তিনি ছিলেন পাক্কা ছ’ফুট চার ইঞ্চি লম্বা, গায়ের রং ছিল মর্তমান কলার মতো। তাঁর মেজাজটিও ছিল রাজার মতো। গটগট করে হাঁটা, পাইপ-মুখে আয়েশি ধোঁয়া-ছাড়া ছবি বিশ্বাস অভিনয়ের বাইরেও ছিলেন জমিদার, রাজা। আভিজাত্যের সঙ্গে রসবোধের বিক্রিয়ায় কী ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হয়, তার প্রমাণ ছিলেন তিনি। এছাড়া খুব শৌখিন ছিলেন। টালিগঞ্জের কাছে বাঁশদ্রোণীতে ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, সেখানে অনেকটা জায়গায় একটা পুকুরও ছিল। যত্ন করে বাগান করেছিলেন। দুষ্প্রাপ্য জবাগাছের চারা ইন্দোনেশিয়া থেকে প্লেনে উড়িয়ে এনেছিলেন এক বার। কলা, বেগুন, কড়াইশুঁটি, আলু, পেঁয়াজ – সব ফলত। খুরপি হাতে সকালে কাজ করতেন। কেউ গেলে লুচির সঙ্গে ‘স্বরচিত’ বেগুনভাজা খাওয়াতেন। অনেক বেগুন ফলত, কিন্তু তিনি তো ছবি বিশ্বাস, বেগুন বেচতে পারেন না! তাই এক ফড়েকে রোজ তিন পয়সা সের দরে কয়েক বস্তা করে বেগুন দিতেন বিক্রির জন্য। এক বার বাড়িতে দুটো গরু, একটা মোষ কিনে ডেয়ারি বানিয়েছিলেন। রোজ প্রচুর দুধ হত। খেয়ে, ছানা-মিষ্টি বানিয়েও পড়ে থাকত। ভেবেছিলেন, দুধ বিক্রির ব্যবসা করলে কেমন হয়? লিফলেট ছাপিয়ে-টাপিয়ে সে এক কাণ্ড করেছিলেন! ব্যবসাটা নিজে ক’দিন দেখে, দু’-তিন জন লোকের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার পর যা হয়, মাস কয় বাদে বাড়ির দুধে জল-যোগ দেখে তাঁর টনক নড়েছিল, এবং আবিষ্কার করেছিলেন, দুধ-বিক্রির টাকার হিসেব নেই, গোয়ালে গরু-মোষের স্বাস্থ্য-যত্নও ঝিমোচ্ছে। তখন সেই লোকেদের কাছেই জলের দরে গরুমোষ বেচে, ব্যবসার দি এন্ড করেছিলেন।
তেলরঙে মাটির ফুলদানি বা প্লাস্টিকের পাত্রের উপর তিনি আঁকতেন আশ্চর্য সুন্দর নকশা, ছবি। বাটিক, এমব্রয়ডারির কাজ করতেন। দেবনারায়ণ গুপ্ত দেখেছিলেন, বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে ছবি বিশ্বাস মাছের আঁশ দিয়ে মোটা কালো কাপড়ের উপর ফুলের সাজি বানাচ্ছেন। একসময় মিনার্ভা থিয়েটারে ‘ঝিন্দের বন্দী’ নাটকের রাতভর রিহার্সাল হত। কোনও কোনও দিন মহড়া এগারোটার মধ্যে শেষ হয়ে যেত, এ দিকে ছবি বিশ্বাসের ছিল অনিদ্রা রোগ, ঘুম আসত সেই ভোরের দিকে। তাই নিজের মেকআপ রুমে বসে বড় বড় পোড়ামাটির ঘটে রং-তুলি দিয়ে ছবি আঁকতেন – এগুলো নিজের স্মৃতিকথায় লিখে গিয়েছেন কমল মিত্র।
তাঁর রসবোধ ছিল দেখার মতো। পাহাড়ী সান্যাল আর ছবি বিশ্বাসের একটা গল্প খুব বিখ্যাত। বহু মানুষের বয়ানে এই গল্প স্থান-কাল পাল্টেছে। গল্পের নির্যাসটুকু এ রকম – কোন এক শ্যুটিংয়ে পাহাড়ী সান্যাল রেগেমেগে গজগজ করছিলেন, এটা নেই, ওটা নেই, সেটা নেই, এ ভাবে কাজ হয়! কোথাও একটুও শান্তি নেই! উত্তরে ছবি বিশ্বাস শুধু বলেছিলেন, ‘‘শান্তি এখানেই ছিল, এতক্ষণ!’’
একবার দার্জিলিংয়ে বাজে আবহাওয়ায় শ্যুটিং বন্ধ, সবাই মিলে তাসের জুয়ো খেলা হচ্ছিল। সব টাকা ছবি বিশ্বাস জিতে নিয়েছিলেন, হেরে গিয়ে বিকাশ রায়ের কাছে সিগারেটটুকু কেনার পয়সাও ছিলনা। তাই রাতে তিনি মনের দুঃখে কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলেন। এহেন সময়ে তাঁর ‘ছবিদা’ মান ভাঙাতে তাঁকে ডেকে তুলে সিগারেট খাইয়েছিলেন। তিনি নিজে অনিদ্রা রোগের জন্য বিনিদ্র ছিলেন, আর বিকাশ রায়কেও ঘুমোতে দেননি। বিকাশ রায় ঘুমের ভান করে পড়ে থাকলে গা থেকে কম্বল কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমার সিগারেট ফুঁকলি ফুসফুস করে, আর আমার সঙ্গে জেগে থাকবি না, এত বড় বেইমানি তোকে আমি করতে দেব! আমি তোর দাদা না?’’
ওদিকে তিনি মজা করতে গিয়ে কখনও বিপত্তিও বাঁধিয়ে বসতেন। ‘ঝিন্দের বন্দী’ নাটকে কমল মিত্রের সঙ্গে তরবারি-যুদ্ধের একটা দৃশ্য ছিল, তাতে ব্যবহৃত হয়েছিল আসল স্প্যানিশ সোর্ড। ঠিক হয়েছিল, দু’জনের মধ্যে ১২ নম্বর মার অবধি চলবে, তারপরে প্রতিটা মার রিহার্সড হবে। ছবি বিশ্বাস সে দিন কী মনে করে ৩-এর পর ৬ নম্বর মার চালিয়ে দিয়েছিলেন, কমল মিত্রের খাকি কোটের হাতা ভেদ করে তরোয়ালের ডগা ঢুকে গিয়েছিল তাঁর বাঁ হাতের কনুইয়ে। রক্তে ভেজা জায়গাটা ডান হাতে চেপে ধরেই পরের দৃশ্যে অভিনয় করেছিলেন কমল মিত্র। সিনের পর ছবি বিশ্বাসকে তিনি চেপে ধরতেই ছবি বিশ্বাস বেমালুম অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘‘তুমিই তো মারের ভুল করলে!’’
সব বড় শিল্পীই বুঝি অনন্ত ছেলেমানুষ হন। ছবি বিশ্বাসও ব্যতিক্রম ছিলেন না। বিকাশ রায়ের অনবদ্য লেখা থেকে তুলে ধরা যাক –
‘‘লাঞ্চের ছুটির আগেই ছবিদা এলেন, আমাকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে পাহাড়ীদার কাছে গিয়ে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘পাহাড়ীবাবু, ‘সাজঘর’-এ আমার পার্ট আপনাকে দিয়েছিলাম, এখন আপনি সেই পার্ট আমাকে ফেরত দিন।’
পাহাড়ীদার জবাব, ‘এ ছবি ‘সাজঘর’ নয়, এর নাম ‘অর্ধাঙ্গিনী’। এ ছবিতে আমার পার্ট আমি আপনাকে দেব না মশাই। আর সেট-এ আমাকে ডিসটার্ব করবেন না, ডিরেক্টরকে বলুন।’
ছবিদা আমার দিকে ফিরতেই আমি বললাম, ‘লাঞ্চ ব্রেকের আগে আমাকে দুটো শট নিতেই হবে। জ্বালাতন করবেন না, চুপ করে বসুন।
ছবিদা কোনও কথা না বলে একটি চেয়ার টেনে ক্যামেরার সামনে বসলেন। বললেন, ‘আমার পার্ট দে।’
আমি বললাম, ‘পার্ট নেই।’
ছবিদা বললেন, ‘ঠিক আছে … তুই অন্তত আমাকে একটা এক্সট্রার পার্ট দে।’
‘মানে?’
‘মানে, ছবি বিশ্বাসকে এক্সট্রা সাজাবি, একটা ক্লোজ আপ দিবি তো। ওই এক শটেই তোদের সব্বাইকে মেরে দেব।’
আমি বললাম, ‘ছবিদা প্লিজ সরে বসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
ছবিদা বললেন, ‘আমি সত্যাগ্রহ করছি। হয় পার্ট দে, না হলে আমার মাথা সুদ্ধু ছবি তোল।’
অনেক বলেকয়ে, ফ্রি লাঞ্চ খেতে দেব বলে, তবে ভদ্রলোককে সরানো গেল।’’
সত্যজিৎ রায় বলতেন, ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তাঁর কাজ সাড়ে তিনখানা। ‘জলসাঘর’, ‘দেবী’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ – তিনটে। আর ‘সাড়ে’খানি হল ‘পরশপাথর’-এ ককটেল পার্টির দৃশ্য। সেখানেও ছবি বিশ্বাস আছেন, ডায়ালগহীন। ছবি বিশ্বাস ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ করতে গিয়েও এক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেছিলেন। মনোজ মিত্র সে গল্প শুনেছিলেন থিয়েটারের বর্ষীয়ান শিল্পী-কর্মীদের মুখে। আউটডোরে দীর্ঘদিন বাইরে থাকতে হবে শুনে ছবি বিশ্বাস নাকি বলেছিলেন, সোম থেকে বুধ ঠিক আছে, কিন্তু বৃহস্পতিবার তো আমাকে কলকাতা ফিরতেই হবে! (তখন বৃহস্পতি-শনি-রবি নাটক হত)। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, তা তো হবে না। ছবি বিশ্বাস তখন ‘না’ বলে চলে এসেছিলেন। পরে থিয়েটারের সবাই সে কথা জানতে পেরে তাঁকে বলেছিলেন, সে কী, আপনি কাকে ‘না’ করলেন, সত্যজিৎ রায়কে! থিয়েটার কাল না-ও থাকতে পারে, সত্যজিৎ রায়ের কাজটা যে ইতিহাসে থেকে যাবে! তাঁরাই আবার ছবি বিশ্বাসকে সত্যজিৎ রায়ের কাছে ফেরৎ পাঠিয়েছিলেন।
স্বয়ং সত্যজিৎ রায় লিখে গিয়েছেন ওঁর অসম্ভব স্মরণশক্তির কথা। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র শ্যুটিংয়ের আগে ছবি বিশ্বাসকে বলেছিলেন, তাঁর সিন আর সংলাপগুলো নিয়ে একটু কথা বলে নিতে চান। শুনে ছবি বিশ্বাস জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন, কিছু অদলবদল করেছেন না কি? সত্যজিৎ রায় ‘না’ বলাতে উনি বলেছিলেন, তা হলে আর কথা বলে নেওয়ার কী দরকার! শ্যুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায় দেখেছিলেন, পাতার পর পাতা সংলাপ, সব ছবি বিশ্বাসের ঠোঁটস্থ। তিনি লিখেছেন মেকআপে ‘ছবিবাবু’-র বিতৃষ্ণার কথাও। দাড়িগোঁফ লাগাতে গেলে স্পিরিট গাম লাগাতে হত, তাতে তাঁর ‘ডেলিকেট’ স্কিনে সমস্যা হত। ‘দেবী’-র কালীকিঙ্কর তাই গোঁফ লাগাতে চাননি। সত্যজিৎ রায়ের ভাষ্যে, একটা ‘যাত্রা–মার্কা গোঁফ’ দেওয়া হয়েছিল, ‘প্রতি শট্-এর আগে পিছনে এক পোঁচ আঠা লাগিয়ে থাবড়া দিয়ে সেটিকে নাক ও ঠোঁটের মধ্যিখানে আটকে নিতেন।’ স্টার থিয়েটারে ‘ডাকবাংলো’ নাটকে ছবি বিশ্বাস ন’বছর পর মঞ্চে ফিরেছিলেন। বিশ্বেশ্বর নামের চরিত্রটির কাঁচাপাকা পরচুল, দাড়ি-গোঁফ, সব ছিল। কিন্তু ফুল রিহার্সালের দিন তিনি নির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্তকে জানিয়েছিলেন, দাড়ি নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। ফলে সেটি বাদ গিয়েছিল। কয়েকটা অভিনয় হবার পরে, একদিন জানিয়েছিলেন, পরচুলা পরে মাথা বড্ড দপদপ করছে। তাই সেও দূর করা হয়েছিল। শেষে বাকি ছিল গোঁফ। তিনি সেটি সিন-এ পরতেন, সিন শেষ হলেই গোঁফ খুলে হাতে আটকে রাখতেন। শততম অভিনয়ের পর এক রাতে দেখা গেল, নাটক চলছে, ছবি বিশ্বাস মঞ্চে আর গোঁফটি সাঁটা হাতে! অতঃপর পরদিন থেকে গোঁফটিও বাদ গিয়েছিল। ছবি বিশ্বাস কাগজে মুড়ে সেই গোঁফ নির্দেশককে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, সঙ্গে একটা কাগজে লিখেছিলেন, ‘ঝামেলা ফেরত দিলাম। প্রাপ্তিসংবাদ দিস।’
ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল পরিচালক তপন সিনহার। অবশ্যই এইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে ছবি বিশ্বাসের নকল দাড়ি-গোঁফ সংক্রান্ত সমস্যাও ছিল। তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ দেখে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়! তত দিনে কিন্তু ছবিটা নিয়ে হই হই পড়ে গিয়েছিল সারা ভারতে। পরিচালক তপন সিনহার নামে ধন্য ধন্য করছিলেন সকলে। তখনই একদিন হঠাৎ সত্যজিৎ রায় ফোন পরিচালককে বলেছিলেন, ‘‘নিজে একজন টেকনিশিয়ান হয়ে এত খারাপ টেকনিকাল কাজ করলেন কী করে?’’ রাগের কারণ শুনে ফোনেই প্রায় হাতজোড় করেছিলেন তপন সিনহা। অসহায়তার কথা কবুল করেছিলেন। তাতে আরওই ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর বহুকালের সুহৃদ সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘‘এত ভালমানুষ সাজবার দরকার নেই। কাজের সময় কোনও দিন কমপ্রোমাইজ করবেন না।’’ তপন সিনহার অপরাধ কী ছিল? ছবি বিশ্বাসের মতো অমন মাপের এক জন শিল্পী, কিছুতেই স্পিরিট গাম দিয়ে দাড়ি লাগাতে দিতেন না। ফলে কাবুলিওয়ালার দাড়িটি হয়েছিল প্রায় কদাকার। বার্লিন ফেস্টিভ্যালে ছবিটি দেখে এক বিদেশি সাংবাদিক পরিচালকের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন, ‘‘অভিনয়টি এতই ভাল যে, আপনাকে উনি ওঁর দাড়ির ব্যাপারটা ভুলিয়ে ছেড়েছেন।’’ (‘‘হি ইজ সো গুড দ্যাট হি মেক্স ইউ ফরগেট অ্যাবাউট হিজ বিয়ার্ড।’’)
কিন্তু ছবি বিশ্বাসকে এসব বোঝায় সেটা কার সাধ্য ছিল! এমন এমন সব বিশ্বাস ছিল তাঁর, খুব কড়া ধাঁচের মানুষ না হলে, তা থেকে তাঁকে বের করে আনা ছিল রীতিমতো ঝকমারি ব্যাপার। ‘কাবুলিওয়ালা’-তে আরও দু’বার অদ্ভুত কাণ্ড করেছিলেন ছবি বিশ্বাস।
প্রথমে কাকে করবেন ‘কাবুলিওয়ালা’, সেটাই ভেবে পাচ্ছিলেন না তপন সিনহা। ছবি বিশ্বাস শুনে বলেছিলেন, ‘‘কাবলেদের সম্বন্ধে আমাকে একজন অথরিটি ভেবে নিতে পারো। ওদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছি।’’ এটা শুনে আশাবাদী হয়ে তপন সিনহা বলেছিলেন, ‘‘তা’হলে তো ওদের পুশতু ভাষাও একটুআধটু জানেন। কিছু সংলাপ পুশতুতে দিতে চাইছি।’’ এতে যেন একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। বলেছিলেন, ‘‘শুধু শুধু পুশতু-মুশতু আনতে গেলে কেন? বুঝবে কে?’’ উত্তরে পরিচালক জানিয়েছিলেন, ‘‘না বুঝলেও চলবে। এতে অভিনয়ের একটা ডায়মেনশন আসতে পারে।’’ ছবি বিশ্বাস একটু ভেবে বলেছিলেন, ‘‘তা ঠিক। একটা কাবলেকে ধরে শিখে নিলেই চলবে। বাদবাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। কেমন পোশাক-পরিচ্ছদ, মেকআপ, চলাবলা …।’’ তপন সিনহা তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে একটা বাড়িতে অনেক কাবুলিওয়ালা থাকে। তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে মাঝে মাঝে আপনার কাছে যাবে।’’
এর পরের কাহিনী তপন সিনহার ভাষ্যেই জানা যাক। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন, ‘‘সেটটি ছিল মেটিয়াবুরুজের একটা মুসলমান হোটেলের অংশবিশেষ। … আমরা যখন সেট লাইট প্রভৃতি নিয়ে ব্যস্ত, হঠাৎ ছবি বিশ্বাস কাবুলিওয়ালার বেশে প্রবেশ করলেন। চমকে উঠলাম। এ কাকে দেখছি? অতি দরিদ্র মলিন বেশধারী হিং বিক্রেতা কোনও কাবুলিওয়ালা, না সদ্য কবর থেকে বেরিয়ে আসা স্বয়ং মহম্মদ বিন তুঘলক? মাথায় জরির পাগড়ি। গায়ে সিল্কের আচকানের ওপর জরির কাজ করা হাতকাটা জ্যাকেট। পায়ে সোনার জরির কাজ করা নাগরা। তখন আমি তিনশো টাকা মাইনের এক জুনিয়র পরিচালক। আর ছবি বিশ্বাস হলেন সে যুগের অজেয় দুর্দান্ত অভিনেতা। সুতরাং ইগনোর্যান্স ইজ্ ব্লিস কথাটি ভেবে কাজ শুরু করে দিলাম।’’
ওদিকে বিকেল বেলা ছবির প্রযোজক অসিত চৌধুরী হাজির হলেন। দেখে শুনে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বাদেই তাঁর প্রস্থান হয়েছিল। তিন চার দিন বাদে অসিতবাবু মুখ খুলেছিলেন, তপন সিনহাকে বলেছিলেন – ‘‘দেখুন মশায়, ছবিদাকে ওই ঔরঙ্গজেবের পোশাক ছেড়ে গরিব কাবুলিওয়ালা সাজতে হবে। যতটা কাজ হয়েছে ফেলে দিন।’’ ঠিক হয়েছিল তাঁরা দু’জনে মিলে গিয়ে কথাটা বলবেন ছবি বিশ্বাসের কাছে। বেশ ভয়ে ভয়েই ছবি বিশ্বাসের কাছে কথাটা বলেছিলেন তাঁরা। শুনে প্রথমে চমকে উঠলেও পরে অবশ্য যুক্তিটা মেনে নিয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। তখন আবার নতুন করে পোশাক তৈরি করা হয়েছিল। নতুন করে শ্যুটিং শুরু হয়েছিল।
কিন্তু ছবি বিশ্বাসের দ্বিতীয় কাণ্ডটি ছিল আরও মারাত্মক। ছবি বিশ্বাসকে নিয়ে তপন সিনহা বলে গিয়েছেন, ‘‘যেমন সুদক্ষ অভিনেতা তেমনি আবার ফাঁকিবাজও ছিলেন।’’ এই ঘটনাটি অনেকটা সেই ধাঁচেরই বটে। সে বার শ্যুটিং হচ্ছিল কাশ্মীরে। শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁওয়ের পথে বেশ কিছু ভেতরে সুন্দর একটা উপত্যকায়। অনেকটাই কাবুলের সঙ্গে মিলে যায় তার গড়ন। নানা জায়গা ঘুরে ঘুরে শ্যুটিং করে তপন সিনহার শরীর তখন বেশ কাহিল ছিল। রোজ রাতে জ্বর আসছিল। শ্যুটিঙের দিন ভোরবেলা ছবি বিশ্বাসকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘শরীরটা আর দিচ্ছে না। আপনি তাড়াতাড়ি চলে আসুন। আজকেই কাজ শেষ করে নেব।’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’’ তপন সিনহা লিখেছেন – ‘‘শ’খানেক ভেড়া ও লোকজন জড়ো করে অপেক্ষা করছি। এমন সময় ওঁরা এলেন। দূর থেকে দেখছি জিপ থেকে কাবুলিওয়ালা নামলেন, কিন্তু তার পর যিনি নামছেন, তিনি কে? স্যুট পরা লম্বা চওড়া এক ভদ্রলোক! কাছে আসতে চমকে উঠলাম, উনি তো ছবি বিশ্বাস! তা’হলে কাবুলিওয়ালা কে? এসেই বললেন, দারুণ জায়গা বেছে নিয়েছ তো! এত সুন্দর জায়গায় কি আর আমার ক্লোজ-আপ নেবে? তাই তোমার সহকারী বলাইকে কাবুলিওয়ালার মেকআপ করালাম। একটু লং-এ ট্রিট করলে কেউ ধরতে পারবে না।’’ তপন সিনহা বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন! বলেন কি ভদ্রলোক! কিন্তু আর তো উপায়ান্তরও ছিলনা। অতএব? শ্যুটিং হয়েছিল ওই বলাইকে দিয়েই! বলাই বাহুল্য, ছবিতে কাবুলের দৃশ্যে আজও কাবুলিওয়ালা বেশে যাঁকে দেখা যায়, তিনি ছবি বিশ্বাস নন, তিনি বলাই সেন।
মানুষ যে কত বিচিত্র হয়! কত বৈপরীত্যে ভরা তার যে আচার-আচরণ! সেটা এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু এই ছবি বিশ্বাসকেই আবার সম্পূর্ণ অন্য চিত্রেও পাওয়া যায়। সময়টা ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর। আউটডোরে যেতে তখন অল্প ক’দিন বাকি। পোস্টমাস্টারের চরিত্রটি তখনও কে করবেন, সেটা ঠিক করতে পারেননি পরিচালক তপন সিনহা। ছবি বিশ্বাসের কাছে গিয়ে কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘‘কাকে নিই বলুন তো?’’ উত্তর এসেছিল, ‘‘একজনই আছে।’’ তপন সিনহা সাগ্রহে জানতে চেয়েছিলেন – ‘‘কে?’’ উত্তর এসেছিল – ‘‘তাঁর নাম ছবি বিশ্বাস।’’ তপন সিনহা নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তখন। তপন সিনহা তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘মাত্র দু-তিন দিনের কাজ। রাত বারোটায় ফ্লাইট। সেখান থেকে গাড়ি। আপনার শরীর অত ধকল নিতে পারবে?’’ তাঁকে স্বস্তি দিয়ে ছবি বিশ্বাস বলেছিলেন – ‘‘খুব পারবে। ঘাবড়াচ্ছ কেন?’’ তখন তিনি স্টার থিয়েটার-এ। নিয়মিত স্টেজ করতেন। প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হত। তার মধ্যেই তিন দিন ‘ম্যানেজ’ করে কাজ করতে ছুটেছিলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ অভিনয় করার জন্য।
বারাসতের জাগুলিয়ায় জমিদারি ছিল দে বিশ্বাস পরিবারের। ‘দে’ পদবি, ‘বিশ্বাস’টা নাকি তাঁর পূর্বপুরুষ পেয়েছিলেন আকবর বাদশাহর কাছ থেকে। বাবা ভূপতিনাথ দে বিশ্বাসের চার ছেলের মধ্যে ছোট ছিলেন শচীন্দ্রনাথ। জন্মেছিলেন ১২ই জুলাই ১৯০০ সালে। বয়স এক না পেরোতেই মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। প্রিয়দর্শন শিশুটিকে মা আদর করে ‘ছবি’ নামে ডাকতেন। সেই নামটাই রয়ে গিয়েছিল আজীবন, আর রয়ে গিয়েছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও!
অভিনয় জীবনের শুরুটা করেছিলেন সতু সেনের রঙমহল-এ, নাটক দিয়ে। ১৯৩৬ সালে অভিনেতা-পরিচালক তিনকড়ি চক্রবর্তী ছবি বিশ্বাসকে মুখ্য ভূমিকায় নিয়েছিলেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ (পরে উত্তমকুমার যে ছবি করেছিলেন আবারও) ছবিতে। লম্বা, সুদর্শন নায়কটিকে কিন্তু তখনকার দর্শক নেননি। ছবি বিশ্বাস এখানে-ওখানে ঘুরতেন নতুন কাজের আশায়। এক দিন শুনেছিলেন, কমেডিয়ান-চরিত্রে অভিনয় করা এক অভিনেতা নাম নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, নাকি বদনাম করে বেড়াচ্ছেন তাঁর নামে। এক দিন পাকড়াও করেছিলেন তাঁকে। গম্ভীর হয়ে নৃপতি তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘বদনাম করার মতো কাজ করেছেন, তাই বদনাম করে বেড়াচ্ছি।’’ সে আবার কী! সেই জায়গায় দাঁড়িয়েই নৃপতি তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অভিনয়ের ভুলচুক, খামতিগুলো। কেমন হবে হাঁটা, তাকানো, ডায়ালগ থ্রো, টাইমিং – সব কিছু। সে দিন থেকেই নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ছবি বিশ্বাসের ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড হয়ে গিয়েছিলেন। সেই ভালবাসা, বন্ধুতা অটুট ছিল আজীবন।
১৮ই জানুয়ারি ১৯৪১ সালে, চিত্রা-য় মুক্তি পেয়েছিল দেবকী বসুর ‘নর্তকী’। ৪১ বছরের ছবি বিশ্বাস সে ছবিতে হয়েছিলেন অশীতিপর এক সন্ন্যাসী! কেউ তখন বিশ্বাসই করতে পারেননি, ইনি আসলে বৃদ্ধ নন! অনেক পরে তপন সিংহের ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এ একই বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন বছর চল্লিশের মনোজ মিত্র। ‘নর্তকী’-র মধ্য দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়ে গিয়েছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতাকে। একটু বেশি বয়সেই ছবির জগতে এসে, ২৬২ খানা মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিকে হাতে ধরে পার করে দিয়েছিলেন চরিত্রাভিনয়ের বৈতরণী। খানদানি জমিদার, অভিজাত বাঙালি বা ইঙ্গবঙ্গ চরিত্রে ভাবতেই দেননি আর কাউকে।
১৯৩৬ থেকে ৪১ সাল পর্যন্ত টানা নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে হঠাৎই ‘নর্তকী’ ছবির রোম্যান্টিক চরিত্র ছেড়ে তিনি স্বামীজীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে ছবি মুক্তি পাওয়ার পর ঘোষণা করেছিলেন – এ বার থেকে তিনি চরিত্রাভিনেতা। এ কথা শুনে উত্তমকুমার বলেছিলেন এমন সিদ্ধান্ত শুধু ওই অভিনেতার পক্ষেই নেওয়া সম্ভব। পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ভারতবর্ষের ‘বেস্ট স্ক্রিন অ্যাক্টর’ শিরোপা দিয়ে বলেছিলেন, অভিনয় জগতে তিনি একটা যুগ। চলচ্চিত্রে অভিনয়ে একটা থিয়েটারি ঢঙ ছিল। প্রথমে সেটি ভাঙেন প্রমথেশ বড়ুয়া। পরে যিনি অভিনয় শিল্পকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন অতীতের তাঁরায় সেই ‘ব্লু-ব্লাডেড অভিনেতা’ ছবি বিশ্বাস।
… “মে আই স্পিক টু মিসেস রিনা ব্রাউন?” …
… “লেকিন খোঁকি তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে না, হামাকে ছেড়ে কোত্থাও যাবে না।” …
… “দাও, ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বচ্ছর।” …
… “সুদখোরের টাকায় আমার একমাত্র ছেলের উপনয়ন হতে পারে না তারাপ্রসন্ন।” …
… “মনে রাখব? কেন মনে রাখব? ওর বিশেষত্বটা কী?” …
সপ্তপদী, কাবুলিওয়ালা, সবার উপরে, জলসাঘর, কাঞ্চনজঙ্ঘা – বাঙালির মনে এমন আরও ছবির সংলাপ স্পষ্ট হয়ে রয়েছে শুধু ছবি বিশ্বাসের অভিনয়ের গুণে। গিরিশ-যুগের অভিনয়ের ধারাটি শিশির ভাদুড়ি বা অহীন্দ্র চৌধুরী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। একই মঞ্চে, একই ধারায় তাঁদের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। কিন্তু সর্বত্রই বজায় ছিল তাঁর স্বকীয়তা। মন্মথ রায়ের ‘মীরকাশিম’ নাটকে ছবি বিশ্বাস নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। এ তো গেল মঞ্চের কথা। চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় প্রসঙ্গে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,
“ছবিবাবু না থাকলে ‘জলসাঘর’-এর মতো চিত্ররূপ দেওয়া সম্ভব হত কিনা জানি না। বোধ হয় না। এক দিকে বিশ্বম্ভর রায়ের দম্ভ ও অবিমৃষ্যকারিতা, অন্য দিকে তাঁর পুত্রবাৎসল্য ও সঙ্গীতপ্রিয়তা এবং সব শেষে তাঁর পতনের ট্র্যাজেডি – একাধারে সবগুলির অভিব্যক্তি একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল।”
মাত্র বাষট্টি বছরের জীবন। ১৯০০ সালে জন্ম নেওয়া মানুষটি বাংলা ছবিকে হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছিলেন আধুনিকতার আঙিনায়, বললে ভুল হবে কি? আর মঞ্চের ছবি বিশ্বাসও তো শুধু পটে নয়, ইতিহাসেও লেখা। বাঙালিরা শিল্প নিয়ে কথা কইতে গেলে ‘যুগ’ শব্দটি বলতে বড় ভালবাসেন। রবীন্দ্র যুগ, অহীন্দ্র যুগ। সে কালের থিয়েটার-ভক্তরা বলেন, অহীন্দ্র চৌধুরী-শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পর বাংলার মঞ্চে ছিল ছবি বিশ্বাস যুগ। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দুই পুরুষ’, মনোজ বসুর কাহিনি-আধারিত ‘ডাকবাংলো’, দেবনারায়ণ গুপ্ত-র ‘শ্রেয়সী’, ‘ঝিন্দের বন্দী’, কত ঐতিহাসিক নাটক! শিশির ভাদুড়ীর ভাই ছিলেন ছবি বিশ্বাসের সহপাঠী, তাই শিশিরবাবুকে ‘বড়দা’ বলতেন। কাছ থেকে অভিনয় দেখেছিলেন, শিখেছিলেন, তার পর পাল্টেছিলেন সেই অভিনয়কে। ম্যানারিজম-হীন সেই অভিনয়ের গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়ত চরিত্রের আভিজাত্য, দাপট, কারুণ্য, ভাঙচুর। ফিল্ম-কেরিয়ারের তুঙ্গ পর্যায়ে ন’বছর বাদ পড়েছিল মঞ্চাভিনয়, শরীরও ভাল যাচ্ছিল না। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে যে দিন স্টার থিয়েটারে ফিরেছিলেন, বুকিং অফিস খুলতেই লম্বা লাইন পড়েছিল, প্রতিটা শো হাউসফুল হয়েছিল। বক্স অফিস টানেন নায়ক-নায়িকারা আর ছবি বিশ্বাস – এ ছিল অমোঘ সত্য।
বাংলা সিনেমায় তত দিনে বাবার রোল মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ছবি বিশ্বাস, আর বাঙালি বাড়িতে বাড়িতে বাপ-জ্যাঠা-ঠাকুর্দাদের প্রায় ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল ছবিবাবু। ছেলেপুলেরা সে সময় কোনও কোনও বাড়িতে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইতে যেতে ডরাত, ছবি বিশ্বাসের ডায়ালগ শুনতে হবে বলে। ‘চাঁদা তো চাইছিস খুব, দিনে ক’বার বইয়ের পাতা ওল্টানো হয় শুনি!’ পাড়ার সুন্দরী মেয়েদের বাবারা তো ছবি বিশ্বাস ছিলেনই। যাঁদের দর্শন পাওয়া মাত্র তল্লাটের রোমিওরা নিমেষে অলিগলি বেয়ে বেপাড়ায় পাচার হয়ে যেত। ‘সপ্তপদী’ দেখে এসে রোমিওরা রোয়াকে বসে কপাল চাপড়ে ছবির ক্রাইসিস বুঝিয়ে দিত, “সব ঠিকঠাকই যাচ্ছিল, ছবি বিশ্বাস এসে সব বিগড়ে দিল।” এর পিছনের কারণটা বোঝা খুব কঠিন নয়। বাঙালি পরিবারের বাবা-জ্যাঠাদের দেখে ছবিবাবু যেমন তাঁর অভিনয় সাজিয়েছিলেন, তেমনই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে বাড়ির বাবা-কাকারাও তাঁকে মডেল করে কায়দাকানুন রপ্ত করা শুরু করেছিলেন। পাহাড়ি সান্যাল ও কমল মিত্রও সে সময় দিব্যি মানিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির কর্তা বা জমিদারের রোলে। কিন্তু পরিবারের বয়স্কদের মেজাজমর্জিতে ভর করে থাকতেন ছবি বিশ্বাস। উঠতি বয়সে ছোকরাদের কাছে যা ছিলেন উত্তমকুমার, পরিণতবয়সীদের কাছে তাই হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। ছায়াছবির ছবি আর জীবনের ছবি প্রায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
মঞ্চের সফল অভিনয় থেকে রুপোলি পর্দায় এসে এত চমৎকার ধরে নিয়েছিলেন সিনেমার অভিনয় যে আগামী বিশ বছর তাঁর কাজের ঠিকানা হয়ে গিয়েছিল ফিল্ম স্টুডিয়ো, আর ‘নর্তকী’-র সাফল্য তাঁকে অপরিহার্য করে তুলেছিল প্রবীণ চরিত্রে। এতটাই যে, সত্যজিৎ রায় কবুল করেছিলেন ছবি বিশ্বাসের মৃত্যুতে তিনি চিত্রনাট্যে প্রবীণ চরিত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কারণ ওই শ্রেণির অভিনয় আর কোত্থেকে পাবেন? আরও একটা মজার প্রসঙ্গ। ‘দেবী’তে সত্যজিৎ রায় ছবি বিশ্বাসের ছেলের ভূমিকায় অভিনেতাটির অভিনয়ে খুব একটা খুশি হতে পারছিলেন না। তবু তাঁকে রেখেছিলেন কারণ তাঁর মুখের খুব মিল ছিল ছবি বিশ্বাসের মুখের সঙ্গে। পিতাপুত্রের মুখের এই আদলটা তিনি ছাড়তে চাননি। খুব সাধারণ পরিবারের থেকে ক্রমে ক্রমে দর্পিত বড়লোক, জাঁদরেল পরিবারকর্তা বা জমিদারের ভূমিকায় যে ছবি বিশ্বাস জাঁকিয়ে বসেছিলেন পঞ্চাশের দশকের একটা সময় থেকে, তারও কারণ সহজবোধ্য। এক, উচ্চবিত্ত পরিবার নিয়ে বাণিজ্যিক ছবির একটা চলন শুরু হয়েছিল ওই সময়। সেখানে ছবি বিশ্বাসের জন্য, বলতে গেলে, চরিত্র ও সংলাপ লেখা হয়ে যাচ্ছিল। আর দুই, ছবিবাবুর অভিজাত চেহারা, রাশভারী চালচলন, গম্ভীর ও কিছুটা আনুনাসিক কণ্ঠস্বর, ইংরেজি মিশিয়ে বাংলা বলার দাপুটে ডেলিভারি এবং অবশ্যই, পর্দাজোড়া উপস্থিতি একটা প্রায় টাইপকাস্টিং-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু ওঁর বাপ-জ্যাঠা-জমিদার বনাটা যে নিছকই টাইপকাস্টিং হল না তারও কারণ আছে। প্রথমত অভিনয়, সংলাপ বলা, ধরা, ছাড়া, হাতে পাইপ কী গায়ে আলোয়ান বা ড্রেসিং গাউন, চোখের কোণ দিয়ে ভ্রুকুটি, কী ভুরু ও চোখ তুলে জিজ্ঞাসার চাহনি – সব মিলিয়ে এমন এক নাটকীয় প্যাকেজ যে টাইপকাস্টিং-এর একঘেয়েমি কখনও ভারাক্রান্ত করার সুযোগ পায়নি তাঁর কাজকে। টাইপ অতিক্রম করে তাঁর অভিনয় চরিত্রগুলোকে সুন্দর রক্তমাংসের মানুষ করে তুলত। যার এক চমৎকার উদাহরণ ‘সপ্তপদী’তে নায়ক কৃষ্ণেন্দুর পিতার চরিত্রায়ণ। অমন এক চরিত্রে তাঁর কী করণীয় তা সকলেই জানতেন। কিন্তু কী ভাবে, তার এক অভিনব দৃষ্টান্ত তিনি তুলে ধরেছিলেন ছবিতে। এর বছর পাঁচেক আগে, ১৯৫৬-য়, ছবি বিশ্বাসের নতুন চালের এক অভিনয় শুরু হয়ে গিয়েছিল দু’দুটি ছবিতে। একটিতে নিতান্তই এক পার্শ্বভূমিকা – শম্ভু মিত্র পরিচালিত ‘এক দিন রাত্রে’ ছবিতে এক মাতালের গলায় গান ধরেছিলেন ছবি বিশ্বাস, ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি, সব সত্যি’, আর দর্শক ধাঁ মেরে ভাবতে বসেছিল, এ কোন ছবি বিশ্বাস! অন্য ছবিটিতে ছবি বিশ্বাস ছিলেন নায়ক, কিন্তু কী এক অভাবনীয় ভূমিকায়। তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবির কাবুলিওয়ালা। ‘নর্তকী’ করে চরিত্রাভিনয়ে সরে যাওয়া ছবি বিশ্বাস যেন ক্রমশ ফিরে আসা শুরু করেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের নানা নায়কের চরিত্রে। যার শিখর ভূমিকা – জানানোর প্রয়োজনই হয় না – সত্যজিৎ রায়ের ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়।
মনে করুন ‘লৌহকপাট’-এ জেলখানা জুড়ে পাগলা ঘন্টি বাজছে আর গারদের গরাদ ধরে যাবজ্জীবন দণ্ডিত ডাকাত ছবি বিশ্বাসের সেই বিহ্বল চাহনি ও স্মৃতিপথযাত্রা। কিংবা মনে করুন, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ রাতের অন্ধকারে আকাশবাতাস কাঁপানো উন্মাদ মেহের আলির সেই ভৌতিক চিৎকার ‘সব ঝুট হ্যায়! সব ঝুট হ্যায়!’ চরিত্র ধরলে ধরতেই হয় ‘দাদাঠাকুর’-এর দাদাঠাকুর। যদিও যাঁর চরিত্র ভিত্তি করে ছবি সেই দাদাঠাকুরের পছন্দের হয়নি এই দাদাঠাকুর, তবু বাঙালি দর্শক বেজায় মুগ্ধ হয়েছিল তাঁদের প্রিয় ছবি বিশ্বাসের এই অপূর্ব বিবর্তনে। কেউই বলতে গেলে ত্রৈলোক্য মহারাজকে চাক্ষুষ করেনি তার আগে, অনেকে এমনও মন্তব্য করে বসেছিলেন যখন দাদাঠাকুর সাক্ষাৎ আবির্ভূত হয়েছিলেন কলকাতায়, ‘কই, এঁকে তো ঠিক দাদাঠাকুরের মতো লাগছে না!’ লাগবে কী করে? তদ্দিনে দাদাঠাকুর বলতে তো ছবি বিশ্বাস। ওই বছরই, ১৯৬২, ছবি বিশ্বাসের করা অপর স্মরণীয় চরিত্র সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির মানী, অভিজাত, সাহেবি কেতায় দুরস্ত এবং দিশি সেন্টিমেন্টে অনভ্যস্ত পরিবারপ্রধান। সত্যজিৎ রায়ের প্রথম রঙিন ছবির সম্ভবত সব চেয়ে রঙিন ব্যক্তিত্ব ছবি বিশ্বাসই পাইপে টান দিতে দিতে আর ইংরেজি ডায়ালগ দিয়ে ছবির আরম্ভ করেছিলেন। খুব শিগগির মেঘাচ্ছন্ন হয় দার্জিলিং-এর আকাশ এবং ছবির দু ঘণ্টার মধ্যেই গোটা পরিবারের জীবনেরও দু’ঘণ্টা বাঁধা পড়ে। যাঁর ইচ্ছে-অনিচ্ছে, মত ও অমতে পরিবার চলে সেই কাহিনির নায়ক ছবি বিশ্বাসের সোচ্চার, ঘোষণা ‘মেঘ কেটে গেছে’ দিয়েই যবনিকাপাত। স্ত্রীর অপরূপ রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সময় হয় না যে কোম্পানি ডিরেক্টর সাহেবের, তাঁর কাঞ্চনজঙ্ঘার চুড়োয় রোদ আবিষ্কারের উল্লাস ছবির চূড়ান্ত মুহূর্ত। সেই দৃশ্যে ছবি বিশ্বাসের যে অভিনয় ও আবেগ তা যেন শিল্পীর জীবনের এক ‘লাস্ট হুর্রে,’ বিজয়ীর বিদায়ী হাতনাড়া। সে বছরই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ছবি বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছিল এবং পর দিন আনন্দবাজার পত্রিকায় সেই বিধ্বস্ত অ্যাম্বাসাডরের ছবি বেরিয়েছিল। কোনও চলচ্চিত্রাভিনেতার ও রকম মৃত্যুর পেজ ওয়ান নিউজ বোধ হয় প্রথম পড়েছিল বাঙালি।
(তথ্যসূত্র:
১- কিছু স্মৃতি কিছু কথা: বিকাশ রায়, অনুলিখন – অমিয় সান্যাল, করুণা প্রকাশনী।
২- মনে পড়ে, তপন সিংহ, আনন্দ পাবলিশার্স।
৩- Beyond time: With legendary actor Chhabi Biswas, article written by Koral Dasgupta, on News 18, Dated- 15th June 2015.)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত