সাইমন কমিশন বর্জন উপলক্ষে পুলিশের নির্মম লাঠিচালনার ফলে পাঞ্জাবের অবিসংবাদিত নেতা লাল লাজপত রাই মৃত্যুবরণ করেন। সর্দার ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরু প্রত্যুত্তর দেন স্যান্ডার্সকে হত্যা করে। বিচারে তিনজনেরই ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির পূর্বে তাঁরা তিনজন একটি যৌথ দাবীপত্র পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন পাঞ্জাব সরকারে কাছে, যেটির বয়ান ছিল নিম্নরূপ –
“আমরা (ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরু) এই স্মারকলিপি আপনার অবগতি ও বিবেচনার জন্য পাঠাচ্ছি। ১৯৩০ সালের ৭ই অক্টোবর ব্রিটিশ বিচারালয়ের ট্রাইব্যুনাল আমাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। আমাদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ – আমরা ইংল্যান্ডের অধিশ্বর জর্জের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম।
বিচারকরা আমাদের শাস্তি দেবার সময়ে দুটি জিনিষ স্থির-নিশ্চয় করে নিয়েছিলেন। এক – তাঁরা স্বীকার করেছেন যে, ব্রিটিশ এবং ভারত পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। দুই – এ যুদ্ধে আমরা ভারতের পক্ষে লড়াই করেছি এবং যুদ্ধবন্দী (Prisoner of War)।
দ্বিতীয়টি মেনে নিতে আমাদের দিক থেকে আপত্তির কোন কারণ নেই, তবে প্রথমটি সম্বন্ধে আমাদের কিছু বলার আছে। যে যুদ্ধ চলছে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, তা কার্যতঃ কোথাও দেখা না গেলেও তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য স্বীকার করে নিয়ে আমরা মেনে নিচ্ছি যে, যুদ্ধ ঘোষণাই করা হয়েছে।
এ যুদ্ধ সম্বন্ধে আমরা আমাদের ধারণা স্পষ্ট করে বলছি। আমরা ঘোষণা করেছি যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যতদিন মেহনতি সমাজের ওপর এবং দেশের সম্পদের ওপর মুষ্টিমেয় পরভোজীদের শোষণ ও শাসন বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এ যুদ্ধ চলবেই।
এই পরভোজীদের শ্রেণী ব্রিটিশ পুঁজিপতি বা ব্রিটিশ ও ভারতীয় পুঁজিপতির মিশ্রণ বা কেবল ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণীও হতে পারে। হতে পারে ঐ শ্রেণী ভারতীয় বা মিশ্রিত আমলাতন্ত্রের সহায়তায় তাদের শোষণ অব্যাহত রাখবে। পরিণামের দিক থেকে তাতে কোন পার্থক্য নেই।
আপনার সরকার খেতাব, ধনদৌলত বা সন্মান বিতরণ করে ভারতীয় সমাজের উচ্চবর্গের কিছু লোককে এ পক্ষে টেনে নিতে সক্ষম হতে পারেন। তাদের আমরা তৃনবৎ মনে করি। আপনারা প্রকৃত স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের নৈতিক শক্তি খর্ব করার যতই চেষ্টা করুন না কেন, আমরা অকম্পিত চিত্তে এগিয়ে যাবই।
প্রবীণ নেতৃবৃন্দ আপস মনোভাব প্রদর্শন করার ফলে স্বাধীনতা-সংগ্রামের পুরোধা বিপ্লবীদল সাময়িকভাবে সমগ্র বিচ্ছিন্ন হলেও আমরা বিরত হব না।
যেসব নেতৃবৃন্দ আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সহানুভূতিশীল, ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা ভুলতে পারিনা সে-সব নেতাদের, যাঁরা চরম তাচ্ছিল্যভরে তাঁদের শান্তি আলোচনায় আমাদের যে সমস্ত মহিলাকর্মী অগ্রণী বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে নিজেদের প্রিয় ঘরবাড়ি আত্মীয়স্বজন হারাতে বাধ্য হয়েছেন – তাঁদের কথা উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।
আমরা ভালভাবেই জানি, ঐ সব নেতৃবৃন্দ আমাদের অগ্রগামী বিপ্লবী-বাহিনীকে তাদের দীর্ঘকালের বস্তাপচা কাল্পনিক অহিংস মতবাদের চরম শত্রু বলেই মনে করেন। আমাদের সেনাবাহিনীর ওই বীরাঙ্গনারা দেশের জন্য অসাধ্য কিছুই অবশিষ্ট রাখেননি। তাঁরা চরম স্বার্থত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতার বেদীমূলে তাঁরা স্বামী, ভ্রাতা, এমনকি নিজেকেও কোরবানী করতে বদ্ধপরিকর।
সুতরাং, আপনার দালালরা চরম হীনবৃত্তিবশতঃ ঐ সিংহিনীদের চরিত্রে কালিমা লেপন করে তাঁদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ আনয়ন করাতে আমরা মোটেই চিন্তিত নই। আমাদের যুদ্ধ চলতেই থাকবে। আমাদের এই সংগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করবে। হয়ত কোন এক মুহূর্তে এ সংগ্রামে আপনার সরকারের সঙ্গে অস্ত্র বিনিময় হবে, পর মুহূর্তে আবার হয়ত এ সংগ্রাম গেরিলা-কৌশল অবলম্বন করবে।
কখনও এ যুদ্ধ দেখা যাবে জাতীয় আন্দোলন রূপে, আবার কখনও হয়ত ‘শত্রুকে হত্যা করে মৃত্যুবরণ কর’ – এই মনোভাব নিয়ে খণ্ডযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করবে।
আমাদের সংগ্রাম রক্তস্নাত হবে বা শান্তিপূর্ণ হবে, তা নির্ভর করে আমাদের সম্পর্কে আপনাদের নীতি কি তার উপরে। আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন ধরনের সংগ্রাম আপনারা আমাদের সঙ্গে করতে চান।
কিন্তু মনে রাখবেন, এ যুদ্ধ অবিরাম চলতে থাকবে, সঞ্চারিত হবে নতুন প্রাণ, নতুন শক্তি। এরপরে এ যুদ্ধ আপনাদের বিশাল শক্তি উপেক্ষা করেই পরিচালিত হবে অর্থহীন জাতিতত্ব প্রচার সত্বেও। এ যুদ্ধ চলবে নতুন উদ্দীপনা, সাহস ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে। এ যুদ্ধ থামবে না, যতদিন না সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। যতদিন না আজকের প্রচলিত সর্বপ্রকার শোষণের অবসান ঘটিয়ে কল্যাণভিত্তিক সমাজ-ব্যবস্থার প্রচলন হয়। যতদিন না বিশ্বের সমগ্র মানব সমাজে শান্তির যুগের সূচনা হয়। অতি শিগগিরই এ সমস্যা সমাধানের জন্য শেষ সংগ্রাম শুরু হবে। পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণের দিন শেষ হয়েছে। আমাদের এই সংগ্রামে যোগ দেবার আগে থেকেই এই যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমাদের মৃত্যুর পরেও এ সংগ্রাম স্তিমিত করতে পারবেন না।
ঐতিহাসিক ও বর্তমান অবস্থার অনিবার্য ও যুক্তিসঙ্গত পরিণতি এই যুদ্ধ। অতুলনীয় আত্মোৎসর্গের যে মহতী দৃষ্টান্ত যতীনদাস রেখে গেছেন, কমরেড ভগবতীচরণের করুন কিন্তু মহান আত্মোৎসর্গের ঘটনা এবং আমাদের মহান নেতা চন্দ্রশেখর আজাদের বীরোচিত মৃত্যুবরণের যে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য – আমাদের ফাঁসির ঘটনা সেই ঐতিহ্যকে কিঞ্চিৎ সমৃদ্ধ করবে মাত্র।
আমরা সুনিশ্চিত, আপনি আমাদের ফাঁসি দেবার সিদ্ধান্তকে নিশ্চয়ই কার্যকর করবেন। কারণ, শাসক শ্রেণীর এটাই একমাত্র শক্তি। দৈহিক শক্তিই যে একমাত্র ন্যায্য পন্থা – এটাই হল আপনাদের আদর্শ। আমাদের বিচার-কাহিনীই আপনাদের আদর্শের প্রমাণ।
কিন্তু আমরা প্রাণভিক্ষা চাইনা। আপনার কাছে দয়াভিক্ষাও করি না। আমরা কেবল একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
আপনাদের বিচারালয়ের রায় – আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করেছি, সুতরাং আমরা যুদ্ধবন্দী। আমরা অনুরূপ ব্যবহার পাবার অধিকারী। তাই আমরা জানাতে চাই যে, আমাদের আপনারা ফায়ারিং স্কোয়াড দিয়ে হত্যা করুন। অন্যায়ভাবে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবেন না। অবশ্য আপনাদের বিচারকের রায় আপনি মানবেন, কি মানবেন না, সেটা দুনিয়াকে জানাবার দায়-দায়িত্ব আপনার।
আমরা আশা করি এবং আপনাকে অনুরোধ করি – আপনার সামরিক বাহিনীকে আদেশ দিন, তারা যেন ফায়ারিং স্কোয়াড পাঠিয়ে আমাদের গুলি করে হত্যা করে।
ইতি –
ভগৎ সিং
শুকদেব
রাজগুরু।”
৩০শে অক্টোবর, ১৯২৮ সাল … পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রাই, লাহোরের রাজপথে তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনার জন্য আসা, স্যার জন সাইমনের, ‘সাইমন কমিশন’ বিরোধী একটি অহিংস স্বদেশী মিছিল পরিচালনাকালে, লাহোরের তৎকালীন পুলিশ কমিশনার জেমস এ. স্কট ও ডেপুটি কমিশনার জে. পি. স্যান্ডার্সের নেতৃত্বে এক পুলিশ বাহিনীর হাতে প্রহৃত হয়ে গুরুতর আহত হন।
১৭ই নভেম্বর ১৯২৮ সাল … গুরুতর আহত পাঞ্জাবকেশরী লালা লাজপৎ রাই গত হন। যদিও তাঁর ডেথ সার্টিফিকেটে লিখিত হয়েছিল ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’ হয়ে মৃত্যু, কিন্তু ডাক্তারদের মতে ব্রিটিশ পুলিশের নির্মম প্রহার ছিল তাঁর মৃত্যুর মূল কারণ। পরবর্তীতে বিষয়টি ব্রিটিশ সংসদে উত্থাপিত হলে, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার পাঞ্জাবকেশরী’র মৃত্যুতে ব্রিটিশ পুলিশের নির্মম লাঠি চার্জ ও ব্রিটিশ পুলিশের কোনও রকমের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে।
১৭ই ডিসেম্বর ১৯২৮ সাল … পাঞ্জাবকেশরীর মৃত্যুর ঠিক এক মাসের মাথায় প্রতিশোধ নিলেন বিপ্লবীরা। বিপ্লবীদের গুলিতে ডেপুটি কমিশনার জে. পি. স্যান্ডার্স নিহত হন।
লাহোরের সব রাস্তা পোস্টারে ছেয়ে যায়। পরে ঘোষিত হয়,
“Beware of Bureaucracy. The killing of J. P. Sanders was only to Avenge the murder of Lala Lajpat Rai… We are sorry that we had to shed human-blood on the altar of revolution which will end all exploitation of man in the hands of man.”
৬ই জুন ১৯২৯ সাল … এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দিল্লী অ্যাসেম্বলিতে যখন বিঠলভাই প্যাটেলের Speakership-এ সভা চলছে এবং Public Safety Bill, Trade Dispute Bill, Simon Commission এবং লালা লাজপৎ রায়ের শোচনীয় মৃত্যু নিয়ে সারা দেশ বিক্ষুব্ধ; সেদিন তা প্রকাশের ভাষা দিয়েছিল বিপ্লবী ভগৎ সিং ও বিপ্লবী বটুকেশ্বর দত্তের কাজে। ওই অ্যাসেম্বলি হলে একটি উন্মুক্ত স্থানে কোনো মানুষকে হত্যা না করে তাঁরা সজোরে একটি বোমা নিক্ষেপ করেন – তারই শব্দ ইংরেজ সরকারকে সচকিত করে। স্যান্ডার্স হত্যা ও বোমা নিক্ষেপের ঘটনা একই দলের কাজ – এই অনুমানের উপর ভিত্তি করে একটি ষড়যন্ত্রের মামলা সরকারি পরিকল্পনায় সংঘটিত হয়, যার নাম দেওয়া হয়, ‘লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’।
১৪ই জুন ১৯২৯ সাল … লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার জন্য, সেদিন সকালে কলকাতায় টাউনসেন্ড রোড ও হাজরা রোডের মোড়ে দোতালায় একটি ঘর থেকে বিপ্লবী যতীন দাসকে গ্রেপ্তার করে পত্রপাঠ লাহোরে পাঠানো হয়।
১০ই জুলাই ১৯২৯ সাল … পুলিশের ডেপুটি কমিশনার স্যান্ডার্সকে হত্যার অপরাধে ও ইংরেজ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে লাহোরে ষড়যন্ত্র মামলা খাড়া করে, যাতে পাঞ্জাবের ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু, বাংলার বীর সন্তান যতীন দাস প্রমুখ ১৭ জনকে আসামী করা হয়। যতীন দাসের সেই মামলা চলাকালীন জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীর মর্যাদা দাবি করে আমৃত্যু অনশন, সরকারি মহলেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় সাইমন কমিশনের বিরোধীতায় আন্দোলন পরিচালনা। ১৯২৭ সালের ১০ই নভেম্বর সাইমন কমিশন গঠিত হয় সরকারকে শাসনতন্ত্র সংশোধনের ব্যপারে পরামর্শ দানের জন্যে। ১৯২৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারী এই কমিশন কলকাতায় এলে কংগ্রেস কমিটির নির্দেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এই কমিশান ৩০শে অক্টোবর লাহোরে এলে লালা লাজপত রাইয়ের নেতৃত্বে এক বিরাট শোভা যাত্রা স্টেশান অবরোধ করে ধ্বনি তুললো ‘গো ব্যাক সাইমন’। সে সময়ে পাঞ্জাবের পুলিশ প্রধান স্কট নামে এক দুর্বিনীত অফিসার তাঁর সহকারী স্যান্ডার্স কে নিয়ে পুলিশকে দিয়ে ব্যপক লাঠিচার্জ করায়। গুরুতরভাবে আহত হয়ে লালাজী ১৭ই নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এর প্রতিশোধ নেবার শপথ গ্রহণ করেন ভগৎ সিং ও তাঁর অনুগত তরুণ পাঞ্জাবী বিপ্লবীরা। ১৭ই ডিসেম্বর লাহোরের প্রধান সড়কে ভগৎ সিং ও রাজগুরু, দয়ানন্দ বৈদিক মহাবিদ্যালয়ের সামনে স্কটকে না পেলেও তাঁর সহকারী স্যান্ডার্স কে গুলি করে হত্যা করেন। স্যান্ডার্সের হেড কনস্টেবল চন্দন সিং স্যান্ডার্স কে সাহায্যার্থে এগিয়ে এলে ভগৎ সিং তাঁকেও গুলি করে ভূপাতিত করেন। এটা যে সাধারণ খুন নয়, সাধারণকে তা বোঝাতে প্রচুর ইস্তেহার ছড়িয়ে বিপ্লবীরা লাহোর থেকে সরে পড়েন। কলকাতয় এসে ভগৎ সিং যতীনদাসের সঙ্গে দেখা করে বিপ্লবীদের জন্য বোমা তৈরীর কাজে সাহায্য করতে অনুরোধ করেন। যতীন দাস রাজি হন।
বাংলায় যতীন দাসকে যখন খুবই প্রয়োজন ছিল, সেই সময় কেবলমাত্র ভগৎ সিং এর অনুরোধে তিনি আগ্রা গেলেন বোমা তৈরী করতে ও শেখাতে। দলের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক আগ্রায় এলেন ট্রেনিং নিতে। ঝাঁসির জঙ্গলে বোমা পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও বিজয় কুমার সিংহ নির্জনে একটা বাড়ি ভাড়া করলেন। সেখানেই এলেন যতীন্দ্রনাথ দাস। যতীন দাসকে ঘিরে চারিদিকে কড়া পাহাড়া। তাঁর কাছেই ট্রেনিং নিয়ে শুখদেব গেলেন লাহোরে, আর শিব বর্মা গেলেন সাহারানপুরে, যেখানে আরো দুটো গোপন বোমার কারখানা খোলা হয়েছিল।
দিল্লি, ১৯২৯ সালের ৮ই এপ্রিল … একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। দিল্লীতে সেদিন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার অধিবেসন বসেছে। কংগ্রেসী আসনে মতিলাল নেহেরু, মদনমোহন মালব্য যেমন ছিলেন, তেমনি সভায় উপস্থিত ছিলেন কুখ্যাত লর্ড সাইমন। সভায় Trade Dispute Bill এবং Public Safety Bill পাশ করানো হচ্ছিল। সেই সময়েই অধিবেশনে কক্ষে বিকট শব্দে একটি বোমা বিস্ফোরণ হয়। চারিদিকে শুরু হয়ে যায় আতঙ্কিত লোকদের ছুটোছুটি। সঙ্গে সঙ্গে আবার পিস্তলের গুলির শব্দ। সকলের চোখে মুখে যখন মৃত্যুর বিভীষিকা, তখন দুই সুদর্শন তরুন ভগৎ সিং এবং বাংলার বটুকেশ্বর দত্ত তাঁদের হাতের রিভলবার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন – ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। তরুনদ্বয় উচ্চকন্ঠে বললেন, – ‘আমরা কাউকে হত্যা করতে আসিনি। বিপ্লবের পথ আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু আজ আমরা শুধু প্রতিবাদ জানাতে এসেছি। অত্যাচারী গভর্নমেন্টের জন স্বার্থ বিরোধী কাজের প্রতিবাদ।’ ইচ্ছে করেই ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ধরা দিলেন।
যদিও বিপ্লবের আদর্শ প্রচারের জন্যেই ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত ধরা দিয়েছিলেন। তবু মনে হয়, ওটা তাঁদের অদূরদর্শীতাই ছিল। কেন না এই সূত্র ধরেই ব্রিটিশ সরকার বহু বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করলো, বহু সূত্র আবিষ্কার করলো। সবচেয়ে বড় ঘটনা হল স্যান্ডার্স হত্যার যোগসূত্রও আবিষ্কার করে ফেললো। বিভিন্ন সূত্র ধরে এবং বিভিন্ন বন্দীর স্বীকৃতি আদায় করে পুলিশ পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, বাংলা ও বিহার জড়িয়ে এক আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্রের সূত্র আবিষ্কার করলো। এই ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের নামের তালিকায় ছিলেন – ভগৎ সিং, বটুকেশ্বর দত্ত, শুখদেব, রাজগুরু, চন্দ্রশেখর আজাদ, যতীন দাস, ভগবতীচরণ ভোরা, শিব বর্মা, জিতেন স্যান্যাল, ফনী ঘোষ, ললিত মুখার্জী, জয়গোপাল সহ মোট ত্রিশ জন। ফণীঘোষ, ললিত মুখার্জী ও জয় গোপাল রাজসাক্ষী হয়ে যান।
এরপরের ঘটনাক্রম ইতিহাসের পাতায় রক্তের ধারায় লিখিত। কিন্তু আজও যে প্রশ্ন ইতিহাসকে ছায়ার মতন তাড়া করে বেড়ায়, সেটি হল গান্ধীজি কি সত্যিই ভগৎ সিং, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসির বিরোধীতা করেননি? অধিকাংশ মানুষ বলবেন, করেন নি কারণ তাঁদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্য ছিল। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টালে অন্য ঘটনাক্রম নজরে পড়ে।
ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির হুকুম যখন হয়, তখন কলকাতায় একটি প্রতিবাদসভায় নেতাজি ও অন্যান্যদের ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সেই সভায় উত্তেজনা হতে পারে এই আশঙ্কায় হোম সেক্রেটারি এইচ ডব্লিউ এমারসন গান্ধীজিকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির উত্তরে গান্ধীজি লেখেন,
“I thank you for your letter just received. I knew about the meeting you refer to. I have already taken every precaution possible and hope that nothing untoward will happen. I suggest that there should be no display of police force and no interference at the meeting. Irritation is undoubtedly there. It would be better to allow it to find vent through meeting, etc.”
গান্ধীজি ভারতের এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁকে ভুল বোঝা ভারতবর্ষে কোনও নতুন ব্যাপার নয়, তার সঙ্গে আবার যদি ভুল বঙ্গানুবাদ জনিত বিশ্বাসও এ ভাবে পল্লবিত হতে থাকে, তা হলে তো গোটা ইতিহাসটাই এক দিন বারোয়ারি বিপন্নতায় আক্রান্ত হবে।
উপরোক্ত চিঠিটি পড়ে অনেকেই মনে হয় বা মনে হতে পারে, গান্ধীজি ব্রিটিশদের সমর্থন করছেন এবং চাইছেন মিটিংটা আটকাতে!
অথচ চিঠিটির অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ করলে উল্টোটাই সত্যি মনে হচ্ছে, হিংসা বা অশান্তির মতো অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার সম্ভাবনা তো উড়িয়ে দিচ্ছেনই, উল্টে শাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন এই বলে যে, সভাস্থলে যেন কোনও পুলিশ না থাকে। তিনি এও বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই যে, মানুষের মনে প্রবল ক্ষোভ আছে। এই ভাবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিতে হবে।’’
আশা করছি ইতিহাসের পাতা থেকে আরও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে, ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির আগে ও পরে গান্ধীজির অবস্থান ঠিক কেমন ছিল তা সকলে ধারণা করতে পারবেন।
ভগৎ সিং, রাজগুরু ও সুখদেবের ফাঁসি স্থগিত করার জন্য গান্ধীজির প্রয়াস সম্পর্কে অনেকেই জানেন না।
১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে গান্ধীজি তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইনের সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। গান্ধীজি ভাইসরয়কে বলেন, ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি কার্যকর না করে যদি মুলতুবি বা প্রত্যাহার করা যায়, তা হলে ইংরেজদের সঙ্গে ভারতবাসীর শান্তি প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এর পর মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভাইসরয়ের সঙ্গে গান্ধীজির পুনরায় কথা হয়। গান্ধীজি বলেন, ভগৎ সিংয়ের দণ্ডাদেশ কি ফাঁসি ব্যতীত অন্য কোনও শাস্তি হতে পারে না অথবা ফাঁসি কি মুলতুবি রাখা যায় না? প্রত্যুত্তরে আরউইন বলেছিলেন, তিনি এই মামলাটি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখেছেন এবং এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে তিনি কোনও ভাবেই এই দণ্ডাদেশ পরিবর্তন করতে বা মুলতুবি রাখতে পারবেন না।
তাঁর করাচি যাত্রা পিছিয়ে দিয়ে তিনি ১৯৩১ সালের ১৮ই মার্চ, তার পর ১৯শে, ২১শে, ও ২২শে মার্চ তিনি ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করে বারংবার একই অনুরোধ করেন। ২২শে মার্চ তারিখের বৈঠকে কিছুটা আশ্বাস পাওয়ার পরেও, গান্ধীজি এতটাই মরিয়া ছিলেন যে ২৩ তারিখ সকালেও এই মৃত্যুদণ্ড আটকাবার জন্য ভাইসরয়কে তিনি ব্যক্তিগত চিঠি পাঠান, তাতে জনমত, অভ্যন্তরীণ শান্তি ইত্যাদি নানা কারণ দেখানো ছাড়াও, ভাইসরয়কে তাঁর খ্রিস্টধর্মের শিক্ষা মনে করাতেও পিছপা হননি।
ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি রদ করা নিয়ে গান্ধীজি একাধিক বার লর্ড আরউইনকে মানবিক অনুরোধ করেছেন। এ বার তিনি যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেন। ২৩শে মার্চ কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় যোগদান করার জন্য সন্ধ্যায় করাচির উদ্দেশে ট্রেন ধরার ঠিক আগে লর্ড আরউইনকে চিঠি লিখে তিনি বলেন, ‘‘ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা এক সংশোধনাতীত কাজ।’’ তাই তিনি (আরউইন) যদি মনে করেন এই রায়দানে সামান্যতম ভুলের সম্ভাবনা আছে, তা হলে তাঁর উচিত এই দণ্ডাদেশ কার্যকর না করে পুনরায় বিবেচনা করা।
কিন্তু তাঁর সমস্ত চেষ্টা বিফলে গেল।
পঞ্জাবের ইউরোপিয়ান আইএএস ও আইপিএস অফিসারদের লাগাতার হুমকির কাছে মাথা নত করলেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইন। ১৯৩১ সালের ২৩শে মার্চ সন্ধ্যায় ফাঁসি হয়ে গেল ভারতমাতার তিন বীর সন্তানের।
প্রসঙ্গত, গান্ধীজি যখন ট্রেনে ছিলেন, তখনই লাহোরে ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়।
১৯৩১ সালের ৩১শে মার্চ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধীজি, ভগৎ সিংকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে উল্লেখ করে লেখেন,
‘‘তাঁদের মুক্তির জন্য আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। ভগৎ সিং অহিংসায় বিশ্বাস করতেন না কিন্তু রাষ্ট্রীয় হিংসার কাছেও আত্মসমর্পণ করেননি। অসহায়তার কারণেই তাঁকে বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করতে হয়েছিল।’’
একই সাথে ব্রিটিশদের তীব্র নিন্দা করে লেখেন,
‘‘এই বীরদের মুক্তির জন্য জাতির সর্বসম্মত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ইংরেজ সরকার এই দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের সম্ভাবনাটুকুও বিনষ্ট করলেন।’’
উল্লিখিত সত্য জানার পরও কি গান্ধীজিকে অভিযুক্ত করা যায় যে ফাঁসি প্রদানকারী বিদেশি প্রশাসকের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল?
স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে থেকে আজ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিসমূহ গান্ধীর বিশালকায় ভাবমূর্তির সঙ্গে কেবলই ছায়াযুদ্ধ করে চলেছে। যার ফলস্বরূপ তৈরি হচ্ছে অপব্যাখ্যা ও বেশ কিছু মিথ্যাচার। সবারই এতে কমবেশি অবদান আছে। তাই আমাদেরই সচেতন থাকতে হবে। আমাদের ভুল বোঝার ফল যেন ইতিহাসের বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়।
বিপ্লবী নায়ক শ্ৰীভূপেন রক্ষিত রায় তাঁর গ্রন্থ ‘সবার অলক্ষ্যে’তে লিখেছেন,
“বাংলা তথা ভারতের বিপ্লবযুগের প্রধান অবদান হল ‘মার্টারডম’ বা আত্মদানের শিক্ষা। ‘ভাবনাহীন চিত্তে’ জীবন ও মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্যরূপে গ্রহণ করবার তত্ত্ব পরিস্ফুট হয়েছে অজস্ৰ বিপ্লবী শহিদের আত্মোৎসর্গে শতসহস্ৰ বিপ্লবী-কর্মীর দুর্জয় কর্মকাণ্ডে, বিপ্লবীর সাহস, মৃত্যুভয়হীনতা, কর্মনিষ্ঠা, নিয়মানুবর্তিতা ও বৃহৎ-এর পানে সমুন্নত দৃষ্টিই জাতির বেঁচে থাকার সঞ্চয়। বিপ্লবের ইতিহাস মিউজিয়ামে যত্ন করে তুলে রাখার বস্তু নয়, ইহা জীবনপথে নিত্য কাজে লাগাবার সম্পদ।”
বিপ্লব জাতিকে নেতিবাদ শেখায় না, সে যা দেয় তা ‘ডিরেক্ট’ ও ‘পজিটিভ’। বিপ্লবী শুধু ধ্বংসের বার্তা শোনান না। তাঁর কণ্ঠে একই সঙ্গে ধ্বনিত হয় ধ্বংস ও সৃষ্টির আহ্বান। তাঁর বাণী তাই চিরন্তন। সে-বাণী লালন করতে হয় সুখে-দুঃখে, সম্পদে-বিপদে সর্বক্ষণ।
(তথ্যসূত্র:
১- গান্ধীজি ও নেতাজি, শৈলেশ দে।
২- অগ্নিযুগ, শৈলেশ দে।
৩- বিপ্লবী ভগৎ সিং, বিজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যলোক (২০১২)।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত