কথিত যে, দেশবন্ধু বিপ্লবীদের আইনি সহযোগিতা করতেন বিনা খরচে। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় সিংহের মতো লড়াই করে শ্রীঅরবিন্দ ও বারীন ঘোষকে ছাড়িয়ে আনলেন। ঠিকই, ‘প্রচলিত মিথ’ বলে, চিত্তরঞ্জন ‘বিনা পারিশ্রমিকে’ ‘আলিপুর বোমার মামলা’টি লড়েছিলেন। কিন্তু এই মামলায় ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা পাওয়া’ ‘বোমা-বিশারদ’ ‘বিপ্লবী হেমচন্দ্র দাস’ (কানুনগো)-র লেখা ‘বাংলায় বিপ্লবী প্রচেষ্টা’ বইটি অন্য কথা বলে। ‘ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড’কে হত্যার উদ্দেশ্যে ‘ক্ষুদিরাম বসু’ ও ‘প্রফুল্ল চাকী’ যে বোমা ছুড়েছিলেন, তা তৈরি করেছিলেন ‘হেমচন্দ্র’, তাঁর লেখা বই থেকে জানা যায় – ‘‘অরবিন্দবাবুকে সমর্থন করবার প্রথমে ভার নিয়েছিলেন মি. ব্যোমকেশ। তিনি আইনের মার-পেঁচে আমাদের মোকদ্দমা হাইকোর্টে তুলে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। বিফল হলো। কম ফীতে হাইকোর্ট ছেড়ে নিম্ন আদালতে আটকে থাকতে রাজি হলেন না। তখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে ধরা হলো। তিনি এককালীন অগ্রিম ছ’হাজার টাকা এবং মোকদ্দমা শেষ করতে ১২ হাজার টাকা দাবি করেছিলেন। … সে যাবৎ লক্ষ টাকা পূর্বোক্ত ব্যারিস্টার সাহেবকে বিদায় দিতে ব্যয়িত হয়ে গেছল। অথচ সেই দিনই ছ’হাজার টাকা চাই। কারণ পরদিন মোকদ্দমা চলবার কথা ছিল। শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্ত কৃষ্ণকুমার মিত্র মহাশয়ের মুখে পরে শুনেছি, একজন সহৃদয় মাড়োয়ারী ভদ্রলোককে বলা মাত্রই ছ’হাজার টাকা তক্ষুণি দিয়েছিলেন।’’ ‘ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন’ যে কেবলমাত্র ‘অরবিন্দের হয়েই’ এই মামলায় লড়েছিলেন সে কথা ‘ঋষি অরবিন্দের ভাই’ ‘বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের আত্মজীবনী’ ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’তেও আছে। তিনি লিখছেন, ‘‘অরবিন্দের পক্ষে ব্যোমকেশ চক্রবর্তী ও কে এন চৌধুরী উকিল নীরোদচন্দ্র চ্যাটার্জ্জিকে বাহন বা সহযোগী করিয়া দণ্ডায়মান; মোকদ্দমা কিন্তু দু’পা হাঁটিতেই পট পরিবর্ত্তন হইয়া উক্ত ব্যারিস্টারদ্বয়ের স্থান গ্রহণ করিলেন দেশবন্ধু দাশ। বাকি বড় ও চুণাপুঁটিগুলির পক্ষে হইলেন ব্যারিস্টারের মধ্যে পি মিত্র, ই পি ঘোষ, এস রায়, জে এন রায়, আর সি ব্যানার্জ্জি, আর এন রায়।’’ ‘বিচারক বিচক্রফ্ট’-এর রায়ে ‘অরবিন্দ-সহ ১৭ জন’ বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেও, ‘বারীন ও উল্লাসকরের ফাঁসি’ এবং ‘হেমচন্দ্র-সহ ১০ জনের’ ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের হুকুম’ জারি হয়েছিল। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গেলে, সাত মাস পরে ফাঁসির হুকুম ‘রদ’ হয়ে ‘বারীন ও উল্লাসকরের’ ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা হয়’। অন্যদের সাজা কিছু কমে গেলেও, ‘হেমচন্দ্র দাস’ (কানুনগো) ও ‘উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের’ ‘যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর’ বজায় থাকে। মানসিক ভাবে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় সরকার ‘উল্লাসকর দত্ত’কে ১৯২০ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯২১ সালে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ ভারতে আসার ঘটনাকে উদ্যাপন করতে গিয়ে তৎকালীন ‘ব্রিটিশ সরকার’ বেশ কিছু রাজবন্দিকে মুক্তি দিয়েছিল। দীর্ঘ ১২ বছর ‘আন্দামানের সেলুলার জেলে’ সশ্রম কারাদণ্ডের পর অবশেষে মুক্তি পেয়েছিলেন ‘বারীন’, ‘হেমচন্দ্র’ ও ‘উপেন্দ্রনাথ’।
দেশবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের একটি ‘উল্লেখযোগ্য ও বিতর্কিত অধ্যায়’ হল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’। ১৯২৩ সালে কয়েক মাস ধরে চলতে থাকা ‘সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’ বন্ধ করার জন্য চিত্তরঞ্জন যে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন, তারই ফসল ছিল ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বরে হওয়া ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’। সেই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, হিন্দু মুসলমান দু’পক্ষকেই মিলেমিশে স্বরাজের জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং তা অধিগত হলে তবেই চুক্তিটি হবে কার্যকর। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর সালে ‘কোকনদে’ অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে’ চুক্তিটি খারিজ হয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেক্ষেত্রে চিত্তরঞ্জনের প্রতিক্রিয়াটিও ছিল লক্ষণীয়, তিনি বলেছিলেন – ‘‘… you can delete the Bengal Pact from the resolution, but you cannot delete Bengal from the History of the Indian National Congress … Bengal will not be deleted in this Unceremonious fashion. If you do, Bengal can take care of itself.’’ তবে বহু সদস্যের ‘নিস্পৃহ মনোভাবের কারণে’ চুক্তিটির বাস্তব গতিও প্রায় রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ১৯২৪ সালে ‘সিরাজগঞ্জে’ ‘প্রাদেশিক কংগ্রেসের’ যে অধিবেশন হয়েছিল, সেখানে অকাট্য যুক্তিতে তা ‘পাস’ করানো হলেও; ‘গান্ধী’, ‘লালা লাজপত রাই’, ‘মদনমোহন মালব্য’ প্রমুখ এতে সম্মতি দেননি। অনেক ‘প্রাদেশিক নেতা’ও এটির বিরোধিতা করেছিলেন। কটাক্ষ করে এটাও বলা হয়েছিল, ‘প্রাদেশিক কংগ্রেস’ যখন ‘জাতীয় কংগ্রেসের শাখাবিশেষ’, এমন স্বীকৃতির কোনও দাম নেই। কেননা সেখানে আগেই এটি রদ হয়ে গিয়েছে।
১৯২৪ সালে ‘কলকাতার মেয়র’ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে চিত্তরঞ্জন ‘সুভাষচন্দ্র বসু’কে ‘কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান কর্তা’ হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জনের বিরুদ্ধে দু’টি অভিযোগ অনেকেই আনেন – ‘জাতিবিদ্বেষ’ এবং ‘মফস্বল-বিরোধিতা’। ‘মেদিনীপুরের কাঁথি নিবাসী’ ‘মাহিষ্য’ ‘বীরেন্দ্রনাথ শাসমল’কে অপমানিত হতে হয়েছিল ঠিকই, তবে তাতে চিত্তরঞ্জনের কোনও দায় ছিল না। তাঁর মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র ‘জাতিবিদ্বেষ’ এবং ‘নগরভিত্তিক উচ্চমার্গীয় মনোভাব’ থাকত, তবে ‘আত্মমর্যাদাসম্পন্ন’ ‘শাসমল’ ‘স্বরাজ্য দলে’ নাম লিখিয়ে কি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারতেন? এটাও মনে রাখা দরকার, ‘স্বরাজের স্বার্থে’ প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষজনকেও তখন চিত্তরঞ্জন আপন করে নিয়েছিলেন। এমনকি, ‘সশস্ত্র বিপ্লবীদের কট্টর দেশপ্রেম’কে কাজে লাগাবার জন্য কংগ্রেসে তাঁদের অন্তর্ভুক্তিও চাইতেন। আসল কথা, ১৯২৬ সালে ‘কৃষ্ণনগরে’ অনুষ্ঠিত ‘প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে’ ‘গান্ধীবাদী শাসমল’ ‘সশস্ত্র বৈপ্লবিক কর্মের’ কড়া নিন্দা করেছিলেন। সেদিন সেখানে উপস্থিত ‘সশস্ত্র বিপ্লবীদের প্রতিনিধি সংস্থা’ ‘কর্মী সঙ্ঘ’-র কিছু সদস্যের চাপেই ‘শাসমল’কে প্যান্ডেল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। এরপরে অপমানিত ‘শাসমল’ ‘প্রাদেশিক কংগ্রেস’ থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। তবে তাঁর পুত্র পরে অভিযোগ করেছিলেন – ‘জাতপাতের কথা’ তুলে তাঁকে তখন অপমান করা হয়েছিল এবং ‘মফস্বলবাসী’ হওয়ার কারণে কটাক্ষও করা হয়েছিল। এ ব্যবহার অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এর সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সম্পর্ক কোথায়? তিনি তো ১৯২৫ সালেই গত হয়েছিলেন।
‘মেয়র’ হওয়ার পর চিত্তরঞ্জন ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’কে অনুসরণ করেই কাজে মন দিয়েছিলেন। চাকরির শূন্যপদে শতকরা ৭৫ ভাগ মুসলমানের নিয়োগ হয়েছিল (সূত্র – বঙ্গভূমি ও বাঙালির ইতিহাস, ড. নীতিশ সেনগুপ্ত)। এই সময় মুসলমানদের মধ্যে তাঁর প্রবল জনপ্রিয়তা লক্ষ করা গিয়েছিল। ‘স্বরাজ’ না আসায় অন্যত্র ‘প্যাক্ট’টির বাস্তবায়ন তেমন ভাবে সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে সুভাষকে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছিল। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জনও মারা যান। পরে ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘কৃষ্ণনগরের অধিবেশনে’ ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’কেও বাতিল করা হয়েছিল। ‘আশাহত’ হয়ে তখন থেকেই অনেক ‘মুসলমান সদস্য’ কংগ্রেস ত্যাগ করতে শুরু করেছিলেন। এর দু’তিন বছরের মধ্যে, যে ‘সোহরাওয়ার্দি’, ‘তমিজুদ্দিন’ প্রমুখ ব্যক্তিরা একসময় চিত্তরঞ্জনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, তাঁরাও কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এই সব কারণে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ যখন ভাল ভাবে আত্মপ্রকাশ করারই সুযোগ পায় নি, তার প্রেক্ষিতে চিত্তরঞ্জনকে বিদ্ধ করা কি সমীচীন? এই প্রসঙ্গে ‘দেশবন্ধু-কন্যা অপর্ণা দেবী’র পর্যবেক্ষণটি স্মরণীয়, ‘‘যদি সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানকল্পে কংগ্রেস ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ বা লালা লাজপত রায় ও ডাক্তার এম এ আনসারি কৃত প্যাক্টে ত্বরায় দৃঢ় মনোনিবেশ করতেন তা হলে পিতৃদেবের মৃত্যুর পরই সাম্প্রদায়িক সমস্যা তীব্র ভাবে কখনও দেখা দিত না। কারণ সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানকল্পে স্বরাজ্য পার্টির হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই প্রবল চেষ্টিত ছিলেন, কিন্তু পিতৃদেবের মৃত্যুতে স্বরাজ্য পার্টি স্তিমিত হয়ে গেল। তৃতীয় শক্তি এ সুযোগ গ্রহণে তৎপর হয়ে উঠল এবং তারা এতে সফল হয়েছিল কি না তা দেশবাসীর বিচার্য।’’ (মানুষ চিত্তরঞ্জন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পৃ. ১৯৯)
নেতাজি নিজে দেশবন্ধুর উপর একটি দীর্ঘ মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন ‘মান্দালয় জেলে’ ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। তিনি লিখেছিলেন –
‘‘ভারতের হিন্দু জননায়কদের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এত বড় বন্ধু আর কেহ ছিলেন বলিয়া আমার মনে হয় না … তিনি হিন্দুধর্মকে এত ভালবাসিতেন যে তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন, অথচ তাঁর মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না … দেশবন্ধু ধর্মমতে বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু তাঁর বুকের মধ্যে সকল ধর্মের লোকের স্থান ছিল …।’’
চিত্তরঞ্জনের পথ ধরেই ভারতবর্ষের ধর্মীয় বিভিন্নতার বিষয়ে এই উদার মহানুভবতার আদর্শকে সুভাষচন্দ্র তাঁর নিজের রাজনীতিতে প্রতিফলিত করতে চেয়েছিলেন। নেতাজি শ্রদ্ধাভরে লিখেছিলেন –
‘‘চিত্তরঞ্জনের জাতীয়তাবাদ পূর্ণতা লাভ করত আন্তর্জাতিক সংযোগের মধ্যে। কিন্তু সেই বিশ্বপ্রেমের জন্য নিজের দেশের প্রতি প্রেম তিনি বিসর্জন দেননি। আবার তার সঙ্গে এও ঠিক যে এই স্বজাতিপ্রেম তাঁর মধ্যে কোনও সঙ্কীর্ণ আত্মকেন্দ্রিকতাও তৈরি করেনি।’’
দেশবন্ধুর এই অপূর্ণ স্বপ্ন এবং আশার মধ্যেই তাঁর ‘‘সর্ববৃহৎ উত্তরাধিকার’’ খুঁজে পেয়েছিলেন নেতাজি।
৫ই সেপ্টেম্বর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একটা ‘নোট’ বিলি করেছিলেন কলকাতায়, ১৯২০ সালের কংগ্রেসের অধিবেশনে। তিনি চেয়েছিলেন, ‘অসহযোগ’ নামক একটি আন্দোলন করুক কংগ্রেস – সেই প্রস্তাবের ‘নোট’। তার মাত্র পাঁচ বছর আগে ‘দক্ষিণ আফ্রিকা’ থেকে স্থায়ীভাবে ভারতে চলে এসেছিলেন ‘মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী’। এসেই কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে এসে যেন কংগ্রেসের খোলনলচে বদলে দেওয়ার একটা আভাস দিচ্ছিলেন। সেই নোটে গান্ধীজির প্রস্তাব ছিল ‘সাতদফা অ্যাকশন’ – ‘ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া সমস্ত উপাধি ও সাম্মানিক পদ সমর্পণ করা হবে’, ‘সরকারি অনুষ্ঠান বয়কট করতে হবে’, ‘সরকারি স্কুল কলেজ থেকে ধীরে ধীরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে ছেলেমেয়দের’, ‘পরিবর্তে জাতীয় স্কুল কলেজ নির্মাণ করা হবে’, ‘ব্রিটিশ বিচারবিভাগকে বয়কট করা হবে’, ‘লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বয়কট করা হোক’ ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি ছিল ‘বিদেশি পণ্য বর্জন’ করা। দু’দিন ধরে সেই ‘নোট’ পড়ে অনুধাবন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন কংগ্রেস প্রতিনিধিরা। ৮ই সেপ্টেম্বর সেই ‘নোট’ পেশ করা হয়েছিল অধিবেশনে। এলাহাবাদের খ্যাতনামা আইনজীবী ‘মতিলাল নেহরু’ সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন। আর দ্বিতীয় সমর্থন দিয়েছিলেন তাঁরই ছেলে ‘জওহরলাল’। ‘ইনার টেম্পল ব্রিটিশ কলেজ’ থেকে আইন পাশ করে আসা জওহরলাল তখনও কট্টরপন্থায় আকৃষ্ট ছিলেন। আর অন্যদিকে গান্ধীজির প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছিলেন তিনজন – ‘মহম্মদ আলি জিন্না’, ‘মদনমোহন মালব্য’ এবং ‘অ্যানি বেসান্ত’। সারাদিন ধরে পক্ষে-বিপক্ষে প্রবল বক্তৃতা চলেছিল। দিনের শেষে ভোটাভুটি হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল গান্ধীজির প্রস্তাব জয়ী হয়েছে সংখ্যার বিচারে। ‘১৮৫৫টি ভোট’ পড়েছিল প্রস্তাবের ‘সমর্থনে’, আর ‘বিপক্ষে’ ভোটের সংখ্যা ছিল ‘৮৭৩’। কিছু কিছু রাজ্যে অসহযোগের পক্ষে সমর্থন ছিল একতরফা। যেমন – ‘সংযুক্ত প্রদেশ’, সেখানে পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৫৯, আর বিপক্ষে মাত্র ২৮। ‘মাদ্রাজ’ আর ‘বেঙ্গলে’ সবথেকে ‘টাফ ফাইট’ হয়েছিল। বেঙ্গলে গান্ধীজির ওই অসহযোগের পক্ষে ভোট পড়েছিল ৫৫১, বিপক্ষে ৩৯৫। মাদ্রাজে পক্ষে-বিপক্ষের অনুপাত ছিল ১৬১ ও ১৩৫। সুতরাং ব্যাপারটা এরকমই দাঁড়ায় যে, সংখ্যার বিচারে ‘অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব’ জয়ী হলেও, পাশ করানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছিল। কারণ বোঝাই যাচ্ছে, বহু কংগ্রেসি প্রতিনিধি এই আন্দোলনে সায় দেননি। তাই সকলকে বোঝাতে হবে, এই যুক্তি দিয়ে তথ্য দিয়ে, পক্ষপাতহীন হয়ে – তিনমাস পর ‘নাগপুরে বার্ষিক অধিবেশনে’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে বলে স্থির হয়েছিল। ততদিন ধরে গোটা দেশের কংগ্রেসের মধ্যে এই বিষয়টি বোঝানোর দায়িত্ব দুজনকে দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা ছিলেন – ‘বিপিনচন্দ্র পাল’ এবং ‘চিত্তরঞ্জন দাশ’। ‘বিপিনচন্দ্র পাল’ তখন সিনিয়র কংগ্রেসি নেতা। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাসকে এই দায়িত্বে সংযুক্ত করার কারণ ছিল তাঁর ‘অসামান্য আইনজ্ঞান’ ও ‘বাগ্মিতা’। পাশাপাশি তিনি ছিলেন ‘পক্ষপাতহীন জাতীয়তাবাদী’। গান্ধীজি বুঝে গিয়েছিলেন, এই লোকটিই কংগ্রেসের আগামীদিনের ‘নক্ষত্র’ হবেন। গান্ধীজির প্রস্তাবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনিই সবথেকে দায়িত্বশীল।
ঠিক দু’বছর পর গোটা চিত্রটাই বদলে গিয়েছিল। ততদিনে অসহযোগ আন্দোলনের কারণে কংগ্রেসের নেতৃবর্গ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন; গান্ধীজি তো বটেই, সাথে চিত্তরঞ্জন দাস’ও। ১৯২২ সালে ‘গয়া’য় আহ্বান করা হয়েছিল কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন। সেখানে চিত্তরঞ্জন দাস হয়েছিলেন ‘সভাপতি’। সভায় বক্তৃতার শুরুতেই তিনি গান্ধীজি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘এই বিশ্বের দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষটির নাম হল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।’’ একদিকে তিনি একথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রস্তাবটি উপস্থিত সকলকেই হতচকিত করে দিয়েছিল। গান্ধীজির ‘বয়কটের রাজনীতি’কে এবার চিত্তরঞ্জন দাস ‘সমাপ্ত’ করতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মন্টেগু চেমসফোর্ড স্কিমে’ গঠিত ‘লেজিসলেটিভ কাউন্সিল’কে বয়কট করে লাভ হচ্ছে না। আমাদের উচিত কাউন্সিলে অংশ নিয়ে ভিতরে গিয়ে বিরোধিতা করা। কিন্তু ‘গান্ধীজির পথের বিরোধিতা করা’ সেই প্রস্তাবকে কংগ্রেস প্রতিনিধিরা সমর্থন করেন নি। প্রস্তাবটি পরাস্ত হয়েছিল ভোটাভুটিতে। চিত্তরঞ্জন দাস সভাপতির পদ থেকে ‘ইস্তফা’ দিয়েছিলেন এবং গঠন করেছিলেন সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক দল – ‘স্বরাজ্য পার্টি’। যদিও এই দলটি কংগ্রেসের অন্দরেই ‘নতুন উইং’ হিসেবেই ছিল; অর্থাৎ ‘কংগ্রেস পরিত্যাগ’ করা নয়। চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে ওই নতুন ‘স্বরাজ্য পার্টির অংশীদার’ হয়েছিলেন ‘মতিলাল নেহরু’, ‘হাকিম আজমল খান’ এবং ‘বিঠল ভাই প্যাটেল’ (সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দাদা)। আর ‘গান্ধীজির পক্ষে’ রয়ে গিয়েছিলেন অন্য নেতানেত্রীদের মধ্যে ‘সরোজিনী নাইডু’, ‘মৌলানা আব্দুল কালাম আজাদ’ এবং ‘চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি’। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। গান্ধীজিকে বিস্মিত করে চিত্তরঞ্জন দাস গান্ধীজির একের পর এক অনুগামীকে নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর তার পরিণাম পাওয়া গিয়েছিল এক বছরের মধ্যেই। চিত্তরঞ্জন দাশের সেই ‘কাউন্সিলে প্রবেশ করার প্রস্তাব’ই জয়ী হয়ে গিয়েছিল ‘এআইসিসি অধিবেশনে’। চিত্তরঞ্জন দাস কতটা ‘দূরদ্রষ্টা’ ছিলেন, তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ‘সংযুক্ত প্রদেশ’ এবং ‘বেঙ্গলে’, ‘স্বরাজ্য পার্টি’ লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনে বিপুল সাফল্য লাভ করেছিল। ১৯২৪ সালে ‘কলকাতা পুরসভা’ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল ওই দল। জনপ্রিয়তার নিরিখে নির্বাচিত প্রথম কলকাতার ‘মেয়র’ হয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস।
গান্ধীজি আবার বুঝে গিয়েছিলেন, চিত্তরঞ্জন দাস শুধুই বাংলার নয়, দেশের কংগ্রেসিদের কাছেও এক ‘আকর্ষণীয় তারকা’। তাঁর সেই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল আবার অন্য এক প্রস্তাবে। গান্ধীজি ১৯২৪ সালে হঠাৎ প্রস্তাব এনেছিলেন কংগ্রেসের প্রত্যেক নেতাকর্মী পদাধিকারীকে দিনের মধ্যে অন্তত আধ ঘন্টা হলেও ‘চরকা কেটে সুতো বয়ন’ করতেই হবে। ‘অল ইন্ডিয়া খাদি বোর্ড’কে প্রতি মাসে অন্তত ২ কেজি করে সুতো পাঠাতেই হবে। এই প্রস্তাবটি জয়ী হয়েছিল, কিন্তু একেবারেই নগণ্য মার্জিনে। গান্ধীজির পক্ষে ভোট পড়েছিল ৭৮ আর বিপক্ষে ৭০। নির্বাচনের পরিভাষায় ‘নেক টু নেক’। বিপক্ষীয়দের নেতা কে ছিলেন? চিত্তরঞ্জন দাস। নীতিগতভাবে এই প্রস্তাবকে স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারেননি চিত্তরঞ্জন দাস। কিন্তু তাই বলে কি গান্ধীজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল? একবারও নয়। বরং ঠিক পরের বছর চিত্তরঞ্জন দাসের আমন্ত্রণে গান্ধীজি ‘দার্জিলিঙে’ এসেছিলেন। সেখানে চিত্তরঞ্জনের ‘গ্রীষ্মাবকাশের’ একটি বাড়ি ছিল। স্রেফ গান্ধীজি আসছেন এবং দিন সাতেক থাকবেন, এই কারণেই চিত্তরঞ্জন দাস সমতল থেকে ‘সাতটি ছাগল’ আনিয়েছিলেন। কারণ গান্ধীজির ‘অভ্যাস’ ছিল ছাগলের দুগ্ধ পান করা। ওই পাঁচদিন ‘রাষ্ট্রগঠন’, ‘ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল দু’জনের। একটি বিস্তৃত প্ল্যানও হয়েছিল যা নিয়ে অগ্রসর হওয়া যাবে বলে স্থির হয়েছিল। পাশাপাশি চিত্তরঞ্জন দাস গান্ধীজির থেকে ‘চরকা কেটে সুতো তৈরি’র ব্যাপারটাও শিখে নিতে চেয়েছিলেন। গান্ধীজি নিয়ম করে প্রতিদিন শিখিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই চরকা কাটার প্রক্রিয়া দেখে গান্ধীজি পরে হাস্যচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘‘চিত্তরঞ্জন যেভাবে চরকা কাটতেন তা দেখে বোধ হয়েছে সেটা তাঁর কাছে ছিল ব্রিটিশ সরকারকে পরাস্ত করা কিংবা কোনও মামলায় জয়ী হওয়ার থেকেও কঠিন কাজ।’’ গান্ধীজি ফিরে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে দার্জিলিঙেই অকস্মাৎ মৃত্যু হয়েছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের।
১৮৭০-এর ৫ই নভেম্বর ঢাকা বিক্রমপুর-বাসী পরিবারে চিত্তরঞ্জনের জন্ম হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্র, আইসিএস পরীক্ষায় দু’বার অকৃতকার্য, মিডল টেম্পল থেকে ব্যারিস্টারি পাশ চিত্তরঞ্জন সক্রিয় রাজনীতি করেছিলেন মাত্র নয় বছর – ১৯১৭ থেকে ১৯২৫। তবে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিল অনেক আগে, বিলেতে ‘দাদাভাই নওরোজির নির্বাচনী প্রচারে’। স্বদেশি যুগে তাঁর ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠায় অবদান এবং স্বদেশি নেতৃবৃন্দ ‘বিপিনচন্দ্র পাল’, ‘ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়’ ও ‘অরবিন্দ ঘোষের’ রাজনৈতিক মামলায় আদালতি নৈপুণ্যের জন্য খ্যাতি। ১৯০৯ সালের ‘আলিপুর বোমা মামলায়’ চিত্তরঞ্জন অরবিন্দকে যে ভাষায় নন্দিত করেছিলেন – ‘‘দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, মানবিকতার প্রেমিক’’ – তিনি সে দিন হয়তো বুঝতে পারেননি যে ঠিক এই কথাগুলিই তাঁর নিজের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য হয়ে উঠবে, এই ভাবেই পরবর্তী কালের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে। বাস্তবিক, আজাদির সুমহৎ আদর্শের জন্য দেশবন্ধু যে ভাবে ত্যাগ ও দুঃখ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন, তা আজ প্রায় কিংবদন্তিতে পরিণত।
১৯১৭ সালের এপ্রিলে কলকাতার ভবানীপুরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক অধিবেশনে সভাপতি রূপে চিত্তরঞ্জনের সরাসরি রাজনৈতিক আত্মপ্রকাশ। সে বছর ‘মডার্ন রিভিউ’-তে রবীন্দ্রনাথের নেশন-বিরোধী বক্তৃতার বয়ান পড়ে চিত্তরঞ্জন প্রথম দিকে বিচলিত হয়েছিলেন। পরে তিনি কবির নেশন-চিন্তার মর্ম উপলব্ধি করে খানিকটা গ্রহণ করেছিলেন। চিত্তরঞ্জন স্বীকার করেছিলেন যে, ‘‘জাতীয়তাবাদকে চরমে নিয়ে গেলে যে বাড়াবাড়ি ঘটে, তারই পরিণাম’’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে মর্যাদা দিতে হবে। কিন্তু তিনি এও মনে করতেন যে ভবিষ্যতে বিশ্বমানবতার এমন একটা যুগ আসবে যখন ‘‘বিশ্বমণ্ডলের জন্য রাজারাজড়াদের মতই নেশন ও জাতীয়তারও আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না।’’ আজকের দিনে জাতীয়তাবাদ শব্দটাকে যখন উত্তরোত্তর লঘু আর সারহীন করে ফেলা হচ্ছে, তখন তাঁদের এই সব ভাবনা মনে করার গুরুত্ব বিরাট।
১৯২০ সালে উচ্চ আদালতে রাজকীয় টাকার অঙ্কের প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে গান্ধীজির ‘অসহযোগ’ ও ‘খিলাফত আন্দোলনে’ ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশবন্ধু। ১৯২১ সালে ঘটে একটা ঘটনা, বাংলার পরবর্তী ইতিহাসে যার গুরুত্ব অনেক। ‘আইসিএস’ ত্যাগ করে সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতায় দেশবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁর অসামান্য উদারতায় মুগ্ধ হয়ে সুভাষচন্দ্র ‘‘এক জন নেতাকে খুঁজে পেলেন’’ এবং ‘‘এঁরই পদানুসারী হবেন’’ বলে সংকল্প করলেন। দেশবন্ধুর সহধর্মিণী ও সুভাষচন্দ্রের মাতৃসমা ‘বাসন্তী দেবী’র গ্রেফতারের ফলে অসহযোগ আন্দোলনে নতুন জোয়ার এল। ১৯২১-এর ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন ও সুভাষচন্দ্র একই সঙ্গে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন।
গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর দেশবন্ধু ‘স্বরাজ দল’ গঠন করলেন। ১৯২৩ সালের ‘বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনে’ হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সমর্থনপুষ্ট স্বরাজীরা খুব ভাল ফল করল। দেশবন্ধু দু’বার মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন এবং ইংরেজদের মদতে গড়া ‘ডায়ার্কি’ প্রথার সাম্রাজ্যবাদী দ্বিচারিতা প্রকাশ্যে আনলেন। ১৯২৪ সালে ‘স্বরাজ দল’ কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয়ী হল। দেশবন্ধু ‘কলকাতার মেয়র পদে’ অধিষ্ঠিত হলেন। ‘ডেপুটি মেয়র’ হিসেবে তিনি বেছে নিলেন ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’কে। ‘শরৎচন্দ্র বসু’ ‘অল্ডারম্যান’ হলেন, আর ‘সুভাষচন্দ্র’কে দেশবন্ধু ‘চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার’ নিয়োগ করলেন।
এই সময় হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সুষম ক্ষমতা বণ্টনের লক্ষ্যে দেশবন্ধু একটি ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর নেতার সেই চুক্তি কার্যকর করতে শুরু করলেন। বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি ন্যায়বিচারের একটি দৃষ্টান্ত দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্র স্থাপন করলেন। ইংরেজ সরকার সুভাষচন্দ্রকে বন্দি করে মান্দালয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল। ক্ষিপ্ত চিত্তরঞ্জন দাস বলেছিলেন – ‘‘দেশকে ভালবাসা যদি অপরাধ হয়, তা হলে আমিও অপরাধী। সুভাষচন্দ্র বসু যদি অপরাধী হন, তবে আমিও অপরাধী।’’
‘আইনজীবী’ হিসেবে কেমন ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস? ১৯০৮ সালে ‘আলিপুর বোমা মামলা’য় অরবিন্দ ঘোষের হয়ে আদালতে সওয়াল করা চিত্তরঞ্জন দাসের ওজস্বী বক্তব্যগুলি গোটা দেশের পত্রপত্রিকায় ভূয়সী প্রশংসা পায়। ‘আলিপুর বোমা মামলা’র অভিযুক্ত ‘বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ’ সম্পর্কে আদালতে কোনও নরম বাক্য ব্যবহার করে জুরিদের মন জয় করার চেষ্টাই করেননি তিনি। উল্টে ‘অরবিন্দ ঘোষ’ সম্পর্কে বলেছিলেন – ‘‘He will be looked upon as the poet of patriotism, as the prophet of nationalism and the lover of humanity. His words will be echoed and reechoed …’’
চিত্তরঞ্জন দাস বস্তুতঃ এক আদর্শ বাঙালি রোলমডেল ছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। এতটাই যে, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যেও তিনি আচমকা ‘ব্রাউনিংয়ের কবিতা’ থেকে রেফারেন্স দিতেন। তাঁর চরিত্রের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। পরিবারকে না জানিয়ে এক আত্মীয়কে ঋণের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি চরম অর্থসঙ্কটের মধ্যেও একবার ১০ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন ৯ শতাংশ সুদে। আত্মীয়কে ঋণের জাল থেকে মুক্ত করেছিলেন নিজে ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে। নির্দিষ্ট সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন ঋণদাতা ওই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর নতুন চুক্তি করতে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে এসেছিলেন, তখন কিন্তু তাঁর সেই আত্মীয় বিপুল ধনীতে পরিণত হয়েছেন। চিত্তরঞ্জন দাস বলতেই পারতেন – ‘ও হে, তুমি এবার তোমার ঋণের বোঝা নিজের স্কন্ধে নিয়ে আমাকে মুক্তি দাও’; তা কিন্তু বললেন না। তিনি হাসিমুখে আবার সেই ঋণ পরিশোধের কাগজে দস্তখত করলেন। চিত্তরঞ্জন দাস অনুজ সহকর্মীদের বলতেন, ‘‘তোমরা আসলে মনে করো আমাকে সকলে ঠকিয়ে যায় এবং আমি কিছুই বুঝি না, তাই না! আমাকে বোকা ভাবে সকলে। কিন্তু জানো তো, আমি সব বুঝতে পারি। কিছু বলি না। আমার কাজ দিয়ে যাওয়া, তাই দিয়ে যাই।’’ মাত্র ৫৫ বছর বয়সে অকালমৃত্যু না এলে বাঙালির ভবিষ্যৎ হয়তো অনেকটাই অন্যরকম হতে পারত চিত্তরঞ্জন দাসের হাত ধরে। কারণ তিনি ছিলেন আদ্যন্ত এক বাংলাপ্রেমী জাতীয় নেতা।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্বল্প জীবনে বাঙালিজাতির প্রতি সবচেয়ে মহৎ এবং ‘তাৎপর্যপূর্ণ অবদান’ কী? বাকি সব উপকারকে সরিয়ে রাখলেও অন্তত একটি বিষয়ে তিনি আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছিলেন একটি ‘অগ্নিশিখা’কে। ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে আট মাস তাঁর সঙ্গে একই কারাগারে থাকার সুবাদে ‘এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক’ চিত্তরঞ্জন দাসকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে পারেন। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ৬ মাস একটানা একটি বড় ঘরে একই সেলে সেই যুবক চিত্তরঞ্জনের সান্নিধ্য পেয়ে এতটাই মুগ্ধ হন যে, স্থির করেন এই মানুষটিই তাঁর ‘দীক্ষাগুরু’। দেশবন্ধুর নীতিকেই নিজের আদর্শ হিসেবে হৃদয়ে বপন করেন সেই যুবক। বাঙালিকে স্বদেশে এবং আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন ওই যুবক। আর ওই যুবককে অনুপ্রেরণা দেওয়ার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ চিত্তরঞ্জন দাসের। তিনি প্রকৃতই ‘দেশবন্ধু’। একটা গোটা জাতির আত্মোন্নয়নের জন্য তিনি প্রেরণা দিয়েছিলেন নিজের এক মহাজাগতিক রাজনৈতিক ভক্তকে। তিনি ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’।
চিত্তরঞ্জন দাসের এই চরিত্রটি অনুধাবন করলে স্পষ্ট হয় বাঙালি জাতির প্রকৃত নবজাগরণ যাঁদের হাত ধরে এসেছে এবং যাঁরা বাঙালিকে নিয়ে একটি বিশেষ চরিত্রায়নের স্বপ্ন দেখেছেন, সেই বাঙালি আইকনেরা প্রত্যেকেই এরকমই। তাঁদের চরিত্রটি ছিল – ‘ধর্মমতে উদার’, ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি বোধে পণ্ডিত’, ‘সামাজিক উন্নয়নে একনিষ্ঠ সেনাপতি’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘নারী ও দরিদ্র জাগরণে নিবেদিত প্রাণ’, ‘মনেপ্রাণে বাঙালি’ কিন্তু ‘মননে এক আন্তর্জাতিকতা’।
(তথ্যসূত্র:
১- দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।
২- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে দেশবন্ধু ও দেশনায়ক, ব্রজগোপাল রায়, ত্রিপুরা বাণী প্রকাশনী।
৩- মানুষ চিত্তরঞ্জন, অপর্ণা দেবী, কলিকাতা ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং লিমিটেড।
৪- বাংলায় বিপ্লবী প্রচেষ্টা, হেমচন্দ্র দাস (কানুনগো)।
৫- বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ।
৬- শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু সমগ্র রচনাবলী।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত