#সত্যজিৎ১০০#২মে
“পরশু তো ষষ্ঠী, পরশুর মধ্যে কি আপনার কাজ শেষ হয়ে যাবে ?”
পৃথিবীর আর কোন জাতি এই লাইনটা শুনে প্রবাসে বসে দুর্গাপুজোর ঠিক আগে আগে Homesick হয়ে পরতে পারে? বাঙালিরা পারে। বাঙালিরাই বোধহয় একমাত্র পারে সম্মিলিত ভাবে চোয়াল শক্ত করতে “হয় এর বদলা নেবো নয়তো গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেবো” শুনে। বাঙালিরাই তো বলতে পারে আবিষ্কারের আনন্দে, “আছে, আছে আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে”।
আজ ও বিদ্রোহে বিপ্লবে কেউ বলতে পারে, “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খানখান।” বাঙালিদের আপনি যতোই Welldone, Great Job Bro, Super Performance বলে প্রশংসা করুন না কেন, একটা দারুণ কাজের পরে স্রেফ একবার পিঠ চাপড়ে “সাবাশ তোপশে” বলে দেখবেন। অস্কার হাতে তুলে দিলেন যেন। এসব পাগলামির জন্য যে দায়ী আজ তার জন্মদিন। আজ বাঙালির শিক্ষক দিবস ও বটে। সত্যজিৎ রায়ের ১০০ বছর শুরু হল।
যার ছবি দেখতে দেখতে সিনেমার ভূত চাপে, যার গল্প পড়তে পড়তে লেখার দত্যি আসে খাতায়, যার আঁকা রোজ চ্যালেঞ্জ করে যায় আমাদের শিল্পকর্মকে, যার করা সুর শুনে আজ ও গায়ে কাঁটা দেয় আজ তার জন্মদিন। আজ র্যাক্সিট, ক্যাপ্টেন স্পার্ক, ডাকু গন্ডারিয়া, তারিণী খুড়ো, অনুকুল, মন্দার বোস, অপু, দুর্গা, পিকু, রুকু, মুকুলকে প্রফেসর শঙ্কুর টাইম মেশিনে চাপিয়ে ১/১ বিশপ লেফ্রয় রোডের Summer camp এ নিয়ে যাওয়ার দিন। সবুজ এম্বাসাডর চেপে জটায়ু খাবারদাবার নিয়ে আসবে হগ মার্কেটের কলিমুদ্দিদের দোকান থেকে, ভূতের রাজার ভোজ বসবে দুপুরে, প্রহ্লাদ সব্বাইকে পরিবেশন করে দেবে। সারাদিন আমরা আলকেমি, প্ল্যানচেট শিখবো, গুপি গান শেখাবে, সিধু জ্যাঠা যত্ন করে বই সংরক্ষণ শেখাবে, বনবিহারী বাবু তার র্যাটেল স্নেকটাকে নিয়ে এসেছে, বেনারসের ঘোষাল বাবু এসেছে আফ্রিকার রাজা আর ওই সোনার গনেশটা নিয়ে। মন্দার বোস তার উজবেকিস্তানের উট ধরার গল্প বলবে, মনমোহন মিত্র বলবে সভ্যতার সংকট নিয়ে, জটায়ু নিজের সাম্প্রতিকতম উপন্যাস “কোরোনার কামড়” এর প্রথম পাতায় সই করে দেবে। বিরিঞ্চি বাবাকে ও ডাকা হবে সন্ধের দিকে৷ সূর্য বিদ্যা আয়ত্তে রাখা জরুরি।
প্রতিপক্ষ যতোই দুর্ধর্ষ দুশমন হোক না কেন, বাঙালির মগজাস্ত্রের কাছে সে ভ্যানিশ হবেই। এই যুদ্ধ বিদ্যা যে শিখিয়েছিল সেই দ্রোণাচার্যের আজ ১০০ বছর হলো। অবশ্য পয়েন্ট ৩২ বোরের, ছটা গুলি থাকে সেই কোল্ট পিস্তল ব্যবহার ও সেই শিখিয়েছি। অ্যানাইহিলিন, মিরাকিউরল, নার্ভিগার, অমনিস্কোপ, স্নাফগান, ক্যামেরাপিড, লিঙ্গুয়াগ্রাফ বের করে ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই করে চালিয়ে দেওয়া যে শিখিয়েছিল আজ তার জন্মদিন।
যে মেমরি গেম খেলার ছলে শিখিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্কস, ক্লিওপেট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অফ ট্রয়, শেক্সপিয়ার, মাও শেতুং আজ তার জন্মদিন। ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন এট্টু জিরো মানের খোঁজার হোমটাস্ক দিতো যে স্যার, আজ তার জন্মদিন। যে প্রতি গরমের ছুটিতে ফেলুদা, তোপশে, লালমোহন বাবুর সাথে আমাকে ও বেড়াতে নিয়ে যেত নানান জায়গায় তারপর লালমোহন বাবুর কথায় হাইলি সাসপিশাস কিছু টের পেয়ে ঘটে যেত কোন থ্রিলিং এডভেঞ্চার, আজ তার একশোতম বছর।
নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল ওরা পাপাঙ্গুল, পিপলিবিলের ধার, ডং, মোল্লা নাসিরুদ্দিনের আজব দুনিয়ার সাথে আমার মাতৃভাষায় পরিচয় করিয়েছিল, উপহার দিয়েছিল তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম, চিলেকোঠায় শুনিয়েছিল লিমেরিক, রামপাগলের গান, আদ্যি বুড়োর পাদ্যি আজ সেই ইয়া লম্বা লোকটার জন্মদিন।
যে শিখিয়েছিল দুপুরের খাওয়ার পরে একটা খয়ের ছাড়া মিঠে পান খেতে আর ভাবতে ভাবতে সিগারেটের রিং ছাড়তে তার জন্মদিন আজ। সিগারেটের প্যাকেটে পৃথিবীর সর্ব প্রথম Statutory warning, “খাবার পরে একটা করে”, ওটা ও তো ওরই লেখা।
আমাদের এই reaching to the top,top, top এর ইঁদুর দৌড়টা আসলে কি ভীষণ অর্থহীন, যে পরশ পাথরের লোভ তা আজ আছে কাল নেই, আজ যে রাজা, কাল সে ফকির, এটা যে মগজধোলাই এর মতো গেঁথে দিয়েছিল, আজ তার জন্মদিন। ইন্দির ঠাকুরনদের অবহেলা করে, কাশবনের মধ্যে দিয়ে কালো ধোঁয়া ওড়া ট্রেনের পিছনে না ছুটে অর্থ যশের পিছনে ছুটলে শেষমেশ ওই টাকার চোরাবালিতে ডুবে যেতে হবে। আমাদের ও চলে যেতে হবে। আমি, আপনি, ফেলুদা, তোপশে দা, লালমোহন বাবু আমরা সব্বাই চলে যাবো একদিন, ভ্যানিশ হয়ে যাবো নকল ডাক্তার হাজরার মতো কিন্তু যাওয়ার আগে শেষ দিন অবধি বাঙালির সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে প্রিয় মাস্টারমশাইকে সেলাম ঠুকে যাবো। তার ২৮টা সিনেমা, ফেলুদা সমগ্র, ছোটগল্প, গুগাবাবার গান, আঁকা, ছড়া সব, সব বুকে আগলে রাখবো। ওগুলোই তো মনখারাপের মিরাকিউরল। এটা ২মে, এটা জয় বাবা মানিকনাথ বলার দিন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত