‘স্বামী বিবেকানন্দ’ যখন লন্ডনের বিভিন্ন বক্তৃতাসভায় ‘বেদান্তের বাণী’ শুনিয়ে অনেক শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনীদের আকৃষ্ট করেছিলেন, সেই সময় আরও একজন ‘বঙ্গসন্তান’ ইংল্যান্ডে কিছু নির্বাচিত এবং বিশিষ্ট শ্রোতাদের সামনে বক্তৃতা দিয়ে তাঁদের চমৎকৃত করেছিলেন। তিনি ‘কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক’, ‘জগদীশচন্দ্র বসু’। দু’জনের কেউ কাউকে তখন চিনতেন না। ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে’ সাহেব অধ্যাপকদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ‘বিজ্ঞানের অধ্যাপক’ হিসেবে নিজের স্থান করে নিলেও কোনদিন ‘আত্মসন্তুষ্টিতে’ ভোগেননি জগদীশ। তখন বেশির ভাগ অধ্যাপকই কোনওক্রমে একসময় ‘বিভাগীয় প্রধান’ হওয়াটাকেই ‘জীবনের পরমার্থ’ জ্ঞান করতেন, তার বেশি আর কী চাইবার ছিল তাঁদের! কিন্তু জগদীশ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। ‘বিজ্ঞানের অজানা রহস্য’ তাঁকে অস্থির করে তুলত। তিনি শুধু ‘অধ্যাপক’ ছিলেন না, ছিলেন ‘গবেষক’। সেই সময়ে অনেক দিন পর্যন্ত তাঁর ‘গবেষণার কথা’ কেউ জানতেনই না। তখন ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে’ কোনও ‘গবেষণাগার’ ছিল না, সেখানে বাথরুমের মতন একটি ‘অব্যবহার্য ছোট্ট ঘর’ নানারকম হাবিজাবি জিনিসপত্র ও মাকড়সার জালে ভরা ছিল, সেই ঘরখানা নিজে সাফসুতরো করে জগদীশচন্দ্র নিজের গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। সেখানে তিনি টিনের পাত আর দড়িদড়া দিয়ে তৈরি খেলনার মতন যন্ত্রপাতি নিয়ে কলেজ ছুটির পরেও বসে কী সব খুটখাট করতেন, তা নিয়ে অনেক দিন কেউ মাথা ঘামান নি।
তখন ইউরোপের নানা দেশে ‘আলোর তরঙ্গ’, ‘অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গ’ নিয়ে নানা রকমের গবেষণামূলক কাজ হচ্ছিল, সে সব দেশের ‘সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়’ বৈজ্ঞানিকদের নানাভাবে সাহায্য করত। কিন্তু জগদীশচন্দ্র ছিলেন ‘পরাধীন দেশের মানুষ’, ‘ব্রিটিশ সরকার’ তাঁর প্রতি ছিলেন ‘বিমুখ’, তাঁর নিজের ‘সাহেব সহকর্মীরা’ তাঁকে ‘অবহেলার চোখে’ দেখতেন, অনেকেই মনে করতেন যে তিনি ‘ভারতীয়’ হয়েও ‘বিজ্ঞানের অধ্যাপকের চাকরি’ পেয়েছেন, সেটাই যথেষ্ট! তাঁরা মনে মনে ভাবতেন – ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’, ‘ধর্মভীরু ভারতীয়’দের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক আছে নাকি? অমন একটা সময়ে, স্থানীয় একজন ঝালাই মিস্ত্রিকে দিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু যন্ত্র তৈরি করিয়ে নিয়ে জগদীশচন্দ্র নিভৃতে ‘বিজ্ঞানচর্চা’ করে গিয়েছিলেন বছরের পর বছর। কলেজ থেকে যা ‘মাইনে’ তিনি পেতেন তার বেশির ভাগই তাঁর খরচ হয়ে যেত ‘বই কেনায়’ আর ‘গবেষণার জন্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করায়’। অবশ্য একটা ‘সুবিধে’ তাঁর ছিল, তাঁর স্ত্রী ‘অবলা’ ‘শাড়ি-গয়না বা সংসারের ছোটখাটো অভাব’ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। কিছুদিন ‘ডাক্তারি’ পড়েছিলেন বলে ‘অবলা’রও একটা ‘বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু মন’ ছিল, তিনি নিছক ‘গৃহিণী’ ছিলেন না। এমনকি জগদীশচন্দ্র স্ত্রীর সঙ্গে নিজের কাজ নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন।
‘আলো জিনিসটা কী?’ তখন ‘কবি’ ও ‘দার্শনিক’রা আলো বিষয়ে অনেক কিছু লিখেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞান জানতে চায় ‘উৎস ও কার্যকারণ’। সেই সময়ে, সবেমাত্র বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছিলেন, ‘বিদ্যুৎ ও চৌম্বক শক্তির যৌথ কম্পনে’ই ‘আলোর সৃষ্টি’ হয়। কিন্তু শুধু ‘তত্ত্ব’টি বুঝলে তো চলবে না, ‘হাতেকলমে’ সেটা প্রমাণ করে দেখাতে তো হবে। প্রখ্যাত ‘জার্মান বৈজ্ঞানিক হার্ৎজ’ এক যন্ত্র তৈরি করে দেখিয়েছিলেন, একদিকে উৎপন্ন হচ্ছে ‘অদৃশ্য আলো’, আর দূরে রাখা একটি যন্ত্রে ধরা পড়ছে সেই ‘অদৃশ্য আলোর ঢেউ’। ‘হার্ৎজের সেই আবিষ্কার’ নিয়ে সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। সেই ‘আলোর তরঙ্গ’ই ‘বেতার তরঙ্গ’ হতে পারে কি না তাই নিয়ে তখন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন ‘ইতালির মার্কনি ও লম্পা’, ‘রাশিয়ায় পপভ’, ‘ফ্রান্সেব ব্রাঁলি’ এবং ‘ইংল্যান্ডের স্যার অলিভার লজের’ মতন বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা। জগদীশচন্দ্র ‘হার্ৎজের রচনাবলি’ কিনেছিলেন, বারবার সেটা পাঠ করতেন, তাঁর ইচ্ছে হত ওই বিষয়টা নিয়ে কাজ করার। কিন্তু সেই সময়ে তিনি ছিলেন হতভাগ্য এই দেশের এক নগণ্য বৈজ্ঞানিক, সুতরাং কে তাঁকে সাহায্য করবে? তবু তিনি নিজের মতন করে গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন। একটা সুবিধা হয়েছিল এই যে, এর মধ্যে একসময় ‘প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ নামে আর একজন যুবক তাঁর ‘সহকর্মী’ হয়েছিলেন। অত্যন্ত কৃতী ও মেধাবী ছাত্র ‘প্রফুল্লচন্দ্র’ ইংল্যান্ডের ‘এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ‘ডি এসসি ডিগ্রি’ নিয়ে ফিরে, ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের পর দ্বিতীয় ভারতীয়’ হিসেবে ‘বিজ্ঞানের অধ্যাপক পদ’ পেয়েছিলেন, তাঁরা দু’জনে আগে থেকেই বন্ধু ছিলেন। তখন থেকেই ‘প্রফুল্লচন্দ্র’ করবেন না বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন, তিনি শুধু ‘বিজ্ঞানী’ ছিলেন না, ‘দেশের দুঃখ-দারিদ্রের জন্য কাতরতা’ তাঁর কথাবার্তার মধ্যে সব সময় ফুটে উঠত। তিনি জগদীশচন্দ্রের কাজে উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন। একদিন জগদীশচন্দ্র ‘কলেজের ল্যাবরেটরিতে’ তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে ডেকে একটি আশ্চর্য ব্যাপার দেখিয়েছিলেন। ‘অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্রের ঘরে’ রাখা হয়েছিল একটি ‘প্রেরক যন্ত্র’। আর ‘আলেকজান্ডার পেডলার’ নামে কলেজের আর একজন অধ্যাপকের ঘরে রাখা হয়েছিল ‘গ্রাহক যন্ত্র’। দুটো ঘরের মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় ৭০ ফুট এবং মাঝখানে ছিল মোটামোটা দেওয়াল। ‘প্রেরক যন্ত্র’ থেকে ‘অদৃশ্য বিদ্যুৎ তরঙ্গ’ গিয়ে ‘অন্য ঘরের গ্রাহক যন্ত্রের মাধ্যমে’ একটি পিস্তলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিয়েছিল। সকলে অবাক হয়েছিলেন, ব্যাপারটি কী হল, ম্যাজিক নাকি? ‘বিজ্ঞানের অভিনব আবিষ্কারগুলিকে’ প্রথমে ম্যাজিকের মতনই মনে হয়। ‘বেতার তরঙ্গ’ চোখে দেখা যায় না। ‘বিদ্যুৎ রশ্মিতে’ যে ‘বেতার তরঙ্গের’ সৃষ্টি হয়েছিল তা কিছু দূরের যান্ত্রিক কলকব্জাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাড়াচাড়া করে দিতে পেরেছিল। এটা ছিল বিজ্ঞানের একটা নতুন দিগন্ত। জগদীশচন্দ্র বুঝেছিলেন এইভাবে ‘বেতার তরঙ্গে’ দূরদূরান্তে খবরাখবর পাঠানোও যেতে পারে। ‘কলকাতা টাউন হলে’ আর একটি বড় আকারের সভার আয়োজন করে জগদীশচন্দ্র আবার দেখিয়েছিলেন তাঁর গবেষণার ফল। সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন স্বয়ং ‘ছোটলাট স্যার উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জি’। বিশাল ছিল তাঁর বপু। সেই ‘ছোটলাট’কেই জগদীশচন্দ্র দাঁড় করিয়েছিলেন তাঁর দুই যন্ত্রের মাঝখানে। জগদীশচন্দ্র দেখিয়েছিলেন ‘বিদ্যুৎ তরঙ্গ’ ‘ছোটলাটের’ অত বড় চেহারা ভেদ করে, আরও তিনটি বন্ধ ঘর পেরিয়ে ‘গ্রাহক যন্ত্রের মারফত’ বারুদের স্তুপ উড়িয়ে দিয়ে একটা লোহার গোলা ছুটিয়ে দিয়েছিল। উপস্থিত সকলেই ‘স্তম্ভিত এবং অভিভূত’ হয়েছিলেন। এরপরে জগদীশচন্দ্র সভায় উপস্থিতজনদের ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিলেন, সেটার মধ্যে ‘অলৌকিক’ বা ‘ভোজবাজি’ কিছু নেই, সেটা বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের এতখানি অগ্রগতি সম্পর্কে ভারতের আর কেউ তখনও অবগত ছিলেন না, সকলে অবাক হয়ে ভেবেছিলেন জগদীশচন্দ্র কলকাতায় বসে একা একা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই আবিষ্কার করলেন কী করে? ‘লেফটেন্যান্ট গভর্নর ম্যাকেঞ্জি’ জগদীশচন্দ্রের কৃতিত্বে মুগ্ধ হয়ে সব খোঁজখবর নিয়েছিলেন এবং ‘সরকারি তরফে’ তাঁকে ‘কিছু অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিলেন। ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ থেকে জগদীশচন্দ্রকে আহ্বান জানানো হয়েছিল সেই বিষয়ে ‘প্রবন্ধ পাঠ’ করার জন্য। সেই প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল সোসাইটির পত্রিকায়। বিলেতে জগদীশচন্দ্রের শিক্ষক ছিলেন ‘লর্ড র্যালে’। তাঁর সঙ্গে জগদীশচন্দ্র যোগাযোগ রেখেছিলেন, সেই সময় জগদীশচন্দ্র তাঁর কাছে ‘দুটি গবেষণাপত্র’ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের প্রিয় ছাত্রটির ‘উদ্ভাবনী শক্তি’ দেখে মুগ্ধ হয়ে ‘লর্ড র্যালে’ সঙ্গে সঙ্গে ‘সেই গবেষণাপত্র’ ছাপার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিখ্যাত বিজ্ঞানের পত্রিকা ‘দ্যা ইলেকট্রিশিয়ানে’ জগদীশচন্দ্রের ‘গবেষণা পত্র’ ছাপাও হয়েছিল। এরপরে ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে’ জগদীশচন্দ্র তাঁর ‘নিজস্ব ক্ষুদ্র গবেষণাগারে’ যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন, তার বিবরণ দিয়ে একটি পুস্তিকা ছাপিয়েছিলেন। সেটি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তখনকার বিখ্যাত ‘পদার্থবিদ লর্ড কেলভিনের’ কাছে। ‘লর্ড কেলভিন’ সেগুলি পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলেন। ‘বিদ্যুৎ রশ্মির যে তরঙ্গ’, তার দৈর্ঘ্য নানা মাপের হয়। সেই ‘তরঙ্গদৈর্ঘ্য’ নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই কাজ করেছিলেন, জগদীশচন্দ্র একটা ‘গবেষণাপত্র’ লিখেছিলেন সেই ‘তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের নির্ণয়কৌশল’ নিয়ে। ‘লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়’ সেই ‘গবেষণাপত্রের জন্য’ জগদীশচন্দ্রকে ‘ডি এসসি ডিগ্রি’ দেবার কথা ঘোষণা করেছিল। একজন অনুপস্থিত ব্যক্তিকে এ রকম ডিগ্রি দেওয়ার দৃষ্টান্ত বিশেষ পাওয়া যায় না।
জগদীশচন্দ্র সেই সময় অনুভব করেছিলেন, এই সব বিষয়ে ইউরোপে অন্য বৈজ্ঞানিকরা কে কী কাজ করছেন তার ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’ থাকলে ভাল হয়। এ জন্য তাঁর একবার বিদেশে যাওয়ার দরকার। একটা যোগাযোগও ঘটে গিয়েছিল। তাঁর শিক্ষক ‘লর্ড র্যালে’ ভারতে এসেছিলেন সেই সময়ে। সত্যিই জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের এক বাথরুমে বসে সেইসব কঠিন পরীক্ষা চালিয়েছিলেন কি না তা চাক্ষুষ করার জন্য তিনি কলেজে চলে এসেছিলেন একদিন। সব দেখে তিনি বুঝেছিলেন, দেশি মিস্তিরিদের দিয়ে সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বানিয়ে একেবারে নতুন ধরনের পরীক্ষা চালাচ্ছেন যে মানুষটি, সে সত্যি ম্যাজিশিয়ান! কিন্তু বিনা পৃষ্ঠপোষকতায় সেই কাজ চালিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? ‘লর্ড র্যালে’ জগদীশচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি এক্ষুনি ইংল্যান্ডে চলে এসো, তোমার এই পদ্ধতিগুলির কথা সবাইকে জানাও!’’ কিন্তু ‘দলাদলি’ থাকবে না, ‘পারস্পরিক ঈর্ষা’ থাকবে না – এমন কলেজ আবার হয় নাকি? ‘লর্ড র্যালে’ চলে যাবার পরে সেদিন বিকেলবেলাতেই ‘কলেজের অধ্যক্ষ’ জগদীশচন্দ্রের কাছে ‘জবাবদিহি’ চেয়েছিলেন, ‘‘লর্ড র্যালেকে আপনি কলেজের ল্যাবরেটরি দেখিয়েছেন কোন অধিকারে? কার অনুমতিতে আপনি একজন বাইরের লোককে এখানে ঢুকতে দিলেন?’’ আসলে জগদীশচন্দ্র ‘ডি এসসি ডিগ্রি’ পাবার পর থেকেই অন্যান্য অধ্যাপকদের মধ্যে গুজগুজ ফুসফুস হয়েছিল যে জগদীশ বোস মন দিয়ে ছাত্রদের পড়ায় না, সরকারের কাছ থেকে অধ্যাপনার জন্য মাইনে নিয়ে সে নিজের কাজ করে। জগদীশচন্দ্র কোনও অভিযোগেরই উত্তর দেন নি, তিনি বিলেত যাবার জন্য ‘লম্বা ছুটির দরখাস্ত’ করেছিলেন। কিন্তু ছুটি চাইলেও সহজে সেটা তিনি পান নি, নানা অজুহাতে তাঁকে আটকে দেবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ‘লর্ড র্যালে’ নিজে ‘ভারত সচিব’কে জগদীশচন্দ্রকে ইংল্যান্ডে পাঠাবার জন্য ‘সুপারিশ’ করেছিলেন, ইংল্যান্ডের অনেক বড় বড় বৈজ্ঞানিক তাঁর সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন। এমনকী ‘রয়্যাল সোসাইটি’ জগদীশচন্দ্রের কাজকর্ম সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। ‘বাংলার গভর্নর মাকেঞ্জি’ও তাঁর প্রতি ‘সহানুভূতিশীল’ ছিলেন, সুতরাং ‘জগদীশচন্দ্রের বিরোধীরা’ বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেন নি। জগদীশচন্দ্রকে ‘শিক্ষা বিভাগ’ ‘বৈজ্ঞানিক হিসেবে’ ‘ডেপুটেশানে’ পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত নিজের উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতিগুলি নিয়ে জগদীশচন্দ্র সস্ত্রীক সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন।
ভারতে যে ‘ধর্ম ও দর্শনের’ বহু ‘প্রাচীন ঐতিহ্য’ আছে, সে সম্পর্কে ‘ইংল্যান্ডের শিক্ষিত সম্প্রদায়’ অবহিত ছিল। ‘সংস্কৃত সাহিত্যের লুপ্ত ভাণ্ডার’ পুনরুদ্ধার করার পর ‘ইউরোপের বুদ্ধিজীবীদের’ বিস্ময়ের যেন শেষ ছিল না। সেই ‘সমস্যাসঙ্কুল দরিদ্র দেশে’ ‘রামায়ণ-মহাভারতের’ মতন মহান গ্রন্থ রচিত হয়েছিল কতকাল আগে। ‘ইলিয়াড-ওডিসি’র তুলনায় সেই দুটি গ্রন্থ অনেক বেশি ‘কাব্যময় ও গভীর মূল্যবোধসঞ্জাত’। ‘উপনিষদ ও গীতা’র মতন ‘সূক্ষ্ম দর্শন ও জীবনবোধের কথা’ আর কোন দেশে পাওয়া যায়? ‘কালিদাসের’ মতন কবি জন্মেছিলেন এ দেশে। কিন্তু ‘বিজ্ঞান’? তখন ‘ভারতে বিজ্ঞানচর্চার’ কোনও ইতিহাস ছিল না। প্রাচীন কালে ‘গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা’য় কিছু কিছু কাজ হয়েছিল। কিন্তু ‘ধারাবাহিকতা’ ছিল না। বিজ্ঞানে কোনও কিছুই চূড়ান্ত নয়, ‘একটি আবিষ্কার’ বা ‘একটি নতুন তত্ত্ব’, পরবর্তী অনেকগুলি ‘সম্ভাবনার দ্বার’ খুলে দেয়। ভারতে পর পর বিদেশি আক্রমণে ‘সমাজজীবন’ পর্যদস্তু হয়েছিল, তা ছাড়া ছোট ছোট রাজ্যগুলি ‘অন্তঃকলহে’ লিপ্ত ছিল যুগ যুগ ধরে। এ রকম অশান্তির পরিবেশে ‘একনিষ্ঠ বিজ্ঞান সাধনা’ সম্ভব ছিল না। সেই সময়টায় ‘পশ্চিমি জগৎ’ ধরেই নিয়েছিল যে ‘আধুনিক বিজ্ঞানে’, বিশেষতঃ ‘পদার্থ ও রসায়নে’ যে ‘বিস্ময়কর অগ্রগতি’ হচ্ছিল সেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে, তাতে ‘প্রাচ্য দেশগুলির’ কোনও ভূমিকাই নেই। তারা ভাবত ‘প্রাচ্য দেশগুলির’ এ সব বুঝতে আরও কটা শতাব্দী লাগবে কে জানে! ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ও অনেক জায়গায় বলেছিলেন, ‘‘ওদের কাছ থেকে আমরা নেব বিজ্ঞানের সুফল, বিনিময়ে আমরা ওদের দেব ধর্ম ও দর্শন।’’ কিন্তু জগদীশচন্দ্র লন্ডনে এসে তাঁর যন্ত্রপাতিব মাধ্যমে ‘হাতেকলমে পরীক্ষায়’ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর গবেষণার কাজ পৃথিবীর প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের সমতুল্য। ‘হার্ৎজের অনুগামীরা’ অনেকেই ‘বেতার তরঙ্গ’ নিয়ে কাজ করেছিলেন। ‘বিদ্যুৎ তরঙ্গের সাহায্যে’ দূর থেকে নির্দেশ পাঠিয়ে কোনও যন্ত্রকে স্বয়ংক্রিয় করার পরীক্ষায় ‘পথিকৃতের সম্মান’ জগদীশচন্দ্রের প্রাপ্য ছিল। জগদীশচন্দ্র অবশ্য ‘পেটেন্ট’ নেবার কথা চিন্তা করেননি। ‘ইতালিয়ান বৈজ্ঞানিক মার্কনি’ নিজের যন্ত্রের ‘পেটেন্ট’-এর জন্য ‘নকশা’ জমা দিয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র ও ‘মার্কনি’র কাজের অবশ্য কিছুটা তফাত ছিল, জগদীশচন্দ্র কাজ করছিলেন ‘মাইক্রো ওয়েভে’, আর ‘মার্কনি’ করছিলেন ‘শর্ট ওয়েভে’। ‘শর্ট ওয়েভে’ বেতার সংকেতের দূরত্ব অনেক বেশি। ‘লিভারপুলে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে’ জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতার সময় বিশিষ্ট শ্রোতাদের মধ্যে বসে ছিলেন বৃদ্ধ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ‘লর্ড কেলভিন’। বক্তৃতা শেষ হবার পর সবাই যখন জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন, তখন ‘লর্ড কেলভিন’ হাঁটুর ব্যথা নিয়েও কষ্ট করে উঠে এসেছিলেন দোতলায়। সেখানে মহিলাদের আসনের কাছে গিয়ে ‘অবলা’কে বলেছিলেন, ‘‘মহাশয়া, আপনি আপনার স্বামীর জন্য গর্ব বোধ করতে পারেন। তিনি একজন সার্থক বিজ্ঞানী।’’ ইংল্যান্ডের পত্র-পত্রিকাগুলির মধ্যে ‘লন্ডন টাইমস’ ও ‘স্পেকটেটর’ বরাবরই ‘ভারতবিদ্বেষী’ ছিল। নানান ছুতোয় এরা ‘ভারত সম্পর্কে কুৎসা’ ছড়াত। সে সব লিখে এরা প্রমাণ করতে চাইত যে ‘অকর্মণ্য’, ‘অলস’, ‘মূর্খ’ ভারতীয়দের ‘ইংরেজ-শাসন’ ছাড়া গতি নেই, শাসক ইংরেজরাই তাঁদের ‘রক্ষাকর্তা’, তাঁরাই ‘ভারতে নিয়ম-শৃঙ্খলার রাজত্ব’ স্থাপন করেছে। কিন্তু ‘বিজ্ঞানের পরীক্ষিত সত্যকে’ অমান্য করার উপায় ছিল না। ‘লন্ডন টাইমস’ লিখতে বাধ্য হয়েছিল, ‘‘এই বছর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয়ে অধ্যাপক বসুর বক্তৃতা। … এই বিজ্ঞানী বিদ্যুৎ রশ্মির সমবর্তন সম্পর্কে যে মৌলিক গবেষণা করেছেন তার প্রতি ইউরোপের বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহ জন্মেছে।’’ জগদীশচন্দ্রের জন্য ‘সবচেয়ে বেশি সম্মানের আহ্বান’ এসেছিল ‘রয়্যাল সোসাইটি’ থেকে। ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউটে’ মাঝে মাঝে ‘শুক্র-সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠিত হতে। কোনও কোনও মাসের ‘শুক্রবারের সন্ধ্যাবেলা’ পৃথিবীর অগ্রগণ্য বৈজ্ঞানিকদের কোনও একজনকে ডাকা হত বক্তৃতা দেবার জন্য। সেখানে ডাক পাওয়াই ছিল একটি খুব বড় খেতাব পাওয়ার সমান। সেখানে ‘সভারম্ভে বক্তার পরিচয়’ দেবার কোনও রীতি ছিল না। কারণ বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছাড়া কেউ সুযোগই পেতেন না, আর যাঁরা সেই বিজ্ঞানীর কাজ সম্পর্কে কিছু জানতেন না, তাঁরা শ্রোতা হিসেবেও আমন্ত্রণও পেতেন না। ঠিক রাত নটা থেকে দশটা পর্যন্ত এক ঘণ্টা বক্তৃতা হত। যেখানে ‘স্যার হামফ্রে ডেভি’ বা ‘মাইকেল ফ্যারাডে’র মতন বিজ্ঞানীরা বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে সেই প্রথম বক্তৃতা দিতে উঠেছিলেন এক ভারতীয়। সভাপতির পাশে বসে ‘অবলা’র বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। তিনি যেন কল্পনায় দেখতে পেয়েছিলেন, তাঁর স্বামীর হাতে রয়েছে ‘ভারতের জয়-পতাকা’। ‘অবলার পিতৃকুল ও শ্বশুরকুল’ ছিলেন ‘স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ’। ‘পরাধীনতার জ্বালা’ সব সময় তাঁর মনের মধ্যে ধিকিধিকি করে জ্বলত, সেই সব মুহূর্তে তা মুছে গিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, এমনও কি দিন আসবে, যখন কলকাতায় ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউটের’ মতন কোনও ‘বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান’ হবে, সেখানে তাঁরা ওরকম ভাবে বিদেশি বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানাতে পারবেন? বক্তৃতা শেষে অন্যদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘লর্ড র্যালে’ জগদীশচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘‘এমন নির্ভুল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা আগে দেখিনি। জগদীশ, তুমি দু-একটা ছোটখাটো ভুল করলে তবু মনে হত জিনিসটা বাস্তব। এ যেন মায়াজাল!’’ ‘স্পেক্টেটর পত্রিকা’ সেই বক্তৃতার বিবরণ দিয়ে লিখেছিল, ‘‘একজন খাঁটি বাঙালি, লন্ডনে উপস্থিত হয়েছে, বাঘা বাঘা ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিকদের সামনে দাঁড়িয়ে আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের অতি দুরূহ বিষয়ে সাবলীলভাবে বক্তৃতা দিয়ে চলেছে, এ দৃশ্য যেন বিশ্বাস করা যায় না!’’ ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউশনের বক্তৃতায়’ জগদীশচন্দ্রের ব্যক্তিগত খ্যাতি ও সাফল্যই বড় কথা ছিল না। সেখানে উপস্থিত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, ভারতে বিজ্ঞানচর্চার আরও প্রসার হওয়া উচিত। প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের অধীনে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরি করে দেওয়া ভারত সরকারের কর্তব্য। তাঁরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে চিঠি দিয়েছিলেন ‘ভারত সচিব’কে, ‘অনুকুল সাড়া’ও পাওয়া গিয়েছিল, ব্রিটিশ সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করে বিস্তর চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছিল। এর পর ‘ফ্রান্স’ ও ‘জার্মানি’তে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়ে ‘বসু পরিবার’ দেশে ফিরেছিলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ কলকাতায় ফেরার দু’মাস পরে।
‘স্বামী বিবেকানন্দ’কে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল ‘শিয়ালদহ স্টেশনে’। দেশবাসী তাঁর ‘পাশ্চাত্য-বিজয় কাহিনী’ আগে থেকেই জেনে উৎসাহিত হয়েছিল। সেই তুলনায় জগদীশচন্দ্রের কথা বিশেষ কেউ জানতেন না। তিনি কী নিয়ে ‘গবেষণা’ করছেন, তা কজনই বা সেটা তখন বুঝতেন! ‘বিলেতের পত্র-পত্রিকায়’ কারুর প্রশংসা বেরুলে এ দেশের পত্র-পত্রিকায় তাঁকে গুরুত্ব দেওয়া হত ঠিকই। এখানকার কিছু কিছু কাগজেও ‘জগদীশচন্দ্র বিষয়ে সংবাদ’ ছাপা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলোতে কেউ বিশেষ কেউ গুরুত্ব দেয়নি। জাহাজে ‘বোম্বাই’ পর্যন্ত এসে ‘জগদীশচন্দ্র ও অবলা’ ট্রেনে এসে পৌঁছেছিলেন ‘হাওড়া স্টেশনে’। তাঁদের অভ্যর্থনা জানাতে ‘গুটিকয়েক আত্মীয়’ ছাড়া আর কেউ আসেনি। ‘জগদীশচন্দ্রের ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসু’ নিজে আসতে না পেরে, একজনকে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে যাবার জন্য, স্থির হয়েছিল তাঁরা প্রথমে তাঁর বাড়িতেই উঠবেন। মালপত্র দেখেশুনে যখন কুলির মাথায় চাপানো হচ্ছিল, তখন পেছন থেকে একজন একটা চাপড় মেরেছিলেন জগদীশচন্দ্রের পিঠে। চমকে মুখ ফিরিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন সহাস্য ডাক্তার ‘মহেন্দ্রলাল সরকার’কে। সেই এপ্রিল মাসের গরমেও তিনি থ্রি পিস সুট পরে ছিলেন, তাঁর বয়েসের ছাপ পড়েছিল মুখে, তবু আনন্দে-উৎসাহে তাঁর চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছিল। জগদীশচন্দ্র বিস্মিতভাবে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘এ কী স্যার, আপনি এসেছেন? খবর পেলেন কী করে?’’ ‘মহেন্দ্রলাল’ বলেছিলেন, ‘‘তুমি এত বড় একটা কীর্তি করে আসছ, আর আমি খবর পাব না? ট্রেন চল্লিশ মিনিট লেট! টুপিওয়ালা লালমুখোরা বুঝেছে যে এ দেশের মানুষেরও সায়েন্সের ব্রেন আছে, শুধু কেত্তন গায় আর মা মা করে না। কী হে সুলেমান, মালাটালাগুলো বার করো!’’ ‘মহেন্দ্রলালের’ সঙ্গে ‘বিজ্ঞান পরিষদের চার-পাঁচজন সদস্য’ও এসেছিলেন। তাঁরা কয়েকটি মালা পরিয়ে দিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের গলায়, বয়ঃকনিষ্ঠরা প্রণাম করেছিলেন তাঁর পায়ে হাত দিয়ে। এরপরে ‘মহেন্দ্রলাল’ ফিরে তাকিয়েছিলেন ‘অবলা’র দিকে। কুচি দিয়ে শাড়ি পরা, কাঁধের কাছে ব্রোচ লাগানো, মাথায় আধ-ঘোমটা, ‘অবলা’ স্মিতমুখে চেয়ে ছিলেন তাঁর ‘পিতৃবন্ধু’র দিকে। ‘মহেন্দ্রলাল’ মালার বদলে একটি ডাঁটাসুদ্ধ গোলাপ ফুল তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘কেমন আছিস মা? তুই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়েছিলি বলে তোকে আমি একদিন রাম বকুনি দিয়েছিলুম, মনে আছে?’’ ‘অবলা’ বলেছিলেন, ‘‘শুধু বকুনি, প্রায় মারতে গিয়েছিলেন।’’ ‘মহেন্দ্রলাল’ বলেছিলেন, ‘‘স্বীকার করছি আমার গুখুরি হয়েছিল। ডাক্তারনী হলে কি আর এমন স্বামী পেতিস! ওরে, তুই সব সময় জগদীশের পেছনে লেগে থাকবি, ওকে থামতে দিবি না। এই তো সবে শুরু, জগদীশ আমাদের নিউটন, গ্যালিলিও হবে। বিলিতি কাগজে জগদীশ সম্পর্কে লেখা পড়েছি আর গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। জামানিতে এক্স-রে আবিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায়। জগদীশ নিজের চেষ্টায় এক্স-রে যন্ত্র বানিয়ে ফেলেছিল। আমার রুগিদের হাড়গোড় ভাঙার ছবি তুলে দিয়েছে, তখন থেকেই বুঝেছি এ ছোকরার মাথায় অনেক কিছু আছে।’’ জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘স্যার, ও দেশে আমার কী সুখ্যাতি হয়েছে না হয়েছে, তার চেয়েও একটা বড় খবর আছে। সেটা শুনলে আপনি সত্যিকারের খুশি হবেন।’’ ‘মহেন্দ্রলাল’ আগ্রহের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘‘তাই নাকি, কী খবর, শুনি শুনি।’’ জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘লর্ড লিস্টার, লর্ড কেলভিন ভারত সরকারের কাছে সুপারিশ করেছেন কলকাতায় একটি অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরি গড়ে দিতে হবে। ভারত সরকার রাজি হয়েছে, এর জন্য চল্লিশ হাজার পাউন্ড বরাদ্দ হয়েছে।’’ ‘মহেন্দ্রলাল’ চক্ষু ছানাবড়া করে বলেছিলেন, ‘‘চল্লিশ হাজার পাউন্ড, বলল কী হে! …’’ জগদীশচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, সব ঠিক হয়ে গেছে। নতুন বাড়ি হবে, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আসবে, আমরা যা চাইব তাই-ই পাব।’’ ‘মহেন্দ্রলাল’ বুকে হাত দিয়ে একটি আরামের নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, ‘‘ব্যাটাদের সুমতি হয়েছে তা হলে? এ দেশের ইংরেজরা তো শুধু শোষণ করতেই জানে। অত বড় লেবরেটরি তৈরি হলে আরও কত ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা করতে পারবে, আমাদের দেশেও এডিসন, ডেভি’র মতন বিজ্ঞানী তৈরি হবে। বড় আনন্দ হচ্ছে গো, বড় আনন্দ হচ্ছে!’’ তারপর বলেছিলেন, ‘‘কয়েকটা দিন বিশ্রাম নিয়ে নাও। একদিন আমাদের ইনস্টিটিউটে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে সব বোঝাবে। আমাকে এক্ষুনি রুগি দেখতে দৌড়তে হবে।’’
দু-চারদিনের মধ্যে কয়েকটি সভা-সমিতিতে ডাক পড়েছিল জগদীশচন্দ্রের, তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বস প্রকাশ শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা খুব বড় মাত্রায় ছিল না। ‘জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে’ও জগদীশচন্দ্রের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। ‘বলেন্দ্র’ ‘রবীন্দ্রনাথ’কে বলেছিলেন, ‘‘রবিকা, রামকৃষ্ণের শিষ্য বিবেকানন্দকে যদি নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয় এত বড় করে, তা হলে জগদীশ বোসকেই বা দেওয়া হবে না কেন? ইউরোপে উনিও প্রবল সাড়া ফেলে দিয়েছেন, এ দেশের সম্মান বাড়িয়েছেন।’’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘তা তো ঠিকই।’’ তবে তাঁদের দু’জনের কথাবার্তার মধ্যে একটি ‘সূক্ষ্ম ব্যাপার’ উহ্য রয়ে গিয়েছিল। ‘বিবেকানন্দ’কে নিয়ে ‘উচ্ছ্বাসের আতিশয্য’ আসলে ছিল ‘হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীদেরই পুনরুত্থান’, ‘ব্রাহ্মদের’ তা ভাল লাগার কথা ছিল না এবং লাগেও নি। তখন ‘প্রতাপ মজুমদারের দল’ প্রাণপণে ‘বিবেকানন্দের কৃতিত্বকে’ হেয় করে দেখাবার চেষ্টা করছিল। ‘ঠাকুরবাড়ি পরিচালিত আদি ব্রাহ্ম সমাজ’ অবশ্য তাতে গলা মেলায়নি, তাঁরা প্রকাশ্যে কখনও কারুর নামে ‘কটুবাক্য প্রয়োগ’ করতেন না, সব সময় ‘শিষ্টতা’ বজায় রাখতেন, তবু তাঁরা ‘বিবেকানন্দ সম্পর্কে শীতল মনোভাব’ অবলম্বন করে ছিলেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র ছিলেন ‘ব্রাহ্ম’, তাঁদের নিজেদের লোক। ‘জগদীশচন্দ্রের সংবর্ধনার জন্য’ ‘ব্রাহ্মদের’ই উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে তাঁদের মনে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ জগদীশচন্দ্রকে চিনতেন, তবে এর আগে তেমন ‘ঘনিষ্ঠতার সুযোগ’ তাঁদের ঘটেনি। বিজ্ঞানী হিসেবে হঠাৎ এত খ্যাতি অর্জনের আগেও জগদীশচন্দ্রের ‘ফটোগ্রাফি’, ‘ফোনোগ্রাফ যন্ত্রের ব্যবহার’ প্রভৃতির শখ ছিল। ‘বিজ্ঞানের অধ্যাপক’ হয়েও তিনি ছিলেন ‘সাহিত্যের অনুরাগী’, জগদীশচন্দ্র যে ‘সাধনা’ পত্রিকার ‘গ্রাহক’ ছিলেন তা রবীন্দ্রনাথ জানতেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার কিছু কিছু পঙক্তি তিনি মুখস্থ বলতে পারতেন, এই ঘটনার কিছুকাল আগে তিনি রবীন্দ্রনাথকে একবার ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে’ আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘ফোনোগ্রাফ যন্ত্রে’ তাঁর কণ্ঠে ‘ব্ৰহ্ম সঙ্গীত’ রেকর্ড করিয়েছিলেন। তখন দু’জনের সামান্য আলাপ হয়েছিল। কবি হলেও রবীন্দ্রনাথ সব সময় ‘ভাবের জগতে’ তো থাকতেন না, অন্যান্য নানা বিষয়ের মতন ‘বিজ্ঞানে’ও তাঁর যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। ‘বিজ্ঞান’ও তাঁকে এক ‘অলীক রহস্যময় জগতের সন্ধান’ দিত। সময় পেলেই তিনি ‘বিজ্ঞানের বই’ পড়তেন। তাই জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এক দিন ‘বলেন্দ্র’কে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ধর্মতলায় আনন্দমোহন বসুর বাড়ি’ তাঁর পরিচিত ছিল, ‘অযাচিতভাবে’ সেখানে যেতে তাঁর লজ্জা ছিল না। ব্যস্ত ‘ব্যারিস্টার’ হয়েও ‘আনন্দমোহন’ বহু রকম ‘সামাজিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে’ জড়িত ছিলেন, ‘কংগ্রেসের কাজ’, ‘সিটি স্কুল ও কলেজ’, ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ এই সব দেখাশুনোর জন্য অনেক সময় ব্যয় করতেন, তা ছাড়া করতেন ‘দানধ্যান’। তাঁর বাড়িতে থাকতেন অনেক ‘আশ্রিত’। ‘জগদীশচন্দ্র এবং অবলা’ তখন বাড়িতে ছিলেন না, কাছাকাছি একটি সভায় যোগ দিতে গিয়েছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের ফেরার কথা ছিল। সেই বাড়ির অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন, তাঁদের খাতির করে বসানো হয়েছিল। কিন্তু সেদিন বেশিক্ষণ অপেক্ষা করার মতন সময় রবীন্দ্রনাথের ছিল না, তাঁর আর এক জায়গায় যাবার কথা ছিল। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে করে ‘দুর্লভ ম্যাগনোলিয়া ফুলের একটি গুচ্ছ’ এনেছিলেন। টেবিলের ওপর সেই ফুল রেখে তিনি একটা ‘চিরকুট’ লিখতে গিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন লিখবেন, ‘‘এক দিগ্বিজয়ী বিজ্ঞানীর প্রতি বঙ্গের এক কবির শ্রদ্ধা নিবেদন।’’ কিন্তু কলম হাতে নিতেই তাঁর মাথায় এসে গিয়েছিল একটা কবিতা। তিনি লিখেছিলেন –
‘‘বিজ্ঞান লক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিম মন্দিরে
দুর সিন্ধুতীরে
হে বন্ধু গিয়েছ তুমি; জয় মাল্যখানি
সেথা হতে আনি
দীনহীনা জননীর লজ্জানত শিরে
পরায়েছ ধীরে …’’
(তথ্যসূত্র:
১- অব্যক্ত, জগদীশচন্দ্র বসু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র (২০১৪)।
২- আচার্য্য জগদীশচন্দ্র, ডক্টর শ্রী ফণীন্দ্রনাথ বসু।
৩- বিজ্ঞানসাধক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, ড. ডি সি হাজারী, মাতৃভূমি প্রকাশনী (২০১৫)।
৪- আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, মনি বাগচি, চারুলিপি প্রকাশন।
৫- প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
৬- অবলা বসুর ভ্রমণকথা, দময়ন্তী দাশগুপ্ত, পরশপাথর প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত