১২৭৭ বঙ্গাব্দ। ‘রাণী রাসমণি’ বহুদিন পূর্বেই গত হয়েছেন। তখন পরিবারের কর্তা জামাতা ‘মথুরমোহন বিশ্বাস’। ঠাকুর ‘শ্রী রামকৃষ্ণদেব’ এসেছেন জানবাজারে দুর্গাপুজো উপলক্ষে। ঠাকুরের উপস্থিতিতে সেই বাড়ি তখন আনন্দস্রোতে প্রবাহিত হয়ে আনন্দধামে পরিণত। তার উপর মথুরমোহন শ্রীরামকৃষ্ণকে ইষ্টজ্ঞানে ‘বাবা’ ডাকতেন। ঠাকুর আর মা সারদামণির প্রতি মথুরবাবু আর তাঁর স্ত্রী ‘জগদম্বা দেবী’র শ্রদ্ধা, ভক্তি, অনুরাগ পবিত্র ধারার মতো স্বতোৎসারিত। মথুরনাথের জীবনের উপর শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাব অবিস্মরণীয়। রাণীনিবাসে শুরু হল মহামহোৎসব। ভক্তজন প্রিয় ঠাকুরের দিব্য উপস্থিতিতে ঘটা করে শুরু হল সপ্তমী পুজো। মথুরের আননে তখন আনন্দের আল্পনা। জানবাজার স্ফূর্ত ও দীপ্ত। মাতৃঅঙ্গন ভাবগাম্ভীর্যে পরিপূরিত। সেবার দুর্গতিহারিণী দেবীমূর্তি যেন বড় হাস্যময়ী, প্রাণময়ী ও আনন্দময়ী। পুণ্যার্থীরা ভাসতে থাকেন এক অনাস্বাদিত উপলব্ধির অমৃতপ্রবাহে। ‘স্বামী সারদানন্দ’ তাঁর ‘লীলাপ্রসঙ্গে’ লিখেছেন,
‘‘… প্রতিমা বাস্তবিকই জীবন্ত জ্যোতির্ময়ী হইয়া যেন হাসিতেছেন। আর ঐ প্রতিমাতে মা-র আবেশ ও ঠাকুরের দেবদুর্লভ শরীর-মনে মা-র আবেশ একত্র সম্মিলিত হওয়ায় পূজার দালানের বায়ুমণ্ডল কি একটা অনির্বচনীয়, অনির্দেশ্য সাত্ত্বিক ভাবপ্রকাশে পূর্ণ বলিয়া অতি জড়মনেরও অনুভূতি হইতেছে। দালান জম জম করিতেছে—উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। … সর্বত্র যেন সেই অদ্ভুত প্রকাশে অপূর্ব শ্রীধারণ করিয়াছে।’’
সপ্তমী পূজান্তে মথুরবাবু সস্ত্রীক পদ্ম, কুমুদ, জবা ও বিল্বপত্র দিয়ে মহামাতৃকা মহিষাসুরমর্দিনী ও শ্রীরামকৃষ্ণের রাজীব চরণে বার বার পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করে ধন্য হলেন। সন্ধ্যায় মায়ের আরতির প্রস্তুতি শুরু হল। মথুরবাবুর দেওয়া সুন্দর গরদের চেলি মেয়েদের মতো করে পরে ঠাকুর তখন বসে আছেন অন্দরমহলে। জগন্মাতার সহচরী ভাবে উদ্দীপিত হয়ে দক্ষিণেশ্বরের পূজারি ঠাকুর নিজের পুরুষ শরীরের কথা আক্ষরিক বিস্মৃত হয়ে গেছেন। তাঁর দিব্যপ্রভা, প্রেমাবেশ ও সাত্ত্বিক বিকার যেই দর্শন করে কেউই আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। ওদিকে মা দুর্গার আরতি শুরু হয়েছে। জগদম্বা দেবী শ্রীরামকৃষ্ণকে রমণী বেশে নিয়ে এলেন পুজোমণ্ডপে। সেখানে ঠাকুর কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে অন্যান্য মেয়ের সঙ্গে চামর ব্যজন করতে লাগলেন সহর্ষে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। ধূপ, দীপ, ধূনা প্রজ্বলিত হওয়ায় মাতৃমন্দির সৌরভে আমোদিত। সে আরতি দেখতে সকলে ভক্তিভরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ মথুরবাবুর চোখে পড়ল তাঁর স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সুন্দর বস্ত্র পরিহিতা সালংকারা এক অনিন্দ্যকান্তি মহিলা চামর দোলাচ্ছেন, কিন্তু বার বার সেই ভাবময়ীকে দেখেও তিনি চিনতে পারলেন না। আরতির পর মথুরবাবু অন্দরমহলে গিয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন; ‘‘আরতির সময় তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যে চামর দোলাচ্ছিলেন, তিনি কে?’’ জগদম্বা হেসে বললেন – ‘‘তুমি চিনতে পারলে না? ‘বাবা’ ভাবাবস্থায় এভাবে চামর করছিলেন। মেয়েদের মতো কাপড় পরলে বাবাকে পুরুষ বলে চেনে কার সাধ্য?’’ এভাবে উৎসব মুখরিত সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর দিনগুলিও সার্থক হয়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দিব্য উপস্থিতিতে। এবার বিজয়া দশমী। বিষাদের ছায়ার মধ্যে বিসর্জনের আয়োজন। সেবার দশমী খুব কম সময় থাকায় নির্দিষ্টকালে দশমীবিহিত পুজো শেষ করে সন্ধ্যার পর হবে দুর্গা প্রতিমা নিরঞ্জন। বিকেলে পুরোহিত মশাই মথুরবাবুর কাছে বলে পাঠালেন, মায়ের বিসর্জন যাত্রার আর দেরি নেই, বাবু যেন নীচে নেমে এসে দুর্গা-বন্দনা ও প্রণাম করে যান। একদিকে দশভুজার মহাপুজোর অনির্বচনীয় আনন্দ, অপরদিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কয়েক দিনের উপস্থিতিতে তাঁর সান্নিধ্য লাভ – এই অভাবনীয় আনন্দে বিহ্বল ও আত্মহারা মথুরমোহন সেদিন যে বিজয়ার বিসর্জন সে-কথা অবলীলাক্রমে ভুলেই গিয়েছিলেন। পরে যখন বুঝে উঠলেন যে সেদিন বিজয়া দশমী, তখন নিরাশ আর মনোবেদনায় মুহ্যমান মথুরনাথ। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন মাকে আর বিসর্জন দিয়ে দুঃখ ডেকে আনবেন না। রাজামশাইয়ের দু’চোখ বেয়ে নামে অবিরত অশ্রুর ঢল। এদিকে বিসর্জনের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পুরোহিত মশাই বার বার লোক পাঠিয়েও বিফল হলেন। তখন মথুরবাবু বলে উঠলেন, ‘‘আমি মাকে বিসর্জন কিছুতেই দিতে দেব না। যেমন পুজো হচ্ছে তেমনই পুজো চলবে। আমার অননুমোদনে কেউ যদি প্রতিমা বিসর্জন দেয়, তাহলে সাংঘাতিক বিপত্তি দেখা দেবে, খুনোখুনি পর্যন্ত হতে পারে।’’ এই বার্তা গিয়ে পৌঁছাল দুর্গা দালানে। বাড়িতে সম্মাননীয়রা তখন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, সবাই এসে গৃহকর্তাকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। মথুরবাবু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে বরং উল্টে বললেন, ‘‘কেন? আমি মা’র নিত্যপুজো করব। মা’র কৃপায় আমার যখন সে ক্ষমতা আছে, তাহলে বিসর্জনই বা দেব কেন?’’ উপায়হীন হয়ে তখন মথুর-গৃহিণী জগদম্বা দেবী শ্রীরামকৃষ্ণের শরণাগত হলেন। ঠাকুর মথুরবাবুর কাছে গিয়ে দেখলেন, চোখ লাল করে গম্ভীর মুখে উদাস হয়ে মথুরনাথ ঘরের ভেতর পায়চারি করছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরের বুকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘‘ও এই তোমার ভয়। একথা কে বলল যে, মাকে ছেড়ে তোমাকে থাকতে হবে? আর বিসর্জন দিলেও তিনি বা যাবেন কোথায়? মা এই তিনদিন ঠাকুর দালানে বসে তোমার পুজো নিয়েছেন। আজ থেকে তোমার আরও কাছে থেকে সর্বদা হৃদয়ে বসে তোমার পুজো নেবেন।’’ অবশেষে ঠাকুরের স্পর্শানুভূতি ও মধুমাখা কথায় মথুরবাবু দমিত হলেন। রাজি হলেন তিনি মাকে বিসর্জন দিতে।
‘আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের দশমী তিথি’তে শ্বশুরবাড়ি কৈলাসে পাড়ি দেন দেবী দুর্গা। বিষাদের সুরেই সেইদিনে ‘বিজয়া’ পালন করেন মর্ত্যবাসী। কেন এমন রীতি, তার পৌরাণিক ব্যাখ্যায় নানা কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণে কথিত আছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ও ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর ‘দশম দিনে’ জয় লাভ করেন দেবী দুর্গা। সেই জয়কেই চিহ্নিত করে ‘বিজয়া দশমী’। তবে উত্তর ও মধ্য ভারতে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য ভিন্ন। ‘বাল্মীকি রচিত রামায়ণে’ কথিত আছে, ‘আশ্বিন মাসের শুক্লা পক্ষের দশমী তিথিতেই নাকি রাবনকে বধ করেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র’। তাই এই দিনটিকে ‘দশেরা’ বা ‘দশহরা’ হিসেবে পালন করেন ‘উত্তর ও মধ্য ভারতের মানুষ’। আবার ‘কালিদাসের রঘুবংশ’ ও ‘তুলসিদাসের রামচরিতমানসে’ বলা হয়েছে যে আশ্বিনের তিরিশতম দিনে লঙ্কা জয় করে সস্ত্রীক অযোধ্যায় ফিরেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র। সেই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঘরে ঘরে জ্বলেছিল দীপ। সেই রীতিই ‘দশেরা’ ও ‘দীপাবলি’ রূপে পালন করা হয়। দেবী দুর্গার বিদায়ের দিনে বিষাদের সুরেই ‘বিজয়া দশমী’ পালন করে মর্ত্যবাসী। সধবা মহিলারা সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন। আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয় মানবকুল। চলে মিষ্টিমুখ। বিশ্ব সংসারে ‘ঐক্য ও সম্প্রীতির বার্তা’ ছড়িয়ে পড়ে। আর এখানেই বিজয়া দশমীর বিশেষত্ব অন্যরকম বলে মনে করা হয়। আবার ‘মহাভারতে’ কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমীতেই ‘পাণ্ডবরা’ শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।
পুরাণ মতে, ‘অপরাজিতা আরাধনা’ দুর্গাপুজোরই অন্য অঙ্গ। কারণ, ‘ঊমা’ তথা দুর্গার অন্য নামই নাকি ‘অপরাজিতা’। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম। অপরাজিতা ‘চতুর্ভূজা’। হাতে ‘শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা শোভিত’, ‘ত্রিনয়না’ ও মাথায় ‘চন্দ্রকলা’ সম্বলিত এই দেবী ‘নীল বর্ণা’ বলে পুরাণে কথিত। দেবী দুর্গার বিসর্জনের পর পুজো মণ্ডপের ইশান কোণে ‘অষ্টদল পদ্ম’ এঁকে অপরাজিতা লতা রেখে পুজো করা হয়। দুর্গা পূজার শেষ দিন হিসেবে বিজয়া দশমী পূর্ব ভারতে শোকাবহ হলেও শাস্ত্রে বিষয়টিকে সেইভাবে দেখা হচ্ছে না। ‘প্রাধানিক রহস্য’ গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হয়েছে ‘‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব …।’’ অর্থাৎ যিনি ‘নিরাকার’, তিনিই ‘সাকার’। দেবী সাকার রূপে মর্ত্যে পূজা গ্রহণ করেছেন, তারপর নিরাকার রূপে ফিরে গিয়েছেন কৈলাসে। তার অর্থ সন্তানের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ নয়। মা-সন্তানের চিরমিলনের এই শাস্ত্রীয় তত্ত্বই প্রাঞ্জলভাবে মথুরবাবুকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ।
এই বিজয়া দশমীতে দেবী সপরিবারে ফিরে যাবেন কৈলাসে। মাকে প্রদক্ষিণ করা সন্তানের স্বাভাবিক রীতি। মা আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারবেন না। এই আমাদের আকাঙ্ক্ষা। প্রদক্ষিণ করে ভক্তরা স্তব করতে থাকে,
‘‘দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, তুমি শিবা অর্থাৎ মঙ্গলকারিণী।’’
তুমি বিশ্বের ‘ঈশ্বরী’, ‘সর্বদেবময়ী’। তুমি সকল ভয় ও রোগ হরণকারিণী। তুমি ঔষধিরূপে সকল রোগ নাশ করে থাক।তুমি ‘যোগমায়া’, তুমি দুঃখময় সংসার সমুদ্র পার করে দাও। আয়ু, আরোগ্য, বিজয় দাও। তোমাকে নমস্কার। ভূত, প্রেত, পিশাচ, রাক্ষস, দেবতা, মানুষ, সকলের ভয় থেকে সর্বদা আমাদের রক্ষা কর। তোমার নাম ‘ভগবতী’, তুমি ভয় দূর কর। তোমার নাম ‘কাত্যায়নী’, তুমি বাসনা পূরণ কর। তুমি সন্তানকামীকে সন্তান দান করে থাক। উগ্র তোমার রূপ, তুমি সর্বত্র জয় দান কর। তুমি ‘বিজয়া’।
‘‘দুর্গোত্তারিণী দুর্গে ত্বং সর্বাশুভবিনাশিনী। ধর্মার্থকামমোক্ষায় নিত্যং মে বরদা ভব। …’’
তুমি সকল ‘অশুভবিনাশকারিণী’, ‘ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের বরদানকারিণী’। মহিষাসুর আজ তোমার হাতে নিহত।তুমি আমাদের প্রতি প্রসন্ন হও। আমাদের পাপ হরণ কর, ক্লেশ হরণ কর, অশুভ হরণ কর, রোগ হরণ কর, ক্ষোভ দূর কর।তুমি যাঁর মাথায় তোমার কল্যাণহাত রাখ, সে প্রভুত্ব লাভ করে। শক্তিহীন, গুণহীন, সত্যাচারবর্জিত মানুষ তোমার কৃপায় পৌরুষ লাভ করে। ক্ষুধা, পিপাসা, আর্তি তুমি নাশ কর। তোমাকে পূজা করে আমরা ধন্য। আমরা কর্তব্য শেষ করেছি, সফল আমাদের জীবন। হে দুর্গে, ‘মহেশ্বরী’, তুমি এসেছ,অর্ঘ্য, পুষ্প, নৈবেদ্য, মালা গ্রহণ করে আমাদের কল্যাণ করো। আয়ু, যশ, ভাগ্য, ভক্তি, জ্ঞান, সকল আমাদের হোক। তোমার কৃপায় আমাদের বার্ষিক পূজা সাঙ্গ হোক। মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন, ভক্তিহীন আমরা, তোমার কৃপায় সব পূর্ণ হোক।তোমার আবাহন জানি না, বিসর্জন জানি না, পূজার ভাবও জানি না, তুমিই আমাদের গতি। হে জননী, পুত্র-আয়ু-ধন বৃদ্ধির জন্য তোমার পূজা হল। আজ দশমীতে পূজাশেষে যেখানে ‘নিরাকার পরমব্রহ্ম’ আছেন সেখানে তুমি যাও। আমাদের সুখ দান করার জন্য আবার এস, শত্রুর দর্প বিনাশ করার জন্য পুনরায় আগমন কর। আমাদের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে তুমি নিজের স্থানে যাও। এক বছর গেলে তুমি আবার এস। ‘জয়ন্তী বৃক্ষে’ তোমার পূজা হল, তুমি সর্বত্র আমাদের জয়ী কর। তুমি সংসার-বন্ধনমুক্তির জন্য কৃপা কর। ‘অশোক বৃক্ষে’ তুমি ছিলে। তুমি আমাদের শোকরহিত কর। ‘মানবৃক্ষে’ তোমার পূজা হল, তুমি আমাদের সর্বত্র মান ও সুখ দাও।ধানরূপে তোমার পূজা হল, তুমি লোকের প্রাণ ধারণ কর, আমাদের প্রাণে শান্তি দিয়ে প্রাণ ধারণ করাও। হে পরমেশ্বরী, আমরা তোমার দাস। জ্ঞানভক্তি বৃদ্ধির জন্য তোমাকে জলে স্থাপন করা হলো। দশমীতে এই কারনেই জলে বিসর্জন। প্রতিমা থেকে ঘটে, এবং ঘট থেকে ভক্তের হৃদয়ে। ভক্তের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি তাদের অসুরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করবেন।
মা’কে হৃদয়ে অনুভব করে আনন্দে ভক্তরা পরস্পর কোলাকুলি করে। পরস্পর আপন বোধ করে। এত দিন অন্তরে হিংসা, গর্ব, নিন্দা, ক্রোধ নামক ‘অসুর’ থাকায় সকলকে আপন বোধ করতে পারেনি। এবার সেসব অসুর ধ্বংস হল মায়ের কৃপায়। সমস্ত ভেদ উঠে গেল। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন, ‘‘ভক্তিতে সব জাতিভেদ উঠে যায়। ভক্তের কোনও জাত নেই।’’ তাই সকলেই আমরা আপন। বিজয় হল আসুরিক শক্তির ওপর দৈব শক্তির। মা দুর্গার নামও তাই ‘বিজয়া’। বিসর্জন ও বিজয়ার তাৎপর্য বুঝে ভক্তের মনের শোক কেটে যায়। মায়ের পূজার বিসর্জনমন্ত্রেও বলা হয়,
‘‘ওঁ গচ্ছ দেবি পরং স্থানং যত্র দেব নিরঞ্জনঃ।
অস্মাকং তু সুখং দত্তা পুনরেস্যসি সর্বদা।’’
তুমি নিরাকার স্বরূপে ফিরে যাও। সব সময় তুমি অবশ্য আসবে আমাদের আনন্দ দিতে। কাম, ক্রোধ, লোভ নামক শত্রুর দ্বারা সব সময়ই মানুষ আক্রান্ত।
মায়ের নিজ স্থান ভক্তের হৃদয় মন্দিরে। ভক্ত নিজ হৃদয়েই মাকে ফিরে যেতে অনুরোধ জানায়।
‘‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ পরে স্থানে স্বস্থানে পরমেশ্বরী।
যত্র ব্রহ্মাদয় সর্বে সুরাস্তিষ্ঠন্তি মে হৃদি।’’
অর্থাৎ, ‘‘হে মা, তুমি আমার হৃদয়েই থাক, যেখানে ব্রহ্মা এবং সব দেবতা বিরাজ করেন।’’
বিজয়ায় বিসর্জন মাকে ত্যাগ নয়, ‘বিশেষরূপে অর্জন’। এই কদিনের পূজাশেষে যে জ্ঞান অর্জিত হল, তা হচ্ছে, মা স্বস্থানে কৈলাসে ফিরে গেলেন। এ অবস্থায় মা নিরাকারা। চর্মচক্ষের বাইরে চলে গেলেন। ‘‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব …।’’ (প্রাধানিক রহস্য-২৯, চণ্ডী)
আবার মা সন্তান তথা আমাদের কল্যাণে আবারও আসবেন বছরান্তে রূপাধারে। এভাবে মা ভক্তের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অবস্থান করবেন। এ প্রতিষ্ঠাই আমাদের জ্ঞানার্জন। বিসর্জন অর্থে আত্মপ্রতিষ্ঠ। বিজয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জ্ঞান অর্জন দেবী দুর্গাকে কেন্দ্র করে। এ শুভদিনে ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পণ্ডিত-মূর্খ, উঁচু-নিচু বিচার না করেই সকলে একাত্মবোধে আবদ্ধ। সকল ক্ষুদ্রতা ও পাশবিক বৃত্তির অবসান ঘটিয়ে আজ ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সহাবস্থানের ভাবনা জাগ্রত হয়ে মানবকল্যাণে সকলে ব্রতী। দুর্গাপূজার বিজয়ার তাৎপর্য এটাই। বিজয়ার শুভ এই দিনে দুঃখ নয়, বেদনা নয়, সকলে আনন্দে মুখরিত এবং সকলের মধ্যে প্রেমের বন্ধনে আকৃষ্ট। এই দিনে পাড়া-পড়শি সকলকে নিয়ে প্রেমালিঙ্গন একটি বিশেষ দিগ্দর্শন। তাই ভক্ত আকুতিতে প্রার্থনা জানায়,
‘‘ওঁ দেবী ত্বং জগতাং মাতঃ স্বস্থানং গচ্ছ পূজিতে।
সংবত্সর ব্যতিতে তু পুনরাগমনায় চঃ।’’
অর্থাৎ, ‘‘হে দেবী, জগজ্জননী, পূজিতা হয়ে তুমি নিজ স্থানে গমন কর এবং এক বছর পরে আবার তুমি অবশ্য আসবে।’’
দুর্গাপূজায় এক আধ্যাত্মিক ভাব নিহিত। দেবীর পূজায় লাভ হয় ভুক্তি ও মুক্তি উভয়ই। পার্থিব সুখ-সমৃদ্ধির মধ্যে মানুষ খোঁজে ভুক্তি বা ভোগের বস্তু। আর পারমার্থিক চেতনার মধ্যে মানুষ পায় সত্যিকারের শান্তি ও মুক্তি। জীব ‘সত্ত্ব’, ‘রজঃ’ ও ‘তমঃ’ এই তিন গুণের অধীন। ‘সত্ত্ব’ – ‘জ্ঞানাত্মক বা প্রকাশস্বরূপ’, ‘রজঃ’ – ‘রাগাত্মক বা আসক্তি ও বিদ্বেষমূলক’, ‘তমঃ’ – ‘মোহ উৎপাদক’। ‘সত্ত্বগুণময়ী দেবী’ স্বয়ং নিয়ন্ত্রণ করছেন রজোগুণের প্রতীক রাগ-দ্বেষযুক্ত মনরূপ সিংহকে। সিংহ শাসন করছে তমোগুণরূপী অসুরকে। এই গুণময়ী দেবীই স্বরূপত ‘ব্রহ্মচৈতন্যময়ী মহাশক্তিরূপে’ বিভাসিতা। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুরই নিয়ন্ত্রী শক্তি। এই হলো দেবীপূজার ‘পারমার্থিক তত্ত্ব’। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরা অন্তরে সর্বদা একটা সংগ্রাম অনুভব করি। এ সংগ্রাম শুভ ও অশুভের। রজঃ ও তমঃ থেকে দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ প্রভৃতি অজ্ঞানবাচক গুণ উৎপন্ন। অপরদিকে সত্ত্বগুণ থেকে উৎপন্ন তপস্যা, স্বাধ্যায়, দম, শৌচ, তিতিক্ষা, অহিংসা, সত্য, ত্যাগ, ক্ষমা, ধৃতি, দয়া ইত্যাদি জ্ঞানলাভের সহায়ক। মহাদেবী দুর্গার পূজায় আমাদের একমাত্র প্রার্থনা হবে আসুরিক ও পাশবিক বৃত্তিগুলোকে পরাভূত করে আমাদের অন্তরদেবতাকে জাগ্রত ও সংগ্রামমুখী করে তোলা। দেবী দুর্গার পূজার এ এক তাৎপর্য। কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই, কী দিয়ে শত্রু নাশ করব – এ প্রশ্ন আমাদের। কিন্তু মায়ের কৃপা হলে আমরা বিবেক, বৈরাগ্য এবং জ্ঞান-অসি দিয়ে সকল শত্রু নাশ করতে পারব। আসলে মায়ের হাতের অস্ত্রগুলো ‘জ্ঞান-অসির প্রতীক’। শুভবুদ্ধি ও জ্ঞানার্জনে পশুভাবের নাশ হয়। সর্বশক্তিরূপিণী ও সর্ববীর্যের উৎসরূপা জগজ্জননী দুর্গার আরাধনায় সব মালিন্য থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর কৃপায় আমাদের শুভবুদ্ধির দীপশিখাটি প্রজ্বলিত রাখতে পারলেই স্বার্থক হয় দেবী দুর্গার পূজা।
সনাতন ধর্ম বিশ্বাস করে, মানুষের দেহ পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি। যথা – ‘আকাশ’, ‘বায়ু’, ‘অগ্নি’, ‘জল’ ও ‘মাটি’। তাই মৃত্যুর পর এই দেহ আগুনে দাহ করা হয় অথবা মাটি দেওয়া হয়। যে উপাদান দিয়ে এই দেহ তৈরি, মৃত্যুর পর আবার সেই একই উপাদানে মিশে যায়। ঈশ্বর সর্বত্রই বিরাজিত। প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি প্রাণীর মধ্যই তিনি আছেন। তবে, পঞ্চ উপাদানে গড়া এই মানব দেহের প্রতীকী হিসেবেই আমরা পূজার সময় প্রতিমা তৈরি করি মাটি দিয়ে। পরবর্তীতে সেই মাটির প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করি। এই প্রতিমা পূজার সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে বিসর্জন। জলের মাধ্যমেই যেন মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়, সেই জন্যই আমরা জলে প্রতিমা বিসর্জন দেই। আমাদের হৃদয়ে যে নিরাকার ঈশ্বর রয়েছে, উপসনার নিমিত্তে মাটির প্রতিমা তৈরি করে তাঁকে ‘সাকার রূপ’ দেওয়া হয়। পূজা শেষে পুনরায় সেই ‘সাকার রূপ’কে বিসর্জন দিয়ে নিরাকার ঈশ্বরকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া হয়। সেই কারণেই দুর্গা পূজার সময় যখন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তখন মায়ের প্রতি আমাদের প্রার্থনা থাকে, “মা, তুমি আবার এসো আমাদের মাঝে। এই একটি বছর তুমি থাকবে আমাদের হৃদয়ে । আবার, বছর পরে তোমার প্রতিমা গড়ে আমরা সাড়ম্বরে তোমার পূজা করবো।” যে জন্ম নিয়েছে, তাঁর মৃত্যু অনিবার্য। এটাই প্রকৃতির শাশ্বত নিয়ম। ঠিক তেমনি যাঁকে আবাহন করা হয়, তার বিসর্জনও অনিবার্য। বিসর্জনের মাধ্যমেই ‘পুনরায় আগমনের’ আশা সঞ্চারিত হয়। এই সকল কারনেই আমরা প্রতি বছর হৃদয়স্থ ঈশ্বরের মাটির প্রতিমা গড়ে তাঁকে বাহ্যিক ভাবে পূজা করি এবং পূজা শেষে বিসর্জনের মাধ্যমে তাঁকে আবার হৃদয়ে স্থানাতরিত করি। এটিই প্রতিমা পূজা ও প্রতিমা বিসর্জনের মূল তাৎপর্য।
‘‘জয়ন্তী জয়দে লোকে সর্বলোক জয়প্রদে।
কৃপাং কুরুস্ব দেবী ত্বং সংসার বন্ধ মোক্ষণে।।’’
আমরা সহস্র সহস্র বছর ধরে বিশ্বাস করে আসছি মা আমাদের ‘বিজয়দাত্রী’। মায়ের কৃপা হলেই জয় পাব, ‘জয়ন্তী’, ‘জয়দাত্রী’, ‘বিজয়া’ মায়ের নাম। বিজয়া’ অর্থাৎ – ‘বি-জি+অচ্ স্ত্রিয়ামটাপ’। ‘জি’ ধাতুর অর্থ ‘জয়’, ‘বি’ উপসর্গের যোগে ‘বিজয়’, মানে ‘বিশেষ রূপে জয়’। স্ত্রীলিঙ্গে ‘বিজয়া’, কারণ ‘বিজয়া’ একটি ‘তিথিবিশেষ’। পুরাকালে রাজারা এই তিথিতে ‘যুদ্ধযাত্রা’ করতেন। কারণ এদিন যাত্রা করলে নাকি ‘জয়’ অবধারিত। ‘মহাবলী পদ্ম’ নামে দৈত্যকে পরাজিত করে দেবী হন ‘বিজয়া’, সুরগণকে পরাজিত করে তিনি হয়েছিলেন ‘বিজয়া’। বিজয়ার অন্য অর্থ হল ‘পীযূষরূপা’। সমুদ্র মন্থনকালে উত্থিত অমৃতের আর এক নাম ‘বিজয়া’। ‘অমৃত’ হল ‘মানুষের শুভশক্তি ও শুভবুদ্ধি’। ‘বিজয়’ উৎসব হল তারই প্রতীক। রাম রাবণকে যুদ্ধে পরাজিত করে – ‘বিজয় উৎসব’ পালন করেছিলেন এই দিনে। আবার মায়ের বিসর্জনের তিথিও হল এই ‘বিজয়া দশমী তিথি’।
সেকালের বিজয়ার সূচনা হ’ত আনন্দঘন মুহূর্ত আর বেদনার মিশ্রণে। মা এসেছেন চার দিনের জন্যে বাপের বাড়ি। বিজয়ার দিন সব অন্ধকার করে তিনি ফিরে যাবেন পতির কাছে। তাই সবার চোখে জল। রাত পোহালেই দশমী। কবি মেনকার কথায় গেয়ে ওঠেন – ‘‘নবমী নিশি পোহাইও না’’, কখনও বা বলেছেন ‘‘এবার আমার ঊমা এলে আর মাকে পাঠাব না।’’
বড় গামলায় হলুদ জল গোলা রাখা হত, তাতে ‘দর্পণ’ দিয়ে তার ভেতর দিয়ে বাড়ির সকলে দেখতেন মায়ের চরণ-যুগল। এবার মায়ের যাত্রাকাল উপস্থিত। উপস্থিত আত্মীয়া, বাড়ির বয়স্কা মহিলা এয়োতিরা সকলে এগিয়ে আসতেন মাকে বরণ করে বিদায় জানাতে। তাঁদের হাতে থাকত শাঁখ, বরণডালা, মিষ্টি, জল, কনকাঞ্জলির চালের থালা। মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে দিতেন শাঁখা, পলা, লোহা। পাঁচ, সাত, নয় – বিজোড় সংখ্যায় এয়োরা বরণ করতেন উলু দিয়ে। এয়োরা সাজতেন কনের সাজে। গরদের লালপাড় শাড়ি, নাকে নথ, কানে ঝুমকো, গলায় চন্দ্রহার – অল্পবয়সিদের সিঁথিতে টিকলি, সবাই যেন মা দুর্গার এক-একটি রূপ। জমিদার বাড়ির ব্যাপার, পায়ে থাকত রুপোর মল, আর হাত ভরতি চুড়ি, বালা, কঙ্কণ – এমনকী উপর হাতে থাকত তাগা। অবশ্যই সোনায় মোড়া প্রতিমার মতো। মায়ের সিঁথিতে ও পায়ে সিঁদুর দিয়ে বরণ শেষ হ’ত – ঢাক, কাঁসর, শাঁখ আর উলুধ্বনির মাধ্যমে। এবার বাড়ির কর্ত্রী মাকে মিষ্টি খাওয়াবেন, জল খাওয়াবেন, শেষে পানের খিলি হাতে গুঁজে দেবেন। বিদায়ক্ষণটা হয়ে উঠত স্বর্গীয়। ঢাকি ঢাকে বোল তুলত –
‘‘মা থাকবে কতক্ষণ
মা যাবে বিসর্জন।’’
এরপর শুরু হ’ত সিঁদুর খেলা। দোলের মতো ছোটখাট একটা অনুষ্ঠান। মায়ের বিদায় ব্যথা কিছুক্ষণের জন্যে ভুলে সবাই মেতে উঠত আনন্দে। কুলি ভাড়া করা হ’ত। দুটো বাঁশের ওপর মার মূর্তি তোলা হ’ত। আগাগোড়া কাঁধে করে যেতেন মা। শোভাযাত্রা হ’ত দেখার মতো। বিলিতি ব্যান্ড, তাসা, সানাই, কী না থাকত। পিছন পিছন যেতেন প্রজারা, আত্মীয়রা – বাড়ির যুবা পুরুষ। মেয়েদের কোনও স্থান ছিল না। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বাড়ির ছেলেরা যেতেন। কর্তার হাতে থাকত মঙ্গলঘট।
অনেকসময় তা বহন করতেন পুরোহিত। ধুনুচি নৃত্য চলত, চলত দামি দামি আতসবাজি। মায়ের দুপাশে বড় বড় চামর দিয়ে হাওয়া করত বাড়ির কাজের লোকেরা। চতুর্দিকে জ্বলত হ্যাজাক আর গ্যাসের আলো। পথটা হয়ে উঠত দিন। মায়ের বিসর্জন হলে মঙ্গলঘটে জল পূর্ণ করে সবাই ফিরে আসতেন বাড়িতে। মঙ্গলঘট রাখা হ’ত বেদিতে বড় পিলসুজে জ্বলত প্রদীপ, শান্তির জল ছিটিয়ে দেওয়া হ’ত। ছোট ছোট কলাপাতায় লাল কালিতে ডুবিয়ে খাগের কলম দিয়ে লেখা হ’ত শ্রীদুর্গা নাম। সকাল থেকেই বাড়িতে ভিয়েন বসত। গামলা গামলা রসের মিষ্টি, সন্দেশ, নারকেল নাড়ু, বড় বড় নিমকি তৈরি হ’ত। আর একটি বিশাল পাত্রে বড় বড় গ্লাসে তৈরি করে রাখা হ’ত সিদ্ধি। যেখানে যতজন থাকতেন পেটপুরে তাঁরা খেতেন মিষ্টি নোনতা আর সিদ্ধি। প্রজারা আসত দেখা করতে, সকলকে দেওয়া হ’ত মিষ্টির সঙ্গে টাকা। জমিদার বাড়ি ছাড়াও এই প্রথাটা কম-বেশি বড় বড় আমলাদের ঘরেও হ’ত। অবশ্যই খাবার আগে প্রণামের পালা চলত, চলত কোলাকুলি – পূর্বপুরুষদের ছবিতে প্রণাম।
একালের বিসর্জনের ছবিটা একটু নয় অনেকটা আলাদা। বর্তমানের বনেদি বাড়িতে পুরনো ঐতিহ্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে তার সমারোহ হয় সামান্য নিয়মরক্ষার মতো। যাঁরা বাড়ির লোক আত্মীয় তাঁদের জন্য লুচি আর মোহনভোগ রাখা হ’ত। তবে তা খুবই সামান্য। এখন দুর্গানাম লেখা হয় সাদা কাগজে। তাও বারোয়ারি পূজায় এসব কিছুই হয় না। অবশ্যই পাড়ার বউ-ঝিরা এসে বরণ বা কনকাঞ্জলির ব্যবস্থা করেন, তবে তাতে প্রাণের ছোঁয়ার থেকেও কর্তব্য আর সংস্কার মিশে থাকে। থিমের পূজায় আর্টের সমারোহ। কিন্তু প্রতিমার দিকে তাকিয়ে মন আনচান করে না। বিসর্জনের পর মাকে বিসর্জন না দেওয়া মানে পূজার অঙ্গহানি। কিন্তু এখন তাই ঘটছে। দিনের পর দিন প্রতিমা পড়ে থাকছেন প্যান্ডেলে। নিয়মরক্ষে মতো হয়তো প্রদীপ জ্বালা আরতির ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু তা করেন কোনও ভারপ্রাপ্ত পুরোহিত। তবে বিসর্জনের ঘটা এখন কিছু কম নয়। বড় বড় আলো দিয়ে জেনারেটার দিয়ে – নানারকম ব্যান্ডের বাজনা দিয়ে বিসর্জন যাত্রা করা হয় – কিন্তু শব্দবাজি আর নাচ দর্শনীয় হয়ে ওঠে, মন কাড়ে না। বিজয়ার পর প্রণাম প্রায় নেই বললেই চলে। সময়ের অভাব, ইচ্ছার অভাব, ব্যস্ততার অজুহাতে ফোনেই সব সারা হয়। কেউ কারও বাড়ি মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছে এমন উদাহরণ কম। কারণ সেই আন্তরিকতাটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সবাই মিলেমিশে থাকার সেই আনন্দটাই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্যই অনেক ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। বিজয় দশমীতে দুই বাংলায় দুটি বিপরীত প্রথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গে দশমীপুজোয় দেবীকে দেওয়া হত ‘দধিকর্মা’। পূর্ববঙ্গে দেওয়া হত ‘পান্তাভাত আর কচুর শাক’।
আমরা হয়তো মনে করি নাচগান করতে করতে প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে যাওয়া হয়তো একালেই হয়েছে, কিন্তু না, এই প্রথা বহু পুরনো। যার উল্লেখ আছে ‘জীমূতবাহনের’ ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে। শবরজাতির মতো সারা দেহকে লতাপাতা দিয়ে সাজিয়ে, সারা গায়ে কাদা মেখে নাচ-গান করা হতো বলেই বিজয়া দশমীর এই উৎসবকে বলা হতো ‘শবরোৎসব’। শুধু নাচ-গানই নয়, গ্রাম্যভাষায় একে অন্যকে গালমন্দ করাও এই শবরোৎসবের অঙ্গ। শোভাযাত্রায় অনেক সময় ‘খাস-গেলাস’-এর ঝাড় হতো। মাটির ছোট ছোট মোমবাতি রাখার একরকম বাতিদান হতো, তার মাঝখান থেকে উপর-নীচে দুটো এক ইঞ্চি করে চোঙা থাকত। অভ্রর গেলাস তৈরি করে লাল কাগজের পাড় দিয়ে গেলাসটার উপর দিক ও নীচের দিক জুড়তে হতো। দেখতেও বাহারি হতো, আবার অভ্রটাও পড়ে যেত না। সেই অভ্রর গেলাসটা খুরির উপর আঠা দিয়ে বসান হতো। আর তার ভেতর একটি মোমবাতি থাকত এবং এই মাটির খুরিটা একটা বাখারির, ডাল বা ডান্ডার উপর আটকানো হতো। এইভাবে আট বা দশটা ডাল দিয়ে একটা ‘ঝাড়’ হতো। প্রতিমা নিয়ে গঙ্গায় বাইচ খেলানোরও চল ছিল ‘বাবু’দের মধ্যে। বজরার ছাতে শৌখিনবাবুরা খ্যাম্টাউলি ও বাঈজি সঙ্গে নিয়েও প্রতিমা নিরঞ্জনে যেতেন। বিজয়ার দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পর চণ্ডীমণ্ডপে ফিরে পূর্ণ ঘটকে প্রণাম করে ‘শান্তিজল’ নেওয়াই শুধু নয়, সেই সঙ্গে ‘ঘটজল’ ও ‘কাঁচাহলুদও’ খেতে হতো। তারপর হতো শুভ বিজয়ার কোলাকুলি। ছোটরা বিজয়ার দিন পাড়ার বয়স্ক ব্রাহ্মণদের খালি হাতে কিন্তু প্রণাম করতে পারত না, প্রণামী দিতেই হতো। বড়রা সে প্রণামী যেমন নিতেন, তেমনি ছোটদের হাতে তুলে দিতেন নারকোল-ছাবা ও অন্যান্য নারকোলের মিষ্টি। বিজয়ার কোলাকুলিতে এবং প্রণামে ছানার মিষ্টি খাওয়ার নিয়ম ছিল না। কলাপাতায় ‘দুর্গানাম’ লিখতে হতো তারপর, এবং সিদ্ধি মুখে দিতেই হতো সবাইকে। তবেই ঘটত শুভ বিজয়ার পরিসমাপ্তি।
(তথ্যসূত্র:
১- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ, স্বামী সারদানন্দ।
৩- মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, দেব সাহিত্য কুটীর।
৪- দুর্গা পূজা পদ্ধতি, দেবী পুরাণোক্ত, বুক চয়েস।
৫- কালিকাপুরাণোক্ত: শ্রী শ্রী দুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায়, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড।
৬- উদ্বোধন পত্রিকা, অক্টোবর ২০০৭ সংখ্যা।
৭- বর্তমান পত্রিকা, ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সাল।
৮- বর্তমান পত্রিকা, ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৬ সাল।
৯- প্রসঙ্গঃ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, বিনয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, এভেনেল প্রেস (২০১২)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত