আজীবন মোহনবাগানী চুনী গোস্বামীর শেষ ইচ্ছা ছিল, মৃত্যুর পর দেশ আর ক্লাবের পতাকাটা যেন তাঁর মরদেহের উপর রাখা হয়।
মোহনবাগান ছেড়ে আর কোথাও কোনওদিন যেতে তাঁর ইচ্ছে করেনি। পয়সার জন্য খেলেননি কখনও। ক্লাবের কাছ থেকে খেলার জন্য এক পয়সাও নিতেন না। তাই বেশি টাকার লোভে কখনও ক্লাব বদলাতে হয়নি। ক্লাবকে এতটাই ভালবাসতেন যে, ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও যাননি। থেকে গিয়েছিলেন মোহনবাগানেই। সেই মোহনবাগান – ময়দানের ফুটবলপাগলদের কাছে যার অর্থ, ঘটির ক্লাব। ওপার বাংলার জন্মবৃত্তান্ত কি সেইজন্যই প্রকাশ্যে কোনদিন আনতে চাননি চুনী? পাছে বাঙাল প্রমাণিত হয়ে যান! যখনই নিজের প্রাণাধিক প্রিয় ক্লাবের কথা বলতেন, তখনই সামান্য ভিজে যেত তাঁর গলা।
আপাদমস্তক মোহনবাগানি নিজেকে বাঙাল বলতে পছন্দ করতেন না। শুধু তাই নয়, প্রসঙ্গ উঠতেই সরাসরি গোষ্ঠ পালকে টেনে আনতেন। বলতেন, ‘উনিও ওপার বাংলার মানুষ। কিন্তু টানটান মোহনবাগানি। মোহনবাগান সবসময়ই ভাল ফুটবলারদের বেছে নিয়েছে। এপার-ওপার ভাগ করেনি।’ সত্যি বলতে
কী, যে সময়ের কথা তিনি বলতেন, সেই সময়
এপার-ওপার ভাগ করা সম্ভবও ছিল না। দেশটাই
তো ভাগ হয়নি তখনও!
চুনী গোষ্ঠ পালের কথা বলতেন। বাংলা ফুটবলের স্বর্ণযুগ ছিল সেটা। তাঁর সময়েও বাংলার ফুটবলে কম সোনা ছিল না। মোহনবাগান জুনিয়র থেকে সিনিয়র টিমে যখন তিনি ঢুকেছিলেন, ময়দানে তখন নামের ছড়াছড়ি। পি কে-চুনী-বলরামদের রাজত্ব। তাঁর আগের প্রজন্মে ময়দান দাপিয়েছেন শৈলেন মান্নারা। পরের প্রজন্মে এসেছিলেন নঈমেরা। পি কে-চুনীরা এশিয়ান গেমসে সোনা এনে দিয়েছেন দেশকে। রুপো জিতেছেন। অলিম্পিক্সে পৌঁছে দিয়েছেন ভারতীয় ফুটবলকে।
হঠাৎ কী হল? কোথায় হারিয়ে গেল সেই ফুটবল? গ্রামে গ্রামে ছেলেরা কি ফুটবল খেলা বন্ধ করে দিয়েছে? হতাশ গলায় প্রশ্নগুলো প্রায়ই করতেন।
আক্ষেপ। শুধুই আক্ষেপ ঝড়ত ফুটবলার চুনী গোস্বামীর কণ্ঠে। বহু বার বহু জায়গায় বলছেন, বিশ্বকাপেও যেতে পারতাম আমরা। ’৬২ সালে সেই সুযোগও তৈরি হয়েছিল। দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে তাঁরাই তখন এশিয়ার এক নম্বর দল। অথচ ফুটবল কর্তারা তাঁদের বিশ্বকাপে পাঠানোর ব্যবস্থাই করে উঠতে পারেনি। চুনী বলেছিলেন, ‘এটা শুধু দুঃখের নয়, হতাশারও। সামান্যতম দূরদর্শিতা ছিল না তাঁদের।’
সে সময় ভারত বিশ্বকাপে গেলে এখন হয়তো ফুটবলের চেহারাটাই অন্যরকম হত! ফুটবলের জন্য আরও উন্নত পরিকাঠামো পাওয়া যেত। গ্রামে গ্রামে ছেলেদের খুঁজে বার করে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হতো। চুনী মেনে নিয়েছিলেন, এ দেশে ফুটবল নিয়ে পাগলামো থাকলেও গরিব ঘরের ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকাঠামো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। আরও বেশি অ্যাকাডেমি দরকার। ফুটবলার তৈরির পেশাদার মানসিকতাটাই ঠিকমতো তৈরি হয়নি। কারণ, সেই এক্সপোজারটাই নেই।
তিনি তো এক্সপোজার পেয়েছিলেন! সুযোগ পেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্লাবে গিয়ে ফুটবল খেলার। রাজি হননি। কেউ কেউ বলেন, চুনী নাকি বুঝতেই পারেননি যে, কত বড় ক্লাবে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন! তাই গুরুত্ব দেননি। চুনী একেবারে অস্বীকার করতেন না কথাটা। তবে একইসঙ্গে জানিয়ে দিতেন, যাননি বলে কোনও আফসোস নেই। তিনি বাংলাতেই থাকতে চেয়েছিলেন। মোহনবাগানেই। কারণ, ওটাই তাঁর কাছে ফুটবলের স্বর্গ।
তবে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের অভিযোগ ছিল, চুনীকে দ্রোণাচার্য হিসেবে পাওয়া গেলে ভাল হতো। কিন্তু তিনি কোচিংয়ে সময় দেননি। চাইলে তো তিনি ভাল কোচ হতেই পারতেন! অনেকেই জানেন না, সেই প্রশিক্ষণও তাঁর ছিল। চুনী ছিলেন ফিফার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ফার্স্টক্লাস কোচ। চুনী বলেছিলেন, কোচিংয়ে কোনওদিন আগ্রহ পাননি তিনি। ফুটবল ছাড়ার পর ক্রিকেটে মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাই কোচিংয়ের সময়ও পাননি। তবু কোচিংয়ের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। কারণ, মাঠের বাইরে থেকে ফুটবল খেলার টেকনিক্যাল বিষয়গুলো জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। পরবর্তীকালে তাঁকে ফুটবলের কলাম লিখতে যা সাহায্য করেছিল।
তাঁকে নিয়ে কথা উঠলে ক্রিকেটের কথা উঠবেই। অমোঘ প্রশ্নটাও চলে আসে গায়ে গায়ে। ক্রিকেট খেললে কি আরও সফল খেলোয়াড় হতে পারতেন চুনী গোস্বামী? শুধু বাংলা নয়, শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করা সহজ হতো?
চুনী বলতেন, গড়ে ছ’টা দেশ যে খেলাটা নিয়ে লাফালাফি করে, তার চেয়ে ফুটবলের আমেজ অনেক বেশি। ক্রিকেটকে তিনি ছোট করছেন না। ক্রিকেট খেলতে তিনি ভালবাসেন। তবে ফুটবল অন্যরকম ব্যাপার। দু’য়ের মধ্যে তুলনা চলে না। এবং নিজেকে একজন ফুটবলার বলতেই তিনি গর্ববোধ করেন। এই খেলাটার জন্যই তো একসময় বিস্তর ধমক খেয়েছেন বাড়িতে! মধ্যবিত্ত বাবা চিরকালই চেয়েছিলেন যে, পড়াশোনা করে, স্নাতক হয়ে ভাল চাকরি করুক ছেলে। খেলা নিয়ে বকাঝকাও করতেন। তবু পালিয়ে পালিয়ে খেলে বেড়াতেন চুনী। মায়ের প্রশ্রয়ে। এশিয়ান গেমসে সোনা জেতার পর অবশ্য বাবা বলেছিলেন – ‘‘চুনী মুখ উজ্জ্বল করেছে !’’
ওই দিনগুলোই ছিল তাঁর সম্পদ। ওই দিনগুলোকে সম্বল করেই এখনও নিজেকে ফিট রাখতেন চুনী।
আজ তাঁর সাথে শেষ হয়ে গেল বাংলার ক্রীড়া জগতের একটা অধ্যায়, একটা মহাকাব্য। ওমোঘ একটা প্রশ্ন রয়ে গেল, পরবর্তী প্রজন্ম কি তাঁকে চিনবে? তাঁকে মনে রাখবে? উত্তরটা হয়ত ভবিষ্যতই দিতে পারবে।
জন্ম: ১৯৩৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির কিশোরগঞ্জে জন্ম চুনী গোস্বামীর।
জুনিয়র ফুটবল: ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত মোহনবাগানের জুনিয়র দলের স্ট্রাইকার ছিলেন।
সিনিয়র ক্লাব ফুটবল: ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত মোহনবাগানের সিনিয়র দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৬০-১৯৬৪, পাঁচ বছর মোহনবাগানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন চুনী।
আন্তর্জাতিক কেরিয়ার: ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ভারতীয় দলে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। চিনা অলিম্পিক দলের বিরুদ্ধে জাতীয় দলে অভিষেক হয় চুনীর। ৫০টি ম্যাচ খেলেন দেশের জার্সিতে। দেশের হয়ে অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, এশিয়া কাপ ও মারডেকা কাপে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। দুটি এশিয়া কাপ ও মারডেকা কাপে চুনী দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
কোচিং কেরিয়ার: ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ভারতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন চুনী।
ক্রিকেট কেরিয়ার: ১৯৬২-৬৩ মরশুম থেকে ১৯৭২-৭৩ পর্যন্ত বাংলা ক্রিকেট দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।
খেলার স্টাইল: মূলত অল-রাউন্ডার ছিলেন। ডানহাতে ব্যাট করতেন। ডানহাতি মিডিয়াম পেসার ছিলেন।
অন্যান্য খেলা: ক্লাবের হয়ে হকি স্টিক হাতেও মাঠে নেমেছেন চুনী। সাউথ ক্লাবে টেনিস খেলতেন নিয়মিত।
পুরস্কার ও সম্মান: ১৯৬২ সালে এশিয়ার সেরা স্ট্রাইকারের পুরস্কার জেতেন। ১৯৬৩ সালে অর্জুন হন। ১৯৮৩ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। ২০০৫ সালে মোহনবাগান রত্ন হন। বাংলার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে জীবনকৃতি সম্মানে ভূষিত করে। ২০০৫ সালে কলকাতার শেরিফ নিযুক্ত হন।
মৃত্যু: ৩০শে এপ্রিল ২০২০, কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
(তথ্য সহায়তা – খেলা পত্রিকা ও সংবাদ প্রতিদিন)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত