একদিন মহানায়ক সোজা এসে হাজির হলেন নীহাররঞ্জন গুপ্তের বাড়িতে। ফিয়েট গাড়ি থেকে নামলেন। ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি। হাতে কিং সাইজ সিগারেট। বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে শেষ সুখটানটা দিয়ে পায়ে সিগারেট পিষে দিলেন রাস্তায়। বাড়িতে ঢুকে নীহাররঞ্জনের ঘরে গিয়ে এ-কথা সে-কথার পর সটান ওঁর আর্জি, ‘‘কিরীটী করতে চাই, সিনেমায়।’’ কিরীটীতে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন উত্তমকুমার! কিন্তু নীহাররঞ্জনকে সে দিন টলাতে পারেননি স্বয়ং মহানায়কও! অতিথিকে খাতির-যত্নের ত্রুটি করেন নি নীহাররঞ্জন। কিন্তু যথাসময়ে বিনীত ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘‘না। আপনি ‘কিরীটী রায়’ হলে কিছুতেই মানাবে না!’’
নীহাররঞ্জন যে কিরীটীকে সেলুলয়েডে আনতে চাননি, তা নয়। কিন্তু নীহাররঞ্জন ভাবতেন, কেউ যদি এই চরিত্র করতে পারেন, তবে তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়! অজিতেশবাবু অবশ্য জানতে পারেননি তাঁর এই ইচ্ছের কথা!
নীহাররঞ্জনের বর্ণনায় কিরীটী রায় যেমন, নীহাররঞ্জন নিজেও অনেকটা ছিলেন তেমনই। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, ব্যাকব্রাশ করা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর চুল আঁচড়ানোটা ছিল দেখার মতো। কিরীটীর চোখে পুরু লেন্সের সেলুলয়েড চশমা। নীহাররঞ্জনেরও তাই।
উল্কাবাড়ির ‘মেজানাইন ফ্লোরে’ এক চিলতে একটা ঘর ছিল। বাড়িতে থাকলে, দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে নীহাররঞ্জন ঘুমোতে যেতেন না। ওটাই ছিল তাঁর লেখার সময়। খাওয়াদাওয়া সেরে মোজাইকের মেঝেতে শোনা যেত তাঁর পায়ের খসখস শব্দ। সুইং ডোর ঠেলে তিনি ঢুকতেন সেই ঘরে। গায়ে গোল গলা গেঞ্জি, নয় বোতাম খোলা শার্ট। ও ঘরের তিন দিকের দেওয়ালে কাঠের বুক সেল্ফ। ঠাসা বইপত্র। এক কোণে তাঁর স্ত্রীর সেতারটি রাখা। খড়খড়িওয়ালা জানালাও ছিল। তার ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ত একটি কলেজের গার্লস হস্টেল। নীহাররঞ্জনের ‘বেলাভূমি’ কাহিনিতে যে হস্টেলের কথা আছে, এই হস্টেল সেটিই। চেয়ারটা টেনে তিনি বসতেন লেখার টেবিলে। ততক্ষণে ঘরের মেঝেয় তাঁর চার কন্যা হয়তো শুয়ে পড়েছেন। তিনি লিখতে বসতেন। এমনিতে যে মানুষ গল্পগাছা করে কাটাতেন, লেখার সময় আশেপাশে কোনও কথা তাঁর সইত না। চাপা স্বরে দু’একটা কথা বললেও বিরক্ত হতেন। বকা দিতেন। তার পরে অবশ্য ফের লেখা।
কিরীটীর সঙ্গে তাঁর যেমন মিল, তেমন আবার ছিল অমিলও। কিরীটী গৌরবর্ণ। তাঁর গায়ের রং খানিক তামাটে। কিরীটীর উচ্চতা প্রায় সাড়ে ছ’ফুট। তিনি কমবেশি পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।
কিরীটী। কিরীটী রায়। নামটা বলা মাত্রই বইয়ের পাতা ফুঁড়ে উঠে আসে ‘ইরেজিস্টেবল’ এক পুরুষ। নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখনি-সন্তান। সত্যসন্ধানী।
রাত্রি তার ঘন কালো পক্ষ বিস্তার করে দিয়েছে বিরাট এ কলকাতা মহানগরীর বুকে। কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি। জনহীন রাস্তা যেন ঘুমন্ত অজগরের মতো গা এলিয়ে পড়ে আছে। সাড়া নেই, শব্দ নেই। … কিরীটী একা একা পথ অতিক্রম করে চলেছে। পকেটের মধ্যে কালো পাথরের ড্রাগনটি। আশ্চর্য, কিরীটীর যেন মনে হয়, নিঃশব্দে কে বুঝি আসছে কিরীটির পিছু পিছু! যে আসছে তার পায়ের শব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায়, সে আসছে।
সাদাকালো পৃষ্ঠায় ছমছমে আলোআঁধারির এমন কত কত নিঝুম রাতের রহস্য। শিরদাঁড়ায় কাঁপন ধরিয়ে বুঁদ করে ফেলত। দিনের দিনের দিন। দুপুরের পর দুপুর। রাতের পর রাত।
চেহারার বর্ণনা — ‘‘প্রায় সাড়ে ছ-ফুট লম্বা। গৌরবর্ণ। মজবুত হাড়ের ফ্রেমে বলিষ্ঠ এক পৌরুষ। মাথা ভর্তি ব্যাকব্রাশ করা কোঁকড়ানো চুল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েড চশমা। নিখুঁতভাবে কামানো দাড়িগোঁফ। ঝকঝকে মুখ। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। আমুদে, সদানন্দ। এবং প্রখর রসবোধ। অসাধারণ বাকচাতুর্য। কিন্তু মিতবাক।’’
এ-ই কিরীটী রায়। যে নামের সঙ্গে ওই চরিত্র এক অনিবার্য আকর্ষণে দুর্দান্ত শরীরী আর জীবন্ত। অসম্ভব উজ্জ্বল তার পুরুষালি উপস্থিতি। প্রত্যেকটা জায়গায়। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দার এমন হাজিরা বোধহয় সেই প্রথম বার।
বইয়ের কুচকুচে কালো প্রচ্ছদ। তাতে অদ্ভুত এক হলদেটে আঁচড়ে পুরুষমুখের সাইড ফেসের সিল্যুট। মাথায় সাহেবি টুপি একটু বাঁকানো। টুপির হুডে কপালের অর্ধেকটা ঢাকা। ঠোঁটে জ্বলন্ত চুরুট। তার থেকে ধোঁয়া উঠছে।
নিশুতি রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় কালো অ্যাম্বাসাডর। দরজা খুলে ততোধিক নিঃশব্দে নেমে আসে আগাপাস্তলা সাহেবি পোশাকের এই পুরুষ। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মার্জারি ক্ষিপ্রতা। দৃঢ় পা ফেলে প্রবল আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে যায় নিশানার দিকে। অটল লক্ষ্যভেদ।
সত্তর-আশির দশকের সদ্য ফোটা কিশোরী থেকে প্রায় সব যুবতীর ‘হার্টথ্রব’ এই কিরীটী রায়। আর কিশোর-যুবকদের কাছে তিনি যেন লৌহমানব!
কিরীটী রায় বিবাহিত। তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা। টালিগঞ্জের বাড়ির সংসারে আছে ড্রাইভার হীরা সিং, পরিচালক জংলী। প্রায় সব সময় সঙ্গে থাকে সহকারী সুব্রত…
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত