প্রায় পাঁচবার পরপর ফোন, দু’ডজন হোয়াটসঅ্যাপ করে দিয়েছি বলে বেশ খিঁচিয়ে ছিল ৪৪ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ব্যবসায়ীর মেজাজ। লিখলেন এখন কথা বলা সম্ভব না। ভারতীয় সময় ভোর ৪টের সময় হোতে পারে। আমার মাথায় হাত। আমি ইংরেজি কপি শুরু করে ফেলেছি “রাহুল নাম তো সুনা হোগা” অবধি লিখে। জানালাম ও সে কথা৷ বলিউডের বিখ্যাত লাইন শুনে বর্তমানে মানবতার পোস্টারবয়, আমেরিকানদের কাছে “হিরো” যে সব বিরক্তি ভুলে হেসে গড়িয়ে পড়বে বোঝা যায় নি। নিজেই ফোন করলেন। “পাঁচ মিনিটের এক মিনিট বেশী নয়”।
ইন্টারভিউটা বোধহয় এক মিনিটেই শেষ হয়ে গেছিল। তারপর চললো গল্প। সেই রাতের গল্প, আগামীর কথা ভেবে সামান্য কিছু করার গল্প, কারফিউ এর সেই রাতে ওয়াশিংটনের একটা ছোট ফ্ল্যাটে ৭৫জনের একসাথে দশ ঘন্টা বা সারা রাত কাটানোর গল্প। ভুল বললাম। ৭৬জনে। রাহুল নিজেও তো ছিলেন। বাড়িটা রাহুলেরই।
আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের গুলি করে মারার হুমকি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কাঁদানে গ্যাস মারা হচ্ছিল, লাঠি চলছিল, গুলি মারার টার্গেট খোঁজা হচ্ছিল। দুবে বাড়ির জানালা দিয়ে সবটা দেখে তারপর কী মনে হয় দুম করে দরজাটা খুলে বলতে থাকে, ” ভিতরে ঢোকো, ভিতরে ঢোকো”। এরপর ওর চোখের সামনে নদীর স্রোতের মতো মানুষ ঢুকতে থাকে। পরে গুনে দেখা হয় ৭৫জন। কৃষাঙ্গ, সাদা চামড়া, খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম, এলজিবিটি – সব ধরনের মানুষ, একে অপরের থেকে আলাদা, অচেনা কিন্তু সবাই ট্রাম্পকে ঘৃণা করে, ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদ করে।
আমাকে রাহুল বললো, “আমি এ দৃশ্য কখনো দেখিনি। চোর ডাকাতের মতো মারা হচ্ছে। ওরা কেউ দাঙ্গাবাজ নয়। দাঙ্গাবাজ তো অন্য কেউ যে এভাবে প্রতিবাদীদের কন্ঠরোধ করতে চাইছে, ভীত- সন্ত্রস্ত করে তুলছে, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াচ্ছে দেশ জুড়ে। এটা তো আমেরিকা নয়। আমেরিকা সেদিন আমার বাড়িতে এসে উঠেছিল। নানা ভাষা, নানা ধরনের মানুষের সমাগম। তারপর এই মহানভূমিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। এটাই তো গ্রেট আমেরিকান ড্রিম। আমেরিকানদের থেকে ম্যাকডোনাল্ডস আর কোক ছিনিয়ে নিতে পারো, বিক্ষোভ হবে। কিন্তু গণতন্ত্র ছিনিয়ে নিতে চাইলে জ্বলে যাবে সবকিছু”
পাঁচ মিনিট অনেকক্ষণ আগে পেরিয়ে গেছে। অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছি এই প্রথম প্রজন্ম আমেরিকানের কথা। সাধারণ মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, সাদা চামড়া নয়, বহু যুগ ধরে আমেরিকাবাসী নয় যার পরিবার কিন্তু প্রাণের চেয়ে বেশী ভালোবাসে তার দেশকে। তার দেশ মানে ওর কাছে দেশবাসী। ওই ৭৫জন। সে রাতে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ও যাদের ও আশ্রয় দিয়েছিল। চোখে গোলমরিচগুঁড়া স্প্রে করে দেওয়া হয়েছিল, জানালা দিয়ে ও স্প্রে করা হয়। ও ঠান্ডা মাথায় ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে চোখ পরিস্কার করিয়ে দেয়, খাবার বানিয়ে দেয়, মুখ হাত ধুয়ে মেঝেতে শুয়ে নিতে বলে।
আমি ইচ্ছে করে উত্তর পেতে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভয় লাগেনি? এতোজন “নিগ্রো, সমকামী, সংখ্যালঘু, শ্রমিক, বেকার, ভবঘুরে ” বাড়িতে হুরহুর করে ঢুকে পড়লো। রাহুল বললো, “জানি আমাকে তাতাচ্ছো। হেডলাইন চাই তোমার। কিন্তু না আমার ভয় লাগেনি৷ কারণ আমি ও ওই আমেরিকাটাই৷ আমাকে আমেরিকা দুহাত ভরে গ্রহণ করেছিল। সাদা চামড়ার দাম্ভিকতা মানে আমেরিকা নয়। আমার সন্তানের বাসযোগ্য পৃথিবীতে এই সাম্প্রদায়িকতা, এই দাম্ভিকতার জায়গা নেই। আমি খুব স্বার্থপর ব্যবসায়ী। নিজের জন্য, আমার সন্তানের জন্য এটা করেছি।”
কিন্তু গোটা পৃথিবীর কাছে, ইন্টারনেটে, ফুটপাত তো তুমি এখন হিরো। কেমন লাগছে হিরো হিসেবে ঘুম থেকে উঠে?
চুলটা এলোমেলো ছিল। ঠিক করে বললো, “See Ghosh I Don’t know the measuring scale to be a Hero, but this is a very normal thing I did. You would have done the same”
ধুপ করে আয়নাটা সামনে ধরিয়ে দিলো। সত্যি কী আমি পারতাম? মুসলমানের, দলিতের, কৃষকের, শ্রমিকের, ছাত্রের, বেকারের এক মিছলকে আমার বাড়িতে আশ্রয় দিতে? ভয় পেতাম না? পেতাম না ভয়?
হয়তো এরা এইরকমই হয়। একটা নির্দিষ্ট কোন হরমোন কাজ করে। রাহুল দুবেরাই তো ‘৪৬ এ হিন্দু মা ও মেয়েটাকে নিজের ঘরের খাটের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। রাহুল দুবেরাই তো ৮৪’তে পাঞ্জাবি লোকটার চুল দাড়ি কামিয়ে নিজের পোশাক দিয়ে দাঙ্গাবাজদের বলেছিল “ও আমার ভাই”। রাহুল রাই তো ‘৯২ এ তলোয়ারের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোন মোহাম্মদ কোন আয়েশাকে বলেছিল যতোদিন না বাইরের পরিস্থিতি শান্ত হচ্ছে, তোমরা আমাদের বাড়িতে থাকবে।
রাহুল দুবে হওয়ার জন্য বুকের পাটা দরকার হয়। কাঁদানে গ্যাস, জলকামান, স্নাইপার, রক্তচোখ তো রাষ্ট্রের ও থাকে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত