবতীকে। যদিও সেই কাজ অসুস্থের চিকিৎসা-সংক্রান্ত, তবু আমন্ত্রণটিই তো ঈষৎ অ-স্বাভাবিক! গত শতকের মধ্যভাগের সমাজ-সম্পর্কের বিচারে তো বটেই, এমনকী এখনও, এই একুশ শতকী বঙ্গভূমেও, এমন চিঠি চার পাশে বেশ কিছু ভ্রু কুঞ্চিত করবে, নিশ্চিত! কী কথা তাঁহার সাথে? কেনই বা ডাক দেওয়ার পরে কয়েকটি শব্দে সহসা একটি দূরত্ব জাগিয়ে রাখার প্রয়াস? অন্তরঙ্গতা সত্ত্বেও কাছে থেকে দূর রচনার আলতো একটি খেলা? কেনই বা তাঁর স্বামী ‘নির্মলচন্দ্র’কে আর একটি ছোট্ট হাতচিঠিতে জরুরি কাজ নিয়ে বসার কথা জানিয়ে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – ‘‘কাল সকালে কফি টেবিলে কথা হতে পারে যদি তোমরা এস – রথীদা।’’ সর্বনামের নীচে নজরটান তাঁরই দেওয়া, পাছে তাও চোখে না পড়ে, তাই অন্তিমে আরও দু’টি বাক্য জুড়তে হয়েছিল, ‘‘বহুবচনটা লক্ষ্য রেখ। আমাকে দোষের দায় ফেল না।’’ কেন ‘তোমরা’? কাজ তো ছিল ‘নির্মলচন্দ্রের’ সঙ্গে। কাজটা ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’-তে একটি অনুষ্ঠান নিয়ে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের সঙ্গে এক শিক্ষকের জরুরি কিছু আলাপ। সেখানে ‘বহুবচন’টি কেন? স্বাভাবিক, প্রাতরাশের আমন্ত্রণ একলা শিক্ষকটিকেই করা হয়তো সৌজন্যের বিরোধী, বিশেষতঃ তিনি যখন এই নবীন দম্পতিটির খুবই ঘনিষ্ঠ … কিন্তু, শুধুই কি ‘সৌজন্য’? শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা? টুকরো টুকরো চিঠিতে ছড়িয়ে থাকে এই ‘বহু’-বচন! আরও কিছু চিঠির দিকে নজর দেওয়া যাক –
‘‘কাল ছুটি, তায় আজ চাঁদনী রাত। অশেষকে বলেছি এস্রাজ নিয়ে আসতে। আহারাদির পর ৮টা-৯টার মধ্যে তোমরা দু’জনে এস যদি বাজনা শুনতে ভাল লাগে।’’
‘‘সন্ধ্যাবেলাটা একলা ভাল লাগে না। দেখেছ তো কেওই বড় আসে না। তোমরাও কি আসবে না?’’
‘‘যদি বিশেষ অসুবিধা বোধ না কর তবে আজ রাত্রিতে যদি এস তবে খুসী হব। অনেক উপকার পেয়েছি তোমাদের কাছ থেকে তাই লোভও অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। তোমাদের বেশি লেখা বাহুল্য। এটা নিতান্তই ছেলেমানুষী আবদারের মত তোমাদের মনে হবে, না?’’
এগুলো কি নিতান্তই ছেলেমানুষী’ বুঝি? তা হলে শান্তিনিকেতনের রাঙা ধুলোয় কেন উড়ত নানাবিধ গুঞ্জন? কেন জীবন্ত একটি প্রশ্নচিহ্নের মতো জেগে থাকতেন আর এক নারী? বয়সে রথীন্দ্রনাথের তুলনায় পাঁচ বছরের ছোট। সম্পর্কে তাঁর সহধর্মিণী। ঠাকুর পরিবারের প্রথম ‘বিধবা’-বধূ প্রতিমা দেবী। ‘কোণার্ক’ ভবনে ছিল তাঁর নিভৃত বাস। ‘উত্তরায়ণের’ যে ‘পম্পা সরোবরের ধারে’ রথীন্দ্রনাথের দারু-কর্মের স্টুডিও ‘গুহাঘর’, তারই উপরে ছিল প্রতিমা দেবীর স্টুডিও ‘চিত্রভানু’! ‘গুহাঘরে’ই থাকতেন রথীন্দ্রনাথ। অথচ দু’জনের সাক্ষাৎ ছিল না। কী করেই বা থাকে? যে শান্তিনিকেতন একদা পরিহাস করে বলত, বিশ্বভারতী কোথায়, এ তো ‘বিশ্ব বা রথী’, সেখানেই জনতার কানে কানে ভাসত আর একটি নাম। ‘রামী’। ‘মীরা’ নয়, ‘রামী’! চকিতে প্রাচীন এক প্রেমকথার অনুষঙ্গ জেগে উঠত, আবার মিলিয়েও যেত লোকজনের বাঁকা হাসির মধ্যে! বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীনই একবার হাজারিবাগ গিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। সহচর ছিলেন ‘নির্মলচন্দ্রের স্ত্রী মীরা’। শান্তিনিকেতনের আকাশবাতাস বিদ্রূপে, সমালোচনায় তিক্ত হয়ে উঠেছিল। সে কথা কি বুঝতেন না প্রাজ্ঞ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর? তখনও গণমাধ্যম এমন সর্বত্রগামী ছিল না, ‘পাপারাৎজির দল’ তাঁকে তাড়া করেনি, কিন্তু মুখরোচক এমন একটি সংবাদ গোপন থাকেনি। রথীন্দ্রনাথের বোন, ‘মীরা ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায়’ ‘মেয়ে নন্দিতা’কে (কৃপালিনি) একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘রোজই কাগজ খুল্লে একটা আশঙ্কা হোত যে না জানি ওখানকার বিষয় কি লিখে বসে। একদিন Blitz কাগজে দাদার হাজারিবাগ যাওয়া নিয়ে বেশ স্পষ্টই লিখেছিল শুধু দাদার নামটা দেয়নি। বিশ্বভারতীর কাজ ছেড়ে দিলে সে দিকে আর কোনও দুশ্চিন্তা রইল না যে কে কি ছেপে দেবে Private Life-এ যা খুশী করতে পারবেন সে দিক দিয়ে আরো স্বাধীন হলেন কারোর বলবার কিছু রইল না।’’ আরেকটা চিঠিতে তিনি ‘নন্দিতা’কে লিখেছিলেন – ‘‘বৌঠান আর আমি তাই বলি যে লোকের কাছে মুখ রক্ষার এই চমৎকার ব্যবস্থা করলেন। নিজে পালিয়ে গিয়ে তাঁকে ত আর সে-গুলো শুনতে হবে না যা হয় আমাদের হবে।’’ রথীন্দ্রনাথের স্ত্রী প্রতিমা দেবীও লিখেছিলেন – ‘‘এত বৃদ্ধ বয়েসে শেষটা যে নিজেকে একটা এরকম উদ্দামতার মধ্যে নিয়ে ফেলবেন তা ভাবিনি।’’ আর সমসময়েই, ‘আত্মপক্ষ সমর্থনে’ ‘ভাগ্নি নন্দিতা’কে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দেহরাদূন’ থেকে – ‘‘তোরা হয় তো অনেক গুজব শুনতে পেয়েছিস্ – সব কথা সত্যি না জেনে হঠাৎ বিশ্বাস না করলে খুসী হব।’’ গুজব আর সত্যের রহস্যময় আলো-আবছায়ায় ঘেরা রথীন্দ্রনাথের জীবনের এই অংশটি ধরতে ‘আপনি তুমি রইলে দূরে’ গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ এই সব চিঠিপত্র সংকলন ও সবিস্তার আলোচনা করেছেন ‘নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়’।
সজ্ঞানেই হোক, বা অজান্তে, বোন ‘মীরা’ই ধরিয়ে দিয়েছিলেন অগ্রজ রথীন্দ্রনাথের জীবনে নিহিত সংকট! এক দিকে ‘বিশ্বভারতী’, ‘জনসমাজ’, ‘বিপুল দায়িত্ব’। অন্য দিকে, ‘Private Life’, ‘ব্যক্তিগত জীবন’। এক দিকে ‘ইতিহাসের চাপ’, ‘ভাবমূর্তির দায়’। অন্য দিকে, ‘লুকোনো বেদনা’ – ‘‘যতই দেখি তারে ততই দহি আপন মনজ্বালা নীরবে সহি, তবু পারিনে দূরে যেতে …’’। অতঃপর? তিক্ত, বিষণ্ণ রথীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছিলেন – ‘‘আমাকে চলে যেতেই হবে এই কলুষিত আবহাওয়া ছেড়ে। আমার সামান্য যেটুকু পুঁজি আছে তাতে জীবনটা আয়েসে না হলেও কোনোরকমে চলে যাবে। টাকার চেয়ে যেটা বেশি দরকার মনে করি সেটা হচ্ছে একটু যত্ন ও সমবেদনা। এটা বলতে আমার লজ্জা হয় কিন্তু বয়স ও স্বাস্থ্যের কাছে হার মেনেছি। আমার এই দুর্বলতার জন্য তোমার কাছে অসম্ভব দাবি করেছি যা আমার আত্মীয়দের কাছেও করি নি, করতে ইচ্ছাও করে না।’’ সম্ভবতঃ ‘গুহাঘরে’র নিভৃতে বসেই ‘নির্মলচন্দ্রের কাছে’ কী ‘অসম্ভব দাবি’ রাখার কথা ভেবেছিলেন রথীন্দ্রনাথ? তার ছিঁড়ে গেছে কবে, সে খোঁজ কে-ই বা রেখেছিলেন? শেষে রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র তাঁরই অতি স্নেহভাজন এক শিক্ষকের পত্নীর সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন দূর দেশ। দেহরাদূন। সঙ্গে সেই নবীনার মা ছিলেন যদিও, জনরব তাতে মন্থর হয়নি একটুও। তবে এসবের আগেই সব গুঞ্জনকে ছাপিয়ে গিয়েছিল আশ্রমের ‘অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ আর তাঁর স্ত্রী মীরার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের ‘প্রথাভাঙা অন্তরঙ্গতা’। ও দিকে ‘নির্মলচন্দ্র আর মীরা’কে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেওয়ার মৌখিক পরামর্শ দিয়ে, উপাচার্য রথীন্দ্রনাথের কাছে খবর পাঠিয়েছিলেন ‘আচার্য জওহরলাল নেহরু’। এতেই যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল অপমানিত রথীন্দ্রনাথের। ‘পদত্যাগ’ করেছিলেন তাঁর কাছেই। কারণ হিসেবে লিখেছিলেন, তাঁর শরীর খারাপ। ঠিক করেছিলেন, ‘বিশ্বভারতীর কলুষিত পরিবেশ’ ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবেন। সেই ‘স্বেচ্ছা-নির্বাসনে’ তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য ‘নির্মলচন্দ্রের কাছে’ তার পর তিনি করে বসেছিলেন এক ‘অসম্ভব দাবী’। ‘নির্মলের কাছে’ এক রকম সোজাসাপটা ভাবেই তিনি চেয়ে বসেছিলেন বয়সে তাঁর ‘একত্রিশ বছরের ছোট মীরা’কে। এই চাওয়ার কথা প্রথম স্বীকার করে চিঠি লিখেছিলেন ‘নির্মলচন্দ্র’কে। তারিখ ছিল ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৩। স্বামী ‘নির্মলচন্দ্র’ বিশ্বভারতীতেই কর্মসূত্রে নিয়োজিত ছিলেন। কন্যা ‘জয়িতা’ও ছিলেন বিশ্বভারতীর ছাত্রী। কিন্তু ‘মীরা চট্টোপাধ্যায়’ ছিলেন তাঁদের থেকে অনেক দূরে। রথীন্দ্রনাথ এবং মা ‘কমলা দেবী’র সঙ্গে দেহরাদূনে। তাঁদের নতুন বাড়ির নাম, ‘শেষের কবিতা’-র অনুষঙ্গে, রথীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন ‘মিতালি’। ‘নির্মলচন্দ্রের’ নীরবতা এক্ষেত্রে ছিল বিস্ময়কর এবং প্রলম্বিত। ছুটিতে তিনিও গিয়েছিলেন সেখানে, আবার ফিরেও এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। কিন্তু, এই ত্রিভুজের গভীরে কি থেকে গিয়েছিল আরও কিছু? শুধুই কি ‘নির্মলচন্দ্র’ই যেতেন দেহরাদূনে? দূর থেকে কি আরও বেশ কিছু উৎসুক চক্ষু অপলকে সেই বাড়ির দিকে কি তাকাত না? রথীন্দ্রনাথের বোন ‘মীরা দেবী’ মেয়ে ‘নন্দিতা কৃপালনি’কে চিঠিতে লিখেছিলেন – ‘‘বৌঠানের সঙ্গে দাদার চাক্ষুষ দেখা হয়নি তবে মুসুরি যাওয়া আসার পথে দাদা যেখানে আছেন বাড়ীটা দু দিন বার দেখেছেন। বারান্ডা থেকে নতুন শাড়ী ঝুলছে তাও দেখছেন। রামকৃষ্ণ আশ্রমের কাছে জমি কিনে নতুন বাড়ী তৈরি করছেন দুজনে মিলে তদারক করতে যান তাও শুনেছেন। … এখন বুঝছি যে বাবার নাটকগুলোর জবাই করে সে টাকায় রামীর জন্যে নতুন প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে। কালিংপংএর বাড়ীর ভিতরে যে সব কাঠের কাজ আছে তার ডিজাইন ও মাপ জোপের খাতা সুবলকে পাঠাতে লিখেছেন। বুঝলুম যে এটা রামীর আবদার রাখবার জন্যে যাতে চিত্র-ভানুর চেয়ে তার বাড়ী কোন অংশে খাটো না হয়। সম্ভব হলে বোধহয় দ্বিতীয় আর একটা উদয়ন করে ফেলত তবে অত টাকা বোধহয় এখন নেই। আশ্চর্য্য ক্ষমতা রামীর, কোন যোগ্যতা না থেকেও শেষ পর্যন্ত বৌঠানের উপর টেক্কা মারল। দেরাদুনে দাদার ছবির একজিবিশন হচ্ছে শুনে মুসুরি যাবার পথে বৌঠান সেখানে একবার নেমেছিলেন দাদার আঁকা ছবির পাশে রামীর আঁকা ছবি পাশাপাশি ঝুলছে দেখলেন। আর কি চাই বল?’’ সহসা মনে হতেই পারে,এটা আশ্চর্য কোনও চিত্রনাট্য! চলন্ত গাড়ি থেকে পথের পাশে, কিছুটা দূরে একটি বাড়ির দিকে সতৃষ্ণ চেয়ে থাকতেন যিনি, তাঁরই স্বামী ছিলেন সেই গৃহের বাসিন্দা। ছিলেন স্বেচ্ছা-নির্বাসনে। সঙ্গে অন্য এক নারী। লং শটে দেখা যেত সেই বাড়ির বারান্দায় দোদুল্যমান একটি শাড়ি। সেই বস্ত্রের ঝকঝকে অবয়ব থেকে ঠিকরে আসত রৌদ্র। গাড়ি এগিয়ে যেত। মাথার ভিতরে, গম্ভীর পেন্ডুলামের মতো একটি শাড়ি দুলে চলত অবিরাম। ‘প্রতিমা দেবী’ ননদের মেয়ে ‘নন্দিতা’কে লিখেছিলেন – ‘‘কী ভয়ঙ্কর মেয়ে মানুষ শান্তিনিকেতনে আমাদের পাসা পাসি ছিল তা কখন পূর্ব্বে তো ভাবিনি। … আমার নিজের চেয়েও তোর মামার জন্যই কষ্ট আজ আমি পাচ্ছি। কী মতিভ্রম হোল নিজের কাজ কর্ম সব ছেড়ে ঐ একটা অতি অর্ডিনারী টাইপের মেয়ের সঙ্গে চলে গেলেন, মানুষের কত পরিবর্তন হয় তাই ভাবি।’’ আর যে নারীকে নিয়ে এই বিস্ময়কর আখ্যান, তাঁর সম্পর্কে স্বয়ং রথীন্দ্রনাথের কী ধারণা ছিল? দু’টি চিঠি দাখিল করা চলে দৃষ্টান্তবশতঃ। ‘নির্মলচন্দ্র’কে লিখেছিলেন রথীন্দ্রনাথ – ‘‘মীরার মধ্যে হাল্কা-হাসির দিক ছাড়াও যে গভীরতা আছে, যা সকলের চোখে পড়ে না, সেইটা না থাকলে বা আমি যদি না বুঝতে পারতুম তবে আমার এতটা ভাল লাগত না। আমার মনে হয় লোকে মীরাকে ভুলই বোঝে।’’ খোদ ‘মীরা’কে (চট্টোপাধ্যায়) একটা চিঠিতে লিখেছিলেন – ‘‘যা চাচ্ছিলুম, যার অভাবে মন অসাড় হয়ে গিয়েছিল তোমার মধ্যে তা দেখতে পেয়ে অন্তরাত্মা উল্লসিত হয়ে উঠল। একটুও দ্বিধা বোধ হয় নি…আমি তৃপ্ত হলুম, নিঃসঙ্গ জীবন সঙ্গী পেল, নিজেকে ধন্য বোধ করলুম। বাইরের জগৎ অদৃশ্য হয়ে গেল তোমার মধ্যেই আমার সমস্ত জগৎ পেয়ে গেলুম।’’ দেহরাদূনে একটি নিভৃতবাস ছাড়া বাকি সমূহ জগৎ অদৃশ্য হোক, এই আকাঙ্ক্ষাটি রথীন্দ্রনাথের তদানীন্তন মানসিক পরিস্থিতির পক্ষে অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। ঘটেওনি। ফলে ‘নির্মলচন্দ্র’কে তাঁর চিঠিতে লিখতে হয়েছিল – ‘‘আমাদের তিনজনের মধ্যে যদি কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকে তবে সেটা মর্মান্তিক বেদনাদায়ক হবে।’’ কিংবা ওই চিঠিতেই আর এক জায়গায় তাঁর বক্তব্য ছিল – ‘‘মীরা যে আমার মন অধিকার করেছে তার মধ্যে সন্তান স্নেহ, মাতৃভক্তি এবং অকৃত্রিম অকলুষ ভালবাসা সব মেশান আছে। এ কথা কি তুমি জান না?’’ পাশাপাশি ‘মীরা চট্টোপাধ্যায়’কে একটি চিঠিতে একবার লিখেছিলেন – ‘‘তোমারি সব, আমার কিছু নয়। আমার কেবল মীরু আছে সেই-ই আমার সমস্ত জগৎ ব্রহ্মাণ্ড। তাকে ছাড়া আমি কিছুই নই আমার কোনো অস্তিত্ব নেই। তাকে আমার সবকিছু দিয়েছি নিজেকেও সঁপে দিয়েছি।’’ আশ্চর্য ছিল সেই সমর্পণ! মাঝে মাঝে দেহরাদূন থেকে শান্তিনিকেতনে আসতেন রথীন্দ্রনাথ। সঙ্গে থাকতেন মীরা। কানাকানি চলত, তখন প্রতিমা দেবী চলে যেতেন নিঃশব্দ অন্তরালে, কিন্তু রথীন্দ্রনাথ থাকতেন অবিচলিত। আবার ‘মীরা চট্টোপাধ্যায়’ যখন স্বামী ‘নির্মলচন্দ্র’কে ‘‘নিমু আমার’’ সম্বোধন করে একটি চিঠি লিখেছিলেন, তখন সেই কাগজেই ছিল রথীন্দ্রনাথের লেখা একটি সংযোজন। সংযোজনটি কেন সেখানেই ছিল, কেন অন্য পত্রে নয়, সেই প্রশ্নটি অবশ্য বিশেষ অসঙ্গত নয়। উত্তর মেলে না। রথীন্দ্রনাথের নিজস্ব দাম্পত্য জীবনের কথা মনে আসে প্রসঙ্গতঃ। সেখানেও কি ব্যক্তিগত কোনও পরিসর রচনা করে নিতে পেরেছিলেন তাঁরা? পারলেও, কতটা পেরেছিলেন? ‘সুপ্রসিদ্ধ পিতৃদেবের ছায়ায় গ্রস্ত’ ছিল তাঁর ‘ব্যক্তিগত জীবন’। প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যায় নিরন্তর নিয়োজিত ছিলেন। ‘‘আমার রাস্তা দিয়ে যে তোমাদের জীবনের পথে তোমরা চলবে এ কথা মনে করা অন্যায় এবং এ সম্বন্ধে জোর করা দৌরাত্ম্য’’, এ কথা প্রতিমা দেবীকে লিখেছিলেন বটে রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু বাস্তবে কি অনেকটা সে রকমই ঘটে নি রথী এবং প্রতিমার যুগল-জীবনে? এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁদের ‘নিঃসন্তান জীবন’। এমনকী, ‘পালিতা কন্যা নন্দিনী’ (‘পুপে’)-র আগমনও অন্তর্গত ফাটলটি তেমন করে জুড়তে পারে নি। দু’জনে দু’ভাবে মুক্তির সন্ধান করেছিলেন হয়তো। ঝড় এসেছিল, যেমন আসে, আবার চলেও গিয়েছিল। প্রয়াণের ঠিক আগের বছর আগে, ১৯৬০ সালে ‘‘ভাই প্রতিমা’’ সম্বোধন করে একটি চিঠিতে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘আমরা দুজনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারো প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা শোভনীয় হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনো রাগ নেই আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি।’’ প্রথাগত প্র্যাকটিসে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাননি রথীন্দ্রনাথ। স্বভাবতই তাঁর বোন বা স্ত্রী কোনও দিনই তাঁর ‘মীরু’কে মেনে নিতে পারেননি। কখনও বলেছিলেন ‘‘কী ভয়ঙ্কর মেয়ে মানুষ’’, কখনও শঙ্কিত হয়েছিলেন ‘‘বুড়ো বয়সের দুর্ব্বল মন, একেবারে মীরার কবলে তলিয়ে যাবেন।’’ এ সব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করা আজ সম্ভব নয়। কিন্তু সন্দেহ নেই, ঠাকুরবাড়ির ঝকঝকে, পবিত্র-পবিত্র উঠোনে রথীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিক্রমী। সমালোচিত হয়েও, স্বতন্ত্র।
জানা যায়, কোলের ছেলে ‘জয়ব্রত’কে নিয়ে ‘মীরা’কে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেহরাদূনে গিয়ে বসবাসের সম্মতিও দিয়েছিলেন তাঁর ‘উদার-হৃদয় স্বামী’। নিজে শান্তিনিকেতনে থেকে গিয়েছিলেন মেয়েকে নিয়ে। যাওয়ার আগে প্রতিমাকে রথীন্দ্রনাথ লিখে গিয়েছিলেন, ‘‘আমি লুকিয়ে চুরিয়ে যাচ্ছি না, এখানে সবাইকে জানিয়েই যাচ্ছি মীরা আমার সঙ্গে যাচ্ছে।’’ রথীন্দ্রনাথের নিজের কথায়, ‘বিশ্বভারতী’ থেকে তাঁর ‘মুক্তি’ পাওয়ার দিনটা ছিল ২২শে অগস্ট ১৯৫৩ সাল। আর আশ্রম ছেড়েছিলেন তার দু’-একদিন পর। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬১। দেহরাদূনে প্রথমে তিনটে ভাড়াবাড়ি। তার পর ’৮৯-এ ‘রাজপুর রোডে’ তাঁর নিজের তৈরি বাড়ি ‘মিতালি’তেই মীরাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ‘বিশ্বভারতী’ ছেড়ে তাঁর দূরে চলে যাওয়ার ইচ্ছের কথা জেনেই প্রতিমা রথীকে লিখেছিলেন, শুধু ‘‘ভাল আছ এই খবর পেলেই খুশী হব।’’ ভাল থাকার খবর দিয়ে দেহরাদূন থেকে প্রতিমাকে নিয়মিত মমতায় মাখা সব চিঠি লিখেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। ও দিকে অদৃষ্টের হাতে সব ছেড়ে দিয়েও রথীর জন্য উতলা হয়েছিলেন প্রতিমাই। ১৯৬০ সালে বাংলা নববর্ষের আগে প্রতিমাকে রথী লিখেছিলেন, ‘‘আমরা দু’জনেই এখন জীবনের সীমান্তে এসে পড়েছি। এখন আর কারও প্রতি রাগ বা অভিমান পুষে রাখা (শোভনীয়) হয় না। সেইজন্য জেনো আমার মনে কোনও রাগ নেই – আমি সব ঝেড়ে ফেলেছি। আমাদের মধ্যে প্রীতি সম্বন্ধ অক্ষুণ্ণ থাকে এই নতুন বছরে তাই কামনা করি।’’ ‘রতনপল্লি’তে ‘ছায়ানীড়’-এ মেয়ে ‘নন্দিনী’র নিজের বাড়ি শুরু হওয়ার আগে সেখানেই রথীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন, নিজের মাথা-গোঁজা আর কাঠের-কাজের জন্য দু’-একটা ঘর। বলেছিলেন, ‘উত্তরায়ণ’ আর ভাল লাগে না তাঁর। ‘বাবার শততম জন্মবর্ষে’ একবার এসে ছুঁয়ে গিয়েছিলেন আশ্রমের মাটি। ৪ঠা মার্চ, মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার দিন গাড়িতে তুলে দিতে গিয়ে, তাঁর স্বামী ‘গিরিধারী লালা’র সঙ্গে ‘নন্দিনী’ সেই প্রথম দেখেছিলেন, বহু দুর্যোগে এযাবৎ অবিচল তাঁর বাবার চোখে জল! ৩রা মে ১৯৬১। দেহরাদূনের ‘মিতালি’তে, রবীন্দ্রনাথের শতবাৰ্ষিক জন্মদিনের দিনকয়েক আগে, পৃথিবী থেকে চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাবান পুত্র রথীন্দ্রনাথ। নির্বিবাদী, সিংহরাশি, ‘সেবক রথী’র বিষণ্ণ জন্মপত্রীতে তখন শুধু জেগে ছিল – ‘‘অমিত নবমী পূর্ব্বফল্গুনী।’’ রথীন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘিরেও ‘প্রশ্নের মেঘ’ জমাট বেঁধেছিল। ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ অনুযায়ী, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ‘অন্ত্রের সমস্যায়’। কিন্তু তাঁর বোন ‘মীরা ঠাকুর গঙ্গোপাধ্যায়’ মেয়েকে লিখেছিলেন – ‘‘সময় মত রোগের চিকিৎসা করে নি তাও ত যে শুনছে সেই বলছে কিন্তু সত্যি কি ওরা কিছু খাইয়ে মেরে ফেলেছে? শেষকালে এই ছিল কপালে! ওদের সবই ত দিয়েছিলেন তবু প্রাণে মারল কেন?’’ একদা ‘পুরুষের মন’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন রথীন্দ্র। তাতে তিনি লিখেছিলেন,
‘‘ছিল এক সময়
মেয়েদের আঁচলের হাওয়ায় দুলিয়ে দিত মন
তাদের ছোঁয়া গায়ে দিত কাঁটা
… কত জনের মাধুরী চুনে গড়লুম কল্পনার এক মূর্তি,
সব কাজের ফাঁকে উঠতে লাগল মনে
একটি মোহন ছবি।’’
(তথ্যসূত্র:
১- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, চিত্রা দেব।
২- আপনি তুমি রইলে দূরে, সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ, নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
৩- রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্মশতবর্ষপূর্তি-শ্রদ্ধার্ঘ্য (অনাথনাথ দাস সম্পাদিত)।
৪- On the Edges of Time, Rathindranath Tagore.
৫- A Home in Urbana: Correspondences between the Tagores and Seymours, Supriya Roy Ed.; The Diaries of Rathindranath Tagore, Supriya Roy Ed.;
৬- Rathindranath Tagore: The Unsung Hero, Tapati Mukhopadhyay and Amrit Sen Ed.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত