তখন রেকর্ড কোম্পানি, রেকর্ড করা গানের স্যাম্পেল কপি দিত শিল্পীদের, শিল্পী অ্যাপ্রুভ করলে সেটা প্রিন্ট হয়ে বেরোবে। সে বছর, খুব ভুল না করলে ১৯৫৭, সতীনাথ মুখোপাধ্যায় আর একজন শিল্পী গেছেন উৎপলা সেনের কাছে স্যাম্পেল রেকর্ড নিয়ে। কার গান হিট হবে জানতে, দু’জনই পরস্পরের সুরে গেয়েছেন সে বছর। সব কিছু শুনে উৎপলা সেন বললেন, দু’জনের সুরই অনবদ্য হয়েছে, তবে সতীনাথের সুর দেওয়া গান দুটো হিট হবেই। উৎপলা সেনের সামনে দুই বন্ধু পরস্পরের কাছে বাজি রাখলেন, এইচ.এম.ভি প্রথম ছ’মাসের বিক্রির যে লিস্ট দেবে তাতে যাঁর গানের বিক্রি বেশী হবে, সেই জয়ী। ঐ শিল্পী যদি বাজি জেতেন তাহলে সতীনাথ ওঁকে এক কার্টন বিয়ার দেবেন, আর উনি হারলে সতীনাথ কে দেবেন এক কার্টন গোল্ড ফ্লেক। সে বছর দেখা গেল শ্যামল মিত্রের সুর করা সতীনাথের গান, “রাতের আকাশ তারায় রয়েছে ভরে” উলটো দিকে “পথ চেয়ে শুধু মোর দিন কেটে যায়” আর বেস্ট সেলার হিসেবের শ্যামল মিত্রের গান, সতীনাথের সুর করা – “এত আলো আর এত হাসি গান” আর অন্য দিকে “তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর।”
সতীনাথ মানুষটি ছিলেন অনেকটাই আলাভোলা। সুর মাথায় এলে দিকশূন্য। গান মনে এল তো, সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তাতেই কথা লিখতেন, নোটেশন করতেন। চাঁদনি রাতে গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎই লিখে ফেলেছিলেন, ‘জীবনে যদি দীপ জ্বালাতে নাহি পারো’ কিংবা ‘এখনও আকাশে চাঁদ ওই জেগে আছে’।
নতুন গানের সুর ভাঁজতে গিয়ে বেখেয়ালে নিয়ম ভেঙে থানাতেও গিয়েছিলেন। একবার ভুল পার্কিং করে ফেলেছিলেন। ট্রাফিক পুলিশ সোজা পার্ক স্ট্রিট থানায় ধরে নিয়ে যায়। তাতেও হুঁশ হয়নি। থানার চেয়ারে বসে বসেই সুর লাগিয়েছিলেন। গলা শুনে ওসি ছুটে এসে দেখেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়! তখন সেই ট্রাফিক পুলিশেরই সাজা হয় আরকী!
একটা সময় কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটে টানা এগারো বছর ছিলেন। সবে তখন এজি বেঙ্গলের চাকরিতে ঢুকেছেন। অফিসের সময়টুকু বাদ দিলে ঘরের মধ্যেই চলত টানা রেওয়াজ। বিকেলের আলো নিভে গিয়ে সন্ধে পেরিয়ে রাত নামত। রেওয়াজে এতটাই মশগুল থাকতেন, ঘরের আলো জ্বালতেও ভুলে যেতেন। এক দিন কেউ একজন ঘরে ঢুকে দেখেন মশার চাদরে যেন ঢাকা পড়েছেন সতীনাথ! মশা কামড়ে এখানে ওখানে রক্তও। তা’ও আপন মনে গলা সেধে চলেছেন তিনি।
শুধু যুবকবেলা বলে নয়, গানের জন্য এই একই রকম ধ্যান ছিল তাঁর প্রান্তদিনেও। নিয়ম করে সাত-আট ঘণ্টা রেওয়াজ না করলে স্বস্তি হত না।
উৎপলা সেনের ‘ঝিকমিক জোনাকির দীপ জ্বলে শিয়রে’র রেকর্ডিং হবে। তার ঠিক আগেই যন্ত্রশিল্পী ভি বালসারার হাত জখম হল। রেকর্ডিং বন্ধ হয়ে যায় প্রায়। সারা রাত ধরে চেষ্টা করে সতীনাথ হারমোনিয়ামেই পিয়ানোর এফেক্ট এনে ফেললেন। দুনিয়া রসাতলে গেলেও গানের কাজে হাত দিলে তিনি অর্জুন, পাখির চোখটি ছাড়া কিচ্ছু দেখতেন না।
এই একই মানুষ যখন ঘরকন্নার কাজ করতেন, তখন কিন্তু একসঙ্গে অনেক কিছু করতেন। ছেলের বিছানা তুলতে তুলতে চা বসাতেন। তার সঙ্গেই তরিবত করে রান্নার জোগাড় চলতেন। তখনই হয়তো ছাত্রছাত্রী এসে পড়েছে, তাঁদের তবলাটা বেঁধে দিতেন, কারও লয়কারিতে ভুল হলে ঠিক করে দিতেন।
রান্নায় পাকা বামুন ঠাকুরকে টেক্কা দিতেন। ছেলে ভালবাসে বলে প্রতি দিন হাজার কাজ থাক, নিয়ম করে চিকেন রোস্ট বানাতেন। ভাত নামাতেন একদম ফুরফুরে। টমেটো, ধনে পাতা দেওয়া আড় মাছের ঝাল থেকে থিন অ্যারারুট বিস্কুট দিয়ে ডিমের স্ক্র্যাম্বল, বাদ যেত না কিছুই।
রান্নার পাশাপাশি জমিয়ে বাজারও করতেন সতীনাথ। নিউমার্কেটে তাঁর বাঁধা মুরগিওয়ালা ছিলেন আলাউদ্দিন। উর্দুভাষী। আর নিজে উর্দুটা যেহেতু বলতে, লিখতে পারতেন, সতীনাথ তাঁর সঙ্গে উর্দুতেই কথা বলতেন।
সে-উর্দু এতটাই চোস্ত ছিল, আলাউদ্দিন ধরেই নিয়েছিলেন তাঁর খদ্দের বাবুটি মুসলিম। কিন্তু তাঁর খটকা লাগত অন্য জায়গায়। এক দিন আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললেন, ‘‘আপ মুসলমান হোকে ধোতি কিঁউ প্যাহেনতে হ্যায়?’’ শেষে গলার উপবীত দেখিয়ে তাঁকে বোঝানো গিয়েছিল, ‘‘না বাবা, আমি মুসলিম নই, হিন্দু ব্রাহ্মণ।’’
উর্দুটা ভাল জানতেন বলে গজলটাও ভাল গাইতেন। ’৪৭-এর আগে লাহৌর-করাচিতে গজল গেয়ে বেড়াতেন গোলাম মুস্তাফা নামে। অনেকটা সেই কাশেম মল্লিক যেমন ভক্তিগীতি গাইতে গিয়ে কে মল্লিক হয়েছিলেন, তেমন।
স্ত্রী উৎপলাকে নিয়ে সতীনাথ গভীর রাত অবধি জেগে মেহেদি হাসান শুনতেন, লাহোর রেডিয়োতে। সেই মেহেদি হাসান যখন প্রথম কলকাতায় গভর্নর হাউসে এলেন, তখন হিন্দি বা ইংরেজিটা তেমন বুঝতেন না। ভূপেন হাজরিকা সতীনাথকে পাকড়াও করে নিয়ে যান তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য।
সতীনাথের গজলের ভক্ত ছিলেন খোদ বেগম আখতার। আখতারি বাঈ উৎপলাকেও চিনতেন লখনউ রেডিয়োয় তাঁর ‘গীত’ গাওয়ার সময় থেকে। কলকাতায় এলে উঠতেন ‘ম্যাজেস্টিক’ হোটেলে। তখন একবার না একবার গজল শোনাতে সতীনাথের ডাক পড়ত সেখানে। অথচ নিয়মের গেরোয় পড়ে গজল রেকর্ড করা তাঁর আর হয়নি। বাংলা আধুনিকে সুর করার সময় একবার গজল অঙ্গটাকে জুড়ে দিয়ে আশ মিটিয়েছেন মাত্র – ‘বোঝো না কেন আমি যে কত একা’ গানে!
আখতারি বাঈয়ের সঙ্গে সখ্যটা কতটা নিবিড় হয়ে উঠেছিল, কাশ্মীরের ঘটনাটা বললে বোঝা যেতে পারে।
কাশ্মীর রেডিয়োয় গান গাইতে গেছেন উৎপলা। ভারতীয় জওয়ানদেরও গান শোনাতে হবে। সঙ্গে সতীনাথ। তাঁরা উঠেছিলেন ‘হোয়াইট হাউস’ হাউস বোটে।
সন্ধে থেকে ধুম জ্বর এল উৎপলার। তার সঙ্গে গলা বুজে গেল। পাশের বোটেই ছিলেন বেগম আখতার। সতীনাথ গিয়ে বলতেই তখনই চলে এলেন তিনি। তালমিছরি, লবঙ্গ, গোলমরিচ জলে ফেলে ফুটিয়ে, বারে বারে সেটা খাওয়াতে লাগলেন। শিয়রে বসে চলল জলপটি দেওয়া। প্রহরে প্রহরে নমাজ পড়লেন। সারা রাত জেগে। ভোরের দিকে জ্বর নামল উৎপলার, গলাও ফুটল। তখন তাঁর ছুটি।
ধ্রুপদী সঙ্গীতশিল্পীদের সঙ্গে শ্রদ্ধা, মায়া, ভালবাসার সম্পর্কের এক অদ্ভুত রসায়নে বার বার জড়িয়ে পড়েছেন সতীনাথ-উৎপলা। তার শুরুটা কি উস্তাদ বড়ে গোলাম আলিকে দিয়ে?
সময়টা পঞ্চাশের শুরু। কলকাতার এক বিখ্যাত জলসার আসর। উস্তাদজির গানের পর মঞ্চে উঠবেন লতা মঙ্গেশকর। এই দুই শিল্পীর মাঝখানের সময়টুকু ভরাট করতে গান গাইতে বসবেন এমন কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সতীনাথ এগিয়ে এলেন। সদ্য যুবক। আহীর-ভৈঁরো রাগে ধরলেন ‘না যেও না গো চলে যেয়ো না’। গান শেষ হতে শ্রোতারা উচ্ছ্বসিত। – ‘এনকোর এনকোর’। তন্ময় সতীনাথ শুনলেন ‘নো মোর নো মোর’। উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন। ভুল ভাঙাতে মঞ্চে উঠে এলেন লতাজি। গ্রিন রুমে জড়িয়ে ধরলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি। বলেন, ‘‘তুমি সতীনাথ নও, শিউনাথ (শিব)।’’
এর পর থেকে ‘শিউনাথ’ ছিলেন উস্তাদজির প্রিয় পাত্র। এক বার ওঁকে বাড়ির সরস্বতী পুজোয় নেমন্তন্ন করার খুব শখ হল। দ্বিধা যে ছিল না, তা নয়। তবু গেলেন। হাতের হিরের আংটি খুলে উস্তাদজিকে পরিয়ে দিয়ে নেমন্তন্ন করলেন। এসেও ছিলেন উনি।
পঞ্চাশের দশক। গভর্নর হাউসে ‘স্টার্স অব ইন্ডিয়া’ বলে শো হবে তিন দিন ধরে। উদ্দেশ্য কার্শিয়াং-এ টিবি স্যানিটোরিয়াম করার জন্য টাকা তোলা। ভারতের প্রায় সব বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হাজির হবেন। দর্শকদের মধ্যে দিলীপকুমার, রাজকপূর, নার্গিসরা কৌটো হাতে ঘুরবেন।
এমন এক অনুষ্ঠানে বাবা আলাউদ্দিন খানকে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন উদ্যোক্তা উৎপলা। আলাউদ্দিনের বয়স তখন প্রায় নব্বই। তা’ও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
সময় পেলেই প্রতি রবিবার সিনেমা দেখতে যেতেন উৎপলা-সতীনাথ। তো, এক বার সিটে বসার পর থেকেই উৎপলা খেয়াল করলেন, পিছন থেকে মাঝে মাঝেই কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছেন তাঁকে। সতীনাথকে উৎপলা বললেন, ‘‘শোনো, এ বার সুড়সুড়ি দিলে কিন্তু আমি তোমার হাতে চিমটি কাটব। তুমি লোকটাকে ধরবে।’’ একটু পরেই হাতে চিমটি খেয়ে সতীনাথ পিছনে ফিরে ‘লোক’টিকে আবিষ্কার করে হো হো করে হেসে উঠলেন। অবাক হয়ে উৎপলা তাকিয়ে দেখেন – উস্তাদ বিলায়েত খান!
এক বছরের ভাড়া বাকি ছিল বলে কলকাতার বাড়ি থেকে এক প্রবাদপ্রতিম ধ্রুপদ শিল্পীকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। টান মেরে ফেলে দেওয়া হয় তাঁর জিনিসপত্র। শিল্পীর ছেলে সেই খবর নিয়ে এলেন উৎপলার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া টাকা দিয়ে, উপরি এক বছরের আগাম ধরিয়ে তাঁকে আরও অপমানের হাত থেকে বাঁচান তাঁরা।
আসলে ধ্রুপদ-শিল্পী বলে নয়, গুণী মানুষের কদর করতে কখনও বোধ হয় দু’বার ভাবেননি তাঁরা – সতীনাথ ও উৎপলা।
নইলে রেডিয়োয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গিটার শোনামাত্র কী দায় পড়েছিল উৎপলার খুঁজেপেতে তাঁকে এইচএমভি-তে নিয়ে যাওয়ার। সেই তো সুনীলের রেকর্ডিং-এর শুরু।
চল্লিশের দশক। হুগলি মহসিন কলেজে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে। গোলকিপিং করছে যে ছেলেটি, সে মাঝে মাঝেই গুন গুন করে গান গায়। উপস্থিত দর্শক সতীনাথের কানে গেল। খেলা শেষে ছেলেটিকে ডেকে নিয়ে তিনি কলকাতায় গিয়ে ভাল গান শেখার পরামর্শ দিলেন। সে দিনের সেই গোলকিপার, পরবর্তী কালের শ্যামল মিত্র।
শোনা যায়, বাংলা-হিন্দি গানের এক কিংবদন্তি এক সময় বিপাকে পড়ে অর্থাভাবে অদ্ভুত উপায়ে রোজগার করতেন। ধনী মানুষ, যাঁদের রাতে ঘুম আসে না, তাঁদের তিনি বাড়ি গিয়ে গিয়ে গান শোনাতেন। বিনিময়ে কিছু অর্থ পেতেন। উৎপলা সেন জানতে পেরে তাঁরও পাশে দাঁড়ান।
নিউ থিয়েটার্সে এক সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গাইবার সুযোগ পেতেন না। অভিযোগ ছিল, তাঁর গলা পঙ্কজ মল্লিকের মতো। স্বভাবতই তার জেরে বেকায়দায় পড়েন তিনি। উৎপলার জন্যই আবার তাঁর ওখানে গাওয়ার সুযোগ ঘটে।
গান তো ছিলই, গানের বাইরেও ওঁদের প্রতি অন্যদের কোথাও একটা আলাদা সম্ভ্রমবোধ কাজ করত।
সতীনাথের সুরে ‘এ বার তা হলে আমি যাই’ গানটি তুলতে বসে মহম্মদ রফি সুরকারকে বলেছিলেন, ‘‘আপনার আসল জায়গা হল বম্বে, এখানেই চলে আসুন।’’
ইন্ডোর স্টেডিয়ামে গাইতে এসে কিশোরকুমার উৎপলা সেনের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করে বলেন, ‘‘দিদি, আপনার ‘এক হাতে মোর পূজার থালা’ গানটা আমার পার্সোনাল লাইব্রেরির কালেকশনে আছে।’’
ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে উৎপলা সেনকে ফোন করে উত্তমকুমার বলতেন, ‘‘প্লিজ একবার তোমার ‘আমি তোমায় ছাড়া আর কিছু হায় ভাবতে পারি না’ গানটা একটু শোনাবে?’’
এ ধরনের উচ্চারণ কি নিছকই গানের জন্য?
গীতা দত্তর কথা বলা যাক। তখন উৎপলা থাকেন ২ নম্বর কেয়াতলা রোডের বাড়িতে। প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সপ্তমীতে জলসা আয়োজন করতেন তিনি। কে না আসতেন সেখানে! ক্লাবের সদস্যরা সে বার বললেন, ‘‘গীতা দত্তকে বলে দেখুন না, যদি আসেন।’’
গীতা দত্ত তখন সুপারহিট। তাঁকে দেবার মতো টাকা কোথায়! উৎপলা ফোনে ধরলেন। বললেন, ‘‘আমরা তো টাকাপয়সা তোমায় দিতে পারব না, প্লেন ভাড়াটা দিতে পারি।’’ ও পাশ থেকে উত্তর এল, ‘‘তুমি বলছ যেতে, তোমার কাছ থেকে প্লেন ফেয়ার নেব? কী বলছ!’’ ষষ্ঠীর দিন কলকাতায় চলে এসেছিলেন গীতা দত্ত।
গুরু দত্ত যখন মারা যান, খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন গীতা দত্ত। তখন বারবার দেখা করতে চাইতেন সতীনাথের সঙ্গে। গীতা দত্তর ভাই কানু রায় তাঁকে নিয়ে যান নার্সিংহোমে। সতীনাথ তখন বেনিয়ান কাটের শেরওয়ানি পরতেন। ঘরে ঢুকতে অসুস্থ শরীরে চমকে উঠে বসেন গীতা দত্ত। সতীনাথকে নাকি হুবহু গুরু দত্তর মতো লেগেছিল ওঁর!
লতা মঙ্গেশকর, সতীনাথের সুরে তাঁর প্রথম বাংলা আধুনিক ‘কত নিশি গেছে নিদ হারা’ আর ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’ এক বার শুনেই তাঁর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সম্পর্কে গাঢ়ত্বের শুরু বোধ হয় তখনই। সে-নৈকট্য কোথায় পৌঁছয়, বোঝাতে একটা ঘটনা বলাই যথেষ্ট।
ভূপেন হাজরিকার সুরে ‘জীবনতৃষ্ণা’ ছবির ‘আবার নতুন সকাল হবে’ গানের রেকর্ডিং। উৎপলা গেলেন বম্বে। লতা মঙ্গেশকর ওঁকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন জুহু বিচে। গল্প, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া সব হল।
হঠাৎ রেকর্ডিং-এর আগের রাতে খুব জ্বর উৎপলার। গলা বসে গিয়েছিল। সাউন্ড রেকর্ডিস্ট মিনু কাতরাক বললেন, ‘‘উৎপলাদি, আপনি ফিসফিস করে গান। আমি ঠিক টেক করে নেব।’’ তখন ওখানে যা মেশিনপত্তর, কথাটা নিশ্চয়ই ‘স্তোক’ ছিল না। বিশেষ করে ওঁর মতো নামী রেকর্ডিস্টের কাছে। লতা মঙ্গেশকর তা সত্ত্বেও ঠায় বসেছিলেন স্টুডিয়োয়। উৎপলার শরীর খারাপ না!
সে বার অসুস্থ উৎপলাকে মুম্বই থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনে এসকর্ট করে এসেছিলেন মালা সিনহা।
মালার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল বহুকালের। সতীনাথ যখন ১এ, একডালিয়া প্লেসে থাকতেন, তখন মালা সিনহার বাবা অ্যালবার্ট সিনহা মেয়েকে নিয়ে টানা দু’তিন বছর গান শেখাতে সেখানে আনতেন।
তবে উৎপলা-সতীনাথের ভাগ্যে এক এক সময় যা জুটেছে, তেমনটা বোধ হয় ওঁদের প্রাপ্য ছিল না।
’৪২ সালে সতীনাথ প্রথম রেকর্ড করলেন নজরুলগীতির। – ‘ভুল করে যদি ভাল বেসে থাকি’। তুমুল সাড়া পড়ে গেল। কিন্তু পরের গানের রেকর্ড ‘আমি চলে গেলে পাষাণের বুকে লিখো না আমার নাম’ আর ‘এ জীবনে যেন আজ কিছু ভাল লাগে না’ যখন বেরোল, তত দিনে পেরিয়ে গেছে দশটি বছর! বলা হত, ‘ওঁর তো পাতলা গলা। তালাত মামুদকে নকল করে।’
‘সপ্তপদী’-তে গান গাওয়ার অনুরোধ করলেন সুচিত্রা সেন। – ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’। এক বিখ্যাত গীতিকার ভুল বোঝালেন উৎপলাকে, ‘‘আরে, এ গান তুমি গাইবে কেন? এ তো শুধু লা-লা-লা করে সুর।’’ গাওয়া হল না।
একটি রেকর্ড কোম্পানিতে কোনও এক জন শিল্পীকে রেকর্ড করতে দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিবাদে সে কোম্পানিই ছেড়ে দিলেন উৎপলা-সতীনাথ দু’জনেই। পরে দেখলেন, যাঁর জন্য কোম্পানি ছাড়লেন, তিনি রয়ে গেলেন বহাল তবিয়তে।
রেডিয়ো স্টেশনে গাইবার জন্য সতীনাথের মতো শিল্পীকে বারো বার অডিশন দিতে হয়। এগারো বার কৃতকার্য না হয়ে সোজা চলে যান স্টেশন ডিরেক্টর অশোক সেনের কাছে। এর পর স্টেশন ডিরেক্টর নিজে কারণ-অনুসন্ধান করতে নামেন। তখন ছাড়পত্র মেলে সতীনাথের।
ঠাকুরদা নাতির গান বন্ধ করতে শর্ত দিয়েছিলেন, প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হতে হবে। তাই-ই হতেন সতীনাথ। এক বার শুধু পারেননি। সে বছর আর গান শেখা হয়নি।
এমনিতে বাড়িতে গানবাজনা বলতে, ঠাকুরদা রামচন্দ্র বেহালা বাজাতেন। বাবা তারকচন্দ্র গান গাইতেন। তবে কেউই প্রফেশনাল ছিলেন না। এঁরা দু’জনেই চাইতেন, মেধাবী ছাত্র সতীনাথ মন দিয়ে পড়াশুনোটাই করুক।
এ দিকে ছোট্ট সতীনাথের গানের এমনই নেশা ছিল যে উপনয়নে পাওয়া টাকায় লখনউ থেকে তানপুরা কিনে এনেছিলেন ট্রেনে করে। তা’ও কী, সারা রাত বাজনা আগলে টান টান জেগে বসে। যদি ভেঙে যায়!
বাপ-ঠাকুরদার কাজের সূত্রে লখনউতে জন্ম হলেও ছেলেবেলাতেই সতীনাথ চলে আসেন হুগলির চুঁচুড়ায়। বিএ পাশ করেন ডিস্টিংশনে। এর পর বাড়ির চাপ এমএ পড়ার। পড়তে হবে কলকাতায়। তত দিনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ধ্রুপদ-ধামার-টপ্পা তাঁকে বুঁদ করে ফেলেছে।
নামেই কলকাতা এলেন পড়তে। পড়া শিকেয় তুলে ছুটতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরু চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। এ দিকে বাড়ির লোক জানে, ছেলে এমএ পড়ছে। তালিম নিতে নিতে এক-এক দিন এত রাত হয়ে যেত, হাওড়ার স্টেশনেই থাকতে হত। শেষে ধরা পড়ে গেলেন বাড়িতে। চাকরি নিতে হল এজি বেঙ্গলে।
গুরুজির সাধের গুচ্ছ বেড়ালের জন্য মাগুর মাছ রেঁধে দিতেন। চুল আঁচড়ে তাদের টিপ পরাতেন। তত ক্ষণে হয়তো গুরুজির দিবানিদ্রা হয়ে যেত। ছাত্রী উৎপলা অপেক্ষা করতেন। জানত মুড না এলে গুরু সুধীরলাল চক্রবর্তী গান শেখাতে পারেন না।
ঢাকার মেয়ে উৎপলার বাবা রায়বাহাদুর প্রফুল্লকুমার ঘোষ গানবাজনা জানতেন না। তবে মা হিরণবালা হারমোনিয়াম তো বাজাতেনই, বাঁশি, এসরাজ, সেতার খঞ্জনিও বাজাতে পারতেন। মায়ের কাছেই গান শেখার শুরু উৎপলার। তারপর তো অনেক শিক্ষাগুরু। এমনকী আনন্দময়ী মায়ের কাছেও গান শিখেছেন।
অল্প বয়েস থেকে ঢাকা রেডিয়োয় নানা ধরনের গান গাইতেন। এমনকী কবিতা পাঠ, নাটকও। রায়বাহাদুর বাবার এ সব সহ্য হত না। কিন্তু যে দিন দেখেন কলকাতার এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকে ছবি সমেত মেয়ের গানের প্রশংসা বেরিয়েছে, সে দিন বোধহয় তাঁর মন ঘোরে।
’৯১ সাল। উৎপলার ইন্টেস্টিনাল ভলভুলাস ধরা পড়ল। জটিল রোগ। অপারেশন হল। ওই সময় থেকেই খুব দুশ্চিন্তা করতেন সতীনাথ। কী যে হল তাঁর প্রাণভোমরা রোশনির!
সম্পর্ক তো এক-আধ বছরের নয়, উৎপলা যখন বেণু সেনের ঘরণি, তখন থেকে। তিন জনের বন্ধুতা, হৃদ্যতা কখনও যে টাল খায়নি একটি বারের জন্যও।
১৯৬৫ সালের ১৩ই নভেম্বর বেণু সেনের অকাল মৃত্যুর পর তাঁর মায়েরই উদ্যোগে সতীনাথ বিয়ে করেন উৎপলাকে। তার পর জীবন চলেছে নানা বাঁক পেরিয়ে। হঠাৎ একটা অঘোষিত টাইফুন কোত্থেকে ধেয়ে এসে সব যেন উপড়ে ফেলে দিল।
হার্টের সমস্যা দেখা দিল সতীনাথের। তবু কাউকে বুঝতে দিতেন না শরীরের কষ্ট। নিজে নিজেই ওষুধ খেতেন। বুকে অসহ্য ব্যথা নিয়ে ভর্তি হলেন পিজি-তে। আর বাড়ি ফেরা হল না। ১৯৯২-এর ১৩ই ডিসেম্বর ওঁর চলে যাওয়ার পর খাটের জাজিম তুলে বাড়ির লোকজন পেয়েছিলেন গুচ্ছ গুচ্ছ সরবিট্রেটের খালি কৌটো!
২০০০ সালে কোলন ক্যানসার হল উৎপলার। আবার অপারেশন। বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু দিনে দিনে বন্দি হয়ে পড়লেন বিছানায়। তবু শুয়ে শুয়েই ঘরকন্নার তদারকি করতেন। আর শেষের বছরটা জড়িয়ে বাঁচতেন সদ্যোজাত নাতিকে নিয়ে। নামও রাখলেন নিজেই – ‘সূর্য’। ওই অতটুকু শিশুর কানে সুর ঢেলে দিতেন যখনতখন! আর শিশুর মা পারমিতাকে বলতেন, ‘‘বল তো, ও ক’বে হাঁটতে পারবে? আমি দেখে যেতে পারব?’’
২০০৫-এ হাসপাতালে কোমার মধ্যেই চলে গেলেন উৎপলা সেন।
আর কী অদ্ভুত, বেণু সেন আর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ার দিনটির মতো সে দিনও ছিল ১৩ তারিখ!
পরপারেও কী আশ্চর্য বাঁধনে জড়িয়ে রইলেন তাঁরা তিন জন!
(তথ্যসূত্র:
১- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২১শে মার্চ ২০১৫ সাল।
২- বর্তমান পত্রিকা, ২৩শে মার্চ ২০১৫ সাল।
৩- উইকিপিডিয়া।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত