ঊনবিংশ শতাব্দীর একদম শেষ দিকের কিংবা বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের ঘটনা। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে তাঁর ‘ব্রহ্ম গাড়ি’ চড়ে আসছিলেন ‘ধাত্রীবিদ্যার অধ্যাপক কর্নেল পেক’। মোড় ঘুরতে গিয়ে সদ্য চালু হওয়া বৈদ্যুতিক ট্রামের সঙ্গে গাড়ির সংঘর্ষ। কর্নেল এবং তাঁর কোচোয়ান বেঁচে গেলেও গাড়িটি চুরমার হয়ে গেল। সে সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এক তরুণ ছাত্র। অধ্যাপক গাড়ি থেকে নেমে সেই ছাত্রকে সাক্ষী মেনে বললেন, ট্রামটি কি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে যাচ্ছিল? ছাত্রটি উত্তরে বললেন, দোষ ট্রামের নয়, আপনার কোচোয়ানের। রাগে কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলেন কর্নেল। আদালতে মামলা হল। সাত দিন পরে কর্নেলের ঘরে ডাক পড়ল সেই ছাত্রের। কর্নেল ছাত্রকে বললেন, মামলায় তাঁকে সাক্ষ্য দিতে হবে। কিন্তু ছাত্র তখনও অনড় থেকে বলেছিল, ‘দিতে পারি, কিন্তু তাতে আপনার লাভ হবে না।’ রাগে গুম হয়ে বসে রইলেন অধ্যাপক। প্রতিশোধ নিতে এমবি-র মৌখিক পরীক্ষায় ঘর থেকে বের করে দিলেন ওই ছাত্রকে।
ছাত্রের নাম ‘শ্রী বিধানচন্দ্র রায়’। কর্নেলের প্রতিশোধও যে তাঁর পথের কাঁটা হতে পারেনি – সে তো এখন ইতিহাস।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’কে নিয়ে বাঙালি পাঠকের যে বাজার, যে আগ্রহ, যত বই, তার ভগ্নাংশও বিধানচন্দ্র রায়ের জন্য নেই। বিধানচন্দ্র রায়ের ‘জীবন পর্যালোচনা’ করলে কিন্তু দেখা যায়, আমরা আজ যে আধুনিক বাংলায় বসবাস করি সেটা কিন্তু বিধানচন্দ্রের নিজের তৈরি। তা সেটা ‘কলকাতা বন্দর হোক’, ‘লবণহ্রদ’ বা ‘কল্যাণী’র মতো ‘উপনগরী’ হোক, ‘দুর্গাপুর-আসানসোলের মতো শিল্পাঞ্চল’ হোক, ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার বিমান সংযোগ’ হোক, সব কিছুরই ‘স্থপতি’ বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু ওই এক বাঙালি জীবনের রহস্য! বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে ‘গবেষণা’, ‘বইপত্র’ খুবই কম।
তাঁর ঠাকুমা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘ভজন’। আর তাঁর ভাল নাম রাখার দিনে হাজির ছিলেন ‘কেশবচন্দ্র সেন’। পটনার মেধাবী ছেলে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার জন্য এসে যে সব কাণ্ড করেছিলেন তা নিয়ে একটা আস্ত বই লিখে ফেলা যায়।
ডাক্তারি পড়বার বিশেষ বাসনা বিধানচন্দ্রের ছিল না, শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ফর্মের জন্য আবেদন করেছিলেন। ডাক্তারির ফর্মটা আগে আসায় ওইটাই আবেদন করলেন। পূরণ করে পাঠিয়ে দিলেন। পরে শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফর্ম আসায় আর আবেদন করেননি।
ছাত্রাবস্থায় তিনি থাকতেন কলেজ স্ট্রিট ওয়াই এম সি এ-তে। অর্থাভাব প্রবল, মাস্টারমশায়রা ছাত্রকে অবসর সময়ে ধনী রোগীদের বাড়িতে মেল নার্স হবার সুযোগ করে দিতেন। রোগীর বাড়িতে বারো ঘণ্টার ডিউটিতে পারিশ্রমিক ছিল আট টাকা। মেল নার্স কথাটি আজকাল তেমন শোনা যায় না। কেউ কেউ এখন বলেন, নার্সিংটা মেয়েদের একচেটিয়া হওয়ার কোনও অর্থ হয় না।
ডাক্তারি প্র্যাকটিস জমাবার প্রথম পর্বে বিধানচন্দ্র রায় কলকাতায় ‘পার্ট টাইম ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছিলেন। চালক ও মালিক হিসেবে মোটর গাড়ি সম্বন্ধে তাঁর আজীবন আগ্রহ ছিল।
মহাপুরুষরা সমকালের অক্লান্ত যন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে পারেন না। জেনে রাখা ভাল, যাঁর চিকিৎসাখ্যাতি এক দিন কিংবদন্তি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ‘এমবি পরীক্ষা’য় ফেল করেছিলেন। আবার তিনিই মাত্র ১২০০ টাকা সম্বল করে বিলেত গিয়ে দু’বছরে মেডিসিন ও সার্জারির চূড়ান্ত সম্মান ‘এম আর সি পি’ এবং ‘এফ আর সি এস’ প্রায় একই সঙ্গে অর্জন করেছিলেন।
তাঁর বিভিন্ন অপমান কাণ্ডের সঙ্গে সায়েবরা জড়িত ছিলেন। কিন্তু দেশবাসীরা তাঁর জীবনকালে যে সব যন্ত্রণা ও অপমান তাঁকে করেছিলেন তা ভাবা যায় না।
যখন লাখ টাকার প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন হাওড়া-কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে কুৎসিত ভাষায় লেখা হয়েছিল – ‘বাংলার কুলনারী হও সাবধান, বাংলার মসনদে নলিনী বিধান।’ডাক্তার রায়ের নিকট-বন্ধু ‘নলিনীরঞ্জন সরকার’ ছিলেন আর এক আশ্চর্য বাঙালি, যাঁকে নানাবিধ দুর্নাম দেওয়া ছাড়া সমকালের নিন্দুকেরা বিশেষ কিছুই করেননি। অনেকেই শুনেছিলেন এবং বিশ্বাস করেছিলেন, বিধানচন্দ্র রায় ‘বড় ডাক্তার’, কিন্তু ‘মদ্যপ’ এবং জেলে যেতে ‘ভয়’ পেতেন ইংরেজ আমলে।
কিন্তু বিধান রায় যদি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী না হতেন! কোনও সন্দেহ নেই ইতিহাস অন্য পথে হাঁটত। বিধানচন্দ্র এক জন বহুমুখী সক্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ‘ভারী শিল্প’ এবং সমস্ত নতুন নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর, সবই তো ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর নিজের হাতে করা।
‘যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য’, যিনি বিখ্যাত ‘বারো ভুঁইঞা’র এক জন ছিলেন, বিধানচন্দ্র রায় সেই পরিবারের সদস্য। ‘ব্রাহ্ম’ পরিবারের সন্তান। বাবা সরকারি অফিসার ছিলেন। এ হেন বিধানচন্দ্র যে কলকাতার এক লম্বা মানুষ ছিলেন তা-ই নয়, তাঁর জীবনী অনুধাবন করলে কিছু জিনিস বোঝা যায়।
প্রথমতঃ, বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে ‘নেহরু’ ও ‘গান্ধী’র এক ‘প্রত্যক্ষ সম্পর্ক’ ছিল। বিধানচন্দ্র রায় বহু বিষয়ে নেহরুর সঙ্গেও ‘ঝগড়া’ করার ‘সাহস’ রাখতেন। বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে তো নানা বিষয়ে বকেও দিতেন। এর ফলে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিধানচন্দ্র রায় ‘আজ্ঞাবহ ভৃত্য’ ছিলেন না। ‘ইন্দিরা গান্ধী যুগে’ পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রীদের কী দশা হয়েছিল, সেটা অনেকেই জানেন।
দ্বিতীয়তঃ, বিধানচন্দ্র রায় শুধু যে এক জন ‘পেশাদার রাজনীতিবিদ’ ছিলেন তা নয়। তিনি বিশিষ্ট চিকিৎসকও ছিলেন। জগৎজোড়া তাঁর খ্যাতি ছিল। ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি’র স্বাস্থ্য পরীক্ষা পর্যন্ত করতে হয়েছিল তাঁকে। তা ছাড়া, ঐতিহাসিক ভাবে সে সময় ‘কলকাতার রাজনৈতিক গুরত্ব’ও ছিল অনেক বেশি। তাই সে সময়ে কলকাতার বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করতেই পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে রাষ্ট্রনেতারা আসতেন। ‘মিশরের প্রেসিডেন্ট কর্নেল নাসের’, ‘রাশিয়া থেকে ক্রুশ্চেভ’ – কে না এসেছেন তখন।
তৃতীয়তঃ, বিধানচন্দ্র রায় খুব ‘সংঘাতে’ গিয়ে লড়াই চালিয়ে কাজ করার পক্ষে ছিলেন না। এ ব্যাপারে ‘সুভাষচন্দ্র বসু’ অনেক বেশি ‘আবেগপ্রবণ’ ছিলেন। বিধানচন্দ্র ‘গান্ধী-সুভাষ’, ‘দেশবন্ধু-গান্ধী’ – এ সব পারস্পরিক উত্তেজনাতেও নিজে কোনও পক্ষেরই ‘বিরাগভাজন’ হতেন না। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল অনবদ্য। ‘রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্নে মতপার্থক্য’ থাকলেও তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপর বিশেষ ভাবে ‘নির্ভরশীল’ ছিলেন। ‘কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী’ হিসাবেও তাঁকে বিধানচন্দ্র কাজে লাগাতেন।
বিধানচন্দ্র রায়ের পরে এসেছিলেন ‘সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়’, তাঁকে বিধানচন্দ্রই রাজনীতিতে এনেছিলেন এক ‘যুবক-মুখ’ তুলে আনার জন্য। তারপরে জ্যেতি বসুর দীর্ঘ অধ্যায়ের থেকে আজকের বাংলা। বিধানচন্দ্র রায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য যা করে গিয়েছিলেন, তারকয়েকটি নমুনার উল্লেখ করা যাক। কোথাও তিনি সফল হয়েছিলেন, কোথাও হননি।
১) বজবজে অথবা রাজ্যের কোনও উপযুক্ত স্থানে ‘তেল শোধনাগার’ করতে চেয়েছিলেন তিনি। এই নিয়ে ‘আসাম’ এবং ‘বিহার’ নিজেদের মধ্যে রাজনীতি শুরু করে। ‘বারাউনি’তে পূর্ব ভারতের তেল শোধনাগার তৈরি হয়।
২) দার্জিলিঙে দেশের প্রথম ‘পর্বতারোহণ শিক্ষাকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা তাঁর হাতে।
৩) কলকাতার পর হলদিয়া ‘নদী বন্দর’ তাঁর অবদান।
৪) ‘ফরাক্কা ব্যারাজ’ তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত।
৫) ‘দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চল’ তাঁর সৃষ্টি।
৬) কলকাতা থেকে ‘ইস্ট ইন্ডিয়ান রেল’ ও ‘বেঙ্গল নাগপুর রেলের সদর দফতর’ বিলুপ্ত করে দুই রেলের বহু বিভাগ ‘উত্তরপ্রদেশ’ ও ‘বিহারে’ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল। ‘শ্যামাপ্রসাদ’ দিল্লিতে গোপন সূত্রে তা জানতে পেরেই জানিয়ে দেন বিধানচন্দ্র রায়কে। তারপর দু’জন মিলে লড়াই করে তা থামান। রেলওয়ের ‘পুনর্বিন্যাস’ হয় বটে, তবে তা হয় বিধান রায়ের শর্ত মেনে। তাতে ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চল রেলের বড় অংশ’ আবার ‘পূর্ব রেলের অধীনে’ কলকাতার হাতে আসে। বিধানচন্দ্র রায়ের ‘সমর্থন’ নিয়ে ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়’ ‘ধর্মঘট’ ও ‘হরতাল’ ডেকেছিলেন।
‘প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো’ এলে বিধানচন্দ্র তাঁর সঙ্গে ‘গ্যাসভিত্তিক শিল্প সম্ভাবনা’ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ‘দুর্গাপুর উপনগরী’ নির্মাণ এবং তার সম্প্রসারণ তো এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। দুর্গাপুরের শিল্পকেন্দ্রগুলিকে ঘিরে উপনগরীকে গড়ে তুলতে যে ধরনের ‘রাস্তা’, ‘পার্ক’, ‘ক্রীড়া উদ্যান’, ‘বেচাকেনার শ্রেণিবদ্ধ দোকান-বাজার’, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নকশা’ – সমস্ত খুঁটিনাটি বিধান রায় নিজের চোখে দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সময় ও জনসংখ্যার সঙ্গে তাল রাখতে দুর্গাপুর রেলস্টেশন সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তিনি। ‘জিটি রোড’ থেকে প্রশস্ত চার লেনের সড়ক, দুর্গাপুর স্টেশনে রেললাইনের উপরে যে ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে তার খরচ ‘রেল’, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকার’ ও ‘দুর্গাপুর ইস্পাত নির্মাণ কর্তৃপক্ষ’ বহন করবেন বলে ঠিক হয়েছিল। ওভারব্রিজ তৈরির ‘এক-তৃতীয়াংশ ব্যয়ভার’ বহন করতে রাজি হলেও কেন্দ্র পশ্চিবঙ্গ সরকারকে জানিয়ে দেয়, এত টাকা কেন্দ্রের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। এতে বিধানচন্দ্র এতই চটে গিয়েছিলেন যে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ‘অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারি’-কে ফোন করে বলেছিলেন – “তোমরা দিল্লির নেতারা কলকাতার মধু নিতে খুব পটু আর পশ্চিমবঙ্গকে দেওয়ার ব্যাপারে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি? এ ভাবে চলবে না। আমি জওহরকে বলছি।” ব্যস। এর পর নেহরুর কাছে নালিশ এবং ফের রাজ্যের জন্য অর্থ বরাদ্দ। ‘বিধাননগর’ থেকে ‘দণ্ডকারণ্য প্রকল্প’, সবই ছিল বিধানচন্দ্র রায়ের ভাবনা।
এমনকী, এ’কথাও অনেকে জানেন না যে দিল্লিতে রাজ্য সরকারের অতিথিশালার জন্য জমি কিন্তু প্রথম আদায় করেন বিধানচন্দ্র রায়। দিল্লিতে আসলে তিনি হয় গান্ধীর কাছে থাকতেন অথবা তাঁর এক চিকিৎসক বন্ধুর বাড়িতে থাকতেন। এক বার বৈঠক করতে অনেক অফিসার একসঙ্গে আসেন। তখন থাকার খুব অসুবিধা হয়। তখনই বিধানচন্দ্র রায়ের মাথায় আসে ‘বঙ্গভবন’ গড়ার কথা। বাংলাকে দেখে পরে অন্য রাজ্যও একই ভাবে ভবন বানায়। মজার ব্যাপার হল, সে দিন বিধানচন্দ্র যখন ‘বঙ্গভবন’ তৈরির কথা বলেছিলেন, তখন বিরোধী নেতারা প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, এ সব হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর আমোদ-প্রমোদের জন্য। বিধানচন্দ্র কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উপাচার্য’ পদেই থাকুন বা কলকাতা ‘পুরসভার মেয়র’ – যখনই যে পদে ছিলেন, সেখানেই তাঁর সেরাটা দেওয়ারই চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। উপাচার্য থাকার সময়ে ‘শিক্ষা বিল’ নিয়ে যেমন ভেবেছিলেন, তেমনই মেয়র থাকাকালীন ‘কলকাতার জলনিকাশি ব্যবস্থা’ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রয়োজনের অতিরিক্তি ‘সোভিয়েত মডেল’ অনুসরণ করে শিল্পায়নের চেষ্টার প্রশান্ত মহলনাবিশের বিরোধিতা করেছিলেন বিধানচন্দ্র। কেন্দ্র-রাজ্য কর রাজস্বের অসম বণ্টন নিয়েও তিনি আওয়াজ তুলেছিলেন।
তাঁর ডাক্তারির ব্যাপারটা আর একটু বলে রাখা যাক। ১৯১১ সালে ডাক্তার রায় বিলেত থেকে যখন কলকাতায় ফিরলেন তাঁর কাছে মাত্র সম্বল ছিল মাত্র ‘পাঁচ টাকা’। বিলেত যাবার আগে কলকাতায় তাঁর ফি ছিল ‘দু’টাকা’।
আদিতে তাঁর ঠিকানা ছিল ‘৬৭/১ হ্যারিসন রোড’, পরে ঠিকানা হয় দিলখুশ কেবিনের কাছে, ‘৮৪ হ্যারিসন রোড’। সেখানে ছিলেন ১৯১৬ পর্যন্ত, এর পর আসেন ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে। শোনা যায়, উপার্জন বৃদ্ধির প্রচেষ্টায় তিনি বাড়িতে রক্ত ইত্যাদি পরীক্ষার জন্য প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন।
পেশায় বিপুল সাফল্য বিধানচন্দ্রকে বিশেষ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মাত্র সাড়ে আট বছরের প্র্যাকটিসে কলকাতায় প্রাসাদোপম বাড়ি এবং গাড়ির মালিক হওয়া সহজ ব্যাপার ছিল না।
তাঁর রোগীর তালিকায় তখন কোন বিখ্যাত মানুষ নেই? এর মধ্যে স্বয়ং ‘রবীন্দ্রনাথ’ও ছিলেন। শোনা যায়, গোড়ার দিকে জোড়াসাঁকোর জন্যও ভিজিট নিতেন, যদিও পরবর্তী সময়ে দু’জনে খুব কাছাকাছি আসেন।
চিত্তরঞ্জন দাশের মহাপ্রয়াণের পর দেশবন্ধুর একটা ছবি বিক্রি করে বিধানচন্দ্র কিছু টাকা তোলবার পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ‘চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য’ একটি চিঠিতে লিখেছিলেন –
“চিত্তরঞ্জনের একটা ছবি নিয়ে বিধানচন্দ্র রায় কবির কাছে গিয়ে বললেন এর উপর একটা কবিতা লিখে দিন।
“ডাক্তার, এ তো প্রেসক্রিপশন করা নয়। কাগজ ধরলে আর চটপট করে লেখা হয়ে গেল।”
উত্তর: “বেশ অপেক্ষা করছি।”
কিন্তু বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ছবির উপর সেই অপূর্ব কবিতাটি লেখা হল,
‘এসেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ …”
বিধানচন্দ্র যখন ‘কলকাতার মেয়র’, তখন (১৯৩১) কবিগুরুর সপ্ততি বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানে কবিগুরুর উত্তর আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
“এই পুরসভা আমার জন্মনগরীকে আরামে, আরোগ্যে, আত্মসম্মানে চরিতার্থ করুক, ইহারা প্রবর্তনায় চিত্রে, স্থাপত্যে, গীতিকলায়, শিল্পে এখানকার লোকালয় নন্দিত হউক, সর্বপ্রকার মলিনতার সঙ্গে সঙ্গে অশিক্ষার কলঙ্ক এই নগরী স্খালন করিয়া দিক পুরবাসীর দেহে শক্তি আসুক, গৃহে অন্ন, মনে উদ্যম, পৌরকল্যাণ সাধনে আনন্দিত উৎসাহ। ভ্রাতৃবিরোধের বিষাক্ত আত্মহিংসার পাপ ইহাকে কলুষিত না করুক শুভবুদ্ধি দ্বারা এখানকার সকল জাতি, সকল ধর্মসম্প্রদায় সম্মিলিত হইয়া এই নগরীর চরিত্রকে অমলিন ও শান্তিকে অবিচলিত করিয়া রাখুক, এই কামনা করি।”
ডাক্তার রায়ের বিশাল প্র্যাকটিসের কোনও মাপজোক আজও হয়নি। কলকাতার বাইরেও ‘বার্মা’ থেকে ‘বালুচিস্তান’ পর্যন্ত তাঁর ডাক্তারির দাপট ছিল, যার একমাত্র তুলনা ‘স্যর নীলরতন সরকার’। শোনা যায়, তাঁর এক আপনজনের প্রতি তরুণ চিকিৎসক এক সময় আসক্ত হন, কিন্তু আর্থিক বৈষম্য সেই শুভকর্মকে সম্ভব করেনি।
‘মতিলাল নেহরু’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘জওহরলাল নেহরু’, ‘কমলা নেহরু’, ‘বল্লভভাই পটেল’, ‘ইন্দিরা গান্ধী’ থেকে কে না তাঁর চিকিৎসা পরামর্শ নিতেন! ১৯১৩-১৯৪৮ পর্বে মহাত্মা গান্ধী আঠারো বার ‘অনশন ব্রত’ পালন করেছিলেন, এবং বহু বারই বিধানচন্দ্র তাঁর শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত হয়েছিলেন।
একবার (১৯৩১) অসুস্থ ‘মতিলাল নেহরু’কে দেখতে ডা. রায় এলাহাবাদে যান। সেখানে ‘গান্ধীজি’ও উপস্থিত ছিলেন। তখন ‘গান্ধীজি’ দুধ ও শস্য ছেড়ে দিয়ে কেবল ‘কাঁচা সব্জি’ খাচ্ছিলেন। ব্যাপারটা ডা. রায়ের পছন্দ হয়নি। এই সময় ‘গান্ধীজি’র ওজন ছিল ‘৯৯ পাউন্ড’। বিধানচন্দ্র বলেছিলেন, আপনার ওজন অন্তত ‘১০৬ পাউন্ড’ হওয়া উচিত। অনুগত রোগীর মতো মহাত্মা গান্ধীজি বলেছিলেন, দশ দিন সময় দাও। এই খাবার খেয়েই দেহের ওজন ১০৬ পাউন্ড করে দেব। বিখ্যাত ডাক্তারকে বিস্মিত করে মহাত্মা গান্ধী এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন।
দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন বিধানচন্দ্র চোখের চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছিলেন। তার কিছু দিন আগে জওহরলাল নেহরু তাঁকে তারবার্তা পাঠিয়ে ‘ইউপি-র গভর্নর’ হবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই মতো ভারত সম্রাটের বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়েছিল।
কিন্তু বিধানচন্দ্র জানিয়েছিলেন চোখের চিকিৎসা সম্পূর্ণ না করে তাঁর দেশে ফেরা সম্ভব নয়। যখন ফিরলেন, তখন ‘সরোজিনী নাইডু’ ওই পদে রয়েছেন, তাঁকে সরিয়ে নতুন পদে বসতে বিধানচন্দ্র রাজি হননি। এর জন্য গান্ধীজি তাঁকে রসিকতা করে বলেছিলেন, “তুমি গভর্নর হলে না। ফলে তোমাকে ইওর এক্সেলেন্সি সম্বোধন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।” সুরসিক বিধানচন্দ্রের উত্তর ছিল – “আমার পদবি রায়, আপনি অবশ্যই আমাকে ‘রয়্যাল’ বলতে পারেন, আমি অনেকের চেয়ে লম্বা, সে হেতু আমাকে ‘রয়্যাল হাইনেস’ বলতে পারেন।”
শোনা যায়, দিল্লির এক পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে ‘গভর্নর জেনারেল লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন’ বিধানচন্দ্র সম্বন্ধে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি জওহরলাল নেহেরুকে বলেছিলেন, লাট সাহেবের পদে না বসিয়ে এঁকে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব দিন।
প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের পর বিধানচন্দ্র রায় এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন নেতাজির জন্মদিন ২৩ জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে এবং ঠিক তার সাত দিন পরে সেই অশুভ শুক্রবারে দিল্লিতে গান্ধীজি নিহত হয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যায় যে’সকল প্রবীণ নেহরু ও ডা. রায়ের কণ্ঠস্বর রেডিয়োতে শুনেছিলেন তা আজও তাঁদের অনেকেরই কানে বাজে। ‘প্রিন্স অফ পিস’ শব্দটি সেদিন ব্যবহৃত হয়েছিল ডাক্তার রায়ের মুখ থেকে।
যখন ডা. রায় মুখ্যমন্ত্রী হলেন তার আগের মাসে ‘ডাক্তারি থেকে তাঁর আয় ছিল ৪২০০০ টাকা’, মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তিনি নিজেই নিজের ‘মাইনে’ ঠিক করেছিলেন ‘১৪০০ টাকা’, তখন তাঁর বয়স ৬৫। নিকটজনদের কাছে তিনি বলেছিলেন, “দশটা বছর কম হলে ভাল হত।” তার উপর ছিল ‘চোখের সমস্যা’, ‘ম্যাগনিফাইং গ্লাস’ ব্যবহার করতেন এবং খুব লম্বা কিছু পাঠ এড়িয়ে চলতেন। এই জন্যই বোধ হয় নিন্দুকেরা প্রচার করেছিল, ডা. রায় বাংলার দিগ্বিজয়ী লেখকদের কোনও লেখাই পড়েন না, যদিও ক্ষণজন্মা লেখকরা সানন্দে তাঁকে স্বাক্ষরিত বই দিতেন। ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’কে তিনি খুবই খাতির করতেন। এবং স্বাভাবিক সৌজন্যে বলতেন, লেখার অভ্যাসটা যেন ছেড়ে দেবেন না।
তবু বাংলা সাহিত্য ও সিনেমার মস্ত উপকার তিনি করেছিলেন। তাঁর ‘বান্ধবী বেলা সেনের’ কথায়, সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত ছবি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচিত ‘পথের পাঁচালী’ তিনি দেখেন এবং সরকারি নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে এই ছবিটির ‘সরকারি প্রযোজনার ব্যবস্থা’ করে দেন।
শোনা যায়, ‘বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়’ যে তখন প্রয়াত তাও তিনি জানতেন না, বইটি পড়া তো দূরের কথা। আরও একবার তিনি বাঙালি লেখকদের উপকার করেছিলেন। লালবাজারের একটি বিশেষ বিভাগ পত্রপত্রিকা ও বাংলা বইয়ে আপত্তিকর অংশ সম্বন্ধে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। ‘বুদ্ধদেব বসু’, ‘অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত’, ‘প্রবোধ সান্যাল’ ইত্যাদি লেখকেরা পুলিশের ‘বিষনজরে’ পড়ে গিয়েছেন বলে গুজব রটেছিল। এঁরা আতঙ্কিত হয়ে ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়’ ও ‘সজনীকান্ত দাস’কে ধরলেন, তারপর লেখকরা দলবদ্ধ হয়ে ডাক্তার রায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, নামী সাহিত্যিকদের বই ‘অশ্লীল’ বলে ‘বাজেয়াপ্ত’ হবে এ কেমন কথা! সব শুনে বিধানচন্দ্র বললেন, তাই নাকি, এটা তো বড় অন্যায় ব্যাপার। ‘রুনু’কে ডাকো। তৎকালীন ‘হোম সেক্রেটারি’ ‘আই সি এস’ ‘রুনু গুপ্ত’ আসতেই ডা. রায় বললেন, এ কি সব তুঘলকি কাণ্ড। বিখ্যাত লেখকদের বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করছে, অ্যারেস্টের ভয় দেখাচ্ছে। আই সি এস রুনুর নিবেদন ছিল, আইনের ধারা অনুযায়ী পুলিশ কাজ করছে। বিধান রায় তাঁকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, ওসব আইনটাইন কী আছে দেখে পাল্টাতে বলো। এঁদের অসম্মান করে এবং চটিয়ে সরকার চালানো যায়? তারপরে তারাশঙ্কর ও অন্যান্য লেখকদের নিশ্চিন্ত করে তিনি জানালেন, আমি বলে দিচ্ছি, পুলিশ আপনাদের আর বিরক্ত করবে না। এরপরেই সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিলেন, “তুমি পুলিশকে বলে দাও, এঁদের বাদ দিয়ে সিনেমার পোস্টারে যে সব প্রায়-ল্যাংটো মেয়েদের ছবি ছাপে সেগুলো আটকাতে।”
১৯৪৮ থেকে বাংলার ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে বিধানচন্দ্র রাইটার্সের লালবাড়িতে সাড়ে চোদ্দো বছর বসেছিলেন। তাঁর ‘সেক্রেটারি’ ‘সরোজ চক্রবর্তী’ পরবর্তীকালে জানিয়েছিলেন, প্রথম দু’বছর তিনি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছিলেন। নিজের ‘জমি’ বিক্রি করেছিলেন, নিজের ‘শেয়ার’ বিক্রি করেছিলেন, এমনকী ‘শৈলশহর শিলং’-এর প্রিয় ‘বাড়ি’টাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন।
বিধানচন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাড়িতে বিনা পয়সায় নিয়মিত রোগী দেখতেন সকাল সাতটায়। এবং তার জন্য দু’জন ডাক্তারকে নিজের পয়সায় নিয়োগ করেছিলেন। ব্যক্তিগত স্টাফের মাইনে দিতেন নিজের গ্যাঁট থেকে।
ডাক্তার রায়ের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে নানা রকম গুজব রটেছিল। কিন্তু তাঁর প্রথম ‘জীবনীকার’ ‘কে পি টমাস’ স্পষ্ট জানিয়ে গিয়েছেন যে, তিনি ‘ধূমপান’ বা ‘মদ্যপান’ কোনওটাই করতেন না।
‘কে পি টমাস’ লিখে গিয়েছেন, তাঁর চিরকুমারত্বের পিছনে কোনও কাহিনী আছে কিনা তা তিনি কখনও জানতে চাননি। একদিন (১৯৫৫) ‘দিল্লি-বোম্বাই’ পরিভ্রমণ করে বিধানচন্দ্র বিমানে ফিরেছিলেন দুপুর একটায়। ফিরেই সঙ্গে সঙ্গে রাইটার্সে চলে গেলেন, বাড়ি ফিরলেন সাড়ে ৭টায়। তাঁর দু’একটা ছবির ক্যাপশনের জন্য লেখক টমাস সেদিন তাঁর বাড়িতে বসেছিলেন। কিন্তু ডা. রায় ফাইলের মধ্যে ডুবে ছিলেন। যখন ঘড়িতে রাত সাড়ে ৯টা, তখনও ডা. রায় পড়ে যাচ্ছেন। এরপরে লজ্জিত টমাস বলেছিলেন, এখন আপনার শোবার সময়। ডা. রায়ের উত্তর ছিল, তা হলে আমার কাজগুলো কে করবে? প্রত্যুত্তরে টমাস বলেছিলেন, কাজের একটা সীমা থাকা উচিত। আপনি বিয়ে করেননি। তাই চলছে। আপনার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা থাকলে তাঁরা আপনাকে বিশ্রামের কথা বলতেন। ডাক্তার রায়ের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিল – ‘‘আপনি জানেন না, কাজের সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছে।’’
৬৫ বছর বয়সে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বিধানচন্দ্র যে অমানুষিক পরিশ্রমের বোঝা বহন করেছিলেন তার কিছু বিবরণ ডাক্তার রায়ের বিভিন্ন জীবনীকাররা আমাদের দিয়েছেন।
ভোর পাঁচটায় উঠে ‘গীতা’ ও ‘ব্রহ্মস্তোত্র’ পড়ে, স্নান সেরে, সাড়ে ৬টায় ‘ব্রেকফাস্ট’ খেয়ে, দু’ঘণ্টা ধরে ‘বিনামূল্যে’ ১৬ জন রোগী দেখে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংস-এ আসতেন ‘সবার আগে’। তাঁর ব্রেকফাস্টে থাকত ‘একটি টোস্ট’, ‘একটি ডিম’, ‘বেলপানা’ অথবা ‘পেঁপে’ ও ‘এক কাপ কফি’। বিধানচন্দ্র ভাল কফির ‘সমঝদার’ ছিলেন। ভাল কফি পেলেই বন্ধুদের খাওয়াতেন। তৎকালীন ‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন’ তাঁকে ডিফেন্স কারখানায় বিশেষ ভাবে তৈরি ‘কফি গ্রাইন্ডার’ উপহার দিয়েছিলেন। খুবই ‘মিতাহারী’ ছিলেন তিনি। বাইরে সাধারণতঃ ‘নিমন্ত্রণ’ খেতে যেতেন না। তিনি ‘রসিকতা’ করে বলতেন – ‘‘হসপিটালিটি অনেক সময় হসটিলিটি হয়ে যায়।’’ রাইটার্সে সকাল ন’টা থেকে দশটা ‘জরুরি ফাইল’ দেখতেন। তারপরে সচিবদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা সারতেন। সেখানে দর্শনার্থীদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা চলত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটা, তারপর ‘অ্যান্টি চেম্বারে’ গিয়ে ‘মধ্যাহ্নভোজন’ সেরে ‘সামান্য বিশ্রাম’ করতেন। পরবর্তী সময়ে নিজের শারীরিক অসুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বাড়ি চলে এসে খাওয়াদাওয়া করে সামান্য বিশ্রামের পরে আবার রাইটার্স চলে যেতেন। এবং সেখানে তাঁর রাত ৮টা পর্যন্ত সময় কাটাত। তাঁর ছিল দুটি ‘দুর্বলতা’। তিনি দিনে বেশ কয়েকবার স্নান করতেন এবং সবাইকে বলতেন রাত ন’টায় শুয়ে পড়া ভাল।
ডাক্তার রায়ের প্রভাবে রাইটার্সের বড় বড় অফিসাররাও নিজেদের অভ্যাস বদলে নিয়েছিলেন। তার আগে তাঁরা ১১টার আগে অফিসে হাজিরা দিতেন না। টমাস জানিয়েছেন, ‘লর্ড কার্জন’ এমন ‘ডিসিপ্লিন’ চেয়েছিলেন। লর্ড কার্জনের আমলে, ১১টায় অফিসে এসে বড় বড় অফিসাররা ১টায় লাঞ্চে বেরোতেন, অফিসে ফিরতেন ৩টায় এবং সাড়ে চারটে বাজলেই ‘দপ্তরত্যাগ’ করতেন। এসব দেখে ‘লর্ড কার্জন’ লিখিত নির্দেশ দিয়েছিলেন, পদস্থ অফিসাররা কেরানিদের আগে অফিস ছাড়বে না।
চিকিৎসক বিধানচন্দ্র সম্বন্ধে সামান্য কিছু বলে নেওয়ার লোভ ছাড়া যাচ্ছে না। তাঁর রোগীদের তালিকায় বিশ্ববিখ্যাতরা হলেন ‘দেশবন্ধু’, ‘মোতিলাল নেহরু’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘বল্লভ ভাই পটেল’, ‘মৌলানা আজাদ’, ‘জওহরলাল নেহেরু’ ও তাঁর কন্যা ‘ইন্দিরা গান্ধী’। তাঁর গুণগ্রাহীদের মধ্যে ছিলেন – ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি’ এবং ‘ব্রিটেনের প্রাইম মিনিস্টার ক্লেমেন্ট এটলি’।
‘মোতিলাল নেহরু’ তাঁর দুই ডাক্তার ‘আনসারি’ ও ‘রায়’কে ‘তাঁর দেহের দুই ট্রাস্টি’ বলে ‘পরিচয়’ দিতেন। আর ‘গান্ধী-রায় সম্পর্ক’ তো কিংবদন্তী পর্যায়ের। গান্ধীজি অনশন করলেই সব কাজ ছেড়ে বিধান রায় ছুটতেন তাঁর পাশে থাকবার জন্য। অনশনরত গান্ধীজি ও সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়ে পুরো একটা বই লিখে ফেলে যায়। পুণের আগা খাঁ প্যালেসে বন্দি গান্ধী, যখন সব রকম ‘ওষুধ খাওয়া বন্ধ’ করে দিয়েছিলেন, এবং তাঁর ‘দেহাবসান’ অনিবার্য ও আসন্ন জেনে, ইংরেজ জেলর তাঁর দেহের জন্য ‘চন্দন কাঠ’ও জোগাড় করে ফেলেছিলেন; তখন বিধানচন্দ্র তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন যে, একটা ওষুধ যেন তিনি গ্রহণ করেন। গান্ধীজি রাজি হননি, কঠিন ভাবে বলেছিলেন – “কেন আমি তোমার কথা শুনব? তুমি কি এদেশের চল্লিশ কোটি মানুষকে আমার মতো বিনামূল্যে চিকিৎসা করো?” বিধানচন্দ্র শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিলেন – “না গাঁধীজি, সবাইকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়, কিন্তু মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে চিকিৎসা করার জন্য এখানে আসিনি, আমি এসেছি এমন একজনকে চিকিৎসা করতে যিনি আমার কাছে আমার দেশের চল্লিশ কোটি মানুষের প্রতিনিধি।” প্রত্যুত্তরে গান্ধীজির স্মরণীয় উত্তর ছিল “মফস্বল আদালতের থার্ড ক্লাস উকিলের মতন তর্ক করছ। ঠিক আছে, ওষুধ নিয়ে এসো, আমি খাবো।”
আর একবার ডা. রায় বলেছিলেন, “উকিল হয়ে আমি হয়তো আরও অনেক বেশি রোজগার করতে পারতাম, কিন্তু তা হলে আমি তো মহামানব গান্ধীর চিকিৎসা করতে পারতাম না।”
আর একবার স্বয়ং গান্ধীরর সামনে বিধানের দেহ-প্রশস্তি করে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, “বিধান, তুমি হাসলে এখনও গালে টোল পড়ে ব্যাপারটা কী?” ডাক্তার রায় উত্তর দিয়েছিলেন, সেই টোলে কেন বয়োজ্যেষ্ঠর নজর পড়ে যায়। তারপর এই প্রাণবতী মহিলাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল – আপনি মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে মিকিমাউসকে খুঁজে পেয়েছিলেন।
‘নেহরু-বিধান পত্রাবলি’ খুঁটিয়ে দেখলে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, যা হৃদয় স্পর্শ করে। সিরিয়াস বিষয়ের মধ্যেই নেহরু তাঁর বন্ধুকে অনুরোধ করছেন – কলকাতা থেকে গোটা বারো ‘ডাব’ পাঠিয়ো, ইন্দিরার পেটের রোগ কমছে না। এক সময় গোটা ভারতের ‘ধারণা’ ছিল, ‘কলকাতার ডাব’ই ‘পৃথিবীর সেরা’। পরের দিন একজন বিড়লা দেখা করতে এলে ডাঃ রায় তাঁকে বলেছিলেন গোটা কয়েক ‘ডাব’ সেদিনই প্রাইভেট বিমানে দিল্লি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য।
নেহরুর আরেক প্রিয় খাবার ছিল উত্তরপাড়ার ‘তরমুজ রসগোল্লা’, বিধানচন্দ্রের এই বিখ্যাত উপহারের জন্য জওহরলাল অপেক্ষা করে থাকতেন। সময়ের স্রোতে সবই হারিয়ে যায়, বিধানচন্দ্র কোন দোকান থেকে এই রসগোল্লা আনতেন তা কেউই খুঁজে বের করতে পারেননি। পরিবারের প্রিয় চিকিৎসক বিধানের ওপর জওহরলাল নেহেরুর এতই বিশ্বাস ছিল যে ইন্দিরা গান্ধীর অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি কলকাতাকেই নির্বাচন করেছিলেন। আবার নানা বিষয়ে দু’জনের মধ্যে পত্রযুদ্ধ লেগেই ছিল। সেই সব চিঠি এত দিন পরে পড়তে যে কোন ব্যক্তির আশ্চর্য লাগবে।
নেহরু একটা চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন বাংলার সমস্যাটা কী? বিধানচন্দ্র একটা ঐতিহাসিক উত্তর দিয়েছিলেন যা আজও নির্মম সত্য হয়ে আছে। উত্তরে তিনি লিখেছিলেন – “ভেবেচিন্তে দেখলাম, বাঙালিদের তিনটে সমস্যা: ১) খাওয়াদাওয়ার সমস্যা, ২) রুজিরোজগারের সমস্যা, ৩) মাথা গোঁজবার সমস্যা।’’
এমন সহজ ভাবে ‘অন্ন’, ‘কর্ম’ ও ‘আবাসন সমস্যা’য় জর্জরিত বাঙালির ‘রোগনির্ণয়’ আর কেউ কখনও করতে পেরেছেন বলে মনে হয়না।
জওহরলাল নেহরুর চিকিৎসায় ডাক্তার বিধানচন্দ্রের ভূমিকার ছোট্ট একটি বিবরণ দিয়েছিলেন ‘নীতীশ সেনগুপ্ত’। দিল্লির সব নামকরা ডাক্তার সে বার নেহরুর অসুস্থতার ধরনটা বুঝতে পারছিলেন না। বিচলিত হয়ে ‘ইন্দিরা গান্ধী’ খবর দিয়েছিলেন ‘লালবাহাদুর শাস্ত্রী’কে। ‘মেডিক্যাল বোর্ড’ গঠন করা হয়। ‘ইন্দিরা’ ও ‘লালবাহাদুর’ সমস্ত রাত জেগে কাটিয়েছিলেন, শারীরিক অস্বস্তিতে নেহরু সারারাত ঘুমোতে পারেননি। ভোরবেলা হতেই ‘লালবাহাদুর’ ফোন করেছিলেন ডাঃ রায়কে এবং তাঁকে দ্রুত দিল্লি আসতে বলে জানিয়েছিলেন, তখনই একটা বিশেষ বিমান দমদমে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। সেই বিমানে ডাক্তার রায় দিল্লি পৌঁছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নেহরুর ঘরে ঢুকতেই মেডিক্যাল বোর্ডের রিপোর্ট তাঁর হাতে দেওয়া হয়। রিপোর্ট একঝলক দেখে ডাক্তার রায় তা সরিয়ে দিয়ে বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক ডা. সেনকে ‘তিরস্কার’ করে বলেছিলেন – “তুমি এ রকম অপদার্থ!” তারপরে নিজে স্টেথোস্কোপ নেহেরুকে পরীক্ষা করেন। পেটে থাবড়া মেরে শব্দ শোনেন। তারপরে কাপড় কাচার সাবান এবং গরম জল আনার নির্দেশ দেন। ডাঃ রায় নিজের হাতে ওই সাবান জলে গোলেন এবং ‘লালবাহাদুর’ ছাড়া সবাইকে বাইরে যেতে নির্দেশ দেন। এতক্ষন রোগী নেহেরু চুপচাপ ছিলেন, কিন্তু এবারে ডাক্তার রায় নেহরুর পাজামার গিঁট খুলে দিতে নেহরু ধমকে উঠেছিলেন। তখন ডা. রায় নেহেরুকে পাল্টা ধমক দিয়ে বলেছিলেন, “আমি ডাক্তার, তুমি রোগী। একদম চুপ করে থাকবে।” অয়েল ক্লথ বিছিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে ডাঃ রায় দু’বার ‘ডুস’ দিয়েছিলেন। এবং বেডপ্যান পেতে নেহরুকে পায়খানা করান। এরপরে তিনি কলকাতায় ফোন করে একটা ‘হোমিওপ্যাথিক ওষুধ’, কয়েকটা ‘ডাব’ ও ‘ডানলোপিলো’ পাঠাতে বলেন। এর পর নেহরুকে পুরো সুস্থ করার জন্য ডা. রায় প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নিঃশব্দে ‘কলকাতা-দিল্লি’ ‘ডেলি প্যাসেঞ্জারি’ করেছিলেন এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমানে।
এ বার ডাক্তার রায়ের নিজের চিকিৎসা সম্বন্ধে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী হবার কিছু পরেই একবার তাঁর ‘জ্বর’ হয়েছিল। তৎকালীন ‘ফিনান্স মিনিস্টার’ ‘নলিনীরঞ্জন সরকার’ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার অসুখ হলে কে আপনার চিকিৎসা করে? ডাক্তার রায় বলেছিলেন – “বিধান রায়। আয়নার দিকে তাকাই আর অমনি সেই প্রতিচ্ছবি বি সি রায় আমার চিকিৎসা করে।”
‘হোমিওপ্যাথি’ সম্বন্ধে এক ‘ইন্সিওর কোম্পানির বোর্ড মিটিং’-এ তিনি সকৌতুক বলেছিলেন – এক রোগী একটা ছুরি গিলে ফেলেছেন। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ প্রথম ডোজ দিল, অমনি পেটের ছুরির ফলার ধারটা ভোঁতা হয়ে গেল। দ্বিতীয় ডোজে ছুরির ফলাটা কাঠের হাতলের ভাঁজে ঢুকে গেল। তৃতীয় ডোজের পরে ছুরিটি সর সর করে বেরিয়ে এল রোগীর কোনও ক্ষতি না করে!
নিজের পেশার ডাক্তারদের নিয়েও যে তিনি ‘রসিকতা’ করতে ছাড়তেন না, তার নানা প্রমাণ আছে। হায়দরাবাদের এক সভায় তিনি ভাষণ শেষ করেছিলেন এই গল্পটি বলে – লন্ডনের উপকণ্ঠে একদল গুন্ডা পিস্তল দেখিয়ে একটা বাস থামালো। তাঁদেরই একজন বাসে উঠে প্রত্যেক যাত্রীর টাকার ব্যাগটা হাতিয়ে নিচ্ছিল। সবার শেষে বাসের শেষ প্রান্তে এক বুড়োর কাছে দাঁড়াল। বুড়ো তাঁর ব্যাগ খুলে দিতে দিতে একটু হেসে বলল, “দেখো ছোকরা তোমার বিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি ডাক্তার। আমরা ডাক্তাররা মানুষের টাকা আর জীবন দুই-ই নিয়ে থাকি।”
এ বার ধন্বন্তরির নিজের ‘স্বাস্থ্য’ সম্বন্ধে জানানো যাক। বিধানচন্দ্র ‘সর্দিকাশি’ ইত্যাদি ছোট ছোট রোগে সেই ছোটবেলা থেকেই ভুগতেন। তাঁর প্রথম ‘হার্ট অ্যাটাক’ করেছিল ১৯৩০ সালে, তখন তিনি কংগ্রেসের কাজে আমদাবাদ থেকে দিল্লির পথে যাচ্ছিলেন। এই ‘হার্ট অ্যাটাক’ নিয়ে তেমন হইচই হয়নি। তাঁর দ্বিতীয় ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয় তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব কালে। কিন্তু সেবারেও তাঁকে ‘অমানুষিক পরিশ্রম’ থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে যেতে হয়নি। শুধুমাত্র দৈনিক রুটিনের পরিবর্তন করে তিনি দুপুরে ওয়েলিংটন স্ট্রিটের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করতে আসতেন এবং বাড়িতেই ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করে আবার রাইটার্সে যেতেন।
তাঁর জীবনের ‘অন্তিমপর্বের শুরু’ হয় ‘২৪শে জুন ১৯৬২ সালে’। রাইটার্সে ওইটাই ছিল তাঁর শেষ দিন। নিমপীঠের এক সন্ন্যাসীকে সেদিন তিনি বলেছিলেন, “শরীর যেমন ঠেকছে কাল নাও আসতে পারি।’’ তাঁর মাথায় তখন অসহ্য যন্ত্রণা, কিন্তু কাউকেই তখন কিছু তিনি জানতে ও বুঝতে দেননি। পরের দিন বাড়িতে ডাক্তার ‘শৈলেন সেন’ ও ‘যোগেশ বন্দ্যোপাধ্যায়’কে ডাকা হয়। তাঁরা সিদ্ধান্তে আসেন যে বিধানচন্দ্র রায়ের তৃতীয়বার ‘হার্ট অ্যাটাক’ হয়েছে। ৩০শে জুন ডাক্তার রায় তাঁর প্রিয় বন্ধু ‘ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়’কে বলেছিলেন – ‘‘আমি তিরিশ বছর হৃদরোগের চিকিৎসা করে আসছি, আমার কতটা কী হয়েছে আমি তা ভাল করেই বুঝতে পারছি। কোনও ওষুধই আমাকে ভাল করতে পারবে না।”
১ জুলাই তাঁর ‘জন্মদিন’। সেদিনই তাঁর ‘তিরোধান দিবস’। ওই দিন তাঁর আত্মীয়স্বজনরা এসেছিলেন। ‘পরিচারক কৃত্তিবাসের’ হাত থেকে তিনি এক গ্লাস ‘মুসুম্বির রস’ খেয়েছিলেন। ‘বন্ধু সার্জেন ললিতমোহন’কে দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন – ‘‘ললিত আমার গুরুও বটে, ওর কাছ থেকে কত কিছু শিখেছি।’’ তারপরে নিজের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে বলেছিলেন – “আমি দীর্ঘ জীবন বেঁচেছি। জীবনের সব কাজ আমি সমাধা করেছি। আমার আর কিছু করার নেই।” এরপরেই জানিয়েছিলেন – ‘‘আমার পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’’ এরপরেই নাকে নল পরানো হয়, ইঞ্জেকশন, ডাক্তারদের ছোটাছুটি এবং ঠিক ১১টা ৫৫ মিনিটে তাঁর ‘অমৃতপথ যাত্রা’।
দুঃসংবাদ পেয়ে ‘দেশবন্ধুর স্ত্রী বাসন্তীদেবী’ বলেছিলেন – ‘‘বিধান পুণ্যাত্মা, তাই জন্মদিনেই চলে গেল। ভগবান বুদ্ধও তাঁর জন্মদিনে সমাধি লাভ করেছিলেন।’’
তাঁর দেহাবসানের কয়েক বছর আগে ‘কেওড়াতলা শ্মশানের বৈদ্যুতিক চুল্লি’র সূচনা করতে এসে বিধানচন্দ্র বলেছিলেন, “ওহে আমাকে এই ইলেকট্রিক চুল্লিতে পোড়াবে।” ২রা জুলাই ১৯৬২ সালে তাঁর সেই ইচ্ছা পূর্ণ করা হয়েছিল।
‘সীমাহীন প্রতিভা’, ‘মানুষের জন্য অনন্ত ভালবাসা’, ‘বিস্ময়কর পরিশ্রমের ক্ষমতা’ নিয়ে বিধানচন্দ্র সংখ্যাহীন মানুষের ‘ভালবাসা অর্জন’ করেছিলেন। কিন্তু জীবনকালে তিনি যে সব ‘নিন্দা’ অকারণে নতমস্তকে গ্রহণ করে গিয়েছেন তারও তুলনা নেই। তাঁর চরিত্র নিয়ে দেওয়াল লিখন ছড়ানো হয়েছিল। তাঁর ‘রাজনৈতিক নিন্দুক’রা তাঁকে ঘিরে ধরে ‘কুৎসিত গালাগালি’ করেছিল, ‘এমনকী জামা গেঞ্জি ছিঁড়ে দিয়েছিল’। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। এবং যিনি ‘দেশের কাজে’ একের পর এক ‘সম্পত্তি বন্ধক’ দিয়েছিলেন অথবা ‘বিক্রি’ করে দিয়েছিলেন, তাঁকে ‘চোর’ বলা হয়েছিল এবং ‘সরকারকে ঠকিয়েছেন’ বলা হয়েছিল। আঘাত পেলেও ডাক্তার রায়কে বিচলিত দেখাত না। তিনি মাঝে মাঝে বলতেন – “তোমার সাধ্যমতো চেষ্টা করো, এবং বাকিটা ভগবানের উপর ছেড়ে দাও।” আবার কখনও কখনও মেডিক্যাল কলেজের তাঁর প্রিয় মাস্টারমশাই ‘কর্নেল লুকিস’কে স্মরণ করে বলতেন, “হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে চেষ্টা করে হেরে যাওয়া ভাল।” আবার কখনও কখনও নিজের মা-বাবাকে স্মরণ করে বলতেন – “মা-বাবার কাছ থেকে তিনটে জিনিস শিখেছিলাম স্বার্থহীন সেবা, সাম্যের ভাব এবং কখনও পরাজয় না মেনে নেওয়া।”
আর যাঁরা তাঁর নিন্দায় মুখর ছিলেন তাঁদের সম্বন্ধে তিনি তাঁর জীবনসায়াহ্নে বলেছিলেন, “আমি যখন মরব তখন ওই লোকগুলোই বলবে, ‘লোকটা ভাল ছিল গো, আরও কিছু দিন বাঁচলে পারত’।”
(তথ্যসূত্র:
১- ডঃ বি সি রায়, কে পি থমাস।
২- ডঃ বি সি রায় অ্যান্ড আদার চিফ মিনিস্টারস, সরোজ চক্রবর্তী।
৩- ডঃ বিধান রায়, অশোককুমার কুণ্ডু, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট (১৯৮৮)।
৪- ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় জীবন ও সময়কাল, নীতিশ সেনগুপ্ত, দে’জ পাবলিশিং (২০০২)।
৫- জ্যোতি বসু রচনাবলি (বিধানসভায় বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক)।
৬- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত