ইতালিয়ান পরিচালক ভিত্তোরি দ্য সিকার বানানো নিও রিয়েলস্টিক ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ (ইংরেজিতে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’) ছবিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন এক বাঙালি তরুণ। সিনেমার মধ্যে খুঁজেছিলেন জীবনের অস্তিত্বকে। একসময় রবীন্দ্র সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরবর্তীতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে। তিনি সত্যজিৎ রায়।
সত্যজিৎ একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, লন্ডনে ঐ ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পরপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি চলচ্চিত্রকার হবেন এবং প্রথম চলচ্চিত্রটি তৈরি করবেন কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে। তারপর সমস্ত আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সিনেমাতে।
যে পথের পাঁচালী ছবি বানিয়ে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনার জগতে নিজের স্থান করে নেন, সেই পথের পাঁচালীর কাহিনিটা নাটকীয়ভাবেই এসেছিল তাঁর জীবনে। সত্যজিৎ যে প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করতেন, সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় বইগুলো একেবারে সাধারণ পাঠক বা কিশোরদের উপযোগী করে নতুন সংস্করণে ছাপা হতো। আর সেইসব বইগুলির প্রচ্ছদসহ আরও অন্য ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়তো সত্যজিৎ রায়ের ওপর।
একদিন সিগনেট প্রেসের প্রধান ডি কে গুপ্ত সত্যজিতকে ডেকে বলেছিলেন, পথের পাঁচালীর কিশোরপাঠ্য সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বের হবে এবং প্রচ্ছদসহ –এর ভেতরের ছবিগুলো তাঁকে আঁকতে হবে। ঘটনাটি ১৯৪৫ সালের। সত্যজিৎ তখনও পথের পাঁচালী পড়েননি। ব্যপারটি শুনে ডি কে গুপ্ত তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই বইয়ের কাহিনি থেকে একটি সুন্দর চলচ্চিত্র হতে পারে। তারপর সত্যজিৎ তিনশো পৃষ্ঠার মূল বই পড়ে ফেললেন। পড়ে শুধু তিনি অস্ফূট স্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অপূর্ব’! তারপরই কাহিনিটা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও মনের ভিতর গেঁথে যাওয়া প্রখ্যাত কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসটি নিয়ে ভাবনার কমতি ছিল না তাঁর। অবশেষে মনস্থির করলেন সিনেমা বানাবেন বলে। যদিও পথের পাঁচালী -এর চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক তোড়জোড় হয়েছিল! স্ক্রিপ্টটি নিতে আগ্রহী ছিলেন আরও অনেকে। কিন্তু, বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা দেবী সত্যজিতকেই দিয়েছিলেন পথের পাঁচালীর স্বত্ব। তারপর পথের পাঁচালী দিয়েই শুরু করেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের পরিক্রমা। আর এই পথচলায় সূচনা হয়েছিল নতুন এক অধ্যায়ের।
সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রটি প্রবল ভূমিকম্পের মতো ভারতীয় চলচ্চিত্রের গৃহীত কাঠামোকে চূর্ণ করেছে। চলচ্চিত্রটির নব্য বাস্তববোধ দর্শক ও সমালোচকদের হতবাক করেছিল। এই ছবিই একদিন সত্যজিৎ রায়কে পরিচিত করে তুললো বিশ্বব্যাপী।
পথের পাঁচালী সবদিক থেকেই উন্নতমানের চলচ্চিত্র। বিশেষ করে ছবির আঙ্গিক। তা না ছিল প্রথাগত হলিউড না ছিল ইটালিয়ান নিও রিয়ালিস্ট ঘরানা। একেবারেই অতুলনীয়। ছবির বিষয় নিয়ে অজস্র লেখা আছে। কিন্তু এই আঙ্গিক নির্মাণের কাজটা যে বেশ জটিল, সেটি স্বীকার করেছিলেন সত্যজিৎ। ‘কিন্তু এই জটিলতাসহ সাংগীতিক কাঠামোর সামগ্রিকতা যদি শিল্পীর অনুভবে না আসে, তা হলে ফিল্ম করা যায় না। আর সেই অনুভবকে উপলব্ধি করতে না পারলে ভাল ফিল্ম বোঝাও যায় না।’ অমোঘ মন্তব্য তাঁর। তাঁর মতে ‘চলচ্চিত্র শিল্পের পথিকৃতেরা অনেকেই ছিলেন সংগীতরসিক। গ্রিফিথ বেটোফেনের সংগীত থেকে প্রেরণা পেয়েছিলেন এ কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। ‘বার্থ অব এ নেশন’ বা ‘ইনটলারেন্স’ ছবির দৃশ্যগঠনে এই সংগীতশৈলীর কাঠামো লক্ষ্য করার মতো’।
‘ভারতকোষ ৩য় খণ্ড’-এ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘চিত্রনাট্য’ লেখাটি। যেখানে তিনি লিখেছিলেন,
‘চলচ্চিত্রের রস মূলত তাহার চিত্রভাষায় নিহিত। সংগীতের মতোই চলচ্চিত্রের রস অন্য কোনও ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়’। আর এই চিত্রভাষার উপলব্ধির প্রধান অন্তরায় আমরাই, ‘আমাদের বাঙালিদের, শিল্প গ্রহণের মনটা বোধহয় মূলত সাহিত্যিক মন। অর্থাৎ সাংগীতিক মন নয়, বা চিত্রগত মন নয়,’ উপলব্ধি করেছেন তিনি। এই প্রবন্ধেই সিনেমার আঙ্গিক নিয়ে নির্দিষ্ট করেছেন তাঁর মত, ‘সাহিত্যের ওপর ফিল্মের এই নির্ভরতাকে প্রায় অস্বীকার করেই ফিল্মের সাংগীতিক কাঠামোর জন্ম।’
পথের পাঁচালী ছবিটা তোলার কাজ চলেছিল আড়াই বছর ধরে। অবশ্য এই আড়াই বছরের প্রতদিন যে শ্যুটিং হত তা নয়। সত্যজিৎ রায় তখন বিজ্ঞাপন অফিসে চাকরি করেন। এই চাকরি করার ফাঁকেই ছুটি নিয়ে তিনি শ্যুটিং করতেন। অধিকাংশ শ্যুটিং হত ছুটির দিনে বা তিনি অফিস থেকে ছুটি নিলে সেদিন। পয়সাকড়ি তাঁর হাতে বেশি ছিল না। যেটুকু জোগাড় হত, সেটা ফুরিয়ে গেলে কাজ বন্ধ করে তাঁকে বসে থাকতে হত যতদিন না আবার কিছু টাকাকড়ি জোগাড় হয়। এই শ্যুটিং হবার আগে অভিনয়ের জন্য লোক জোগাড় করা একটা বড় পর্ব ছিল। পথের পাঁচালীর মূল চরিত্র অপু – গোড়ার দিকে এই চরিত্রে অভিনয় করার জন্য একটা বছর ছয়েকের ছেলের সন্ধান সত্যজিৎ রায় কিছুতেই পাচ্ছিলেন না। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেন। কলকাতার রাসবিহারী এভিনিউয়ের একটা বাড়িতে তিনি তখন ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন এক কাজের জন্য। সেখানে অভিনয়ের জন্য তাঁর সামনে অনেক ছেলেই এসেছিল, কিন্তু তাঁর মনের মতন একজনও হয়নি। রোজ বিকেলে একটা নির্দিষ্ট সময়ে রাসবিহারী এভিনিউয়ের সেই ঘরে অপু বাছাই পর্ব চলত। এই অপুকে খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতারও সম্মুখীন হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। যেমন, একদিন একটা ছেলে সেখানে তাঁর অভিভাবকের সাথে এসে উপস্থিত হয়, তাঁর ঘাড়ে পাউডার লেগে রয়েছে দেখে সত্যজিৎ রায়ের সন্দেহ হয়। তিনি ছেলেটিকে তাঁর নাম জিজ্ঞেস করায় সে খুব মিহি গলায় উত্তর দেয়, ‘টিয়া’। সত্যজিৎ রায়ের অভিজ্ঞ চোখে বুঝতে দেরি হয়নি ব্যাপারটা কি। তিনি সঙ্গের অভিভাবককে চেপে ধরায় আসল ব্যাপারটি সামনে আসে। সেই অভিভাবক স্বীকার করে নিয়েছিলেন, টিয়া আসলে মেয়ে, সিনেমায় অপুর পার্ট পাবার লোভে তিনি তাঁর মেয়েকে সেলুন থেকে চুল কাটিয়ে ছেলে সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন! বিজ্ঞাপন দিয়েও ছেলে পাওয়া যায়নি। সত্যজিৎ রায় যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন হঠাৎ একদিন তাঁকে আশার আলো দেখালেন তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী বিজয়া রায়। একদিন বিকেলে বিজয়া রায় তাঁদের বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়ির ছাদ থেকে নেমে এসে পাশের বাড়ির ছেলেটিকে ডেকে পাঠাতে বললেন, যাঁকে তিনি কিছুক্ষণ আগেই পাশের বাড়ির ছাদে দেখেছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের পাশের বাড়ির ছেলে শ্রী সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়-ই শেষে সত্যজিতের অপু হন। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জীবনের মাইলস্টোন এই ছবি তৈরির কাজ যে আড়াই বছর ধরে চলবে – সেটা শুরুর দিকে তিনি নিজেও ভাবেননি। শেষে যত দিন গড়িয়েছিল, তাঁর মনে একটা ভাবনামিশ্রিত ভয় ঢুকে গিয়েছিল, যদি অপু-দুর্গা এই সময়ের মধ্যে বেশি বড় হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা ছবিতে ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এই আড়াই বছরে তাঁদের দু’জনের সেই বয়সে যতটা বাড়ার কথা ছিল, তাঁরা কেউই সেটা বাড়েন নি। সত্যজিৎ রায় নিজেই পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ইন্দিরা ঠাকুরণের চরিত্রে অভিনয় করা আশি বছরের বৃদ্ধা শ্রীমতী চুনিবালা দেবীও যে আড়াই বছরের শ্যুটিংয়ের ধকল সহ্য করে বেঁচেছিলেন – সেটা তাঁর পরম সৌভাগ্য ছিল।
শ্যুটিংয়ের শুরুতেই গোলমাল বাঁধে। অপু-দুর্গাকে শ্যুটিংয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকাতা থেকে প্রায় সত্তর মাইল দূরে বর্ধমান জেলার পালসিট বলে একটা জায়গায়। সেখানে রেললাইনের ধারে কাশফুলে ভরা একটা মাঠ ছিল। পথের পাঁচালীর সেই বিখ্যাত ট্রেনের দৃশ্য, অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার দৃশ্য সেখানে তোলা হবে বলে ঠিক ছিল। দৃশ্যটা বেশ বড়, তাই একদিনে হবে না, অন্ততঃ দুই দিন সময় লাগবে। প্রথম দিন ছিল জগদ্ধাত্রী পূজা। অপু-দুর্গার মধ্যে মন কষাকষি চলছে, নিজের দিদির পিছু নিয়ে অপু গ্রাম থেকে বেরিয়ে কাশবনে এসে পৌঁছেছে। সকাল থেকে শুরু করে বিকেল অবধি কাজ করে প্রায় অর্ধেক দৃশ্য তোলা হয়েছিল। পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, শিশুশিল্পীদ্বয় – সকলেই নতুন ছিলেন, তাই সকলেরই প্রথমে বাধোবাধো ঠেকছিল, কিন্তু কারও উৎসাহের অভাব ছিলনা। প্রথম দিনের কাজ শেষ করে সবাই ফিরে এলেন। দিন সাতেক পরে আবার সেই একই জায়গায় পৌঁছে সত্যজিৎ রায় চমকে গেলেন? এ তিনি কোথায় এলেন? কারণ মাঠভর্তি কাশবন উধাও! স্থানীয় লোকেদের কাছে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পেরেছিলেন, কাশফুল গরুর প্রিয় খাদ্য – তাই এই মাঝের সাতদিনে সারা মাঠের কাশফুল গরুতে খেয়ে সাফ করে দিয়েছে! ছবিতে এই দৃশ্যের বাকি অংশ সত্যজিৎ রায় তুলেছিলেন পরের বছর, যখন মাঠ আবার কাশফুলে ভরে গিয়েছিল। সেবার অবশ্য ট্রেনের শটও নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ট্রেন নিয়ে এতগুলো শট ছিল যে, একটা ট্রেনে কাজ হয়নি, পর পর তিনটে ট্রেন ব্যবহার করতে হয়েছিল। সত্যজিৎ আগে থেকেই ট্রেনের সময়সূচি দেখে জেনে নিয়েছিলেন যে ওই লাইনে সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে কয়টা ট্রেন চলে। অবশ্য তাতেও কিছু শর্ত ছিল। উল্টোদিক থেকে আসা ট্রেন চলবে না আর ট্রেনের কালো ধোঁয়া চাই। তখন কয়লার ইঞ্জিনের সময়। সাদা কাশফুলের পাশে ট্রেনের কালো ধোঁয়া না হলে দৃশ্য জমবে কেন? যে স্টেশন থেকে ট্রেন আসবে সেখানে শ্যুটিং দলের একজন থাকতেন, তিনি সোজা ট্রেনের ড্রাইভারের ইঞ্জিনে উঠে পড়তেন – কারণ গাড়ি শ্যুটিং স্পটের কাছাকাছি এলেই বয়লারে কয়লা দেওয়া দরকার, নাহলে কালো ধোঁয়া বেরোবে না যে! আজ এত বছর পরেও যখন বিশ্বজুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিটি দেখেন, তখন তাঁরা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেন না যে তাঁরা আসলে একটা নয়, তিনটে আলাদা ট্রেন দেখছেন।
পয়সার অভাবে এত বেশিদিন ধরে শ্যুটিং চলার জন্য সত্যজিৎ আরও বেশ কিছু অসুবিধায় পড়েছিলেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় রয়েছে অপু-দুর্গার পোষ্য কুকুর ভুলোর কথা। গ্রাম থেকেই সত্যজিৎ একটা কুকুর জোগাড় করেছিলেন, সেটা তাঁদের বেশ পোষও মেনে গিয়েছিল। ছবির একটা দৃশ্যে আছে যে, অপুর মা সর্বজয়া অপুকে ভাত খাওয়াচ্ছেন, ভুলো সামনের উঠানে বসে খাওয়া দেখছে। অপুর হাতে তীর-ধনুক, খাওয়ায় তাঁর বিশেষ মন নেই। সে মায়ের দিকে পিঠ করে বসে আছে, আবার কখন খেলবে তার অপেক্ষায়। অপু খেতে খেতেই তীর ছোঁড়ে, তারপরে খাওয়া ছেড়ে উঠে যায় তীর আনতে। সর্বজয়া বাঁ হাতে থালা আর ডান হাতে গ্রাস নিয়ে ছেলের পিছনে ধাওয়া করেন। কিন্তু ছেলের হাবভাবে তিনি বুঝে যান যে ছেলে আর ভাত খাবেনা। এরমধ্যে ভুলোও উঠে পড়ে, তার নজর ভাতের থালার দিকে। এতটা ছিল একটা শট। পরের শটে ছিল – সর্বজয়া বাকি ভাতটা আস্তাকুঁড়েতে ফেলে দিচ্ছেন, আর ভুলো সেটা খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় এই শটটি সেদিন সত্যজিৎ নিতে পারেননি, দিনের আলো ফুরিয়ে গিয়েছিল আর ফুরিয়ে গিয়েছিল টাকা। মাস ছয়েক পরে টাকার জোগাড় হলে আবার শ্যুটিং করতে যাওয়া হয় গড়িয়ার কাছে বোড়াল গ্রামে। কিন্তু এবারে গিয়ে জানা গেল যে, সেই কুকুর মরে গিয়েছে! এবারে কি হবে? একই রকমের দেখতে কুকুরের অভাবে শেষে দৃশ্য বাদ পড়ার উপক্রম। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে অবশেষে একই রকমের দেখতে একটা কুকুরের সন্ধান পাওয়া গেল। ধরে আনা হল সেই কুকুরকে। দেখা গেল, দুই কুকুরের আশ্চর্য মিল, শুধু যে গায়ের রঙে সেটা নয়, এই কুকুরেরও ল্যাজের ডগা সাদা ছিল। শেষ পর্যন্ত এই নকল ভুলোকে দিয়েই সত্যজিৎ রায় তাঁর কাজ শেষ করলেন। নকল ভুলো দিব্যি সর্বজয়ার আস্তাকুঁড়েতে ফেলে দেওয়া ভাত খেয়ে নিল। ছবিতে কিন্তু বোঝা যায়না যে সত্যজিৎ আসলে দুটো ভিন্ন কুকুর ব্যবহার করেছিলেন।
অবশ্য শুধুমাত্র কুকুর নয়, মানুষকে নিয়েও সত্যজিৎ বিপদে পড়েছিলেন। চিনিবাস ময়রার কাছ থেকে মিষ্টি কেনার সাধ্য অপু-দুর্গার নেই। তাঁরা ময়রার পিছু নিয়ে যায় মুখুজ্জ্যেদের বাড়িতে, তাঁরা বড়লোক, তাই তাঁরা মিষ্টি কিনবেই, আর সেটা দেখেই অপু-দুর্গার আনন্দ। এই দৃশ্য তোলার পরেও শ্যুটিং কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টাকার জোগাড় হবার পরে সত্যজিৎ যখন আবার নিজের শ্যুটিং ইউনিট নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন, ততদিনে চিনিবাস ময়রার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন তিনি আর এই জগতে নেই। দুশ্চিন্তায় সত্যজিতের কপালে ভাঁজ পড়েছিল, কারণ কুকুরে-কুকুরে পার্থক্য না ধরা গেলেও, প্রথম চিনিবাসের সাথে মেলে এমন মানুষ তিনি কোথায় পাবেন? শেষ পর্যন্ত যাঁকে পাওয়া গিয়েছিল, তাঁর সাথে আগের চিনিবাসের মুখের সাথে বিশেষ মিল না থাকলেও চেহারাতে ছিল – ইনিও আগের চিনিবাসের মতন নাদুস নুদুস ছিলেন। ছবি দেখে কারও বোঝার সাধ্য নেই যে ওই দৃশ্যে দু’জন চিনিবাস রয়েছেন – দু’জন আলাদা লোক। প্রথম দৃশ্যে আসল চিনিবাস বাঁশবন থেকে বেরোলেন আর পরের দৃশ্যে নকল চিনিবাস ক্যামেরার দিকে পিঠ করে মুখুজ্জ্যেদের বাড়ির ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন।
এছাড়াও পয়সার অভাবে বৃষ্টির দৃশ্য তুলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় কম নাজেহাল হননি। বর্ষাকাল তিনি পেয়েছিলেন – কিন্তু হাতে টাকা ছিলনা, অগত্যা শ্যুটিং বন্ধ। শেষে যখন তিনি হাতে টাকা পেলেন, তখন অক্টোবর মাস – তখন কোথায় বৃষ্টি! বৃষ্টির আশায়, অপু-দুর্গা, ইউনিটের লোকজন আর যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনি গ্রামে গিয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতেন। শেষে একদিন তিনি বৃষ্টি পেলেন। পথের পাঁচালীর আরেকটা আইকনিক দৃশ্য – তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গা কুলগাছতলায় তাঁর ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিল, ভাইবোন জড়াজড়ি করে বসে, দুর্গা বিড়বিড় করছে, ‘নেবু পাতা করমচা, হে বৃষ্টি ধরে যা!’। শরৎকালের অসময়ের ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজে অপু-দুর্গার অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়েছিল। শেষে শটের পরে দুধের সাথে ব্র্যান্ডি খাইয়ে দু’জনের শরীর গরম করতে হয়েছিল।
শ্যুটিংয়ের সময়ে গ্রামের লোকেদের সঙ্গে তাঁর বেশ ভালো পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। এঁদের মধ্যে বেশ কিছু বিচিত্র লোকও তিনি পেয়েছিলেন। একজন বয়স্ক ব্যক্তি ফিল্মের লোক দেখলে মোটেও প্রসন্ন হতেন না, চিৎকার শুরু করতেন – ‘ফিল্মের দল এয়েচে – বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়!’। পরে সত্যজিৎ জানতে পেরেছিলেন যে সেই ভদ্রলোকের মাথায় একটু গোলমাল ছিল। পরে অবশ্য এই ভদ্রলোকের সাথে সত্যজিতের ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে তিনি সত্যজিৎকে তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসিয়ে বেহালায় যাত্রার গান বাজিয়ে শোনাতেন। আবার কখনও তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলতেন – ‘ওই যে সাইকেলে যাচ্ছে, ও কে জান তো? ও হল রুজভেল্ট! মহা পাজি!’ এমন ভাবেই তিনি কাউকে বলতেন হিটলার! কাউকে গান্ধী! আবার কাউকে খান আব্দুল গফফর খাঁ! আরেক ছিটগ্রস্ত ব্যক্তি আবার এমনিতে শান্ত থাকতেন, কিন্তু মাঝে মাঝেই ‘হে বন্ধুগণ’ বলে দীর্ঘ রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে শুরু করে দিতেন। এঁকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় রীতিমতো আতঙ্কে থাকতেন। কারণ এমনি সময়ে অসুবিধা নেই, কিন্তু সাউন্ড রেকর্ড করার সময়ে বক্তৃতা শুরু করলে যে সবকিছুর দফারফা হয়ে যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির বাড়ির লোকের সহায়তায় তেমন কিছু ঘটেনি।
তবে সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল সাপ নিয়ে। যে বাড়িটা সত্যজিৎ পেয়েছিলেন, সেটা ছিল জীর্ণ ও জঙ্গলে ভর্তি। বাড়ির মালিক কলকাতায় থাকতেন। তাঁর কাছে মাসিক ভাড়া দিয়ে সত্যজিৎ বাড়িটা ব্যবহার করার জন্য নিয়েছিলেন। বাড়িটাকে সংস্কার করে ব্যবহার করার উপযোগী করে তুলতে সত্যজিৎ রায়ের প্রায় একমাস লেগেছিল। বাড়ির একটা অংশে সারবাঁধা অনেকগুলো ঘর ছিল, যেগুলো ছবিতে দেখা যায়না। সেগুলোতে শ্যুটিং ইউনিটের মালপত্র রাখা হত। আরেকটা ঘরে সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের যন্ত্র সমেত বসতেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ভূপেনবাবু। তাঁকে দেখতে না পেলেও সত্যজিৎ তাঁর গলা পেতেন। কারণ তিনি সাউন্ড রেকর্ড করতেন ঘরের ভেতরে বসে। প্রতি শটের পরে সত্যজিৎ হাঁক পাড়তেন, ‘সাউন্ড ঠিক আছে তো?’ ভূপেনবাবু জবাবে হ্যাঁ কি না জানিয়ে দিতেন। একদিন হাঁক পেড়েও সত্যজিৎ তাঁর কোন উত্তর পেলেন না। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর না পেয়ে, সত্যজিৎ ঘরে ঢুকে দেখেন, একটা বিরাট বড় গোখরো সাপ সেই ঘরের পিছনের জানলা দিয়ে ঘরের মেঝেতে নামছে, আর সেই বিশালাকৃতির সাপের ভয়েই ভূপেনবাবুর কথা বন্ধ হয়ে গেছে! সাপটাকে সত্যজিৎ গ্রামে শ্যুটিং করতে যাবার কয়েক দিনের মধ্যেই দেখেছিলেন। মারতে স্থানীয় লোকজন না করেছিল, কারণ সেটা ছিল বাস্তুসাপ, বহুদিন ধরে সেই পোড়ো বাড়ির বাসিন্দা।
‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন সামনে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেশে-বিদেশে সিনেমাবোদ্ধাদের আলোড়িত করেছিল। বহু নামীদামি পরিচালক এক নবীন নির্মাতার চলচ্চিত্র দেখে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলেন। অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। ‘পাত্তা না পাওয়া’ এক সিনেমা পাগল তরুণের দিকে দৃষ্টি পড়েছিল সবার। যে তরুণ নির্মাতা একটি স্বপ্ন পূরণের জন্য বিত্তবানদের কাছে ঘুরেছেন, ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর দেখা গেলো তাঁর পিছনে ছুটেছে ভারতের সবচেয়ে নামীদামি প্রযোজক সংস্থাও। সিনেমা নির্মাণের জন্য পরবর্তীতে আর অর্থ কষ্টে পড়তে হয়নি। জগদ্বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎকে জানতে হলে তাঁর ভিতরের চিত্রকরটিকেও চিনতে হবে, আর সে জন্যই প্রাণের উৎসর্গ খুঁজতে হবে তাঁর চলচ্চিত্রে।
(তথ্যসূত্র:
১- একেই বলে শুটিং, সত্যজিৎ রায়।
২- সত্যজিৎ রায়, বাবলু ভট্টাচার্য, অগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি।
৩- সত্যজিৎ রায়: বিশ্বজয়ী প্রতিভার বর্ণময় জীবন, অরূপ মুখোপাধ্যায়, দীপ প্রকাশন।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত