শ্রী রাজ্যপাল মহাশয়, আপনি আন্দামানে ঘুরতে গেছেন কিন্তু আমি ব্যাথিত ও অপমানিত বোধ করছি, আপনি যেমন করে থাকেন। শেষ বার এরকম অপমানিত বোধ করেছিলাম বাঙালি হিসেবে ওই আপনার লর্ড কার্জনের ‘আইকনিক’ চেয়ারে বসে গদগদ হয়ে ছবি টুইট করা দেখে।
এবার আপনি সেলুলার জেলে ঘুরতে গেছেন দেখলাম। সাভারকরের সেলে বসে ধ্যান ও করেছেন দেখলাম। আপনি জানেন ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়টি সেলুলার জেলের। কি মারাত্মক অত্যাচার করা হতো ভারতীয়দের সাথে ওখানে। রাতের পর রাত না খাইয়ে ফেলে রাখা হতো, বরফের উপর শুইয়ে চলতো অত্যাচার, ঠাঠা রোদে দাঁড় করিয়ে চাবুক মারা, ১৮ঘন্টা টানা ঘানি টানতে বাধ্য করা। নারকেল পিষে রোজ ২৫ কেজি তেল বানাতে হত, নইলে দেওয়ালের হুক থেকে ঝুলিয়ে ডান্ডা দিয়ে পেটানো হতো৷ এসব কিছু করা হতো কারণ ওদের অপরাধ ছিল ওরা স্বাধীনতা সংগ্রামী।
রাজ্যপাল মহাশয়, আপনি বাংলার ফার্স্ট পার্সন। আপনার চেয়ারের ওজন অপরিসীম। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে সেলুলার জেলে বন্দিদের মধ্যে সর্বাধিক ছিল বাংলার। ৫৮৫জন বন্দির মধ্যে ৩৯৮ জনই ছিল বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী। অন্য কেউ না হোক, আপনি বাংলার রাজ্যপাল থাকাকালীন যখন ওই পবিত্র ভূমিতে গেলেন, একবার দ্বিতীয় তলায় ডানদিকে শ্বেতপাথরে লেখা ওই নামগুলো দেখে আসলেন না? বিস্মৃত থেকে যাবে ওই নামগুলো? খাবার বলতে ভাতের মাড় আর ঘুপচি একটা ঘর যাতে সূর্য-আলো ঢোকেনা। হাত-পাটুকুও ছড়ানো যেত না। আপনি নিশ্চিত জানবেন। ওরকমই এক ঘরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন দেখলাম। কিন্তু একবার ও মোহিত মৈত্রর মূর্তিটা দেখতে গেলেন না? একরত্তি ছেলে তিন সপ্তাহ অনশন করেছিল। জোর করে নাক দিয়ে দুধ শরীরে ঢুকিয়ে দিতে যাচ্ছিল ব্রিটিশরা, কিছুতেই পারেনি। দম আটকে মারা যায় কিন্তু অনশন চালিয়ে যায় দেশের জন্য। এই গল্প আপনার টুইটারে স্থান পাবে না?
আপনি তো লর্ড কার্জন নিয়ে আপ্লূত ছিলেন। জানেন তো, একমাত্র একজন বড়লাটই খুন হয়েছিল। ১৮৭২-এ বড়লাট লর্ড মেয়ো আন্দামান পরিদর্শনে আসেন। সেখানে আফ্রিদি উপজাতির ওয়াহাবি শের আলি তাঁকে হত্যা করে। শের আলি আফ্রিদি কিন্তু ভারতীয়দের চোখে ‘আইকনিক’।
বটুকেশ্বর দত্ত, আলীপুর মামলায় অভিযুক্ত যতীন্দ্রনাথ মুখার্জি ওরফে বাঘা যতীনের বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ সহচর, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উল্লাসকর দত্ত, মোহিত মৈত্র, বীরেন্দ্র চন্দ্র সেন, ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন’ সমিতির সদস্যরা, সূর্য সেনের সহযোগী চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সঙ্গে জড়িত বিপ্লবীদের ও খাঁচা ছিল এই সেলুলার জেলে।
কালাপানি বা সেলুলার জেলের ইতিহাসটা স্রেফ সাভারকারের ইতিহাস না। উনি মহান ব্যক্তি হতে পারেন কিন্তু ওনার বন্দিজীবনের গল্প না এই কালাপানি। ওর ঠিক পাশেই যে খাঁচাগুলো আছে ওই প্রত্যেকটা খাঁচার একটা একটা গল্প আছে। গায়ে কাঁটা দেয় সেই গল্প শুনে। হাউ হাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করে ওদের উপর চলা অত্যাচার শুনে। দারুণ রাগ হয়, কৃতজ্ঞতা জানাতে ইচ্ছে করে ওদের আমাদের জন্য একটা সুন্দর স্বাধীন দেশ উপহার হিসেবে রেখে যাওয়ার জন্য। আপনাকে শুনতে হবে রাজ্যপাল সেই সমস্ত গল্প। ওগুলোই বাঙালির ঐতিহ্য, অহংকার। স্বাধীনতাটা রক্ত দিয়ে এসেছিল। ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে না। সেলুলার জেলের প্রত্যেকটা নাম সমানভাবে উচ্চারিত হোক। তাদের আত্মবলিদান ব্যার্থ হতে দেবে না বাঙালি। অপমানিত বোধ করছি এই অজ্ঞতা দেখে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত