একটা ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে প্ল্যাটফর্ম থেকে… জানলায় দেখা যাচ্ছে বছর তেইশের এক যুবতীর মুখ, প্রত্যয়ী, অথচ বিষণ্ণ। খুব দ্রুত কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়া প্রয়োজন তাঁর। এই শহরটা বার বার তাঁকে ব্যথা দিচ্ছে। আর এবারের ব্যাথার উপশম বোধহয় বিচ্ছেদেই লুকনো।
মেয়েটির ডাইরি বলছে, ‘অক্ষত হৃদয়ে আমার তেইশ বছর বয়স হয়নি। … আমার একজনকে ভালো লাগত। এবং আমাদের বাড়ির সকলেও তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে দিয়েছিল। খুব যা-তা ছিল না সে, মাথায় লম্বা, রং ফর্সা, ব্যবহার মিষ্টি, সুকুমার, কমনীয়, সাহিত্যানুরাগী, সদ্বংশজাত, আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। আমি মনে মনে মুগ্ধ। … কিন্তু যতই দিন যায় ততই বুঝি সে বড় ছেলেমানুষ, ব়ড় কোমল, আমার আরো কড়া ওষুধ দরকার।’ ডাইরি আরও বলছে, ‘চলে না গিয়ে উপায় ছিল না। … ট্রেন ছেড়ে দিল, আমি আমার পুরনো জীবন থেকে শিকড়গুলো উপড়ে নিলাম।’
সেদিনকার সেই সুপরিণত, আত্মবিশ্বাসী, বেপরোয়া মেয়েটিই লীলা। লীলা মজুমদার। শিকড় উপড়ে নেবার খেলায় জীবন যাকে কোনও দিনও হারিয়ে দিতে পারেনি। কারণ এমন কাজ তাঁকে একবার নয়, বহুবার করতে হয়েছে।
যে বাঙালির জীবনে উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার নেই, দক্ষিণারঞ্জন, যোগীন্দ্রনাথ, পুণ্যলতা, সুখলতা, লীলারা কেউ নেই, সে বাঙালির কোনও ছেলেবেলাই নেই। লীলা মজুমদার নামটির সঙ্গে শিশু সাহিত্যের বিষয়টি এমন ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, তাঁর লেখা ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘টংলিং’, ‘হলদে পাখির পালক’, ‘গুপীর গুপ্তখাতা’, ‘মাকু’ বাঙালি আজও ভুলতে পারে না। বাঙালির ছেলেবেলাকে তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে দিয়েছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে লীলা মজুমদারের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত।
আপাতত ট্রেন তাঁকে নিয়ে চলেছে কলকাতা থেকে দূরে … কোথায়? তার উত্তর নয় পরে জানা যাবে। এই মুহূর্তে এ-ঘটনার বেশ কিছু বছর পরে চলে যাওয়া যাক, যেখানে লীলাকে আবারও নিজের ভিত খুঁড়ে ফেলতে হচ্ছে শক্ত হাতে।
যে-মানুষটির উপস্থিতি রীতিমতো উপভোগ করতেন তিনি ছোটবেলায়, যে-মানুষটির রসবোধ চারিয়ে নিতেন নিজের মধ্যে, সবচাইতে ভালবাসার কয়েক জনের তালিকায় উপরের দিকে, সেই মানুষটির সঙ্গে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ তো বন্ধই। সেই মানুষটিই মুখ ফিরিয়ে নিলেন, আর তিনিও সাধলেন না বিশেষ। মানুষটি স্বয়ং তাঁর পিতৃদেব প্রমদারঞ্জন রায়। তখন তিনি লীলা রায়। আর রায় থেকে মজুমদার হয়ে ওঠার কালেই এই বিপত্তি, যা প্রমদারঞ্জনের জীবৎকালে ঘোচেনি।
তখনকার নাম করা ডাক্তার সুধীন কুমার মজুমদার, পারিবারিক মেলামেশায় গোড়া থেকেই তাঁকে মনে ধরেছিল যুবতী লীলার। পছন্দ অবশ্য উভয় দিকেই ছিল। কিন্তু পাত্র হিন্দু। বেঁকে বসলেন গোঁড়া ব্রাক্ষ্ম প্রমদারঞ্জন। সম্ভবত তিনি বোঝেননি, তাঁর মেধাবী, গৃহকর্মনিপুণা, সুলেখনীর অধিকারী কন্যাসন্তানটি তাঁরই মতো জেদি। হয়তো-বা তাঁর চেয়েও কিছু বেশি।
বিয়ে হল সই করে, সেদিনকার লীলা রায় হয়ে উঠলেন সকলের লীলা মজুমদার আর সেইসঙ্গে বন্ধ হল বাবার মনে যাতায়াত করার রাস্তা।
লীলা লিখছেন, ‘বাবা আমাকে ত্যাগ করলেন। পরদিন সকালে সব কথা ভুলে দুজনে গেলাম বাবাকে প্রণাম করতে। তিনি আমাদের দেখেই ঘর থেকে উঠে চলে গেলেন। শুধু ঘর থেকেই নয়, আমার জীবন থেকেই সরে পড়লেন। তারপর আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন, কখনো আমার বা আমার ছেলে-মেয়ের দিকে ফিরে চাননি।… আঠারো বছর পরে যখন তিনি চোখ বুজলেন, আমি এতটুকু ব্যক্তিগত অভাব বোধ করিনি। যে অভাব, যে বেদনা ছিল, ঐ সময়ের মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে টের পেলাম।’
এই ছিলেন আদত মানুষ লীলা। নীতিবোধ আর আত্মমর্যাদার প্রশ্নে যিনি কখনও কোন আপস করেননি। কোনও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও নয়, এমনকী, যেমন দেখা গেল, নিজের বাবার সঙ্গেও নয়।
যেটা ভাবায়, তা হল এই যে, যে-শিল্পীর কলম থেকে এত পেলব, এত কল্পনাপ্রবণ, এত আদুরে আর এত ফুরফুরে সমস্ত লেখা বেরিয়েছে, তাঁর ভেতরকার ভিতটা যে এইরকম পোক্ত আর অনড় হতে পারে, অনেক সময়েই তা আমরা ভেবে উঠতে পারি না। তাঁর অন্তঃকরণের সমস্তটুকুকে তাঁর সৃষ্টি দিয়েই মাপতে চাই।
সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের সৃষ্টি তাঁর চারিত্রিক পেলবতারই প্রতিফলন, তাঁর স্বপ্নময় ভাবনারই প্রকাশ। কিন্তু তার আড়ালে এই রকম কঠোর নীতির একজন মানুষ লুকিয়ে আছেন, তাঁর জীবনকে না-জানলে সে-কথা বোঝার রাস্তা নেই।
কিন্তু এসব তো অনেক পরের কথা। আমরা যারা আমাদের সক্কলকার ঠাকুমার মুখটি বসিয়ে নিয়েছি লীলা মজুমদারের মুখে আর আবাল্যকাল হাঁ করে তাঁর কাছ থেকে একের পর এক মজাদার আজগুবি সমস্ত গল্প শুনেছি, তাদের সেই আদরের পাতানো ঠাকুমার রূপকথার ভিতটা কোথায় তৈরি হয়েছিল?
তাঁর ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ গল্পে আশ্চর্য এক বড়ির অলৌকিক ক্ষমতার কথা বড় হয়েও আমাদের মনে থেকে যায়। কালুর বন্ধু বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনে যখন বলে, ‘ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি’, যেহেতু মানুষদের পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিল এবং বাঁদরের রক্ত মানুষের রক্তে এখনও মিশে ‘আছেই আছে’, তাই সেই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, ‘ওই একরকম ধাত কিনা’, অবিশ্বাস হয় না। অতএব রোজ পড়াতে আসা মাস্টারের হাত থেকে বাঁচতে এর প্রয়োগ কালুর কাছে বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেই বড়ি দেওয়া পান খেয়ে অবশ্য মাস্টারের কিছু হয়েছিল কি না, কালু আর জানতে পারেনি। তিনি অন্য গ্রামের স্কুলে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কালু রাতের অন্ধকারে পাঁচিল থেকে দুটো ল্যাজ ঝুলে থাকতে দেখত।
লীলা মজুমদারের এই দুর্লভ ‘বাল্যদৃষ্টি’র কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন রাজশেখর বসু থেকে আরও অনেকেই। এই দৃষ্টির জন্ম হয়েছিল তাঁর শৈশবে, খাসিয়া পাহাড়ের শিলং শহরে। সেখানকার পরিবেশ তাঁকে সহায়তা করেছিল। আরও একটি কারণ অবশ্যই ছিল, সেটি পারিবারিক। বাংলাদেশের শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে যে ক’টি পরিবারের অবদান উল্লেখযোগ্য, তাদের মধ্যে রায়চৌধুরী পরিবার অন্যতম। লীলা মজুমদারের সাহিত্যে যে বাল্যদৃষ্টি, তার সূচনা হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’-এর হাত ধরে। সদ্য ছাপা ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি তিনি উপেন্দ্রকিশোরের হাতেই দেখেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। সেই স্মৃতি তিনি কোনও দিনও ভুলতে পারেননি। ১২ বছর বয়সে শিলং থেকে কলকাতায় আসার পর সুকুমার রায় তাঁকে দিয়ে জীবনের প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মীছেলে’ লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘সন্দেশ’-এর জন্য। বড়দা সুকুমার, বড়দি সুখলতা, মেজদি পুণ্যলতা, মণিদা সুবিনয়ের মতো মানু্ষের প্রভাব ক্রমশ তাঁকে যথার্থ ‘সন্দেশী’ করে তুলেছিল। তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘জ্যাঠামশাইরা, জ্যাঠামশাইয়ের ছেলেমেয়েরা সবাই গল্প লিখতেন, চমৎকার ছবি আঁকতেন। সুখলতাদির পরিদের গল্প পড়ে মুগ্ধ হতাম। ছোটো জ্যাঠা কুলদারঞ্জনের রবিনহুড পড়ে তো প্রায় অজ্ঞান!’
খুব ছোট থেকেই তাঁর চার পাশে গল্পরা ঘুরে বেড়াত। স্কুলের ‘প্রসূন’ পত্রিকায় হাত পাকানোর পালা শুরু হয়েছিল। বাড়িতে বানিয়ে বানিয়ে এমন করে ঘটনার বর্ণনা দিতেন, শুনে মনে হত বুঝি সত্যিই ঘটেছে। তাই নিয়ে মায়ের বকুনিও খেয়েছেন কত বার। কিন্তু বানানো গল্প আর মিথ্যে কথার মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে চেষ্টা করতেন। লিখেছেন, ‘শিলং পাহাড়ে থাকতাম, সরল বনের মধ্যে হাওয়া দিলে সোঁ সোঁ শব্দ হত। ঠিক যেন লুকনো কথা বলে দিচ্ছে। দুটো পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইলে গোঁ গোঁ শব্দ হত। মনে হত ওইখানে কোনও গোপন জায়গায় শেকল দিয়ে দৈত্য বাঁধা আছে, ছাড়াবার চেষ্টা করছে। পাহাড়ি আয়ারাও গল্প বলত। সে সব দুঃখের গল্প, হারানোর গল্প, না পাওয়ার গল্প, কষ্টের গল্প। শুনে কান্না পেত।’
তাঁর নিজের জীবন নিয়ে নিজের-বলা গল্প পড়লে বোঝা যায়, শৈশবের শিলং শহরের বাস, সে-শহরের বেড়ে ওঠার দিনগুলো তাঁর পিছু ছাড়েনি কোনও দিনও। তিনি ছেড়ে এসেছেন সে-শহর, হয়ে গিয়েছেন কলকাতার, খানিকটা শান্তিনিকেতনেরও বটে। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ দীর্ঘায়ু জীবনে পাহাড়-ঘেরা ছোট্ট সাহেবি কেতার শহরটিকে বরাবর মনে রেখে দিয়েছেন তিনি।
‘পাহাড়ের ঢালের ওপর বাড়ি। গেট দিয়ে ঢুকে কাঁকড় বিছানো পথ দিয়ে নেমে বারান্দায় পৌঁছতে হত। একহারা লম্বা বাংলো, সামনে টানা বারান্দা, তার কাঠের রেলিং। বাড়ির তিনদিক ঘিরে বৃষ্টির জল যাবার জন্য নালা কাটা। তার ওপর দুটি চ্যাপ্টা পাথর ফেলা। তার ওপর দিয়ে বারান্দায় উঠতে হয়। বারান্দার ছাদ থেকে তারের বেড়ায় অর্কিড ফুল ঝুলত। তাদের তলায় সবুজ কাঠের বাক্সে জেরেনিয়ম ফুল ফুটত। লোকে এমন বাড়ি স্বপ্নে দেখে।’
এই ছিল শিলং-এ ছোট্ট লীলা আর তার দাদা-দিদির স্বপ্নের বাড়ি ‘হাই উইন্ডস’। ভাড়া নিয়ে সপরিবার এই বাড়িতেই কর্মসূত্রে আট বছর কাটিয়েছিলেন প্রমদারঞ্জন, ১৯১১ থেকে ১৯১৯। সেই আট বছরে লীলার মনে তৈরি হয়ে যায় রূপকথার রাজ্যের এক নিজস্ব ছক, সারাজীবন যার নকশা বুনে গিয়েছেন তিনি।
মেম শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ফিরিঙ্গি বান্ধবীদের সঙ্গে ক্লাস করা, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে দিদির সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরা, বর্ষা থেকে শীতে পাল্টাতে থাকা শিলং-এর আশ্চর্য রূপ, বাড়িতে কাজ করতে আসা খাসিয়া মেয়েদের মুখ থেকে সুযোগ পেলেই আজগুবি সব গল্প শোনা, লাইব্রেরি আর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে একরাশ ইংরেজি বই জড়ো করে এনে গোগ্রাসে পড়া আর এসবের বাইরে একা একা ঘুরে বেরিয়ে প্রকৃতির ছোটখাটো মজা আর ভাললাগা কুড়িয়ে বেড়ানো। এই ছিল ছোট্ট লীলার সেই আট বছরের রোজনামচা।
গল্পের ভূত তাঁকে পেয়ে বসেছিল সেখানেই, মাথাতেই বাঁধতে শুরু করল মজার মজার সব গল্প। ভাইবোনদের, দাদাদিদিদের শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিতে লাগলেন। পাশাপাশি লুকিয়ে লুকিয়ে একটা খাতায় লিখেওছিলেন কয়েকখানা। কিন্তু ফাঁস হয়ে যেতেই অভিমানে ছিঁড়ে ফেলে দেন।
অবশ্য আবার তাঁকে ফিরে যেতে হয় খাতার কাছেই এবং শিলং-এ থাকাকালীনই, ওই ছোট বয়সেই সম্ভবত তিনি টের পেয়েছিলেন, তাঁর সারা জীবনের কাজ হতে চলেছে এই লেখালিখি। আর হ্যাঁ, যে-ভাষায় তিনি ছোট থেকে সড়গড়, সেই বিলিতি ইংরেজিতে নয়, তাঁর মায়ের মুখের ভাষা, বাবার মাটির ভাষা বাংলাতেই।
শিলং-এর আরও একটি বিকেলবেলা তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। আর সেই বিকেলে যে সম্পর্কের সূত্রপাত, তার চিহ্ন তিনি বহন করেছিলেন আমৃত্যু।
সেই মানুষটি সম্বন্ধে লীলা এক কথায় লিখেছেন, ‘আমার মনে হয় এমন সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে কম জন্মেছে।’ তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবি সপরিবার শিলং বেড়াতে গিয়েছিলেন যখন, বাবার হাত ধরে ছোট্ট লীলাও গিয়েছিল কবিকে দেখবে বলে।
সেই তাঁর রবীন্দ্র-সংসর্গের শুরু। পরবর্তীতে খোদ কবিই তাঁকে ডেকে নিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে, সে কাহিনি সকলেরই জানা।
শান্তিনিকেতনের কাজে মেতে থাকা, পরে মন-না-লাগায় সে-কাজ ছেড়ে চলে আসা, ফের শান্তিনিকেতনেই পাকাপাকি থাকার জন্য বসতবাটি তৈরি করা… মোট কথা, রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনের তৎকালীন নির্ঝ়ঞ্ঝাট প্রাকৃতিক আশ্রয়ের ছায়া তাঁকে বার বার টেনেছিল।
রবীন্দ্রনাথের বিশালতার সঙ্গে সারল্যের যে-অভাবনীয় মিশ্রণ, তা লীলার ভাল লাগত প্রথম দিন থেকেই। আর টেনেছিল নীতির পথে অবিচল থাকবার পণ। লীলার ভিত তৈরিতে সেও কিছু কম কাজে লাগেনি।
তবে এসবের অনেক আগে দুটি মানুষের প্রভাব ও একটি কাগজ লীলার মজ্জায় ও মননে চিরস্থায়ী রূপ নেয়। ইতিমধ্যেই কিশোরী লীলা ঢুকে পড়েছেন তাঁর গল্প বুনে চলার নেশায়।
লীলা। লীলা রায়। সম্পর্কে যিনি ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাইঝি আর স্বয়ং সুকুমার রায়ের ছোট বোন। এহেন মানুষের ভবিষ্যৎ বোধ হয় জন্মেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
লীলার শৈশবে মা’র চিকিৎসা করাতে বাবা সকলকে নিয়ে এসে উঠেছিলেন গড়পাড়ের বিখ্যাত বাড়িটিতে। একতলায় প্রেস, দিনরাত লোকজনের যাওয়া আসা। গম্ভীর অথচ সুরসিক মেজ জ্যাঠামশায়ের কাগজ নিয়ে মেতে ওঠা, যে-কাগজের নাম ‘সন্দেশ’।
লীলা মজুমদারের কথায়, ‘নিচে প্রেস চলত, তার একটানা ঝমঝম শব্দ কানে আসত, মনে হত বাড়িটা বুঝি দুলছে, যে কোন সময় পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যাবে। সে বাড়ির রোমাঞ্চের কথা মুখে বলার সাধ্যি নেই আমার’।
সেই সময়েই একদিন ‘সন্দেশ’-এর প্রথম সংখ্যা হাতে করে ভিতরমহলে ঢুকে এলেন উপেন্দ্রকিশোর। অজান্তেই শুরু হয়ে গেল বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়, পরে লীলা যার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে পড়বেন।
অমন সুন্দর পত্রিকা দেখে লেখার লোভ খুবই হয়েছিল তাঁর, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেন না। ওই যে, আত্মমর্যাদা বোধ! ছোট থেকেই তা বড় তীব্র ছিল লীলার।
চারপাশে দেখা জীবন আর তার সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে ছোটদের জন্য এক নতুন পৃথিবী গড়ছিলেন তিনি তখন। মনে মনে ঠিকই করে নিয়েছিলেন, লিখলে ছোটদের জন্যই লিখবেন, ছোটদের জন্যই বাঁচবেন। আর এইখানেই বোধহয় পারিবারিক ঐতিহ্য কাজ করেছিল।
রায়চৌধুরী পরিবারের এতদিনকার পরম্পরা বোঝার আগেই জড়িয়ে ফেলেছিল তাঁকে। নইলে ওই বয়সে এমন সিদ্ধান্ত নেয় কী করে মানুষ?
শেষমেশ লেখা হল সন্দেশ-এ। বড়দা সুকুমারের নির্দেশে একখানা ছোট গল্প লিখে দিলেন, ছাপাও হল। নিজে নাম দিয়েছিলেন ‘লক্ষ্মীছাড়া’, বড়দা বদলে রাখলেন ‘লক্ষ্মী ছেলে’। ব্যস, শিশুদের জন্য ছাপার হরফে নতুন এক ভালবাসার মানুষের আবির্ভাব হল, যার নাম তখন ছিল লীলা রায়।
সন্দেশে লেখা বেরনোর পরপরই এ-কাগজ সে-পত্রিকা থেকে ছোটদের জন্য গল্প লিখে দেওয়ার আর্জি আসতে লাগল লীলার কাছে, তিনিও হাসিমুখে লেখার কাজে লেগে পড়লেন রীতিমতো। তৈরি হতে লাগল একের পর এক অবাক-করা সমস্ত চরিত্র, যাদের নানান কীর্তিকলাপ চিরকালীন হয়ে থাকার দাবি নিয়েই এল।
কিন্তু জীবন বরাবরই লীলাকে স্থিতি থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। উপেন্দ্রকিশোর গত হওয়ার পর সুকুমারের হাত ধরেই দিব্যি এগোচ্ছিল সন্দেশ, সেই তরুণ সুদক্ষ লেখক-সম্পাদকও লীলার হাত ছাড়িয়ে পালালেন।
১৯২৩ সাল, লীলা তখন ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়ার বাড়ি ছেড়ে সবেমাত্র রসা রোডের জাস্টিস চন্দ্রমাধব রোডের বাসায় এসে উঠেছেন, সুকুমার রায়ের অকাল মৃত্যুতে থমকে গেল সন্দেশ। লীলাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দেবার মানুষটি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলেন। শুধু সন্দেশ পত্রিকাই নয়, রায় পরিবারের ব্যবসাও ডুবল দেনার দায়ে, এমনকী গড়পারের প্রিয় সেই ভিটেও ছেড়ে দিতে হল তাঁদের। প্রায়-যুবতী লীলা আবারও এসে দাঁড়ালেন লেখালিখির এমন এক রাস্তায়, যেখানে কোনও ছায়া আর নেই তাঁর জন্য। কিন্তু তাঁর মনে পড়ে গেল, এক দুপুরে আবোল-তাবোলের ছবিতে তুলি লাগাতে লাগাতে বড়দা লীলাকে বলেছিলেন, ‘তুইও এসব করবি, কেমন?’
বহু পরে লীলা মজুমদার লিখছেন, ‘সেদিন আমার পনের বছর বয়স, স্কুলে পড়ি। শুধু এটুকু বুঝতে পারছিলাম বড়দা যে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, সেই আমার পথ। আমাকে দিয়ে অন্য কোনো কাজ হবে না।’ নিজের হাতের মশলাটা এভাবেই যোগ্য হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সুকুমার রায়।
এর পর কয়েকটা বছর এগিয়ে গেলেই দেখতে পাব, এক গ্রীষ্মের দুপুরে নতুন গল্পের নকশা মাথায় বুনতে বুনতে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জের ছায়ায় হাঁটছেন ছিপছিপে লীলা। শান্তিনিকেতন তাঁর ভারী ভাল লেগে গিয়েছে। সেইসঙ্গে পরম পাওয়া প্রিয় কবির সান্নিধ্য। কিন্তু আগের দৃশ্য থেকে এ-দৃশ্যে লীলাকে আসতে হয়েছিল বেশ খানিকটা ঘুরপথেই। কলকাতা-দার্জিলিং-শান্তিনিকেতন।
আপাত-স্থির এই মানুষটির মন কিন্তু শান্তি খুঁজে পেত না কোথাও। থিতু হয়ে গেলেই সে-মনের মনে হত, আটকা পড়েছি বোধহয়। তাই নতুন ঠিকানার খোঁজ শুরু হত। কলেজ শেষ করবার পর লেখালিখি পুরোদমে চললেও, নিজের সঙ্গে বেঝাপড়ার প্রয়োজনেই কলকাতা ছাড়া দরকার, এমনটাই মনে হয়েছিল তাঁর।
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। নিজেই চিঠি লিখে দার্জিলিং-এর মহারানি গার্লস স্কুলে শিক্ষিকার পদে যোগ দিলেন। সে-সময় স্কুলটি চালাতেন শিবনাথ শাস্ত্রীর কন্যা হেমলতা সরকার, লীলার হেমমাসিমা। তিনিই আদর করে ডেকে নিলেন।
এই লেখার গোড়ায় কলকাতা ছেড়ে একটা ট্রেন চলে গিয়েছিল ধোঁয়া উড়িয়ে… সেই ট্রেন আসলে গিয়ে থেমেছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার রোদ্দুরে। স্কুলের চাকরি নিয়ে নতুন জীবনের প্ল্যাটফর্মে পা রেখেছিলেন তেইশের লীলা।
কিন্তু সেখানেও বেশি দিন মন লাগল না। পালাবার পথ খুঁজছিলেন, সে-পথ নিজেই এসে ধরা দিল। দার্জিলিং বেড়াতে এলেন রবীন্দ্রনাথ, লীলা গিয়ে দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। তদ্দিনে লীলার লেখালিখি, ছোটদের প্রতি তাঁর উৎসাহ, এ সবই রবীন্দ্রনাথের গোচরে এসেছে।
শান্তিনিকেতন ফিরে গিয়ে লীলাকে একটি চিঠিতে লিখলেন তিনি, ‘আশা অধিকারী শিশু-বিভাগ পরিচালনা করেন, তিনি এক বছরের ছুটি নিচ্ছেন, তুমি এসে এক বছরের জন্য তাঁর জায়গা নাও।’
তখন সেটিই ছিল রবীন্দ্রনাথের কাজ। প্রস্ফুটিত বিশ্বভারতীকে নানান রঙের যোগ্য মানুষজনে সাজিয়ে আরও বিকশিত করে তোলা। চিঠি পাওয়ামাত্রই লীলা ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিলেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলমলে বরফের দিন ঘুচল, সামনে লাল মাটির বিস্তীর্ণ পথ।
শান্তিনিকেতনের সেই চাঁদের হাটে লীলাকে ঘিরে থাকল এক আশ্চর্য জ্যোৎস্না। আর পাশাপাশি মোমের মতো এক বিস্ময়কর মানুষের আলোও। কিন্তু বেপরোয়া মনটির বেশিক্ষণ জ্যোৎস্না সইবে কেন?
বিশ্বভারতী বা অধ্যাপনা, কোনওটিই তাঁর মনকে সেই শান্তি দিতে পারল না, যার খোঁজে এতগুলো বছর হেঁটেছেন তিনি। বিশ্বভারতী বিষয়ে লীলা মজুমদারের একটি বাক্যই তাঁর হতাশাকে বুঝিয়ে দেয়- ‘মোমবাতির ঠিক তলাটিতে অনেকখানি জমানো অন্ধকার’।
কবিগুরু যখন বিদেশে, শান্তিনিকেতনের পাট চুকিয়ে লীলা ফের কলকাতায় চলে এলেন। দেশে ফিরে তাঁর ইস্তফা পত্র হাতে পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন, ঠিক কেনখানটিতে অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে গিয়েছেন লীলা। উত্তরে বিশ্বভারতীর মলিনতার কথা স্বীকার করে নিয়ে তিনি লিখলেন, ‘তোমার যখন খুশি, যদি এসো, তাহলে দেখবে তোমার জন্য রয়েছে তোমার যথার্থ স্থান’।
বহু বছর পর শান্তিনিকেতনে অনেক আকাঙ্ক্ষার বসতবাটি তৈরি করে ফিরেই গিয়েছিলেন লীলা মজুমদার। তখন তাঁকে ঘিরেও বহু মানুষের সমাবেশ, অনেক অনুরাগীর পরিসর। জীবনসঙ্গীর প্রয়াণ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের নিভৃত বাড়িটিই ছিল তাঁর শান্তির ঠিকানা। কখনও হয়তোবা কলকাতার জন্য মন কেমন করত, কিন্তু দূর থেকে শুনতে পাওয়া সমুদ্রের গর্জনের মতোই কলকাতাকে ভাবতেন তিনি।
শান্তিনিকেতনের বাড়ির প্রশস্ত বারান্দাটিতেই শেষমেশ সৈকত খুঁজে পেয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ এই মানুষটি। রাঁধতে ও খাওয়াতেও ভারী ভালবাসতেন। তাঁর হাতের খুন্তি-কড়াইয়ে নিত্যনতুন পদের ঝালমশলার ঝাঁঝ লেগেই থাকত। ‘হলদে পাখির পালক’ বা ‘টংলিং’-এর লীলা মজুমদার তো আমাদের কবেকার চেনা।
কিন্তু ‘রান্নার বই-এর মতো উপাদেয় রন্ধনপুস্তক আর ক’টি লেখা হয়েছে এ-ভাষায়?
সংসার তাঁকে দিয়েছে অনেক, তাঁর কাছ থেকে নিংড়েও নিয়েছে বহু কিছু। তিনি অভিমান করেননি, ওইটি তাঁর ধাতে ছিল না। বরং এগিয়ে গিয়েছেন পরের ধাপের দিকে, কেবল একটুকরো বিশ্বাস আর জীবনের প্রতি ভালোবাসাকে সঙ্গী করে।
ভাবলে মনে হয়, কী আশ্চর্য রঙিন :আর কর্মময় একটি জীবন! কত রকমের অভিজ্ঞতা, যেন এক কোঁচড়ে কুড়িয়ে রাখা নানা রঙের নুড়ি। যখন যে-কাজটি করেছেন, ছাপ রেখে যাবার চেষ্টায় মেতে থেকেছেন। সেই পর্যায়ে সম্ভবত সবচাইতে বেশি সৃষ্টিশীল থেকেছেন তিনি।
অনবদ্য শিশুসাহিত্যের বেশির ভাগই তাঁর কলমে এসেছে তিনি আকাশবাণীতে কর্মরত থাকাকালীন। খানিকটা হয়তো কেজো তাগিদেই লিখতে হয়েছে তাঁকে, কিন্তু সে-লেখার মান প্রশ্নাতীত হয়েই থেকেছে। শেষমেশ এক কর্তাব্যক্তির কথায় মনে আঘাত লাগায় সেই যে কাজ ছেড়েছিলেন, দিল্লির দফতর থেকে উচ্চপদস্থ আধিকারিকের অনুরোধও তাঁকে ফেরাতে পারেনি।
তবে এর পর যে-কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন, সম্ভবত সেইটেই ছিল তাঁর সবচাইতে ভাললাগার কাজ, পছন্দের ভূমিকা। বড়দা’র সুপুত্র মানিক ও উপেন্দ্রকিশোরের নাতনি নলিনী দাশের সঙ্গে ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদনা। ১৯৬১ থেকে খোদ সত্যজিৎ রায়ের উদ্যোগে ফের বেরোতে লাগল সন্দেশ, তাঁরই আর্জিতে তাঁর আদরের ‘লিলুপিসি’ সম্পাদনায় হাতে হাত মেলালেন।
তখন তাঁর দুই মেয়ে কলেজ যাচ্ছে, সংসারের কাজকর্মও বিশেষ নেই। নিজের লেখালিখির পাশে বাকি সময়ের সবটুকু সন্দেশকেই উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি।
যে-পত্রিকা দিয়ে তাঁর গল্প লেখার শুরু, সেই পত্রিকারই পাতা এবার সেজে উঠতে লাগল তাঁর নিপুণ সম্পাদনার গুণে। ২০০৪ পর্যন্ত প্রাণ ঢেলে এই কাজটি করে গিয়েছেন লীলা। শেষমেশ ৯৭ বছর বয়সে পদত্যাগ করেছেন সন্দেশ থেকে।
আর এই সমস্ত কিছুর মধ্যে, এই ভ্রাম্যমানতা, এই স্থিরতার খোঁজের সফর চলতে চলতেই দু’হাত ভরে তিনি লিখে গিয়েছেন অসামান্য, অবিস্মরণীয় লেখা। সেসব নিয়ে কথা বলবার লেখা এ নয়, তার উপযুক্ত মানুষও আমি নই। কিন্তু একজন সফল শিল্পী বোধহয় এই রকমই হন। হাজার ঝড় আর ঢেউয়ের ঝাপটা থেকে তিনি অনায়াসে বুকের ভেতর জ্বলতে থাকা বাতিটিকে আগলে রাখতে পারেন, সারাক্ষণ। যেমন রেখেছিলেন লীলা মজুমদার।
শেষ জীবনটা কলকাতাতেই কেটেছিল। পাঠক থেকে আত্মীয়ের ভিড়ে, লেখালিখি আর সম্পাদনার ব্যস্ততায়। একেবারে শেষ দিকে স্মৃতি প্রতারণা করেছিল ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে আপামর বাঙালির স্মৃতিতে শতায়ু লীলার চিরকালীন আসনটি পাতা হয়ে গিয়েছে।
লীলা মজুমদার আসলে ক্যালেইডোস্কোপের ডাকনাম, যা চোখে লাগিয়ে ঘোরাতে থাকলে অগুনতি রঙিন কাচের নকশা ফুটে ওঠে আজও।
আমাদের সক্কলকার ঠাকুমাকে আসলে তো লীলা মজুমদারের মতোই দেখতে। যাবার আগে আমাদের প্রত্যেকের ঘুমের পাশে, বিছানার মাথার কাছে তিনি টাঙিয়ে রেখে গিয়েছেন তাঁর সেই ঝুলি, যা থেকে আজও আশ্চর্য সব গল্প বেরিয়ে আসে আর ঘুম পাড়িয়ে দেয় আমাদের।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছিলেন, “লীলাদির কথা ভাবলে মনটা আজও ভাল হয়ে যায়। অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসার সেরা উপায় হল লীলাদির গল্প পড়া। খারাপ সময়কে হারিয়ে দিয়ে ভাল সময় ডেকে আনার এর চাইতে সহজ উপায় আর হয় না।”
নবনীতা দেব সেন লিখেছিলেন, “বাংলা কেন, যে-কোনও সাহিত্যেই মেয়েদের লেখায় ব্যঙ্গরস, ব্যঙ্গকৌতুক খুব কম। তাই লীলা মজুমদারের লেখা বিশেষ ভাবে ভাল লাগত, এখনও লাগে। তাঁর শাণিত, বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা, প্রাণময়, সুস্থ রসিকতার কোনও তুলনা হয় না। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর, সেই কারণেই রসিকতার মধ্যে দিয়েও প্রতিবাদ করতে পারতেন।”
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভাষ্যে, “লীলা মজুমদার ছিলেন অদ্ভুত ধরনের এক লেখক। ছোটদের জন্য লেখায় যে-মজা তিনি আনতেন, যা তিনি বোধ করি তাঁর পারিবারিক সূত্রেই পেয়েছিলেন, আমাকে বরাবর খুব টানত। তাঁর বড়দের জন্য লেখাও আমি সমান আগ্রহে পড়েছি। আভিজাত্য বজায় রেখে রসকে উত্তীর্ণ করা, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।”
বাণী বসু বলেছিলেন, “লীলা মজুমদার নামটা শুনলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে। সাহিত্য থেকে জীবনে একজন মানুষ আনন্দকে এতখানি মূল্য দিয়েছেন, এর উদাহরণ কমই আছে। সকলেই তো দুঃখ নিয়ে লিখতে ব্যস্ত। ছোটদের গল্পে যে-শব্দচয়ন বা নামকরণ, তারও জুড়ি নেই। গুপী বা পদিপিসি শুনলেই মাথায় একটা ছবি তৈরি যায়। ছোটদের মনটা উনি খুব ভাল বুঝতেন।”
লীলা মজুমদারের জন্ম ১৯০৮ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জন রায়ও শিশুদের জন্য লিখতেন। তাঁর লেখা ‘বনের কথা’ ধারাবাহিক ভাবে ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত হত। মা সুরমা দেবী ছিলেন শান্ত ও বুদ্ধিমতী। লীলারা ছিলেন আট ভাইবোন। প্রভাতরঞ্জন, সুলেখা, লীলা, কল্যাণরঞ্জন, অমিয়রঞ্জন, সরোজরঞ্জন, যতিরঞ্জন ও লতিকা। ভাইবোনেদের প্রত্যেকের জন্ম কলকাতায়।
লীলার জীবনের প্রথম এগারো বছর কেটেছে শিলংয়ে। প্রথমে তাঁরা থাকতেন ‘লাবানপাড়ার ব্রাহ্ম মন্দিরের ওপরে ছোট্ট একটা বাড়িতে’। তার পর চলে যান যে বাড়িতে, ‘তার নিচ দিয়ে কুলকুল করে একটা নদী বয়ে যেত’। সেখান থেকে যে বাড়িতে যান, সেখানেই পাকাপাকি ভাবে থেকেছেন আট বছর। বাড়িটার নাম ছিল ‘হাই উইন্ডস’। ছোটবেলায় লীলা বেশ দুষ্টু ছিলেন। লিখেছেন, ‘মার হাতে চড় কানমলা খাবার গৌরব আমার একার ছিল। লোক আমি ভাল ছিলাম না। আমার কথামতো না চললে দাদাকে পেটাতাম, দিদিকে পেটাতাম … দাদা উলটে মারত আর দিদি ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদত।’
১০০ গড়পার রোডের বাড়িতে ইউ রায় অ্যান্ড কোং-এর ছাপাখানা ও অফিস ছিল। ওই বাড়িই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারের আস্তানা। শিলং থেকে এসে লীলার পরিবার প্রথমে সেই বাড়িতে থাকতে শুরু করে। যদিও তার চার বছর আগে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু জ্যাঠা, কাকা, দাদা, দিদিতে ভরা এই বাড়ির হাওয়ায় সাহিত্য সংস্কৃতির পরিবেশের সঙ্গে ইউ রায়ের ছাপাখানার শব্দ, গন্ধ, ‘সন্দেশ’ পত্রিকা দফতরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড এমন ভাবে মিশে থাকত যে, তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা সহজ ছিল না।
সুকুমার রায় ছিলেন লীলার জীবনে ঈশ্বরতুল্য। লীলাকে সারা জীবন বোধ হয় লালন করেছেন সুকুমারই। মৃত্যুর পরও। সুকুমারের অকালমৃত্যু লীলাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘আমার তখন ১৫ বছর বয়স। ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ি… বড়দার ঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখি সরু একটা নিচু খাটে সাদা চাদরে গা ঢেকে, বুকের উপর হাত দু’খানি জড়ো করে চোখ বুজে তিনি শুয়ে আছেন। তাকের উপর তাঁর রঙের শিশি, গেলাসে দাঁড় করানো অনেকগুলি তুলি রং মাখা, একটা ছোট্ট ন্যাতার পুঁটলি অনাদরে পড়ে আছে। ছেলের পায়ের উপর মুখ গুঁজে জ্যাঠাইমা পড়ে আছেন। খাটের পাশে একটা টুলে বৌঠান দু’হাত জোড় করে চোখ বুজে বসে আছেন। চোখের পাতার তলা দিয়ে অবিরাম ধারায় জল গড়াচ্ছে। মুখখানি পাথর কুঁদে গড়া, ভাবলেশহীন। মনে হল আমারও বুকের মধ্যে কি একটা ভেঙে যাচ্ছে। আর সেখানে দাঁড়াইনি।’
লীলা আদতে সুকুমার রায়কে জেনেছিলেন, ‘সন্দেশ’-এর ভাবনা, আদর্শের মধ্য দিয়ে। কলকাতার পাঠভবন স্কুলের ‘সুকুমার মেলা’য় লীলা এসেছিলেন। এ কালের ‘সন্দেশী’ সুগত রায়ের মনে আছে, “সুকুমার রায় সম্বন্ধে উনি দশ-বারো মিনিটে এমন করে বললেন, যেন মনে হল আস্ত মানুষটিকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম। এমনই ছিল তাঁর ভাষার দখল।’’
লীলার কর্মজীবনের শুরু হয় দার্জিলিংয়ে ‘মহারানী গার্লস স্কুল’-এ শিক্ষকতা দিয়ে। এর পর তিনি রবীন্দ্রনাথের ডাকে শান্তিনিকেতনে পড়াতে আসেন ন’মাসের জন্য। তার পর কলকাতার আশুতোষ কলেজের মহিলা বিভাগে শুরু করেন অধ্যাপনা। ১৯৩২ সালে তাঁর বিয়ে হয় হার্ভার্ড ফেরত দন্ত চিকিৎসক সুধীরকুমার মজুমদারের সঙ্গে। এই বিয়ে লীলা নিজের সিদ্ধান্তে করেছিলেন। ব্রাহ্ম-হিন্দুর এই বিয়েকে কেন্দ্র করে ঝড় উঠেছিল তাঁর পরিবারে। গোঁড়া ব্রাহ্ম পিতা প্রমদারঞ্জনের সঙ্গে চিরকালের জন্য বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল। যদিও মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অটুট ছিল আজীবন। রবীন্দ্রনাথ নিজে হাজির থেকে এই বিয়ে দিয়েছিলেন।
বিয়ের পর সাংসারিক দায়িত্বের চাপে তাঁর সাহিত্যচর্চা কমে এসেছিল। যে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় মাঝেমাঝে লিখতেন, তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গল্পগুলো মনের মধ্যে ডানা ঝটপট করত, বেরোতে পারত না। তবে শ্বশুরবাড়িতে এসে মনে হয়েছিল ‘নিতান্ত আঘাটায়’ পড়েননি। সঙ্গীত, সাহিত্য, ক্রীড়া জগতের কুশীলবদের সঙ্গে আড্ডা ও আলাপ ক্রমে জমে উঠেছিল। স্বামীর চৌরঙ্গী ম্যানসনের চেম্বার তথা বাড়িতে প্রায়ই রাতে গানের আসর বসত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও যোগাযোগ ঘটেছিল। কিন্তু ‘যে কামারশালায় নতুন দিনের বাংলা সাহিত্যের লোহা পিটিয়ে শক্ত’ করা হচ্ছিল, তার থেকে দূরে রয়েছেন বলে মনে হত। কেবল ‘স্ফুলিঙ্গ ছাড়া আর কিছুই দেখার’ সুযোগ পাচ্ছেন না যেন। সমবয়সি অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র, বুদ্ধদেব, আশাপূর্ণা প্রমুখের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। বন্ধু বুদ্ধদেবের তাড়নায় এই বাড়িতে বসেই ‘বৈশাখী’ পত্রিকার জন্য প্রথম বড়দের গল্প ‘সোনালি রুপালি’ লিখেছিলেন। তবে দুই সন্তানের জন্ম তাঁর জীবনে এমন এক পূর্ণতা এনে দিয়েছিল যে, খেদের জায়গা তেমন ভাবে তৈরি হয়নি। ১৯৩৪ সালে জন্ম তাঁর প্রথম সন্তান রঞ্জনের আর তার চার বছর পর ১৯৩৮ সালে জন্মায় মেয়ে কমলা।
ছেলে ডা. রঞ্জন মজুমদারের ভাষ্যে, “যখন স্কুলে পড়ি, সেই সময় প্রথম মায়ের বই বেরোল ‘বদ্যিনাথের বড়ি’। তখন আমার সাত বছর বয়স। আমার বোন পড়ত ডায়াসেশনে। আমি বাড়ি থেকে ট্রামে ভবানীপুর এসে বেলতলায় আমার স্কুল বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট অবধি হেঁটে যেতাম। স্কুলে বেরোনোর সময় তাড়াহুড়ো করে মায়ের মেখে দেওয়া গলা ভাত, আলু সিদ্ধ, ডাল সিদ্ধ পেট ভরে খেয়ে যেতাম। হাঁটতে গেলে পেটে ব্যথা করত। সেই ব্যথাটা আজও মনে আছে। বিকেলবেলা কাজের লোক গিয়ে আমাকে নিয়ে আসত। এই অভ্যেসেরই বদল ঘটেছিল এক দিন। সে দিন হঠাৎ তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমি একা ফিরেছিলাম। স্কুল থেকে ফিরলে মা-ই দরজা খুলতেন। সে দিন অন্য রকম হল, বাড়ি ফিরে দেখি মা নেই! শুনলাম রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন, মা তাই জোড়াসাঁকোয় গিয়েছেন।”
সুকুমার রায়ের মতো রবীন্দ্রনাথও ছিলেন লীলার জীবনে বিরাট নির্ভরতার মানুষ। তাঁর অটোগ্রাফের খাতায় রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁকে জীবনের নির্দেশ দিয়েই লিখেছিলেন, ‘পারিস যদি প্রেমের আখর, রাখিস জীবন মাঝে।’ সুকুমারের মতোই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর মুহূর্তও লীলা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন তাঁর লেখায়।
রঞ্জনবাবুর কথায়, “মা ছিলেন ইউনিক একজন মানুষ। বাবা তো শুধু টাকা দিয়েই নিশ্চিন্ত। মা সংসারের পুরো ঝক্কিটা একা সামলাতেন। ’৪২-এ কলকাতায় বোমা পড়ল। মা আমাদের নিয়ে চলে গেলেন কৃষ্ণনগর। বাবা থেকে গিয়েছিলেন চেম্বার ছিল বলে। আমাদের স্কুল বন্ধ। কৃষ্ণনগরে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতাম। ওখানে গিয়ে আমার আর বোনের খুব অসুখ করত। মা সব সামলাতেন।’’
তারই মধ্যে ‘মৌচাক’, ‘রামধনু’, ‘রংমশাল’ পত্রিকায় ছোটদের জন্য ও ‘বৈশাখী’, ‘পরিচয়’ পত্রিকায় বড়দের জন্য গল্প লিখে গিয়েছেন অনিয়মিত ভাবে। যদিও কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন, “ও সব ছোটদের জন্য আজগুবি লেখা বন্ধ করো এক্ষুনি,” তবু ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ বেশ নাম করে ফেলেছিল। পারিবারিক সমস্যা ও কাজের চাপে সাহিত্যচর্চা তেমন ভাবে এগোচ্ছিল না। কারণ তাঁর মনে হত, ‘সংসারটা বাস্তবিক একটা ইয়ে’। তবে ‘মাঝেমাঝে হঠাৎ একটা গোটা গল্প একেবারে তৈরি হয়ে আমার কলমের আগায় ছাড়া পাবার জন্য আঁকু-পাঁকু করত…বুঝতাম সব নষ্ট হয়ে যায়নি।’
লীলার স্বামীও ছিলেন ঘোর সংসারী। পুত্র রঞ্জনের স্মৃতিতে আছে, “রবিবার সকালে বাবা যেতেন যদুবাবুর বাজারে। পরনে শর্টস আর বাজার যাওয়ার জন্য বিশেষ জুতো। অনেক সময়ই আমি থাকতাম ড্রাইভারের ভূমিকায়। বাবার হাতে থাকত মায়ের করে দেওয়া লম্বা একটা লিস্ট। বাবার নির্দিষ্ট কিছু দোকান ছিল, যেখান থেকে সব কেনাকাটা করতেন। কিন্তু তাও প্রথমে সারা বাজারটা এক বার পাক মারবেন। ফেরার পর মা লিস্ট মিলিয়ে বাজারের থলি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেন। তার পর আসনপিঁড়ি হয়ে বসে তরকারি কোটার পর্ব শুরু হত। রান্নার লোক মাকে সাহায্য করত। রবিবারের খাওয়াটা টিপিক্যাল বাটি সাজিয়ে, পাত পেড়ে… সারা জীবন বাবাকে দেখেছি কাঁটা দিয়ে খেতেন। ইলিশ মাছ পর্যন্ত। কেবল রবিবারটা হাত দিয়ে খেতেন। মা দেশি-বিদেশি সব রান্নাই চমৎকার করতেন। মা ‘রান্নার বই’ লিখেছিলেন অনেক পরে, বোন কমলার সঙ্গে।”
এরই মধ্যে এক দিন হঠাৎ কবি কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এলেন তাঁর ‘রংমশাল’ পত্রিকার জন্য একটি কিশোর উপন্যাস লেখার অনুরোধ নিয়ে। তখন লীলার মনে হল, ‘এ আবার কেমন কথা? উপন্যাস লিখেছি নাকি কখনো?’ তবু রাতে সেই কথা ভাবতে ভাবতে ঝপ করে একটা গল্প জন্মাল। লেখা হয়েছিল ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’। এর কয়েক বছর পরে ১৯৪৭ সালে এক দিন মেট্রো সিনেমার সামনে ‘মানিক অর্থাৎ সত্যজিৎ বলল, “আমায় তোমার সব ছোট গল্পগুলো দেবে? বই হবে।” ‘বদ্যিনাথের বড়ি’র সব গল্প ও আরো কিছু গল্প নিয়ে গেল মানিক। সিগনেট প্রেস থেকে বেরিয়েছিল ‘দিনদুপুরে’ বইটি ১৯৪৮ সালে। আর ঐ একটি বই দিয়েই চিরকালের মতো বাংলা সাহিত্যের বিপদসঙ্কুল পাথুরে পথে সেই যে একটু দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে গেলাম, তার থেকে আর নামিনি।’
এই সময়পর্বে তাঁর জীবনে নেমে এসেছিল মৃত্যুর পরম্পরা। ছোট জ্যাঠামশায় কুলদারঞ্জন, বাবা প্রমদারঞ্জন, তাঁর প্রিয় মণিদা সুবিনয় ও মা সুরমাকে হারান পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে। তবু জীবনকে থামতে দেননি। অসীম ছিল তাঁর উদ্যম। রঞ্জন জানালেন, “বালিগঞ্জের বাড়িটা মা তৈরি করিয়েছেন। শান্তিনিকেতনে আমাদের যে বাড়ি ছিল, সেটাও একা দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করিয়েছেন মা। ১৯৫৪ সাল সেটা। মনে আছে, কলকাতা থেকে ট্রেনের সাধারণ কম্পার্টমেন্টে জানালার ফ্রেম, গ্রিল— এ সব নিয়ে গিয়েছেন। ওই সব ভারী ভারী জিনিস কী করে যে উনি একা নিয়ে যেতেন, আজ ভাবলে অবাক হই।” শান্তিনিকেতনের এই বাড়ির নামকরণের মধ্যে লীলা ধরে রেখেছিলেন তাঁর গোটা পরিবারকে। সুধীর, রঞ্জন, কমলা ও লীলার আদ্য অক্ষর সাজিয়ে সে বাড়ির নাম হয়েছিল ‘সুরকলি’।
১৯৫৬ সালে লীলা কলকাতা বেতারের চাকরিতে যোগ দেন। আর সূচনা হয় তাঁর জীবনের সবচেয়ে সফল পর্বের। পরবর্তী সাত বছর আকাশবাণীর কর্মজীবনে এক দিকে যেমন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, প্রেমেন্দ্র, শৈলজানন্দর মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজ করার আনন্দ পেয়েছিলেন, তেমনই ‘মহিলা মহল’ অনুষ্ঠানে তাঁর ‘ঠাকুমার চিঠি’, ‘ইষ্ট কুটুম’-এর গল্প যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ‘গল্পদাদুর আসর’-এ পঠিত হয় ‘হলদে পাখির পালক’ ও ‘টাকার গাছ’। অভিনীত হয় ‘বক বধ পালা’ নাটক। লেখেন ‘লঙ্কাদহন পালা’। বেতারের কাজকর্ম সব সময় পছন্দ না হলেও এই মাধ্যমটি লীলা মজুমদারকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলি। ছোট গল্প, নাটক, উপকথা, জীবনী সাহিত্য ও আরও অনেক কিছু দিয়ে তিনি বাঙলির ছেলেবেলাকে ভরিয়ে দেন।
তাঁর ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরাও ছিল তাঁর লেখার ভক্ত। রঞ্জন লিখেছিলেন, “সকাল সাড়ে নটা-দশটা বাজলেই মায়ের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। কারও প্রবেশাধিকার থাকত না।” পুত্রবধূ স্বপ্না খেয়াল করতেন লীলা চিন্তা করার সময় সেলাই করতে ভালবাসতেন। “হাতের কাছে যা পেতেন তার ধারটা মুড়ে সেলাই করতে শুরু করে দিতেন। বলতেন, ‘আই স্পিন দ্য স্টোরি।’ মনের দিক দিয়েও খুবই আধুনিক ছিলেন মা। আমাদের বিয়ের পর বলেছিলেন, ‘তুই আমার ভাঙা নৌকাটা জোড়া লাগালি,’ যা আজও আমি আগলে রেখেছি মনের গভীরে।”
১৯৬১ সালটা লীলা মজুমদারের জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য বছর। সে বছর রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী পালন হচ্ছিল সারা দেশ জুড়ে। আকাশবাণীতেও কর্মব্যস্ততা। আকাশবাণীর হয়ে শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানের প্রযোজক নিযুক্ত হন অমল হোম। লীলার ‘ননীকাকা’। কিন্তু কাজ আরম্ভ হওয়ার পর অমল হোম হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এর ফলে লীলাকে তাঁর কাজ শেষ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, সত্যজিতের চেষ্টায় ‘সন্দেশ’-এর প্রকাশ পাওয়া। ‘সন্দেশ’কে ফিরে পেয়ে লীলা যেন নতুন করে বেঁচে উঠেছিলেন। পত্রিকাটির যৌথ সম্পাদিকাও হন। লিখতে শুরু করেন তাঁর অন্যবদ্য কিশোর উপন্যাস ‘টংলিং’। তার পর ক্রমশ লিখতে থাকেন ‘হট্টমালার দেশে’, ‘বালী-সুগ্রীব কথন’, ‘নেপোর বই’।
সম্পাদক হিসেবে লীলা ছিলেন কড়া ধাতের। ‘সন্দেশ’-এর আর এক সম্পাদক নলিনী দাশের ছেলে অমিতানন্দ জানালেন, “এমন কিছু ‘সন্দেশ’-এ উনি ছাপতে দিতেন না, যা কোনও ভাবে ছোটদের মনে খারাপ প্রভাব ফেলে। এক বার একটা লেখায় ছিল এক জন দোকানদার অসৎ উপায়ে মুনাফা করছে। সেই লেখাটা কম্পোজ হয়ে নেগেটিভ পর্যন্ত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু উনি দেখার পর বললেন, এ লেখা চলবে না।”
১৯৬৭-তে ছোট ভাই যতিরঞ্জনের অকালমৃত্যুর অভিঘাতে গজেন্দ্রনাথ মিত্রর পরামর্শে লিখতে শুরু করেন তাঁর প্রথম আত্মজীবনী ‘আর কোনখানে’। তারও দশ বছর বাদে ১৯৭৭-এ মণীন্দ্র রায়ের অনুরোধে ‘অমৃত’ পত্রিকার জন্য লেখেন ‘পাকদণ্ডী’। তবে শতায়ু লীলা সারা জীবন ধরে যত লেখা লিখেছেন, তার সব ক’টির হদিস পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন তাঁর জীবনীকার, ভাইপো প্রসাদরঞ্জন রায়। তাঁর হিসেব মতো লীলা মজুমদারের মোট ২৮৯টি বইয়ের উল্লেখ সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি অপ্রকাশিত এবং এর বাইরেও দু’-একটি বই থাকা সম্ভব।
লীলা পুরস্কার পেয়েছেন অঢেল। ভারত সরকারের শিশু সাহিত্য পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, ভুবনেশ্বরী পদক, ভুবনমোহিনী দাসী সুবর্ণ পদক, দেশিকোত্তম, ডি-লিট প্রমুখ।
১৯৭৫ সাল থেকে তিনি পাকাপাকি ভাবে শান্তিনিকেতনে থাকতে শুরু করেন। শিলংয়ে শৈশব কাটিয়ে বার্ধক্যের শান্তিনিকেতন যেন তাঁর জীবনের এক বৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছিল। এখানে এসে ফিরে পেয়েছিলেন ছেলেবেলার বন্ধু পূর্ণিমা ঠাকুরকে। পূর্ণিমা ঠাকুরের ছেলে সুপ্রিয় ও মেয়ে ঈশিতা জানালেন, “যত দিন মা ছিলেন, লীলামাসির সঙ্গে যোগাযোগ কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। এখানে চলে আসার পর তো মা প্রায়ই যেতেন ওঁর বাড়িতে। ওঁর নতুন বই বেরলেই আমাদের দিতেন।” সুপ্রিয় ঠাকুর যখন পাঠভবনে কাজ নিলেন, খুব উৎসাহ দিয়েছিলেন তাঁর লীলামাসি। ‘সন্দেশ’-এর জন্য এক বার গল্পও লিখিয়ে নিয়েছিলেন তাঁকে দিয়ে।
শান্তিনিকেতনের স্থানীয় মানুষ, কর্মী, ছাত্র, অধ্যাপক থেকে উপাচার্য, প্রখ্যাত কবি, অভিনেতা থেকে গায়িকা সকলের আনাগোনা ছিল তাঁর বাড়িতে। ওই আড্ডাখানা থেকে তিনি ‘সন্দেশ’-এর জন্য নতুন লেখকদের খুঁজে বের করতেন। আর ছিলেন যিনি, তাঁকে লীলা ডাকতেন ‘নো প্রবলেম দাদা’ বলে। তিনি হলেন সাংবাদিক ও বিশ্বভারতীর কর্মী স্বপনকুমার ঘোষ। তাঁকে দিয়েও পুরনো দিনের খেলোয়াড়দের নিয়ে একটা সিরিজ লিখিয়েছিলেন তিনি ‘সন্দেশ’-এ। “এই লেখা বাবদ কখনও পাঁচ, দশ, পনেরো টাকা পেতাম। মানি অর্ডারে টাকাটা আসত। এক বার মাকে ওই টাকা দিয়ে একটা মুগার চাদর কিনে দিয়েছিলাম। সেটা জেনে সুধীরদা বলেছিলেন, ‘তুই অনেক ভাগ্যবান রে। আমি আমার মাকে কখনও সে ভাবে কিছু দিতে পারিনি’।
একটা সময় খুব কষ্ট করে বড় হয়েছিলেন সুধীরদা।”
‘পাকদণ্ডী’ বইয়ের শেষে লীলা ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, ‘বিধাতা যতদিন রাখেন, যেন কাজ করে যেতে পারি আর যখন ডাক দেবেন, সব ছেড়েছুড়ে কলম নামিয়ে যেন চলে যেতে পারি’। বাস্তবে কিন্তু তা হয়নি। পুত্র রঞ্জনের কাছে শান্তিনিকেতন থেকে ফোনে প্রথম খবরটা দিয়েছিলেন স্বপনই। “মা বাথরুমে পড়ে গিয়েছেন। এই ঘটনার তিন-চার মাস পর দেখা গেল, মা লিখতে পারছেন না। লিখতে গেলে পেনটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা জানালেন, হাই প্রেশার, মাথায় ব্লাড ক্লট। চিকিৎসায় কিছুটা ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে এলেও, আবার পড়ে গিয়ে কোমর ভাঙেন। সেটাও ভাল হতে না হতেই হার্ট অ্যাটাক হয়। ক্রমশ অবস্থা এমন হয় যে কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে আসে। কাউকে চিনতে পারতেন না।”
শতবর্ষে পা দিলেও দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রায় বন্দি জীবনযাপন করে লীলা মজুমদার আমাদের ছেড়ে চলে যান ৫ই এপ্রিল, ২০০৭ সালে। বাঙালি কিন্তু চায়নি তাঁর এই প্রস্থান। কবির ভাষায় তাদের মনের কথা আজও প্রতিধ্বনিত হয়,
“ও লীলাদি কথা রাখুন
আরও অনেক বছর থাকুন
সকল জনার সঙ্গে মিশে
নইলে আমরা বাঁচি কীসে!”
(তথ্যসূত্র:
১- লীলা মজুমদার: সৃষ্টির বহুবর্ণ, মৌসুমী চক্রবর্তী, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ (২০১২)।
২- চিরকিশোর লীলা মজুমদার, নিশীথ রায়চৌধুরী, সহযাত্রী (২০০৯)।
৩- আমিও তাই, লীলা মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স (২০১৪)।
৪- ঘরকন্নার বই, লীলা মজুমদার, আনন্দ পাবলিশার্স।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১ই এপ্রিল ২০১৫ সাল।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে এপ্রিল ২০১৮ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত