বিগত ৩ দিন ধরে টানা সংঘর্ষ চলছে দিল্লীতে। আগুন লাগানো, গুলি, বাড়িতে ঢুকে হামলা, বাদ নেই কোনও কিছুই। চার দিন ধরে খাস রাজধানীর বুকে শহরের একটা অংশে এমন ভয়াবহ ঘটনা চলছে, অথচ পুলিশ তা নিয়ন্ত্রণে কার্যত ব্যর্থ। এখানেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, তবে কি পুলিশের এই ‘অপারগতা’ পরিকল্পিত? ঠিক যেমন অভিযোগ উঠেছিল ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার সময়। কার্যত ‘নিষ্ক্রিয়’ থেকে ক্রমশঃ বাড়তে দেওয়া হয়নি তো রাজধানীর সংঘর্ষ? এমন প্রশ্নও উস্কে দিয়েছেন বিরোধীরা। কেউ সরাসরি, কেউ ইঙ্গিতে।
এনসিপি নেতা নবাব মালিক সরাসরিই গুজরাত দাঙ্গার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘গত কয়েক দিন ধরে দিল্লীতে সংঘর্ষ চলছে। পুলিশ সেখানে নীরব দর্শক। রাজধানী শহরে কেন এটা হবে? দিল্লীতে ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার মডেল চলছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিশানা করে তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন উঠছে, অমিত শাহ এমন নির্দেশ দেননি তো, যে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি ব্যবস্থা না নেন এবং পুলিশ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে, তা হলে নিশ্চয়ই কিছু গন্ডগোল আছে।’
কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী অবশ্য নাম করেননি। তবে দিল্লীর সংঘর্ষের পিছনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন। কার ষড়যন্ত্র, কী ষড়যন্ত্র— সে সব স্পষ্ট না করেও সংঘর্ষ এত বড় আকার নেওয়ার দায় ঠেলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং শাসক দল বিজেপির দিকে। পুলিশ-প্রশাসন কেন আগে থেকে সক্রিয় হয়নি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কী করছিলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে দেখেও কেন আগে থেকে আধাসেনা ডাকা হল না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন।
প্রসঙ্গত, দিল্লী পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনে। সেই মন্ত্রকের দায়িত্ব অমিত শাহের উপর। মনে রাখতে হবে, ২০০২ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর সেই সময় গুজরাতে মোদীর মন্ত্রিসভার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাই কাকতালীয়ভাবে হলেও, অনেকের মনেই ২০০২ সালের গুজরাতের সেই প্রেক্ষাপট ভেসে উঠছে।
কী হয়েছিল সেই সময়? ওই বছর ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাতের গোধরায় সবরমতি এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওই ট্রেনে অযোধ্যা থেকে ফিরছিলেন করসেবকরা। জলন্ত দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫৮ জন করসেবক। সেই ঘটনার পর থেকেই গোটা গুজরাত জুড়ে শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ। প্রায় তিন মাস ধরে চলে হামলা, অগ্নি সংযোগ, হত্যালীলা। সরকারি হিসেবেই মৃত্যু হয়েছিল ১০৪৪ জনের, নিখোঁজ ছিলেন ২২৩ জন। আহত প্রায় আড়াই হাজার। নিহতদের মধ্যে ৭৯০ জন ছিলেন মুসলিম। হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৫৪ জন।
পরবর্তী কালে অভিযোগ উঠেছিল, সেই সময় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা তো নেনইনি, উল্টে প্রচ্ছন্ন মদত দিয়েছিলেন দাঙ্গায়। পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেননি। এমন অভিযোগও ওঠে যে, সরকারি আধিকারিকরাই মুসলিমদের বাড়িঘর, সম্পত্তির তালিকা তুলে দিয়েছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের হাতে। সেই অভিযোগের তদন্তে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) গঠন করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। ২০১২ সালে সেই সিটের রিপোর্টে ক্লিনচিট দেওয়া হয় মোদীকে। পুলিশ-প্রশাসনের নিষ্ক্রিয় থাকার অভিযোগও খারিজ করে দেয় সিট। গুজরাত দাঙ্গা থেকে হাত ধুয়ে ফেলেন মোদী-অমিত শাহরা।
কিন্তু দিল্লীর সংঘর্ষে ফের ফিরে এসেছে সেই প্রশ্নটাই। এনসিপির নবাব মালিক যেটা সরাসরি ‘গুজরাত দাঙ্গা’র উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা অনেকেই সেই একই প্রশ্ন তুলেছেন আকারে ইঙ্গিতে। প্রকাশ্যে না হলেও অন্তত ঘনিষ্ঠ মহলে আলোচনা চলছে তেমনটাই।