তখন ‘পড়োশন’ ছবির গান নিয়ে কাজ চলছে। ‘এক চতুর নার …’। এ গান এক দিনে হয়নি। মান্না দে, কিশোরকুমার, মেহমুদ, বাসু মনোহারীদের নিয়ে একটা বড়সড় দল তখন দিনের পর দিন বসেছেন রাহুলদেব বর্মনের বাড়িতে। সে দিনও সবাই এসে গেছেন। শুধু কিশোরকুমার নেই। আরডি-র বাড়ির কাজের লোক এসে মান্না দে কে বলল, ‘‘আপনার ফোন আছে।’’ ফোনটা এসেছিল কিশোরকুমারের বাড়ি থেকেই। ফোনের ও পাশ থেকে কেউ এক জন খবর দিলেন, কিশোরকুমারের শরীর খুব খারাপ। আজ আসতে পারবেন না। উনি যেন রাহুলদেবকে খবরটা দিয়ে দেন। শোনা মাত্র সবাই ঠিক করলেন, কিশোরকুমারের বাড়ি যাওয়া হবে। প্রায় ছ’-সাতটা গাড়ির কনভয় পৌঁছাল তাঁর বাড়ি। দরজা খুলতেই দেখা গেল, পায়ের ওপর পা তুলে খবরের কাগজ পড়ছেন স্বয়ং কিশোরকুমার। মান্না দে অবাক হয়ে বললেন, ‘‘কী ব্যাপার কিশোর? তোমার নাকি খুব শরীর খারাপ!’’ শুনে মিটিমিটি হেসেছিলেন কিশোরকুমার। আর খবরের কাগজটা এক বার করে নামাচ্ছিলেন, আবার মুখ ঢাকছিলেন। রাহুলদেব ঘরে ঢুকতেই তড়াক করে লাফিয়ে মাটিতে পড়ে তাঁর থুতনি ধরে নাড়িয়ে কিশোরকুমার বলেছিলেন, ‘‘মিউজিক ডিরেক্টর, না! তাই রোজ তোমার বাড়িতে সবাই যাবে রিহার্সালে। কেন আমাদের বাড়িঘর নেই। ইচ্ছে করেই তাই এমন ফন্দি করলাম, যাতে মিউজিক ডিরেক্টরকে আমার বাড়িতে আসতে হয়।’’
কলকাতার বাড়িতে বসে গল্পটা যাকেই বলতেন, বলতে বলতে হো হো করে হেসে উঠতেন মান্না দে। তারপর বলতেন, ‘‘এই হল কিশোর। এ তো তাও রেকর্ডিং-এর আগে। রেকর্ডিং-এর দিনে আবার অন্যরকম। এমন সব কাণ্ড করতে লাগল, যেগুলো রিহার্সালে করেনি। গাইব কী, শুধু ওকে দেখে যাচ্ছি। গানটা তৈরির সময় মনে হচ্ছিল, ওকে উড়িয়ে দেব। গান যখন শেষ হল, মনে হল, আমি কিছুই করিনি। যা করার ও করেছে। এক এক সময় মনে হচ্ছিল, গানটাকে ও নিজের সম্পত্তি করে ফেলেছে।’’
আরেকটা বেশ মজার ঘটনা ঘটেছিল ‘পড়োশন’ ছবির রেকর্ডিংয়ে। সিচুয়েশন অনুযায়ী ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে গানের লড়াইয়ে মান্না দে হারিয়েছিলেন ভীমসেন যোশীকে। পড়োশনে মেহমুদের লিপে গেয়েছিলেন মান্না দে আর কিশোর কুমার গেয়েছিলেন সুনীল দত্ত , নায়কের লিপে। নায়িকা সায়রা বানুর মন পেতে নায়ক সুনীল দত্তকে তো গানের লড়াইয়ে জিততে হবে। বেঁকে বসলেন মান্না দে – ‘কভি নেহি, কিশোরের কাছে আমি হেরে যাব, এটা কেমন করে হয়?’ শেষ পর্যন্ত মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসেন স্বয়ং কিশোর কুমার। জিভ কেটে বলেছিলেন, ‘ও মান্নাদা, গান গেয়ে তো এ জন্মে আপনাকে হারাতে পারব না। সিনেমাতেই নয় মিথ্যে মিথ্যে আপনাক হারালাম।’ তার পর তো এই গান ইতিহাস হয়ে গেল। মান্না দে’র সেই অসাধারণ দক্ষিণ ভারতীয় টানে গান, পরে মান্না দে’ও বারবার স্বীকার করেছেন, ‘অমন করে গাইতে কিশোর ছাড়া আর কে পারবে?’
এলোমেলো কাজের শিরোনামে বারবার যদি আসেন কিশোরকুমার, তো খুঁতখুঁতে, পারফেকশনিস্ট চিত্র পরিচালক হিসেবে মান্না দে খুব নাম করতেন রাজকাপূরের। ছবির নাম ‘শ্রী৪২০’। বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় রাস্তায় হেঁটে চলেছেন রাজকাপূর-নার্গিস। গাইছেন ‘পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া’। মান্না দে-লতা মঙ্গেশকরের ডুয়েট। ওই গানের মহলা চলছিল রাজকাপূরের রিহার্সাল রুমে। হাজির ছিলেন শঙ্কর-জয়কিষান, লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, নার্গিস। সঙ্গে অবশ্যই রাজকাপূর। গান চলছে। বিভোর হয়ে শুনছিলেন তিনি। মাঝে মাঝে ‘এক্সপ্রেশন’ নিয়ে কিছু বলছিলেন। হঠাৎ গান থামিয়ে দিলেন রাজকাপূর। এক জনকে কাছে ডেকে কিছু একটা বললেন। কিছুক্ষণ বাদেই দেখা গেল, লোকটি ছাতা নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। সবাই অবাক! নার্গিসকে ডাকলেন রাজকাপূর। কিছু বললেন তাঁকে, তারপরই গান শুরু করার ইশারা। এ বার দেখা গেল, ছাতা নিয়ে রাজকাপূর-নার্গিস ছবির দৃশ্যের অভিনয় করে চলেছেন। গানের রিহার্সাল চলল ও ভাবেই। এ বার রেকর্ডিং। তার ঠিক আগে দেখা গেল, রাজকাপূর যেন একটু আনমনা। গানটা দু’বার টেক-ও হল। তার পরেও বললেন, ‘‘সব ভাল হচ্ছে, কিন্তু কী একটা যেন নেই।’’ বোঝালেন, ওঁর পিকচারাইজেশনের ভাবনা অনুযায়ী প্রথম অন্তরার পরে একটা আলাপ বা কিছু একটা করে মুখরায় আসতে হবে। শুনে সবাই সাজেশন দিতে লাগলেন। রাজকাপূরের মনে ধরছে না। শেষে মান্না দে গুনগুন করে একটা আলাপ করতেই লাফিয়ে উঠলেন – ‘‘এই তো, এটাই চাই।’’ সেটাই রেকর্ড হল। গানে লিপ দেওয়া নিয়েও রাজকাপূরের অসম্ভব প্রশংসা করতেন মান্না দে। ‘দিল হি তো হ্যায়’ ছবিতে ‘লাগা চুনরী মে দাগ’ যেমন। গানে তারানার একটা বড়় অংশ ছিল। মান্না দে বলতেন, ‘‘রাজসাহেব এত নিখুঁত লিপ দিয়েছেন, মনে হয় নিজেই গাইছেন!’’
শচীনকর্তার বিষয়ে মান্না দে’র কাছে ছিল অফুরন্ত স্টক। শচীন কর্তা একদিন ডেকে পাঠিয়েছেন মান্না দে কে। একটি গান নিয়ে বসতে হবে। একটু দুপুর করে আসতে বলেছেন। মান্না দে কে দেখে বললেন, ‘‘মানা, আইসা গ্যাছো! ভাল হইছে। তুমি খাইছ?’’ মান্না দে তো খেয়ে আসেননি। দুপুরে আসতে বলেছেন। মান্না দে ‘না’ বলতে শচীনদা বললেন, ‘‘অ! তাইলে তুমি বসো। আমি চারটি খাইয়া লই।’’
আর এক দিন শচীন কর্তা ও মান্নাদা খেতে বসেছেন। হঠাৎ শচীন কর্তা একটা ঘিয়ে রঙের শিশি বের করে নিজের গরম ভাতে ঢালতে লাগলেন। ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘‘তোমার বৌদি পাঠাইছে। ঘিয়ের গন্ধ দ্যাখছ? মানা, খাইবা নাকি একটু?’’ মান্না দে কিছু বলার আগেই শচীন কর্তা পরিপাটি করে ঘিয়ের শিশিটা বন্ধ করে বললেন, ‘‘আজ আর তোমার ঘি খাইয়া কাজ নাই।’’
একদিন সাতসকালে মান্না দে’র কাছে শচীনকর্তার ফোন এল। ‘‘আজ কি ফ্রি না কি রে ভাই?’’, ‘‘আজ রেকর্ডিং নেই।’’ ‘‘তোর লিগা দরবারির উপর একটা গান বাঁধছি। এক বারটি চইল্যা আয়।’’ দরাবারি। মধ্য রাতের রাগ। খুব মিষ্টি রাগ। মান্না দে’র অসম্ভব পছন্দের। শচীনদেবের মুখে শুনেই রেওয়াজে বসে গিয়েছিলেন। না জানি কী গান পাবেন তাঁর কাছে! বিকেলে কর্তার বাড়ি যেতেই শুনলেন, গানটা মেহমুদের লিপে যাবে। মান্না দে জানিয়েছিলেন, ‘‘দেখি একটা মজার গান শোনাচ্ছেন। বললাম, আরে আমায় কোনটা গাইতে হবে শোনান।’’ ‘‘এই গানটাই গাইবি।’’ কী গান? ‘জিদ্দি’ ছবির ‘পেয়ার কি আগ মে তনবদন জ্বল গয়া’। দরবারি কানাড়ার মতো একটা ভাবগম্ভীর রাগে অমন কৌতুক গান কী করে যে বেঁধেছিলেন উনি! মান্না দে বারবার বলতেন, ‘‘ওটা শচীনদার পক্ষেই সম্ভব।’’ ‘পুছনা ক্যায়সে’ গানটার গল্প এক বার শুনলে ভুলতে পারা মুশকিল। ছবির নাম ‘মেরি সুরত তেরি আঁখে’।
রাত প্রায় সাড়ে ন’টা। বাড়ির পোশাকে শচীনকর্তা হাজির মান্না দে’র ‘আনন্দন’-এ। তখন রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ। তাতে কী! শচীনদেব এসেই বললেন, ‘‘মনা, হারমোনিয়ামটা লইয়া বইস্যা বড়।’’ শেখালেন আহির ভৈরবী রাগের ওই গান। যাওয়ার সময় বললেন, ‘‘কাল রেকর্ডিং। গানটা তোর মতো করে যে ভাবে ভাল হয় গাইবি।’’ এ ছবির অন্য গান মহম্মদ রফিকে দিয়ে গাইয়েছিলেন শচীনদেব। তাতে মান্না দে’র খুব অভিমান হয়েছিল। ‘পুছনা ক্যায়সে’ গাইতে হবে শুনে বলেছিলেন, ‘‘আবার আমায় কেন! বেশ তো রফি ছিল।’’ এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছিলেন শচীনকর্তা, ‘‘তুই অত কথা কস ক্যান? এইডা তর গান। তুই-ই গাইবি।’’ যে বছর এই গান বেরোয়, সে বছর জাতীয় পুরস্কার ঘোষণার সময় শচীনদেব হাসপাতালে। মান্না দে দেখা করতে গিয়েছেন। দেখামাত্র প্রশ্ন, ‘‘কী হইল, পাইলি তুই?’’ ঘটনাটা বলতে গিয়ে মান্না দে জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার মুখে ‘না’ শুনে শচীনদা বললেন, ‘এই গানের পরও তরে দিল না! কথা শেষ হতে দেখি, শচীনদার চোখে জল।’’
আর এক রাতে এসেছিলেন শচীনকর্তা। অবশ্য ফোন করে। এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘‘মানা, এক বোতল হুইস্কি, জল আর বৌমাকে বল পাঁপড় আর নানারকম ভাজা করে আনতে।’’ মান্না দে তো শশব্যস্ত হয়ে সব ব্যবস্থা করতে লাগলেন। মনে মনে ভাবছেন শচীনদার আবার কী হল? মাথায় গন্ডগোলটোল হয়েছে নাকি! শচীন কর্তা গ্লাসে দু’চার ফোঁটা হুইস্কি ফেললেন, হোমিওপ্যাথি ডোজের মতো। জল ঢাললেন গ্লাসভর্তি। ততক্ষণে টেবিলও পাঁপড় এবং নানারকম ভাজায় ভর্তি হয়ে গিয়েছে। মান্না দে শচীন কর্তার কাণ্ড দেখছেন। গ্লাসের অতল জলে হারিয়ে যাওয়া কয়েক ফোঁটা হুইস্কি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, আর ‘অনেক খাব, অনেক খাব’ ভঙ্গি করে শুধু পাঁপড়ের ছোট্ট একটা টুকরো মুখে দিলেন। রাত একটু বাড়তে ‘বৌমা, আজ আসি গিয়া’ বলে শচীন কর্তার অন্তর্ধান। আসলে হয়েছে কী, সেদিন সন্ধ্যায় এক প্রোডিউসর ও ডিরেক্টরের আসার কথা ছিল শচীন কর্তার বাড়িতে। একটা মালয়ালি ছবিতে সুর করার জন্য। প্রচুর টাকার অফার। শচীন কর্তার কথা ছিল – ‘‘ওই ভাষাটাই বুঝি না, সুর করুম কী কইর্যা!’’ তাঁদের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকার জন্যই চলে এসেছিলেন মান্না দে’র বাড়িতে।
একজন কলাকুশলী একবার খুবই অসুস্থ। সবারই পরিচিত। শচীনকর্তা শুনে ভীষণ দুঃখ পেলেন। খুবই আহা, উহু করছেন। এমন সময় কেউ একজন একটা প্রস্তাব দিল। চিকিৎসার তো প্রচুর খরচ, বেচারি একা আর কত করবে? সামর্থ্যই বা কোথায়? আচ্ছা শচীনদা, আমরা সবাই চাঁদা তুলে কিছু টাকা সাহায্য করতে পারি না?’ এ বার শচীন কর্তা চুপ করে গেলেন। খানিক পরে বললেন – ‘তোমার মুখরাটা সুন্দর ছিল। কিন্তু অন্তরায় আইসা সুর কাইট্যা গ্যাছে।’
‘তমান্না’ ছবিতে মান্না দে’র প্রথম প্লে-ব্যাক, কিন্তু ‘মশাল’ ছবির ‘উপর গগন বিশাল’ গানটিই মান্নাদাকে শিল্পী হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠা দেয়। এই বিখ্যাত গানটি প্রদীপ (গীতিকার), শচীন দেব বর্মন (সুরকার) এবং মান্না দে’র সম্মিলিত সৃষ্টি। তখন কেউই তেমন ভাবে প্রতিষ্ঠা পাননি। ‘মশাল’ ছবির কাজ চলছে। কাজের শেষে তিন জনই কথা বলতে বলতে মালাড স্টেশন যেতেন। একদিন শচীন কর্তা দু’জনকে পিছনে ফেলে জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন। কারণটা পরে বোঝা গেল। স্টেশনের কাছে ছিল একটা ফলের দোকান। সেখানে একটু আগে পৌঁছে কয়েকটা কলা কিনলেন, দোকানি দাম চাইতে ততক্ষণে সামনে এসে যাওয়া মান্না দে’কে দেখিয়ে দিয়ে আবার দ্রুত হাঁটতে শুরু করলেন।
‘অপরাধী কৌন’ বলে একটা ছবিতে সলিল চৌধুরীর সুরে, মজরু সুলতানপুরির লেখায় একটি মজার গান গেয়েছিলেন: ফির ওহি দর্দ হ্যায়। ছবিতে সিচুয়েশন এমন, কিছু একটা ‘আনইউজড’ শুরু চাইছিলেন পরিচালক ও সঙ্গীত পরিচালক। মান্না দে একটা অদ্ভুত কাশি দিয়ে গানটা শুরু করেন। রেকর্ডিং তো হয়ে গেল। কয়েক দিন পরের ঘটনা। বেশ রাত। মান্না দে এবং বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠল। এত রাতে ফোনটোন না করে কে এল রে বাবা! মান্না দে ঘুমচোখে দরজা খুলে দেখলেন, সেই সময়ের ডাকসাইটে সঙ্গীত পরিচালক সি রামচন্দ্র। একটু মুচকি হেসে মান্না দে কে বললেন, ‘ক্যায়া খাসা মান্নাদা! সাবাশ।’ ব্যস, এই কথা বলেই অ্যাবাউট টার্ন। বুঝুন অবস্থা! মান্না দে’র কাশিটি ভাল লেগেছে, এ কথা জানাতে এত রাতে চলে এসেছেন মান্না দে’র বাড়ি।
একবার মান্না দে বাংলাদেশ গিয়েছেন অনুষ্ঠান করতে। সঙ্গে ছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। দারুণ ব্যাপার। অনুষ্ঠান ছিল ঢাকার সোনার গাঁ হোটেলে। সেদিন মান্না দে দুঃখের গানই একটু বেশি গেয়েছিলেন। অধিকাংশ গানই ছিল পুলকবাবুর লেখা। শ্রোতারা তো কেঁদে আকুল। অনুষ্ঠান শেষে মহিলারা এসে ধরলেন পুলকবাবুকে। বললেন, মান্না দে’র এত দুঃখ কেন? সেই মহিলা কত রূপসী, কত বিদুষী যে মান্না দে কে এত আঘাত দেওয়ার পরেও আড়ালে লুকিয়ে থাকে? পুলকবাবু তো তখন মনে মনে হাসছেন। মুখে বললেন, ‘‘আমি কী জানি মান্নাদার ব্যাপার? আমাকে যেমন বলেন আমি লিখে দি। আপনারা বরং মান্নাদাকে জিগ্যেস করুন।’’ সবাই এবার ছুটলেন মান্না দে’র দিকে। মান্না দে দেখলেন ভীষণ বিপদ। দুঃখ দেওয়া সেই মহিলাকে তো এঁরা বের করবেই। মান্নাদা তাঁদের প্রাণের থেকেও প্রিয়। আর তাঁকেই এত দুঃখ দেওয়া? মান্নাদা, আপনাকে বলতেই হবে তার নাম। মান্না দে তখন বললেন, ‘‘আরে এসব পুলকবাবুর ব্যাপার। আমাকে ওরকম লিখে দ্যায়, আমিও গেয়ে দি।’’
মান্না দে’র ক্রীড়া-প্রেমের কথা সবাই জানেন। সব ধরনের খেলা ভালবাসতেন। তবে ফুটবলের প্রতি ভালবাসাটা একটু বেশি ছিল। এই নিয়ে তো কত গল্প আছে। শচীন দেব বর্মন কট্টর ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, মান্না দে মোহনবাগানের সমর্থক। মুম্বাইয়ে খেলা থাকলে দেখবেনই দু’জনে। বসবেনও খেলা দেখতে এক সঙ্গে। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা চলছে, মোহনবাগান গোল করে দিল। মান্না দে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। সে দিকে তাকিয়ে শচীনকর্তা রাগে গরগর করতে করতে বলতেন – ‘তুই মোহনবাগান, মোহনবাগান কইরা মর। তর আর গান গাইতে হইব না।’
মান্না দে একবার ট্রেনে যাচ্ছেন অনুষ্ঠান করতে। সঙ্গে প্রিয় বাদ্যযন্ত্রীরা—তার মধ্যে আছে মান্নাদার প্রিয় তবলিয়া দীপঙ্কর আচার্য। ভালই গল্প-গুজব চলছে। আর মনের মতো মানুষ পেয়ে মান্না দে যে কী রকম আড্ডায় জমে উঠতেন, সেটা যাঁরা তাঁকে দেখেছিলেন তাঁরা সকলেই জানতেন। সেই একই কামরায় উঠেছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা, তাঁরা খেলতে যাচ্ছিল। মান্না দে কে দেখে সবাই ছুটে এল। এতো হাতে চাঁদ পাওয়া। আড্ডা তখন বেশ ভালই জমে উঠেছে। মান্না দে এ বার পড়লেন মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের নিয়ে। সবাই তাঁর প্রিয়, অত্যন্ত স্নেহের। অনেকের সঙ্গে মান্না দে’র ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। ফুটবল খেলাটা অন্তর থেকে ভালবাসেন। টেলিভিশনে পৃথিবীর ভাল ভাল সব খেলা দেখতেন – অধিকাংশ রাত জেগে। খেলাটা দারুণ বুঝতেন। ঠিক কয়েক দিন আগে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে হারিয়ে দিয়েছিল, মান্না দে দারুণ দুঃখে ছিলেন। এ বার মোহনবাগান প্লেয়ারদের কাছে পেয়ে মান্না দে খুব বকা-ঝকা করতে আরম্ভ করলেন। সে দিন কার কি ভুল হয়েছে তাও বলতে থাকলেন—তুমি কেন অত সময় বল হোল্ড করেছিলে, এত সিটার মিস করলে জেতা যায়, ডেড বল সিচুয়েশনগুলো একটাও কাজে লাগাতে পারলে না …? সবাই বাধ্য ছেলের মতো শুনছে। মান্না দে’র কথা শেষ হলে মোহনবাগানের সব খেলোয়াড় সমস্বরে বলে উঠেছিলেন – ‘মান্নাদা, আপনিই মোগনবাগানের কোচ হয়ে যান এ বার।’
একবার ভারতীয় ফুটবল দল যাচ্ছে আফ্রিকায়- শুভেচ্ছা সফরে। দলে রয়েছেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত। মান্না দে’র অত্যন্ত প্রিয় ফুটবলার। একই ফ্লাইটে মান্না দে’ও যাচ্ছেন অনুষ্ঠান করতে, সঙ্গে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। গন্তব্য লুসাকা। তখন ভোর হয়ে এসেছে। অভ্যাসবশত সবারই চায়ের প্রয়োজন। মান্না দে বেল বাজালেন। সঙ্গে সঙ্গে এয়ারহোস্টেস উপস্থিত। মান্না দে জানালেন ক’কাপ চা লাগবে। চা আর আসে না। এ বার বিরক্ত হয়ে সুরজিৎ বেল বাজালেন। এয়ারহোস্টেস আবার এল। চায়ের প্রতিশ্রুতি আবার পাওয়া গেল। কিন্তু যথারীতি চা আর এল না। সেটি ছিল ‘কিনি’ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট। তখনও মান্না দে’র অসাধারণ রসবোধ। বললেন- ‘সুরজিৎ, এটা কী ‘কিনি’ এয়ারওয়েজ, নাকি ‘দুখিনি’ এয়ারওয়েজ?’
ফুটবল নিয়ে মান্না দে’র বিখ্যাত গান – ‘আহা, সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ – ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে গেয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষের সুরে। এই গানটি তো আজ বাঙালির ‘ফুটবলের জাতীয় সঙ্গীত’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কলকাতার খেলার মাঠে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে খেলার মাঠে কয়েক জন ফুটবলপ্রেমী মারা যায়। অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কবিতা লেখেন এই ঘটনা নিয়ে। সূপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে হৃদয় নিংড়ে সেই গান গেয়েছিলেন মান্না দে।
২০০৭ সালে ওয়ান-ডে বিশ্বকাপের সময়ে ক্রিকেট নিয়ে একটা অসাধারণ গান গেয়েছিলেন মান্না দে – ‘জীবনটা ভাই ওয়ান-ডে ক্রিকেট/ভাগ্যের বলে কখনও সুইং/কখনও গুগলি, কখনও স্পিন/ব্যাটে-বলে হয়ে গেলে ছক্কা/ফসকালেই ফক্কা, ফক্কা।’ গানের দ্বিতীয় অন্তরায় মান্না দে প্রিয় কয়েক জন ক্রিকেটারের নাম রেখেছিলেন। যখন গানের প্রস্তুতি চলছে, তখন সৌরভ গাঙ্গুলী ভারতীয় টিমে নেই। স্বভাবতই গানে সৌরভের নাম ছিল না। মান্না দে বলেছিলেন – গান রিলিজ হতে এখনও তো অনেক দেরি আছে। তত দিনে বিশ্বকাপের সময় সৌরভ ঠিক টিমে ফিরে আসবে। রাখা হল সৌরভের নাম। দেখা গেল সৌরভও টিমে ফিরে এসেছে। মান্নাদা খুব খুশি হয়েছিলেন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় ক্রিকেটার সৌরভ টিমে ফিরে আসাতে আর গানেও সচিন-দ্রাবিড়ের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত হওয়ায়।
অনেকের ধারণা মান্না দে খব রাগী মানুষ ছিলেন। আসলে ওটা বাইরের আবরণ। ভিতরে ছিল এক অন্য মানুষ। ভীষণ ইমোশনাল এবং অসম্ভব রসবোধ ছিল তাঁর। মান্না দে’র সঙ্গে দুর্লভ আড্ডার সঙ্গী যারা হতে পেরেছেন, ধনী হয়েছেন অমূল্য অভিজ্ঞতার ধনে। মান্না দে বলতেনও এত সুন্দর, অতি রামগরুড়ের ছানাও না হেসে পারত না। নির্ভেজাল আড্ডার সময় কোনও ধরনের ডিস্টার্বেন্স মান্না দে পছন্দ করতেন না। একবার কাছের মানুষের সঙ্গে তাঁর আড্ডা জমে উঠেছে। এমন সময়ে একটা ফোন এল। মান্না দে ফোন ধরলেন। যিনি ফোন করেছিলেন, তিনি মান্না দে’র গলা শুনেই খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। সে কী যেন বলছিলেন, আর মান্না দে তাঁকে থামিয়ে বারবার বলছিলেন, ‘‘না না, আমি মান্নাদা নই। উনি তো বারাসতে ফাংশন করতে গিয়েছেন। আমি ওনার ছোট ভাই প্রভাস দে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন ভাই! আমাদের দু’জনের গলা প্রায় একরকম।’’ ফোন রেখে মান্না দে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, কী যে চায় পরিষ্কার করে বলতেই পারে না। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন শ্রী দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী।
আরেকবার মান্না দে’র পরিচিত এক গীতিকার তাঁর জন্য একটা গান লিখে নিয়ে এসেছেন। মান্না দে সেটা পড়ে বললেন, ‘‘ভালই তো লিখেছেন।’’ এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। এবার গীতিকার ভদ্রলোক অতি উৎসাহে বললেন, ‘‘এ গানের আমি একটা সুরও করেছি। আপনাকে শোনাই।’’ মান্না দে কে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ভদ্রলোক গানটি গাইতে লাগলেন। গান শেষ হতে মান্না দে বললেন, ‘‘আপনিই গানটা রেকর্ড করুন। সেটাই ভাল হবে।’’ এমন সময় ছোট ছোট গুটকা শিঙাড়া এসে গিয়েছে এক ঠোঙা। একদম হাতে গরম। মান্না দে চোখের ইশারায় ঠোঙা খুলতে বারণ করলেন। সেই গীতিকার ভদ্রলোক অনেকটা সময় কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর মান্না দে বলেছিলেন, এবার সবাই শিঙাড়া খান। চা-ও আসছে। একজন বলেছিলেন, একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে মান্নাদা। মান্না দে সেই স্বর্গীয় হাসি হেসে বলেছিলেন, গানের যা সুর করেছে, ওকে শিঙাড়া খাওয়ানো যায় না।
মান্না দে’র অসাধারণ রসবোধের আরও একটা ঘটনা, তখন সলিল দত্তের ‘ঘরের বাইরে ঘর’ ছবির কাজ চলছে। গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্না দে গাইবেন ‘আয় বৃষ্টি রে’। মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপঙ্কর আচার্যকে নিয়ে মদন ঘোষ লেনে এসেছেন মান্না দে কে গানটা শোনাতে। সঙ্গে তবলা থাকলে গানটা গাইতে এবং শোনাতে সুবিধা হয়। গানের এমন সিটিংয়ে এবং আড্ডায় চা এবং স্ন্যাক্স সহযোগে মান্না দে অসাধারণ আপ্যায়ন করতেন- কোনও দিনই সেটার অন্যথা হয়নি। গান চলছে, পকোড়া এল এক প্লেট। সবাই খাচ্ছে। দীপঙ্কর আচার্য দু’হাত দিয়ে তবলা বাজাচ্ছিলেন, প্লটটাও দূরে। দীপঙ্কর আর খাওয়ার সুযোগ পেল না। প্লেট শেষ। আবার প্লেট ভর্তি গরম গরম পকোড়া এল। এ বার দীপঙ্কর প্লেটটা তাঁর পাশে এনে রাখলেন। এক হাতে তাল রেখে, অন্য হাত দিয়ে মাঝে মাঝে প্লেট থেকে পকোড়া তুলে মুখে দিচ্ছিলেন। রসিক মান্না দে সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। তারপরে যতবারই দীপঙ্কর আচার্য এক হাতে তাল রেখে, অন্য হাতে পকোড়া তুলেছিলেন, মান্না দে ততবারই বলে উঠেছিলেন – ‘কেয়া বাত কেয়া বাত’।
রসিকতার সাহায্যে মান্না দে উৎসাহিত করতেন মিউজিশিয়ানদেরও। ২০০৬ সাল। দমদমে এইচ এম ভি স্টুডিয়োতে মান্না দে’র পুজোর গানের রেকর্ডিং চলছে। তিনি মিউজিকের সঙ্গে লাইভ গাইছেন। টেক চলছে। মান্না দে গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে গেলেন। রেকর্ডিস্ট, মিউজিশিয়ানরা সবাই সন্ত্রস্ত। কারও কি ভুল হয়েছে? তা নয়। মান্না দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘‘সেতারটা কী দারুণ বাজাচ্ছ রাহুল (চট্টোপাধ্যায়), এমন বাজালে গাই কী করে?’’ মান্না দে’র কথা শুনে রাহুল দ্বিগুণ উৎসাহে আরও ভাল বাজাতে শুরু করলেন।
আর একবারের ঘটনা। ফাইনাল টেকের আগে রিহার্সাল চলছে। মান্না দে গাইছেন। চারপাশে বসে মিউজিশিয়ানরা বাজাচ্ছেন। হঠাৎ হাতের ইশারায় মান্না দে বাজানো বন্ধ করতে বললেন। দেখা গেল তখনও একটা গিটার বেজে চলেছে। মান্না দে বললেন, ‘‘তোমরা ভূতের বাজনা শোনো।’’ আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছিল, একটি অল্পবয়সি ছেলে গিটার বাজাতে এসেছিল। ফ্লোরে এসে সে জানেছিল মান্না দে’র সঙ্গে বাজাতে হবে। তাই ভয় পেয়ে, নার্ভাস হয়ে একটা থামের আড়ালে বসে বাজাচ্ছিল। সে কথা শুনে মান্না দে একটু জোরে বলেছিলেন, ‘‘আরে ভাই, আপনি তো দারুণ বাজাচ্ছেন। সামনে আসুন, আপনার সঙ্গে একটু পরিচয় করি।’’ তারপরে ছেলেটি সবাইকে টপকে মান্না দে’র পাশে বসে বাজিয়েছিল।
তবে মান্না দে’র সঙ্গে একবার ভীষণ রসিকতা করেছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক দেবী শেঠী। বেঙ্গালুরুতে ড. শেঠীর হাসপাতালে তখন মান্না দে ভর্তি ছিলেন। বাড়ি ফিরবেন কিন্তু ড. শেঠী কিছুতেই হাসপাতালের বিল দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন, তা কী করে হয় স্যার! বাবা আপনার গানের অন্ধ ভক্ত, আমিও আপনার গান শুনে বড় হয়েছি। আপনার চিকিৎসার জন্য কী করে টাকা নিই? মান্না দে কিন্তু বিল দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। শেষে ড. শেঠী বিল নিয়ে এলেন। সব খরচের পাশে লেখা ‘নিল’। মান্নাদাকে বললেন, আপনি বিল চেয়েছিলেন, আমিও দিলাম।
রসিকতা করেও এমন শ্রদ্ধা প্রকাশ করা যায়!
ভারতীয় সঙ্গীত জগতের কিংবদন্তী গায়ক মান্না দে ছিলেন খাদ্যরসিক। খেতে এবং খাওয়াতে ভীষণ ভালবাসতেন। মান্না দের স্ত্রী সুলোচনা দেও রন্ধনশিল্পে অত্যন্ত পটিয়সী ছিলেন। দক্ষিণ ভারতীয়, উত্তর ভারতীয়, মোগলাই, চিনে, কন্টিনেন্টাল থেকে বিশুদ্ধ বাঙালি সব রকমের রান্নাতেই তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। মান্না দে সুলোচনার হাতের তৈরি রকমারি রান্না খুব তৃপ্তি সহকারে খেতেন। মান্না দে নিজেও খুব ভাল রান্না করতেন। মাঝে মধ্যে দীর্ঘ ব্যস্ততার মাঝে একটু অবকাশ পেলেই বাড়িতে হাতা খুন্তি হাতে ভজহরি মান্না রূপে অবতীর্ণ হয়ে রকমারি রান্না শুরু করতেন। স্ত্রী দুই কন্যা তো বটেই, এ ছাড়া বন্ধু-বান্ধব চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতের বহু বিখ্যাত মানুষজনকেও তিনি রান্না করে যত্ন করে খাইয়ে তৃপ্ত হতেন। একই ভাবে মান্না দে মুম্বই ও কলকাতার বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁর বিখ্যাত পদের রসাস্বাদন করতেন তারিয়ে তারিয়ে। কলকাতায় এলে বহু বিখ্যাত হোটেল রেস্তোরাঁতেই খেতে যেতেন বা খাবার আনাতেন। তবে চাঁদনি মেট্রো স্টেশনের কাছে দক্ষিণ ভারতীয় রেস্তোরাঁয় গিয়ে ধোসা, ইডলি, উত্তপম, পকোড়া, দইবড়া খেতেন। এবং কলকাতার পরিবারের লোকজনদের জন্য পার্সেল নিয়ে আসতেন। গিরিশপার্কের কাছে নিরঞ্জন আগারের ডিমের ডেভিল, মাটন কোপ্তা, ব্রেস্ট কাটলেট আনিয়ে খেতেন। আর ভজহরি মান্নার বাঙালি খাবারের প্রতি দুর্বলতা ছিল। কখনও ভজহরিতে গিয়ে বা হোম ডেলিভেরি আনিয়ে জমিয়ে ইলিশ, চিংড়ি, পাবদা থেকে শুক্তো সবই খেতেন।
যে-কোনও বিষয়ে মান্না দে’র জ্ঞান এবং আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তবে গানের পরেই নিশ্চিত ভাবে তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল স্পোর্টস—খেলাধুলো। একানব্বই বছর বয়স পর্যন্ত মান্না দে সারা পৃথিবী দাপিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। আজ আমেরিকা তো কয়েক দিন বাদে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য। কোনও যুবকও হার মানবে তাঁর কাছে। আসলে সংযমী জীবন-যাপন এবং ছোটবেলায় আখড়ায় নিয়মিত কুস্তিচর্চার প্রভাব ছিল আজীবন। সুঠাম, ঋজু দেহ। গীতিকার শ্যামল গুপ্ত একবার সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন। মান্না দে তাঁর থেকে তিন বছরের বড় ছিলেন। কিন্তু শ্যামলবাবুকে অবাক করত, যখন তিনি বয়সের ভারে গৃহবন্দি, মান্না দে তখন পৃথিবীর নানা দেশে অনুষ্ঠান করছেন, গানের রেকর্ডিংও সমান ভাবে চলছে।
২০০৩ সাল। পার্কস্ট্রিটে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড স্টুডিওতে মান্না দে’র ‘আমার প্রিয় মনীষী’ অ্যালবামের রেকর্ডিং চলছে। তখন তাঁর শরীর খুব খারাপ। হার্টের একটা সমস্যা হচ্ছে। মুড একদম খারাপ। তবুও তিনি সবার আপত্তি অগ্রাহ্য করেই রেকর্ডিং করতে চলে এসেছেন – মিউজিশিয়ানদের একটা কাজের দিন নষ্ট হবে তাঁর জন্য, এটা মানতে পারছেন না। এ দিকে বেসমেন্টে ওয়াশরুমও নেই। হাতলহীন সিঁড়ি বেয়ে ওই শরীরে উপরেও উঠতে হচ্ছে। সবাই জানতেন, মান্না দে’র রেকর্ডিংয়ে প্রয়োজনীয় লোকজন ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। তখন তবলার প্যাটার্ন নিয়ে জোরদার রিহার্স্যাল চলছে। এমন সময় সেখানে ঢুকলেন ফুটবলার (তখন কোচ) সুব্রত ভট্টাচার্য। সকলে প্রমাদ গুনলেন। কিন্তু অবাক হয়ে সকলে দেখলেন, তাঁরা যা ভেবেছিলেন একেবারে তার উল্টো ব্যাপার ঘটল। সুব্রতবাবুকে দেখে মান্না দে’র যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ আনন্দে ভরে গেল। মান্না দে খুশি হলে বাঙাল কথা বলতেন – ‘আরে সুব্রত যে, আইসো, আইসো, কী খবর বলো।’ তখনও অবাক হওয়ার বাকি ছিল। দেখা গেল কলকাতার ফুটবলের সব খবরই তাঁর নখদর্পণে। মোহনবাগানের ব্যারেটোর খেলার ধরনের সঙ্গে তাঁর আগের পায়াসের খেলার মিল কোথায় সে আলোচনা চলল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মান্না দে’র মুডও ভাল হয়ে গেল। মিউজিসিয়ানদের রেডি হতে বলে মান্না দে ফিরে গেলেন রেকর্ডিংয়ে। ডুবে গেলেন গানের সমুদ্রে। তখন তিনি অন্য মানুষ।
সহকর্মীদের ভীষণ ভাবে খেয়াল রাখতেন মান্না দে। আশির দশকে কাকদ্বীপে একটা বিরাট অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল – সব নামী শিল্পী – সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কিছু দিন আগে মান্না দে’ও সেখানে অনুষ্ঠান করে গিয়েছিলেন। তখন এক বিপত্তি ঘটে। খোদ ডাকাতদের কবলে পড়েছিলেন মান্না দে। যখন শুনলেন ওখানে অনুষ্ঠান করতে অন্য শিল্পীরা যাচ্ছেন, মান্না দে ফোন করে সবাইকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, কোনও বিপদ যাতে না ঘটে তার জন্য আগাম কী কী করণীয় তাও বলে দিয়েছিলেন। মান্না দে’র গুণমুগ্ধ কে নয়! নিজের মতো করে সবাই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নানা সময়ে। ‘মধুবালা’র সুরকার জয়দেব খুব ভাল কথা বলেছিলেন – ‘মান্নাদাকে প্রথমে গাইতে দিন। তার পর মুকেশ, তালাত মেহমুদ, হেমন্তকুমার, কিশোরকুমার, এমনকী মহঃ রফিও গাইবার সাহস দেখাবে না।’
এমন কোমল হৃদয় ছিল তাঁর। তিনি মস্তিস্ক দিয়ে সঙ্গীত-বিদ্যা আহরণ করেছিলেন। আর হৃদয়ের অমৃর-রসে সেই বিদ্যা চুবিয়ে তিনি উপহার দিয়ে গিয়েছেন এক একটা অমূল্য রত্ন। আমরা তাঁকে ‘মান্না দে’র গান’ বলেই জানি।
একবার সদলবলে গাড়ি করে মান্না দে বাঁকুড়ায় যাচ্ছেন অনুষ্ঠান করতে। পথে একটা গ্রাম পড়ল। মান্না দে দেখলেন বিরাট একটা মোট মাথায় নিয়ে একজন বয়স্ক কৃষক চলেছেন—হয়তো কোনও দূরের হাটে বেচতে। ভারী মোটের ওজনে শরীর নুয়ে পড়েছে। আরও কত দূর যেতে হবে কে জানে! মান্না দে গাড়ি থামালেন। সেই কৃষকের কাছ থেকে ওই মোটের মধ্যে যত সব্জি ছিল সব কিনে নিলেন—প্রচুর লাউ, কুমড়ো, কপি আর সব কিছু। সবাই বলল, ‘মান্নাদা এত সব্জি নিয়ে কী করবেন?’ মান্না দে বললেন, ‘তোমরা ভাগ করে নাও। মানুষটার এত বয়স হয়েছে। এই বয়সে এই ভার বওয়া ওর পক্ষে সম্ভব? আমি বোঝাটাকে একটু হাল্কা করে দিলাম শুধু’।
লতা মঙ্গেশকর সম্বন্ধে মান্না দে বলতেন, ‘লতা যদি শুধু ক্লাসিকাল গাইত, তা হলে সমান ভাবে সফল হত। সবার আগে ও-ই থাকত।’ আর মান্না দে সম্পর্কে লতা মঙ্গেশকর কী বলেছিলেন? লতা মঙ্গেশকর কয়েক প্রজন্মের শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। সবার সম্পর্কে কিছু না কিছু কথা লতা মঙ্গেশকরের মুখে শোনা গিয়েছে। কিন্তু সে সব কিছু ছাপিয়ে যায় মান্না দে’র জন্য লতা মঙ্গেশকরের শ্রদ্ধা। মান্না দে এবং লতা মঙ্গেশকর একশোর বেশি ডুয়েট গান গেয়েছিলেন হিন্দি ছবিতে। লতা মঙ্গেশকর জানিয়েছিলেন, ‘সংখ্যার দিক থেকে মান্নাদার সঙ্গে আমার ডুয়েট গান হয়তো মহঃ রফি বা কিশোর কুমারের থেকে কম, কিন্তু গুণগত মান বা মানুষের মনে যা চিরদিন রেখাপাত করবে, সেই বিচার করতে গেলে মান্নাদার গান তাঁদের থেকে কোনও অংশে কম নয়।’
সুরকারেরা মান্না দে কে সুরটি দিয়ে যেতেন। সেই গান মান্না দে তাঁর অসাধারণ ইম্প্রোভাইজেসনে এমন জায়গায় নিয়ে যেতেন, এক একটি নতুন সুর নতুন গান হয়ে যেত – অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এ জন্য প্রায় সব সুরকার মান্না দে কে সুরটি দিয়ে বলতেন, ‘একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নেবেন মান্নাদা।’ লতা মঙ্গেশকর তো অহরহ দেখেছিলেন মান্না দে তাঁর অনন্য সাংগীতিক বোধ দিয়ে এক একটি গানের রূপ নির্মাণ করতেন। মান্না দে’র গুণমুগ্ধ লতাজি বহুবার জানিয়েছেন, ‘একজন দক্ষ কনে সাজিয়ে যেমন বিয়ের দিন একজন সাধারণ জনকেও অসাধারণ সুন্দরী করে সাজিয়ে তোলেন, মান্নাদাও সুরকারদের দেওয়া অনেক গান নিজের মতো করে গেয়ে সেই গান সুপারহিট করিয়ে দিয়েছেন।’ একবার এক সঙ্গীত সমালোচক লতা মঙ্গেশকরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন – ‘সুরকাররা কেন অধিকাংশ ক্লাসিকাল গান মান্নাদাকে দিয়ে গাওয়ান?’ লতা মঙ্গেশকর জানিয়েছিলেন, ‘আমি তার কথার কোনও উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর দেবই বা কী করে? ওই সব গান মান্নাদা ছাড়া কে-ই বা গাইতে পারবে? এ কথা যদি আমি বলি, অন্য শিল্পীরা তো দুঃখ পাবেন। তবে এটাই সত্যি। মান্নাদার মতো পাল্লা দিয়ে কে পারবে ভীমসেন যোশীর সঙ্গে গাইতে। সিচুয়েশন চাইছে ঠিক, তবু এমন তো গেয়েছিলেন মান্নাদাই, গানে জিতেছিলেন।
মান্না দে’র প্রতি নরম শ্রদ্ধাশীল আশা ভোঁসলে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের দুঃখ কিন্তু একই জায়গায়। আশা ভোঁসলে তো বহু বার বলেছেন – ‘হিন্দি সিনেমা মান্নাদাকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেনি। যদি পারত, তবে রফি-কিশোর কুমারের মতো মান্নাদার গানেরও একটা যুগ তৈরি হত। একবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মান্না দে’কে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘হিন্দি ছবিতে নায়কের লিপে আপনার এত কম গান কেন?’ জানা যায়, মান্না দে অন্ধকার মুখে উত্তর দিয়েছিলেন! কী আর করব বলুন? তেমন গান না পেলে আমিই বা কি করি? যা করার তা করে দিয়েছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় পরে জানিয়েছিলেন, ‘মান্নাদা একজন ভার্সেটাইল সিংগার। সব ধরনের গান গাইতে পারেন। ডেলিভারিটা দারুণ। নাটকীয়তা দারুণ। উচ্চারণ পরিষ্কার। গলায় সুর খোলে দারুণ।’
মান্না দে’র গায়কি তৈরিতে বিশেষ অবদান ছিল সুরকার অনিল বিশ্বাসের। মান্না দে সম্পর্কে তিনি একটি অসাধারণ মন্তব্য করেছিলেন – ‘অন্য শিল্পীরা যে সব গান গেয়েছে, সে সব গান সমান দক্ষতায় মান্না গেয়ে দিতে পারবে। কিন্তু যে সব গান মান্না গেয়েছে, অন্য কেউ সে ভাবে সে গান গাইতে পারবে না।’ ‘ঋতু যায়ে’ গানে একই সঙ্গে চারটি রাগে মান্না দে’কে দিয়ে গাইয়েছিলেন অনিল বিশ্বাস। আবার সেই মান্না দে’কে দিয়েই গাইয়েছিলেন অসম্ভব ভাল সেই সব রোম্যান্টিক গান – ‘তেরা হাত হাতো মে আগয়া’, ‘মেরে মন কি ধড়কন’, ‘ও ঘায়েল করতে হ্যায়’। অনিল বিশ্বাস ঠিকই বলেছিলেন, এমন বৈচিত্রময় গায়কি একমাত্র মান্না দে’র ছিল, আর কারও নয়।
সব কিছু সত্ত্বেও হিন্দি গানে নিজের অবস্থান নিয়ে মান্না দে’র মধ্যে একটা চাপা অভিমান কাজ করত। মজা করে বলতেন – ‘রফি মিঞা এক নম্বর, কিশোর কুমার দু নম্বর আর আমি নম্বর-টম্বরে নেই। আমি হলাম গিয়ে চিরকালের স্ট্রাগলার।’ মান্না দে’র সঙ্গীত-জীবনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হয়েছিল কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। সেই প্রসঙ্গে মান্না দে বলেছিলেন, ‘সঙ্গীত জীবনের পঞ্চাশ বছর নয়, বলা ভাল আমার সংগ্রামী জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হল।’
মান্না দে অনেক বার বলেছেন, তাঁর বাংলা গানের প্রকৃত শ্রোতা বাংলাদেশের মানুষ। সত্যিই তাই। তিনি দুঃখ করে বলতেন, ‘এখানে তো সবাই ঘুরে-ফিরে ওই কুড়ি পঁচিশটা বাংলাগানই শুনতে চায়। মনে হয় ‘আমায় একটু জায়গা দাও’ গানটা ছাড়া গত পঁচিশ বছরে আমি আর কোনও গান রেকর্ড করিনি। কিন্তু বাংলাদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখেছি, ওরা আমার সব গানের খবর রাখে। ওরা অন্য গানের সঙ্গে শুনতে চায় ‘দুঃখ আমাকে দুঃখী করে নি’, ‘যে সমাধি বেদিটার’, ‘মিষ্টি একটা গন্ধ’, ‘চিঠি লিখে ভুলে গেলে জুড়ে দিতে খাম’, ‘সহেলি গো’ – এই সব কত গান। সব অনুষ্ঠানে ওরা অনুরোধ করবেই ‘তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে’ গাইবার জন্য। বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে কি অসাধারণ গান লিখেছিলেন মিন্টু ঘোষ। তাঁর লেখা বিখ্যাত ‘বড় একা লাগে’ আমার বড় প্রিয়। এখানে তো এ সব গান কেউ শুনতে চায় না। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন, বাংলাদেশের মানুষরা অনেক সময় এমন গানের জন্য অনুরোধ করেন, না-গাইতে গাইতে আমি হয়তো কথা সব ভুলে গিয়েছি। ওরাও ছাড়বার পাত্র নয়। বলছে, আপনি গাইতে থাকুন, ‘কথা’ আমরা মনে করিয়ে দেব। কী আশ্চর্য সব গানের কথা ওদের মুখস্থ।’
এই বাংলার মনীষীদের নিয়ে মান্না দে’র অসাধারণ গানের অ্যালবাম ‘আমার প্রিয় মনীষী’ – সে রকম ভাবে অনেকে এখানে শোনেননি। অথচ বাংলাদেশে গানগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এমনকী সেই অ্যালবামের ‘পাইরেসি’ পর্যন্ত রয়েছে। ‘পাইরেসি’ – অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু জনপ্রিয়তার যে মাপকাঠি, তা অস্বীকার করবেন কি করে? আবার সেই বাংলাদেশে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে মান্না দে বাধাপ্রাপ্তও হয়েছেন। হলের বাইরে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন। ধন নয়, মান নয়, – তাঁদের একটাই অনুরোধ ছিল, শুয়ে পড়া মানুষদের উপর দিয়ে হেঁটে মান্না দে যেন হলে প্রবেশ করেন। সঙ্গীতের ঈশ্বর এসেছেন। তাঁর পায়ের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া যায়? অনেকের কাছেই এই স্মৃতিচারণ করতেন মান্না দে। বলতে বলতে তাঁর চোখে জল এসে যেত, যে শুনতো তাঁরও। ২০১০ সালের ১লা মে মহাজাতি সদনে ভারতবর্ষে মান্না দে’র শেষ অনুষ্ঠানে প্রায় এ রকমই ঘটনা ঘটেছিল। অনুষ্ঠান শেষ। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, একবার মান্না দে কে ছুঁয়ে দেখার জন্য। অবশেষে বিরাট পুলিশ বাহিনী এসে সবাইকে করজোড়ে অনুরোধ করে মান্না দে কে যাওয়ার পথ করে দেয়। দু’চোখে চিক চিক করা জল নিয়ে মান্না দে সেদিন ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর মদন ঘোষ লেনের বাড়িতে।
মেলামেশার ব্যাপারে মান্না দে ছিলেন খুবই সিলেকটিভ। পেশাগত ভাবে অনেকের সঙ্গে মিশতে হত সে অন্য কথা। কিন্তু মান্না দে’র পছন্দের মানুষ ছিল খুবই সীমিত। যেহেতু মান্না দে ছিলেন খেলা-অন্ত প্রাণ, বেশ কিছু ক্রীড়া-সাংবাদিক ছিলেন তাঁর অত্যন্ত কাছের। শুধু কলকাতার আড্ডায় নয়, বেঙ্গালুরুতে মান্না দে’র বাড়িতে যে সামান্য কয়েক জনের যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে, তার মধ্যে বেশ কয়েক জনই মান্নাদার প্রিয় ক্রীড়া সাংবাদিক। মান্না দে’র গান নিয়ে সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখা হত। এর মধ্যে প্রচুর আর্টিকেলই ক্রীড়া-সাংবাদিকদের লেখা ছিল। কিছু কিছু লেখা তো বিষয় এবং ভাবনায় খুবই মূল্যবান। মান্না দে’র গানের উপরে কিছু ক্রীড়া-সাংবাদিকের গবেষণামূলক নিবন্ধ ও বইও রয়েছে। মান্না দে প্রায়ই অবাক হয়ে বলতেন—‘আশ্চর্য এদের প্রতিভা। পেশাগত কারণে খেলাধুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকবে এটা স্বাভাবিক কিন্তু গান-বাজনার ব্যাপারেও ওদের পাণ্ডিত্য এবং পড়াশোনা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।’ একদিন আলোচনা প্রসঙ্গে মান্না দে বলেছিলেন, ‘আমি তো একটু-আধটু গানটাই শুধু পারি, ওরা খেলাও বোঝে, গানটাও বোঝে।’
দেরিতে হলেও মান্না দে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার পেলেন। শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমস্ত পৃথিবী থেকে সানন্দ প্রতিক্রিয়া হল। ব্যতিক্রম শুধু তাঁর জন্মভূমি কলকাতা। কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। মান্না দে খুবই ব্যথিত হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত মান বাঁচালো এক ক্রীড়া সংস্থাই। ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কারপ্রাপ্তিকে সামনে রেখে মান্নাদাকে নিয়ে একটা অসাধারণ অনুষ্ঠান করল কলকাতায়। ক্রীড়া জগতের বহু নক্ষত্র এসেছিলেন সে দিন। তাঁদের দেখে মান্না দে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে কারণে মান্না দে’র ওই পুরস্কার পাওয়া, সেই চলচ্চিত্র জগত থেকে প্রায় কেউই আসেননি। শুধু মৃণাল সেন এসেছিলেন মান্না দে’র ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে।
একটা ঘরোয়া গেট-টুগেদার। মধ্যমণি মান্না দে। আড্ডা এবং গান। মান্নাদার প্রিয় ফুটবলার পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন। তার কিছু দিন আগেই তিনি তাঁর সহধর্মিণীকে হারিয়েছেন। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রদীপবাবু গাইতে শুরু করলেন—‘সেই তো আবার কাছে এলে’— খানিক ক্ষণ গাওয়ার পরে কাঁদতে লাগলেন, গলা আটকে এল। মান্না দে সস্নেহে হাত রেখেছিলেন প্রদীপবাবুর পিঠে। তার পর সে গান নিজে গেয়ে সম্পূর্ণ করেছিলেন।
মান্নার বিখ্যাত আড্ডার সঙ্গী যাঁরা হতে পেরেছেন, তাঁরা সত্যিই ভাগ্যবান। অবশ্য ২০১০ সালের পরে মান্না দে আর কলকাতায় আসেননি।
মান্না দে’র নিজের প্রিয় কোন গানটি? জিজ্ঞাসা করলে মান্না দে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু কেউ যদি জানতে চাইত তাঁর প্রিয় অ্যালবাম কী, সব সময় মান্না দে বলতেন – ‘মধুশালা’। বাঙালিরা এই অসাধারণ অ্যালবামের গান বিশেষ শোনেনি। এটা মান্না দে কে খুব দুঃখ দিত। অমিতাভ বচ্চনের বাবা হরিবংশ রাই বচ্চনের লেখা কবিতায় জয়দেবের অসাধারণ সুরারোপ। প্রথমে শিল্পী হিসেবে ভাবা হয়েছিল রফি, মুকেশের কথা। কিন্তু উর্দু উচ্চারণ এবং শিক্ষিত গায়কির জন্য মান্না দে’ই গায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। বিপত্তি ঘটল রেকর্ডিং-এর সময়। মান্না দে’র গাড়িতে স্টুডিও যেতেন, সঙ্গে যেতেন হরিবংশ রাই এবং তাঁর স্ত্রী তেজি বচ্চন। গাড়ি মান্না দে’ই চালাতেন। বচ্চন দম্পত্তির মান্না দে’র গাড়ি চালানো সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। মান্না দে এত জোরে গাড়ি চালাতেন, মনে হত রাস্তা দিয়ে গাড়ি উড়ে যাচ্ছে। তেজি বচ্চন তো ভয়ে চিৎকার শুরু করে দিলেন। তার পরে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা মান্নাদা, আপনাকে কে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েছে বলুন তো?’ মান্না দে যেন একটু চিন্তা করে বললেন – ‘বোধহয় বোম্বে মোটর ভেহিকেলস।’
অপ্রিয় হলেও কথাটা সত্যি। এত প্রতিভা এবং যোগ্যতা কা সত্ত্বেও মান্না দে কেন তুলনায় কম গান পেতেন? এ নিয়ে বহু দিন ধরে বহু চর্চা হয়েছে। অনেক কারণ ছিল। তার মধ্যে একটা অন্যতম কারণ কম আলোচিত। অনেক সুরকারই মান্নাদার কাছে আসতে ভয় পেতেন, পাছে তাঁদের অজ্ঞতা ধরা পড়ে যায়। মান্না দে’র মতো এত সঙ্গীতবোধ তো আর কারও মধ্যে নেই। তিনি ছিলেন স্পষ্ট বক্তা। সত্যি কথা মুখের উপর বলে দিতে বাধত না। এই ভুল (?) কিন্তু অন্য শিল্পীরা করতেন না। চুপচাপ গানটা গেয়ে দিতেন। ভালই হয়েছে মান্না দে এমন ভুল(?) করতেন, নইলে তিনি তো সবার সঙ্গে এক ব্রাকেটে থেকে যেতেন।
বাংলার মা রত্নগর্ভা। যে দিকেই ফিরে তাকানো যায়, আমরা পেয়েছি অসাধারণ সব প্রতিভা – সাহিত্যে, রাজনীতিতে, চিত্রশিল্পে, নাটকে, চলচ্চিত্রে, শিল্পসংস্কৃতির প্রতিটি শাখায়। সঙ্গীতের কথা বললে – এই বাংলার মতো শিল্পীসমন্বয় আর কোথাও ঘটেনি। শুধু আধুনিক গানের পুরুষ শিল্পীদের কথাই ধরুন। কাকে ছেড়ে কার কথা বলা যায় – পঙ্কজ মল্লিক, সুধীরলাল, রবীন মজুমদার, জগন্ময় মিত্র, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সত্য চৌধুরী, অখিলবন্ধু, মানবেন্দ্র, শ্যামল, সতীনাথ – সর্বোপরি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং মান্না দে। শ্রোতা মাত্রই বলবেন, অসাধারণ, কালজয়ী কত গান আমরা উপহার পেয়েছি এঁদের কাছ থেকে। আনন্দে ভাগ করেছি, বিরহে কেঁদেছি সেই সব গানে – সব সত্যি। কিন্তু সবার থেকে আলাদা মান্না দে এবং মান্না দে-র গান। তিনি একক, তিনি অনন্য। সবার থেকে আলাদা। মান্না দে।
মান্না দে নামটা একক হিসেবে সবার আগে থাকে। তার পর ব্র্যাকেট শুরু হয়।
(তথ্যসূত্র:
১- জীবনের জলসাঘরে: পূর্ণাঙ্গ আত্মকথা, মান্না দে, আনন্দ পাবলিশার্স (২০০৫)।
২- সুরের সূর্য কৃষ্ণচন্দ্র মান্না দে, অভীক চট্টোপাধ্যায়, সপ্তর্ষি প্রকাশন (২০১৪)।
৩- মান্না দে: শিল্পীর চেয়েও যিনি বড় মানুষ, শরাফত আলী, বর্ষাদুপুর।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত