১৮৬৪ সালে ‘শ্রী কালীপ্রসন্ন সিংহ’ তাঁর ‘হুতোমপ্যাঁচার নক্সা’ গ্রন্থে লিখেছিলেন –
‘‘বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু – ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা, বিবি, পরী ও নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো; মধ্যে মা ভগবতী জগদ্ধাত্রী-মূর্তি – সিঙ্গির গায়ে রূপুলি গিলটি ও হাতী সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া। ঠাকরুণের বিবিয়ানা মুখ, রং ও গড়ন আদল ইহুদী ও আরমানী কেতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও ইন্দ্র দাঁড়িয়ে জোড়হাত ক’রে স্তব কচ্চেন। প্রতিমের উপরে ছোট ছোট বিলাতী পরীরা ভেঁপু বাজাচ্চে – হাতে বাদশাই নিশেন ও মাঝে খোড়াসিঙ্গিওয়ালা কুইনের ইউনিফরম ও ফ্রেষ্ট! … বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙলো, একজন বাবু মাতাল, পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন, যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন, (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী-মূর্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতীকে কাম্ড়াচ্চে দেখে, বাবু মহাত্মার বড়ই রাগ হলো, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে –
‘তারিণী গো মা কেন হাতীর উপর এত আড়ি।
মানুষ মেলে টের্টা পেতে তোমায় যেতে হতো হরিণবাড়ী।
সুর্কি কুটে সারা হোতো, তোমার মুকুট যেত গড়াগড়ি।।
পুলিসের বিচারে শেষে সঁপতো তোমায় গ্র্যান্বুড়ি।
সিঙ্গি মামা টের্টা পেতেন ছুট্তে হতো উকীলবাড়ী।।’
গান গেয়ে, প্রণাম ক’রে চলে গেলেন।’’
‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, ‘দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায়’ এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটেছিল। অষ্টাদশ শতকে ‘নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়’ তাঁর রাজধানী ‘কৃষ্ণনগরে’ এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। যদিও ‘দেবী জগদ্ধাত্রী’ যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। ‘শূলপাণি দত্ত’ খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে তাঁর ‘কালবিবেক গ্রন্থে’ ‘কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ’ করেছিলেন। ‘পূর্ববঙ্গের বরিশালে’ খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে সেই মূর্তিটি ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে’ রক্ষিত রয়েছে। কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত ‘নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির’ ও ‘কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে’ জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ‘ব্রাহ্মণগৃহে’ দুর্গাপূজার পাশাপাশি ‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ অনুষ্ঠিত হত।
দেবীর নামটি কী? না, ‘জগদ্ধাত্রী দুর্গা’ – ‘‘জয় সর্বগত দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোহস্তুতে’’! ‘জগদ্ধাত্রী’ও নয়, ‘দুর্গা’ও নয়, ‘দুইয়ে মিলেই’ দেবীর স্বরূপে প্রকাশ। তা-ই যদি হয়, ‘জগদ্ধাত্রী’কে বলতে হবে ‘দেবী দুর্গারই অন্য রূপমহিমা’? সেই সূত্র ধরেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে – যাঁরা দুর্গাপূজা করে উঠতে পারেন না বা কোনও কালে পেরে ওঠেননি, তাঁরাই বেছে নিয়েছিলেন ‘জগদ্ধাত্রী আরাধনার পথ ও পন্থা’?
দুর্গার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর এই ‘বিকল্পের সংযোগ’ বুঝতে গেলে আমাদের একবার ভাল করে তাকাতে হবে দেবীর দিকে। আমরা ‘দেবীর ধ্যানমন্ত্র’ অনুসরণ করলে দেখতে পাব – এই ‘মহাদেবী জগদ্ধাত্রী’ ‘সিংহের স্কন্ধে আরূঢ়া’, ‘নানা অলঙ্কারে ভূষিতা’ ও ‘নাগরূপ যজ্ঞোপবীতধারিণী’। দেবীর ‘বাম হস্তদ্বয়ে শঙ্খ’ ও ‘শার্ঙ্গধনু’, ‘দক্ষিণ হস্তদ্বয়ে চক্র’ ও ‘পঞ্চবাণ’। ‘রক্তবস্ত্রপরিহিতা’ সেই ‘ভবসুন্দরী’ ‘প্রভাতসূর্যের ন্যায় রক্তবর্ণা’। নারদাদি মুনিগণ তাঁর ‘নিত্যসেবা’ করে থাকেন –
“সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্
চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।”
‘দুর্গার সঙ্গে সংযোগ’টি তাহলে কোথায়? এ তো যেমনটি মূর্তিতে দেখে থাকি, প্রায় তেমন রূপবর্ণনাই! ‘দুর্গার সঙ্গে জগদ্ধাত্রীর সংযোগ’ তাই যদি মন্ত্রের সূত্র ধরে খুঁজতে হয়, তবে তাকাতে হবে ‘জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের’ দিকে। তার ‘তিন নম্বর শ্লোকে’ বলা হয়েছে –
“জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে
জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে।”
আবার কিছু কিছু ‘পুরাণ’ বলছে, মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের উল্লাসের কথা। তাঁরা ভেবেছিলেন, ‘দুর্গা’ যেহেতু ‘তাঁদেরই সম্মিলিত শক্তির প্রকাশ’, তাই অসুর বধ হয়েছে ‘তাঁদেরই যুগ্ম শক্তিতে’। ‘ব্রহ্মার বরের সম্মানরক্ষা’ করতে কেবল ওই নারীদেহটির আবশ্যিকতা। তাঁদের ওই ‘গর্ব’ দেখে ‘পরমেশ্বরী দেবী’ একটি ‘তৃণখণ্ড’ অলক্ষ থেকে নিক্ষেপ করলেন দেবতাদের দিকে। পরীক্ষা করতে চাইলেন তাঁদের শক্তি। ‘ইন্দ্র বজ্রদ্বারা’ সেই তৃণটি ধ্বংস করতে ব্যর্থ হলেন। ‘অগ্নি’ সেই তৃণ ‘দহন’ করতে পারলেন না, ‘বায়ু’ অসমর্থ হলেন তা ‘উড়িয়ে নিয়ে যেতে’। ‘বরুণের শক্তি’ সেই তৃণটুকুর একটি অংশও ‘জলস্রোতে প্লাবিত করতে পারল না’। দেবতাদের এই দুরবস্থা দেখে তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হল ‘এক পরমাসুন্দরী সালঙ্কারা চতুর্ভুজা মূর্তি’। তিনিই ‘জগদ্ধাত্রী’। ‘জগদ্ধাত্রী’ এভাবে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের ‘জ্ঞানচক্ষু’টি উন্মীলিত করলেন। বুঝিয়ে দিলেন, তিনিই এই ‘জগতের ধারিণী শক্তি’।
এই একই গল্প ‘কেন উপনিষদ’ এবং ‘কাত্যায়নীতন্ত্রে’ও দেখতে পাওয়া যায়। তফাতের মধ্যে ‘কেন উপনিষদে’ দেবী প্রথমে দেখা দিয়েছিলেন ‘এক যক্ষের বেশে’। আর স্বরূপে আবির্ভূতা হওয়ার পর তাঁর নাম জানা গিয়েছিল ‘উমা হৈমবতী’। ‘মহিষাসুর বধের কোনও প্রসঙ্গ’ সেখানে নেই। আবার, ‘কাত্যায়নীতন্ত্রে’ ‘উমা’ বা ‘জগদ্ধাত্রী’ – কোনও নামই পাওয়া যায় না। সেখানে দেবী কেবল ‘হৈমবতী’ অর্থাৎ ‘স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা’। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই ‘উমা’ নামটির সূত্র ধরেই ‘উপনিষদের গল্পটি’ গৃহীত হয়েছিল অনেক পরে লেখা নানা পুরাণে। এবং, ‘জগদ্ধাত্রীস্তোত্রের’ ‘দুর্গা’ নামটির সূত্রে এসেছিল ‘মহিষাসুর বধের প্রসঙ্গ’। কিন্তু, কোথাও খুব একটা স্পষ্ট করে বলা হল না ‘জগদ্ধাত্রী’ আসলে ‘দুর্গারই বিকল্প রূপ’। কেন না, যে দেবী দেবতাদের গর্ব খর্ব করার জন্য যে রূপধারণ করেছিলেন, ‘উপনিষদ’ তাঁকে ‘আদিশক্তি’রূপেই ব্যাখ্যা করছে। ‘পুরাণে’ও ‘দুর্গার আবির্ভাবের আগে’ বেশ কয়েকবার এক দেবীর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে যিনি ‘বিষ্ণুমায়া’ বা ‘বৈষ্ণবী শক্তি’ হিসেবেই সুপরিচিতা। ‘বিষ্ণুর’ মতো ‘জগদ্ধাত্রী’র হাতেও রয়েছে ‘শঙ্খ’ এবং ‘চক্র’, অতএব এই দেবীর ‘বিষ্ণুমায়া’ হওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। আবার, ‘বিষ্ণু’র মতোই তিনিও ‘ধারণ ও পালন’ করেন এই বিশ্ব। তাহলে?
‘জগদ্ধাত্রী যে দুর্গারই বিকল্প রূপ’, তার প্রথম সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ‘শ্রীশ্রীচণ্ডীতে’ এসে। সেখানে বলা হয়েছে যে, যুদ্ধের সময় ‘মত্ত মহিষাসুর’ নানা মায়ারূপ ধরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন দেবীকে। একবার সেই প্রচেষ্টায় ‘মহিষাসুর’ ধারণ করেছিলেন ‘হস্তীরূপ’। সেই ‘হস্তী’ দেবীকে বধের চেষ্টা করলে ‘দুর্গা’ ধারণ করেছিলেন ‘এক চতুর্ভুজা মূর্তি’। ‘চক্রদ্বারা’ তিনি ছেদন করেছিলেন ‘হাতির শুঁড়টি’। সেই রূপটিই ‘জগদ্ধাত্রী’র। সেই জন্যই ‘ধ্যানমন্ত্রে’ কোথাও উল্লেখ না থাকলেও ‘মূর্তিতত্ত্বে’ দেখা যায়, ‘জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহ’ এক হস্তীর মৃত শরীরের উপর দাঁড়িয়ে। কখনও বা সেই ‘সিংহ’ খেলা করে হস্তীর কাটা মাথা নিয়ে। ‘সংস্কৃতে’ হাতির একটি নাম ‘করী’, সেই অনুসারে অসুরটির নাম ‘করীন্দ্রাসুর’। তাঁকে বধ করেছিলেন বলে ‘জগদ্ধাত্রী’র অপর নাম ‘করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী’।
এভাবেই খুব ধীরে ধীরে ‘জগদ্ধাত্রীর আদি মহিমা’ থেকে সরে এসেছিলাম আমরা। তিনি ‘সত্ত্বগুণের প্রতীক’, তাই ‘প্রথম সূর্যের মতো তাঁর গায়ের রং’। অর্থাৎ, ‘দেবীর গাত্রবর্ণটি কমলা’। কিন্তু, ‘দুর্গার সঙ্গে তাঁর সংযোগ স্থাপন’ করে আমরা বর্তমানে তাঁর মূর্তিটি নির্মাণ করি ‘তপ্তকাঞ্চনবর্ণ’ বা ‘কাঁচা সোনার রঙে’। ‘কমলা রঙের জগদ্ধাত্রী প্রতিমা’ বর্তমানে এই বঙ্গে দুর্লভ। আবার ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় লিখছেন, সেই সময়ের ‘বাবু কলকাতা’ দুর্গার মতো ‘জগদ্ধাত্রী’ মূর্তিতেও স্থান দিয়েছিল ‘লক্ষ্মী-সরস্বতী’কে।
সেই যে শুরু হয়েছিল ‘দুর্গার বিকল্প রূপে জগদ্ধাত্রীর আরাধনা’, কালে কালে তা-ই জনপ্রিয় হয়েছিল বঙ্গে। যার ‘হোতা’ নিঃসন্দেহেই ‘নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’। কেন না, ‘দুর্গাপূজা’ করতে অসমর্থ হয়ে ‘বিকল্পে জগদ্ধাত্রী আরাধনা’ বঙ্গে প্রথম প্রচলন করেছিলেন তিনিই। কাহিনী বলছে, তখন বঙ্গের তখতে আসীন ছিলেন ‘মীর মোহাম্মদ জাফর আলী খান বাহাদুর’ (রাজত্বকাল: ২৫শে জুলাই ১৭৬৩ থেকে ১৭ই জানুয়ারি ১৭৬৫, ‘নাজাফি বংশ’)। তাঁর রাজত্বকালে রাজার কাছ থেকে ‘বারো লক্ষ টাকা নজরানা’ দাবি করা হয়েছিল। ‘কৃষ্ণচন্দ্র’ তা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ‘মুর্শিদাবাদে’। ছাড়া পেয়ে রাজা যখন নদীপথে ‘কৃষ্ণনগরে’ ফিরছিলেন, তখন তিনি শুনতে পেয়েছিলেন ‘বিসর্জনের বাজনা’। ভারাক্রান্ত হয়েছিল তাঁর মন – সে বছর তাঁর আর দুর্গাপুজো করা হয়ে ওঠে নি! জনশ্রুতি, সেই রাতেই রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়েছিলেন ‘জগদ্ধাত্রী’। স্বপ্নে তিনি ‘কৃষ্ণচন্দ্র’কে তাঁর পূজার নির্দেশ দিয়েছিলেন যা ‘দুর্গাপূজারই সমতুল’! সেই ১৭৬৬ সাল থেকে ‘কৃষ্ণনগরে’ ‘দুর্গাপুজোর বিকল্প হিসেবে’ প্রচলিত হয়েছিল ‘জগদ্ধাত্রীর পূজা’। তবে ‘চন্দননগর’ কিন্তু ‘জগদ্ধাত্রীপূজা’ নিয়ে ‘কৃষ্ণনগরের দৃষ্টান্ত’ অনুসরণ করেনি – ইতিহাস বলছে এর উল্টোটা ঘটেছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
আবার, ‘এক দেবীর পূজায় অসমর্থ হয়ে’ ‘জগদ্ধাত্রী আরাধনার প্রচলন’ দেখা যায় ‘সারদামণির বংশে’ও। শোনা যায়, ‘সারদামণির মা শ্যামাসুন্দরী দেবী’ প্রতি বছর প্রতিবেশী ‘নব মুখুজ্যের বাড়ির কালীপুজোয়’ চাল পাঠাতেন। একবার ঝগড়ার জন্য ‘মুখুজ্যেরা’ সেই চাল নিতে অস্বীকার করেন। ‘শ্যামাসুন্দরী’কে সেই রাতেই স্বপ্নে দর্শন দেন ‘জগদ্ধাত্রী’। ওই চালে তাঁর পূজার নির্দেশ দেন। সেই থেকে ‘জয়রামবাটীতে সারদামণির বংশে জগদ্ধাত্রী পূজা’ বিখ্যাত।
তবে এই ‘বিকল্প পূজার সূত্রে’ আরও কিছু সময় পিছিয়ে গিয়ে একবার জগদ্ধাত্রী আরাধনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। সেই ইতিহাস বলছে, ‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ প্রথমে ‘কট্টর ভাবে’ই প্রচলিত ছিল ‘ব্রাহ্মণদের মধ্যে’। দেবী ‘সত্ত্বগুণের প্রতীক’ যা ‘ব্রাহ্মণদের একটি বৈশিষ্ট্য’ বলে গণ্য করা হয়। দেবীর গলায় থাকে ‘নাগযজ্ঞোপবীত’ যা স্পষ্টভাবেই ‘ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের পরিচায়ক’। আবার, ‘মন্ত্রে’ এই দেবীকে ‘সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে। এখান থেকেই তৈরি হয়েছে ‘বিকল্প এবং শ্রেণিবিভাগ’। ‘সত্ত্বগুণধারিণী জগদ্ধাত্রীর পূজা’ করবেন ‘ব্রাহ্মণরা’, ‘রজোগুণধারিণী দুর্গার পূজা’ করবেন ‘ক্ষত্রিয়রা’ এবং ‘তমোগুণধারিণী কালীর পূজা’ করবেন অন্যরা। পরে ‘ব্রাহ্মণদের’ এই ‘জগদ্ধাত্রী আরাধনার সূত্রটি’ গ্রহণ করলেন ‘বণিকশ্রেণি’। ‘দুর্গাপূজা’য় তাঁদের ‘অধিকার’ নেই, ‘কালীপূজা’ ‘তন্ত্রসম্মত’ বলে সবার সামর্থ্য নয়, অতএব রইলেন কেবল এই ‘জগদ্ধাত্রী দুর্গা’ই!
সেই ইতিহাস বহন করেই এখনও ‘দুর্গাপূজার উৎসবের বিকল্প’ হিসেবেই ‘জগদ্ধাত্রীর পূজার উৎসব’ দেখছি আমরা। সেই জন্যই এই পুজো ‘সার্বজনীন’ হল না। রয়ে গেল ‘কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের উৎসব’ হয়েই। নিজেই ভেবে দেখুন না, ‘কৃষ্ণনগর-চন্দননগরের বাসিন্দা’ না হলে কি ‘জগদ্ধাত্রী পুজোয়’ ততটাও আনন্দ করি আমরা?
‘কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা’ হয়েছিল ১৭৬৬ সালে। কেউ কেউ আবার ‘কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্র’কে ‘কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক’ মনে করেন। ‘কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা’ ‘জগদ্ধাত্রী পূজার সময়’ আজও খোলা থাকে। পূজা পুরনো প্রথা মেনে হয় শুধুমাত্র ‘নবমী তিথিতে’। ১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি ‘কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায়’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা ‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ শুরু করেন। ‘বুড়িমার পূজা’ নামে পরিচিত সেই পূজা শুরু হয়েছিল ‘ঘটে ও পটে’। প্রথম দিকে ‘স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে’ সেই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ ‘গোবিন্দ ঘোষ’ ঘটপটের পরিবর্তে ‘প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা’ করেন। সেখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল ‘প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনায় গয়নায় দেবীপ্রতিমার অলংকারসজ্জা’। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে সেই দেবী ‘অত্যন্ত জাগ্রতা’; তাঁর নিকট ‘সকল মনোষ্কামনা’ই পূর্ণ হয়। এছাড়া ‘কৃষ্ণনগরের উল্লেখযোগ্য বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি’ হল ‘প্রীতিসম্মেলনী’, ‘বালকেশ্বরী’, ‘মালোপাড়া’, ‘হাতারপাড়া’, ‘উকিলপাড়া’, ‘ষষ্ঠীতলা’, ‘বউবাজার’, ‘নেদেরপাড়া’, ‘বাঘাডাঙা’, ‘পাত্রমার্কেট’, ‘কৃষ্ণনগর স্টেশন চত্বর’, ‘বেজিখালি’, ‘চকেরপাড়া’, ‘বাগদিপাড়া’, ‘মাঝেরপাড়া’, ‘ঘূর্ণি’, ‘হরিজনপল্লি’, ‘তাঁতিপাড়া’, ‘কালীনগর’ ইত্যাদি। বর্তমানে কৃষ্ণনগরে ‘বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা’ হয় দুই’শোরও বেশি, যা জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য বিখ্যাত ‘চন্দননগর’ মহানগরের চেয়েও বেশি।
হুগলি জেলার ‘চন্দননগর’ ‘জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য’ ভারত তথা সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। কিন্তু কবে থেকে ‘চন্দননগরে’ ‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ শুরু হয় সে সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা আজও অন্ধকারে এবং এই সম্বন্ধে কোন ‘প্রামাণ্য ঐতিহাসিক নথি’ এখনো পাওয়া যায় নি। কোন এক সময় মনে করা হত যে, ‘কৃষ্ণনগরের রাজা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী পূজা’ দেখে, ‘শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী’ চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তী কালে, ‘ঐতিহাসিক গবেষণায়’ সেই মতবাদ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। কারণ ‘কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা’ শুরু হয় ১৭৬৬ সালে ও ‘ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মৃত্যু’ হয় ১৭৫৬ সালে। সুতরাং ‘ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী’, কোন মতেই ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রীপূজা দেখে চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন নি’। কিছু ‘ঐতিহাসিক নথি’ বলছে যে, ১৭৫০ সালের আগেও ‘চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পূজা’ হত। তবে ‘চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা’ই যে ‘বাংলা তথা ভারতের প্রাচীন জগদ্ধাত্রী পূজা’, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। ‘ঐতিহাসিক নথি’ অনুযায়ী, ‘চন্দননগরে শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়িতে’ ‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ হত ও সেখানে ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’ আসতেন (এমনিতেও ‘খাজনা আদায়ের জন্য’ তাঁর যাতায়াত ছিল ‘শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়িতে’)। ‘শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ির পূজা’ দেখেই ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্র’ অনুপ্রাণিত হয়ে ‘কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজার শুরু’ করেন। অর্থাৎ ‘কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজা’, ‘চন্দননগরের অনেক পরে’ শুরু হয়। ১৭৮০ সালে, কলকাতা থেকে ‘জেমস আগাস্টাস হিকি’ দ্বারা প্রকাশিত ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘হিকি সাহেবের পেপার’ – ‘ভারতের প্রথম প্রকাশিত খবরের কাগজে’ কিন্তু বাংলার এই বিখ্যাত পূজা নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না (যা অত্যন্ত আশ্চর্যের)। তবে, ১৮২০ সালে, কলকাতা থেকে প্রকাশিত অপর একটি ইংরেজী দৈনিক ‘দ্যা ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া’ (পরবর্তী কালে যার নাম হয় ‘দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া’) তে, সর্বপ্রথম ‘চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার বিষয়ে’ লেখা ছাপা হয়। ‘চন্দননগরে সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজা’র শুরু হয় ১৭৯০ সালে, খুব সম্ভবতঃ ‘লক্ষ্মীগঞ্জ’ (লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে) বলে একটি স্থানে। সেই সময়, ‘চন্দননগরের লক্ষীগঞ্জ’কে, নিজের একটি লেখায় ‘রবার্ট ক্লাইভ’ ‘বাংলার শস্য ভান্ডার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ‘লক্ষ্মীগঞ্জ’ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা হয়েছিল। এই পূজা চন্দননগরে ‘আদি পূজা’ নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত ‘পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প’ হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল ‘সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ’ এবং ‘বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি’। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় ‘আদি প্রতিমা’ জলে পড়লেই ‘শুশুক’ বা ‘সাপের’ দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী ‘অত্যন্ত জাগ্রতা’। ‘লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়পট্টির জগদ্ধাত্রী পূজা’ ‘চন্দননগরের দ্বিতীয় প্রাচীনতম সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজা’। ১৭৯৮ সালে ‘চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের’ সঙ্গে ‘মতান্তর’ হওয়ায় ‘কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়’ (মতান্তরে ‘শশধর’) রীতিমতো ‘চাঁদা’ তুলে সেই পূজা প্রবর্তন করেছিলেন। এই অঞ্চলের অপর দুটি পূজা হল ‘লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা’ (স্থাপিত ১৯০৩ সাল) ও ‘লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের’ (স্থাপিত ১৯৩৩ সাল) পূজা। ‘উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ’ ‘চাউলপট্টি’, ‘কাপড়পট্টি’, ‘চৌমাথা’ ও ‘বাজার’ – এই চার পূজাতেই ‘সিংহের রং সাদা’। ‘উত্তর চন্দননগরের অন্যান্য বড়ো জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি’ হল ‘চন্দননগর বাগবাজার’ (স্থাপিত – ১৮৩৫ সাল), ‘খলিসানী কলপুকুরধার’, ‘বউবাজার শীতলাতলা’, ‘খলিসানী বউবাজার’, ‘বাগবাজার চৌমাথা’, ‘বিদ্যালঙ্কার’, ‘পালপাড়া’, ‘বিবিরহাট উত্তরাঞ্চল’, ‘বিবিরহাট চড়কতলা তেমাথা’, ‘হরিদ্রাডাঙা’, ‘হেলাপুকুরধার’, ‘নাড়ুয়া’, ‘কাঁটাপুকুর’, ‘কাঁটাপুকুর চৌমাথা’, ‘বোড়ো কালীতলা’, ‘বোড়ো পঞ্চাননতলা’, ‘বোড়ো চাঁপাতলা’, ‘বোড়ো দীঘির ধার’, ‘বোড়ো তালডাঙা’ ইত্যাদি। ‘দক্ষিণ চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘মানকুণ্ডু সার্বজনীন’, ‘মানকুণ্ডু নতুনপাড়া’, ‘নিয়োগী বাগান’, ‘সার্কাস মাঠ’, ‘তেমাথা’, ‘অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব’, ‘মরান রোড’, ‘গোন্দলপাড়া মনসাতলা’, ‘সাতঘাটা’, ‘গোন্দলপাড়া চারমন্দিরতলা’, ‘বেশোহাটা’, ‘লিচুতলা’, ‘হাজিনগর’, ‘হাটখোলা দৈবকপাড়া’, ‘মনসাতলা’, ‘ভুবনেশ্বরীতলা’, ‘নোনাটোলা’, ‘বড়বাজার’, ‘পাদ্রিপাড়া’, ‘লালবাগান’, ‘ড্যুপ্লেক্সপট্টি’, ‘শ্রমিকপল্লি’, ‘সুভাষ জাগরণ সংঘ তেমাথা’, ‘অরবিন্দ সংঘ’, ‘বারাসত দক্ষিণ’, ‘বারাসত গেট’। ‘দক্ষিণ চন্দননগরের হালদারপাড়ার আদিপুজো’ – ‘অশ্বত্থতলার বুড়িমার পূজা’ নামে পরিচিত। এই পূজা ‘লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি ও কাপড়পট্টির পূজার সমসাময়িক’ বলে মনে করা হয়।
‘বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে’ ‘রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মিণী’ ‘সারদা দেবীর জন্মভিটার জগদ্ধাত্রী পূজা’ বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষে ‘জয়রামবাটী’তে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। ‘সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে’ এই পূজার আয়োজন করে ‘রামকৃষ্ণ মিশন’। ১৮৭৭ সালে (১২৮৪ বঙ্গাব্দে) ‘সারদা দেবীর পিতৃগৃহে’ ‘প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন’ করেছিলেন ‘তাঁর জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী’। কিংবদন্তী অনুসারে, প্রতি বছর ‘শ্যামাসুন্দরী দেবী’ প্রতিবেশী ‘নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা’ উপলক্ষে ‘নৈবেদ্যের চাল’ পাঠাতেন। ঐ বছর কোনো বিবাদের কারণে ‘নব মুখুজ্যে’ চাল নিতে অস্বীকার করেন। ‘নৈবেদ্যদানে অসমর্থ’ হয়ে ‘শ্যামাসুন্দরী দেবী’ অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই রাতেই তিনি ‘দেবী জগদ্ধাত্রী’কে স্বপ্নে দেখেন এবং তাঁর ‘স্বপ্নাদেশে’ ওই চালে ‘জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন’ করেন। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন ‘বৃহস্পতিবার’ ছিল। তাই ‘সারদা দেবী’ ‘লক্ষ্মীবারে’ বিসর্জনে আপত্তি করেছিলেন। পরদিন ‘সংক্রান্তি’ ও তার পরদিন ‘মাস পয়লা’ থাকায় ওই দুই দিনও জগদ্ধাত্রী বিসর্জন দেওয়া যায়নি। বিসর্জন হয়েছিল ‘চতুর্থ দিনে’। আরও কথিত আছে যে, পরের বছর ‘সারদা দেবী’ ‘জগদ্ধাত্রী পূজা’ বন্ধ করে দিতে চাইলে ‘দেবী জগদ্ধাত্রী’ তাঁকে ‘স্বপ্নাদেশে’ পূজা বন্ধ করা থেকে নিরস্ত করেন। এরপর ‘প্রথম চার বছর’ পূজা হয়েছিল ‘শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে’; ‘দ্বিতীয় চার বছর’ ‘সারদা দেবীর নামে’ এবং ‘তৃতীয় চার বছর’ ‘তাঁর কাকা নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নামে’। ‘বারো বছর পর’ ‘সারদা দেবী’ পুনরায় পূজা বন্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। শোনা যায়, সেই বারও ‘জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে’ তিনি নিরস্ত হন। ‘জীবদ্দশায়’ প্রতি বছরই ‘জগদ্ধাত্রী পূজায়’ উপস্থিত থাকতেন ‘সারদা দেবী’। ‘পূজা পরিচালনার জন্য’ তিনি ‘সাড়ে দশ বিঘার কিছু বেশি জমি’ ‘দেবোত্তর সম্পত্তিরূপে’ দিয়ে যান। ১৯১৯ সালে ‘সারদা দেবী’ এই পূজায় ‘শেষবার’ উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর তিনি প্রয়াত হন। ‘প্রথম পূজার ঐতিহ্য অনুযায়ী’ আজও ‘শুক্লা নবমীতে’ মূল পূজার পরও দুই দিন প্রতিমা রেখে দিয়ে ‘বিশেষ পূজার আয়োজন’ করা হয়। দুর্গাপূজার মতোই ‘পূজার সঙ্কল্প’ হয় ‘সারদা দেবীর নামে’। জগদ্ধাত্রীর প্রতিমার পাশে ‘জয়া-বিজয়া ও নারদ মুনির প্রতিমা’ থাকে। ‘নবমীতে ষোড়শোপচারে পূজা’, ‘তিন বার চণ্ডীপাঠ’ ও ‘মাতৃমন্দিরে দরিদ্রনারায়ণ সেবা’ হয়। ‘দশমীর দিন দশোপচারে পূজা’ হয়। এই দিন ‘সন্ধ্যারতি’র পর ‘যাত্রাগানের আসর’ বসে। একাদশীর দিনও ‘দশোপচারে পূজা’ ও ‘বিসর্জনকৃত্য’ সম্পন্ন হয়। সেই দিন ‘ধুনুচি নৃত্য’, ‘কর্পূরারতি’, ‘কনকাঞ্জলি’ প্রদান প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হয়। ‘ধুনুচি নাচের পর বাদ্যঘণ্টা ও শোভাযাত্রা সহকারে’ মায়ের দিঘিতে ‘প্রতিমা নিরঞ্জন’ হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনে ‘আশ্রমবাসী’, ‘অতিথি’ এবং ‘গ্রামবাসী’ – সকলে অংশ নেন। পূজা উপলক্ষে আশ্রমপ্রাঙ্গনে মেলাও বসে।
(তথ্যসূত্র:
১- প্রবন্ধ জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব: পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০।
২- পৌরাণিকা : বিশ্বকোষ হিন্দুধর্ম, প্রথম খণ্ড, অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, পৃষ্ঠা ৫৬২।
৩- শ্রীমা সারদা দেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৫০।
৪- সংবাদ প্রতিদিন, ১১ই নভেম্বর, ২০১৬।
৫- French connection: Jagatdhatri’s homecoming to Chandernagore, The Times of India, 23 November 2016.
৬- Overflowing with Ecstasy, The Stattesman, 23 November 2017.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত