তখন ভক্তিমতী ‘রানী রাসমণি’ও নেই, আর অনুগত সেবক ‘মথুরবাবু’ও নেই। তাঁদের পরের জানবাজারের কর্তাদের ছিল জমিদারি মেজাজ, দক্ষিণেশ্বর মন্দির নিয়ে তাঁরা বিশেষ মাথা ঘামাতেন না। তাই রামকৃষ্ণ পরমহংস অসুস্থ হয়ে পড়লেও খোঁজখবর নেন নি কর্তারা। ওদিকে দিন দিন ভক্তের সংখ্যা বাড়ছিল, সারাদিন ধরে মানুষ আসত, তাঁরা রামকৃষ্ণের দর্শন চাইতেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁকে কথা বলতে হত। কথা বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠে গান আসত, তারপরে এক একসময় ভাবাবেশে তিনি মূৰ্ছা যেতেন। তখন পরমহংসের শরীর ক্রমশঃ ‘কৃশ’ হয়ে আসছিল, হঠাৎ হঠাৎ তাঁর কাশির দমক আসত, তখন তিনি খুবই দুর্বলতা ও যন্ত্রণা বোধ করতেন। একদিন ভাবাবিষ্ট অবস্থায় তাঁর ইষ্ট দেবীর উদ্দেশে বলে উঠেছিলেন, ‘‘এত লোক কি আনতে হয়? একেবারে ভিড় লাগিয়ে দিয়েছিস। লোকের ভিড়ে নাইবার খাবার সময় পাই না। একটা তো ফুটো ঢাক, রাতদিন এটাকে বাজালে আর কদিন টিকবে?’’ তবে মন্দিরের মালিকপক্ষ মনোযোগ না দিন, রামকৃষ্ণের ‘অবস্থাপন্ন ভক্তরা’ তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। দু-একজন ডাক্তার তাঁকে দেখে বলেছিলেন, তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, এ অসুখের নাম ‘ক্লার্জিম্যানস সোর থ্রোট’, বেশি কথা বললে এরকম হয়। কিন্তু ডাক্তারদের ওষুধে কোন উপশম হয় নি, তাঁর ব্যথা ক্রমশঃই বাড়ছিল। একদিন তাঁকে গাড়িতে করে ‘তালতলা’য় এনে তখনকার বিখ্যাত ডাক্তার ‘দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়’কে দেখানো হয়েছিল। সেই দুর্বল শরীরে তাঁকে বারবার কলকাতায় আনা যেত না, আর ব্যস্ত চিকিৎসকরাও সবসময় দক্ষিণেশ্বরে যেতে চাইতেন না। দক্ষিণেশ্বর রামকৃষ্ণের ঘরখানিও স্বাস্থ্যকর ছিল না, স্যাঁতসেতে, অবিরাম গঙ্গার জলো হাওয়া আসত। প্ৰাতঃকৃত্য সারবার জন্য তাঁকে অনেকটা দূরে যেতে হত, তাতে তাঁর কষ্ট হত।
শেষে রামকৃষ্ণের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য ভক্তরা তাঁকে কলকাতায় এনে রাখবেন ঠিক করেছিলেন। ‘বাগবাজারে গঙ্গার ধারে’ বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। তারপরে এক সকালবেলা দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে রওয়ানা দিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস, প্রায় তিরিশ বছর যে ঘরটিতে ছিলেন সেখানে পড়ে ছিল তাঁর টুকিটাকি জিনিসপত্র। মন্দিরের অন্যান্য সেবাইত ও কর্মচারীরা বেশ অবাক হয়ে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তাঁর দক্ষিণেশ্বর ছেড়ে যাওয়া। রামকৃষ্ণ ঠাকুর নিজের ঘরখানা ছেড়ে বাইরে থাকতে চাইতেন না কখনও। সেদিন যেন বেশ গরজ করে চলে গিয়েছিলেন, একবারও পেছন ফিরে তাকান নি। বাগবাজারের বাড়িটি তাঁর পছন্দ হয় নি। গঙ্গার ধারেই বেশ নিরিবিলি পরিবেশে বাড়িটি ছিল, কিন্তু সেখানে পা দিয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘‘এখানে থাকব না! আমাকে কি গঙ্গাযাত্রা করতে এনেছে নাকি?’’ বলে হনহন করে তিনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তা হলে কোথায় যাওয়া যায়! তখন ‘রামকান্ত বসু স্ট্রিটে’ ছিল রামকৃষ্ণের সংসারী ভক্তদের মধ্যে অগ্রগণ্য ‘বলরাম বসুর বাড়ি’। সেই বাড়ি ছিল রামকৃষ্ণের চেনা, তিনি অনেকবার সেখানে গিয়েছিলেন, সেখানে অনেক ‘লীলা’ হয়েছিল। আপাততঃ সেখানেই রামকৃষ্ণকে রাখা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। জমিদার ‘বলরাম বসু’ আভূমি প্ৰণত হয়ে গুরুকে বরণ করে নিয়েছিলেন। সেখানে কাছাকাছি তাঁর অনেক ভক্ত ছিলেন, তাঁদের যাওয়া-আসার সুবিধে হয়েছিল। ‘একশো নম্বর শ্যামপুকুরে স্ট্রিটে’ ছিল ‘বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটান স্কুল’, ‘মহেন্দ্র মাস্টার’ ছিলেন সেখানকার প্রধান শিক্ষক, যখন তখন চলে আসতে পারতেন, আর বাগবাজার থেকে হেঁটেই চলে আসতেন ‘গিরিশ ঘোষ’। ইতিমধ্যে ‘নটচুড়ামণি গিরিশের’ মানসলোকে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল।
সেই ‘চৈতন্যলীলা’ দেখার পর রামকৃষ্ণ থিয়েটারে গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। তাঁর ব্যক্তিত্বের কিছু একটা মোহ ছিল, যা চুম্বকের মতন টেনেছিল ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ’কে। এককালের ‘মহা নাস্তিক ও দাম্ভিক গিরিশ’ আস্তে আস্তে নরম হয়ে এসেছিলেন, ঈশ্বরের অস্তিত্বে তাঁর বিশ্বাস হয়েছিল, কিন্তু ‘গুরুবাদ’ ছিল তাঁর দু’চক্ষের বিষ। সবাই বলে ঠিকমতন গুরু না পেলে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায় না। গুরুকেই ঈশ্বরজ্ঞান করতে হয় – কিন্তু তা শুনলেই গিরিশের গা জ্বলে উঠত। মানুষ কী করে ঈশ্বর হবে। সামান্য মানুষের পায়ের কাছে মাথা ঠোকা তো ভণ্ডামি। একদিন তিনি রামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘গুরু কী?’’ রামকৃষ্ণ মুচকি হেসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমার গুরু হয়ে গেছে!’’ গিরিশ প্রথমে বুঝতে পারেননি। কে তাঁর গুরু, ইনিই নাকি? যতবার রামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা হত, ততবারই তিনি গিরিশকে একটু একটু করে বেঁধেছিলেন, তা গিরিশ টের পেয়েছিলেন, তবু তাঁর মন মানতে চাইত না। মাতাল যেমন মাঝে মাঝেই মাথা ঝাঁকিয়ে নেশা কাটাতে চায়, তেমনই গিরিশও এক একবার বিশ্বাস ও আত্মসমৰ্পণ থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন দারুণ দুরন্তপনায়। রামকৃষ্ণের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন, গভীর রাতে মদ খেয়ে হল্লা করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে, যা তা খিস্তি-খেঁউড় করেছিলেন রামকৃষ্ণের সামনে। একদিন তো নেশার ঝোঁকে রামকৃষ্ণের বাপান্ত করতেও ছাড়েননি, তবু সব মেনে নিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। ‘উগ্ৰ চন্ড গিরিশ’কে এমন ‘ক্ষমাসুন্দর চক্ষে’ তো আগে আর দেখেনি কেউ! গিরিশের নাটক চালানো, মদ্যপান, বেশ্যা সংসর্গ এর কোনওটার ওপরেই নিষেধ আরোপ করেননি রামকৃষ্ণ। গিরিশকে তিনি চেয়েছিলেন, যে কোনও শর্তে। গিরিশ তাঁকে বকলমা দিক, তাতেই তার সব পাপ কেটে যাবে, তাঁকে পূজা বা ধ্যানও করতে হবে না। এমন কথা কোনও সাধক আগে বলেছিলেন? তারপর গিরিশ হঠাৎ গুরু বিষয়ে সংকটের একটা সহজ সমাধান করে নিয়েছিলেন। মানুষ কখনও মানুষের আধ্যাত্মিক গুরু হতে পারে না, কোনও মানুষের পায়ে মাথা ঠেকানো যায় না, কিন্তু স্বয়ং ঈশ্বর যদি মানুষ রূপে অবতীর্ণ হন। তা হলে তো আর সংশয় থাকে না! গিরিশ ঠিক করে নিয়েছিলেন – রামকৃষ্ণ পরমহংস সাধারণ মানুষ নন, তিনি ঈশ্বরের অবতার। যিনি রাম, তিনিই কৃষ্ণ, ইদানীং রামকৃষ্ণরূপে মর্ত্যধামে লীলা করতে এসেছেন। গিরিশ সেই অবতারের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছিলেন।
ওদিকে, ‘নরেন্দ্র’ এবং আরও কয়েকজন ভক্ত অবশ্য রামকৃষ্ণের সেই ‘অবতারত্ব’ মানতেন না। তাঁরা তাঁদের গুরুকে ভালোবাসতেন, তাঁকে একজন মহান মানুষ মনে করতেন, কিন্তু অবতার-টবতার কিছু মানতেন না। যিনি ঈশ্বরের অবতার, তিনি রোগভোগের কষ্ট পাবেন কেন? তিনি তো এসব কিছুই ঊর্ধ্বে। ঈশ্বর বা তাঁর অবতারদের দুটি স্পষ্ট লক্ষণ থাকে। তাঁরা কখনও বৃদ্ধ হন না। কোনও ব্যাধি তাঁদের স্পর্শ করতে পারে না। হিন্দু দেবদেবীরা চিরযুবা, চিরযুবতী। ‘শ্ৰীরামচন্দ্র’ কিংবা ‘শ্ৰীকৃষ্ণের’ কখনও জ্বরজারি হয়েছে কিংবা পেটের ব্যথায় কাতরাতে হয়েছে, তা অকল্পনীয়। কিন্তু রামকৃষ্ণ ছিলেন বরাবরই ‘পেটরোগা’, যখন তখন ‘বাহ্যে’ যেতেন, একবার আছাড় খেয়ে পড়ে তাঁর একটা হাতও ভেঙেছিল, প্লাস্টার করতে হয়েছিল। তাঁর সবই ছিল সাধারণ মানুষের মতন। তখন তো গলার ব্যথায় এক এক রাত্তিরে তাঁর ঘুমই হত না। বিশ্বাসটাই যাঁদের যুক্তি, সেই ভক্তরা মনে করতেন, ‘সবই প্রভুর লীলা’। অসুখটাও লীলা। তিনি ইচ্ছে করেই রোগযন্ত্রণা ভোগ করছেন, এবং এরও কোনও তাৎপর্য আছে। তখন খ্রীস্টানি মতের প্রভাব অনেকের ওপরেই পড়েছিল। ‘যিশুর সঙ্গে তুলনা’ এসেই যেত। ‘যিশু’ যেমন অন্য মানুষের পাপ নিজে গ্রহণ করেছিলেন, রামকৃষ্ণও সেইরকম অন্যদের রোগ-ব্যাধি নিজের অঙ্গে ধারণ করেছিলেন। গিরিশের দৃঢ় ধারণা ছিল, রামকৃষ্ণ ইচ্ছে করলেই যে কোনওদিন সেরে উঠবেন।
তখন রামকৃষ্ণ পরমহংস অনেকটা শিশুর মতন হয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার আসতে দেরি করলে উতলা হয়ে বলে উঠতেন, ‘‘ওগো, এখনও এল না? যাও না, তাকে খপর দাও!’’ নিজেই তিনি ওষুধ চেয়ে খেতেন। কাছাকাছি যাঁকেই দেখতে পেতেন, তাঁকেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘‘হ্যাঁ গা, আমার সারবে তো?’’ ‘অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ’ তাঁর সহ্য হত না, তাই সেই সময়ের নাম করা ‘হোমিওপ্যাথ প্রতাপচন্দ্র মজুমদার’কে ডাকা হয়েছিল। ইনি ‘ব্ৰাহ্ম নেতা প্রতাপচন্দ্র’ নন, শুধুই ডাক্তার ছিলেন। তাঁর ওষুধে রামকৃষ্ণের সাময়িকভাবে ব্যথার নিবৃত্তি হত, কিন্তু মূল রোগ বেড়েই চলেছিল। শেষে তাঁর কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ত, শক্ত কিছু খেতেই পারতেন না। নানান অভিমত শুনে বোঝা যাচ্ছিল, ‘পাদ্রিদের গলার ব্যথা’র মতন সহজ রোগ সেটা না।
একদিন একদল ‘কবিরাজ’ এসেছিলেন তাঁকেকে দেখতে। তাঁদের মধ্যে তখনকার প্রখ্যাত ‘কবিরাজ গঙ্গাপ্রসাদ’ও ছিলেন। ‘রোগের উপসর্গ’ শুনে ও রামকৃষ্ণের গলা পরীক্ষা করে তাঁরা গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। ‘গঙ্গাপ্রসাদ’ উঠে গিয়ে এক ভক্তকে বলেছিলেন, ‘‘এ রোগের নাম রোহিণী, আমাদের চিকিৎসার অতীত।’’ ভক্তটি বুঝতে পারেন নি ‘রোহিণী’ আবার কী রোগ? ‘গঙ্গাপ্ৰসাদ’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমরা যাকে রোহিণী বলি, ইংরেজী ডাক্তাররা তাকেই বলে ক্যান্সার।’’ রামকৃষ্ণ গঙ্গাপ্ৰসাদ’কে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এ রোগ সাধ্য না অসাধ্য?’’ কবিরাজ রোগীর সামনে চুপ করে থাকাই সঙ্গত বলে মনে করেছিলেন। তবে রামকৃষ্ণের অধিকাংশ ভক্তই তখন কবিরাজের এই রোগ নির্ণয় বিশ্বাস করেনি, তাঁরা অন্য কথাবার্তা শুরু করে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে দিয়েছিলেন।
রামকৃষ্ণের কলকাতায় অবস্থানের খবর রটে যাওয়ায় সেখানেও বহু মানুষ আসতে শুরু করেছিল। একদিন তাঁর কাছে এসেছিলেন ‘পণ্ডিতপ্রবর শশধর তর্কচূড়ামণি’। ‘হিন্দু ধর্মের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্ৰত’ নিয়েছিলেন তিনি। রামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর ছিল ‘রঙ্গরসিকতার সম্পর্ক’। তিনি অবশ্য ‘অবতারতত্ত্বে’ বিশ্বাসী ছিলেন না, রামকৃষ্ণকে তিনি একজন ‘উচ্চশ্রেণীর সাধক’ বলে মনে করতেন। ‘তর্কচূড়ামণি’ বলেছিলেন, ‘‘এ কী ব্যাপার, আপনারাও রোগ হয়!’’ রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘আমার তো রোগ না, এই দেহটার। চক্রবর্তী যে ছাড়ে না, দেহে রোগ সকলেরই।’’ ‘তর্কচূড়ামণি’ বলেছিলেন, ‘‘দেহটাকে শোধরানো আর এমন কি শক্ত ব্যাপার?’’ রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘বড় গর্ত করো, তাও পুরবে, এ দেহ আর পোরে না।’’ ‘তর্কচূড়ামণি’ একটা উপায় বলেছিলেন – ‘‘আপনি সমাধিস্থ হয়ে থাকুন, আর আমি স্বস্ত্যয়ন করি, আপনি দেশ বেড়াবেন চলুন।’’ শুনে রামকৃষ্ণ হেসেছিলেন। ‘তর্কচূড়ামণি’ বলেছিলেন, ‘‘আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? মশাই, শাস্ত্রে পড়েছি, আপনার ন্যায় পুরুষ ইচ্ছামাত্র শারীরিক রোগ আরাম করে ফেলতে পারেন। আরাম হোক মনে করে আপনার মনটা একাগ্র করে একবার অসুস্থ স্থানে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে রাখতে পারলেই সব সেরে যাবে। এটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার। একবার ওরকম করলে হয় না!’’ রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘তুমি পণ্ডিত হয়ে এ’কথা কী করে বললে গো? যে মন সচ্চিদানন্দকে দিয়েছি তাঁকে সেখানে থেকে তুলে এনে এ ভাঙা হাড়মাসের খাঁচাটার ওপর দিতে কি আর প্রবৃত্তি হয়?’’ কথাটা খুব মনঃপূত হয় নি শশধরের। ভাঙা হাড়মাসের খাঁচাটার প্রতি যদি এতই অবজ্ঞা, তা হলে আর ওষুধ খাওয়া কেন? ডাক্তারের কাছে রোগের এত ব্যাখ্যান দেওয়াই বা কেন? শশধরের ধারণা হয়েছিল – অসুখের ধাক্কায় সাধক হিসেবে রামকৃষ্ণ খানিকটা নীচে নেমে এসেছেন, ইচ্ছের জোরে মনোময় কোষে উঠে আসার ক্ষমতা তাঁর আর নেই।
সাতদিন পরে বলরাম বসুর বাড়ি ছেড়ে ভক্তরা রামকৃষ্ণকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক ভাড়াবাড়িতে। ‘পঞ্চান্ন নম্বর শ্যামপুকুরের স্ট্রিটে’। ‘বলরামবাবু’ তাঁর পরম ভক্ত ছিলেন বটে, কিন্তু একটু ‘কৃপণ’ ছিলেন। গুরুর চিকিৎসা ও সেবার জন্য তিনি অবশ্যই প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু নিজের বাড়িতে গুরুকে দিনের পর দিন রাখলে অনেক আনাগোনা চলবে, তাঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা, বাড়িটা একটা ‘হট্টমেলা’ হয়ে যাবে। নিজের বাড়িতে রাখলে চাঁদা তোলাটাও ভালো দেখায় না, তার থেকে ভাড়াবাড়িই সুবিধাজনক। ঠিক হয়েছিল কয়েকজন ধনী ভক্ত খরচপত্র ভাগাভাগি করে দেবেন। এক ‘কৃষ্ণা নবমীর সন্ধ্যায়’ সদলবলে সে বাড়িতে চলে এসেছিলেন রামকৃষ্ণ। বৈঠকখানা ঘরে তাঁর জন্য শয্যা পাতা হয়েছিল, দেওয়ালে টাঙানো হয়েছিল কতকগুলো ছবি। ‘রামচন্দ্র দত্ত’ একটা বাতি নিয়ে ছবিগুলো রামকৃষ্ণকে দেখিয়েছিলেন। একটা ছবিতে ছিলেন ‘যশোদা ও বালগোপাল’। পাশের ছবিটি ছিল ‘সঙ্কীর্তনে মত্ত শ্ৰীগৌরাঙ্গের’। সে ছবির সামনে একটুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে ছিলেন রামকৃষ্ণ। একজন ভক্ত ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘‘উনি নিজেই নিজেকে দেখছেন।’’ পরমুহুর্তেই রামকৃষ্ণ পেছন ফিরে বলেছিলেন, ‘‘জানলা দিয়ে হিম আসবে না তো?’’ আস্তে আস্তে সেখানে পাতা হয়েছিল সংসার। ‘তরুণ ভক্তরা’ ঠিক করেছিলেন তাঁরা পালা করে দিন-রাত্রি জেগে গুরুর সেবা করবেন। তাঁদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা হয় কি না রামকৃষ্ণ তা নিজেই খোঁজখবর নিতেন। রান্নার জন্য আনানো হয়েছিল সেবিকা ‘গোলাপী মা’-কে। ‘সারদামণি’ই বা একলা একলা দক্ষিণেশ্বরে পড়ে থাকবেন কেন? সেখানে তিনি ‘নহবতখানায়’ আত্মগোপন করে থাকতেন, পুরুষ ভক্তদের সামনে কখনও বের হতেন না। তাঁকেই স্বামী-সেবা থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন। রামকৃষ্ণের ইচ্ছেতেই ‘সারদামণি’কেও নিয়ে আসা হয়েছিল শ্যামপুকুরের বাড়িতে। অসুস্থ রামকৃষ্ণ ‘নরেন্দ্রের’ সব প্রশ্ন ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মানুষটি ছিলেন ‘নিরহঙ্কার’, ‘নিরভিমান’, ‘সদানন্দ’। অসুখের অত কষ্ট, তবু যখনই একটু ভালো থাকতেন, তখনই তিনি ‘হাস্যময়’, ‘কৌতুকপ্রবণ’ থাকতেন। সবাইকে কাছে নিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকতে তিনি বড় ভালোবাসতেন। তিনি তো খ্যাতি চাননি, প্রতিষ্ঠা চাননি, বড় বড় সাধুদের মতন ধনী গৃহে গিয়ে নানারকম বায়নাক্কা করেননি, কোনও কিছুতেই তাঁর লোভ বা মোহ ছিল না, চমক দেখাবার কোনও প্রয়াস ছিল না, তিনি শুধু ভালোবাসা চেয়েছিলেন। ভালোবাসার জন্য যিনি এমন কাঙাল, তাঁকে কি ভালোবাসা না দিয়ে পারা যায়? ‘নরেন্দ্ৰ’ ঠিক করেছিলেন, এঁকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।
শ্যামপুকুরের বাড়িতেই রামকৃষ্ণের শিষ্যমণ্ডলি আস্তে আস্তে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। ‘নরেন্দ্রর নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক’ প্রতি রাত্রে জেগে শুরুকে পাহারা দিতেন। আর ‘নিরঞ্জন ঘোষ’ হয়েছিলেন ‘সৰ্বক্ষণের দ্বারপাল’, যে-কোনও উটকো লোককে আর রামকৃষ্ণের কাছে যেতে দেওয়া হত না। তখন অনেক ডাক্তারই তো দেখানো হচ্ছিল, একবার ‘মহেন্দ্রলাল সরকার’কে ডাকার কথা উঠেছিল। সেই সময়ে ‘ধন্বন্তরি’ বলে তাঁর খুব নাম রটেছিল। ‘প্ৰতাপ মজুমদারের’ও সেই মত ছিল। কিন্তু রামকৃষ্ণ ওই নাম শুনেই বলে উঠেছিলেন, ‘‘না, না, ওকে ডাকতে হবে না।’’ ‘মাস্টার’, ‘প্রতাপচন্দ্র’ ও অন্য ভক্তরা রামকৃষ্ণের একথা শুনে হেসে উঠেছিলেন। এই হাসির কারণ ছিল। ‘মহেন্দ্রলাল সরকারের শাঁখারিটোলার বাড়িতে’ একবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রামকৃষ্ণকে। ভক্তরা গদ গদ স্বরে তাঁকে বলেছিল, ‘‘রামকৃষ্ণদেব এসেছেন, তিনি কষ্ট পাচ্ছেন …’’ তার আগে ‘মহেন্দ্রলাল’ একবার দূর থেকে রামকৃষ্ণকে দেখেছিলেন, কিছু কিছু শুনেওছিলেন তাঁর সম্পর্কে। কিন্তু তিনি যে-কোনও রকম ‘অলৌকিকত্বে’ ঘোর অবিশ্বাসী ছিলেন এবং ‘পরমহংস’ ব্যাপাটাও বুঝতেন না। যোগী পরমহংসই যদি কেউ হবেন, তা হলে তিনি দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে বছরের পর বছর গেড়ে বসে থাকবেন কেন, পরমহংসেরা তো এত সংসারী মানুষের সংসর্গে থাকেন না। ‘মহেন্দ্রলালের’ ধারণা ছিল, বড়লোকরা যেমন শখ করে অনেক কিছু পোষে, সেই রকম রানী রাসমণির জামাই মথুরবাবু দক্ষিণেশ্বরে একটি পরমহংস পুষেছিলেন! তাই কোথাও রামকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উঠলে ডাক্তার কৌতুকচ্ছলে বলতেন, ‘‘ও, সেই মথুরবাবুর পরমহংস!’’ কিন্তু ‘মহেন্দ্রলাল ডাক্তারের’ কাছে রুগী ছিল রুগীই, তা সে সাধুই হোক, রাজাই হোক বা নিঃস্ব হোক। তিনি ‘আপনি-আজ্ঞের’ ধার ধারতেন না, সবার সঙ্গেই ‘তুমি তুমি’ বলে কথা বলতেন। সেবারে রামকৃষ্ণকে সামনের চেয়ারে বসিয়ে তাঁর গলা পরীক্ষার জন্য বলেছিলেন, ‘‘কই দেখি, হাঁ করো!’’ সেই অবস্থায় রামকৃষ্ণ কিছু কথা বলতে যেতেই ‘মহেন্দ্রলাল’ ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘জিভ নাড়লে আমি দেখব কী করে?’’ বলে তিনি রামকৃষ্ণের জিভটা চেপে ধরেছিলেন। সেদিন খানিকটা যন্ত্রণা পেয়েছিলেন রামকৃষ্ণ। সেই প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি বলতেন, ‘‘না না গরুর জিভ টানার মতন টেনেছিল!’’
সেই সময়কার অবস্থার থেকে পরে তাঁর রোগের যাতনা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। গুরুর কষ্ট দেখলে ভক্তদেরও কষ্ট হত। ‘মহেন্দ্ৰ মাস্টারের’ বিশেষ ইচ্ছে ছিল আর একবার ‘মহেন্দ্রলাল সরকার’কে দেখানো হোক। ‘গিরিশ’ও তাই চেয়েছিলেন। অন্য ডাক্তাররাও বলেছিলেন, ডাক্তার সরকারের অভিমতটা জানা প্রয়োজন। তখন রামকৃষ্ণের কানের কাছেও ব্যথা চলে এসেছিল, তাঁর গলার মধ্যে সর্বক্ষণ ছুরি বেঁধার ভাব হত, এর যে কোনও ওষুধ ছিল না। এরমধ্যে ‘মহেন্দ্র মাস্টারের নিজের সংসারে’ও তখন দারুণ দুর্যোগ চলছিল। তাঁর বড় ছেলেটি মাত্র আট বছর বয়েসে মারা গিয়েছিল, তাঁর স্ত্রীর পাগল-পাগল অবস্থা হয়েছিল। তবু তিনি দিনে দু’তিনবার এসে গুরুকে দেখে যেতেন, কোনও রাতে বাড়িও ফিরতেন না। যাতে ঘুম না আসে তাই দু’তিন খানা মাত্র রুটি খেয়ে রাত জেগে গুরুর সেবা করতেন। ‘নরেন’, ‘রাখাল’রা বাড়িতে খেয়ে দেয়ে রাত্তিরে পাহারা দিতে আসতেন। তখন ‘নরেন’ আইন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন, তিনি সঙ্গে আনতেন পড়ার বই। ‘গিরিশ’ও সব কাজ ফেলে প্রায়ই ছুটে আসতেন, রামকৃষ্ণের সামনে বসে অঝোরে কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, ‘‘আপনি যখন নীরোগ থাকেন, তখন কত রকম দৌরাত্ম্য করি, সে এক, কিন্তু আপনাকে এ অবস্থায় দেখতে পারি না।’’
এরই মধ্যে রামকৃষ্ণ এক একসময় যেন রোগ-ব্যাধির কথা সব ভুলে যেতেন! একদিন সকালবেলা স্নান সেরে আসার পর তিনি ফিক ফিক করে হাসছিলেন। কেন তিনি হাসছেন, তা কেউ বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর হাসি আর থামছিল না। খেয়ে-দোয়ে একটু ঘুমিয়েছিলেন। সেদিন বিকেলবেলাও ছিল তাঁর ‘সহাস্য মুখ’, একসময় তিনি নিজেই বলে উঠেছিলেন, ‘‘এত হাসি কখনও হাসিনি, ভেতর থেকে যেন উঠে আসছে।’’ তারপরে একসময় খাট থেকে তিনি নেমে দাঁড়িয়েছিলেন। দু’হাত তুলে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতেই তাঁর ‘ভাবের ঘোর’ এসেছিল। ভক্তরা নির্বাক হয়ে তাঁকে দেখছিলেন। কারণ দক্ষিণেশ্বর ছাড়ার পর রামকৃষ্ণের এরকম ‘ভাব’ আর হয়নি, তাঁর শরীরটি হয়ে গিয়েছিল ‘জড়বৎ’, মন কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। খানিক পরে তিনি আবার বাস্তবে ফিরে এসেছিলেন। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘‘তোমরা গান গাও, সবাই হরিবোল বলো, তাতে যদি অসুখটা কমে।’’ সেই সন্ধেটা সকলের কেটেছিল বেশ মধুর ভাবে। কিন্তু রাত্রেই তাঁর আবার ‘রক্তবমি’ হয়েছিল। যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করেছিলেন তিনি। একবিন্দু ওষুধও তাঁর গলা দিয়ে নামছিল না। এর পর ‘মহেন্দ্রলাল সরকার’কে না-ডাকলে একেবারে হাল ছেড়ে দিতে হয়। ‘গিরিশ’ ও ‘মহেন্দ্র মাস্টার’ অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রামকৃষ্ণকে রাজি করিয়েছিলেন।
‘মহেন্দ্রলালের’ তখন এমন ‘পশার’ যে তিনি আর রুগীর ভিড় সামলাতে পারছিলেন না। তাঁর চেম্বার উপচে পড়ত। যা হোক তা হোক ভাবে রুগী দেখা তিনি পছন্দ করতেন না, আবার রুগীদের ফিরিয়েও দিতে পারতেন না। তাঁরা কেউ যেতে চাইত না। তাঁর ডাক্তারখানার ভেতরে আর বসবার জায়গা থাকত না, অনেক রুগী দাঁড়িয়ে থাকত বাইরে রোদ্দুরে। তাঁর কাছে রামকৃষ্ণর নিজস্ব সেবক ‘লাটু’কে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘মাস্টার’। কিন্তু অত ভিড় দেখে তিনি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে তার ঠিক নেই, তাঁর আবার ইস্কুলেও যাবার ছিল। কুস্তিগির ‘লাটু’র সাহায্য নিয়ে তিনি ঠেলেঠলে ভেতরে ঢুকেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম শুনলেই তিনি ‘মহেন্দ্রলাল’ আগে কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। ‘মহেন্দ্রলাল’ কিন্তু চিনতে পারেন নি ‘মাস্টারকে’। অন্যদের সরিয়ে তাঁকে সামনে আসতে দেখে তিনি এক দাবড়ানি দিয়েছিলেন, ‘‘কে হে তুমি? যাও, বাইরে যাও, বাইরে যাও!’’ কাঁচুমাচু হয়ে মাস্টারকে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল। একবার তিনি ভেবেছিলেন, এই উগ্ৰচণ্ড ডাক্তারকে ডেকে কী কোনও লাভ আছে? তাঁর গুরুর সঙ্গে ইনি কী রকম ব্যবহার করবেন কে জানে! কয়েক মিনিট পরে ডাক্তার নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছিলেন বাইরে। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখেছিলেন অপেক্ষমাণ ব্যক্তিদের। বাজখাঁই গলায় বলেছিলেন, ‘‘অ্যাই, রোদে দাঁড়িয়ে আছ কেন সব। ওই দিকে ছায়া আছে দেখতে পাচ্ছ না? রোদে দাঁড়িয়ে রোগ বাড়াবে আর আমি তোমাদের ওষুধ গেলাব! কেন রে বাপু, কলকাতা শহরে কি আর ডাক্তার নেই?’’ তারপর মাস্টারের দিকে তাঁর চোখ পড়েছিল। ভুরু নাচিয়ে মাস্টারকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘তুমি তো ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ? কারুর মুখে গঙ্গাজল … কী বৃত্তান্তটা শুনি?’’ মাস্টার তাঁর নিবেদন জানিয়েছিলেন। ‘মহেন্দ্রলাল’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘দেখছ তো এখন আমার মরার সময় নেই। বিকেলে এসো, এসে আমায় নিয়ে যেও!’’ বিকেলে আবার গিয়েছিলেন মাস্টার। সেবেলাও ডাক্তারের অনেকগুলি রুগী দেখার ছিল, তবুও তার এক ফাঁকে রামকৃষ্ণকে দেখে আসবেন বলে তিনি স্থির করেছিলেন।
বিকেলে ‘শ্যামপুকুরের বাড়ির দোতলায় সিঁড়ি’ দিয়ে উঠে এসেছিলেন ‘মহেন্দ্রলাল’। বারান্দাওয়ালা ঘরটিতে একটা চৌকির ওপর বিছানায় বসে ছিলেন রামকৃষ্ণ, মেঝেতে শতরঞ্চি পাতা, সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন কয়েকজন ভক্ত। ঘরে আর চেয়ারটেয়ার কিছু ছিল না। ‘মহেন্দ্রলাল’ দরজার কাছে দাঁড়াতেই রামকৃষ্ণ তাঁকে নমস্কার জানিয়েছিলেন হাত তুলে। প্রতি নমস্কার জানিয়ে ‘মহেন্দ্রলাল’ বলেছিলেন, ‘‘কী হে, তুমি তো দক্ষিণেশ্বরের মথুরবাবুর পরমহংস। তুমি যে এখানে এসে জুটেছ?’’ রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘চিকিৎসার জন্য এঁরা এখানে এনেছে।’’ তারপর তিনি বিছানায় নিজের পাশে চাপড় মেরে ডাক্তারকে বসতে ইঙ্গিত করেছিলেন সেখানে। প্যান্ট-কোট ও জুতো পরা অবস্থাতেই ‘মহেন্দ্রলাল’ সেই খাটে বসেছিলেন। কয়েকজন ভক্ত শিউরে উঠেছিলেন। কারণ – রামকৃষ্ণের বিছানায় তাঁর কোনও ভক্ত কখনও বসতেন না, বাইরের লোকের তো প্রশ্নই নেই। সাধক পুরুষদের সব সময় পৃথক আসন। আর এই ডাক্তারটি জুতো পরে তাঁর পাশে বসে পড়ল?
‘মহেন্দ্রলাল’ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘তোমার কী কী কষ্ট হয় বলো তো!’
রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘কোনও কোনও স্থান গোল হয়ে ডোব হয় … হাওয়া গিয়ে ফিরে আসে ঢোঁকের পর।’’
– ‘‘কাশি আছে?’’
– ‘‘হ্যাঁ গো, রাত্ৰে কাশি হয়-যেন ক্যাস্টর অয়েল-পরে পুঁজ হয়ে ওঠে।’’
– ‘‘গলার ব্যথা?’’
– ‘‘যেন ছুরি বেঁধা। ফোঁড়া ফাটিয়ে দেবার মতন যন্ত্রণা–রাত্তিরে ঘুম হয় না।’’
– ‘‘ঠিক আছে, এবার হাঁ করো, গলাটা দেখি।’’
শিশুর মতন ভয়ে ভয়ে রামকৃষ্ণ মুখটা ফাঁক করেছিলেন। তখন তিনি পুরো মুখ খুলতে পারতেন না। ‘মহেন্দ্রলাল’ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ভালো করে দেখাতে পারছ না, তুমি তো বড় আহাম্মক – না দেখালে কাকে দেখতে এসেছি!’’ যাঁর মুখ দিয়ে হাজার হাজার চমকপ্ৰদ ‘উপমা’ ও ‘লৌকিক কাহিনী’ বেরিয়ে এসেছিল, ‘ধর্মের সহজ, সরলতম ব্যাখ্যা’ দিয়েছিলেন যিনি, তাঁর রক্তাক্ত, রোগ-বিক্ষত কন্ঠনালীর মধ্যে উঁকি দিয়েছিলেন ‘মহেন্দ্রলাল’। তারপরে আস্তে আস্তে বলেছিলেন, ‘‘আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন? আমরা কি মানুষ মেরেই বেড়াই?’’
সেদিন রামকৃষ্ণকে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেছিলেন ‘মহেন্দ্রলাল’। তাঁর যে অন্য রুগী দেখতে যাবার তাড়া ছিল, তা যেন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। ডাক্তারের সিদ্ধান্ত কী তা জানার জন্য রামকৃষ্ণ উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকলেও ‘মহেন্দ্রলাল’ সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেন নি তাঁর কাছে। তারপরে এক সময় যন্ত্রপাতি গোছাতে গোছাতে তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, নিয়মিত খাবে। বেশি কথা বলবে না। এখন কিছুদিন উপদেশ-টুপদেশ বন্ধ রাখো।’’ ‘মাস্টার’ ও আরও দু’তিনজন ডাক্তারকে নিয়ে এসেছিলেন নীচে। ডাক্তার বাড়িটি দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘এটিও বুঝি রানী রাসমণির?’’ ‘মাস্টার’ তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘আজ্ঞে না। ঠাকুরের ভক্তরা এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছে।’’ ‘মহেন্দ্রলাল’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘ভক্ত? ওর আবার শিষ্যটিষ্য আছে নাকি? আমি তো জানতুম, জানবাজারের ওরাই রেখেছে। কারা ওর ভক্ত শুনি? তোমাকে সবাই মাস্টার বলে, তুমি কোথাকার মাস্টার?’’ ‘বিদ্যাসাগর মশাইয়ের স্কুলের একটি শাখার হেডমাস্টার’ যে সেই ব্যক্তিটি, তা জেনে ‘মহেন্দ্রলাল’ বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন। অন্য ভক্তদের মধ্যে ছিলেন আর এক ‘ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত’, নেপালের রাজপ্রতিনিধি ‘ক্যাপ্টেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়’, সদ্য বি এ পাশ করা যুবক ‘নরেন্দ্র দত্ত’; এ ছাড়া ‘রাখাল’, ‘কালীপদ’, ‘শশী’ – এঁরা সকলে ছিলেন কলেজে পড়া শিক্ষিত ছেলে। সেদিন ‘মহেন্দ্রলাল’ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব ভক্তদের ‘ব্যক্তিগত জীবনের কথা’ জানতে চেয়েছিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল – যাঁর পরনের কাপড়ের ঠিক থাকে না, কথাবার্তা শুনলে আধ-পাগল মনে হয়, সেই লোকটির চারপাশে একদল কলেজে-পড়া শিক্ষিত তরুণ কেন জুটেছে, কিসের টানে? বয়স্ক লোকেরা সাধু-সন্ন্যাসীদের ঘিরে থাকে নিজেদের পাপ আর দুষ্কর্ম ঢাকার জন্য, পরলোকে যাতে শাস্তি না পায় সেই আশায়, কিন্তু যুব সমাজের মধ্যে তো এমন স্বাৰ্থ বুদ্ধি থাকে না! ‘মহেন্দ্ৰলাল’ সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন ‘গিরিশ ঘোষের বৃত্তান্ত’ শুনে। তাঁর ‘উচ্ছৃঙ্খলতা ও দুর্দান্তপনার কথা’ তখন কে না জানতেন? তিনি অবাক হয়ে ভেবেছিলেন – সেই লোকেরও চরিত্রের এমন বদল হয়েছে, সে রামকৃষ্ণের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে? এই মানুষটি গিরিশের মনের এমন পরিবর্তন ঘটিয়ে দিলেন কী ভাবে? তিনি ঠিক করেছিলেন, এই মানুষটিকে আরও ভালোভাবে জানতে হবে।
‘ডাক্তারের ফি’ আগে থেকেই জোগাড় করে রাখা ছিল, ‘মাস্টার’ সেই টাকাটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ‘মহেন্দ্রলাল’ গম্ভীরভাবে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আমাকে টাকা দিচ্ছ কী জন্য?’’ ‘মাস্টার’ তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আজ্ঞে ঠাকুরের ভক্তরা ওঁর চিকিৎসার জন্য টাকাপয়সা সংগ্রহ করেছেন। ডাক্তারের ফি তো অবশ্যই দিতে হবে।’’ উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করে মহেন্দ্রলাল বলেছিলেন – ‘‘আমাকেও তাঁদের একজন বলে ধরে নিতে পারো। ওষুধের খরচাও লাগবে না। তোমরা তোমাদের গুরুকে সাবধানে রাখবে। বুঝতেই পারছি, এ রোগ অতি কঠিন রোগ। দেখো, যেন বেশি লোকজন ওকে জ্বালাতন না করে। পায়ের ধুলো টুলো দেওয়া বন্ধ রাখো, যত বেশি লোকের সঙ্গে কথা বলবে, তত ওর উত্তেজনা বাড়বে, কষ্টও বাড়বে।’’
(তথ্যসূত্র:
১- প্রথম আলো, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
২- রামকৃষ্ণ-সারদা: জীবন ও প্রসঙ্গ, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩- শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ সংস্পর্শে, নির্মলকুমার রায়, দে’জ পাবলিশিং।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত