মৃত্যুর পর টানা দু’দিন তাঁর লাশ পড়ে পড়ে পচেছিল মর্গে। ‘হিন্দু ধর্মত্যাগী’কে দাহ করতে পারেনি তাঁর বন্ধু-পরিজন। আর তাঁকে গোর দেওয়ার একখণ্ড জমিরও অনুমতি মেলেনি ওই আটচল্লিশ ঘণ্টায়! শেষে এক যাজক সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে তাঁকে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করেন। শোকযাত্রায় পা মেলান সে-কালের কলকাতার এক হাজার নাগরিক!
তিনি আর কেউ নন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’!
খ্ৰীস্টিয় ঊনিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে একদিন, কলকাতার একটা বাগানবাড়িতে আড্ডা দিচ্ছিলেন চার জন – ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালার প্রতিষ্ঠাতা’, ‘পাইকপাড়ার রাজ পরিবারের দুই ভাই’, ‘রাজা প্রতাপচন্দ্র’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ’; ‘পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর’ ও ‘মাইকেল মধুসূদন দত্ত’।
আলোচনা চলাকালীন মাইকেল বলেছিলেন, যত দিন না বাংলায় ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দের চল হচ্ছে, তত দিন বাংলা নাটকের উন্নতির আশা নেই। আর ‘যতীন্দ্রমোহনের’ মত ছিল, বাংলায় এই ছন্দ সৃষ্টি সম্ভব নয়। কথাটা আদৌ পছন্দ হয়নি মধুসূদনের। কিন্তু ‘নাটক’, ‘ফটোগ্রাফি’, ‘সঙ্গীতের সমঝদার’ যতীন্দ্রমোহনও নাছোড় ছিলেন। কবিকে ঈশ্বর গুপ্তের নাম করে খোঁচা দিয়ে বসেছিলেন। ‘গুপ্তকবি’ নাকি এক বার অমিত্রাক্ষরের ‘প্যারোডি’ করে লিখেছিলেন –
“কবিতা কমলা কলা পাকা যেন কাঁদি
ইচ্ছা হয় যত পাই পেট ভরে খাই।”
এই রসিকতায় মনে মনে বেজায় চটলেন মাইকেল। ‘ঈশ্বর গুপ্ত’ পারেননি বলে কি আর কেউ ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দে লিখতে পারবেন না! সোজা ‘চ্যালেঞ্জ’ ঠুকে ‘যতীন্দ্রমোহন’কে বলেছিলেন, তিনি প্রমাণ করে দেখবেন যে, ‘অমিত্রাক্ষর’ লেখার জন্যে বাংলা ভাষা যথেষ্ট উপযোগী। তাঁর ‘আত্মবিশ্বাস’ তো ছিলই, সাথে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন মধুসূদন। হিন্দু কলেজে ‘সনেট’ রচনা হোক বা ইংরেজি কাব্যনাট্য ‘রিজিয়া’, দীর্ঘ দিন এই ছন্দ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন তিনি। চ্যালেঞ্জ শুনে যতীন্দ্রমোহন বলেছিলেন, যদি সত্যিই তা সম্ভব হয়, তাহলে, মাইকেলের কাব্য নিজ অর্থে ছেপে দেবেন। মাইকেলও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দু-তিন দিনের মধ্যে অমিত্রাক্ষরে রচিত কয়েকটি স্তবক লিখে দেখাবেন। কথামত এক দিন দেখা গেল, শুধু স্তবক না, ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দে মধুসূদন লিখে ফেলেছেন কাব্যের আস্ত একটা সর্গ। এমনধারা লেখা বাংলা ভাষায় হতে পারে, ভাবতেই পারেননি ‘যতীন্দ্রমোহন’ ও ‘রাজ-ভ্রাতৃদ্বয়’। ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দের কাব্য পড়ে বিস্মিত হয়েছিলেন হিন্দু কলেজের প্রাক্তনী ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’ও। তাঁর ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’-তে প্রকাশ করেছিলেন কাব্যটির প্রথম দু’টি সর্গ। কবির নাম ছিল না। রাজেন্দ্রলাল সৃষ্টির কৃতিত্ব দিয়েছিলেন কোনও ‘সুচতুর কবি’কে। কবিতাটির নাম – ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’। মধুসূদন সেটা উৎসর্গ করেছিলেন ‘প্রেরণা’ যতীন্দ্রমোহনকেই। এক ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ বাদে মধুসূদনের বাকি সকল কাব্যগ্রন্থই লেখা এই ছন্দে। এভাবেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছিলেন ‘মধু-কবি’!
উপরের ঘটনার অনেক আগে, তখন মধুসূদন হিন্দু কলেজের ছাত্র। তখন তিনি সদ্য পড়েছেন রোমান কবি ওভিড-এর লেখা ‘এপিস্তুলাই হেরোইদুম’ বা ‘হেরোইদেস’; যেখানে গ্রিক পুরাণের নারীরা আবেগে-আশ্লেষে চিঠি লিখেছেন তাঁদের প্রেমিকদের। এমন কাব্য তো বাংলায় নেই, মনে হয়েছিল মধুসূদনের। তিনি ভাবলেন, এর অনুকরণে নতুন এক কাব্য লিখলে হয় না? সেখানে ভারতীয় পুরাণের নারীরা ‘প্রশ্ন-অভিযোগ-আহ্বান’ জানিয়ে চিঠি লিখবেন তাঁদের স্বামী অথবা প্রেমিককে। চিঠির আদল হবে ‘পৌরাণিক’, কিন্তু অন্তরে থাকবে ‘সমকালের স্বর’। মাথায় ঘুরতে থাকা পরিকল্পনা তখনই জানিয়েছিলেন প্রিয় বন্ধু ‘গৌরদাস বসাক’কে।
এর বেশ কয়েক বছর পরে মধুসূদন লিখেছিলেন ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য’ – ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। তত দিনে জীবনের পরিচিত ছন্দ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। জাতপাতের গণ্ডি মেনে বাবা রাজনারায়ণ দত্তের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়েতে তাঁর বেজায় আপত্তি ছিল। অচেনা-অজানা এক মেয়ের সঙ্গে কী ভাবে যে আজীবনের গাঁটছড়া বাঁধা যায়, হিন্দু কলেজের ছাত্রটির মাথায় তা ঢোকেনি। বিয়ে থেকে বাঁচতে ধর্ম বদলে রাতারাতি ‘খ্রিস্টান’ হয়েছিলেন তিনি। মধুসূদনের আগে জুড়ে গিয়েছিল ‘মাইকেল’। নিজের বাড়ি, কলকাতা ছেড়েছিলেন। মাদ্রাজে গিয়ে প্রেমে পড়েছিলেন ‘রেবেকা’ নামে একটি মেয়ের। বিয়ে করেছিলেন তাঁকে। কিন্তু বিয়ে টিকে নি রেবেকার সঙ্গে। তার পরে তিনি আবার বিয়ে করেন ফরাসি তরুণী ‘হেনরিয়েটা’কে।
‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ ও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর পরে, ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। ‘শকুন্তলা’, ‘তারা’, ‘রুক্মিণী’, ‘কৈকেয়ী’, ‘শূর্পণখা’, ‘ভানুমতী’, ‘দ্রৌপদী’, ‘দুঃশলা’, ‘জাহ্নবী’, ‘ঊর্বশী’, ‘জনা’ – এগারো জন পৌরাণিক নারী চরিত্র ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ তাঁদের প্রেমিক অথবা স্বামীকে চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠির সুর ছিল কখনও অনুনয়ের, কোথাও বা প্রশ্ন আর অভিযোগে তীক্ষ্ণ। পুরাণের প্রচলিত ছাঁদ, চেনা গল্পকে সম্পূর্ণ দুমড়ে তাকে নতুন খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল। যে প্রবণতা ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে আছে। সংস্কৃত সাহিত্য, পুরাণ, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বা ভার্জিলের ‘দ্য ইনিড’ পড়া মুক্তমনা মাইকেল এমন এক সমাজের ছবি দেখতে চেয়েছিলেন, যেখানে নারী প্রশ্ন তুলবে, বুঝে নিতে চাইবে নিজের ‘অধিকার’। যা সে সময় ছিল ‘আকাশকুসুম চিন্তা’। তাই দেখা যায়, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ কথা দিয়ে কথা না রাখা স্বামীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন কৈকেয়ী; আবার দেখা যায় যে রুক্মিণী স্বেচ্ছায় অপহৃতা হতে চেয়ে পত্র পাঠিয়েছেন দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণের কাছে। মাইকেলের ‘বীরাঙ্গনা’রা কুণ্ঠা কাটিয়ে জগৎকে জানাতে চান নিজের ইচ্ছের কথা, নিছক সংস্কারবশে মেনে নেন না স্বামী বা প্রেমিকের প্রবঞ্চনা।
কিন্তু প্রথম থেকেই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর সবচেয়ে বিতর্কিত পত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘সোমের প্রতি তারা’। প্রত্যেক নায়িকার চিঠির শুরুতেই মধুসূদন কাহিনীসূত্র দিয়েছিলেন। সেখানে বলা আছে, কোন পরিস্থিতিতে সেই নায়িকা অমুককে ওই চিঠিটি লিখেছেন। তারার চিঠির মুখবন্ধ থেকে জানতে পারা যায়, ‘দেবগুরু বৃহস্পতি’র আশ্রমে বিদ্যালাভের জন্য এসেছিলেন যুবক ‘সোমদেব’। রূপবান এই তরুণের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘বৃহস্পতির স্ত্রী তারা’। শিক্ষাশেষে ছাত্র ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে গুরুপত্নী চিঠি লেখেন সোমদেবকে। যেখানে মেলে ধরেন তাঁর অনুক্ত কামনা। মধুসূদন লিখছেন – “সোমদেব যে এতাদৃশী পত্রিকাপাঠে কি করিয়াছিলেন, এ স্থলে তাহার পরিচয় দিবার কোন প্রয়োজন নাই। পুরাণজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা অবগত আছেন।” আর গোলমাল বাধে এখানেই। আসলে কী করেছিলেন সোমদেব?
পুরাণে আছে, সিক্তবসনা তারাকে দেখে সোমদেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এমনই সে উত্তেজনা যে সব কিছু ভুলে তিনি অপহরণ করেন তারাকে। তারা যথাসাধ্য বাধা দেন। বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকেন কে তিনি। পতিব্রতা গুরুপত্নীকে জোরপূর্বক সঙ্গম করলে যে সহস্র ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়, সে কথাও জানাতে ভোলেন না। কিন্তু কামোন্মত্ত সোমদেব জল-স্থল-পাতালের নানা জায়গায় তারাকে নিয়ে যান, আর মেতে থাকেন উদ্দাম সঙ্গমে। অবশেষে ‘প্রজাপিতা ব্রহ্মা ও মহাদেবের মধ্যস্থতায়’ বৃহস্পতি ফিরে পান তাঁর স্ত্রীকে। তারা তখন গর্ভবতী, ক্রমে সোমদেবের ঔরসে জন্ম হয় ‘বুধের’। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের’ এই কাহিনী সম্পূর্ণ উল্টে যায় মাইকেলের লেখায়। সেখানে দেখা যায় দেবী তারাই কামনা করছেন ‘চন্দ্র’কে। তারা চন্দ্রের উদ্দেশে লিখছেন –
‘‘তুষেছ গুরুর মন: সুদক্ষিণাদানে,
গুরুপত্নী চাহে ভিক্ষা, দেহ ভিক্ষা তারে।’’
এক অদম্য শরীরী আহ্বান, যেখানে স্পষ্ট এক নারীর যৌন স্বাধিকারের কথা।
কিন্তু মাইকেল ‘পুরাণের বদল’ ঘটিয়েছিলেন কেন? উত্তর খুঁজতে আর এক পৌরাণিক প্রসঙ্গের গিঁট খুলতে হয়। মহামতি ‘অঙ্গিরার পুত্র উতথ্য’ ছিলেন বৃহস্পতির বৈমাত্রেয় দাদা। ‘উতথ্যর স্ত্রী মমতা’ যখন গর্ভবতী, এক দিন বৃহস্পতি মমতার অসম্মতি সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে রমণে উদ্যত হন। মমতা বাধা দেন। এমনকি তাঁর গর্ভস্থ সন্তানটিও মায়ের জরায়ুপথ আটকানোর চেষ্টা করে। ‘সম্ভোগ’ ব্যাহত হওয়ায় ক্রুদ্ধ ‘দেবগুরু’ সেই সন্তানকে ‘অন্ধত্বের অভিশাপ’ দেন। মমতাও পাল্টা অভিশাপ দিয়ে বসেন বৃহস্পতিকে – এক দিন তাঁর স্ত্রী তারা-ও পরপুরুষের ভোগ্যা হবেন। তাই তারার নারীত্বের অবমাননা বুঝি একপ্রকার ‘অনিবার্য’ই ছিল। এক বিকৃতকাম পুরুষের লালসার ফলশ্রুতিতে অন্য এক পুরুষের কামনার শিকার হয়েছিলেন আর এক নারী।
মধুসূদন এই ‘পৌরাণিক অশালীনতার প্রায়শ্চিত্ত’ করতে চেয়েছিলেন সদর্পে। পুরাণকথার অভিমুখটাই তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। মূল পুরাণে উল্লেখিত সোমদেবের লাম্পট্যের গল্পের পরিবর্তে সেখানে চালিকার আসনে বসিয়েছিলেন তারাকে।
মাইকেল ছন্দ ভাঙলেও সেই সময় সমাজ তো ছন্দ ভাঙতে শেখেনি। পুরাণের গল্প পাল্টে গিয়েছিল – নারী তাঁর অধিকার নিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করছে, সেক্ষেত্রে সমালোচনার ঝড় ওঠার কথা। কিন্তু এই কাব্য তার বিষয় আর আঙ্গিকের অভিনবত্বে সেই সময় এতই আলোড়ন ফেলেছিল যে, বীরাঙ্গনাদের চিঠির উত্তর লেখার একটা প্রবণতা চোখে পড়ে পরের পঞ্চাশ বছর জুড়ে।
এই কাব্য প্রকাশকালের বছর দশেক পরেই অসমের বরাক উপত্যকার ‘রামকুমার নন্দী মজুমদার’ লিখেফেলেছিলেন ‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য’। যেখানে ‘চন্দ্র’ বলছেন –
“কলঙ্কী শশাঙ্ক কেহ বলে নাই সতি!
এত দিন, কিন্তু তব ভবিষ্যত-কথা
দৈববাণী সম এবে ফলিবে দাসেরে;
ধরিবে কলঙ্ক এ কিঙ্কর তব নামে –
শোভিবে সোমের অঙ্কে সে কলঙ্করেখা,
ভৃগুপদচিহ্ন যথা মাধবের হৃদে।
তারানাথ নাম মম তেয়াগিয়া আজি,
হইব তারার দাস জনমের মত!”
ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় কী ভাবে উত্তরসূরিরা আঁকড়ে ধরেছিলেন মধুসূদনকে, তারই আভাস পাওয়া যায় এই ‘উত্তর-বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য’ পড়লে।
অথচ ৪৯ বছরের জীবনে (১৮২৪-১৮৭৩) কী অশান্তই না ছিলেন ‘দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’!
১৮৪৮ সালের ১৮ই জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ‘লেডি সেইল’ নামের জাহাজটি মাদ্রাজে পৌঁছেছিল। জাহাজ থেকে নেমেছিলেন ‘মাইকেল মধুসূদন ডাট’। বিশপস কলেজের সহপাঠী এডবার্গ কেনেটের দাক্ষিণ্যে শিক্ষকতার চাকরি জুটেছিল অরফ্যান অ্যাসাইলাম বয়েজ স্কুলে। নামে বয়েজ স্কুল হলেও সেখানে ফিমেল অরফ্যান অ্যাসাইলামের মেয়েরাও পড়তেন। ‘রেবেকা ম্যাকটাভিশ’ থাকতেন ফিমেল অ্যাসাইলামে, পড়াশুনো করতেন অরফ্যানের বয়েজ স্কুলে। মাইকেল ছাত্রী হিসেবে সেখানেই রেবেকাকে পান। শিক্ষক মধুসূদন সকলের নজর কেড়েছিলেন এবং কলেজের বার্ষিক প্রতিবেদনে তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়েছিল। নীলনয়না শ্বেতাঙ্গিনী রেবেকার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং পরিণামে পরিণয় হয়ে গিয়েছিল মাত্র ছয় মাসের মধ্যে, যদিও তাতে বাধাও ছিল প্রচুর। ওদিকে রেবেকার পিতৃ-পরিচয় ছিল রহস্যে ঘেরা। তাঁর পিতার নাম ছিল রবার্ট টমসন, মা ক্যাথরিন টমসন। রবার্টের মৃত্যুর পর ক্যাথরিন আশ্রয় পেয়েছিলেন ডুগান্ড ম্যাকটাভিশের কাছে এবং এই পালক পিতা ম্যাকটাভিশের নামকেই রেবেকা নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করে নেন। অথচ রেবেকাকে থাকতে হয়েছিল অরফ্যান অ্যাসাইলামে! তা হলে? রেবেকা কি অনাথ ছিলেন?
বিয়ের সাড়ে তিন মাসের মাথায় রেবেকা গর্ভবতী হলেন। সংসারে যথেষ্ট অভাব। সামান্য বেতনে আর চলে না। এমন পরিবেশে কাব্যচর্চা সহজ নয়। তবু এরই মধ্যে মাইকেল ‘ম্যাড্রাস সার্কুলার’ পত্রিকার জন্য ‘ক্যাপটিভ লেডি’ কাব্যটি লিখে ফেললেন। ধার-দেনা করে বই ছাপিয়ে কলকাতায় পাঠালেন তিনি। বুকে আশা, কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ এই বই গ্রহণ করবে। তাকে কবি বলে প্রতিষ্ঠা দেবে। কার্যত বইটি বিক্রি হয়েছিল মাত্র ১৮ কপি। এমনকী ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় মাইকেলকে তীব্র আক্রমণ করে রিভিউ লেখা হয়েছিল, যেখানে ব্যক্তি মাইকেলকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলেছিলেন সমালোচক। বেথুন সাহেবও কাব্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করেননি, বরং লিখেছিলেন, ‘‘…ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে তিনি যে রুচি এবং মেধা অর্জন করেছেন, তা তাঁর নিজের ভাষার মানোন্নয়ন এবং কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যয় করুন।’’ এর পর মাইকেলের কবিখ্যাতি মাদ্রাজ শহরে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল, ‘রিজিয়া’ (সম্পূর্ণ করেননি), প্রথমে ‘ইউরেশিয়ান’, পরে একযোগে ‘ইস্টার্ন গার্ডিয়ান’ ও ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকল’ সম্পাদনা করেছিলেন, গ্রিক-ল্যাটিন-হিব্রু-সংস্কৃত-ইংরেজি অধ্যয়ন করেছিলেন একদম রুটিন মেনে।
ওদিকে সন্তানের জন্মের পর রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় রেবেকা সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন নাগপুরের দিকে। এই প্রথম রেবেকার সঙ্গে মাইকেলের একটানা দীর্ঘ দিনের বিচ্ছেদ হয়েছিল। সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা তো ছিলই – সেই সব কিছু লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন মাইকেল ‘অন দ্য ডিপারচার অব মাই ওয়াইফ অ্যান্ড চাইল্ড টু দ্য আপার প্রভিন্সেস’ নামে একটি কবিতায় – ‘‘মাই হোম ইজ লোনলি – ফর আই সিক ইন ভেন
ফর দেম হু মেড ইটস স্টার-লাইট।”
পরের বছরের গোড়ায় মাইকেলের মা মারা যান। ‘সুদূর’ মাদ্রাজ থেকে কলকাতায় যাওয়ার মতো আর্থিক সংগতি না থাকলেও ঝটিকা সফরে তিনি কলকাতায় এসে বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। জাহ্নবী দেবীর এই অকাল মৃত্যুর জন্য রাজনারায়ণ মাইকেলকেই দায়ী করেছিলেন। মধু তাঁর পিতার মুখের ওপর বলতে পারেননি – এই মৃত্যুর জন্য রাজনারায়ণ নিজেও কম দায়ী নন। পুত্রসন্তানের আশায় তিনি আরও তিনটি বিবাহ করেছিলেন যা কম আহত করেনি জাহ্নবীকে।
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রেবেকার গর্ভে মাইকেলের চারটি সম্তানের জন্ম হয়েছিল – ব্যর্থা, ফিবি, জর্জ, জেমস। দুটি মেয়ে, দুটি ছেলে। ‘চমৎকার স্ত্রী এবং চারটি সন্তানের’ সংসার যখন তিনি বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে বসছেন, তখন ১৮৫৫ লালের ১৯শে ডিসেম্বর বুধবারে গৌরদাসের লেখা একটি চিঠি থেকে তিনি জানতে পারলেন বাবা রাজনারায়ণ দত্ত মারা গেছেন অন্তত এগারো মাস আগে – ‘‘সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে তোমার জ্ঞাতি ভাইয়েরা কাড়াকাড়ি করছে। তোমার দুই বিধবা মাতা বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমার লোভী এবং স্বার্থপর আত্মীয়দের বাড়াবাড়ির জন্য তাঁরা তাঁদের মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েছেন।’’ সম্পত্তি উদ্ধারের আশা আছে জানতে পেরে মাইকেল কলকাতা যাবেন মনস্থির করে ফেললেন।
রেবেকা যখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় উত্তরে ভ্রমণ করতে গেছিলেন, তখনই মাইকেলের সহকর্মী জর্জ জাইলস হোয়াইটের স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছিল। জর্জের তিন সন্তান ছিল – বড় মেয়ে হেনরিয়েটা, ছোট দুটি ছেলে উইলিয়াম ও আর্থার। নিজের মাকে হারিয়ে মাইকেল জানতেন যে জীবনে মাতৃবিয়োগের ব্যথা কতটা আহত করে, সহকর্মীর এই তিন সন্তানকে তিনি তাই বাড়তি সঙ্গ দিয়েছিলেন স্বাভাবিক কারণেই। স্ত্রী-বিয়োগের তিন বছর পরে জর্জ হোয়াইট দ্বিতীয়বার বিবাহ করে ফেলেছিলেন ষোলো বছর বয়েসি এমিলি জেইন শর্ট নামে এক কিশোরীকে। জর্জের বয়স তখন ছিল সাতচল্লিশ। হেনরিয়েটা তখন ছিলেন সতেরো, নতুন মা ও নববধূর থেকেএক বছরের বড়। ফলে হোয়াইট পরিবারে ঝড় উঠল। বিমাতার সঙ্গে হেনরিয়েটার পদে পদে অশান্তি শুরু হল – মাইকেল সহানুভূতি, দরদ দেখাতে গিয়ে হেনরিয়েটার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হল।
পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মাইকেল যখন কলকাতা যাবেন ঠিক করে ফেললেন, তার কিছু দিন আগে তাঁর ‘সুখের নীড়ে’ ভয়ঙ্কর ঝড় বয়ে গিয়েছিল। হেনরিয়েটার সঙ্গে মাইকেলের প্রেম প্লেটোনিক ছিল না। একাধিক বার তাঁদের মিলন হয়েছিল। মাইকেল দিব্য একটি দ্বৈত সম্পর্ক চালাচ্ছিলেন – রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্য, হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম। হেনরিয়েটা মাইকেলের সাহিত্যসঙ্গিনী হয়ে উঠেছিলেন, তাঁর সঙ্গ কবি পছন্দ করতেন, তুলনায় অর্ধশিক্ষিত রেবেকা ছিলেন কবির নির্ভরতার সঙ্গী। কবি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, রেবেকা সহস্র বাধা অগ্রাহ্য করে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মাইকেলকে বিয়ে করেছিলেন। হেনরিয়েটা যদি মাইকেলকে বিয়ের ইচ্ছের কথা প্রকাশ করেও ছিলেন, স্পষ্টবাক মাইকেল নিশ্চয়ই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন রেবেকাকে ডিভোর্স দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ওদিকে রেবেকা জানতে পেরে গিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর নতুন প্রেমের কথা। অনুমান করা যেতে পারে, রেবেকা স্বচক্ষে, অথবা তাঁদের সন্তানদের মধ্যে কেউ একজন মাইকেল-হেনরিয়েটাকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখে ফেলেছিলেন। এর পর পালিয়ে যাওয়া ছাড়া মধুসূদনের পক্ষে বিকল্প কোনও পথ ছিল না।
কলকাতায় পালিয়ে এলেন মাইকেল। আর কোনও দিন ফিরে যাননি রেবেকার কাছে, সন্তানদের কাছে। রেবেকা তাঁকে বিবাহ-বিচ্ছেদ দেননি। হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করবে মাইকেল – রেবেকা তা চাননি। মধু যখন বুঝলেন বিবাহ-বিচ্ছেদ পাবেন না, তখন হেনরিয়েটাকে কলকাতায় চলে আসতে লিখলেন। পিতার বিনা অনুমতিতে, ছদ্মনাম নিয়ে হেনরিয়েটা কলকাতায় চলে এসেছিলেন। মাইকেলের কলমে সৃষ্টির জোয়ার এসেছিল। নেশাগ্রস্থের মতো মত্ত হয়েছিলেন তিনি সৃষ্টির আনন্দে – ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’স মায়াকানন নাটক, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র মতো প্রহসন, ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ – পাঁচ বছরে মাইকেল বাংলা নাটক ও কাব্যকে বলতে গেলে নিস্তরঙ্গ পুষ্করিণী থেকে পরিণত করেছিলেন মহাসমুদ্রে।
হেনরিয়েটা আর মাইকেল এক সঙ্গে ছিলেন পনেরো বছর – প্রথমে কলকাতা, পরে ইউরোপ, আবার কলকাতা। হেনরিয়েটার গর্ভে মাইকেলের চারটি সন্তান হয়েছিল – শর্মিষ্ঠা, ফ্রেডরিক, অ্যালবার্ট। তৃতীয় সন্তান একটি মেয়ে সূতিকাগৃহেই মারা যায়।
যে বিদ্যাসাগরকে তিনি একসময় ‘টুলো পণ্ডিত বলে ব্যঙ্গ করতেন, সেই বিদ্যাসাগরই তাঁর পরমবন্ধু হয়ে ওঠেন। কেবল বন্ধু নয়, ‘ত্রাতা’ বলা যায় তাঁকে। মাইকেল বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হবেন বলে। অমিতব্যয়িতা, বড়লোকি চাল দেখানো মাইকেলের বহু দিনের স্বভাব ছিল – বলা ভালো বদ-স্বভাব ছিল। এ জন্য তিনি মাদ্রাজ, কলকাতা, লন্ডন, ভার্সাই কোথাও শান্তি পাননি। পাওনাদারদের অভিযোগে তাঁকে পুলিশ-থানা পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শেষ পর্বে, বিশেষ করে ইউরোপ বাসকালে বিদ্যাসাগর তাঁকে যে ভাবে বারবার টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তার তুলনা মেলা ভার। ১৮৬৬ সালের ১৭ই নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্যারিস্টারির স্বীকৃতি পান মাইকেল। এই সুখের খবর তিনি সবার আগে জানিয়েছিলেন বিদ্যাসাগরকে – ‘‘আমি নিশ্চিত আপনি জেনে দারুণ খুশি হবেন যে, গত রাতে গ্রেজ ইন সোসাইটি আমাকে বার-এ ডেকে পাঠিয়েছিল এবং আমি অবশেষে ব্যারিস্টার হয়েছি। এর সব কিছুর জন্য আমি ঋণী প্রথমে ঈশ্বর এবং তাঁর নীচে আপনার কাছে। এবং আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি চিরদিন আপনাকে আমার সবচেয়ে বড় উপকারী এবং সবচেয়ে খাঁটি বন্ধু বলে বিবেচনা করব। আপনি না হলে আমার যে কী হতো।… প্রিয় বিদ্যাসাগর, আপনি ছাড়া আমার কোনও বান্ধব নেই।’’
ছাত্রাবস্থায় অঙ্কে মধুসূদনের আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি যে গণিতেও ভাল করতে পারতেন হিন্দু কলেজের ক্লাসে তার পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্য ছাত্ররা যে অঙ্ক করতে পারেনি, মধু সেই অঙ্ক করে দিয়ে মন্তব্য করেছিলেন – ‘‘দেখলে তো শেক্সপিয়র ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন, কিন্তু নিউটন ইচ্ছে করলে শেক্সপিয়র হতে পারতেন না।’’ বেহিসেবি মাইকেল জীবনের অঙ্ক কোনও দিনই মেলাতে পারেননি, ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরুর আগেই হোটেলে বিলাসী জীবন কাটানো, পরিবারকে ভার্সাইতে রেখে আসার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত, ধার করে ঘি খাওয়া – এই সব কিছুই তাঁর জীবনকে দ্রুত মৃত্যুর দিকে নিয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে গিয়েছিল এই পর্বে। ও দিকে ভার্সাইতে দারিদ্র্য পীড়িত হেনরিয়েটা মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেও তাঁদের অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। এক সময় মাইকেল পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিংহের ম্যানেজারির চাকরি নিয়ে অজ-পাড়াগাঁ কাশীপুরে গিয়েছিলেন। তবে মন্দ কপাল কবির। এই চাকরিও থাকে নি। এক নাপিত রাজামশাইয়ের কান ভেঙেছিলেন মাইকেলের নামে। ফলশ্রুতিতে প্রাণ বাঁচাতে রাতের অন্ধকারে পঞ্চকোট থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
১৮৭৩ সালের মার্চ মাস নাগাদ কবির স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। কন্যা শর্মিষ্ঠার তখন তেরো বছর বয়স, কবি তাঁর বিয়ে দিয়ে দিলেন তাঁর দ্বিগুণ বয়েসি এক অ্যাংলো যুবকের সঙ্গে। মেয়ের বিয়ের পর সপরিবারে মাইকেল গেলেন উত্তরপাড়ায় – লাইব্রেরির ওপর তলায় উঠলেন, হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে আসা বাল্যবন্ধু গৌরদাস মধুকে দেখতে যান এবং দেখতে পান – ‘‘সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়ে ছিল।’’
পরদিন মাইকেলকে ভর্তি করানো হল আলিপুরের জেনারেল হাসপাতালে, গলার অসুখ তো ছিলই, যকৃতের সিরোসিস থেকে দেখা দিয়েছিল উদরী রোগ, হাসপাতালে কবির সঙ্গে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর এক সময়ের মুন্সি মনিরুদ্দিন। মাইকেল তাঁর কাছে টাকাপয়সা আছে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। মনিরুদ্দিন জানিয়েছিলেন, দেড় টাকা আছে। ওটাই চেয়েছিলেন মধু, তারপর তা বখশিস হিসেবে দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর সেবারতা নার্সকে।
২৬শে জুন হেনরিয়েটা মারা যান। মাইকেল এই সংবাদ এক পুরনো কর্মচারীর কাছ থেকে জানতে পারেন।
২৯শে জুন রবিবার, মাইকেলের অন্তিম অবস্থা ঘনিয়ে এল। বেলা দুটোর সময় চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন কবি।
এই মৃত্যুর পরেই সবকিছু শেষ হতে পারত, কিন্তু হয়নি। কবির নশ্বর দেহটা তখনও এই ধরাধামে ছিল।
মৃত্যুর পর মাইকেলের শেষকৃত্য নিয়ে সমস্যা দেখা দিল।কলকাতার খ্রিস্টান সমাজ তাঁকে সমাহিত করার জন্য মাত্র ছয় ফুট জায়গা ছেড়ে দিল না। ফলে কবির মরদেহে পচন ধরল। অবশেষে এগিয়ে এলেন ‘অ্যাংলিকান চার্চের রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো’।বিশপের অনুমতি ছাড়াই, জার্বোর উদ্যোগে, ৩০শে জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে মাইকেলকে সমাধিস্থ করা হয়। চার দিন আগে সেখানেই হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কবির কবর খোঁড়া হয় তাঁর পাশেই।
সে দিন ভক্ত ও বন্ধুবান্ধব মিলে উপস্থিত ছিলেন প্রায় এক হাজার মানুষ। কিন্তু একদিন শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে যাঁদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করে গিয়েছিলেন, সেই ভিড়ে ছিলেন না তাঁদের একজনও।
আজ মধ্য কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোড সেমেটরিতে এত সবুজ, চোখের আরাম হতে বাধ্য। মধুকবি, মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধি খুঁজে পেতে অসুবিধে হয় না, টালি-ফেলা পথের ধারে বড় ফলকের গায়ে লেখা ‘মধু-বিশ্রাম পথ’, ‘বাংলার গৌরব কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্থলে যাবার রাস্তা’। লোহার রেলিং-ঘেরা এক টুকরো জমি। ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকতেই আবক্ষ মর্মরমূর্তি, নীচে সেই বিখ্যাত এপিটাফ:
‘‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!…’’
দু’পাশে নানা রঙের পাতাবাহার পেরিয়ে পাশাপাশি সমাধিতে শুয়ে আছেন ‘মধুসূদন-হেনরিয়েটা’; শান্ত, চুপচাপ।
(তথ্যসূত্র:
১- আশার ছলনে ভুলি, গোলাম মুরশিদ।
২- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিপ্লব বালা, প্রথমা প্রকাশন (২০১৫)।
৩- সেই সময় (অখণ্ড) (পটভুমিকা ১৮৪০ থেকে ১৮৭০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (নীললোহিত), আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
৪- মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী।
৫- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সুনির্মল বসু, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র (২০১৬)।
৬- বিদ্যাসাগর: নানা প্রসঙ্গ, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, চিরায়ত প্রকাশন (২০১১)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত