একুশের বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই যেন প্রকাশ্যে চলে আসছে বঙ্গ বিজেপির অন্তর্কলহ। একইসঙ্গে মাথাচাড়া দিচ্ছে ভাঙনের সম্ভাবনা। ঘটনার নেপথ্যে দুই বিধায়ক ও এক নেতা যিনি কিনা আবার রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি। দুই বিধায়কের একজন মুকুলপুত্র শুভ্রাংশু রায়, অন্যজন আলিপুরদুয়ার জেলার দুই বিজেপি বিধায়ক উইলসন চম্প্রামারি অথবা মনোজ টিগগার মধ্যে যে কোনও একজন। আর যে নেতা রয়েছেন এই তালিকায়, তিনি আর কেউ নন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিনহা। এদেরকে ঘিরেই এখন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব কার্যত চূড়ান্তভাবে দিশাহারা।
প্রসঙ্গত, দুই দিন আগেই নিজের ফেসবুকে শুভ্রাংশু পোস্ট করেছিলেন যে রাজনীতি থেকে অবসর নিলে কেমন হয়। সেই পোস্টের জেরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছিল রাজ্য রাজনীতিতে। অনেকেই ভেবেছিলেন শুভ্রাংশুর এই পোস্ট আদতে বিজেপি ছাড়ার পূর্ব লক্ষ্মণ। বাস্তবে সত্যিই বিজেপির রাজনীতিতে এখন রীতিমত কোণঠাসা দশা শুভ্রাংশুর। তাঁকে দলের কোনও সভা-সমিতি-মিছিলে বা কর্মসূচীতে ডাকা হয় না। তাঁকে রাজ্য কমিটির সদস্য করা হলেও জেলায় বা স্থানীয় স্তরের বিজেপির ঘরোয়া সভাতেও তাঁকে ডাকা হয়নি।
এমনকী এ কথাও শোনা যাচ্ছে যে এবারে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বীজপুর থেকে আর শুভ্রাংশুকে টিকিট দেবে না বিজেপি। আর এইসব কিছু নিয়েই ক্ষোভ বাড়ছিল মুকুলপুত্রের মধ্যে। তার জেরেই ওই পোস্ট। গতকাল কাঁচড়াপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে একটি সাংবাদিক বৈঠক ডেকেও শেষপর্যন্ত তা আর করেননি মুকুলপুত্র। কিন্তু টিটাগড়ে বিজেপির মিলিছে তাঁর নাম ঘোষিত হলেও সেখানে যাননি শুভ্রাংশু। পরিবর্তে ফের পোস্ট দিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এসব দেখে অনেকেরই ধারনা জল মাপছেন মুকুলপুত্র। বিজেপিতে দর না পেলে ফের তৃণমূলের ফিরে যেতে পারেন তিনি। এমনিতেই দলবদল করলেও খাতায় কলমে তৃণমূল বিধায়ক হিসাবেই রয়ে গিয়েছেন তিনি।
এদিকে উইলসন চম্প্রমারি এক দশকের বেশি সময় ধরে আলিপুরদুয়ার জেলার কালচিনির বিধায়ক। ২০০৯ সালে কালচিনি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থীকে পরাস্ত করে প্রথমবার জয়ী হয়েছিলেন উইলসন। তাঁর সঙ্গে বরাবরই বিমল গুরুং ও রোশন গিরির ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কার্যত সেই সময় তো বটেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও মোর্চা সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হন উইলসন। পরে যোগ দেন তৃণমূলে। কিন্তু পুলিশের কাছে খবর ছিল ডুয়ার্স জুড়ে চোরাই কাঠের কারবার চালাচ্ছেন এই বিধায়ক। তার জেরে তাঁর বাড়ি ও কাঠচেরাই কলে হানা দেন বনদফতরের আধিকারিকেরা। উদ্ধার হয় প্রচুর বেআইনি কাঠ যা মজুত করে রাখা হয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে।
এরপর ২০১৯ সালে উইলসন দিল্লী গিয়ে যোগ দেন বিজেপিতে। এদিকে সেই মামলার জেরে আর মোর্চার শক্তিক্ষয়ে কালচিনিতে ক্রমশ ফিকে হতে থাকে উইলসনের প্রভাব। শোনা যাচ্ছে তিনি আবার তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন দলে ফিরতে চেয়ে। আবার মাদারিহাটের বিজেপি বিধায়ক মনোজ টিগগা খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে ২০১৬ সালে জয়ী হন। কিন্তু কোনওদিনই তাঁকে বিজেপির কোনও কর্মসূচীতে দেখা যায় না। কার্যত একঘরেই করে রাখা হয়েছে তাঁকে। সেই ক্ষোভে এবার দলবদলের কথা শোনা যাচ্ছে এই বিধায়কের জন্য। আগামী দিনে এই দুই বিধাযয়কে রাজ্যের শাসক দলের শিবিরে দেখা গেলে খুব একটা অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
আর দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে গেরুয়া শিবিরে থাকা রাহুল সিনহা বেশ স্বচ্ছ ইমেজের রাজনীতিবিদ। এখনও অবধি কোনও নির্বাচনে যেমন জয়ী হতে পারেননি তেমনি তাঁকে ঘিরে কোনও দুর্নীতি বা বিতর্কও নেই। সাম্প্রতিকালে রাজ্য বিজেপির নেতাদের মতন তাঁকে ভুলভাল বলতে যেমন দেখা যায়নি তেমনি নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতেও তাঁর নাম জড়ায়নি। অথচ তাঁকেই রাজ্য বিজেপিতে কার্যত কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বাতিলের খাতায় চলে গিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে। আর তা নিয়ে রাহুল সিনহাকে ক্ষোভ উগরে দিতেও দেখা গিয়েছে। যদিও এখনও তিনি বিজেপিতেই রয়েছেন, কিন্তু রাহুল সিনহা নিজেই জানিয়েছেন তৃণমূলের দুই হেভিওয়েট নেতা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ফলে সবমিলিয়ে বেজায় অস্বস্তিতে গেরুয়া শিবির।