১৯৬০-এর দশকের প্রথম ভাগ, বাংলার বামপন্থী রাজনীতিতে সেই সময়টা বড়ই টালমাটাল। সেই টালমাটাল অস্থির সময়ের স্রোতে ভেলার মতন টাল খাচ্ছিল ঋত্বিক ঘটকের জীবন। অজস্র অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে দলের মধ্যে – মোট ‘তেইশটা চার্জ’। পার্টি তাঁর বিরুদ্ধে ‘ওয়ান ম্যান কমিশন’ বসিয়েছিল, ‘কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত’ ছিলেন তার মেম্বার। হওয়ায় পাক খাচ্ছিল একটা খবর – পার্টি তাঁকে ‘এক্সপেলড’ করবে! তাঁর প্রিয় ‘উমানাথদা’, ‘কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’, ‘মমতাজ আহমেদ খান’ সকলে নাকি তাঁর বিরুদ্ধে চার্জের সমর্থন জানিয়েছিলেন! এই অবস্থায় তাঁর ‘লক্ষ্মী’, ‘শ্রীমতী সুরমা ঘটক’ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন – ‘‘কমরেড জ্যোতি বসু তোমার পক্ষে। কিন্তু এই পার্টি, আইপিটিএ, তেইশটা চার্জ কোনও কাজ করতে দেবে না! নতুন দল করো। গ্রুপ থিয়েটার!’’ তখন ‘সংঘাত অনিবার্য।’ এ পক্ষ, ও পক্ষ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ‘জর্জ’ ওদের কথা শুনতেন। এক শনিবার, সন্ধেয় গোপন মিটিং করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে, বলা ভালো পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বসবেন বলে, একদিন সন্ধের তাসের আড্ডা বাতিল করে জর্জ নিজেই ঘরে ডেকেছিলেন বিজন, ঋত্বিকদের। ঋত্বিক হাজির হয়েছিলেন দুপুর তিনটেতেই। অস্থির ভাবে পায়চারি করছিলেন। তিন-চার কাপ চা হয়ে গিয়েছিল। মাথার চুল মুঠো করে ধরছিলেন বার বার। একবার এই মোড়া, একবার ওই মোড়া। শেষে জর্জ আর থাকতে না পেরে বলেছিলেন, ‘‘আঃ! স্থির হইয়া বোসো না।’’ অস্থির ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘সবাই আসবে তো!’’ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘খবর পাইছে হক্কলে, আইবে কিনা কইতে পারি না।’’ উত্তরে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘সেইটাই প্রধান সমস্যা। বুঝলা, কেউ কারও মনের ভিতরটা জানে না।’’ একই কথা বার বার বলতে বলতে মাথা ঝাঁকাচ্ছিলেন ঋত্বিক। মোড়ায় বসে, পা-টা তুলে দিয়েছিলেন খাটের ওপর। শীর্ণ, শিরা-ওঠা পায়ে ছিল কাদার ছোপ। অস্থিরভাবে পায়ের আঙুল নাড়তে নাড়তে বলেই চলেছিলেন, ‘‘ভাঙনের জয়গান, বুঝলে … ভাঙনের জয়গান! আমি একটু পার্কে ঘুরে আসি। মুক্ত বাতাস দরকার। অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু!’’ ঝোলা কাঁধে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ঋত্বিক। জর্জ জানতেন ওই ঝোলায় কী আছে! বলেছিলেন, ‘‘মুক্ত বায়ু, না বোতল-বদ্ধ তরল! আমি সব জানি। আমার ঘরে হেই সব চলবো না। তুমি যাও, পার্কে বইস্যা যা খুশি করো।’’ মিটিং ভন্ডুল হয়ে যায়! বটুক আর বিজন ছাড়া কেউ আসেননি। তাঁরাও ফিরে গিয়েছিলেন এক সময়। জর্জকে অপেক্ষার আঁধার পেয়ে বসেছিল যেন। এমন সময় দরজায় হাজির হয়েছিলেন ঋত্বিক। সাড়ে সাতটার সময় ঋত্বিক ফিরেছিলেন। টালমাটাল পায়ে। কোনওমতে টাল সামলে জর্জকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘মিটিং হইল না? ডিসিশান দাও, দুই বছর এপাশ-ওপাশ ভালো লাগে না। ডিসিশান চাই … কোন পক্ষে যাব, কোন দলে? বলো, বলো?’’ জর্জ এর কী উত্তর দেবেন, জানতেন না। যন্ত্রণায় বুক ফেটে গিয়েছিল তাঁর। মাথা নিচু করে জর্জ চলে যেতে বলেছিলেন ঋত্বিককে। তাঁর গলা কেঁপে উঠেছিল। টাল খেতে খেতে ঋত্বিক চলে গিয়েছিলেন। গলির আলো-অন্ধকারে দীর্ঘ চেহারাটা হারিয়ে গিয়েছিল। ঘাড় কাত করে তাঁর চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে ছিলেন জর্জ। ঋত্বিকের পিছনে পড়ে ছিল কলকাতার ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের জর্জের একলা ঘর। একটু পরে হারমোনিয়ামের সামনে বসেছিলেন জর্জ। গেয়ে উঠেছিলেন শ্রাবণের গান, ‘‘আমার যে দিন, ভেসে গেছে। চোখের জলে, আমার যে দিন …!’’ জর্জ কখনও মদ্যপান পচ্ছন্দ করতেন না। একদিন সন্ধের একটু আগে আবার এসেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। জর্জের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। জর্জ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আসবা না, এখন আসবা না।’’ ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘জর্জদা, টাকা দাও। মোড়ের বাংলার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে।’’ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘কত দেব, দশ টাকা?’’ এই বলে, তিনি দশ টাকা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ঋত্বিকের সে দিকে হুঁশ ছিলনা। কে ছুঁড়ে দিল, তাতে কিছু যায়-আসত না তাঁর। এমন দৃশ্য দু’দিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন জর্জের ভাগ্নি ‘পারমিতা’। শেষে একদিন জর্জ ঋত্বিক কে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে বিরক্ত কোরো না। টাকা নিয়ে চলে যাও।’’ জর্জ ঋত্বিককে খুব ভালোবাসতেন। বলতেন, ‘‘ঋত্বিক মানিকের থেকে অনেক ট্যালেন্টেড। মদ খেয়ে খেয়ে শেষ হল।’’
তখন ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ করছিলেন ঋত্বিক। পরিচিত মহলে বলেছিলেন, ‘‘ছবিতে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত থাকবে। এবং জর্জদাই গাইবেন।’’ ঘনিষ্ঠরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কোন গান ঋত্বিকদা?’’ ঘটকবাবু তো নিজেই জানতেন না, উত্তর দেবেন কী! অবশেষে দিন এসেছিল রেকর্ডিংয়ের। টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োর স্কোরিং থিয়েটারে জর্জ এসেছিলেন। পরনে ছিল মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি। সাদা পাজামা। কাঁধে ঝোলা, মুখে পান। বাঁ দিকে হেলানো মাথা। চশমার ফ্রেমের ভিতর, গহন চাহনিতে, অদ্ভুত এক মায়ারং-আলো খেলা করে যেন প্রতিক্ষণ। ফ্লোরে ঢুকেই ঋত্বিকের পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘‘দ্যাখ ভবা, আমরা ঠিক আইস্যা পড়ছি।’’ ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘‘সব কিছু রেডি আছে জর্জদা। একবার শোনালেই, ফাইনাল টেক হবে।’’ বিধি বাম। হঠাৎ জর্জ বলেছিলেন, ‘‘আমি তো বাবা তোরে আগেই কইসি, গলা খারাপ। আমি গামু না!’’ সে কী! কে গাইবে এ গান? বুঝি চৌচির স্বপ্ন-সংকল্প! জর্জের গলার ওই বিস্তার, মন্দ্র সপ্তকে স্থিতি-গাম্ভীর্য? দিল খোলা মর্জি-গায়ন? ‘‘না। আমি তো তোরে আগেই কইসি। এ বার আমারে ছাইড়া দে। আমার ছাত্র সুশীল গাইব!’’ বার বার অনুরোধ করেছিলেন ঋত্বিকের। জর্জ শুনতে চাননি কিছুতেই। শেষে, ঋত্বিকের প্রায় কাকুতি মিনতি করে বলেছিলেন – ‘‘প্লিজ জর্জদা, প্লিজ এটা করবেন না। এ গান, ছবির যে সিচুয়েশন, আপনি না গাইলে হবে না! প্লিজ!’’ জর্জ তবুও অনড় ছিলেন। মেঝের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে তাঁর নির্লিপ্ত ভঙ্গি ছিল। সে দিন স্টুডিয়োতে ছিলেন ‘তুষার তালুকদার’। পরে যিনি ‘পুলিশ কমিশনার’ হয়েছিলেন। ‘উন্মুক্ত ব্রাত্যজন’ তথ্যচিত্রে তাঁর সে দিনের স্মৃতি এরকম – ‘‘ঋত্বিকদা কারও কাছে কাকুতি মিনতি করার লোক নন। বরং ওনার মর্জি মতো ব্যাপারটা না ঘটলে, ভীষণ রেগে গিয়ে এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করতেন, সেটা না বলা ভাল। কিন্তু, এই ব্যতিক্রম দেখলাম জর্জদার ক্ষেত্রে। এবং সেটা জর্জদার ক্ষেত্রেই সম্ভব। আলটিমেটলি একটা সমঝোতা হল যে, গানটা শুরু করবেন জর্জদা। ফলো করবেন সুশীল।’’ রেকর্ডিং হয়েছিল। জর্জ গেয়েছিলেন। সঙ্গে তাঁর ছাত্র ‘সুশীল মল্লিক’। রবীন্দ্রনাথের পঁচিশ বছর বয়সে লেখা গান। কাফি রাগে। ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’। ছবিতে অভিমানী জর্জের গায়ন আর এলোমেলো যাপনের ঋত্বিকের ক্লোজআপ ফ্রেম মিলেমিশে হয়েছিল একাকার। বাকিটা সেলুলয়েডের কিংবদন্তি।
শেষে ছিয়াত্তরে ঋত্বিক চলে গিয়েছিলেন। এমন হুট করে তাঁর চলে যাওয়া কিছুতেই মানতে পারেননি জর্জ। সে সময়ের একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘ঋত্বিক ও বিজন তো আত্মহত্যা করল … এ বার বোধহয় আমার পালা।’’ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঋত্বিকের শোকসভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিল। তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন জর্জ। বলেছিলেন – ‘‘ক্যান যামু, হারামজাদাটা না বইল্যা কইয়া চইল্যা গ্যালো, যামু ক্যান আমি, আপনারা মাফ করেন আমারে!’’
কোন এক সময় অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের পাড়াতেই থাকতেন ‘ঋত্বিক ঘটক’। এক-আধ দিন চলে আসতেন অনিলের বাড়িতে। ঋত্বিক ঘটকের প্রতি অনিলের ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা! অনিল বলতেন, ‘‘লোকে ওর মদ খাওয়াটাই শুধু দেখে, ঋত্বিকদা যে কতটা টেকনিক্যালি সাউন্ড!’’ তবে ঋত্বিকদার ওপর একদিন অনিল প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন। সেদিন বসার ঘরে আড্ডা দিচ্ছিলেন তাঁরা। হঠাৎ অনিলের স্ত্রী অনুভা চট্টোপাধ্যায় শুনতে পেয়েছিলেন অনিলের চিৎকার, ‘‘আপনি নিজেই নিজেকে শেষ করবেন!’’ কী হয়েছিল কে জানে!
ঠিক কতবার কতজনের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন ঋত্বিক? কেউ জানেন না – কারণ সংখ্যাটা কারও জানা নেই। তালিকায় উৎপল দত্তের মতন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তির নামও আছে। কারণ – ঐ একটাই – তাঁর নেশা! কিন্তু নেশা দিয়ে তো তাঁর কাজের পরিমাপ করা যায় না। ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘‘ঋত্বিক মনে-প্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল – আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং সেইটেই তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য।’’
৯ই আগস্ট ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটকের স্মরণে কবি, লেখক, পরিচালক ও সংগীতকার ‘গুলজার’ লিখেছিলেন, ‘‘দে খলেই মনে হবে এক জন গ্রিক মাস্টার সামনে দাঁড়িয়ে। খুব লম্বা, উসকোখুসকো চুল, পাঞ্জাবির ওপর বোতাম-খোলা খাদির জ্যাকেট, কাঁধে একটা ঝোলা, আর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ – যেন এই বার অলৌকিক কোনও আখ্যান শুরু হবে। ঋত্বিকদার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা বিমলদা মারফত। ঋত্বিকদার বড়দাদা আবার ছিলেন বিমলদার প্রোডাকশন হেড। এক দিন আমায় ডেকে বললেন, ‘শোনো, তুমি ওঁর কাছ থেকে গল্পটা শুনে লিখে নাও আর নোট্স নিয়ে নাও। পরে এটার ওপর একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে।’ আমি আর ঋত্বিকদা বসে গেলাম। এর পর এই রকম বসা বহু বার হয়েছে, কিন্তু তা থেকে কোনও দিন কোনও সিনেমা তৈরি হয়নি। পরে জেনেছিলাম, কোনও বাঙালির প্রয়োজনে বিমলদা তাঁকে খালি হাতে ফেরান না। কিন্তু ঋত্বিকদাকে কোনও কাজ ছাড়া সাহায্য করাটা যে ঋত্বিকদার সম্মানে এবং মনে বড় লাগবে, সে কথা বিমলদার মাথায় থাকত। তাই দু’পক্ষের মন ও সম্মানের আশ্চর্য দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষী হয়েছিলাম আমি। এর পর অবশ্য মাইডিয়ার হিসেবে ঋত্বিকদাকে চিনতে আরম্ভ করি অভীদা, মানে অভিনেতা অভী ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সেখানে রোজ সন্ধেবেলায় একটা জমাটি আড্ডা বসত। তখনকার বম্বে-বাঙালিদের দু’জায়গায় একদম নিশ্চিত করে পাওয়া যেত। এক, কাজের জায়গা – বিমল রায় প্রোডাকশন্স। কারণ, বিমলদা বড়লোক প্রোডিউসার ছিলেন। সবাইকে নাইয়ে-খাইয়ে রাখতেন। আমাকেও। আমি তো কনভার্টেড বাঙালি। আর দুই, অভীদার বাড়িতে, সেখানে সবাই আড্ডা দিতে যেত। অভীদার বাড়িতেই আমি প্রথম ‘জতুগৃহ’ পড়েছিলাম, বাংলায়।
সেই আড্ডায় রোজ আমরা একটা করে নতুন সিনেমা বানাতাম, কাস্ট ঠিক হত, বাজেট হত, স্ক্রিপ্ট কে করবে – সব ঠিক হত। পরের দিন যথারীতি ভেস্তে যেত। আবার একটা নতুন সিনেমা তৈরি হত। অন্য রকমের নতুন সিনেমা। যখনই মিউজিক ডিরেকশনের কথা উঠত, আমরা বলে উঠতাম, ‘ওই তো, সলিলদাই তো করবে, আবার কে?’ ঋত্বিকদা তাঁর প্রাণের বন্ধু সম্পর্কে বলে উঠতেন, ‘কী! সলিল মিউজিক দেবে? কোথায় মাল খেয়ে উলটে পড়ে থাকবে!’ আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতাম, মনে মনে বলতাম, ‘ঋত্বিকদা এই কমেন্ট করছে!’ আর তার পর একটা বিরাট হাসির রোল উঠত। আর সবাই মিলে তখন ঋত্বিকদার পেছনে লাগা হত। ঋত্বিকদার ছবির সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল। আমি এখনও ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় সুপ্রিয়ার চটি ছিঁড়ে যাওয়ার সিনটা ভুলতে পারি না, কিংবা যে বিশাল গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে অনিলদা বন্দিশ গাইছিলেন, সেই দৃশ্যটা। ওই গাছটা চুজ করাই একটা মাস্টারের কাজ। ওই বিশালত্ব, ওই রাজকীয় ব্যাপারটা ওই সিনটাকে একেবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। ঋত্বিকদাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, ওই গাছটার মতো মনে হয়েছিল আমার। খুব আলুথালু রাজকীয়। কিন্তু আমার মোহ ভাঙল ‘সুবর্ণরেখা’ দেখে। একটা-দুটো দৃশ্য এত মেলোড্রামাটিক যে আমার পছন্দ হয়নি। হয়তো ঋত্বিকদার অনেক কিছুই আমার পছন্দ ছিল না। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ডিন থাকাকালীন উনি যে ভাবে নিজেকে কনডাক্ট করেছিলেন, তা-ও আমার পছন্দ ছিল না। সেখানে ছাত্রদের সঙ্গে একটা ফারাক রাখার দরকার ছিল বলে আমার মনে হয়। এতটা বোহেমিয়ানিজ্ম ধারণ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। শিষ্যরা যদি অন্ধের মতো ফলো করে, সেটা শিষ্যদের পক্ষে সব সময় শুভ হয় না, সেখানে একটা দায়িত্ব থাকা দরকার ছিল। কোথাও যেন ডিসিপ্লিনের ভারী অভাব ছিল। আর ওঁর যা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল, নিজেকে একটু ঠিক ভাবে চালনা করলে শিল্প হয়তো আরও সমৃদ্ধ হতে পারত। আবার ভেবেছি, ঋত্বিকদা যদি ডিসিপ্লিন্ড আর প্রথাগত ‘প্রপার’ হতেন, তা হলে ঋত্বিকদা হতেন না। অন্য মানুষ হতেন। তিনি ওই একটা রকম ভাবেই বাঁচতে পারতেন, শিল্প করতে পারতেন। ওটা তাঁর ঘরানা, তাঁর যাপন। সেটা তাঁর সিনেমায় প্রতিফলিত। ঋত্বিকদার নিয়মছাড়া ভাব হয়তো কিছুটা জেনেটিকও। ওঁর আরও দুই ভাইকেও আমি খুব ভাল ভাবেই চিনতাম। তাঁদের মধ্যেও এই খামখেয়ালিপনা বা একসেনট্রিক ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করেছি। কিন্তু শিল্পের মানচিত্র তো হরেক রকম প্রতিভা দিয়ে তৈরি। কিছু মানুষ থাকবেনই, যাঁরা ছন্নছাড়া, উদ্দাম প্রতিভাধর, উল্কার মতো – স্বল্পকালীন। সেই সব মানুষকে তাঁদের মতো করেই গ্রহণ করতে শিখতে হবে। অনেক বছর পর মুম্বইয়ের খার স্টেশনের কাছে ঋত্বিকদার সঙ্গে দেখা। সব সময়ই ওই স্টেশনের কাছে একটা লজে উঠতেন। সেই না-আঁচড়ানো উসকোখুসকো চুল, না-কামানো দাড়ি, খাদির জ্যাকেট, একই রকম রাজকীয়, কেবল চেহারা একটু ভেঙেছে, জৌলুস একটু কমেছে, এই যা। দেখা হতেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। গালে আলতো একটা থাপ্পড় মেরে বললেন, ‘তুই কী এমন করেছিস রে, যে এত নাম হয়েছে তোর!’ এ কথা বলাটা ওঁরই সাজে। সেই কবে থেকে আর কত কাছ থেকে দেখেছেন তো এই ছোকরাকে! কিন্তু অত বড় হাতের চেটো, তার থাপ্পড় যত আলতোই হোক, তা হজম করার কলজে থাকতে হবে। আমার তো মনে হয়, আমার সেই কলজে ছিল বইকী! আ স্মল টোকেন অব লাভ ফ্রম আ গ্রিক মাস্টার!’’
আত্মধ্বংসী কিছু প্রবণতা ছিল ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে। এই সব নিয়ে গালগল্পও কম হয়নি! একান্ত নিজস্ব এক সিনেমা ভাষা ছিল ঋত্বিকের। ঋত্বিকের ছবি দেখলে মনে হয়, হলিউড বলে যেন কখনও কিছু ছিল না! নাটকীয় সংলাপ, চরিত্রদের মঞ্চ-নাটকীয় শরীরী ভাষা, উচ্চকিত অভিনয়, আপতিক ঘটনার অতিব্যবহার, এসব বৈশিষ্ট্য ওঁর ওপর গণনাট্যের দিনগুলির প্রভাব ছাড়াও যা তুলে ধরে, তা হচ্ছে, পশ্চিমী সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন ঋত্বিক। আবার একই সঙ্গে ইউরো-মার্কিন সিনেমার সর্বশেষ চালচলন সম্পর্কে ঋত্বিকের মতো ওয়াকিবহাল পরিচালকই বা ভারতে ক’জন ছিলেন! ঋত্বিক ঘটক যখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তখন এ ব্যাপারে কুমার সাহনি, মণি কল বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের কাছ থেকে শোনা নানা কথা সেই সাক্ষ্য দেয়। পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষাকে পরিহার করা তাই অজ্ঞতাপ্রসূত কিছু ছিল না। ঋত্বিকের দিক থেকে তা ছিল এক সচেতন প্রয়াসই। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উত্তর-উপনিবেশ বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেন, ঋত্বিকের সিনেমা-শৈলীতে চিন্তার অনেক খোরাকই তাঁরা পাবেন। একটা প্রতিতুলনা টানা যায়। কুরোসাওয়া জাপানি, আবার আন্তর্জাতিকও। কিন্তু ওজু একান্তই জাপানি। ওজুকে সঠিক ভাবে বুঝতে জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। ঋত্বিক ঘটকও যেন তেমনই আমাদের একান্তই বাঙালি এক শিল্পী যাঁর বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, বাংলা ভাষার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী নাটকীয় সংলাপ, বাংলা মঞ্চ-নাটকের ধারায় উচ্চকিত অভিনয়রীতি, এমন কী ওজুর লো ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মতো নিজের আলাদা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল – ঋত্বিকের ছবির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের শটগুলো স্মরণ করুন, এ সবই এক বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার প্রকাশ। তাই ঋত্বিকের শিল্পউৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়, সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলির মাঝে। খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মাকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বার বার। মার্কসবাদের পাশাপাশি ইয়ুং-এর যৌথ নিশ্চেতনার ধারণাও ততদিনে ঋত্বিকের বিশ্ববীক্ষায় গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। সেই আদিমাতার আবার দুই রূপ। কখনও দেখি তার কল্যাণী জগদ্ধাত্রী রূপ— ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, কখনও বা ধ্বংসের কালী – ‘সুবর্ণরেখা’। নারীকে রক্ত-মাংসের মানুষ হিসেবে না দেখে পুরাণের চরিত্রের প্রতীক হিসেবে দেখবার যে প্রবণতা, যা অনেকটাই পুরুষ-কল্পনা, তাতে পুরুষের ইচ্ছাপূরণ ও পিতৃতন্ত্রের আয়ু বাড়ে বটে, কিন্তু নারীর দৈনন্দিন বেদনার বারমাস্যা তাতে কিছু কমে না। ঋত্বিক আদিমাতার রূপকে নারীর পৌরাণিকীকরণ ঘটিয়েছেন বটে, তবে ঋত্বিকই আবার সেই শিল্পী যিনি সবচেয়ে সার্থক ভাবে দেশভাগ পরবর্তী নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি নারীর তীব্র ও কঠোর জীবনসংগ্রামটাকে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। একজন ঋত্বিক ঘটকের পক্ষেই সম্ভব ছিল ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতা চরিত্রটিকে পর্দায় ওই রকম জীবন্ত ভাবে তুলে আনা। সেই সংবেদ ও প্রখর বাস্তববোধ ওঁর ছিল। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে বাঙালি নারীর যে প্রতি দিনের সংগ্রাম, ঋত্বিকের ছবিগুলি থেকে তা পাওয়া যায়। দেশভাগের বেদনার ভাষা কি আজও তৈরি হয়েছে? তবে ঋত্বিকের ছবি নিঃসন্দেহে বিষাদের সেই অতলান্ত গভীরতাকে ছুঁতে পেরেছে অনেক বারই। নিজে যন্ত্রণায় আকীর্ণ নীলকণ্ঠ এক একক শিল্পী হয়েও সমষ্টির প্রতিবাদী চেতনার প্রতি আস্থাটা ঋত্বিক অবিচল রেখেছিলেন আজীবন। ‘সুবর্ণরেখা’-তে জন্মভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘নবজীবন কলোনী’। সে যৌথতার আদর্শ থেকে নিজের একক সুখের অন্বেষায় চলে যাওয়া ঈশ্বর চরিত্রটার করুণ পরিণতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তার নতুন বাড়ির সন্ধান, মানব জীবনের গোটা চক্রটাকেই যেন ধারণ করলেন ঋত্বিক। পালানোর পথ নেই। লড়াই করেই বাঁচতে হবে। অভিজ্ঞতার উপলব্ধি অপাপবিদ্ধ মননের কাছে কখনওই ধরা দেয় না। দেশভাগের আদিপাপের উপলব্ধি যখন সকল বাঙালির চেতনাকে স্পর্শ করবে, ঋত্বিক ঘটক নামের এই অসামান্য সিনেমা-শিল্পীর আজন্ম এষণা সেদিন সার্থক হবে।
ঋত্বিকের সিনেমা, গল্প, ইন্টারভিউ, চিঠিগুলি না-জানা থাকলে রস পাওয়া দুষ্কর। ইন্টারভিউতে ঋত্বিক বলেছিলেন, ‘সিনেমার প্রেমে আমি পড়ে নেই, মশাই। আমি গল্প লিখতাম। দেখলাম, গল্পের থেকে নাটকে আরও বেশি লোককে অ্যারাউজ করা যায়। তার পর দেখলাম, নাটকের থেকে সিনেমা আরও শক্তিশালী। যে দিন আরও শক্তিশালী মাধ্যম বেরোবে, সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’ ১৯৭১ সালে স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক পি সি জোশীর কথা, “আমাকে বলেছে, ঋত্বিক, ইউ আর দ্য ওনলি পিপল্স আর্টিস্ট।” ছবিতে সযত্নে বুনে দেওয়া হয়েছে এই সব উক্তি। যাঁরা ঋত্বিক দেখেননি, কী ভাবে বুঝবেন এই অনুষঙ্গ? উত্তর একটাই। বুঝলে বুঝবেন, না বুঝলে বুঝবেন না। বোর্হেসের গল্প বা উমবের্তো একোর উপন্যাসেও অনেক ক্রস-রেফারেন্স থাকে, ধৈর্য নিয়ে পড়তে হয়। আর পাঁচজন বাঙালির মতো প্রেমের কবিতা দিয়েই ঋত্বিকের লেখালিখির হাতেখড়ি। প্রথম গল্প বের হয় ‘গল্পভারতী’তে। সেটা ১৯৪৭ সাল। আর সে বছরই ‘অভিধারা’ নামে একটি কাগজ বের করলেন তিনি। পর পর গল্প লেখেন সেই নিজের কাগজেই। নাটক-উপন্যাস লিখলেন আরও পরে। সে সময় তাঁর গল্প প্রকাশ হয় ‘দেশ’, ‘অগ্রণী’, ‘শনিবারের চিঠি’-তে। তাঁর নিজের দাবি, ৫০টি গল্প লিখেছিলেন। তারমধ্যে উল্লেখ্য ‘চোখ’, ‘কমরেড’, ‘গাছ’, ‘অয়নান্ত’, ‘আকাশগঙ্গা’ প্রভৃতি। বেশিরভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের কথা। আছে প্রেমও। কোনও কোনও গল্প নিছক কবিতাও। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘চারপাশে যে সমস্ত খারাপ বদমাইশি অত্যাচার ইত্যাদি দেখেছি তার রাজনৈতিক জীব হিসাবে সোচ্চার প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থেকেই গল্প লেখায় আরজ্ এসেছিল সেই ছোট বয়সেই।’’ আর কাঁচা বয়সের গল্প পড়েই নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ঋত্বিককে ‘শক্তিমান নবীন লেখক’ বলেন।
চলচ্চিত্রকার হিসেবে বিশ্বনন্দিত হলেও ঋত্বিক কুমার ঘটকের (১৯২৫-৭৬) সৃজনকর্মের উন্মেষ মূলত নাট্যকর্মী হিসেবে। নিজে নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন, এমনকি অভিনয়ও করেছেন। আত্মপ্রকাশ তথা বেশি মানুষের পৌঁছাবার সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম হিসেবেই তিনি সিনেমা জগতে এসেছিলেন। এর চেয়ে জোরালো মাধ্যম পেলে তাকেই তিনি মান্য করতেন, এমন দৃপ্ত ঘোষণা তিনি করেছেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়, ‘‘আমরা যখন মাঠে ময়দানে নাটক করতাম, তখন চার-পাঁচ হাজার লোক জমা হতো, নাটক করে তাঁদের একসঙ্গে rouse করা যেত। তখন মনে হলো সিনেমার কথা, সিনেমা লাখ লাখ লোককে একসঙ্গে একেবারে মোচড় দিতে পারে। এই ভাবেই আমি সিনেমাতে এসেছি, সিনেমা করব বলে আসিনি।’’ ভবিষ্যতে সিনেমার চেয়ে শ্রেয়তর কোনো মাধ্যমের সন্ধান পেলে সিনেমাকে তিনি লাথি মেরে চলে যাবেন – এমন মন্তব্য তিনি করেছেন তাঁর লেখায়। তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু হয়েছিল অবশ্য গল্পকার হিসেবে। তখনকার অনেক বিখ্যাত সাময়িকপত্রে লেখার সুযোগ পেলেও তিনি মনে করতেন, গল্পের আবেদন পাঠকের কাছে পৌঁছাতে বেশি দেরি হয়; কিন্তু নাট্যাভিনয়ের আবেদন তাৎক্ষণিক, একসঙ্গে বহু মানুষের কাছে তার আবেদন। তাই যৌবনের শুরুতেই তিনি প্রবলভাবে প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, নাট্য-রচনা, নাট্য অনুবাদ তথা পরিচালনা ও অভিনয়ে প্রবলভাবে ব্যস্ত থেকেছেন। অবশ্য সিনেমার দিকে ঝোঁকার কারণে নাট্যকর্মে তেমনভাবে মনোনিবেশ করতে পারেননি, কিন্তু জীবনের সায়াহ্নকাল অবধি নাট্যকর্মে নিয়োজিত হয়েছেন সুযোগ পেলেই।
ঋত্বিক ঘটকের পারিবারিক পরিমণ্ডল তাঁকে নানান সৃজনকর্মে উৎসাহিত করেছে। বালক বয়সেই তাঁর মধ্যে যে প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল, সেই প্রসঙ্গে বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে পড়ার সময়কার স্মৃতি উদ্ধার করে ‘তপতী মুখোপাধ্যায়’ পরে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ‘‘ও সেইসব নাটকে অংশ নিত অতি আগ্রহে। প্রকৃতপক্ষে এসব দিক দিয়ে ও ছিল আমার ডান হাত। তখন থেকেই নিজস্ব ধারায় ও কবিতা লিখত, অভিনয় করত। চন্দ্রগুপ্ত নাটকে (নিজেদের মতো করে লিখে নিতাম) ও সাজত চাণক্য। এ ছাড়া কোনো নাটকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজা। তলোয়ার খেলার দৃশ্য ও খুব ভালোবাসত। আর টিনের তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ আমাদের একটা অবশ্য অঙ্গ ছিল সব নাটকে। বাড়িতে ছাদে টেন্ট খাটিয়ে বা পাড়ার কারো বাগানে নাটক আমাদের চলতই।’’ পরবর্তীকালে রাজশাহীর ছাত্রজীবনে ঋত্বিকের বাঁশি বাজানো, ছবি আঁকা, গল্প লেখা আর অভিনয়ের কথা নানাজনের স্মৃতিকথায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সেই ১৯৪২-৪৩ সালে রাজশাহীর পাবলিক লাইব্রেরিতে তাঁর অভিনয়দীপ্ত অচলায়তন, ডাকঘর, পরিত্রাণ, ফাল্গুনী, বিসর্জন আর রাজা নাটকের কথা জানা যায়। রবীন্দ্রনাটকের মঞ্চায়নে সেই বয়সেই ঋত্বিক তাঁর দক্ষতার যে ছাপ রেখেছিলেন, তা জানা যায় বন্ধু ‘কুমার রায়ের স্মৃতিকথায়’, ‘‘রাজশাহীর দিনগুলো সেই সূচনাপর্বে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় – আমাদের কাছে। রবীন্দ্রনাথের রাজা, পরিত্রাণ দুটি নাটক আমরা করেছি সেখানে। সেই পদ্মা নদী, নদীর বাঁধ, মাছ, নৌকো, সাধারণ মানুষ, আমাদের কলেজের বিশাল মাঠ, মাঠ ঘিরে আলাদা আলাদা বিভাগের কারুকার্য করা লাল রঙের ইমারত এসবই আমাদের সংবেদনশীল মনে এই দেশভাগ, পদ্মা নদী চিরকালের একটা ছাপ ফেলে গেল। এসবের মধ্যে ওর মনটা থিতু হতে পারল না। এই অ-স্থিত মনটাই যেন তার সকল কাজে প্রতীয়মান ছিল।’’ সেই সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর ঋত্বিক একটি আলেখ্য প্রস্তুত করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে ‘কুমার রায়’ লিখেছেন, ‘‘নেতাজির বার্মা আসা পর্যন্ত ছিল স্ক্রিপ্টটিতে। লেখাটির মধ্যে নেতাজি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলেন। অভিনয় সংগীত ধারাভাষ্যপর্ব উল্লেখযোগ্য ছিল।’’ সেই আলেখ্যটি শেষ পর্যন্ত মঞ্চস্থ হয়নি নানা কারণে।
১৯৪৮ সালে কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর কলকাতায় এমএ পড়তে এসে ঋত্বিক ঘটক ‘গণনাট্য সংঘে’ যোগ দেন। সে সময় নাট্যনির্মাণ ও অভিনয়ে তিনি রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সে সময়ে ‘বীরু মুখোপাধ্যায়ের ঢেউ’, ‘পানুপালের ভাঙাবন্দর’, ‘ভোটের ভেট’, ‘রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন’, ‘প্রমথনাথ বিশীর ইন্সপেক্টার জেনারেল’ অবলম্বনে (মূল রচনা ‘গোগোল’) ‘অফিসার’ নাটকে তাঁর অভিনয় স্মরণীয় হয়ে আছে। ‘অফিসার’ নাটকটি নতুন করে লিখেছিলেন। এমনকি ‘কালী বন্দ্যোপাধ্যায়’ বিবাহের কারণে অনুপস্থিত থাকবেন বলে মাত্র দু’দিনের মহড়ায় মূল চরিত্রে তিনি একবার অভিনয়ও করেছিলেন। প্রবল জনপ্রিয়তার কারণে নাটকটি এক মাসে বাহান্নবার অভিনীত হয়েছিল। তবে ‘বিসর্জন’ নাটকে তাঁর ‘রঘুপতি’ চরিত্রে অভিনয়ের কথা সর্বজনবিদিত। তিনি শেকসপিয়রের জন্মোৎসবে ‘শ্রীরঙ্গম মঞ্চে’ উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। নাট্যচক্রের ‘নীলদর্পণ’ ও শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় ‘নবান্ন’ নাটকেও (তখনও দলের নাম ‘বহুরূপী’ হয়নি) অভিনয় করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরেই ‘কুমার রায়’ ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে যোগ দেন। মাত্র পাঁচটি মৌলিক নাটক লিখেছিলেন ঋত্বিক ঘটক। ‘জ্বালা’, ‘দলিল’, ‘সাঁকো’, ‘জ্বলন্ত’ এবং ‘সেই মেয়ে’। এ ছাড়া ব্রেখটের ‘খড়ির গণ্ডী’ ও ‘গ্যালিলেও’ অনুবাদ করেছিলেন। নাটকের সংখ্যা বেশি না হলেও সমকালীন সমাজ ও সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর নাটকে। নাটকগুলো পর্যায়ক্রমে আলোচনা করলেই সমাজমনস্ক ঋত্বিকের একটি উজ্জ্বল ছবি পাওয়া যাবে। ‘জ্বালা’ ঋত্বিক ঘটকের লেখা প্রথম নাটক। যদিও তিনি ‘দলিল’ নাটকটি প্রথম লিখতে শুরু করেন। এই নাটকের পশ্চাৎ কাহিনী ঋত্বিক নিজেই এইভাবে বিবৃত করেছেন, “পি.সি. কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি, সে আমাকে বলল, ‘ইউ টেক ওভার দি চার্জ অফ বেঙ্গল’। করেসপন্ডেন্ট আর কী! সে সময় আমি একতিরিশটা সুইসাইড … মানে, অ্যাজ এ করেসপন্ডেন্ট, অ্যাজ এ জার্নালিস্ট, আমাকে এই সমস্তগুলো কভার করতে হলো। তো একতিরিশটা সুইসাইড দেখে – তার ওপরে আমি ‘সুইসাইড ওয়েভ ইন ক্যালকাটা’ বলে লিখে পাঠালাম। সেটা বেরোল এবং খুব নামটাম হলো। তা আমি ভাবলাম কী, এতে তো জমবে না মাল। আরো রাগ প্রকাশ করার একটা ব্যাপার আছে। তখন আমি ফিল্মে এনক্লোজ করিনি অ্যাট অল। এই জ্বালা নাটক থেকে সিলেক্ট করা ছটা চরিত্র – ইচ ওয়ান ইজ এ ট্রু ক্যারেকটার। জ্বালা ইজ এ ডকুমেন্টারি। এই নাটক লিখলাম এবং অ্যাক্টিং করলাম। ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করলাম।” এই নাটকের একটি দুঃখময় পটভূমি আছে। ওই সময় কলকাতা শহরে এক মাসের মধ্যে বহু মানুষ আত্মহত্যা করেছিল। সেই রকম কয়েকটি চরিত্র সন্নিবেশ করে এই নাটক লেখা। একমাত্র উন্মাদ চরিত্র ছাড়া সবগুলোই জীবন্ত, বাস্তব। জ্বালা নাটকটি কলকাতা বেতারে অভিনীত হয়ে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলা ছাড়াও হিন্দিতে অনূদিত হয়ে পাটনা ও দিল্লি রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছিল। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভেদের জালে জড়িয়ে পড়া যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের সম্মেলক আর্তনাদ ফুটে উঠেছে নাটকের মূল বক্তব্যে। মৃত্যুর অবিরল পদধ্বনির মধ্যে জীবনের অসামান্য জয়গান এই নাটকে প্রতীয়মান হয় শেষ পর্যন্ত। এর পরের নাটক ‘দলিল’। গণনাট্য সংঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াডের এই প্রযোজনা প্রথম অভিনীত হয় ‘২০৬ লোয়ার সার্কুলার রোড়ে ভূপতি নন্দীর বাড়ির ছাদে’। ‘তৃপ্তি মিত্র’ পদ্মার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং ‘শম্ভুমিত্র’। এই নাটকই ১৯৫৩ সালে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পায়। এই নাটকটি যখন ছাপা হয়, তার ভূমিকায় ঋত্বিক ঘটক লিখেছেন, ‘‘সম্পূর্ণাঙ্গ নাটক বলতে যা বোঝায়, দলিল একেবারেই তা নয়। পদ্মার স্রোতের মতোই বাস্তুচ্যুত বাঙালির ধারা চলেছে এগিয়ে এক অলঙ্ঘ্য পরিণতির দিকে। একদিকে রয়েছে চরম প্রতিকূল অবস্থা, আর একদিকে বলিষ্ঠ দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, এ দুইয়ে মিলিয়ে আজকের বাস্তবকে সৃষ্টি করেছে। তারই ঘাত-প্রতিঘাত চলছে ঘটনা থেকে ঘটনায়। স্রোতের ঢেউয়ের মতো ছাপিয়ে ছাপিয়ে। তিনটি প্রবাহে সেই মূল সুরটিকে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।’’ দেশভাগ এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানি। বাঙালি জীবনে যে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল, তারই ফলশ্রুতি ঋত্বিকের পরের নাটক ‘সাঁকো’। মনে রাখা দরকার, দেশভাগকে ঋত্বিক কোনো দিনও মেনে নিতে পারেননি। সারাজীবন তাঁকে এই কষ্ট তাড়া করে ফিরেছে। তাঁর তৈরি ছবিতেও এই প্রসঙ্গটি ফিরে ফিরে এসেছে। সাঁকো নাটকটি শুরু হচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার এক রাত্রির ঘটনা দিয়ে। মানুষ মারছে মানুষকে। হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে মারছে – এ নির্মম ঘটনা ছাপিয়ে ফুটে উঠেছে বাঙালি মারছে বাঙালিকে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে যার সূচনা, অনুশোচনা ও আত্মদহনের মধ্যেই এর অবসান। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর নিবিড় মমতা দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ও ঐক্যের কথাই শেষ পর্যন্ত উচ্চারিত হয়েছে। ‘সাঁকো’ নাটকের পরে পরবর্তী তেরো বছর ঋত্বিক ঘটক নাট্যজগৎ থেকে কেবল বিচ্ছিন্ন ছিলেন না, এরই মধ্যে তাঁর জীবনেও ঘটে গেছে নানা পরিবর্তন। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান ঘটনা ১৯৫৫ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তথা গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এদিকে একটু একটু করে সিনেমা জগতের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন। প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ নির্মিত হয়েও মুক্তি পায় না। ‘কত অজানারে’ ছবিটির ৭৫ শতাংশ নির্মাণ করেও শেষ করতে পারেননি। তবু দমে যাননি তিনি। ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পাওয়ার পর চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর দক্ষতা সর্বজনবিদিত হয়। ক্রমে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’ তৈরি করে তিনি রীতিমতো সাড়া ফেলে দেন। তবুও তিনি নাটক নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন। ষাট দশকের শেষদিকে তিনি ‘অভিনয় দর্পণ’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। সেই পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সাঁকো’ নাটকটি। তাঁর সম্পাদনায় ওই পত্রিকার ওই সময়কার সংখ্যাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, ঋত্বিকের কী পরিমাণ উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল নাট্যশিল্পে। সাঁকোর পরের নাটক জ্বলন্ত। এই নাটক লেখার ইতিহাসটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ১৯৭৪-এ ‘যুক্তি তক্কে গপ্পো’ ছবির পরে তিনি সেই বিষ্ণুপ্রিয়া নামে একটি ছবি তৈরির পরিকল্পনা করেছিলেন। ‘এনএফডিসি’তে প্রস্তাবিত ছবিটির সংক্ষিপ্তসার জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিটি শেষ পর্যন্ত হয়নি। ওই চিত্রকাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছিল ‘জ্বলন্ত’ নাটকটি। চারটি দৃশ্যে বিভক্ত জ্বলন্ত নাটকটি সেই ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ চিত্রকাহিনীর অনুরূপ। সেই সময় যে মাস্তানরাজ তৈরি হয়েছিল, তাদের বীভৎস কর্মকাণ্ডের শিকার হয়ে কীভাবে একটি নিষ্পাপ মেয়ের জীবন শেষ হয়ে গেল অগ্নিকাণ্ডে, তারই এক নির্মম আলেখ্য জ্বলন্ত নাটকটি। ১৯৭৫ সালের ২৪শে আগস্ট প্রাচীতীর্থর প্রযোজনায় নাটকটি কলকাতার একাডেমি অব ফাইন আর্টসে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। নাট্যরচনা, সংগীত, মঞ্চনির্মাণ, আলো এবং পরিচালনার দয়িত্বে ছিলেন স্বয়ং ঋত্বিক। ঋত্বিক ঘটকের শেষতম মৌলিক নাটকের নাম ‘সেই মেয়ে’। ১৯৬৯-এ ১০ই থেকে ১৪ই জুলাই – এই ক’দিনের মধ্যে নাটকটি তিনি লেখেন মানসিক হাসপাতালে বসে। ওই সময় তিনি কিছুদিন সাময়িকভাবে মানসিক অসুস্থতার কারণে ওখানে ভর্তি হয়েছিলেন। সুস্থ হওয়ার পর ওখানেই নাটকটি রচনা করেন, অনুবাদ করেন ‘কুমারসম্ভবের অষ্টম সর্গ’। ‘কলকাতার গোবরা মানসিক হাসপাতালে’ চিকিৎসাধীন রোগীদের দিয়ে নাটকটি অভিনয়ও করান। ‘অভিনয় দর্পণ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায়’ (জুলাই-আগস্ট ১৯৬৯) নাটকটি মুদ্রিত হয়। নাটকটিতে সংযোজিত একটি গানের কথা ও সুর সংযোজনা করেন ‘পণ্ডিত রবিশঙ্কর’। একটি মানসিক চিকিৎসালয়ে সন্তানহারা ‘শান্তি’ নামের এক গৃহবধূর জীবনের কথা ব্যক্ত হয়েছে নাটকটিতে। এই নাটকের একটি চরিত্র ডাক্তারের। তাঁর একটি সংলাপ এই রকম, ‘‘মানুষ ব্যথা পায়, কষ্ট পায়, তরঙ্গে তরঙ্গে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ভাবে মৃত্যু এলো বুঝি। কিন্তু মৃত্যুর ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে নবজীবন … সব জন্মই তো তাই।’’ ডাক্তার জানান, আসল চিকিৎসা ভালোবাসা। আর ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসাই ঋত্বিক দর্শনের মূল কথা – কি থিয়েটারে, কি সিনেমায়।
আগেই বলা হয়েছে, ঋত্বিক ঘটকের নাটকের সংখ্যা বেশি নয়। মৌলিক নাটক মাত্র পাঁচটি আর ‘ব্রেখটের খড়ির গণ্ডি’ আর ‘গ্যালিলেও’ অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অস্থির স্বভাব কোনো কিছুতেই তাঁকে বেশিদিন নিমগ্ন থাকতে দেয়নি। মৃত্যুর চারটি দশক অতিক্রম করার পরও তাঁর নাটক আজও প্রাসঙ্গিক। ‘মানুষ, তোমাকে ভালোবাসি’ এই গভীর জীবনদর্শন নিয়ে তিনি নাট্যসৃজনে ব্রতী হয়েছিলেন। ‘অভিনয় দর্পণ পত্রিকার প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যায় সম্পাদকীয়’তে তিনি লিখেছিলেন, ‘‘সব শিল্পের শেষ কথা মানুষকে ভালোবাসা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ম্যাক্সরাইন হার্ডও করিয়াছিলেন, তাহারও ইতিহাস লিখিত আছে। ‘আঁদ্রে আতোয়া’ হইতে আরম্ভ করিয়া কনস্টানটাইন স্তানিশ্লাভস্কির মধ্য দিয়া অটো ব্রাহামের ইতিহাসও আমরা ভুলি নাই। কিন্তু সর্বস্তরেই, এক জায়গায় পৌঁছানো গিয়াছে, সেটা মানুষকে ভালোবাসা।’’ ‘জ্বালা’ থেকে ‘সেই মেয়ে’ – এই দীর্ঘকালীন নাট্যপ্রবাহে এই ভালোবাসাকেই তিনি নাটকের প্রাণশক্তি হিসেবে অনুভব করেছেন। শুধু নাটকে নয়, তাঁর তৈরি সিনেমাতেও ছিল সেই ভালোবাসারই জয়ধ্বনি।
‘ঋত্বিক ঘটকের নাট্যচর্চার কালানুক্রমিক তথ্যপঞ্জি’টি অনেকেকটা এরকম – ১৯৩৬, ‘চন্দ্রগুপ্ত’; ১৯৪৮, ‘নটীর পূজা’; ১৯৪৩, ‘অচলায়তন’; ১৯৪৩, ‘ডাকঘর’, ‘পরিত্রাণ’, ‘ফাল্গুনী’, ‘বিসর্জন’, ‘রাজা’; ১৯৪৭, ‘জাগরণ’, ‘কালো সায়র’; ১৯৪৮, ‘নবান্ন’; ১৯৪৯, ‘ঢেউ’; ১৯৫০, ‘জ্বালা’, ‘নীলদর্পণ’; ১৯৫১, ‘কলঙ্ক’, ‘ভাঙাবন্দর’; ১৯৫২, ‘ভোটের ভেট’, ‘কত ধানে কত চাল’, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’, ‘দলিল’, ‘ম্যাকবেথ’; ১৯৫৩, ‘অফিসার’; ১৯৫৪, ‘ইস্পাত’, ‘নীচেল মহল’; ১৯৫৫, ‘সাঁকো’, ‘হ য ব র ল’; ১৯৫৬, ‘মুসাফিরে কে লিয়ে’ (হিন্দি); ১৯৫৭, ‘স্ত্রীর পত্র’; ১৯৬৩, ‘বিদ্যাসাগর’; ১৯৬৪, ‘গ্যালিলেও চরিত’; ১৯৬৬, ‘খড়ির গণ্ডী’; ১৯৬৯, সেই মেয়ে’।
‘নবান্ন’ নাটকে সাফল্যের পরে ৪৯-এ গণনাট্যের নতুন নাটকে হাত দিলেন। ‘ঢেউ’। নাটকে বৃদ্ধ কৃষকের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করলেন। প্রথম অভিনয় ‘যাদবপুর কলেজের হস্টেলের ছাদে’। পরের শো সেই রাতেই। ‘সিটি কলেজে’। সে দিন ঋত্বিক মেকআপ নিয়ে উৎপল দত্তের কাছে পয়সা চাইতে গেলেন। তাড়িয়ে দিলেন উৎপল! ‘নবান্ন’ দেখার পরেই ঋত্বিকের সঙ্গে যোগ বাড়ে ‘প্রগেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের’। সেখানে তখন চাঁদের হাট। ‘শম্ভু মিত্র’, ‘বিজন ভট্টাচার্য’, ‘সুধী প্রধান’, ‘গোপাল হালদার’ প্রমুখ। সভাপতি ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’। সদস্য হয়ে গেলেন ঋত্বিক। কিন্তু এখানেও যেন স্বস্তি মিলছে না। এমন অস্থিরতাই যে তাঁকে সারাজীবন তাড়া করেছে। যার সমালোচনাও করেছেন তাঁর গণনাট্যের সহ-যোদ্ধারা। পার্টিতে ঋত্বিককে নিয়ে নানা বিরোধ থাকলেও যখন তিনি রস্ট্রামের সামনে দাঁড়াতেন, তখন তিনি অন্য মানুষ। ১৯৫৫-তেই উৎপলের পরিচালনাতেই অভিনয় করলেন ‘বিসর্জন’ নাটকে। আবার রঘুপতি। রস্ট্রামের উপর উঠতে উঠতে তাঁর অবিস্মরণীয় সেই অভিনয়, সংলাপের থ্রোয়িং মনে রেখেছে এ শহর! উৎপলের পরিচালনাতেই একবার ঘাটশিলায় সেই নাটক করতে গিয়ে নিদিষ্ট সময়ের আগে পর্দা ফেলে দিয়েছিল গণনাট্যের এক কমরেড। তাতে ঋত্বিেকর শেষ দৃশ্যটি অধুরা রয়ে যায়। রেগে গেলেন। বেরিয়ে সেই কমরেডের গালে সপাটে চড়! খুব অল্প বয়সেই গল্প লিখতে লিখতে একসময় তাঁর মনে হয়েছিল ‘‘গল্পটা inadequate’’। সেই জন্য নাটকে চলে এসেছিলেন ঋত্বিক। বলছেন, ‘‘ভাবলাম গল্প ক’জন লোককে নাড়া দেয়, আর নাড়া দেয় অনেক গভীরে গিয়ে, কাজেই অনেক সময় লাগে পৌঁছতে। আমার তখন টগবগে রক্ত, immediate reaction চাই। সেই-সময়ে হল ‘নবান্ন’। ‘নবান্ন’ আমার সমস্ত জীবন-ধারা পাল্টে দিল। … আমি নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়লাম!’’ আবার নাটক করতে করতেই তাঁর মনে হল, কয়েক হাজার নয়, লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। ‘‘এই ভাবে আমি সিনেমাতে এসেছি, সিনেমা করব বলে আসিনি। কাল যদি সিনেমার চেয়ে better medium বেরয় তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে আমি চলে যাব। I don’t love film. সিনেমার প্রেমে মশায় আমি পড়িনি।’’ কিন্তু নাটকই ছিল তাঁর সারা জীবনের পথের দাবি, বক্তব্য প্রকাশের জোরালো মাধ্যম! সারা জীবনে যখনই গল্প লিখতে লিখতে, ছবি করতে করতে থমকেছেন তিনি, নাটকই সেই খরার দিনে তাঁর বক্তব্য প্রকাশের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সরে যেতে চেয়েছেন, পারেননি।ঠোক্কর খেতে খেতেও টাল সামলে বার বার ভাঙা দেশ, উদ্বাস্তু জীবন আর কলোনির গল্পকে নিজের মতো করে বলেছেন মঞ্চের সংলাপে। তাঁর সুহৃদদেরই কেউ কেউ বলছেন, ‘হি ওয়াজ নেভার সিনসিয়ার টু দ্য থিয়েটার’, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে ঋত্বিকই জায়গা করে নিল অনেকখানি। শোভা সেন তাই তাঁকে বলছেন, ‘নাট্য-আন্দোলনের হোতা বা পুরোহিত!’
‘‘চিত্রনির্মাতা দুই ধরনের – এক দল পরিচালক, আরেক দল স্রষ্টা। আমি স্রষ্টার দলে।’’ নিজের সিনেমা সম্পর্কে বলেছিলেন বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রনির্মাতা ঋত্বিক ঘটক। তিনি প্রয়াত হন ১৯৭৬ সালে। তাঁর সহধর্মিণী সুরমা ঘটক। ৭ই মে ২০১৮ সালে রাত সোয়া ১২টায় কলকাতার বাঙুর হাসপাতালে জীবনাবসান হয় এই মহীয়সী নারীর। চলচ্চিত্রের গনগনে আগুনের ফুলকি ঋত্বিককে সামলেছেন সুরমা। সুরমা ঘটকের সমস্ত জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেন ট্র্যাজেডির সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জীবনের রঙ্গমঞ্চে পারফর্ম করে যেতে হয়েছে তাঁকে। ‘‘ঋত্বিক দা, ইউনিভার্সিটিতে বার্গম্যানের সিনেমা চালাচ্ছে। যাবেন দেখতে?’’ ঋত্বিকের উত্তর, ‘‘আরে ধুর! বার্গম্যানের পুরোটাই জালিয়াতি, এক শ ভাগ জোচ্চুরি। আন্তোনিওনির স্টাইলটা ধ্রুপদি। যাকগে, যা বোঝো না তা নিয়ে তোমরা ফ্যাচফ্যাচ কোরো না। শোনো, আরও ৮-১০ বছর বাদে লোকে আমার ছবি নেবে। আমার ছবি পাগলের মতো খুঁজবে। তোমরা দেখে নিয়ো।’’ নিজের সম্পর্কে ঋত্বিকের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি প্রমাণ হয়েছে। জীবদ্দশায় দর্শকের উপেক্ষার শিকার হওয়া এই চিত্রনির্মাতার ছবি চলচ্চিত্র দুনিয়া এখন পাঠ্য করে নিয়েছে। ঋত্বিকের সব কাজ সংরক্ষণের ভার ছিল সুরমা ঘটকের কাঁধে। অসমাপ্ত ছবির রিল, অপ্রকাশিত লেখার পাণ্ডুলিপি তিনিই তুলে দিয়েছেন ঋত্বিক-ভক্তদের হাতে। বোম্বেতে ‘বিমল রায়’, ‘ঋষিকেশ মুখার্জি’দের সঙ্গে কাজ করেছেন ঋত্বিক। চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘দিলীপ কুমার অভিনীত’ ‘মধুমতি’, ‘মুসাফির’ সিনেমার। কিন্তু এই কাজ ভালো লাগছিল না তাঁর। সুরমাকে চিঠি লিখলেন, ‘‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এখন চেষ্টা করা। দেখো লক্ষ্মী, এ জীবন আমাদের নয়। … এসব ছেড়ে দেব। এ হবে না।’’ সত্যি ছেড়েও দিলেন। বোম্বে ছেড়ে এলেন কলকাতায়। নিজের মনের মতো ছবি বানাবেন বলে। ইনিই ঋত্বিক ঘটক। আর একবার ওই মুলুকে গিয়েছিলেন। ‘ইন্দিরা গান্ধী’ নিজে তাঁকে পুনেতে ‘এফটিআইআই’তে ‘ভাইস প্রিন্সিপাল’ করলেন যখন। আবার ঋত্বিককে ‘পদ্মশ্রী দিলেন এই ইন্দিরা গান্ধীই। ঋত্বিকের কাজের গুণমুগ্ধ ছিলেন ‘ইন্দিরা’।
এই ঋত্বিক একবারই প্রেমে পড়েছিলেন। আর সেই পদ্মের মতো প্রেমটি নিয়ে এসেছিলেন যিনি, তিনিই ‘সুরমা ঘটক’। ঋত্বিক ডাকতেন তাঁকে ‘লক্ষ্মী’ বলে। শিলং পাহাড়ের মেয়ে ‘সুরমা’। বাংলা ভাগ হয়ে দুই টুকরো হওয়ায় ঢাকার সন্তান ঋত্বিক তখন কলকাতায়। ঋত্বিকের বর্ণনায়, কাগজের বাবুরা তাঁদের নাম দিয়েছিল ‘উদ্বাস্তু-শরণার্থী’। ঋত্বিকের জীবনে ‘শরণার্থী’ কথাটা শ্লেষ হয়ে কানে বাজত। সুরমা কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। ঋত্বিকও তাই। দু’জনেই কেন্দ্রীয় সদস্য পদও পেয়েছিলেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংঘ ‘গণনাট্য’ (‘আইপিটিএ’) করতে গিয়ে পরিচয় দু’জনের। উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে নিজের লেখা নাটক দলিল বোম্বেতে মঞ্চস্থ করতে গিয়েছিলেন ঋত্বিক। সেখানে সুরমা ভিড়ের একটি দৃশ্যে ছোট্ট একটি চরিত্রে অভিনয় করে দিয়েছিলেন। তাঁর জন্য রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে এলেন। সেই পরিচয়ের শুরু। ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল কলকাতায় ফিরে। ‘গণনাট্য সংঘে’ ঋত্বিক সুরমাদের ক্লাস নিতে শুরু করলেন। ‘লেনিন’, ‘মার্ক্স’, ‘প্লেখানভ’ পড়াতেন মন্ত্রোচ্চারণকারী ঋত্বিকের মতো ভঙ্গিতে। সুরমা সে মন্ত্রে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন। তিনি যে সাধারণ নারী নন। এর আগে কমিউনিস্ট পার্টির জন্য জেল খেটেছেন ১৮ মাস। সেসব লিখে গেছেন শিলং জেলের ডায়েরিতে। বিসর্জন নাটকের মহড়া করাচ্ছিলেন ঋত্বিক। সুরমা করছিলেন ‘অপর্ণা’র রোল। দুটি চোখ এক হলো। দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে গেলেন তখনই। সুরমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া ‘সাধনা রায়চৌধুরী’ ঋত্বিককে চিনতেন। পই পই করে বললেন, ‘‘এঁর সঙ্গে মিশিশ না। বরবাদ হয়ে যাবি। ও ট্রটস্কির তত্ত্ব ছড়াচ্ছে। এই জন্য পার্টি বহিষ্কার করে দিচ্ছে ওকে।’’ কে শোনে কার কথা। পার্টি ছেড়ে দিয়ে দু’জনে গড়লেন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন। এর মধ্যে বিয়েও করে ফেললেন দুজনে। ঋত্বিকের মা বললেন, এই মেয়ে সাক্ষাৎ ‘লক্ষ্মী’। ঋত্বিক এক চিঠিতে সুরমাকে লিখেছিলেন, ‘‘আমার বাড়ির লোকে বলছে, আমাকে কোনো মেয়ের ভালো লাগে কী করে? আমার পা নোংরা থাকে, সস্তা বিড়ি খাই, ধুতি হাঁটু অব্দি উঠে থাকে। আমি নাকি তোমার মোটেই উপযুক্ত নই, মিছিমিছি তোমাকে ডোবাচ্ছি। ‘লক্ষ্মী’ মহিলাটি জলে পড়লেন!’’
দারুণ সোনার সংসার হয়েছিল ঋত্বিক-সুরমার। কিন্তু একের পর এক ছবি ফ্লপ করতে থাকে ঋত্বিকের। হতাশ হয়ে পড়েন ঋত্বিক। পয়সা-কড়িও নেই বললেই চলে। সন্তান তিনটি – ছেলে ‘ঋতবান’, মেয়ে ‘সংহিতা’ ও ‘শুচিস্মিতা’। এদিকে ঋত্বিক ‘অ্যালকোহলিক’ হয়ে পড়ছেন দিনে দিনে। বাড়িতে মদের আড্ডা। ঋত্বিক ‘একরোখা’ – পুরো ইন্ডাস্ট্রি তা জানে। ‘রাজেশ খান্নার’ মুখের ওপর স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। নিজে জলে পড়েছেন সে নয় মানা গেল, মা হয়ে বাচ্চাদের জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলেন কী করে সুরমা? ঋত্বিককে একা ছেড়ে দেবেন, সিদ্ধান্ত নিলেন। শিলংয়ে বাবার বাড়ি চলে গেলেন সুরমা। এই সেপারেশনেও দু’জন দু’জনকে চিঠি লিখেছেন মাঝেমধ্যেই। ঋত্বিকের চলচ্চিত্রে ‘সুরমার রেফারেন্স’ এসেছে বারবার। ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় ‘নীতা’কে দেখানো হয় জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন জন্মেছেন। আসলে সুরমা জন্মেছিলেন জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। ‘কোমল গান্ধার’-এ কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘অনসূয়া’র জীবনের সংকটগুলো ছিল আসলে সুরমার সংকট থেকে অনুপ্রাণিত। আর ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ তো আত্মজৈবনিক ছবিই। এটিতে সুরমার ছায়া ছিল প্রকট। ‘আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাঁশি’ গানটি ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন ঋত্বিক। এই গানটি প্রেমের দিনগুলোতে সুরমাকে গুনগুনিয়ে শুনিয়েছেন যে কতবার! আর এর চিত্রায়ণও করেছিলেন শিলংয়েই। ঋত্বিকের মৃত্যুসংবাদ সুরমা পান শিলংয়ে বসে। মৃণাল সেন সে খবর দেন। তার পর ৪২ বছর ঋত্বিকের স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ঋত্বিককে স্মৃতিতে ধরে রাখতে লিখেছেন ‘ঋত্বিক’ ও ‘পদ্মা থেকে তিতাস’ বই দুটি। ২০০৯ সালে মারা যায় ‘শুচিস্মিতা’। ‘সংহিতা’ও মারা যান বছর খানেক আগে। ছেলে ‘ঋতবান’ও দীর্ঘদিন মানসিক রোগে ভুগে গত হন। সুরমা সত্যি যেন ‘ট্র্যাজেডির নায়িকা’ হয়ে রয়ে গিয়েছিলেন সমস্ত জীবন।
ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা তার সময়ে একেবারেই চলেনি। এক কথায় বলতে গেলে সেই সময় মানুষ তাঁর ছবি গলাধঃকরণ করতে পারেনি। ঋত্বিকের মৃত্যুর পর এক স্মরণসভায় ‘সুবর্ণরেখার হরপ্রসাদ’ অর্থাৎ অভিনেতা ও কিংবদন্তী নাট্যকার ‘বিজন ভট্টাচার্য’ বলেছিলেন ‘‘ঋত্বিককে খুন করা হয়েছে।’’ প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ঋত্বিক ঘটককে সিনেমা বানাতে হয়েছে। সিনেমা তৈরির বিন্দুমাত্র টাকাও জুটতো না তাঁর কপালে। ‘সুবর্ণরেখা’র আউটডোর হয়েছিল জাফুলিয়াতে। সেখানে রাত ন’টায় একটা ট্রেন আসতো। ঋত্বিক সেই লোকটার অপেক্ষায় বসে থাকতেন কখন তিনি ফিল্মের ‘র স্টক’ নিয়ে হাজির হবেন। র স্টক এলে তবেই শুটিং সম্ভব। কোনও কোনও দিন ‘র স্টক’ এসে পৌঁছতও না। শুটিং বন্ধ হয়ে যেত। চিত্রনাট্যের বাইরেও অনেক বেশি ফুটেজ ঋত্বিক ঘটক তুলে রাখতেন ‘সুবর্ণরেখা’র শুটিং-এর সময়ে। পরে এডিটিং টেবলে সেগুলোকে সাজানো হত। কিন্তু ওই এক্সট্রা শটগুলোই পরে টালিগঞ্জে রুপো গলানোর কাজে এসেছে। সম্ভবতঃ এর জন্যই ঋত্বিক ‘ব্যতিক্রমী’।
(তথ্যসূত্র:
১- দূরে যাব যবে সরে তখন চিনিবে মোরে, দেবব্রত বিশ্বাস, দে’জ পাবলিশিং।
২- ‘সত্যজিৎ রায় ভিন্ন চোখে’ – শীতলচন্দ্র ঘোষ ও অরুণকুমার রায় সম্পাদিত।
৩- ঋত্বিক ঘটক, রজত রায়, প্রতিভাস।
৪- সাক্ষাৎ ঋত্বিক (ঋত্বিক ঘটকের ১৮ টি সাক্ষাৎকার ওঋত্বিক সম্পর্কে ২১ জনের লেখা/কথা), শিবাদিত্য দাশগুপ্ত, দীপায়ন।
৫- শিলং জেলের ডায়েরি, সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।
৬- ঋত্বিক, পদ্মা থেকে তিতাস, সুরমা ঘটক, অনুষ্টুপ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত