সেদিন ছিল অম্বিকাচরণ গুহর বাড়িতে খুব ধুমধাম। উত্তর কলকাতায় বিরাট বাড়ি। পৈতৃক জমিজমা, পয়সাকড়ির অভাব নেই। গাড়ি, বাড়ি, লোকলস্কর, ভারী নামডাক। কলকাতার বড় বড় সাহেব কোম্পানির মুৎসুদ্দি এই গুহরা। সাহেবদের মুখে মুখে ‘গুহ’ পদবি কালে হয়ে গিয়েছে ‘গোহ’। উদার হৃদয়, দরাজ হাত অম্বিকাচরণকে লোকে বলে ‘রাজামশাই’। এই রাজামশাইয়েরই বড় ছেলে রামচরণ গোহ-র ঘর আলো করে এসেছে পুত্রসন্তান। ১৮৯২ সালের ১৩ মার্চ। দোলপূর্ণিমার দিন। অম্বিকাচরণের স্ত্রীর খুশি আর ধরে না। আঁতুড়ে গোলগাল স্বাস্থ্যবান বাচ্চাটিকে দেখে তিনি বললেন, ‘‘এ যে দেখি গোবরের তাল!’’ পাশ থেকে মুচকি হেসে দাই বলে উঠল, গোবরের তাল না গো, গোবর গণেশ। বড় হয়ে এই ছেলে একেবারে গোবর গণেশ হবে দেখো। তখন কে জানত, ছোটবেলার এই নাদুসনুদুস গোবরের তালই এক দিন ধারালো চেহারা আর পেটানো স্বাস্থ্য নিয়ে পশ্চিমি দুনিয়ায় শোরগোল ফেলে দেবেন! তাঁর শারীরিক ক্ষমতা, দুর্দান্ত স্কিল আর কুস্তির প্যাঁচপয়জার তাক লাগিয়ে দেবে বিশ্বকে! যতীন্দ্রচরণ গোহ ওরফে গোবর গোহই প্রথম পেশাদার কুস্তিবিদ যিনি বিদেশে যান কুস্তি লড়তে। তিনিই প্রথম ভারতীয় পালোয়ান যিনি কুস্তিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব জিতে নিয়ে আসেন। বস্তুত সেই প্রথম কোনও অশ্বেতাঙ্গ মল্লবিদ গোরাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেরার শিরোপা।
শোনা যেত, দেহের শক্তি বাড়ানোর জন্য তাঁর খাবারে মেশানো হত সোনা-রুপো!
তিনি নাকি শরীরচর্চা করতেন গলায় ১৬০ পাউন্ডের পাথর ঝুলিয়ে!
তিনি ছিলেন দশাসই পালোয়ান। অথচ ছিলেন অতি বিনয়ী, ছিলেন সুবক্তা। এছাড়া ভালবাসতেন সেতার বাজাতে!
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পথটা অবশ্য কখনওই সুগম ছিল না গোবরের পক্ষে। যে খেতাব বিদেশিরা নিজেদের কব্জায় রেখে দিয়েছিলেন এত দিন ধরে, হঠাৎ এক হিন্দু পালোয়ান কোথা থেকে এসে সেই খেতাব জিতে যাবে, এটা হজম করা সম্ভব ছিল না তাঁদের পক্ষে। প্রতি পদে বাধা দেওয়া হয়েছে গোবরকে, অনৈতিক ভাবে জিতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীকে। মার্কিন খবরের কাগজগুলি দিনের পর দিন আজগুবি গালগল্প লিখে গিয়েছে তাঁকে নিয়ে। অসীম নিস্পৃহতায় সব কিছু দেখে গিয়েছেন গোবর। প্রতিপক্ষ বারবার খেলার নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। সাচ্চা খেলোয়াড়ি মনোবৃত্তির গোবর ভরসা রেখেছেন বিচারকের রায়ের ওপর। নিজে কখনও জেতার জন্য অনৈতিক পন্থা নেননি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আর ষাটের দশকের বেশ ক’বছর দেদার পেশাদার দঙ্গল বসত কলকাতার রনজি স্টেডিয়ামে। যে কুস্তিকে ডাকা হত আমেরিকান ফ্রি-স্টাইল বা শুধুই ফ্রি-স্টাইল। আর বালক, কিশোর, নব্য যুবার ঠোঁটে ঠোঁটে ঘুরত রুস্তম-এ-হিন্দ, দারা সিংহ, কিং কং, ওয়াদি আইয়ুব, সৈয়দ সৈফ শাহ গোছের সব পালোয়ানের নাম। অথচ হাজার চেষ্টাতেও টলানো যায়নি প্রাচীন প্রজন্মকে। হরিনামের মতো তাঁদের জিভে লেগে ছিল একটাই নাম— গোবর গোহ।
তখন শোনা যেত, পেশাদার কুস্তির চ্যাম্পিয়ন লু-থেজ-এর সঙ্গে নাকি দু’বার ড্র করেছিলেন দারা সিংহ। কিন্তু আমাদের প্রাচীন প্রজন্ম কাগজপত্তর বের করে দেখিয়ে দিতেন, গোবর গোহ ১৯২১-এর ২৩শে অগস্ট সান ফ্রানসিসকোর কলিসিয়াম স্টেডিয়ামে জার্মান কুস্তিগির আড সান্টালকে চিৎ করে বিশ্ব পেশাদার লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। তার আগে, ১৯১৩-য় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ ঘোষণার সামান্য আগে, ৩রা সেপ্টেম্বর এডিনবরায় বিশালদেহী জিমি এসনকে ৩৯ মিনিটে চিৎ করে ব্রিটিশ এম্পায়ার হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হন। খেতাব সহ পেয়েছিলেন দেড় হাজার পাউন্ড ছাড়াও টিকিট বিক্রির সত্তর শতাংশ টাকা।
প্রাচীন প্রজন্মের মুখে যখন এই সব চাঞ্চল্যকর তথ্যের চর্চা চলত, তখনও কিন্তু উত্তর কলকাতার ১৯ নং গোয়াবাগান স্ট্রিটে একটা চৌচালা টালির চালার নীচে গোবরবাবু তাঁর প্রসিদ্ধ কুস্তির আখড়ায় নিজের কাঠের চেয়ারে স্বমহিমায় আসীন। বলা উচিত, স্বরাজ্যে স্বরাট।
কত গল্প তাঁকে নিয়ে বয়স্ক বাঙালির মুখে প্রচলিত ছিল তখন। তাঁর ভাল নাম যতীন্দ্রচরণ গোহ আর ক’জন উচ্চারণ করে! গোবর গোহ তো গোবর গোহই। শক্তির প্রসঙ্গ উঠলে যেমন চলে আসে স্যান্ডোর নাম, বড় ও ছোট গামা, গোলাম পালোয়ান, করিম বখশের কথা, তেমনই বাঙালির গৌরব এক ও অদ্বিতীয় গোবরবাবুর লীলাকীর্তন। বড় বাঙালির নাম করতে হলে তাঁরা কর গুনে বলতে থাকেন সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা, উদয়শঙ্কর, যামিনী রায়, আলাউদ্দিন খান, ভীষ্মদেব, গোবর গোহ …
গোবরবাবুর আখড়ার থেকে দু’গলি পেরিয়ে ৪নং ঈশ্বর মিল লেন। সেখানে নিবাস বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথের, যিনি মাঝেমধ্যেই আখড়ায় চলে আসতেন, চা নিয়ে আড্ডায় বসতেন। তা নিয়েও গপ্পো কিছু কম না। আসলে ফ্যাকড়া, এলেই গোবরবাবু ছেলে রতনকে দেখিয়ে বলতেন, ‘‘ওর মগজে একটু অঙ্ক কষে দিন তো।’’ তখন সত্যেন বোসে আচ্ছন্ন রতন পালায় কোথায়!
গোবর গোহ মানেই কিন্তু গল্প, গল্প আর গল্প। সে-সবে যাওায়ার আগে মার্ক্সবাদী নেতা হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটা ছোট্ট স্মৃতি তুলে দিই। হীরেনবাবু লিখছেন: ‘‘১৯২৭-২৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদক রূপে আমি তাঁকে নিমন্ত্রণ করে কলেজে আনি। তিনি এলেন— ‘ব্যূঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ’ — বিরাট তাঁর মূর্তি ও ব্যক্তিত্ব, পরনে বাঙালির ধুতি পাঞ্জাবি শাল (এটা এমন সময় যখন কলেজের অধ্যাপকরাও প্রায় সকলে ‘সাহেবি’ পোশাক পরতেন!) বাঙালি জীবনে গর্বের একটা বিস্মৃত অধ্যায়…।’’
তবে গোবর গোহ বলতে যে-চেহারাটা সব বাঙালির চোখে ভাসে, সেটা ১৯২১-এ স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্টস পরে আমেরিকায় তোলা কুস্তির পোজের ছবি। ছ’ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ঊনত্রিশ বছর বয়সি দৈত্যাকার গোবরবাবুর ওজন তখন ২৩০ পাউন্ড। গলা ২০ ইঞ্চি, হাতের গোছা ১৫ ইঞ্চি, কব্জি পৌনে ৯ ইঞ্চি, বুক ৫০ ইঞ্চি, বুক (ফোলালে) ৫২ ইঞ্চি, ঊরু ৩৩ ইঞ্চি, পায়ের ডিম সাড়ে ১৮ ইঞ্চি। এই দশাসই চেহারার মধ্যেও যা চোখ ও মন কাড়ে তা মুখমণ্ডলের প্রশান্তি, চোখের চাহনির সৌন্দর্য। অবাক লাগে, এহেন মানুষটিকে নিয়েই সে-সময় আমেরিকায় মস্ত স্টোরি বেরোল ক্যানসাস সিটি পোস্ট পত্রিকায় এই হেডিং-সহ: “Invasion of ‘Hindu Menace’ breeds fear among matmen.” হিন্দু আক্রমণে কুস্তিগিররা থরহরি কম্প।
সদ্য খেতাব হারানো মার্কিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের সঙ্গে গোবরের লড়াইয়ের আগে দেশ জুড়ে একটা তুমুল উত্তেজনা। তত দিনে অপরাজিত গোবরকে নিয়ে একটা আতঙ্কই প্রায় ছড়িয়ে গেছে দঙ্গল মহলে। সমানে লেখালেখি হচ্ছে বহিরাগত হিন্দু কুস্তিগিরের গুপ্ত প্যাঁচপয়জার নিয়ে। তাঁর আহারে সোনা ও রুপোর চূর্ণ মেশানো নিয়ে। সব কিছুর মধ্যেই একটা গেল-গেল ভাব! এতটাই যে, শেষ অবধি এক যুবতী মার্কিন কুস্তি বিশেষজ্ঞ লোরি প্র্যাটকে গোবরের পক্ষ নিয়ে কলম ধরতে হল গোবর-লুইস লড়াইয়ের আগে। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘গোবর কোনও ভাঁওতা নয়। শুধু সোনার গুঁড়োর খেল নয়। ওঁর আসল শক্তি শ্বাস নিয়ন্ত্রণে।’ লোরি প্র্যাটের সেই রচনা থেকে একটু উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না। লিখছিলেন –
‘‘গোবর গোহকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় যা চলছে, তা এক কথায় ভয়ঙ্কর। আর তার একটাই কারণ — মানুষটা বড়ই বিনয়ী। কাগজে কাগজে তাঁর জমকালো পোশাক নিয়ে ছবি বেরোচ্ছে, তাঁর জেতার অভ্যাস নিয়ে লেখা হচ্ছে, তাঁর রোজকার খাওয়ার মধ্যে সোনা রুপোর গুঁড়োর কথা থাকছে, আর থাকছে তাঁর গলায় মস্ত পাথরের ভার চাপিয়ে ব্যায়ামের কেত্তন। অথচ গোবর মানুষটা বাস্তবত এক লজ্জাবতী লতার মতো। আমি এই গোবরকে নিয়েই লিখতে চাই।’’
সে-লড়াইয়ে বলা বাহুল্য, গোবর পা ধরে লুইসকে এক ঘণ্টার মধ্যে আছড়ে ফেললেন রিংয়ে। তার পর দুটো কাঁধ চেপে ধরলেন জমিতে। গোটা লড়াই ধরে গোবরই আগ্রাসী ছিলেন, এবং যে-সাবলীল কেতায় তিনি লুইসকে পা ধরে লটকালেন তা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন সিবিস্কোর প্রয়োগ করা টো-হোল্ড প্যাঁচের চেয়েও চটকদার ছিল। ওই টো-হোল্ডেই কয়েক মাস আগে লুইসকে কাত করে বিশ্ব খেতাব জিতে নিয়েছিলেন সিবিস্কো।
এই শক্তিশালী সিবিস্কোকেও হারতে হয়েছিল গোবরের কাছে। এ ছাড়া ছোট গামার সঙ্গেও ওঁর লড়াইয়ের বৃত্তান্তে যেতে হবে। তার আগে অবশ্য ওঁর বংশ পরিচয় ও নানা বিষয়ে ওঁর অদ্ভুত প্রতিভার কথা একটু শোনালে মন্দ হয় না।
গোবর গোহোর বংশ লতিকায় যাঁর প্রথম উল্লেখ পাচ্ছি আমরা, তিনি ব্রজরাম গুহ (ইংরেজরা মিঃ গোহো ডেকে তাঁর পদবি গোহো করে দেন)। বুদ্ধিমান ও উচ্চাভিলাষী ব্রজরাম যশোহর জেলার ইটিন্ডাঘাটে তাঁর পিত্রালয় ছেড়ে কলকাতায় এসে সাহেবদের মুৎসুদ্দির কাজ ধরেন। এবং অনতিকালে প্রভূত অর্থোপার্জন করে উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায় প্রচুর সম্পত্তি কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হন। ব্রজরাম গোহো (১৭৬৩-১৮০০) বেশি দিন বাঁচেননি, কিন্তু তাঁর বংশধরেরা জমিদারি ও সম্পদ সুরক্ষিত রেখেছিলেন। বিশেষত পুত্র শিবচরণও (১৭৯৩-১৮৭৪) মুৎসুদ্দির কাজে পর্যাপ্ত অর্থ করেছিলেন। এই শিবচরণের নাতি অম্বিকাচরণের (১৮৪২-১৯০১) হাত ধরেই ডন-কুস্তির নেশা ঢোকে গোহো পরিবারে। নাতির নতুন নেশায় শিবচরণের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয় ও বিপুল অর্থব্যয় ডন-কুস্তিকে কালে কালে সম্ভ্রান্ত গোহো বাড়ির এক কালচারে পরিণত করে।
মথুরা থেকে বীর হনুমানের এক পাথরের মূর্তি আনিয়ে ৬৫ মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটে আখড়া বসালেন শিবচরণ, আর ওই মথুরারই বড় পালোয়ান কালী চৌবেকে আখড়ার গুরু করলেন। গোহোদের এই আখড়ার চালচলন কলকাতার অবাঙালি আখড়ার থেকে বেশ স্বতন্ত্র ছিল। চল্লিশটা গরু ও তিরিশটা ছাগলের এক খাটালও তৈরি হয়েছিল শিক্ষার্থীদের দুধ জোগাতে। ডন-কুস্তির নেশাটা ক্রমে উত্তর কলকাতার ভদ্র ও অভিজাত পরিবারে চারিয়ে যায়।
অম্বিকাচরণ চমৎকার তালিম নিয়ে, রেওয়াজ করে আঠারো-বিশ বছর বয়সের মধ্যেই প্রথম শ্রেণির পালোয়ান হিসেবে সমাদর পান। বড় পালোয়ান হয়েও কুস্তিকে পেশা করেননি বলে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের পালোয়ান মহলে তাঁর বেশ সম্মান ছিল। এক সময়কার মল্লসম্রাট বুটা তাঁর নওজোয়ান শিষ্য করিম বখশ্কে নিয়ে অম্বিকাচরণের আখড়ায় এসেছিলেন। কুস্তিতে তাঁর অবদানের জন্য পালোয়ান মহলে তত দিনে তাঁকে ডাকা শুরু হয়েছে ‘রাজাবাবু’। এই ‘রাজাবাবু’-র চতুর্থ পুত্র ক্ষেত্রচরণ (ক্ষেতুবাবু ডাকনামেই প্রসিদ্ধ) গোহো ঘরানার কুস্তিকে ক্রমপ্রসারিত করেন। ডাকসাইটে পালোয়ান গোলামের শিষ্য কাদরা-কে কুড়ি মিনিটের লড়াইয়ে চিৎ করেছিলেন। যদিও কুস্তিতে ক্ষেতুবাবুর সেরা স্বাক্ষর থেকে গেল ভাইপো বিশ্ববিশ্রুত গোবর ছাড়াও বিপ্লবী মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভীম ভবানীর মতো পালোয়ান তৈরি করায়।
ক্ষেতুবাবু গোবরকে তৈরি করতে গিয়ে দেখেন যে, পনেরো বছর বয়সেই দু’ঘণ্টার কুস্তিতে তাঁর কোনও দমই খরচ হয় না। কাজে কাজেই রেওয়াজের জন্য অমৃতসর থেকে রহমান ওস্তাদকে আনা হল। তাতেও পাঁচ-ছ’ঘণ্টার কোস্তাকুস্তির সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। তখন বিখ্যাত মল্ল কল্লুর শাগরেদ গুর্তা সিংহকে আনানো হল। আর পুরো ব্যাপারটার তদারকির জন্য নিয়োগ করা হল লাহোরের ওস্তাদ বগলা খলিফাকে।
সতেরো-আঠারো বছরেই গোবরের ব্যায়াম-কুস্তির চেহারাটা অদ্ভুত দাঁড়িয়ে গেল। রোজ ছ’ঘণ্টা ডন-কুস্তি করেও ক্লান্তির নামগন্ধ নেই। দু’আড়াই হাজার বৈঠকেও কিছু হয় না। তাই গলায় একটা ১৬০ পাউন্ড ওজনের পাথরের হাঁসুলি পরতে হয়। তখন তাঁর দু’জোড়া মুগুরের এক জোড়ার প্রতিটির ওজন ২৫ সের। অন্য জোড়ার প্রত্যেকটার ওজন এক মণ দশ সের করে।
তবে এ সব অনেক পরের কথা। পেশাদার মানসিকতা আর দৃঢ় নৈতিক চরিত্র অর্জনের শিক্ষা তাঁর শুরু হয়েছিল অনেক আগেই, মা নির্মলাসুন্দরী দেবী এবং কাকা ক্ষেত্রচরণ গোহর কাছে। বাড়িতে কুস্তির চর্চা আগে থেকেই ছিল। গোবর নাড়া বাঁধলেন কাকার কাছে। ক্ষেতুবাবু নিজে দক্ষ মল্লবিদ ছিলেন। তাঁর নিজের এমন কিছু কুস্তির কৌশল ছিল যা পঞ্জাবি বা পাঠান কুস্তিগিরদের জানা ছিল না। তিনি যত্ন করে সেগুলি শিখিয়েছিলেন শিষ্যকে। পরে গোবর তালিম নেন খোসলা চৌবে এবং রহমানি পালোয়ানের কাছ থেকে। লাহৌরের ওস্তাদ পালোয়ান কলিকা বাগলা রোজকার রুটিনের তদারকি করতেন। দক্ষ তালিমের জোরে সাত-আট ঘণ্টা লাগাতার কুস্তি চালিয়ে যাওয়ার পরও গোবরের দম ফুরোত না। তাঁর ওজন ছিল ২৪৫ পাউন্ড, মানে ১১১ কিলোর একটু বেশি। পায়ের শক্তি বৃদ্ধির জন্য তিনি ১৫ মণ ওজনের পাথরের নেক কলার গলায় পরতেন। তাঁর মুগুরের ওজন ছিল ২৫ সের। গামা পালোয়ান, ইমাম বক্স, আলি সাই আহমেদ বক্স কাল্লুর মতো বাঘা বাঘা পালোয়ানরা গোবরের সঙ্গে কুস্তি লড়া শুরু করলেন। এতে সুবিধা হল গোবরের। বিভিন্ন ঘরানার পালোয়ানের সঙ্গে লড়ার ফলে তিনি কুস্তির কায়দাগুলি আরও ভাল করে রপ্ত করলেন। কিন্তু বাধা এল অন্য দিক থেকে। গোবরকে সবাই বলেন ‘রইস কা লড়কা’। এই বাড়ি থেকেই কুস্তির মাসোহারা পান যাঁরা, তাঁরা কি না লড়বেন মালিকের ছেলে গোবরের সঙ্গে? কুস্তির সময় ইচ্ছে করেই পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করতেন না তাঁরা। বরং খেয়াল রাখতেন যাতে গোবর কোনও ভাবে চোট না পান। আখড়ায় নেমে গোবর দিব্যি বুঝতেন সে কথা। তাঁর তখন সতেরো-আঠারো বছর বয়েস। গায়ে মত্ত হাতির বল। কুস্তি লড়ে যখন সাধই মিটছে না, তখন আর শুধু শুধু এখানে পড়ে থাকা কেন? তা ছাড়া বড়লোকের ছেলে পেশাদার কুস্তিবিদ হয়ে দঙ্গলে নামলে সমাজের চোখরাঙানির ভয়ও কম ছিল না। সব ভেবেচিন্তে জামাইবাবু শরৎচন্দ্র মিত্রের পরামর্শে কুস্তি লড়ার জন্য বিদেশে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন গোবর। ১৯১০ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বড় গামা, আহমেদ বক্স, ইমাম বক্সকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিলেন তিনি। কালাপানি পেরোনো তখন সাংঘাতিক ব্যাপার। গোবর বিত্তবান পরিবারের ছেলে বলে তাঁকে অর্থের কথা ভাবতে হয়নি। কিন্তু সেই সময় রাজ পৃষ্ঠপোষকতাতেও কুস্তিবিদরা বিদেশে যেতে চাইতেন না। ১৮৮৬ সালে নৃসিংহগড়ের রাজা বিদেশি পালোয়ানদের সঙ্গে লড়ার জন্য মল্লসম্রাট বুটাকে লন্ডনে পাঠাতে চেয়েছিলেন। শোনা যায় বুটা বিরাট জিভ কেটে বলেছিলেন, ‘‘হুজুর, বিদেশে যেতে হলে শুনেছি কালাপানি পাড়ি দিতে হয়। আর কালাপানি পাড়ি দেওয়া মানেই তো জাত যাওয়া। জাতই যদি যায় তা হলে রুপেয়া-উপেয়া দিয়ে কী হবে?’’ আরও অনেকের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটেছিল। নিষ্ঠাবান কায়স্থ পরিবারের সন্তান গোবর কুস্তির কাছে সমস্ত সংস্কারকে তুচ্ছ করেছিলেন।
এই শক্তিচর্চার দীর্ঘপ্রসারী সুফল কী দাঁড়াতে পারে তা নিয়ে প্রবীণদের মুখে শোনা একটা গল্প এখানে শোনানো যায়। গোবরবাবুর তখন পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি বছর বয়স। গোয়াবাগানের আখড়ায় নিত্যদিন চেয়ারে বসে ছেলেদের ডন-কুস্তির ওপর চোখ রাখেন। তো এক দিন এক সুঠামদেহী ছোকরা এসে প্রণাম করে বলল, ‘‘স্যার, একটু কুস্তি শিখতে পারি?’’ গোবরবাবু মুখের মোটা লম্বা চুরুটটা (শেষ বয়সে এটাই তাঁর আরাম আর বিলাসিতা ছিল) বাঁ হাতে নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘‘আলবৎ শিখবি! তার আগে আমার ডান পাশে একটু দাঁড়া।’’ ছেলেটি তাঁর ডান পাশে ঘেঁষে দাঁড়াতে গোবরবাবু বসে বসেই নিজের ডান হাতটা ওর বাঁ কাঁধে রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিতে লাগলেন। সেই চাপে ছেলেটি দেখতে দেখতেই বসে পড়ল। গোবরবাবু হেসে বললেন, ‘‘বডি ঠিক আছে, তবে জোর বাড়াতে হবে। সময় করে ঠিকঠাক আয়, ডনবৈঠক কর। তার পর কুস্তি ধরে নিবি।’’
গোবর গোহর কিংবদন্তি গড়ে দিয়েছিল যে-সব লড়াই, তার প্রায় সবই সে কালের সেরা মার্কিন ও ইউরোপীয় কুস্তিগিরদের সঙ্গে লড়ে। জীবনের দশ-দশটা বছর তিনি বিদেশে লড়ে কাটিয়েছিলেন, যার শুরু ১৯১০-এ, বয়স যখন নিতান্ত আঠারো।
বড় বংশের ছেলে হয়েও গোবর কুস্তিকে পেশা করতে পিছ-পা হননি। তবে ভারতীয় মল্লমহলের প্রথানুযায়ী গুরু-শিষ্যে, শিষ্যে-শিষ্যে কি একই ঘরানার একজনের সঙ্গে আরেক জনের লড়া বারণ। তাতে অনেক বড় পালোয়ানের সঙ্গে ওঁর মোকাবিলায় বাধা পড়ছিল। তখন রাস্তা বার করার জন্য ভগ্নিপতি শরৎকুমার মিত্রকে নিয়ে গোবর লাহোর রওনা হলেন রহিম ওস্তাদ ও গামা পালোয়ানের তিন নম্বর মোলাকাত দেখার জন্য। সেটা ১৯৯০-এর ফেব্রুয়ারিতে। আগের দুটির মতো সেটিও ড্র হল।
কুস্তি দেখে শরৎবাবু ফিরে এলেন, কিন্তু গোবরবাবু এলেন না। তিনি আহমদ, গামা, ইমাম এবং গামু জলন্ধরিয়াকে নিয়ে একটা দল গড়ে ওখান থেকে লন্ডন পাড়ি দিলেন। এবং লন্ডন পৌঁছেই সাহেব ম্যানেজার নিয়োগ করলেন। এবং সরকারি ভাবে ঘোষণা করলেন যে, এই দল যে-কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত।
ইউরোপ-আমেরিকার কুস্তিবিদরা ভারতীয় মল্লবিদদের তখন বেশ তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখতেন। অথচ ১৮৯২ সালেই কলকাতায় পঞ্জাবি পালোয়ান করিম বক্স আয়ারল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন মল্লবিদ টম ক্যানন-কে শোচনীয় ভাবে পরাস্ত করেছেন। টমের সঙ্গী, গ্রিক চ্যাম্পিয়ন আন্তোনিয়ো পিরি-রও একই দশা হয়েছিল। কিন্তু এঁরা দুজনেই স্বদেশে নিজেদের পরাজয়ের কথা সম্পূর্ণ গোপন করেন। ফলে কুস্তি লড়ার জন্য গোবররা যখন ইংল্যান্ডে এসে পৌঁছন, তাঁদের নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি হয়। এর পরেই আমেরিকার বেনজামিন রোলার, পোল্যান্ডের স্তানিসলস সিবিস্কো, সুইটজ়ারল্যান্ডের জন লেম ধরাশায়ী হলেন গামা আর ইমাম বক্সের হাতে। এই প্রথম সফরে দারুণ ছাপ ফেলে দিয়েছিল ভারতীয় দল। দাঁড়ানো মাত্র লটকে পড়েছিল সাহেব পালোয়ানরা। কপাল মন্দ সে বার গোবরবাবুর। শ্বেতাঙ্গরা যখন কালোদের ভয়ে কাঁপছে, এবং নতুন নতুন লড়াইয়ের চুক্তি সই হচ্ছে তখনই টেলিগ্রাম গেল কলকাতা থেকে,‘‘ফিরে এসো, মা অসুস্থ।’’
গোবরের অনুপস্থিতিতে অবশ্য গামা, ইমাম আর আহমদ বখশ দুর্ধর্ষ লড়েছিলেন সে বার ইংল্যান্ডে। সুন্দর, ফর্সা চেহারার জন্য গামা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন। আমেরিকা থেকে বেনজামিন রোলার ইংল্যান্ড চলে আসেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে দু’-দু’বার চিৎ হন গামার প্যাঁচে। তখন শ্বেতাঙ্গদের মান বাঁচাতে লড়াই ডাকা হয় গামার সঙ্গে পোল্যান্ডের স্তানিস্লস্ সিবিস্কোর। প্রথম বার পরাস্ত হয়ে দ্বিতীয় বার গা ঢাকা দিলেন সিবিস্কো। তাই দ্বিতীয় বার যখন গোবরবাবু লন্ডন এলেন ১৯৬২-তে তত দিনে ওখানে একটা রহস্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়ে গেছে ভারতীয় মল্লদের ঘিরে। গোবরের দ্বিতীয় আবির্ভাবে সেই রহস্য বহু গুণ ঘনীভূত হল। ভারতীয়দের হাতে সাহেবদের পরাজয়ে উৎসাহিত গোবর কিছু দিনের মধ্যেই ফের ইংল্যান্ডে এসে শুরু করলেন জয়ের অভিযান। ১৯১৩-র অগস্টে এডিনবরায় স্কটিশ চ্যাম্পিয়ন জিমি ক্যাম্বেলকে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিটে চিৎ করেছিলেন গোবর। কিছু দিন পরেই লন্ডনে জিমি এসনকে হারিয়ে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতলেন তিনি। কুস্তিতে চ্যাম্পিয়ন হলেন বটে, কিন্তু রেসলিং চ্যাম্পিয়নের প্রাপ্য ‘জন বুল বেল্ট’ তাঁকে দেওয়া হল না, কারণ তিনি ‘যদিও ব্রিটিশ প্রজা, কিন্তু জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নন’। আসলে ব্রিটিশদের অধীনে থাকা ভারত থেকে এক জন এসে তাঁদের গর্বের খেতাব কেড়ে নিল, এটা মানতে পারেননি ইংরেজরা। ওই বছরই প্যারিসে মল্লযুদ্ধের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ছিল। সারা পৃথিবীর বাঘা বাঘা চ্যাম্পিয়নরা এসেছিলেন সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। সেখানে বেলজিয়ামের হ্যানসন আর জার্মানির কার্ল জাফট-কে অবলীলায় পরাজিত করেন গোবর।
এরপরে ডাক পড়ল আমেরিকা থেকে। আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ এবং মল্লবিদের দেশে খেতাব এবং অহমিকার রক্ষায় তখন মল্লক্রীড়ায় যে কোনও নীতিকে এ দিক-ও দিক করতেও প্রস্তুত সে দেশের মানুষ। ১৯২০-র ২৬শে অক্টোবর গোবর আমেরিকার উপকূলে হফম্যান বন্দরে এসে পৌঁছলেন বটে, কিন্তু তখনই তাঁকে নিউইয়র্কে ঢুকতে দেওয়া হল না, ‘কোয়ারান্টাইন’ করে রাখা হল। দেড় মাস পরে যখন ছাড়া পেলেন, তখন তিনি ক্লান্ত, বিরক্ত। আশ্চর্য, দশ দিনের মাথাতেই তাঁকে জোর করে ডাচ কুস্তিবীর টমি ড্রুক-এর বিরুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া হল! প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, অনুশীলনে দীর্ঘ ছেদ— এই সমস্ত কথা টেকেনি। তবুও জয় গোবরেরই নিশ্চিত ছিল, যদি না রেফারি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করতেন। এক বার বিখ্যাত আমেরিকান মল্লবিদ এডওয়ার্ড স্ট্র্যাঙ্গলার লুইস-এর সঙ্গে কুস্তিতে নামবেন গোবর। প্রথম দুটি রাউন্ড ড্র হওয়ায় তৃতীয় রাউন্ডে গোবরকে ফাউল করে হারালেন লুইস। নির্বিকার রইলেন রেফারি। পরে অবশ্য লুইসকে হারিয়েছিলেন গোবর। এক ঘণ্টারও কম সময়ে চিৎ করেছিলেন তাঁকে। তবে লুইসকে গোবরের বিরুদ্ধে খেলতে নামানো আমেরিকার ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত ছিল। কোনও বিভাগে চ্যাম্পিয়ন থাকাকালীন অবস্থায় আমেরিকানরা তাদের মল্লবিদকে সুনাম এবং খেতাব হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে গোবরের বিরুদ্ধে নামাতেন না। এতটাই ছিল তাঁদের গোবর-ভীতি। অথচ বিদেশে সম্পূর্ণ অচেনা পদ্ধতিতে খেলতে হয়েছে গোবরকে। ভারতে যেখানে মাটিতে খেলা হয়, বিদেশে সেখানে খেলা হত ম্যাটের ওপর। সেখানে কুস্তির স্বীকৃত নিয়ম ছিল গ্রেকো রোমান পদ্ধতি। এই নিয়মে প্রতিপক্ষের কোমরের নীচে ধরলে ফাউল ধরা হত। ফ্রি-স্টাইল কুস্তিতে অভ্যস্ত গোবর এই নিয়মে আগে কখনও খেলেননি। তবে কোনও বাধাই দমাতে পারেনি তাঁকে। ১৯২১ সালে সানফ্রান্সিসকোতে তৎকালীন লাইট হেভিওয়েট রেসলিং চ্যাম্পিয়ন অ্যাড স্যান্টেলকে গোহারা হারিয়ে পদক জিতে নেন তিনি। কুস্তিতে কোনও ভারতীয়ের সেই প্রথম বিশ্বজয়। মোহনবাগানের শিল্ড জয়ের পর ভীরু, দুর্বল অপবাদ ঘুচিয়ে সাহেবদের দেশে পরাধীন দেশের এক নাগরিকের জয়যাত্রা। বাঙালি তথা ভারতবাসীর কাছে এই জয়ের গুরুত্ব যে অপরিসীম ছিল তা বলাই বাহুল্য।
প্রায় ছয় বছর আমেরিকায় ছিলেন গোবর। এই সময়ে তিনি একের পর এক কুস্তিবিদকে চিৎ করেছেন। খ্যাতি যত বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁকে নিয়ে গুজবও। বিশ্বসেরা হওয়ার কিছু আগে বিখ্যাত আমেরিকান স্পোর্টস কার্টুনিস্ট রিপ্লে লিখলেন, শক্তি বাড়ানোর জন্য গোবর রোজ সোনা খান। লেখার সঙ্গে ছবি, মাটিতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে সোনা খাচ্ছেন গোবর। আমেরিকায় মহা হইচই পড়ে গেল মহাক্ষমতাশালী অ্যাথলিটের শক্তিবৃদ্ধির ‘সিক্রেট’ জানতে পেরে। শেষে লরি প্র্যাট নামে এক সাংবাদিক লিখলেন, ও সব কিছু না। গোবরের আসল ক্ষমতা তাঁর শ্বাস নিয়ন্ত্রণে। সাংবাদিকরা ইন্টারভিউ নিতে এসে বহু বার চেষ্টা করেছেন তাঁকে বেকায়দায় ফেলার। এক বার ইভলিন ওয়েলস নামে এক মহিলা সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, আমেরিকায় এসে নতুন কী কী শিখলেন? মুচকি হেসে গোবর জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘জাঙ্ক, বাঙ্ক, বাম, আরও বেশ কিছু আমেরিকান স্ল্যাং।’’ উত্তর শুনে ইভলিন থতমত। পরের প্রশ্ন ছিল, হলিউডের কোনও সিনেমা দেখেছেন? গোবর বলেছিলেন, অবসর সময়ে এ দেশে কিছু করার নেই বলে সিনেমা দেখি। কিন্তু এখানকার সিনেমা খুব একঘেয়ে আর অবাস্তব। এই ইভলিনকেই গোবর বলেন বার্নার্ড শ’ এবং অস্কার ওয়াইল্ডের লেখার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের কথা।
তখনকার সংবাদপত্র কখনও তাঁকে বলেছে ‘হিন্দু মিনেস’, আবার কখনও তাঁর প্রজ্ঞা, ধীরস্থির স্বভাবের জন্য নাম দিয়েছে ‘জেন্টল জায়ান্ট’। আমেরিকা ও ভারতের জাতিভেদ প্রথা এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধেও কথা বলেছিলেন তিনি। সুদর্শন যুবক গোবর, উচ্চতা ছ’ফুট দুই ইঞ্চি। আয়ত চোখ, খড়্গ নাসা। যে পোশাকই পরেন, একটা চাদর উপরে ঘুরিয়ে নেন নিজেকে ভারতীয় বোঝাতে। বিদেশেও তাঁর পছন্দ দেশি পোশাক। নিউ ইয়র্কের এক সভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও শিক্ষা নিয়ে। গাঁধীর প্রতিও ছিল গভীর শ্রদ্ধা। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ যখন ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করছেন, তখন গোবর ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্রিটিশদের। ‘স্ট্যান্ডার্ড এগজামিনার’ কাগজে তিনি লেখেন, ইংল্যান্ড কোনও দিন ভারতে তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বিশ্বযুদ্ধের সময় সে সহায়তা চেয়েছিল, আমাদের দেশ লোকবল অর্থবল দিয়ে তাকে সাহায্য করেছিল। বিনিময়ে কী পেলাম? রাওলাট আইন, জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বোঝা যায়, কতটা ক্ষিপ্ত আর পীড়িত হয়েছিলেন তিনি এই ঘটনায়।
ইউরোপ ও মার্কিন মল্লমহল দেখল প্রবল শক্তি ও জটিল প্যাঁচের পাশাপাশি এই বিনয়ী, ভদ্র মানুষটি দারুণ বক্তৃতা করেন নিখুঁত উচ্চারণে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে। প্রিয় লেখকদের মধ্যে উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথ, বার্নার্ড শ’, অস্কার ওয়াইল্ডের নাম। ‘নিউ ইয়র্কের মডার্ন আর্টস অ্যান্ড লেটার্স-এ তো দীর্ঘ বক্তৃতাই দিলেন রবীন্দ্রনাথের জীবন ও বাণী নিয়ে। সেই ভাষণের বিষয়-গুরুত্ব ছাড়াও ওঁর ভাষাও প্রশংসা পায় পত্রপত্রিকায়। একটা নতুন নামও জোটে ভারতীয় পালোয়ানের— ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’।
এই দৈত্যের পাল্লায় পড়ে এক সময় পাশ্চাত্যের সব বড় পালোয়ানকেই নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। এড ‘স্ট্র্যাংগলার’ লুইসের কথা আগেই বলেছি। সেই লুইসকে হারিয়ে যিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন, সেই জো স্ট্রেখারকেও হারালেন গোবর। অবশ্য তত দিনে স্ট্রেখারও আর চ্যাম্পিয়ন নেই, তিনি খেতাব হারিয়েছেন স্তানিস্লাস্ সিবিস্কোর কাছে। এই সিবিস্কোর সঙ্গে দুই মোলাকাতে একবার হেরে একবার জিতেছিলেন গোবরবাবু।
বস্তুত কাকেই বা হারাননি গোবর? স্কটল্যান্ডের জিমি ক্যাম্বেল, গ্রিসের বিল দেমেত্রালস, জার্মানির কার্ল সাফ্ট, বোহেমিয়ার জো শুল্জ, বেলজিয়ামের জ্যানসন, সুইডেনের লুনডিন, বুলগেরিয়ার গ্রানোভিচ, তুরস্কের মেহমুদ …।
১৯২১-এর ১৮ অক্টোবরে শিকাগোর এক পত্রিকায় হেডলাইনে সেই প্রবাদপ্রতিম স্যান্ডো (১৮৬৭-১৯২৫) গোবরের লড়াই দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘গোবর ইজ অ্যানাদার মেহমুত।’’ মসৃণ প্যাঁচ ও প্রবল ঝটকার জন্য মেহমুতের বেজায় নাম তখন বিশ্ব কুস্তিতে।
তবে যে-ছোট গামা ও গোবরের কুস্তি নিয়ে দীর্ঘকাল চর্চা শুনে আসছি আমরা, তার ফলাফল নিয়েও বিশেষ কৌতূহল থাকার কথা নয়। তিন ভাই গোলাম, কল্লু ও রহমানের মধ্যে মধ্যম জন কল্লুর পুত্র ছোট গামা (জন্ম ১৮৯৯) মারপিট ও জঙ্গিপনাতেও অভ্যস্ত ছিলেন। গোবরবাবুর ঘনিষ্ঠ ও তাঁর জীবনীকার সমর বসু মনে করেন না, ছোট গামা গোবরের যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন।
মুর্শিদাবাদের নবাব স্যার ওয়াশিক আলি মির্জা খাঁ সাহেবই ছোট গামার সঙ্গে গোবরের কুস্তির প্রস্তাব দেন, অথচ সে-কুস্তিতে না রাখা হল রেফারি, না টাইমকিপার। বস্তুত নিয়মের বালাই রইল না। গোবরবাবু হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়াতেই ছোট গামা ওঁকে ধাক্কা মেরে মেরে দড়ির ওপর নিয়ে ফেললেন এবং নিজেও দড়ির ওপর গিয়ে পড়লেন। তার পর ‘জিত গয়া!’ হুঙ্কার দিয়ে রিং থেকে নেমে গেলেন। বাঁশি বাজিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে আনা হলে অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়ানো গোবরকে ধাক্কা মেরে ছোট গামার দিক থেকে চিৎকার ‘জিত গ্যয়া!’
দেশে ফিরে প্রথমে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট, পরে গোয়াবাগানে আখড়া তৈরি করেন তিনি। বাইরের জগৎ থেকে এক রকম বিচ্ছিন্ন এই আখড়াই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধ্যানজ্ঞান ছিল তাঁর। কারণও ছিল হয়তো। যে অবিচার দেশের বাইরে বারবার তাঁর সঙ্গে হয়েছে, স্বদেশে অন্তত তার সম্মুখীন হতে হবে না, আশা করেছিলেন হয়তো। কিন্তু তা হয়নি। ১৯২৯ সালে পার্ক সার্কাসে কংগ্রেসের অধিবেশনে কুস্তি প্রদর্শনীতে গোবর গোহর প্রতিপক্ষ ছিলেন ছোট গামা। ছোট গামা পরপর দু’বার ফাউল করা সত্ত্বেও কী কারণ দেখিয়ে তাঁকেই বিজয়ী ঘোষণা করেন মুর্শিদাবাদের নবাব। গোবরের নামে অনেকেই পিছনে বলতেন, উনি তো বিদেশে কিছু শৌখিন কুস্তির ভ্যারাইটি শো জিতে এসেছেন! কান দেননি তিনি। দলাদলি, রাজনীতির পাঁক থেকে দূরে রেখেছেন নিজেকে। এক সময়ে সাজপোশাকে শৌখিন ছিলেন। বাহারি পাগড়ি, সূক্ষ্ম কাজের কাশ্মীরি শাল পরা গোবরকে ‘প্রিন্স গোবর’ বলতেন বিদেশিরা। সেই তিনিই দেশে গাঁধী টুপি আর সহজ সাধারণ ফতুয়া ছাড়া আর কিছু পরতেন না। ধুতি নিয়ে হত সমস্যা। এত লম্বা লোক সচরাচর বাঙালিদের মধ্যে হয় না। অর্ডারি ধুতি আনা হত তাঁর জন্য। যুবক বয়স থেকেই আতরের শখ ছিল। বয়স হওয়ার পর তার ব্যবহারও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু হরেক খোপওয়ালা কারুকার্যময় আতরের বাক্সটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন আখড়াতে। আখড়ায় বিদ্যুৎ পর্যন্ত রাখতেন না বাহুল্য বোধে। প্রত্যেক শিষ্যের খুঁটিনাটির খবর রাখতেন। গা ঘামিয়ে ছেলেরা যখন তাঁর বাড়ি যেত, প্রত্যেককে নিজের হাতে গুড়ের শরবত বানিয়ে দিতেন। সত্যেন বোস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, গাঁধীজির প্রথম একান্ত সচিব অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু প্রায়ই আসতেন আখড়ায়। মান্না দে ছিলেন তাঁর মেজ ছেলের বন্ধু, রীতিমতো কুস্তি শিখতেন এখানে। গোবরের ছেলেরাও কুস্তি শিখেছেন এই আখড়াতেই। বড় ছেলে রতন গোহ রাজ্য কুস্তি ফেডারেশনের সচিব ছিলেন। মেজ ছেলে মানিক জাতীয় হেভিওয়েট কুস্তি চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
এক সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিলেন। এস্রাজ বাজাতেন চমৎকার। মৃত্যুর কিছু দিন আগে মেয়েকে বলেছিলেন ধুলো ঝেড়ে যন্ত্রটা বার করে দিতে। ১৯৭২ সালের ২রা জানুয়ারি, রেসলিং চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার পরে আমেরিকায় তোলা তাঁর একটা ছবি বাড়ির লোকেদের দিয়ে বলেছিলেন, রেখে দাও, কাজে লাগবে। সেই রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। গোবরের মৃত্যুর খবর পেয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। কেদারায় কাত করে রাখা ছিল এস্রাজটা। মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন নেই, পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিলেন গোবর গোহ। ‘দ্য জেন্টল জায়ান্ট’। সুর, প্রজ্ঞা আর শক্তি যাঁর মধ্যে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল।
কুস্তির এই প্রহসন দিয়ে গোবরবাবুর গুরুত্ব মাপা যায় না। সত্যিই তো, এত বড় মল্ল বাংলায় তো আর হল না। শেষ বয়সে এটাই বড় আফসোস রয়ে গেল তাঁর। জুডো, ক্যারাটের শখ হল, বাঙালি ছেলে-ছোকরাদের (কুংফু-র নাম তখনও ছড়ায়নি অতটা) মধ্যে, কিন্তু ডন-কুস্তির হাল ধরল না কেউ। ডন-কুস্তি করেও যে সেতার বাজানো যায় এ তো তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়েছিলেন।
সে কথাটিই তাঁর শ্রাদ্ধবাসরে ‘গোবরস্মরণে’ স্মৃতিগ্রন্থ প্রকাশ করে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বন্ধু বিজ্ঞানী ও এস্রাজ বাজিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
(তথ্যসূত্র:
১- “Lord of the wrestling rings” – Article published in ‘The Telegraph’ by Abhijit Gupta on 4th July 2010.
২- “অথ কুস্তি-কথা” – ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় ২রা ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে শ্রী অনন্ত মন্ডল লিখিত প্রবন্ধ।
৩- আনন্দবাজার পত্রিকা: ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল ও ৩১শে মার্চ ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত