২২শে জুলাই ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী শ্রীমতী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন –
‘‘ড্রিঙ্ক করার পরে বন্ধুর বউয়ের সঙ্গে একটু ফ্লার্ট তো অনেকেই করেন! তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না, কিন্তু শক্তিকে অনেকটা খেয়েও তেমন কিছু করতে দেখিনি।
মদ্যপানের পরে সুনীলের বন্ধুদের মধ্যে নানা মজার ঘটনা ঘটত। এএইআই ক্লাবের আড্ডায় একবার কেউ একজন সুনীলকে বললেনও, শোনো, তুমি যদি স্বাতীকে ডিভোর্স করো, আমায় খবর দিও কিন্তু। সুনীল, বুদ্ধদেব গুহ, মতি নন্দী অনেককেই মেয়েদের সঙ্গে একটু-আধটু ফ্লার্ট করতে দেখেছি। আর শ্যামল (গঙ্গোপাধ্যায়) তো ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করতেন, ‘স্বাতী তুমি কি আমায় একবারটি চুমু খেতে দেবে?’ বন্ধুদের মধ্যে এ সবই নির্দোষ মজা। শক্তির কিন্তু মেয়েদের নিয়ে এই ব্যাপারটা কখনও দেখিনি!
আমার বরং ওঁকে দেখে কেমন মায়া হতো! মায়েদের যেমন সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটার ওপরে বাড়তি স্নেহ থাকে। আমার মনে হয়, মদ খেলে সুনীল খানিকটা বেশি ‘হোল্ড’ করতে পারত। চট করে অতটা বেসামাল হতো না। হলেও চুপচাপ থাকত। শক্তি তুলনায় বেশি হইচই করতেন। হয়তো একটু বেশি তাড়াতাড়ি অনেকটা খেয়ে ফেললেন! তার পর কয়েক বার বললেন, ‘আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়!’ কিংবা হয়তো নিজেদের মধ্যে একটু গালাগাল করলেন। সুনীলকে দু’-একবার দেখেছি, এই সময়ে ওঁকে সামলাচ্ছে, ‘শক্তি, উঁ-হু এখানে কিন্তু এ সব কথাবার্তা হয় না।’ প্রথম প্রথম লোকটাকে নিয়ে আমার একটু জড়তা ছিল। শক্তিকে একটু ভয়-ভয়ও করত। কিন্তু ক্রমশ সে-সব কেটে গিয়েছিল। তখন মনে হতো, যাই একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিই, কয়েক বার দিয়েওছি! বলেছি, ‘সত্যি আপনারা পারেনও! কেন এত খান? কী যে করেন! ’
শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতে তো কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা সুনীলের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়— যা-ই হোক, আমার কাছে শুধুই কিছু সুখস্মৃতি। শক্তি আর শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়া আমার বিশেষ প্রিয়। শক্তির খোলা গলায় কবিতা পড়ার মধ্যে একটা নিজস্বতা ছিল। ‘ফুটপাথ বদল হয় মধ্যরাতে’ বা ‘অবনী বাড়ি আছো’ তো শক্তির সিগনেচার কবিতা। আমার কিন্তু ‘ওই বাঘটা’ও বড্ড প্রিয়…সেই যে ‘ভালবাসার বাঘ বেরোল বনে’! তবে কবিতার বাইরের মানুষটাও একটা আলাদা ছাপ ফেলেছিল।
সুনীলের পুরনো বন্ধুদের মধ্যে অনেকের সঙ্গেই পরে খানিক সুর কেটে গিয়েছে, বা কিছু অভিমান জন্মেছে! কিন্তু শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ বদলায়নি। হ্যাঁ, কত লোকে তো কত কথা রটায়। এর-ওর নাম করে এটা-সেটা বলে। শক্তির নাম করেও হয়তো কেউ সুনীলকে কখনও কিছু বলেছে। কিন্তু তার ফলে শক্তি-সুনীল সম্পর্কে শেষ দিন অবধি আমি তেমন কোনও বদল দেখিনি।
এখনও শক্তির কথা ভাবলেই আমার ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার শেষ দিনটার কথা মনে পড়ে! উনি তখন আনন্দবাজার থেকে রিটায়ার করেছেন। শান্তিনিকেতনে পড়াচ্ছেন। সে-দিনটায় বেশ সকাল-সকাল আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়িতে এসে হাজির। তা আমার মনে আছে, দু’বন্ধু তো যথারীতি রামের বোতল খুলে বসলেন। আমি বেশ রাগ করেছিলুম! আর শক্তি অমনি ‘অমন করিস না মা, আজ একটু খেতে দে না’ করে উঠলেন। মদ খেলে আমাকে ‘তুই’ বলতেন, ‘মা-মা’ করে ডাকতেন। কিন্তু সে-দিন মদ্যপানের আগেই শক্তি-সুনীলের কিছু কথাবার্তা হয়েছিল, যা আমার মনে থেকে গিয়েছে।
আমি তখন রান্নাবান্না দেখছি, ঘরের কাজ সামলাচ্ছি, আর মাঝেমধ্যে ওঁদের মাঝে এসে বসছি। তখন সুনীল সাহিত্য অ্যাকাডেমি নিয়ে ব্যস্ত, আনন্দবাজারের চাকরিও করছে। লেখালেখির চাপ খুবই! ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে তখন সুনীলের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছিল। তখন বোধহয় ‘কৃত্তিবাস’ বন্ধই ছিল, বা বিক্ষিপ্ত ভাবে বেরোচ্ছিল। পরে আমাদের বিলেতের বন্ধু ভাস্কর দত্ত ‘কৃত্তিবাস’-এর পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। সেই সময়ে কে ‘কৃত্তিবাস’টা দেখবেন, কে সময় দেবেন— কিছুই ঠিক করা যাচ্ছিল না। দুই বন্ধুর মধ্যে এ সব নিয়েই কথা হয়েছিল।
শক্তি ‘কৃত্তিবাস’-এর দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। ‘আমি তো রিটায়ার করেছি। তুমি আমায় কৃত্তিবাসটা দিয়ে দাও।’ সুনীল এটা শুনে খুবই উৎসাহিত হয়েছিল। শক্তি বলছিলেন, ‘লেখা যে যার মতো দেবে, আমি নিজে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে আনব!’ শক্তিই মালিক-সম্পাদক হবেন। সুনীল শুনে বলেছিল, ‘এ তো খুব ভাল কথা! সত্যিই আমি আর পারছি না। তুমি দেখলে নিশ্চিন্ত হতে পারি! কলকাতায় ফিরে বাকি কথা হবে।’
এ সবই আমার নিজের কানে শোনা! খুবই সিরিয়াসলি কথা বলছিলেন দু’জনেই। তখনও কেউ গ্লাস হাতে নেননি। তার আগেই কৃত্তিবাসের ব্যাপারটা ওঁরা ঠিক করে ফেলেন। দু’জনেই একমত হয়েছিলেন। কিন্তু কথা আর হয়নি। শক্তির আর কলকাতায় ফেরাও হয়নি। সে-রাতে আমরা কলকাতায় ফিরে যাই! আর তার পরের দিনই শক্তির চলে যাওয়ার খবরটা ছড়িয়ে পড়ে।
ওই দিনটাতেও শক্তিকে মৃদু বকুনি দিতে হয়েছিল। শক্তি এদেশি। কিন্তু মিষ্টি দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। বোয়াল-চিতল সব মাছ ভালবাসতেন। সে-দিনও বোয়াল মাছ রান্না হয়েছে শুনে খুব ভালবেসে খেতে চাইলেন। কিন্তু ভাত খেতে পারলেন না! কিছুতেই খেলেন না। এত করে বললাম! তবু ভাত ছাড়া ভরদুপুরে শুধু মাছ খেয়েই বেরিয়ে গেলেন। সেই শেষবারের মতো।
এই শক্তির ক-ত গল্পই যে আমি শুনে আসছি, সুনীলের সঙ্গে আলাপ হওয়া ইস্তক। ওঁর কবিতা আমি আগেই পড়েছি, যেমন সুনীলেরটাও পড়তাম। কিন্তু আমি কবিতার তত ভক্ত ছিলাম না গোড়ায়। তখন সুনীলের ‘নীললোহিত’ বেশি ভাল লাগত। এর মধ্যে সুনীলের সঙ্গে আলাপ হল। তখন কিন্তু সুনীলের সঙ্গে শরৎবাবু (শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়), তারাপদ (রায়)— এঁদেরই বেশি দেখতাম। আমি-সুনীল, শরৎবাবু-বিজয়া এখানে-ওখানে বেরোতামও, শক্তি সেখানে থাকতেন না। পরের দিকে সাগরদা (সাগরময় ঘোষ) কোথাও ডেকেছেন। কিংবা এএইআই ক্লাবের আড্ডায় বসেছি! এই সব জায়গায় সব সময়ে শক্তিকে পাওয়া যেত না। উনি এলে সকলেই কিন্তু খুব খুশি হতেন। শক্তির সঙ্গে বোধহয় হিমানীশ গোস্বামীদের বেশি ভাব ছিল। বন্ধুর সংখ্যা শক্তিরই বেশি। সুনীলের তুলনায় প্রায় ১০-১২ গুণ। সুনীল তো একটু লাজুক প্রকৃতিরও ছিল। লোকে ভাবত দাম্ভিক! কিন্তু শক্তি বরাবরই যেখানে যায় মধ্যমণি! নানা রকম মজা, ছেলেমানুষিতে জমিয়ে রাখে। শক্তিকে দেখার আগেই ওঁদের বিষয়ে অনেক মজার গল্প আমি শুনে ফেলি। তার মধ্যে একটা ওই এলএসডি খাওয়া। শক্তি-সুনীল দু’জনেই খেয়েছিলেন। তারাপদ খাননি। একজনকে তো সামলাতেও হবে! বোধহয় তাই!
শুনেছি, আমেরিকার বিখ্যাত কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ওঁদের বলেছিলেন, বেশি নয়, তোমাদের বড় জোর দু’টো করে বড়ি দেব। তা ওরা দু’জনেই বোধহয় একটা করে খেয়েছিল। তাতেই যা হওয়ার হয়! আমার এখন ঠিক ভাল মনে নেই, কার কী হয়েছিল। তবে সুনীল সম্ভবত ছোটবেলায় চলে গিয়েছিল, খানিকটা নিজের থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে দেখছিল। অনেকগুলো লাল রঙের ফুটকি দেখছিল! আর আলপথের ওপর একটা ছোট ছেলে। কী-সব আশ্চর্য দৃশ্য! হ্যালুসিনেশন! শক্তিও তেমন কী যেন দেখেছিলেন, কিছু একটা দেখে ওঁর বোধহয় খুব কষ্ট হয়েছিল।
এই লোকটাকেই বোধহয় প্রথম দেখলাম ডায়মন্ড হারবারে। তখনও আমার আর সুনীলের বিয়ে হয়নি। আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা কেউ জানে না। শুধু দু’জনের মধ্যেই গোপন রয়েছে। সুনীলের অনেক বন্ধুর মধ্যে সে-দিন শক্তিও ছিলেন। সেটা অবশ্য খুব আলাদা করে মনে নেই। এই সময়ের কাছেপিঠেই সুনীলের বন্ধুদের দুদ্দাড় করে বিয়ে হতে লাগল। ১৯৬৭ সালটায় তো বিয়ের লাইন লেগেছিল। তারাপদ, সমরেন্দ্র (সেনগুপ্ত)-র বোধহয় আমাদের আগেই বিয়ে হয়েছিল। আমাদের পরে বোধহয় শক্তি, শরৎবাবু, শ্যামলের।
এর পরে শক্তির কাছেও ওঁদের সবার অল্প বয়সের দৌরাত্ম্যের নানা গল্প শুনেছি। আমায় একবার বলেছিলেন, ‘জানো, তোমার বর আমায় মেরেওছে! ওর মার খেয়েই আমি এখনও কানে একটু কম শুনি!’ সুনীলের হাতের পাঞ্জাটা খুব বড় ছিল তো! সুনীলও পরে বলেছিল, শক্তিকে সামলাতে কখনওসখনও একটু-আধটু অমন করতে হতো। এ সবই ওরা যখন দল বেঁধে রাতের কলকাতা শাসন করত, তখনকার ঘটনা। মাঝেমধ্যে টলমলে অবস্থায় মাথা গরম করত ওরা সবাই। ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে ঝামেলাটামেলা হয়েছে, শুনেছি। আবার নিজেদের মধ্যেও টুকটাক কিছু! কিন্তু তখনকার এ সব ঘটনা ওঁদের বন্ধুত্বে কোনও দিন ছায়া ফেলেনি।
পরের দিকে, মানে আমাদের বিয়ের পরে অবশ্য ওঁদের মধ্যে কোনও মারকুটেপনা আমি দেখিনি। তবে একটা ঘটনা আলাদা করে মনে আছে। আমাদের বাড়িতেই ঘটেছিল! তখন সম্ভবত আমরা বিজন সেতুর দিকটায় একটা অন্য বাড়িতে থাকতাম। আমার শাশুড়ি-মা অন্য কোথাও গিয়েছিলেন। এই সুযোগে বাড়িতে একটা আসর বসেছিল। শক্তি, সুনীল, মতি… তার পর খেলোয়াড়রা—চুনী গোস্বামী, পিকে ব্যানার্জি এঁরা ছিলেন। শক্তি তো নিজেই খুব উৎসাহ নিয়ে বললেন, আমি ‘বার’ সামলাচ্ছি। আর ‘বার’ সামলানো মানে তো যত না সামলাচ্ছেন, নিজে ঢকঢক করে খাচ্ছেনও তত বেশি। এর মধ্যেই ঘটল ঘটনাটা। পিকে তো খুব সুন্দর কথা বলতেন। আর অনর্গল কথা বলতেন। শক্তি বোধহয় কিছুতেই ‘এন্ট্রি’ পাচ্ছিলেন না। আচমকা ‘অ্যাই চুপ!’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আমরা সবাই একটু অপ্রস্তুত। পিকে নিজেও বেশ খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছেন।
এর কিছুক্ষণ বাদে পিকে, চুনীরা চলে যাওয়ার পরই বোধহয় শক্তি আর মতির মধ্যে গোলমাল শুরু হল। ঠিক কী নিয়ে, এত দিন বাদে তা আর মনে নেই। কিন্তু একটার পর একটা গ্লাস ভাঙছে তখন! কাউকে থামানো যাচ্ছে না। সে যা-হোক, কোনওমতে সামলানো গেল। তবে আমাদের বাড়িতে শক্তির আসাটা খুব ঘন-ঘন ঘটত না। এর একটা কারণ বোধহয় আমার শাশুড়ি-মা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। সুনীলের মা খুব ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন। তখনকার দিনে তো মা-বাবারা থাকলে ছেলেমেয়েদের এত মদ খাওয়ার চল ছিল না। আমার শাশুড়ি-মা সুনীলকে দিয়ে মদ খাওয়ার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তা, সুনীলের পক্ষে তো ‘মদ খাব না’ কথা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ও চেষ্টা করত, মা থাকলে বাড়িতে না-খাওয়ার বা বাইরে থেকে খেয়ে এসে চুপ করে শুয়ে পড়ার। এ ছাড়া জানতাম, একটু বেশি খেলে শক্তি মাঝেমধ্যেই বাড়ি না-ফিরে কোনও বন্ধুর বাড়িতে থেকে যাওয়াটা প্রেফার করেন। তারাপদদের বাড়িতে ওঁরা স্বামী-স্ত্রী শুধু দু’জনে থাকতেন। শুনেছি, শক্তি সেখানে খুব যেতেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো মা থাকতেন। হয়তো সে-জন্যই শক্তি সচরাচর অত রাতে তেমন একটা আসতেন না।
কিন্তু সেই নিয়মেরও হেরফের ঘটেছে। একবার অন্তত স্পষ্ট মনে আছে, শক্তি আমাদের বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন। সে রাতে খাওয়ার পরে একটা সিঙ্গল খাট বা ডিভানে ওঁর শোওয়ার বন্দোবস্ত হল। মনে আছে, শুয়ে মাঝেমধ্যেই কী রকম আওয়াজ করছেন! কখনও বা আচমকা ‘অ্যাই সুনীল’ করে ডেকে উঠছেন! উনি এমন করায় আমি দু’-একবার বলেছি, ‘যান, এ বার ঘুমিয়ে পড়ুন’, কিন্তু ফল হচ্ছে না। তখন মাকে গিয়ে বলেছি। মা অমনি উঠে এসে বললেন, ‘শক্তি, কী হল! কেন ঘুমোতে পারছ না? এমন চিৎকার করে না। আমরা কেউ ঘুমোতে পারছি না! যাও, অন্য কথা ভাবো, ঠিক ঘুম চলে আসবে!’ ও মা, ঠিকই তো! দেখলাম, শক্তি একটু বাদে ঠিক ঘুমিয়ে পড়লেন।
শক্তির আর একটা ঘটনাও ভোলা মুশকিল। একবার, বোধহয় ওই বিজন সেতুর বাড়িতেই বাজারের থলে হাতে ওঁর মেয়ে বাবুইকে সঙ্গে নিয়ে হাজির। তার পর এটা-সেটা বলতে বলতে ‘এই একটু বাজারটা সেরে আসছি’ বলে উধাও! তার পর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাবার। আর আসেনও না! তখন তো অত ফোনও ছিল না। থাকলেও বোধহয় শক্তির স্ত্রী মানে মীনাক্ষীর নম্বর আমাদের কাছে ছিল না। বাড়িতে আমি আর শাশুড়ি-মা। সুনীল একটু বাদে অফিসে বেরিয়ে গেল। আমাদের ছেলে পুপলু, শক্তির মেয়ের থেকে বোধহয় অল্প বড়। কিন্তু ওদের মধ্যেও তত ভাব নেই। বেচারি বাচ্চা মেয়ে তো একটু বাদে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। খালি ‘বাড়ি যাব, বাড়ি যাব’! আমি আর মা ওকে সমানে খাওয়াতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বেচারি তখন বাড়ি যাবে বলে অস্থির।
বুঝতে পারছিলাম, মীনাক্ষী কেন ওঁর ওপর এত রাগ করেন। শেষে বোধহয় অনেক পরে এসে বাবুইকে নিয়ে গেলেন। শক্তি নিজে এসেছিলেন, না কোনও জায়গা থেকে খবর পেয়ে মীনাক্ষী এসেছিলেন, তা এত দিন বাদে আর মনে নেই। তবে মনে আছে, পরে শক্তিকে বেশ বকেছিলাম। তাতে অবশ্য ওঁর বয়েই গিয়েছে।
আমাদের দু’টি পরিবারের বাচ্চাদের নিয়ে মেলামেশা ওদের ছোটবেলার পরে অবশ্য বড় একটা হয়নি। কিন্তু পার্ক সার্কাসের কাছে কর্নেল বিশ্বাস রোডে শক্তিদের বাড়িতে ওঁর জন্মদিন আমার খুব মনে আছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তখন সুনীলের চেয়ে শক্তির বেশি ভাব। আর আমি তো সৌমিত্ররও ফ্যান! তো, শক্তির বাড়িতে গিয়ে দেখি, সৌমিত্র হারমোনিয়াম কোলে নিয়ে বসে গান করছেন। এই দৃশ্যটা শক্তির সৌজন্যেই পাওয়া।
আর মীনাক্ষীকেও আমি খুবই অ্যাডমায়ার করি। উনিও কবিতার পত্রিকা করতেন, লিখতেন। ব্যক্তিত্বময়ী। পরের দিকে শক্তি-সুনীলের অফিসে নিয়মিত দেখা হলেও বাড়িতে আমাদের মেলামেশা কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিকে একদিন একসঙ্গে বেড়ানো আমার খুব মনে পড়ে। বোধহয় মধ্যপ্রদেশের কবি অশোক বাজপেয়ীর ডাকে শক্তি-সুনীল ভোপালে কবিতা পড়তে গিয়েছিলেন। আমি আর মীনাক্ষীও গিয়েছিলাম। বাচ্চারা তখন একটু বড় বোধহয়। পুপলুকে কলকাতায় মায়ের কাছে রেখে যাই। ভোপাল থেকে ওঁদের দেওয়া একটা গাড়িতে আমাদের চার জনের বেড়াতে যাওয়া হল পাঁচমারি।
তখন কিন্তু শক্তিকে ক’টা দিন খুব লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকতে দেখেছি। সুনীল তো ড্রাইভারের পাশে বসতে ভালবাসত। গাড়িতে উঠেই একদম সামনে গিয়ে বসেছে। মীনাক্ষী গম্ভীর ভাবে শক্তিকে বললেন, তুমি ধারে বসবে না! শক্তিরও কোনও প্রতিবাদ নেই। মনে আছে, সুনীল সামনে আর পিছনে আমি আর মীনাক্ষী সাইডে বসেছি, শক্তি মাঝখানে। আমার বরং তখন মনে হচ্ছিল, ইস্, সুনীল যদি আমার একটু কথা শুনত…
এমনিতে সাইটসিয়িং-এ শক্তি-সুনীলের তত ঝোঁক ছিল না। নানা জায়গায় ঘোরা হচ্ছে। আমি আর মীনাক্ষীই এ দিক-সে দিক উঠছি নামছি। শক্তি আর সুনীল বড়জোর গাড়ি থেকে নেমে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় মগ্ন। আর গাড়িতে বসে টুকটাক হাতবদল চলছে বোতলের। অত শাসনের মধ্যেও শক্তি-সুনীলের স্টক রেডি থাকত। বোতলে জল মেশানো। গাড়িতে বসেই সামনের সিট-পিছনের সিটের মধ্যে বোতলটা ঘুরছে। এর মধ্যেও মনে পড়ে, শক্তি আর সুনীলও এক বার কোনও একটা জায়গায় নেমেছিল। বোধহয় অনেক সিঁড়ি ভেঙে জলের মধ্যে একটা মন্দিের। পরের দিকে সুনীল আর অত সিঁড়ি ভাঙতে পারত না।
ওদের বন্ধুদের সেই প্রাণবন্ত অতীতটার কথা এখন খুব মনে হয়। শক্তিদের সঙ্গে দল বেঁধে আর কোথাও বেড়ানো খুব একটা হয়নি। হলেও বড়জোর দু’-একদিনের জন্য। শক্তি চলে যাওয়ার পরেও বেলেঘাটায় ওদের বাড়ি গিয়েছি। কী সুন্দর বাগানঘেরা জায়গা! মাঝে মীনাক্ষীর শরীরটা খারাপ হয়েছিল। তখন গিয়েছিলাম। গাছপালা, শক্তির নাতি-নাতনিদের নিয়ে জমজমাট সেই বাড়ি, সত্যিই খুব ভাল লেগেছিল।
আর শক্তিকে যতটুকু দেখেছি, ওঁর পাগলামি বোহেমিয়ানিজমের বাইরেও একটা অন্য মানুষ ছিলেন। শুনেছি, শক্তি বাজার খুব ভাল করতেন। এ দিক-ও দিক ঘুরতেন, বাড়ি ফিরতেন না, আবার কয়েক দিন মাঝেমধ্যে খুব ভাল হয়েও থাকতেন। চান করে মাথা আঁচড়ে বসে পরিপাটি ভাত খেতেন। এই শক্তির জন্য আমার খুব আফসোস হয়। সুনীলদের বন্ধুদের মধ্যে ও-ই তো সবার আগে চলে গেল।
কবিতার আমি কী-ই বা বুঝি, তবে মনে হয়, শক্তির কোথাও একটা ইনার ডিসিপ্লিন ছিল। নইলে এত ভাল লিখবে কী করে? সুনীলকে পরের দিকে দেখেছি, দিনের বেলা অফিসের দিনে মদ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। শক্তি সে-সব আমল দিতেন না। উনি হয়তো নিজের টার্মসে বেঁচেছেন। আনন্দে থেকেছেন। তবে ওঁকে যাঁরা ভালবাসতেন, তাঁদের কথা ভাবলে মনে হয়, একটু রাশ টানলেই ভাল হতো। এখন দেখি অনেকেই বলেন, শক্তি তো প্রথমে গল্প লিখতেন, সুনীল কবিতা! ওঁরা নাকি চেয়েছিলেন, নিজেরা এক সঙ্গে সব না-করে আলাদা-আলাদা দিক ধরে রাখবেন। আমি অত বুঝি না! সুনীল-শক্তি যে যেমন ইচ্ছে লিখেছেন। শক্তি আরও গল্প লিখলে সেটাও খুব ভাল হতো বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু আমি বলব, শক্তির কবিতার মধ্যেও কত ভ্যারাইটি ছিল। আমাকেও তো কত জন বলতেন শক্তির কবিতার কথা। লোকে সুনীলের মহিলা ফ্যানদের কথা এত বলে, আমার কিন্তু বাংলাদেশের এক মহিলার কথা মনে পড়ছে, শক্তির কবিতার অন্ধ ভক্ত। উনি আমায় বলেছিলেন, সুনীলদার কবিতা খুবই ভাল, কিন্তু শক্তিদার কবিতার তুলনা নেই।
শক্তি-সুনীলের সেই শেষ দিনের কথা বার বার মনে হয়! আমার স্থির বিশ্বাস, শক্তি যদি সত্যিই কৃত্তিবাসের দায়িত্ব নিতেন, সে এক অন্য রকম ‘কৃত্তিবাস’ হতো। তাই ওঁকে যাঁরা ভালবাসতেন তাঁদের কাছে তো বটেই, বাংলা সাহিত্যেও বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল শক্তির অত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা। অন্তত আমার তাই মনে হয়।’’
নিজের আত্মজীবনী ‘আপন মনে’তে অভিনেতা শ্রী রবি ঘোষ কবি শ্রী শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে লিখে গিয়েছেন –
“দেখা হলেই প্রচণ্ড গালিগালাজ করত। তারপর যাবার সময় থুতু মাখানো একটা চুমু খেত। মদ্যপান একসঙ্গে বহুদিন করেছি, কিন্তু ওর সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষমতা আমার থাকত না। বোধহয় শক্তি শাক্ত, আমরা বৈষ্ণব বলে। … কোনও মদ্যপায়ী লেখক বা গুণী ব্যক্তি হলফ করে বলতে পারবে যে তাকে একদিন রাত্রে গভর্নমেন্ট স্টেট বাস ড্রাইভার বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে? পারবে না। শক্তি পারত। ওর যে এমনটা ঘটেছিল। সেই স্টেট বাসের ড্রাইভার ছিল শক্তির কবিতার ভক্ত।”
সুবর্ণরেখা পেরিয়ে লোকটা হাঁটছে রবিঠাকুরের ঘর-বাড়ির দিকে। হাঁটছে… তিনপাহাড়। মন্দির। ছাতিমতলা। ওপাশে পুরনো মেলার মাঠ। কিঙ্করের ডেরা থেকে বেরিয়ে, রতনপল্লির একলা পথ। লোকটা উত্তরায়ণে। বিচিত্রা-সংগ্রহশালায় ঢোকার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার চোখ যে গিয়েছে, সংগ্রহশালার সিঁড়িতে। প্ল্যাকার্ডের লেখায়। সেখানে লেখা,
‘জুতা খুলিয়া প্রবেশ করুন’।
কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা…
সজোরে লাথি মেরে লোকটা দূরে সরিয়ে দিল প্ল্যাকার্ড!
হায়, হায় করে উঠল চারপাশ! ‘‘এটা কী করছেন শক্তিবাবু!’’ লোকটার স্পর্ধা দেখে ছুটে এসেছেন রবীন্দ্রভবনের অধ্যক্ষ ভবতোষ দত্ত। বিস্মিত তিনিও!
লোকটা যেন উন্মত্ত দরবেশ! জলদগম্ভীর স্বরে বলল, ‘‘এটা কি মন্দির? রবীন্দ্রনাথ কি দেবতা? আমি বিশ্বাস করি মানুষে। মন্দির হলেও মানুষের মন্দির!’’
কে এই ‘শক্তিবাবু’? গিন্সবার্গ, মলয় রায়চৌধুরীদের হাংরি আন্দোলনের ম্যানিফেস্টো লেখক, ‘ক্ষুৎকাতর, যৌনকাতর নয়’-এর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়?
নাকি, একটু পরেই যিনি রবীন্দ্র-অনুকরণেই লিখলেন,
“দূর বাগানের কেতকী ফুল
হয়তো এখন ফুটে আকুল
শেষ শ্রাবণের মেঘে …”
সেই শক্তি?
ঠিক মেলানো যায় না, এই দুই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে।
যে লোকটা দরাজ গলায় খোয়াইয়ের নিভৃতে বসে সুর বিস্তারে গেয়ে ওঠে কবির পিলু-টপ্পাঙ্গ, ‘আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা’। সে-ই আবার, লাথি মেরে উত্তরায়ণের সিঁড়িতে প্ল্যাকার্ডে লাথি মেরে নিজেই সে-খবর সকলকে জানিয়েও দেয়!
স্ববিরোধ?
শক্তির নিজের লেখা রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত কবিতা ‘স্ববিরোধী’-তে বোধহয় মিলে যায় এ প্রশ্নের উত্তরের ইঙ্গিত –
“তোমার বিষণ্ণ গান আমায় করেছে স্ববিরোধী…
বৃষ্টি শুরু, হলুদ অমলতাসে বৃষ্টি ঝরে পড়ে
উদাসীন মাঠে বৃষ্টি, রঙিন কাঁকরগুলি হাঁ করে
ধুলোয় পড়ে আছে।”
শক্তির যখন তিরিশ, তার একটু আগে থেকেই বীরভূমে তাঁর আসা যাওয়া বেড়ে গেল। অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠল ভুবনডাঙা-শান্তিনিকেতন। কখনও রামকিঙ্করের ডেরা। কখনও সিউড়ির অনতিদূরে কেঁদুয়া। সুলতানপুর ইস্কুলের পিওনের চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তত দিনে নবনী দাস বাউল আখড়া গেড়েছেন কেঁদুয়াতে। সেই আখড়ায় দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন শক্তি। দাওয়ায় বসে নবনী গান ধরেছেন লালনের,
‘‘সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দীনের সাধন কেন জানলে না…।’’
চুর হয়ে শুনছেন শক্তি কবিয়াল। গান শেষে আড় ভাঙে কবির। আশমান-উপুড় ভাল লাগায় জড়িয়ে ধরেন নবনীকে। তাঁকে নিয়ে ‘এলেজি’ও লেখেন।
জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় বাউলরাও প্রায় সকলেই শক্তিকে চিনতেন। তাঁর স্বজন ছিলেন তাঁরা। শুধু মুখচেনা নয়, শক্তি তাঁদের ঘর গেরস্থালির খবরও রাখতেন। কখনও’বা জানুয়ারির রাত্তিরে হাড় হিম করা ঠান্ডায়, অজয়ের নদীগর্ভে বসে গীতবিতান উজাড় করে শক্তি একের পর এক রবিঠাকুর গাইছেন। কখনও মধ্যরাত কাঁপিয়ে তাঁর দরাজ গলায় খাম্বাজে ধরেছেন —
‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’ —
এখনও ভোলেনি কেঁদুলির গাঁ-ঘর, বাউল-বসতি!
১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫। এই তিন বছর, শক্তির দোস্ত আয়ান রশিদ খান ছিলেন বীরভূমের পুলিশ সুপার। এই সময়ের সিংহভাগ শান্তিনিকেতন, সিউড়ি, দুবরাজপুর, জয়দেব, রামপুরহাটে কেটেছে শক্তির। তাঁর সঙ্গে কখনও সঙ্গ দিয়েছেন সন্দীপন-ইন্দ্রনাথ, কখনও সুনীল। কখনও একা। রশিদের সঙ্গে গালিব-তর্জমায় মেতেছিলেন শক্তি। প্রকাশিত হয় ‘গালিবের কবিতা’।বইয়ের ভূমিকায় শক্তি লিখেছিলেন,
‘‘আজ বছর দেড়েক হলো। এখনো হালে পানি পাওয়া যায়নি। যাবে কী করে? দুরন্ত দিনপঞ্জী বশে এনে তবেই গালিব-তর্জমা!… বাসে অর্থ খেলো। আমোদে খেলো শতগুণ।’’
শেষে বোলপুর ট্যুরিস্ট লজ। শান্তিনিকেতনের নিভৃতিতে একদিন শেষ হল অনুবাদের কাজ। শক্তি তত দিনে গালিবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন।
রশিদ সেই সময়ের শক্তির কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন,
‘‘দেখেছিলাম গালিবের প্রতিটি পঙক্তি কীভাবে তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। শক্তি-গালিব বা গালিব-শক্তি একাকার হয়েছিল তার অনুবাদেই— ‘কাঁদতে কাঁদতে ফুরিয়ে যাওয়া এমন সহজ আমার কাছে/ যেমন সহজ মেঘ ঘনালে ছটফটিয়ে বৃষ্টি বাজে।’ …”
খোয়াইয়ে পলাশ ফুটলে শক্তি যেন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারতেন না। কোপাইয়ের চরে উতলা চাঁদের নীচে ভিজতে ছুটতেন কবি ও কাঙাল। কিঙ্কর (রামকিঙ্কর বেইজ) শক্তিকে ‘কবি’ বলতেন। তাঁর সঙ্গে প্রথম আলাপের দিন ছিলেন রশিদসাহেবও। পরে ‘কিঙ্করদা’র ডেরায় গেলেই বাইরে থেকে শক্তি বুক চিতিয়ে হাঁক দিতেন। রবীন্দ্রনাথের গান-পদ্য আর অফুরন্ত বাংলা মদে তাঁদের রাত যে কখন শেষ হত, হুঁশ থাকত না কারও। অশোক-কিংশুকের বেড়ার ওপাশে লালমাটির দেশে, কিঙ্করের সঙ্গে বেসামাল হয়ে দিনযাপনের কথা শক্তি নিজেই লিখেছেন।
সেবার রিকশা রেখে শক্তি ঢুকতেই কিঙ্কর বললেন, ‘‘রিকশা ছাড়লে না? কোথাও যাবে নাকি?’’
‘‘না তো, আপনার কাছেই এসেছি।’’
‘‘তাহলে?’’
‘‘থাক, কিছুক্ষণ।’’
জমানো অভিমানে কিঙ্কর বলেন, ‘‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক। ভালো না লাগলে কেটে পড়তে পারবে। বুড়োমানুষের কাছে আজকাল আর কেউ আসে না। বেশ আছি। একা-একা।’’
শান্তিনিকেতনে সেবার দিনভর রিকশা করে খুব উড়েছিলেন শক্তি আর কিঙ্কর। বোলপুর, ভুবনডাঙা, গোয়ালপাড়া। দাউ দাউ দ্বিপ্রহরে রিকশায় যেতে যেতে, নেশায় চুরমার দু’জন। ওঁদের জরুরি কথাবার্তা যেন আজও শুনতে পাওয়া যায়। কিঙ্কর বলছেন, ‘‘…আচ্ছা, একবার বল্লভপুর ঘাটের দিকে যাওয়া যায়?’’
‘‘কেন যাবে না? চলুন। দুটো বোতল তুলে নিই?’’
‘‘অতটা নেবে? একটাই নাও বরং।’’
‘‘থাক না দুটোই। নষ্ট তো আর হবে না?’’
‘‘তা বটে। ওখানে তোমায় খুব ভালো হাঁড়িয়া খাওয়াব। শোরের মাংস খাও? যা রাঁধে না সাঁওতাল ছুঁড়িগুলো! ফার্স্টক্লাস। চলো, আজ দুজনে মিলে একটা পিকনিক সেরে আসি। আমরা অবশ্য বেশিক্ষণ থাকব না। খেয়ে-দেয়ে ক্যানালের ধারে গিয়ে বসব। আকাশমণির ছায়ায় বসে গুরুদেবের গান গাইব চেঁচিয়ে।…’’
ওঁদের রিকশা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে লালমাটির পথ ধরে বনেরপুকুর ডাঙার বাঁকে। হাওয়ায় হাওয়ায় আর শোনা গেল না দু’জনের কথা।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শক্তির প্রথম আলাপ হয়েছিল কবির মৃত্যুদিনে! তখন শক্তি ৮/৯ বছরের নিতান্তই বালক। দাদামশাই আর এক বিধবা মাসির সঙ্গে বহড়ু গ্রামে থাকতেন। ‘বাইশে শ্রাবণ’ শীর্ষক এক লেখায় শক্তি লিখছেন, ‘‘সে দিন দাদামশাই হন্তদন্ত হয়ে ইস্টিশান থেকে ফিরলেন বিকেলবেলা। …ঘরে গ্যাসবাতি জ্বালালেন না। …পড়াশুনোতে বসা হল না সেদিন। দাদামশাই এক সময় শুধোলেন, ‘তুমি রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ? কবিতা পড়েছ তাঁর? খবর এসেছে, তিনি মারা গেছেন।’ …’’ আর কবিকে প্রথম দেখলেন, তার কিছু দিন পরেই জয়নগরে সিনেমা হলে বসে, নিউজ-রিলে। ছবি শুরু হওয়ার আগে, রবীন্দ্রনাথের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার ছবি দেখে শক্তি কেঁদে ফেলেছিলেন। হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন মাসির সঙ্গে।
শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের মধ্যে মোহরের গান শক্তিকে খুব টানত। ‘দিদি’ বলে প্রণাম করে মোহরকে বলতেন, ‘‘এখানে এসে তোমার সঙ্গে দেখা না করে গেলে আমার শান্তিনিকেতন আসা পূর্ণ হয় না।’’
ঘুম ভেঙে শক্তি গিয়ে বসছেন ফলপট্টির চায়ের দোকানের কালো বেঞ্চে। তার চোখের তারায় শ্রাবণের ছন্নছাড়া স্মৃতি! একমুখ দাড়ি, চেক শার্ট। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা। আড়মোড়া ভেঙে, ভরাট গলায় হাঁক দিচ্ছেন, ‘‘কে আছিস, চা দিবি।’’ একটু পরেই ধরাবেন সিগারেট। যাঁরা শান্তিনিকেতনে শক্তিকে প্রথম দিকে দেখেছেন, তাঁদের কাছে এ সব খুব চেনা দৃশ্য। চেনা মন্তাজ। শক্তি হেঁটে যাচ্ছেন শালবীথি, সুবর্ণরেখা, আশ্রমমাঠ পেরিয়ে আদিগন্ত খোয়াইয়ের দিকে। কাঁধের ঝোলায় কি নতুন পদ্যর খাতা? শালবনের বিজনে একটু থেমে থেমেই হাঁটছেন যেন —
“আষাঢ়ের বৃষ্টি শেষ হয়ে গেলো শালের জঙ্গলে
তবুও নও ব্যথায় রাতুল
আমার সর্বাংশে হলো ভুল
একে একে
শ্রান্তিতে পড়েছি নুয়ে।
সকলে বিদ্রুপভাবে দ্যাখে …।”
কীসের যে এত দহন? উজাড় মর্মশোক!
শক্তি-সুনীল শান্তিনিকেতন গেলে, বরাবরই জুড়ে যেতেন জেলার কবি-গদ্যকাররা। তাঁদের স্মৃতিতে আজও ঘোরেফেরে শক্তির জাঁহাবাজ জীবনের নানা জলছবি। জেলার কবিরা শক্তি-সুনীলের সঙ্গে মেঘমেদুর দোলের দিন সকালে গৌড়প্রাঙ্গণে বৃষ্টি ভিজে দাঁড়িয়ে আছেন। শক্তি সিগারেট ধরানোর জন্য দেশলাই জ্বালাচ্ছেন। হাওয়ায় বার বার নিভে যাচ্ছে আগুন। এক তরুণ শক্তির দিকে দেশলাই জ্বেলে এগিয়ে দিতেই, শক্তি থুতু ছিটিয়ে দিলেন তাঁর মুখে! সবাই অপ্রস্তত। একটু পরেই সবাই দেখল, সেই কবির সিগারেটেই টান দিচ্ছেন শক্তি। আরও দেখল, তরুণ কবিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে শক্তি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছেন!
‘১৪০০ পত্রিকা’র সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, হেমন্তের হরকরা শক্তির কবিতার লাইন,
“কোথায় তোমার দুঃখকষ্ট, কোথায় তোমার জ্বালা
আমায় বলো, আমারই ডালপালা।”
এক সময় দক্ষিণপল্লি, এন্ড্রুজপল্লিতে পরিচিতদের বাড়িতে গিয়ে রাত-বিরেতে শক্তির রিকশা থামত নিত্য।দরজায় রাতের কড়া নেড়ে রিকশাওয়ালার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। পিকনিকে ঢুকে চিৎকার করে উঠতেন, ‘‘বাতি নিভিয়ে দাও, বাতি নিভিয়ে দাও। আজ জ্যোৎস্নায় পিকনিক হবে।’’ শেষ পর্যন্ত কোথায় যে থাকবেন, তা জানত শুধু তাঁর মর্জি! তাঁকে নিয়ে শান্তিনিকেতনী গৃহস্থের ‘অস্বস্তি’-ও কম ছিল না!
একবার যেমন ঘটেছিল বিশ্বভারতীর অধ্যাপক উজ্জ্বল মজুমদারের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে শক্তির আলাপ অনেক কালের। কফি হাউসে এক বাংলা-বিকেলে শক্তি তাঁকেই পড়ে শুনিয়েছিলেন প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’। শান্তিনিকেতনে উজ্জ্বলবাবু থাকতেন এন্ড্রুজপল্লির কোয়ার্টারে। এক সন্ধেয় রিকশার শব্দ শুনে তিনি দেখলেন, ‘‘একটা রিকশা আমার কোয়ার্টাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কে একজন পা তুলে দিয়েছে রিকশাওয়ালার ঘাড়ে। আর-একজন হেঁটে আসছে— শক্তি! ঠিক ‘প্রকৃতিস্থ প্রকৃতি’র মতো নয় মনে হল। ওকে দেখে নিজেকে ভিতু ভিতু গেরস্থ ভাবছি। একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু বারান্দায় উঠে এসে জড়িয়ে ধরল, একেবারে ধাত ছাড়েনি দেখে ভালো লাগল।’’
কে কী ভাবল, তাতে কোনও দিনই বোহেমিয়ান শক্তির কিছু এসে যায়নি। জীবদ্দশাতেই লিজেন্ড শক্তিকে কেঁদুলির মতো সত্তরের দশকে দেখা যেত শান্তিনিকেতনের পৌষমেলাতেও। কালোর দোকানে তাঁকে ঘিরে, তাঁর খপ্পরে পড়ে থাকত প্রচুর তরুণ-তরুণী। সেই শক্তি এখনও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। উজ্জ্বল তাঁর অস্থির, টগবগে অস্তিত্ব নিয়ে।
বিরাশি সালের একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন শান্তিনিকেতনের ‘চতুর্দশী’ পত্রিকার সম্পাদক মানস বন্দ্যোপাধ্যায়। সেবার নাট্যঘরে সাহিত্যমেলার আসর বসেছে। সভাপতি শিবনারায়ণ রায়। দুই বাংলার কবি-সাহিত্যিকদের ভিড় উপচে পড়ছে। এপার বাংলা থেকে আমন্ত্রিত শক্তি-সুনীল-গৌরকিশোর ঘোষেরা। দুটি করে কবিতা পাঠ বরাদ্দ সকলের জন্য। কবিতা পড়তে উঠলেন মেদিনীপুরের এক কবি। দুটি কবিতা পাঠ করে, ভুল করে তৃতীয়টি যেই না পড়বেন, তাঁকে নামিয়ে দিলেন বিশ্বভারতীর কর্তা ব্যক্তি! শক্তি এর পরই পড়তে উঠলেন। তবে দুটি নয়, পড়লেন একটিই কবিতা। —‘অবনী বাড়ি আছো?’। সভায় ছিলেন মানস। তিনি জানিয়েছেন –
‘‘শক্তিদা বললেন, ‘আমার দ্বিতীয় কবিতাটা ওই মেদিনীপুরের কবিকে উৎসর্গ করছি। আর উদ্যোক্তাদের অনুরোধ করছি, এভাবে কোনও কবিকে থামাবেন না। থামানো উচিত নয়।’ শক্তিদা নেমে চলে গেলেন!’’
তাঁর ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনের কোনও বাড়ির ছাদে ঘর বানাবার! শেষবার শান্তিনিকেতন গিয়ে বলেও ছিলেন, বন্ধু ‘‘সত্যর বাড়ির ছাদে বাড়ি করব। ছাদের উপর ঘর হবে, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে।’’
সে ঘর আর হল কই!
শান্তিনিকেতনে থাকলে, শক্তি প্রায়ই সুনীলের ফুলডাঙার বাড়ির পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে যেতেন। এমনও হয়েছে, পূর্বপল্লি গেস্ট হাউস থেকে মজলিশ ভেঙে ছুটেছেন শ্যামবাটি ক্যানাল পেরিয়ে ফুলডাঙায় ‘একা এবং কয়েকজন’। ‘দেশ’ পত্রিকায় শক্তির স্মরণ সংখ্যায়, সে বাড়িতে শক্তির সঙ্গে শেষ স্মৃতি লিখেছিলেন সুনীল।—
‘‘সকাল সাড়ে দশটা আন্দাজ কেউ আমার নাম ধরে ডাকল। শান্তিনিকেতনের বাড়িতে আমি তখন কাগজ-কলম খুলে বসেছি, দোতলার ঘরে। কেউ দেখা করতে এলে একতলা থেকে ডাকে, কিংবা খবর পাঠায়, এই ডাক দ্বিতীয়বার শুনেই চিনতে পেরেছি শক্তির কণ্ঠস্বর, সে সরাসরি ওপরে উঠে আসছে। ঘরে ঢুকে শক্তি বলল, এ কী! আজই লেখাপড়া শুরু করে দিয়েছ?
কলম বন্ধ করতে করতে আমি বললাম, কী করি বলো, যাবজ্জীবন দণ্ডিত আসামির মতন অবস্থা যে।’’
শক্তি এসে পড়লে আর কি লেখালিখি হয়? সেদিনও শক্তি সুনীলকে লিখতে দেননি। নতুন করে কৃত্তিবাস করার পরিকল্পনা শুনিয়েছিলেন।
ফেরবার আগে, শক্তি যথারীতি মদ্যপানের জন্য আব্দার করেন। স্বাতী আপত্তি জানান। শক্তি নাছোড়।
সুনীল লিখছেন, ‘‘নিজের স্ত্রীর কাছে সাধু সাজবার জন্য আমি বললাম, শক্তি যখন এত করে বলছে, দাও একটু। কৃত্তিবাসের ব্যাপারটা তো সেলিব্রেট করা যেতেই পারে। শক্তির সঙ্গে এত নিরিবিলিতে অনেক দিন বসা হয়নি। স্বাতী বলল, তা হলে ঠিক দুটো। তার বেশি নয়। তারপর আমি বোতল সরিয়ে নিয়ে যাব। শক্তি বলল, আড়াই! আধখানা গ্রেস দিও!’’
জীবনের খরস্রোতে ভাসতে ভাসতে ঠিকানাবিহীন শক্তির শেষবেলার ঠাঁইও ছিল শান্তিনিকেতন। সে তুমুল শ্রাবণ হোক অথবা ভাদ্রের বিপুল দ্বিপ্রহর, বিশ্বভারতীর উৎসবে দেখা মিলত তাঁর। দোলের দুপুরে সুবর্ণরেখায় ইন্দ্রনাথ মজুমদারের আড্ডাতেও সেই ছিল যেন প্রতিবারের মধ্যমণি। সুবর্ণরেখার আড্ডা নিয়ে একবার বন্ধু জ্যোতিপ্রকাশ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন করেন শক্তিকে –
‘‘ছোট ছোট গেলাশে করে তোমরা কি শিঙাড়া আর জিলিপি খাচ্ছিলে?’’
হেসে ফেলেন শক্তি। বলেন, ‘‘সুনীলটা ঠিক বুঝতে পারে। তখনই ও ইন্দ্রনাথকে বলেছিল, খাওয়াচ্ছ লাল চা, লোকে তো দেখে ভাববে… শক্তি-সুনীল দোলের দুপুরে লেবু মিশিয়ে চা খাচ্ছে এ কথা কি মানবে কেউ? তা নামই যখন হল, রামই বের করো।’’
ছাত্র জীবনে ক্লাসছুট, স্বেচ্ছাচারী শক্তি আনন্দবাজার থেকে অবসর নেওয়ার পর বিশ্বভারতীর অনুরোধে ‘৯৫ সালে পড়াতে রাজি হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ‘ভিজিটিং’ প্রফেসর হিসাবে যোগ দিয়ে, স্ত্রী মীনাক্ষীদেবীকে নিয়ে উঠেছিলেন রতনকুঠীতে। সেখান থেকে পূর্বপল্লি গেস্ট হাউস। ১৯ নম্বর ঘর। শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন সে-ঘরেই। সেই ঘরে বসেই বৃষ্টির রাতে বাংলা বিভাগের পুনর্মিলন উৎসবের স্মারকপত্রের জন্য লিখলেন শেষ কবিতা —
“হঠাৎ অকাল বৃষ্টি শান্তিনিকেতনে
রাতভোর বৃষ্টি হল শান্তিনিকেতনে
আমের মঞ্জরী পেল বৃষ্টি ও কুয়াশা
বসন্তের মুখোমুখি শিমুল পলাশ।”
বাংলা বিভাগে শক্তির প্রথম ক্লাস ২১শে ফেব্রুয়ারি। ‘পদ্য লেখা শেখার ক্লাস’-এ যে দু’ই ছাত্রের কাঁধে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে ক্লাস নিতে যেতেন শক্তি, তাঁরা হলেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী, কবি নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিল্পী বিক্রম সিংহ খাঙ্গুরা। শক্তির ক্লাসে ছন্দের পাঠ নেওয়ার দিনের স্মৃতি, কবি নীলাঞ্জনের স্মৃতিতে আজও অমলিন —
“বিক্রম ডান দিকে, আমি বাঁদিকে। দেখতাম, শক্তিদা উদাসভাবে তাকিয়ে থাকতেন পূর্বপল্লির গাছগুলোর দিকে। রোজ পথ থেকে কুড়িয়ে আমলকী খেতেন। আর ক্লাসেই কবিতা লিখে, আমাদের ছন্দের পর্ব বিভাজন করতে দিতেন। বলেছিলেন, ‘ভাবছি, একটা আত্মজীবনী লিখব। তোর মতো একটা খেরোর খাতা এনে দিস তো!’ …’’
শক্তির স্মরণে পদ্য লিখেছিলেন বিক্রম,
“…বিপরীত মুখে চলে যাওয়া রাজপথ কতোটা সময় রেখে যায়— আয়ুহীন মাপকাঠি?
ক্রমশ ডুবে যাওয়া লালচাঁদ আর
বৃষ্টিতে ভিজে চুপ্পুড় শালবন …।”
গদ্যে-কবিতায় তো কবেই শক্তি বলতে শুরু করেছিলেন, ‘ফুলগুলো সব ঝরল, তা কি পাতার শোকেই?’ শান্তিনিকেতনে শেষবার এসেও প্রায়ই বলছিলেন, ‘‘এখনি যাব না… একাকী যাবো না অসময়ে, বাঁচতে হবে, অন্তত আশি পর্যন্ত।’’ সামনের মানুষকে হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিতেন, ‘‘কী বলো, হবে না?’’
হল না।
তার আগেই চলে গেলেন!
শান্তিনিকেতনেই শক্তির শেষ পদ্য পাঠ। মার্চের উনিশ তারিখ, বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ছিল একটি কবিতা পাঠের আসর। ছিলেন সুনীল ও শরৎ-ও। শক্তি প্রথম পড়লেন —
“সেগুন মঞ্জরী হাতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে
আমি আছি বিষ ঘুমে, জাগাও আমাকে।”
কী তীব্র আকুতি পাঠজুড়ে!
একটার পর একটা পড়ে যাচ্ছেন শক্তি। ভরাট গলায়। মন্ত্রমুগ্ধ সকলে। বেখেয়াল শক্তিকে একসময়, পাশ থেকে বন্ধু সত্য সাঁই সতর্ক করলেন — ‘‘শক্তি অন্যদের সুযোগ দাও।’’ ঘোর ভেঙে শক্তি বললেন, ‘‘আচ্ছা, শেষ করছি! শেষে আনন্দভৈরবীটা একটু পড়ি?’’
নিশি ডাকা ভোরে, টেলিফোনে টেলিফোনে ঘুরল কবির শোক-সংবাদ! চলে যাওয়ার খবরে মীনাক্ষীদেবী এলেন শান্তিনিকেতন। এলেন আরও অনেকে। তাঁদের স্মৃতি —
এসেছিলেন তাঁর প্রেসিডেন্সির শিক্ষক, ভূদেব চৌধুরী। মীনাক্ষীদেবী বলেছিলেন, ‘‘আপনার ছাত্র ফাঁকি দিয়ে চলে গেল!’’ ভূদেববাবু কবি-জায়ার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘ও যে চিরকালের ক্লাস পালানো মা, তুমি আর কত দিন ধরে রাখতে পারবে!’’
শান্তিনিকেতনে শক্তির শেষযাত্রায় তাঁকে স্টেশনে পৌঁছবার জন্য অ্যাম্বুল্যান্সও জোটেনি!
ঘি রঙের ডোরাকাটা পাঞ্জাবি, পাজামায় বরফের বিছানায় ঘুমিয়ে শক্তি। জিপে করে দেহ পৌঁছল বোলপুর স্টেশনে।
রবিঠাকুরকে বিদায় জানানোর প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পর, আর এক প্রিয় কবিকে চোখের জলে ভেসে শেষ প্রণাম জানাল বোলপুর-শান্তিনিকেতন!
পা দুটি হাঁটু অবধি, বেরিয়ে ছিল জিপের বাইরে। সারাটা পথ!
(তথ্যসূত্র:
১- শক্তি, দেশ পত্রিকা বিশেষ সংখ্যা, ১৭ই ডিসেম্বর ২০১৮ সাল।
২- Shakti Chattopadhyay: An iconoclastic poet of Bengal and Sahitya Akademi award winner, India Today, 11th April 2014.
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ই জুলাই ২০১৫ সাল।
৪- ২২শে জুলাই ২০১৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় শ্রী শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণে শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী শ্রীমতী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের লিখিত প্রবন্ধ।
৫- আপন মনে, রবি ঘোষ, সম্পাদনা অভীক চট্টোপাধ্যায়, প্রকাশক সপ্তর্ষি প্রকাশন (২০১৫)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত