কিংবদন্তী মান্না দে তাঁকে নিয়ে অনেক বার বলেছেন, “এমন সুরেলা গায়ক আমি কখনও দেখিনি। আমরা নিজের অজান্তে একটু-আধটু বেসুরো ফেলেছি, কিশোর কখনও নয়।”
কিশোর গুরু বলে মানতেন তিনজনকে। কে এল সায়গল‚ হলিউডি গায়ক-অভিনেতা ড্যানি কে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। তাঁর বাড়িতে ঝোলানো ছিল এই তিনজনের বড় বড় পোট্রেট। রোজ সকালে উঠে এই তিনজনকে প্রণাম করতেন কিশোর কুমার। ভারতবর্ষে মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সবচেয়ে বেশি ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জেতার রেকর্ড আজও রয়েছে কিশোর কুমারের দখলে। মোট আটবার এই পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। ‘রূপ তেরা মস্তানা (১৯৬৯)’‚ ‘দিল অ্যায়সা কিসি নে মেরা (১৯৭৫)’‚ ‘খাইকে পান বনারসওয়ালা (১৯৭৮)’‚ ‘হাজার রাহে মুড়কে দেখি (১৯৮০)’‚ ‘পগ ঘুঙরু বাঁধ (১৯৮২)’‚ ‘অগর তুম না হোতে (১৯৮৩)’‚ ‘মঞ্জিলে আপনি জগহ (১৯৮৪)’‚ ‘সাগর কিনারে (১৯৮৫)’। উদ্ভট কাজকর্মের জন্য তাঁর খ্যাতি কিছু কম ছিল না। একবার এক প্রযোজক বেশ কিছুদিন ধরে তাঁর টাকা বাকি রেখে দিয়েছিলেন। সিনেমার নায়ক-গায়ক ছিলেন কিশোর কুমার। তাই রোজ খানিকটা করে গোঁফ আর চুল কামাতে শুরু করেন তিনি। অবশেষে পুরো টাকা মিটিয়ে দেওয়াতে ক্ষান্ত হন কিশোর। আর একবার একটি দৃশ্যে তাঁর গাড়ি চালিয়ে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। সেই মতো ফ্রেম থেকে তো বেরিয়ে গেলেন কিশোর‚ কিন্তু গাড়ি না থামিয়ে সোজা পানভেল অব্দি চলে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ হিসেবে বলেছিলেন ডিরেক্টর তো ‘কাট’ বলেননি। কিশোর কুমারের অন্যতম সুপার হিট ছবি ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ (১৯৫৮)-র অনুপ্রেরণা ছিল তাঁরই বাবার পুরনো একটা ক্রাইশলার গাড়ি। কিশোর ভেবেছিলেন কমার্শিয়ালি ফ্লপ হবে এই ছবি আর তা তিনি ইনকাম ট্যাক্স লস হিসেবে দেখাতে পারবেন। কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে এই ছবি সে বছরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিট হিসেবে সাফল্য পায়। এই ছবিতে ছিলেন তাঁর স্ত্রী মধুবালা এবং বাকি দুই ভাই অশোক কুমার ও অনুপ কুমার। কিশোর কুমার নির্দেশিত ১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘বড়তি কা নাম দাড়ি’ দেখে সত্যজিত রায় বলেছিলেন নিজের সময়কালের থেকে ২৫ বছর এগিয়ে ছিল সে ছবি। চারটি ছবিতে ডিরেক্টর‚ প্রোডিউসার‚ গল্পকার‚ চিত্রনাট্যকার‚ লিরিস্ট‚ মিউজিক ডিরেক্টর‚ অভিনেতা এবং গায়ক এই সবকটি ভূমিকায় একসঙ্গে একা হাতে কাজ করেছেন কিশোর কুমার। সেই ছবিগুলি হলো – ‘দূর গগন কি ছাঁও মে’ (১৯৬৪)‚ ‘দূর কা রাহি’ (১৯৭১)‚ ‘বড়তি কি নাম দাড়ি’ (১৯৭৪) এবং ‘সাবাশ ড্যাডি’ (১৯৭৮)।
এক রিহার্সালের দিন কিশোর কুমারের কোনও পাত্তা নেই! মান্না দে, মহম্মদ রফি চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ রকম করলে রেকর্ডিংয়ের কী হবে? তখন তো আর স্ট্রাক রেকর্ডিংয়ের সিস্টেম ছিল না। যা হবে প্রথম থেকে শেষ একেবারে লাইভ। খুব ভাল রিহার্সাল না থাকলে যেটা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে এই গানটি গাইছেন হিন্দি গানের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। মান্না দে, মহম্মদ রফি এবং কিশোর কুমার। খুবই বিরল ঘটনা। ছবির নাম ‘চলতি কা নাম জিন্দেগি’। খুব খটোমটো গান। মান্না দে এবং মহম্মদ রফি নিয়মিত প্র্যাকটিস করছেন। রফিসাব একসময় বিরক্ত হয়ে বললেন, “কিশোর গানটা ঝুলিয়ে দেবে। গট আপ ছাড়া এ গান হয় নাকি?” মিউজিক ডিরেক্টরকে কমপ্লেন করে কোন লাভ নেই, কারণ সুরকারের নামও যে কিশোর কুমার। রেকর্ডিংয়ের দিন যথাসময়ে কিশোর কুমার উপস্থিত। কোনও টেনশন নেই। হাসি মজা করছেন। যত টেনশন বাকি দু’জনের। ভাল ভাবে রেকর্ডিং হয়ে গেল ‘বন্ধ মুঠি লাখ কি’। মান্না দে ও মহম্মদ রফি মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন, কি গানটাই না গাইল কিশোর কুমার! মনে মনে একটা কথাই ভাবছেন, বিনা রিহার্সালে এমন গান গাওয়া কেবল কিশোরের পক্ষেই সম্ভব!
খানিকটা এমন ঘটনা ঘটেছিল ‘পড়োশন’ ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘এক চতুর নার করকে শৃঙ্গার’-এর রেকর্ডিং যখন হয়। সব কিছু ঠিকঠাক। রেকর্ডিংয়ের আগের দিন কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন, এই গান তিনি কিছুতেই গাইবেন না। মান্না দে-র সঙ্গে ডুয়েট গান। মান্না দে খুব চেপে ধরতে বললেন, “কী করে গাইব বলুন তো? আমি কি আপনার মতো ক্ল্যাসিকাল জানি? পঞ্চম ঢেলে সব কাজকর্ম করে দিয়েছে!” আরও জোরাজুরি করতে বললেন, “তা ছাড়া কেমন যেন শুনছিলাম, কম্পিটিশনে আমি হেরে যাব!” তারপরেই জিভ কেটে বললেন, “আপনার কাছে হারতে আমার আপত্তি নেই মান্নাদা!” এই গানের প্রসঙ্গ উঠতেই শ্রদ্ধেয় মান্না দে বলতেন, “কি গানটাই না গাইল কিশোর! এমন ইম্প্রোভাইস করল ভাবাই যায় না!”
‘এনসেকট্রিক জিনিয়াস’। কারও মতে তিনি ‘মূর্তিমান পাগল’। আর পাগলামিই তো জিনিয়াসের লক্ষণ। এই জন্যই তাঁর সম্পর্কের অমোঘ উক্তিটি করা যায়,
‘‘ইন এভরি লুনাটিক, দেয়ার ইজ মিসআন্ডারস্টুড জিনিয়াস।’’ …
তাঁর একদিকে ‘বমচিকা বমচিকা’ বা ‘সিং নেই তবু নাম তাঁর সিংহ’!
‘আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়’ থেকে ‘কিশোর কুমার। যাত্রাপথ খুব সহজ ছিল না। কিন্তু ওই যে বলে না অবলীলায় সবকিছুকে উড়িয়ে দেওয়া, যে কোনও প্রতিকূল অবস্থাকে শুধু হাসি মজায় উড়িয়ে ভারতীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন এই মানুষটি।
‘আরাধানা’ চলচ্চিত্রের ‘কোরা কাগাজ হে মন মেরা’ গানটি শুরু হবার আগে ‘এহে … আহা …’ বলে যে আলাপ ছিল, তার কথা কি কেউ ভুলতে পারে? এখনো ওরকম সুর করে কেউ গান শুরু করলে সবার মনে একজনের নামই আসে – কিশোর কুমার, সবার কিশোর দা। বাংলা এবং হিন্দি- দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে চলেছেন তিনি। মৃত্যুও তাঁকে থামাতে পারেনি। আজও তাঁর গান সমান জনপ্রিয়। ছোট থেকে বড় সবাই তাঁর গানে মুগ্ধ। কিছু যেন একটা ছিল তার কণ্ঠে, যা সকল শ্রোতাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। সবাইকে বাধ্য করে তাঁর গান শুনতে।
কী কোমল, মিষ্টি-মধুর ছিল তাঁর কণ্ঠ, অথচ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গায়ক ছিলেন না তিনি। প্রকৃতির উপহার হিসেবে গলায় সুর নিয়েই যেন জন্মেছিলেন। জীবনের নির্দিষ্ট একটি সময় বাদ দিলে তাঁর পুরো জীবনটাই সাফল্যে ভরপুর। একজন সফল অভিনেতা, গায়ক, প্রযোজক, গীতিকার এবং সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর বেশিরভাগই ছিল কমেডি ধাঁচের। লোক হাসানোয় তাঁর অন্ত ছিল না – সেটি পর্দার ভিতরে হোক বা বাইরে। বিভিন্ন ধাঁচের গান গেয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, তার মতো কেউ নেই, কিশোর কুমার শুধু একজনই হতে পারে।
’৭০ এর দশকে, মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে মান্না দে’র পুজোর গান তৈরি করলেন। ‘‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা যে দিন যাবে।’’ গান শুনে মান্না দে আঁতকে উঠে বললেন, ‘‘কী করেছেন মশাই! আমার মরণযাত্রা করিয়ে দিয়েছেন! এই গান আপনাদের বৌদি গাইতে দেবে না!” দু’জনেই খুব ভেঙে পড়লেন! কিন্তু মান্না দে-কে কিছুতেই রাজি করানো গেল না! কিছু দিন বাদে পরিচালক মনোজ ঘোষ তৈরি করলেন, ‘তুমি কত সুন্দর’ নামের একটি চলচ্চিত্র। ছবিটিতে মৃণাল বন্দোপাধ্যায় ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় গান তৈরি করলেন। ‘তোমার বাড়ি …’ গানটা শুনে পরিচালকের পছন্দ হয়ে গেল। বললেন, এই ছবির জন্য গানটা তাঁর চাই। কিন্তু মান্না দে’র জন্য তৈরি গান কে গাইবে? সকলেই একমত, এই গান গাওয়ার মতো এক জনই আছেন, তিনি কিশোর কুমার।
মনোজ ঘোষ ও মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় রওনা দিলেন মুম্বই। গান কিশোরকুমারের খুব পছন্দ হল। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। মুখরাতে একটা লাইন ছিল, ‘তুমি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থাকো …।’ কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন। গানের মধ্যে বারান্দা শব্দটি চলবে না। “পুলকবাবুকে বলে ওটাকে ‘আঙিনা’ করে দাও।” দু’জন পড়লেন মহা বিপদে। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কে কিছুতেই ফোনে ধরা গেল না। আর তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে শব্দ বদল করার সাহস কারও নেই! এ দিকে আবার কথা না বদলালে কিশোর কুমার গাইবেন না! শাঁখের করাত! রেকর্ডিংয়ের দিন কিশোর কুমার এলেন। সিরিয়াস গান। কিশোর মামার ডুবে গেলেন গানের মধ্যে। গান শুরুর আগে ডাকলেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় কে। মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায় তো নিশ্চিত, এ বার কিশোর কুমার নির্ঘাত বলবেন, “কথা চেঞ্জ হল?” আর তার পরই রেকর্ডিং বন্ধ! কিন্তু কী কাণ্ড! কিশোর কুমার বললেন, “বড় ভাল সুর করেছ মৃণাল।” তারপর ‘বারান্দা’ শব্দ সমেত গাইলেন গানটা। আর ওই প্রসঙ্গে গেলেন না। তৈরি হল কালজয়ী এক বাংলা গান।
এই হলেন কিশোর কুমার। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৯১ বছর। চলে গেছেন আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে। এখনও সমান চুম্বক কিশোর কুমারের গানে। এখনও আগের মতো সমান জনপ্রিয় তিনি। তাঁর নামে ভারতবর্ষের যে কোনও প্রান্তে অনুষ্ঠান হোক না কেন, সিট ফাঁকা পড়ে থাকে না! যত মাধ্যম আছে সব জায়গায় তাঁর গান হিট।
বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আজ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকত। থাকত টুইটার কিংবা ইনস্টাগ্রাম। জীবনকে যেভাবে উপভোগ করতেন তিনি, এসব থাকাটাই স্বাভাবিক। আচ্ছা, জন্মদিন উপলক্ষে কিশোর কুমার কি নিজের গাওয়া কোনো গানের লাইন দিতেন তাঁর স্ট্যাটাসে? কোন গানটা শেয়ার করতেন? ‘সুখেও কেঁদে ওঠে মন এমনও হাসি আছে’ গানটা খুব বেশি যে জনপ্রিয় তা নয়, অথচ তাঁর সঙ্গে খুব মানিয়ে যায়। নাকি দিতেন ‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রাখো’, ‘ওরে মনপাগল তুই কেন কেঁদে মরিস’, ‘চোখের জলের হয় না কোনো রং’ নাকি ‘হাওয়া, মেঘ সরায়ে, ফুল ঝরায়ে ঝিরি ঝিরি এলে বহিয়া খুশিতে ভরেছে লগন আজ ওঠে মন ভরিয়া’ নাকি ‘ওপারে থাকব আমি তুমি রইবে এপারে, শুধু আমার দুচোখ ভরে দেখব তোমারে’ বা ‘আমি যে কে তোমার তুমি তা বুঝে নাও’ গানটা? হয়তো নিজের গানের আশ্রয় নিতেন না তিনি। তাহলে কি দিতেন হাসির কিছু? নাকি বেদনার? চলচ্চিত্রের কোনো সংলাপ দিতেন? তবে নিজের গানের কলি দিয়ে স্ট্যাটাস দিতে হলে তিনি নিশ্চিত মুশকিলে পড়তেন। এত এত গান, এত শ্রোতাপ্রিয় গান!
‘প্রতিভা’, এমনকি তার চেয়েও বড় কোনো শব্দ দিয়ে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, তবে কিশোর কুমার তা-ই। এ কথা আবেগের। যুক্তিরও। কি বাংলা, কি হিন্দি – দুই ভাষার চলচ্চিত্রেই সমানভাবে দাপট নিয়ে গেয়ে চলেছেন কিশোর কুমার। অভিনয় করেছেন। এমন নয় যে শখের বশে। পেশাদার শিল্পীর মতোই, দাপটের সঙ্গে। কী ছিল তাঁর কণ্ঠে? কী যেন একটা ছিল, যা শুনলেই মনে হয় কণ্ঠটা চুম্বকের মতো টানে। কোমল, মধুর, কখনো দরাজ ছিল তাঁর কণ্ঠ। গায়কিও কী অসাধারণ! অথচ শুরুতে গানের তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না তাঁর। জীবনকালে খুব একটা সাক্ষাৎকার না দিলেও আড্ডা-আলাপচারিতায় তিনি এমনটাই বলেছেন, জানিয়েছিলেন। কিশোর কুমার বরাবরই স্বীকার করে এসেছেন, তিনি সঙ্গীত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। মন থেকেই তাঁর গান গাইতে ভালো লাগত। পরিণত কিশোর কুমারও হারমোনিয়াম ভালো বাজাতে পারতেন না। বাজাতে গিয়ে ভুল হলে হাল ছেড়ে দিয়ে খালি গলায় গেয়ে দিতেন। এমনও শোনা গেছে, সিঙ্কোপেইটেড নোটস থাকলে নাকি তাঁর যেন দম আটকে আসত!
১৯২৯ সালে আগস্টের ৪ তারিখে ভারতের মধ্যপ্রদেশের ছোট শহর খান্ডওয়ার এক ছোট গলির ছোট্ট বাড়িতে জন্ম কিশোর কুমারের। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা আইনজীবী শ্রী কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি। বড় ভাই ভারতের চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম দিকপাল শ্রী কুমুদলাল গাঙ্গুলি (অশোক কুমার)। বলিউডের সবাই তাঁকে দাদামণি বলে ডাকতেন। বড় ভাই আর কিশোর কুমারের মাঝে বয়সের পার্থক্য ১৮ বছর।
ছোটবেলা থেকেই তাঁর অন্যকে নকল করে দেখানোর শখ ছিল। সবার নকল করে বেড়াতেন তিনি। আর শখ ছিল ইওডেলিংয়ের, যেখানে বিভিন্ন পিচে সুর করে গাইতে হয়। ভারতে কিশোর কুমারই প্রথম ইওডেলিং আনেন।
ছোট বেলায় নাকি তাঁর গানের গলা ভাল ছিল না একদম। অশোক কুমার পরে বিভিন্ন জায়গায় বলেছিলেন, একবার কিশোর কুমার পায়ে আঘাত পেয়েছিলেন। সেই আঘাত পাওয়ার পর তিন-চার দিন নাকি তিনি শুধু কেঁদেছেন। সেই কান্নার পর তাঁর গলায় কী এক পরিবর্তন আসলো, গলায় সুর চলে আসলো, আওয়াজ পরিবর্তন হয়ে গেল। কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে, কিন্তু যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে সেই কয়েক দিনের কান্না অনেক যুগের কোটি মানুষের মনের খোরাক হয়ে চলে আসছে।
১৯৪৯ সালে প্রথম ‘জিদ্দি’ চলচ্চিত্রে আরেক বিখ্যাত অভিনেতা দেব আনন্দের জন্য গান গেয়ে চলচ্চিত্র জগতে পদচারণা শুরু করেন। এরপর ১৯৫১ সালে ‘আন্দোলন’ চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৪ সালের পর থেকে ‘নউকরি’, ‘নিউ দিল্লী’, ‘আশা’, ‘চালতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পড়োসান’, ‘ঝুমরু’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই গান গেয়েছেন শুধু নিজের জন্য। ১৯৬৮ সালের আগে পর্যন্ত তিনি হয় নিজের জন্য, না হয় দেব আনন্দের জন্য গেয়েছেন, অন্য কোনও অভিনেতার জন্য নয়।
দেব আনন্দ আর রাজেশ খান্না—কিশোর–কম্মের দুই প্রচ্ছদ। এই দু’জনের ‘প্লে–ব্যাক’ ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িত কিশোরের সঙ্গীত কেরিয়ারের দুটি অধ্যায়ের উত্থান–বৃত্তান্ত। এবং কিশোর–গীতির আকাশে দুই ধ্রুবতারা বাবা ও ছেলে শচীনদেব বর্মন ও রাহুলদেব বর্মনের সঙ্গে কিশোরকুমারের সুরের পথে ‘জার্নি’র নানা অ্যাডভেঞ্চার–বৃত্তান্ত। আর একটা কথাও উল্লেখের, তা হল কিশোর–ইতিহাসে বম্বের দুই বাঙালি শশধর মুখার্জি (বা তাঁর ভাই সুবোধ মুখার্জি) আর শক্তি সামন্তের অবদান। যা এই ‘ভিনি–ভিসি–ভিডি’র সঙ্গে জড়িত।
দেব আনন্দের গলায় গান গাওয়া দিয়েই কিশোরকুমারের ‘প্লে–ব্যাক’ জীবন শুরু। ১৯৪৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘জিদ্দি’তে। ‘মরণে কি দুয়ায়ে কিউ মাঙ্গু’। করুণ গান। সুর করেছিলেন খেমচাঁদ প্রকাশ। ইসমত চুগতাইয়ের গল্প অবলম্বনে এ ছবি প্রযোজনা করেছিল হিমাংশু রায়ের ‘বোম্বে টকিজ’। পরিচালক হিসাবে শাহিদ লাতিফের নাম গেলেও এ ছবির পরিচালনার কাজ কার্যত করেছিলেন অশোককুমার। ‘কুমুদলাল গাঙ্গুলি’। আভাসলাল গাঙ্গুলির ১৯ বছরের বড় দাদা। না, না, এঁরা আবার কারা, বেশি ভাবার অবকাশ নেই। এই নাম দুটো হল যথাক্রমে অশোককুমার আর কিশোরকুমারের ভাল নাম। দেব আনন্দ–কে প্রথম ব্রেকটা দিয়েছিলেন অশোককুমারই।
তিনিই যখন বোম্বো টকিজের কার্যত সর্বেসর্বা। ভাইকেও এ ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্র দিয়েছিলেন অশোক। বাগানের মালির চরিত্র। চারটে মাত্র সংলাপ। তা বলতেই হিমশিম কিশোর। শেষ পর্যন্ত ওই জায়গাটা কিশোরের লিপ–এ ডাব করে দিয়েছিলেন অশোককুমার স্বয়ং। কিন্তু দেব আনন্দের লিপ–এ গানটা গাইতে গিয়ে দারুণ সাফল্য পেলেন তিনি। আর এই ছবিতে কাজ সূত্রেই দেব আনন্দের সঙ্গে দুর্দান্ত সখ্য গড়ে উঠল কিশোরের। দুই মজাদার ‘ফ্ল্যামবয়েন্ট’ মানুষ হয়ে উঠলেন একে অপরের দারুণ বন্ধু। আর তারই ফসলটা ফলল ‘ফান্টুশ’–এ। ১৯৫৬ সালে এ ছবি প্রযোজনা করেন খোদ দেব আনন্দ। পরিচালক দাদা চেতন আনন্দ আর সঙ্গীত পরিচালক শচীন–কর্তা। দেব আনন্দ জেদ ধরেই নিজের লিপ–এ গান গাওয়ালেন বন্ধু কিশোরকুমারকে। কিশোর কিন্তু তখন ক্রমান্বয়ে এক ব্যর্থ গায়কের নাম। শচীনদেবকে অবশ্য বোঝাতে হয়নি। তাঁর জহুরি চোখ ঠিকই চিনেছিল কিশোরকে। আর তাই ‘ফান্টুশ’–এ এক চূড়ান্ত দরদভরা গান গাইলেন কিশোর–কণ্ঠে। ‘দুখি মন মেরে শুন মেরা কয়না, জহাঁ নেহি চয়না, উহুঁ নেহি রয়না।’ সাহিরের এমন শায়েরিতে কিশোরকে ভাববেন শচীনদেব, তা তখন কেউ ভাবেননি। পরিবারিক বন্ধু শচীনদেব (রাহুলের নাম ‘পঞ্চম’ দিয়েছিলেন অশোককুমার) শুধু কিশোরকে ভরসা জুগিয়ে বলেছিলেন একটাই কথা ‘তোমার যেমন ইচ্ছা গাও। শুধু গানটা উপভোগ করো।’ বাকিটা ইতিহাস।
‘ফিল্মিস্তান’–এর কর্ণধার শশশর মুখার্জির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কিশোরকুমারের আপন দিদি সতী দেবীর। সেই ‘ফিল্মিস্তান’ দেব আনন্দকে নায়ক করে ছবির কাজ শুরু করল ‘মুনিমজি’ (১৯৫৫)। দেবের লিপে এবার কিশোর। এবং সুরে যথারীতি শচীনদেব। এবং কবি হিসাবে আবার সাহির লুধিয়ানভি। আর এবার ম্যাজিক ঘটাল ‘জীবন কে সফর মে রাহি মিলতে হ্যাঁয় বিছড় জানে কো, ঔরদে জাতে হ্যাঁয় ইয়াঁদে তনহাই মে তড়পানে কো’–এই ‘নগমা’টি। এ’গানের রেকর্ডিং পর্ব চলছে। হঠাৎ শচীনদেব ফাইনাল রিহার্সাল থামিয়ে দিলেন। সবাই তো ঘাবড়ে গেল! স্বয়ং কিশোরও। হল কী! শচীন কর্তা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন কিশোরের দিকে। তারপর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়লেন। বললেন, ‘কিশোর, তুমি যদি এইভাবে এই গান গাও, তাহলে তো ছবি সুপারহিট!’ এবং ‘ত্রিমুকুট’ ঝয়টি হল এই ত্রয়ীর ‘পেইং গেস্ট’–এ এসে। ১৯৫৭ সালে। এ ছবিতে শচীনদেবের দুটো ‘এক্সপেরিমেন্ট’ ছিল। এক, গানের মিউজিকে তখন পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ানের ব্যবহারটা ধরে নেওয়া শঙ্কর জয়কিসান–এর নিজস্ব সিগনেচার। শশধর মুখার্জির এই ছবিতে শচীনদেব প্রথম নিজের সুরে এই বাদ্যযন্ত্রের ‘এগজিকিউশান’ ঘটালেন। আর কিশোরের গাওয়া এই গান ছেলে–ছোকরাদের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল। ‘মানা জনাব নে পুকারা নেহি।’ দ্বিতীয় পরীক্ষণটাও ছিল চমকপ্রদ। কিশোর–আশা ‘ডুয়েট’ করলেন ‘ছোড় দো আচল জমানা কেয়া কহেগা।’ আশার গানের বৈশিষ্ট্য যে পরিশীলিত ‘নখরা’ বা ‘দুষ্টুমি’ মেলানো, তাঁর প্রথম প্রয়োগ শুরু হল সম্ভবত এখান থেকেই। আর তার সঙ্গে অদ্ভুত মজাদার সঙ্গত করলেন কিশোর। জন্ম হল ‘হিট’ জুটির। মজার কথা হল, আগে শচীনদেব ভেবেছিলেন এ গান শুধু থাকবে ‘ফিমেল’ ভয়েসে। গীতিকার মজরুহ সুলতানপুরি পরামর্শ দিলেন প্রশ্নোত্তরের ঢঙে এটা ‘ডুয়েট’ করলে ব্যাপারটা জমে যাবে। তাই হল শেষ পর্যন্ত। ভাগ্যিস!
তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে ‘চালতি কা নাম গাড়ি’, ‘হাফ টিকিট’, ‘পড়োসান’– এখনো বিখ্যাত। গানগুলোর সবই প্রায় বিখ্যাত। গানগুলোর মধ্যে তাঁর হাস্যরসাত্মক কাণ্ডগুলো যে কাউকেই অভিভূত করবে। এ সময় অভিনয় করলেও তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সলীল চৌধুরী, এস ডি বর্মণ এর মতো বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালকরা। এ সময়ে তাঁর বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে ছিল- ‘ছোটা সা ঘার হোগা বাদাল কি ছাও মে’ (নউকরি), ‘ইনা মিনা ডিকা’ (আশা), ‘নাখরে ওয়ালি’ (নিউ দিল্লী), ‘পাঁচ রুপিয়া বারা আনা’ ও ‘এক লাড়কি ভিগি ভাগি সি’ (চালতি কা নাম গাড়ি), ‘চিল চিল চিল্লাকে’ (হাফ টিকিট), ‘এক চাতুর নার’ ও ‘মেরে সামনে ওয়ালি খিড়কি মে’ (পড়োসান), ‘মেরি মেহবুব কেয়ামাত হোগি’ (মি. এক্স), ‘দুখি মন মেরে’ (ফানটুস) ইত্যাদি।
গুরু দত্ত মারা গেলেন ১৯৬৪ সালে। আর তার পরের বছর ‘ভূত বাংলো’ তৈরি হল তাঁর স্মৃতিকে উৎসর্গ গরে। এই ছবিই রাহুলদেব ও কিশোরকুমারের প্রথম রসায়ন। তার ফল কী হতে পারে, তার প্রমাণ ‘জাগো শোনেওয়ালো শুনো এরি কাহানি।’ আবির্ভাবের আত্মঘোষণার এর থেকে যথোচিত বয়ান আর হতে পারে কি? ‘সি–মাইনর’–এ গাঁথা এক দুরন্ত অর্কেস্ট্রা। গানের ভেতর পর্দার বদলে–বদলে যাওয়াটা দারুণ সামলালেন কিশোর। বোঝা গেল তাঁর কম্মকে অন্যভাবে ব্যবহারের লোক এসে গেছে। কিন্তু পর্দার এই রসায়েন তখনও একজন আসতে বাকি। তিনি রাজেশ খান্না। পাঁচের দশকের দেব–শচীন–কিশোর ত্রিভুজের পাল্টা ত্রিভুজ হিন্দি ছবিতে এল সাতের দশকের রাজেশ–রাহুল–কিশোর–এ। ঘুরপথে যার শুরু ১৯৬৯–এ। ‘আরাধনা’য়। এ ছবির ‘অফিসিয়াল’ সুরকার কিন্তু শচীনদেব বর্মনই। কিন্তু ছবির নেপথ্য–বৃত্তান্ত যাঁরা জানেন, তাঁরা জানেন কিশোরকুমারের যুগান্তকারী দুটি গানের সুরে রাহুলদেবের কী ভূমিকা ছিল।
‘মেরে স্বপনো কি রানি কব আয়েগি তু’র রেকর্ডিং–এ কিছুতেই ট্রেনের ছন্দ আর সুরটাকে মেলাতে পারছিলেন না শচীনদেব। সেদিন রেকর্ডিং প্রায় ‘ক্যানসেল’ করতে বসেছেন তিনি। সে সময় এগিয়ে এলেন পঞ্চম। মিউজিশিয়ান ভানু গুপ্তকে বললেন, গিটারে ‘রিদম্’ বাজাতে আর নিজে মাউথ অর্গানে চটপট একটা সুর বানিয়ে ফেললেন, যেটা এখন আমরা গানে শুনি। একইভাবে ‘রূপ তেরা মস্তানা’র জন্য একটা চিরাচরিত সুর বানিয়েছিলেন শচীনদেব। রাহুলদেব তার কিছুদিন আগেই কিশোরের মুখে একটা ছড়া–গান শুনেছিলেন ‘কালকে যাব শ্বশুরবাড়ি’ (এমন অনেক গান তখন কিশোর জলসায় মজা করে গাইতেন)। সেটাই তিনি কিশোরকে বললেন বাবার সামনে গাইতে। আর সেই সুরটাই একটু বদলে হয়ে উঠল ‘রূপ তেরা মস্তানা।’ এই ‘আরাধনা’তে যখন কিশোর ‘কোরা কাগজ থা ইয়ে মন মেরা’ গেয়েছিলেন, তখনও গানে ‘ইকো মেশিন’–এর ব্যবহার শুরু হয়নি। কিশোর শুধু গলা দিয়েই এই ‘এফেক্ট’ তৈরি করেছিলেন! এর দু’বছর পরে শক্তি সামন্ত যখন রাজেশকে নায়ক করে আবার ছবি তৈরি করা শুরু করলেন ‘কাটি পতঙ্গ’, তখন সুরের দায়িত্ব তুলে দিলেন আর ডি বর্মনের হাতে। এবারও গানে ‘ইকো এফেক্ট’ থাকবে। তাই বিদেশ থেকে এল ‘ইকোলাইট’ যন্ত্র। কিশোরের গলায় থাকল তিনটে গান – ‘পেয়ার দিওয়ানা হোতা হ্যায়’, ‘ইয়ে শাম মস্তানি’, ‘ইয়ে যো মোহাব্বত হ্যায়।’ শেষ গানটিতে অ্যাকুইস্টিক গিটারে বিদেশি ‘ওড়াল্টজিং রিদম্’–এ প্রয়োগ ঘটিয়ে শ্রোতাদের ‘মাতাল’ করে দিলেন আর ডি। আর বোঝা গেল কিশোর কণ্ঠ ফাঁকে আর ঝোঁকে কেমন খোলে। তবে এই ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দু এল ‘অমর প্রেম’–এ। শক্তি সামন্ত ১৯৭২–এ দুরুদুরু বুকে এ ছবি বানান। কারণ এর বাংলা মূল ছবিতে উত্তমকুমারের উপস্থিতি। সেই চরিত্রে রাজেশ খান্নাকে কি নেবে সাধারণ দর্শক? সব দায়িত্বটা এবার যেন কাঁধে তুলে নিলেন কিশোরকুমার। উত্তমের অনুপস্থিতি বুঝতেই দিলেন না। প্রসঙ্গত, এর আগে ‘রাজকুমারী’ নামে বাংলা ছবিতে মহানায়কের লিপে গান গেয়েছেন কিশোর। ‘এ কী হল, কেন হল’, ‘তবু বলে কেন’, ‘বন্ধ দ্বারের অন্ধকারে থাকব না’। প্রশংসা পেয়েছে, কিন্তু সুপাহিট হয়নি। যদিও রাহুল–কিশোর দুজনেই জানতেন, উত্তমকুমারের গান গাওয়ার ভঙ্গির নিজস্বতা না বুঝে গান গাওয়ায় গানগুলো বক্স–অফিসে ব্যর্থ হয়েছে। সুরে গোলমাল ছিল না। তাই ‘অমর প্রেম’–এ ‘এ কী হল’কে ফিরিয়ে আনা হল ‘এ কেয়া হুয়া’ করে। এবার সুপারহিট হল। কিন্তু আরডি আর কিশোরের ‘চ্যালেঞ্জ’টা ছিল অন্যত্র। এই দুজন সম্পর্কেই বলা হত দুজনেই ভারতীয় রাগ সঙ্গীত সম্পর্কে অজ্ঞ। দুজনেই প্রমাণ করলেন কথাটা কত ভুল। ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে’ গানটা খাম্বাজ রাগে বাঁধলেন রাহুল। তারপর তাকে মিলিয়ে দিলেন রাগ কলাবতীর মাধুর্যে। অদ্ভুত মসৃণতায় ব্যাপারটা সামলালেন কিশোর। কিন্তু এর চেয়েও বড় চমকটা ছিল ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’ গানে। এ গান ভৈরবীতে নিবদ্ধ। ভৈরবী ভোরের রাগ। ছবিতে তা কিন্তু ব্যবহৃত হচ্ছে সন্ধের দৃশ্যে! নদীতে ভাসতে ভাসতে গাওয়া। সুরটা ভাসিয়ে দিলেন কিশোর। আর তারপর ‘সাওন উসে বুঝায়ে’র পর্বে এসে উসে থেকে ‘বুঝায়ে’তে তীব্র মধ্যমের এমন প্রয়োগ ঘটালেন যে মনে হল চারপাশে সন্ধে নেমে এসেছে যেন! বোঝা দায় হল যে ইনি জীবনেও রাগসঙ্গীত শেখেননি! আজীবন এই চমকটাই যে কিশোর। তাঁর না ফুরোনো কিশোর।
১৯৬৫ সালের পর ধীরে ধীরে নায়ক হিসেবে দর্শকরা আর তাঁকে গ্রহণ করছিলেন না। এতে তিনি অনেক বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কোনোভাবেই তিনি এটা মেনে নিতে পারছিলেন না। আবার ততদিনে অন্য একটি সমস্যা দেখা দেয়। ইনকাম ট্যাক্স সমস্যা। সেখানে টাকা দেবার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় স্টেজ শো করা শুরু করলেন। দর্শকদের জন্য গান গাইতে থাকলেন। অন্যদিকে চলচ্চিত্রে যেহেতু তিনি নিজের এবং দেব আনন্দের জন্য ছাড়া অন্য কোনো নায়কের জন্য গান গাননি, তাই সেখানেও কাজ কমে যাচ্ছিল। এমন সময় শচীন দেব বর্মণ তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ালেন। নায়ক ছিলেন তখনকার সদ্য ইন্ডাস্ট্রিতে আসা রাজেশ খান্না। চলচ্চিত্রটির প্রত্যেকটি গান দর্শকরা পছন্দ করলো। কিশোর কুমার হয়ে গেলেন সুপার হিট। এরপর থেকে বলিউডের সবাই কিশোর কুমারকে দিয়ে তাঁদের গান গাওয়ানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। এর আগে চলচ্চিত্রগুলোর সিংহভাগ গান মোহাম্মদ রফি গাইতেন। রাতারাতি সেখানে ভাগ বসালেন কিশোর কুমার। এক সময় তো এমন বিতর্ক শুরু হলো যে, কে ভাল গায়ক? রফি নাকি কিশোর? ফিল্মিস্তান নামক এক ম্যাগাজিন ছিল, যেখানে পাঠকরা এ নিয়ে লিখিত বিতর্ক করা শুরু করে দিলেন। এরকম দুই তিন সংখ্যা চলার পর কিশোর কুমার সেখানে একটি চিঠি লেখেন এবং তাঁদের কে অনুরোধ করেন যে, তাঁকে রফি সাহেবের সাথে যেন তুলনা না করা হয়। মহম্মদ রফি অনেক বড় শিল্পী। তাঁর যে সঙ্গীত শিক্ষা, কিশোর কুমারের সেটি নেই। তিনি যেসব গান গেয়েছেন সেগুলো কি কিশোর কুমার কখনও গাইতে পারবেন?
কিশোর কুমার বরাবরই স্বীকার করে এসেছেন, তিনি সঙ্গীত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। তিনি মন থেকে গান। তাঁর গাইতে ভাল লাগে। এরপর কিশোর কুমার জীবিত কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চনের জন্য গান করেন। এক পর্যায়ে দেখা গেল, অমিতাভের ছবি মানেই সেখানে কিশোর কুমারের নাম থাকবে। এর অন্যথা যেন হতেই পারে না। এসময় এস ডি বর্মণের সুপুত্র রাহুল দেব বর্মণের সঙ্গীত পরিচালনায় গান গাওয়া শুরু করেন কিশোর কুমার। এখানেও সফল হলেন। একের পর এক দর্শক প্রিয় গান দিয়ে যাচ্ছিল এ জুটি। যেমন- ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’, ‘হামে অর জিনে কি’, ‘দেখা এক খোওয়াব’, ‘সাগার কিনারে’, ‘চেহরা হে ইয়া’, ‘ইয়ে দোস্তি’, ‘রিম ঝিম গিরে সাওয়ান’ ইত্যাদি।
‘কিশোর সোধা’, ভারতবর্ষের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্রাম্পেট প্লেয়ার। দীর্ঘ ১৫ বছর বাজিয়েছেন। কিশোর কুমারের সঙ্গে প্রথম কাজ করেন ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দার’ চলচ্চিত্রে। ছবির সেই বিখ্যাত গান ‘রোতে হুয়ে আতে হে সব …’। তাঁর কথায়, ‘‘অনুষ্ঠানে ২৭-২৮ টা গান আরামসে গাইতেন। দর্শকদের অনুরোধকে খুব গুরুত্ব দিতেন। নিজের পছন্দ ছাড়া সেই সব গান গাওয়ার চেষ্টা করতেন। তরতাজা ভয়েস। সব সময় এক রকম। গানের উঁচু পর্দা নিচু পর্দা, সকাল হোক বিকেল, সব সময়ই এক রকম। অমন শিল্পী খুব কমই আছেন। আর একটা বিষয়ে কিশোরদার কোন তুলনা নেই! এমন সুরেলা গায়ক, জীবনে কোনও দিন এক সেকেন্ডও বেসুরো গাননি।” তিনি আরও জানিয়েছিলেন, “মানুষ হিসেবেও কিশোরদার কোনও তুলনা নেই! এক বার হয়েছে কি, আমার বিদেশ যাওয়া খুব দরকার, কিন্তু কিছুতেই পাসপোর্ট পাচ্ছি না। বড় বিপদে পড়লাম! কথাটা কী করে যেন কিশোরদার কানে গেল। বললেন, ‘চিন্তা করতে হবে না, আমি দেখছি।’ কয়েক দিনের মধ্যে পাসপোর্ট হয়ে গেল। তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক, অথচ তাঁর এক জন মিউজিসিয়ানের জন্য এই সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত বেশি নেই!”
একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, কিশোর কুমার যখন ডুয়েট গান গাইতেন, দর্শকদের পুরো মনোযোগ থাকতো তাঁর গানের দিকে। এমনকি একই গান যখন দুজন শিল্পী গাইতেন, তখন কিশোর কুমার যেই ভার্সন গাইতেন, সেটাই দর্শকদের কাছে জনপ্রিয়তা পেত। যেমন- ‘তুম বিন জাহু কাহা তে’ মোহাম্মদ রফির সাথে, ‘ইউহি গাতে রাহ’ তে জনপ্রিয়তা পায় কিশোর কুমারের গাওয়া গান।
মান্না দে হিন্দি গানের ট্রেন্ড এবং কিশোর কুমার কে নিয়ে খুব ভাল কথা বলতেন। মহম্মদ রফি, মান্না দে, তালাত মাহমুদ – এঁরা মূলত হিন্দি গানের একটা ঘরানা তৈরি করেছিলেন এবং গায়কীতে হরকত থাকত। তাতেই শিল্পীদের শিক্ষার পরিচয় পাওয়া যেত। গানটিও খুব সমৃদ্ধ হত। সিনেমার হিন্দি গান বলতে গেলে তখন সব মহম্মদ রফির দখলে। কিন্তু কিশোর কুমারের উত্থানে রফির গান খুবই কমে আসতে লাগল। এই ব্যাপারটা মহম্মদ রফি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না! মান্না দে-কে প্রায় দুঃখ করে বলতেন, “গানে কোনও হরকত নেই শুধু চিৎকার করে! এ সব কী হচ্ছে মান্নাদা?” প্র্যাক্টিক্যাল মানুষ মান্না দে বোঝাতেন, “সবাই এমন গায়কি পছন্দ করে। এটাই স্ট্রেট সিঙ্গিং। তোমাকে সেটা মানতে হবে। তুমি তো শুধু নিজের জন্য গাইছো না। গাইছো অডিয়েন্সের জন্য। তাঁদের কথা ভাববে না? ওঁদের যে ভাল লাগছে কিশোরকে, সে ক্রেডিট দিতেই হবে।” মান্না দে বলতেন, “অনেক বুঝিয়েছি। রফি মিঞা কিছুতেই মেনে নিতে পারতেন না! শেষ পর্যন্ত গুমরে গুমরে মারা গেল! ভেরি স্যাড!”
তিনি শুধু যে হিন্দি গান গেয়েছেন, তা কিন্তু নয়। বাংলা গানও গেয়েছেন। মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্য গেয়েছেন তিনি অনেক গান। ‘আমার স্বপ্ন তুমি ওগো চির দিনের সাথী’, ‘আশা ছিল ভালবাসা ছিল’, ‘যদি হই চোর কাঁটা’, ‘এই তো জীবন’, ‘নারী চরিত্র বেজায় জটিল’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি। তাঁর চারুলতা’তে ‘আমি চিনিগো চিনি তোমারে’ গানটি গেয়েছিলেন। আবার তাঁর ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রেও গান করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের মতে, কিশোর কুমারের গানের গলা চলচ্চিত্রের যেকোনো পরিস্থিতি মোতাবেক দৃশ্যে মানিয়ে যায়।
বাংলা গানের ঐতিহ্যে ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’ একটা ধাক্কা ছিল। প্রথমে যিনি শুনবেন তাঁর এই গানকে মনে হবে ‘বিশৃঙ্খলা’র চূড়ান্ত। তাল, লয়, মেলোডি সব ঘেঁটেঘুটে দিচ্ছে! যেন এক মূর্তিমান কালাপাহাড়!
কিন্তু ভাল করে শুনলে বোঝা যাবে, এ গানের ভিত্তি আসলে চূড়ান্ত শৃঙ্খলাময় এক ব্যান্ডের তাল। একেবার মিলিটারি ব্যান্ড। তার এক–দুই–তিন/এক–দুই–তিন–চার ছকে গাঁথা ‘রিদম’–এ পা ফেলেই তালে তালে গান এগোচ্ছে। সেভাবেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরটা তৈরি করেছেন। অথচ এমনভাবে কিশোরকুমার গাইছেন যে শুনলে মনে হবে ‘বিশৃঙ্খলা’র চূড়ান্ত! এই যে ‘ইলিউশান’টা, এটা পুরোটাই তৈরি করছে কিন্তু কিশোরকুমারের গায়কি! এবং এটাই কিশোরকুমার। যেখানে সামনে ‘ছদ্মবেশী’ একজন মানুষ। আর তার আড়ালে অন্য একজন। সামনে মূর্তিমান এলোমেলোপনা। আর পেছনে একজন চূড়ান্ত সংযমী, পরিশ্রমী, একমুখী মানুষ। যিনি কখনও এক বিন্দুও মদ্যপান করতেন না। বাড়িতে নেমতন্ন করলে বা পার্টি দিলে, তাতে মধ্যপানের আয়োজন থাকত না। থাকত নিখাদ বাঙালি খানা। লুচি, বেগুনভাজা, আলুর দম। আর নিজে কোথাও খেতে গেলে, বিশেষত বাঙালি পরিবারে, যেচে বলে রাখতেন মাছের একাধিক পদ করে রাখতে। কলকাতা থেকে বম্বে ফেরার সময় শচীনদেব বর্মন, শক্তি সামন্তরা কিশোরকুমারের জন্য নিয়ে যেতেন ইলিশ মাছ। বহু পরিচালক–প্রযোজকই জেনে গিয়েছিলেন কিশোরকুমারের এই মাছ–প্রীতির কথা। ডেট পাচ্ছেন না। মাছের ঝোল কিংবা ঝাল ভেট গেলেই কেল্লা ফতে! প্রসঙ্গত, দুটো খাবারের ব্যাপারে সাবধানে থাকতেন কিশোর। এক ‘বিরিয়ানি’। রেকর্ডিং থাকলে তার এক–দু’দিন আগে থেকে বিরিয়ানি খাওয়া বন্ধ রাখতেন। বলতেন, ঘি আর মুরগির মাংসে গলা জড়িয়ে যাবে। স্বরগুলো ঠিক খেলবে না। দুই, ‘শিঙাড়া’, মধ্যজীবনের একটি হার্ট অ্যাটাকের ঘটনার পর থেকে আতঙ্কে ভুগতেন কিশোর এই আপাত–নিরীহ বস্তুটি নিয়ে। ধূমপান করতেন না। রাতে শুয়ে পড়তেন তাড়াতাড়ি। একবার এক জলসায় তুমুল হিট ‘শরাবি’র গান গাইছেন। হাতে কাচের গ্লাসে তরল। গান থামিয়ে মাঝপথে ঢকঢক করে তা খেয়ে ফাঁকা গ্লাস তুলে জানালেন, ওতে সাদা জল ছিল। দর্শকদের জানালেন, তিনি মদ খান না, দর্শকেরাও যেন না খান। বিদেশে গেলে কিশোরকুমার প্রচুর মুখোশ কিনে আনতেন। সঙ্গে কখনও–কখনও ভয় দেখানো খেলনা। রাবারের সাপ, মাকড়সা, বড় টিকটিকি। বলতেন, ‘অপছন্দের লোক দেখলে গায়ে ছুঁড়ে দেব।’ আসলে এই মুখোশগুলো আর খেলনাগুলোই হয়তো ছিল তাঁর জীবনের ছদ্মবেশ। যেগুলো আড়াল করে রাখত ভেতরের মানুষ–কিশোরকুমারকে।
কী বলা যাবে একে? ‘প্যাকেজিং–এর নাম পাগলামি’ ছাড়া?
জীবনের শেষদিকে লতা মঙ্গেশকরের কাছে একটি সাক্ষাৎকার দিতে তিনি রাজি হন। লতা মঙ্গেশকরের মতো কিংবদন্তী হয়তো কখনোই আর কারও সাক্ষাৎকার নেননি। সেটিই ছিল প্রথম এবং শেষ। সেখানে কিশোর কুমার বলেন, তিনি কুন্দল লাল সায়গালকে তাঁর গুরু মানেন। প্রথমদিকে যখন তিনি গান শুরু করেন, তখন তার গায়কীতে কে এল সায়গলের ভাব চলে আসতো। পরে এস ডি বর্মণের পরামর্শে তিনি সেই প্রভাব থেকে বের হয়ে নিজের গায়কী খুঁজে নেন।
জীবনের প্রথম দিকে অনেক ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছিলো তাঁকে। যদিও তাঁর বড় ভাই অশোক কুমার ততদিনে বিখ্যাত অভিনেতা হয়ে উঠেছিলেন, তবুও তাঁর পথ সোজা ছিল না। অনেক নির্দেশক, প্রযোজক তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু নিজে কখনো পিছিয়ে যাননি। এমনও সময় এসেছিল, তিনি সঙ্গীতের কোনো একটি দলের মধ্যে কোরাস গান করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি বেশ কয়েকবার আঘাত পেয়েছেন। প্রথম প্রথম যারা তাঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল, তিনি তাঁদের কখনো ভুলতেন না। এমন একটি ঘটনা জানিয়েছেন, বিখ্যাত গীতিকার এবং কবি জাভেদ আখতার। একবার কিশোর কুমারের কাছে এক প্রযোজক আসে তাঁকে চুক্তিপত্রে সই করানোর জন্য। কিশোর কুমার তাঁকে বলেন, তিনি সই করবেন কিন্তু বাড়িতে না। গঙ্গার ধারে দুটি নৌকা একসাথে পাশাপাশি থাকবে। সেখানে তাঁরা দু’জন ধুতি-কুর্তা পরে যাবেন। দু’জনের কপালে লাল ফোঁটা থাকবে আর এবং সেই ফোঁটার উপর একটি চাল বসানো থাকবে। এভাবে সেই নৌকার উপর দাঁড়িয়ে তিনি কন্ট্রাক্ট সাইন করবেন। কিশোর কুমার যদি কারোর সাথে কাজ করতে না চাইতেন, তাহলে এমন অভিনব উপায়ে তাঁদেরকে না করে দিতেন।
বহু ছবি ছেড়েছেন। বহু ছবি অর্ধসমাপ্ত থেকেছে। তবু তাঁরই ভেতর ছেড়ে দেওয়া তিনটি ছবি ইতিহাস হতে পারত। তাঁদের কথা তাই আলাদা করে বলতেই হয়। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় ‘আনন্দ’ ছবির নাম–চরিত্রের জন্য ভেবেছিলেন কিশোরকুমারকে। সেই মর্মে ‘পাবলিসিটি’ও শুরু হয়েছিল। অভিনয় করবেন। গানও গাইবেন। শেষমেশ পিছিয়ে গেলেন কিশোর। অদ্ভুত কিছু শর্ত আরোপ করলেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল কিশোরের। রুমাদেবীর সঙ্গে বিবাহ সূত্রে তা পরিণত হয়েছিল পারিবারিক বৈবাহিক সম্পর্কে। ‘পথের পাঁচালী’র জন্য অর্থ সাহায্যও করেছিলেন একটা পর্বে। অথচ এই সত্যজিতের ছবিতেই অন্তত দুবার অভিনয়ের প্রস্তাব ছেড়ে দেন কিশোর। প্রথমবার ‘পরশপাথর’–এ। সম্ভবত পরেশবাবুর যুবক সেক্রেটারির চরিত্রে কিশোরকে ভাবেন সত্যজিৎ। আর পরেরবার ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’–এ। সত্যজিতের ভাবনায় প্রথম ‘গুপী’ ছিলেন কিশোরই। গানে। এবং অভিনয়েও।
১৯৮৭ সালের ১৩ই অক্টোবর এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান এই মহান শিল্পী। মৃত্যুর আগের দিনেও তিনি গান রেকর্ড করেছিলেন। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর গান এখনো রয়ে গেছে, তাঁর সুরেলা কণ্ঠ এখনও রয়ে গেছে। নতুন কোনো সঙ্গীত পরিচালক যখন কোনো গানে সুর দেন, সুর দেওয়ার পর এখনও অনেকে আফসোস করে বলেন, যদি তাঁর সেই গানটি কিশোর কুমার গাইতেন! কিশোর কুমার বেঁচে থাকবেন আজীবন সবার মনে, শুধু তাঁর গাওয়া গানগুলো দিয়ে।
(তথ্যসূত্র:
১- Kishore Kumar: An Authorised Biography by Kishore Valicha, Viking (১৯৯৮)।
২- Composer Kishore Kumar by Kamal Dhiman, Nikita Publications (২০১৭)।
৩- Kishore Kumar: Method in Madness, Derek Bose, Rupa Publications India (২০০৪)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত