২০ মার্চ তারিখটি ভারতীয় ফুটবলের জন্য একটা দুঃসহ দিনই বলা চলে। ঠিক ১৭ বছর আগে এইদিনেই আমরা হারিয়েছিলাম একসময়ে কলকাতা ময়দান কাঁপানো ফুটবলার কৃশানু দে’কে। আর আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় ফুটবলের জগতের সঙ্গে যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাঁদের কাছে এই দিনটি কালো দিন হিসেবেই চিরদিন মনে থাকবে।
শুধুই সাতের দশক না, কলকাতা ময়দান এই প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়েছিল, আটের দশকের একেবারে শুরুতে। সাল ১৯৮০। সুরজিৎ, ভাস্কর, চিন্ময়, প্রশান্ত, মিহির সহ একঝাঁক ফুটবলার ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মহামেডানে। ঠিক তার আগের বছর পিক বাজেটের তারকা সমৃদ্ধ দল গড়েও মুখ থুবড়ে পড়েছিল ইস্টবেঙ্গল। ‘৮০ সালে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় মোহনবাগান ছেড়ে সেই আনকোরা ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নেন। প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া সুধীর কর্মকার, হাবিব, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও ময়দানের নতুন বাদশা মজিদ ছাড়া বলার মতো কেউ ছিল না তখন। সেই ভাঙাচোরা ইস্টবেঙ্গলকে আবার সাফল্যের মুখ দেখিয়েছিলেন পোড় খাওয়া প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।
পিকে কখনও ট্যাকটিকাল কচকচানির মধ্যে খুব একটা যেতেন না। অমুক সিস্টেম বা তমুক সিস্টেমের বিজ্ঞাপনও তাঁকে করতে হয়নি কখনও। তবে প্লেয়ারদের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনার কৌশল তাঁর রপ্ত ছিল। সেটাই তাঁকে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা কোচ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। কিন্তু কি ছিল তাঁর কৌশল? তাঁর ছাত্রদের মতে, ‘ম্যান ম্যানেজমেন্টটা তিনি জলবৎ তরলং করে শিখিয়ে নিয়েছিলেন। একইসঙ্গে মুষড়ে পরা ফুটবলারদের ভোকাল টনিক দিয়ে শরীরে অ্যাড্রিনালিনের স্রোত বইয়ে দিতে পারতেন।
এর আগে ‘৭২ সালে যখন ইস্টবেঙ্গলের দায়িত্ব নিলেন, সেই টিম তখন নক্ষত্রখচিত। সুধীর কর্মকার, অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হাবিব, আকবর, গৌতম সরকার, সমরেশ চৌধুরী তখন ভারতীয় ফুটবলে লাল-হলুদের অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছেন। এদের এক সুতোয় বাঁধা খুব একটা সহজ ছিল না। ম্যারাথন সাফল্যের জন্য প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দৌড় শুরু করলেন এদের নিয়ে। ‘৭২ সালে তাঁর সৌজন্যেই ত্রিমিকুট জয় ইস্টবেঙ্গলের। ওই বছরই একটিও গোল হজম না-করে ইস্টবেঙ্গল জিতল কলকাতা ফুটবল লিগ।
‘৭৫ সালের কলকাতা লিগে সব ম্যাচ জিতেই চ্যাম্পিয়ন হল ইস্টবেঙ্গল। ‘৭৫ সালেই টানা ছয়বার কলকাতা লিগ জিতে রেকর্ড গড়ল প্রদীপ ব্রিগেড। একইসঙ্গে সেবছরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগানকে ৫-০ গোলে হারিয়ে ইতিহাস তৈরী করেছিল লাল-হলুদ দল। ‘৭৬ সালে তিনি মোহনবাগানে চলে যান। সাফল্য কিন্তু একবারের জন্যও থমকায়নি।
কয়েকবছর আগের ফ্যাকাশে মোহনবাগান ভারতীয় ফুটবলের সেরা দল হয়ে উঠল এক লহমায়। এই প্লেয়ারদের সঙ্গেই আবার পিকে’কে সামলাতে হল প্রসুন বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়, বিদেশ বসু, মানস ভট্টাচার্য, শ্যাম থাপার মত তারকাদের। প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোচিংয়েই ‘৭৭ সালে মোহনবাগান প্রথম ও শেষবারের জন্য ত্রিমুকুট জেতে। ‘৭৯ সাল পর্যন্ত টানা ৩ বছর তিনি মোহনবাগানের কোচ ছিলেন।
প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় গুণটি ছিল ভোকাল টনিক। সেই সময় ফুটবলারদের ক্লাবের প্রতি যে আনুগত্য ছিল, সেটাকে তিনি কাজে লাগাতে পারতেন ভরপুর। দুর্ধর্ষ পিয়ং ইয়ং, কসমসদের হারানো তার প্রমাণ। এখনও গৌতম, সুভাষরা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, বহু কঠিন ম্যাচ তাঁরা অবলীলায় বের করে এনেছেন তাঁদের গুরুদেবের তপ্ত ভাষণে।
সেই ভোকাল টনিক শব্দটা এবার হয়তো অভিধানেই থেকে যাবে। সেইসময় কলকাতার ফুটবল ‘পিক’-এ উঠেছিল যে কিংবদন্তি কোচের উপস্থিতিতে, সেই পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের চলে যাওয়ায় ময়দানে আঁধার নেমে এল। ফুটবল যখন কলকাতা থেকে ধীরে ধীরে গোয়া-বেঙ্গালুরুর দিকে সরে যাচ্ছে, তখন মনে হয় এই প্রদীপের আলোই কলকাতা ময়দানের জন্য আরও কিছুদিন দরকার ছিল।