সময়টা হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক। ১৮৮৯-৯১ সাল। প্রফুল্লচন্দ্র রায় সেই সময় প্রেসিডেন্সী কলেজে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক। একটি ভাবনা তাঁর মনকে বিশেষ ভাবে নাড়া দিল। তিনি দেখলেন কলেজে শিক্ষিত বাঙ্গালি যুবক অবলীলায় সেক্সপীয়ার আর স্পেন্সার আওড়াতে পারলেও জীবন যুদ্ধে ভীষণ ভাবে পরাস্ত। কারন তারা চায় চাকুরিবৃত্তি। আর চারিদিকে চাকরির আকাল। এই সুযোগে অবাঙ্গালিরা বিশেষত মাড়োয়াড়ীরা তাদের কর্মকুশলতা আর পরিশ্রমের জোরে শুধু কলকাতাতেই নয়, এমনকি সুদুর গ্রাম বাংলাতেও ব্যবসা বানিজ্যের ঘাঁটি গড়ে তুলল। এদিকে ইংরাজি, বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় পন্ডিত বাঙ্গালি যুবক ইউরোপীয় সওদাগরের অফিসে বৃথাই কেরানীগিরি লাভের আশায় কালপাত করতে লাগল। প্রফুল্লচন্দ্র অনুভব করলেন বাঙালিদের এই অকাল থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের স্বাবলম্বী হতে শিখতে হবে। দরকার শিল্পের।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন প্রফুল্লচন্দ্র দেখেছিলেন ইউরোপে বিজ্ঞান আর শিল্প ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। সেখানে নব নব বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এক একটি নতুন শিল্পের পথ খুলে দেয়। যেটা ভারতবর্ষে একেবারেই দেখা যায় না। এখানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুধু অন্তঃসারশূন্য ডিগ্রীধারী পন্ডিত তৈরি করে। আর কিছু নয়। তখনকার দিনেও বিভিন্ন রাসায়নিক ও ঔষধ পত্র বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। এদিকে বাংলায় কাঁচামালের অভাব নেই। সুতরাং তিনি ভাবতে শুরু করলেন কিভাবে প্রকৃতির এই অফুরন্ত সম্পদ অনাহারক্লিষ্ট বাঙ্গালির উদ্ধারকার্যে নিয়োগ করা যায়। প্রফুল্লচন্দ্র মনস্থির করলেন একটি রাসায়নিক ও ঔষধ তৈরির শিল্প প্রতিষ্ঠা করার। মেসার্স বটকৃষ্ণ পাল এন্ড কোং তখন কোলকাতার সবথেকে বড় ওষুধ বিক্রেতা। তাদের থেকে আশ্বাস পাওয়া গেল সঠিক জিনিস সরবরাহ করলে ক্রেতার অভাব হবে না।
কিন্তু একটি শিল্প গড়ে তোলা সহজ কথা নয়। অনেক রকমের বাধা বিপত্তি অতিক্রম করলে তবে সাফল্যের স্বাদ পাওয়া যায়। প্রফুল্লচন্দ্র লেবুর রস থেকে সাইট্রিক অ্যাসিড বানানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোলকাতার বাজারে লেবু সস্তায় পাওয়া যায় না। তাই লেবু থেকে সাইট্রিক অ্যাসিড বানিয়ে লাভ করার উপায় নেই। তারপর তিনি সাজিমাটির উপর গবেষনা আরম্ভ করেন। উদ্দেশ্য ছিল সাজিমাটি থেকে কার্বনেট অব সোডা (সোডিয়াম কার্বোনেট) তৈরি করা। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। জানা গেল এই সোডা তৈরির ব্যাপারে ব্রানার মন্ড এন্ড কোম্পানির এশিয়ার বাজারে একচেটিয়া অধিকার। চিন আর জাপানে তারাই সোডা সরবরাহ করে। সুতরাং লাভের আশা বিশেষ নেই। এই অবস্থায় তিনি ফসফেট অব সোডা এবং সুপার ফসফেট অব লাইম (রাসায়নিক সার) বানানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু এখন অন্য এক সম্যসার উদ্ভব হল। আগে সেই গল্প বলি।
ফসফেট অব সোডা আর সুপার ফসফেট অব লাইম বানানোর প্রধান উপকরন গবাদী পশুর হাড়। তখনকার মত কাজের জন্য প্রফুল্লচন্দ্রর ১০-১৫ মন হাড়ের প্রয়োজন ছিল। তাঁর বাড়ির পাশেই রাজাবাজার এলাকায় কসাইয়ের দোকান থেকে কয়েক বস্তা গরুর হাড় সংগ্রহ করা গেল। তিনি এই হাড় তাঁর বাড়ির ছাদে শুকাতে দিলেন। সময়টা শীতকাল। এমনিতে এই সময় বাংলায় বৃষ্টিপাত খুব একটা হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেই বছর জানুয়ারি মাসে টানা পনেরো দিন বৃষ্টি হল। ফলে হাড়ের সংলগ্ন মাংস পচে দুর্গন্ধ বেরতে লাগল। পচা মাংসে সুতোর মত পোকাও দেখা দিল। তার ওপর শুরু হল ঝাঁকে ঝাঁকে কাকের উপ্রদ্রব। তারা মহানন্দে পচা মাংস আর পোকা খেতে শুরু করল। হাড় নিয়ে টানাটানিতে কাকের দল সেগুলো আশপাশের বাড়িগুলোর ছাদেও ছড়াতে লাগল। পাশেই ছিল সম্ভ্রান্ত হিন্দু পল্লী। তারা প্রফুল্লচন্দ্রকে স্পষ্ট নোটিশ জারি করল, গোরুর হাড় ছাদ থেকে স্বেচ্ছায় সরানো না হলে তারা সরকারী সাহায্য নিতে বাধ্য হবে। শেষকালে এক নাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবসায়ী প্রফুল্লচন্দ্রকে সাহায্য করলেন। এই ব্যবসায়ীর মানিকতলার এক জমিতে হাড়গুলি একত্রিত করে অগ্নি সংযোগ করা হল। মধ্যরাতে হাড়ের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এতে স্থানীয় পুলিশ অফিসারের হল চক্ষুশূল। তিনি মাঝরাতে আগুন জ্বলতে দেখে কোন কুকর্মের গন্ধ পেলেন – “ইয়া ক্যা লাস জ্বলতা হ্যা” বলে দৌড়ে আসলেন। অনেক কষ্টে তাকে বোঝান গেল ব্যাপারটা কি। সবশেষে হাড়ভস্মতে সালফিউরিক অ্যাসিড যোগ করে সুপার ফসফেট অব লাইম বানান গেল। সেখান থেকে সোডার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি হল ফসফেট অব সোডা।
এতে প্রফুল্লচন্দ্র কিছুটা উৎসাহ পেলেন। এরপর তিনি ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ায় যেসব ঔষধ লিপিবদ্ধ আছে সেগুলি বানাতে তৎপর হলেন। Syrup Ferri Iodidi, Liquor Arsenicalis, এটকিনস সিরাপ, সিরাপ অব হাইপোফসফেট অব লাইম, টনিক অব গ্লিসেরোফসফেট, প্যারিস কেমিক্যাল ফুড প্রভৃতি বানাতে তার খুব একটা অসুবিধা হল না। কারন তিনি একজন প্রথম শ্রেনির রসায়নবিদ ছিলেন। তিনি ‘ফার্মাসিউটিকাল জার্নাল’, ‘কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিস্ট’ ইত্যাদি বৈদেশিক পত্র পত্রিকা খুজে নতুন রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত করার উপায় খুজতেন এবং কোন সমস্যার সমাধানও আবিস্কার করতেন। একবার তিনি দেখলেন যে তাঁর তৈরি সিরাপ অব আওডাইড অব আয়রন কিছুদিন পরেই একটু হলুদ হয়ে যায়। অথচ বিদেশ থেকে আনা সেই একই জিনিস অনেকদিন হালকা সবুজ থাকে। এই সমস্যার সমাধান তিনি পেলেন ওই সিরাপের সাথে সামান্য হাইপো ফসফরাস যোগ করে। এভাবে তিনি বিভিন্ন ‘trade secret’ নিজেই উদ্ভাবন করতে লাগলেন। অবশেষে তার তৈরি রাসায়নিক ও ওষুধ বাজারে ছাড়ার সময় হল। প্রতিষ্ঠা করলেন ‘Bengal Chemical and Pharmaceutical Works’ এর। কিন্তু এখানেই সমস্যার শেষ নয়।
স্থানীয় ওষুধ বিক্রেতাদের রসায়নশাস্ত্রে কোন জ্ঞান নেই। তাঁরা প্রফুল্লচন্দ্রর তৈরি ওষুধ দেখে প্রশংসা করল বটে, কিন্তু মাথা নেড়ে জানাল যে, ‘বড় বড় নামজাদা বিলাতি ফার্মের ঔষধ সহজেই বিক্রয় হয়, কিন্তু দেশি ঔষধ লোকে চায় না।’ সুতরাং তিনি বুঝলেন যে জনগনের কাছে তার কোম্পানির বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। এইসময় তাঁর দেখা হয় সতীর্থ ডাঃ অমূল্যচরন দের সঙ্গে। বাঙ্গালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বেকার সমস্যা কাটাতে প্রফুল্লচন্দ্রর এই শিল্প প্রচেষ্টা অমূল্যচরনের খুব পছন্দ হয়। তিনি যে কেবল এই ব্যবাসায়ে মূলধন নিয়োগ করলেন তাই নয়, উপরন্তু ডাক্তার হওয়ার সুবাদে চিকিৎসক মহলে যেন বেঙ্গল কেমিক্যালের ওষুধ সমাদৃত হয় সেই ব্যবস্থাও করলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় তখনকার দিনের উদীয়মান ডাক্তাররা – নীলরতন সরকার, সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রভৃতি স্বদেশপ্রেমে অনুপ্রানিত হয়ে একজন ভারতীয়র তৈরি ওষুধ প্রেস্ক্রাইব করতে লাগলেন। বলা বাহুল্য এতে প্রফুল্লচন্দ্রর ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ বাজারে বেশ নাম করতে শুরু করল। কালক্রমে স্থানীয় ওষুধ বিক্রেতাদের আলমারীতে তাঁর তৈরি ওষুধ জায়গা পেল।
বহু প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে কবিরাজী ওষুধের প্রচলন আছে। বাঙ্গালির ঘরে ঘরে ওইসব ওষুধের কার্যকারিতা সুপ্রমানিত। ডাঃ অমূল্যচরন দে ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’এর সাহায্যে দেশীয় গাছগাছড়া দিয়ে তৈরি ওষুধ ব্যবহার করে পথপ্রদর্শন করেলন। প্রফুল্লচন্দ্রর কারখানায় তৈরি হতে লাগল কালমেঘের সার, কুর্চ্চির সার, বাসকের সিরাপ, জোয়ানের সার। পাইকারী ব্যবসায়ীরা বাজারে তাঁর তৈরি জিনিসের খোজ করতে লাগলেন। এভাবে শুরু হল বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালসের এক নতুন অধ্যায়।
প্রফুল্লচন্দ্রর রাসায়নিক কারখানা পর্যবেক্ষন করে তখনকার ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটউট অব সায়েন্স’এর ডিরেক্টর ডঃ ট্রাভার্স লিখেছিলেন, “প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়ন বিভাগের ভূতপূর্ব ছাত্রগনই এই কারখানা নির্মান ও পরিচালনা করিতেছেন। সালফিউরিক অ্যাসিড প্রস্তুতের যন্ত্র এবং অন্যান্য ঔষধ প্রস্তুতের যন্ত্রের নির্মান ও পরিকল্পনার মূলে প্রভূত গবেষনার পরিচয় আছে এবং উহার দ্বারা এদেশের সবিশেষ উপকার হইবে।” প্রথমে মানিকতলা মেন রোডে কারখানা শুরু হলেও পরে পানিহাটি, কানপুর, মুম্বাইএ বেঙ্গল কেমিক্যালের শাখা স্থাপিত হয় ও বহু দেশবাশীর কর্ম সংস্থান হয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজের রসায়নের ক্লাস। ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় রইল না।
রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলার মন্ত্রটিও প্রবেশ করিয়ে দিতেন তিনি। যত টুকু দরকার, তার বাইরে কতটুকুই বা পড়ার আগ্রহ আছে আমাদের বইবিমুখ আগামীর? অথচ, বই পড়ার আগ্রহ থেকেই জন্ম হয়েছিল এই বাঙালি মনীষীর। নিজের সফলতাকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন সার্থকতার শিখরে।
১৮৬১, ২রা অগস্ট অবিভক্ত বাংলাদেশের রাড়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রপিতামহ মানিকলাল রায় ছিলেন নদিয়া (কৃষ্ণনগরের) ও যশোরের কালেক্টরের দেওয়ান। পিতামহ আনন্দলাল রায় ছিলেন যশোরের সেরেস্তাদার। পিতা হরিশচন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। বাবা মায়ের আদরের সেই ছোট্ট ফুলু পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন ‘মাস্টার অফ নাইট্রাইটস’ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
কেমন ছিল তাঁর এই জীবন পথ?
নিজ গ্রামে পিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই তাঁর শিক্ষার সূচনা। পিতা পুত্রের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। বই পড়া অপেক্ষা পিতার সঙ্গে কথা বলে অনেক বিষয় বেশি করে শিখতেন। ১৮৪৬ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণনগর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ, ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসনের লেখা ‘ব্রিটিশ কবিগণের জীবনী’ বইটি তিনি পান তাঁর পিতার কাছ থেকে। এটাই ছিল তাঁর অমূল্য পৈতৃক সম্পদ।
১৮৭০ সালে সপরিবার চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। রাত জেগে পড়াশোনা করার ফলে হজমের সমস্যা ও রক্ত আমাশয় হলে তিনি ফিরে আসেন নিজের গ্রামে। এই অসুস্থতাই ছিল তাঁর জীবনে ছদ্মবেশী-আশীর্বাদ। কারণ গ্রামে এসে তিনি অনেকখানি সময় কাটাতেন পিতার তৈরি লাইব্রেরিতে। বাঁধাধরা বইয়ের বাইরে, শেক্সপিয়ার, এমার্সন, কার্লাইল, ডিকেন্সের রচনা, নিউটন, গ্যালিলিও, ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী, বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি ইচ্ছেখুশি বই পড়ার আনন্দে মেতে উঠলেন তিনি। স্যর উইলিয়াম জোন্সের প্রশ্নের উত্তরে জোন্সের মায়ের উক্তি ‘পড়িলেই সব জানিতে পারিবে’ কথাটি প্রফুল্লচন্দ্রের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে।
১৮৭৩ সালে ফিরে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন অ্যালবার্ট স্কুলে। এরপর এন্ট্রান্স পাশ করে ভর্তি হন মেট্রোপলিটনে। কারণ বিদ্যাসাগরের এই কলেজটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেটি তাঁর ‘নিজের’ বলে মনে হত। ভারতে প্রথম এই প্রতিষ্ঠানটিই উচ্চশিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার মতো সুলভ করার সাহসী প্রচেষ্টা দেখায়। এফএ পড়ার সময় থেকেই প্রেসিডেন্সি কলেজে ‘বাইরের ছাত্র’ হিসেবে অধ্যাপকদের রসায়ন বিষয়ে বক্তৃতা শুনতেন। নিজের অজ্ঞাতসারেই তিনি রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। ইংরাজি সাহিত্যানুরাগী প্রফুল্লচন্দ্র বিজ্ঞানের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। রসায়ন নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সিতে। এখানে তিনি বিখ্যাত প্রফেসর আলেকজান্ডার পেডলারের সান্নিধ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ গৃহেই ছোট্ট গবেষণাগার গড়ে গবেষণা শুরু করেন। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির গিলক্রাইস্ট বৃত্তি পরীক্ষা দেন এবং উত্তীর্ণ হন। ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন।
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৮৮৪ সালে বিএসসি ডিগ্রি পান। এখানে ইন্ডিয়ান বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য মিউটিনি’ বিষয়ে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সত্যের সাধক ছিলেন বলেই ভারতে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাব সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছিলেন তাঁর সেই লেখায়। তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী প্রবন্ধটি পুরস্কৃত না হলেও প্রশংসিত হয়েছিল। এডিনবার্গ থেকেই ১৮৮৭ সালে ডিএসসি ডিগ্রির সঙ্গে সঙ্গে ‘হোপ প্রাইজ’ বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৮৮-তে তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়। প্রেসিডেন্সিতে শুরু হয় তাঁর শিক্ষক জীবন। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নেটিভ হওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত কম মাইনে ও কম সম্মানের প্রভিন্সিয়াল অধ্যাপক হিসেবে সেখানে যোগদান করেন তিনি। তাঁর সুন্দর বাচনভঙ্গি ও রসবোধ দিয়ে বাংলা ভাষায় বক্তৃতার মাধ্যমে রসায়নের পাঠ ছাত্রদের কাছে সহজবোধ্য ও মনোগ্রাহী করে তুলতেন। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সফলতার জীবন কাহিনি গল্পের ছলে তুলে ধরতেন ছাত্রদের কাছে। অল্প সময়েই শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ, পঞ্চানন নিয়োগী, পুলিন বিহারী সরকার, গোপালচন্দ্র চক্রবর্তী, এ কে ফজলুল হক, রসিক লাল দত্ত তাঁরই ছাত্র ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর গবেষণা।
শিক্ষক হিসেবে তাঁর কিছু নিজস্ব দর্শন ছিল। রসায়ন তিনি এমনভাবে পড়াতেন যেন মনে হতো তিনি সাহিত্যের বিরাট কোনো উপাখ্যান বর্ণনা করছেন। তিনি বলতেন যে,
“একজন শিক্ষক সর্বত্র জয় অনুসন্ধান করিবে কিন্ত পুত্র ও শিষ্যের নিকট পরাজয় স্বীকার করিয়া সুখী হইবে।”
একজন গবেষক হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র যেরকম অসম্ভব মেধার পরিচয় দিয়েছেন ঠিক সেরকমভাবেই শিক্ষক হিসেবেও স্থায়ী আসন গ্রহণ করেছেন তাঁর ছাত্রদের হৃদয়ে। নিজের ছাত্রদের তিনি পুত্রবৎ স্নেহ করতেন এবং খুব আনন্দঘন ভাবে সকল জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়গুলিকে তিনি ছাত্রদের সামনে উপস্থাপন করতেন। শিক্ষক হিসেবে নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে তিনি নিজের আত্মরচিতে বলেছেন-
“প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার ২৭ বছর অধ্যাপনা জীবনে আমি সচেতনভাবে প্রধানত নিচের ক্লাসেই পড়াতাম। কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাই স্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়। আমি কখনও কোন নির্বাচিত পাঠ্যবই অনুসরণ করে পাঠদান দিতাম না।”
তিনি কেবল মাত্র তার নিজের যশ খ্যাতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকেননি। পাশাপাশি তৈরি করেছেন এক দল দক্ষ ছাত্র ও সহকারী গবেষকদের যারা তার কাজে যুগপৎ সাহায্য করেছেন এবং পরবর্তীতেও নিজেদেরকে স্বাধীন ও প্রকৃষ্ট গবেষক রূপে গড়ে তুলেছেন। নীলরতন ধর, রসিকলাল দত্ত, পঞ্চানন নিয়োগী, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নামজাদা বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের দ্বারাই উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত। একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথাকথিত ডিগ্রির দিকে না তাকিয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন একজন ছাত্রের গবেষণার প্রবৃত্তি ও উৎসাহের উপর। তাঁর একজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে তিনি এমাইন নাইট্রেট আবিষ্কার করেছিলেন। অথচ শ্রীযুক্ত রক্ষিত নামের এই সহকারীটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তার গবেষণার সুপ্ত প্রতিভা প্রফুল্লচন্দ্র ঠিকই অনুভব করতে পেরে তাকে পরবর্তী গবেষণার সুযোগ দিয়ে বিজ্ঞানচর্চায় ভূমিকা রাখেন আর এইখানেই ছিল একজন শিক্ষক হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্রের সার্থকতা।
পাঠ্যবইয়ের বাইরের জ্ঞানকে তিনি সবসময়ই প্রাধান্য দিতেন।
এই শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণা কাজেও খুব মনোযোগী ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেছিলেন, তবে তাঁকে সবচেয়ে বড় খ্যাতি এনে দেয় মারকিউরাস নাইট্রেটের আবিষ্কার। ১৮৯৬ সালে তিনি পারদ ও নাইট্রিক এসিডের বিক্রিয়ায় এই যৌগ তৈরি করেন যা রসায়ন শাস্ত্রের এক অভিনব সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়। তাঁর গবেষণা পত্রের সংখ্যা ছিল ১৪৫টি। পরবর্তীতে ডাচ একাডেমী এবং লন্ডনের রসায়ন সমিতি তাঁকে সন্মানিক ফেলো নির্বাচিত করেন।
১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি অবসর নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন, যতদিন তিনি অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিন তিনি এক কপর্দক বেতন নেননি। এই অর্থ সঞ্চিত থাকত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি সব সময় তাঁর ছাত্রদের নিজের অলংকার হিসেবে বিবেচনা করতেন। জাগতিক কোন কিছুর প্রতি তাঁর কোন লোভ ছিল না কখনওই।
শুধুমাত্র গবেষণার কাজে তিনি নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখেন নি। জ্ঞানের ক্ষেত্র থেকে তাঁর অর্জিত সকল অভিজ্ঞতাকে তিনি শক্তিরূপে নিয়োগ করেছিলেন দেশের কাজে। যেখানেই দারিদ্র্য, বন্যা, মহামারি,দুর্যোগ সেখানেই তিনি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আত্মনিয়োগ করেছেন। সমগ্র বিশ্বই ছিল তাঁর সংসার। তাই তিনি বৈরাগ্যের মধ্যেই নিজের কর্মযজ্ঞের দ্বারা নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন।
এক দিন হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করলেন রসায়নের এক অতি বিষম বস্তু মারকিউরাস নাইট্রাইট। ইউরোপীয় বিজ্ঞানীগণ তাঁকে মাস্টার অব নাইট্রাইটস আখ্যায় ভূষিত করেন। পরনে ধুতি, কালো কোট, চুল অবিন্যস্ত, তাঁর এমন উদাসীন বেশভূষায় আবৃত ছিল এক দূরদর্শী কর্মচঞ্চল প্রাণ। তিনি বুঝেছিলেন, ‘‘একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী’’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন তিনি। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস। মূলধন বলতে ছিল, মাত্র আটশো টাকা আর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস।
এ ছাড়াও ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এডিনবার্গে থাকাকালীন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য রূপে বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা পরিদর্শন করে রাসায়নিক কারখানা তৈরির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনিই খুঁজে বের করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ধাতু সঙ্কর তৈরিতে ভারত যে পিছিয়ে ছিল না, চরক সংহিতা-সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্মাগ্র যন্ত্র যেমন স্ক্যালপোল বা ল্যানসেট তার প্রমাণ। ইস্পাত আবিস্কারের প্রথম কৃতিত্বও প্রাচীন ভারতের। প্রাচীন রসায়নে শুধু ইজিপ্ট, সিরিয়া, চিন বা আরব নয় প্রাচীন ভাতরবর্ষও যে কতটা এগিয়ে ছিল,তা তুলে ধরতেই তিনি লিখলেন ‘দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’। এ বিষয়ে প্যারিসের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্সিলিন বের্তেলোর সান্নিধ্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এই কাজের জন্য সংস্কৃত ও পালি ভাষা শিখেছিলেন। পাশ্চাত্যের অনেক আগে থেকেই প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগ থেকেই বিভিন্ন মুনি ঋষির হাত ধরে বিজ্ঞান চর্চা সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। প্রফুল্লচন্দ্রকে এই বিষয়টি আকৃষ্ট করে প্রবলভাবে আর তাই তিনি সেই বৈদিক যুগ থেকে চলে আসা হিন্দু রসায়নের ক্রমবিবর্তনকে লিপিবদ্ধ করবার উদ্যোগ নেন। ১৯০৪ এবং ১৯১৯ সালে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয় তার রচিত ‘আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’ বা ‘হিন্দু রসায়নের ইতিহাস’। এটি তাঁর অসামান্য কীর্তি। সেই সময় তিনি বিভিন্ন পুঁথিপত্রের উপর বিস্তর গবেষণা করে এই গ্রন্থটি রচনা করেন। পুরো ভারতবর্ষ, নেপাল ও লন্ডনের অনেক জায়গা ঘুরে তিনি এই গ্রন্থ লেখবার দুষ্প্রাপ্য ও প্রয়োজনীয় পাণ্ডুলিপি ও পুঁথি সংগ্রহ করেন। এই বইটির উপর একটি আলোচনা মূলক প্রবন্ধে গবেষকগণ মন্তব্য করেন,
“In this book he showed from an unbiased scientific standpoint, how much the knowledge of acids, alkali, metals, and alloys proceeded in different epochs of Indian history. He showed that, the science of metallurgy and of medicine had advanced significantly in ancient India; when Europe was practicing alchemy, India was not far behind.”
এই বইটির প্রশংসা করে তৎকালীন প্রখ্যাত রসায়নবিদ মারসেলিন বার্থেলো স্বয়ং চিঠি লেখেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে। সেইসময়ে বিশেষতঃ পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীদের কাছে ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানচর্চায় সমৃদ্ধির কথা জানানোর জন্যে বার্থেলো প্রফুল্লচন্দ্রকে ধন্যবাদ জানান।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি বলেন, ‘‘দেয়ার আর অকেশনস্ দ্যাট ডিমানডেড দ্যাট আই সুড লিভ দ্য টেস্ট টিউব টু অ্যাটেন্ড টু দ্য কল অফ দ্য কান্ট্রি। সায়েন্স ক্যান ওয়েট, স্বরাজ কান্ট।’’ তখন ছিল ইংরেজ শাসনামল। শাসকের অধীনস্ত হয়ে কখনও তিনি কোন অন্যায় সহ্য করেননি। এর স্বরূপ আমরা দেখতে পাই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাশ কৃত বঞ্চনাকর রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কলকাতা টাউন হলে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ সভা হয় সেখানে প্রফুল্লচন্দ্র ও যোগদান করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন –
“আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ, কিন্ত এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়।। আমি অনিষ্টকর এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি।”
এছাড়া আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র মহাত্মা গান্ধীর একান্ত অনুরাগী ছিলেন। দেশজ পণ্য ব্যবহারের জন্য যে আন্দোলন তখন বৈপ্লবিক আকার ধারণ করে সেই আন্দোলনে প্রফুল্লচন্দ্র ও একাত্মতা ঘোষণা করেন। ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর খাতায় তাঁকে “বিজ্ঞানীর বেশে বিপ্লবী” নামে ডাকা হত। ১৯৩০ সালে লবণ আইন অমান্যের স্থান হিসেবে তিনি নিজের গ্রাম রাড়ুলিকে নির্বাচিত করেন।
প্রফুল্লচন্দ্র অধ্যাপনা থেকে ৭৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের অধ্যয়ন ও জ্ঞানচর্চা করে গেছেন। জ্ঞানচর্চাকেই তিনি তাঁর জীবনের সাধনা ও একমাত্র ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। এইজন্যে তিনি কখনো বিয়ে করেন নি।
মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। অধ্যাপক থাকার সময় ডক্টর কুদরত ই খোদা এম এস সিতে প্রথম স্থান অধিকার করলে অনেকে তাকে প্রথম স্থান না দেওয়ার জন্যে প্রফুল্লচন্দ্রকে সুপারিশ করলে তিনি এর ঘোর বিরোধিতা করেন এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। তিনি জাতিভেদ প্রথায়েও বিশ্বাসী ছিলেন না। প্রাচীন ভারতে হিন্দু রসায়ন চর্চা তথা বিজ্ঞান সাধনার এত সমৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও জ্ঞান বিজ্ঞানে ভারতীয় উপমহাদেশের পিছিয়ে পড়ার পেছনে তিনি জাতিভেদ প্রথাকেই দায়ী করেছিলেন। তিনি তাঁর বইতে দেখিয়েছিলেন যাদের কাছে বিজ্ঞানের হাতে কলমে ফল পাওয়ার তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাদেরকে যখন জ্ঞান চর্চা থেকে বিরত রাখা হয় তখন থেকেই আস্তে আস্তে বিজ্ঞানের বিস্তারের দুয়ার ও সংকীর্ণ হতে থাকে। জীবন যাপনে তিনি ছিলেন একদম সাদামাটা। এক পয়সার বেশি সকালের নাশতার পেছনে ব্যয় করলে রেগে যেতেন। জামাকাপড় ও খুবই সাধারণ মানের পরতেন। অনেক মানুষ এত বড় অধ্যাপকের পোশাক দেখে অবাক হয়ে যেতেন। নিজে চরকা কেটে পোশাক তৈরি করেছেন নিজের জন্যে। তার অর্থের একটা বড় অংশ চলে যেত বিভিন্ন কলেজ, মানবকল্যান সংস্থা, দরিদ্র তহবিল, বিজ্ঞান সংগঠন প্রভৃতির প্রতি। সেই সময় বাংলায় স্থাপিত এরকম কোন শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তার অনুদান ছিল না। ১৯০৩ সালে তিনি দক্ষিণবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন আর কে বি কে হরিশ চন্দ্র ইনষ্টিটিউট (বর্তমানে কলেজিয়েট স্কুল)। নিজের গ্রামে তার দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর-খুলনার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় “ভুবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়”। বাগেরহাট পিসি কলেজ তারই কীর্তি। সাতক্ষীরা চম্পাপুল স্কুলও পি সি রায়ের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত। খুলনার দৌলতপুর বিএল কলেজ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ, বরিশালে অশ্বিণী কুমার ইনষ্টিটিউশন, যাদবপুর হাসপাতাল, চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতাল সহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠানে তিনি আর্থিক অনুদান দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও পি সি রায় ১৯২৬ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টাকা দান করে ছিলেন। একাধারে একজন শিল্পাদ্যোক্তা, সমাজ সংস্কারক,দার্শনিক, কবি, শিক্ষানুরাগী, বিপ্লবী দেশপ্রেমিক, অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র নিজের পরিচয় দিয়েছেন এভাবে,
“আমি বৈজ্ঞানিকের দলে বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী সমাজে ব্যবসায়ী, গ্রাম সেবকদের সাথে গ্রাম সেবক আর অর্থনীতিবিদদের মহলে অর্থনীতিজ্ঞ।”
তিনি বিশ্বাস করতেন,
“বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
তিনি বলতেন,
“ভারতের দারিদ্র্যের মূল কারণ হচ্ছে কৃষির উপর নির্ভরতা, কৃষিনির্ভর জনসংখ্যা সৃষ্টিই তার সকল সমস্যার মূল সমস্যা, তার অস্তিত্বের সমস্যা।”
এই দারিদ্র তাঁকে প্রচন্ড পীড়া দিত। ছাত্রদের বলতেন,
“তোমরা প্রতিজ্ঞা করো দেশকে গড়ে তুলবে, তোমাদের সাধনা দিয়ে জাতিকে সমৃদ্ধ করবে।”
তাঁর এই কর্মময় জীবনের নানান কীর্তির জন্য তিনি বেশকিছু সম্মাননা পেয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে প্রথমে ‘সিআইই (কম্প্যানিয়ন অফ ইন্ডিয়ান এম্পায়ার)’ এবং পরবর্তীতে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দেশবিদেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক ডক্টরেট। আর শিক্ষকতায় অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য আমরা তাঁর নামের সামনে এখন লেখি ‘আচার্য।’
রবীন্দ্রনাথ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় সম্পর্কে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন,
“বস্তুজগতকে প্রচ্ছন্ন শক্তিতে উদঘাটিত করে বৈজ্ঞানিক, প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর চেয়ে গভীরে প্রবেশ করেছেন কত যুবকের মনোলোকে। ব্যক্ত করেছেন তাঁর অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি ও বোধশক্তি।”
১৯৪৪ সালের ১৬ই জুন ৮৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের পুরো জীবনটি এক অনির্বচনীয় প্রেরণার উৎস। তাঁর প্রতি আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধা অর্থপূর্ণ হবে তখনই যখন আমরা তার জীবন দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে যাব। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে তিনি একজন সত্যিকার জ্ঞানতপস্বীর দৃষ্টান্ত।
কাকতালীয়ভাবে, কবিগুরু আর প্রফুল্লচন্দ্রের জন্মসাল একই। আজ আমরা কবিগুরুকে সবাই মনে রেখেছি। কিন্তু নিজেদের দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি আর বোধশক্তিকে ব্যক্ত করতে আমরা ভুলতে বসেছি সবাই-ই। তা করার জন্য যে আমাদের পিসি রায়ের মত মহীয়ানদেরকে মনে রাখা খুব দরকার, খুবই দরকার! তাঁর অর্জিত আয়ের প্রায় সবটুকুই দেশহিতার্থে দান করে গিয়েছেন। ত্যাগেই ছিল তাঁর তৃপ্তির আনন্দ। তাঁকে আমরা কতটা মনে রেখেছি? আমাদের অভ্যস্ত জীবনের চক্রবূহ্যে আত্মতৃপ্তি কোথায়? আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে আমরা ক্রমশ আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছি না তো?
(তথ্যসূত্র:
১- আত্মচরিত- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
২- আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র – শ্রী ফণীন্দ্রনাথ বসু।
৩- আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের জীবনবেদ- নন্দলাল মাইতি।
৪- P. C. Ray, “Life and experiences of a Bengali chemist,” 2 vols. Calcutta: Chuckervertty, Chatterjee & Co. 1932 and 1935.
৫- অধ্যায়ন ও সাধনা, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুত্রধর।
৬- দেশপ্রেমী বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, অচিন্ত্যকুমার মুখোপাধ্যায়, অর্ক প্রকাশ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত