আজ নবান্নে ভিডিও কনফারেন্সে ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলত, পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরাতে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রকের ‘স্বেচ্ছাচারের’ বিরুদ্ধে এদিন ক্ষোভের জ্বালামুখ খুলে দিলেন মমতা। তাঁর সরাসরি অভিযোগ, কেন্দ্র রাজনীতি করছে। রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে ট্রেন পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাতে বিপদ বাড়ছে রাজ্যের।
কোভিড ও উম্পুনের বিপর্যয় মোকাবিলা নিয়ে সব জেলার জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্সে এদিন বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিযায়ী শ্রমিকদের নিজ রাজ্যে পাঠানোর ব্যাপারে রেলের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে তো রেলের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। তা করেনি। ওদের কি কোনও দায়বদ্ধতা নেই? রেল মর্জিমতো কাজ করছে। গায়ের জোর দেখাচ্ছে। রাজ্যের যে তাতে বিপদ হচ্ছে তা কী বুঝতে পারছে না! এতো বড় দুর্যোগ সামলাব, মানুষের দুর্ভোগ সামলাব নাকি ওদের রাজনীতি সামলাব?’
এখানেই না থেমে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণের ঝাঁঝ আরও খানিকটা বাড়িয়ে মমতা বলেন, ‘এরা আমাকে রাজনৈতিক ভাবে ডিস্টার্ব করতে গিয়ে বাংলার সর্বনাশ করছে। এরপর বাংলার হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হলে কেন্দ্রীয় সরকার দায় নেবে তো?’ প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহেই কেন্দ্র সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, আর রাজ্যের সঙ্গে সূচি চূড়ান্ত করে ট্রেন পাঠানো হবে না। এ নিয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের পর কেন্দ্রের সমালোচনায় মুখর হয় কেরলও। দক্ষিণের রাজ্যটির সরকার কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘সুপার স্প্রেডার’ বলেও তোপ দাগে।
এদিন সেই বিষয়েই মমতা বলেন, ‘হঠাৎ শুনছি মুম্বই থেকে ৩৬টি ট্রেন আসবে। আমাদের কেউ কিচ্ছু জানে না। এবার বলুন তো এই এত লোকগুলোকে কোথায় রাখব?’ নবান্নের তরফে জানানো হয়েছে, আজ রাতে ১১টি এবং কাল ১৭টি ট্রেন শ্রমিকদের নিয়ে বাংলায় ঢুকবে। ভিন রাজ্য থেকে ফেরা শ্রমিকদের যথাযথ স্ক্রিনিং, জেলায় পৌঁছে দেওয়া এবং হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি জেলায় এবং ব্লক স্তরে টাস্ক ফোর্স গঠন করার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। জেলা টাস্ক ফোর্সের মাথায় থাকবেন ডিএম এবং ব্লকের টাস্ক ফোর্সে বিডিও। রাজ্যের টাস্কফোর্স প্রতিদিন সন্ধে ছ’টায় জেলা টাস্ক ফোর্সগুলির সঙ্গে পর্যালোচনা বৈঠক করবে।
এছাড়াও, এদিন উম্পুনে যাঁদের ঘর ভেঙে গেছে, তাঁদের এককালীন ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। এই বিষয়টি দেখভাল করার জন্য একটা স্টেট লেভেলের টাস্ক ফোর্সও গঠন করেছেন তিনি। বুধবার বিকেলে নবান্ন সভাঘর থেকে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স চলার সময়েই এই কথা ঘোষণা করেন তিনি।
এর আগেই যদিও উম্পুন পরবর্তী সময়ে এক দফা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছিলেন, ঝড়ের তাণ্ডবে মৃতদের পরিবারকে আড়াই লক্ষ টাকা করে দেওয়া হবে। বেশি আহত হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের দেওয়া হবে ৫০ হাজার টাকা করে এবং কম আহত হলে তাঁদের প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি।
আর আজ জোর দিলেন ঘূর্ণিঝড়ে বাড়ি ভেঙে পড়া মানুষগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যাপারে। তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহের সুপার সাইক্লোনে যাঁদের ঘর ভেঙে গেছে, তাঁদের এককালীন ২০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য সরকার। কোথায় কত ক্ষতি হয়েছে তার মোটামুটি হিসাব পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন ৬ কোটি মানুষ। পরোক্ষে আরও চার কোটি মানুষের ক্ষতি হয়েছে।’
গত বুধবার উম্পুন বিপর্যয়ের পরেই নবান্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, রাজ্য ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করে ক্ষতিপূরণের তালিকা তৈরি করতে কৃষি, মৎস্য, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ, পশুপালন দফতরের আধিকারিক ও মুখ্যসচিবকে নিয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করার কথা। তাঁর কথায়, ‘কোন কোন এলাকায় ক্ষতি হয়েছে, জেলাশাসকদের তার রিপোর্ট পাঠাতে বলব। আমাদের ব্লক টু ব্লক সমীক্ষা করে এগোতে হবে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও কত কী লাগবে, তার যাবতীয় রিপোর্ট দিতে হবে ৭ দিনের মধ্যে।’
এমনিতেই উম্পুনের দাপটে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ জল-জঙ্গল এলাকায় অনেক নদীর বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন সেই সব বাঁধ সারাইয়ের কাজ চলছে। কিন্তু এর মধ্যেই আসছে পূর্ণিমা। আর পূর্ণিমার ভরা কোটালে ফের ক্ষতি হতে পারে ভেঙে পড়া বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলির। আর তাতে জলমগ্ন এলাকাগুলিতে নতুন করে জল ঢুকতে পারে। তবে এই পরিস্থিতি যাতে তৈরি না হয়, তার জন্য এখন থেকেই প্রশাসনকে আরও একবার সতর্ক করে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিন তিনি বলেন, সেচ দফতর থেকে জেলা প্রশাসন সকলকেই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টার দিকে নজর দিতে হবে। আগামী পূর্ণিমার আগেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সারিয়ে ফেলতে হবে সব বাঁধ।
তবে রাজ্যজোড়া এমন বেশ কয়েকটি বড়সড় বিপর্যয়ের মধ্যেও এদিনের বৈঠক থেকে সুখবর দিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার কৃষিবিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কার সম্পর্কেই অবহিত করেছেন রাজ্যের মানুষকে। বুধবার বিকেলে জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারদের সঙ্গে নবান্ন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেই তিনি জানান, বাংলার কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কারের কথা। যার মোদ্দা বিষয় হল, নোনা জলেই নতুন এক প্রজাতির ধানের চাষ হবে। একই ভাবে নোনা জলে চাষ হবে নতুন এক প্রকার মাছ।
মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার তাঁকে জানিয়েছেন, কৃষি বিজ্ঞানীরা এক ধরনের ধানের বীজ আবিষ্কার করেছেন। যা নোনা জলে চাষ করা যাবে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসে হেক্টরের পর হেক্টর কৃষি জমিতে নোনা জল ঢুকে গিয়েছে দুই চব্বিশ পরগনায়। তাই সেখানকার চাষিরা এই বীজ দিয়ে চাষ করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এদিন মমতা বলেন, ‘বুলবুলের সময়ে আমাকে প্রদীপদা প্রথম এই আইডিয়া দিয়েছিলেন। কৃষি দফতরের বিজ্ঞানীরা গোসাবায় একটা জায়গায় গবেষণা করছিলেন। তারপরই এটা আবিষ্কার হয়েছে। এটা আমাদের রাজ্যের জন্য খুবই ভাল খবর।’ মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, নোনা জলে চাষ করা ধান থেকে যে চাল উৎপন্ন হবে সেই ভাতের স্বাদও হবে সাধারণ চালের ভাতের মতোই।
জেলা প্রশাসনের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, যে সমস্ত জমিতে নোনা জল ঢুকে চাষের বারোটা বেজে গিয়েছে সেসব জায়গায় চাষিদের এই বীজ দিতে হবে। রাজ্যের তরফে সম্পূর্ণ বিনামূল্যেই কৃষকদের এই বীজ দেওয়া হবে। একইসাথে আজ ওই বৈঠকে বসেই এই নতুন বীজের নামকরণ করেন মমতা। এই বীজের নাম দেওয়া হয়েছে ‘নোনা স্বর্ণ!’ এছাড়া, যে সব পুকুর তথা জলাশয়ে নোনা জল ঢুকে মাছ চাষের ক্ষতি হয়েছে সেখানে মৎস্য দফতর আলাদা করে নোনা জলের মাছ দেবে। যাতে মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত মানুষকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে না হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই মাছগুলির নাম হবে ‘স্বর্ণ মৎস্য’।