তৌসিফ হক। নিজের ডিজিট্যাল পেইন্টিংয়ের সৌজন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ পরিচিত নাম। ‘হক’ কথা বলতেও তিনি কখনও পিছপা হন না। তবে মুখে নয়, কথার জবাব দিতেন নিজের শিল্পের মাধ্যমে। আর সেই ‘দুঃসাহস’ দেখানোর জন্যই মুছে গেল তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট।
কি ছিল সেই দুঃসাহস? শুধুমাত্র শিব আঁকার জন্য। শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। তিনি গত পরশু দেবাদিদেব শিবের একটি ছবি এঁকেছিলেন। এই শিব অবশ্য এখন খুব একটা পরিচিত নয়। তবে গ্রাম বাংলা শিব বলতে বুঝত এই শিবকেই। শিল্পী সেই ‘বুড়ো শিব’ বা ‘আদি শিব’কেই ফুটিয়ে তুলেছেন নিজের মতো করে।
শিবরাত্রির দিন তিনি ছবি এঁকেছিলেন। সোশ্যাল সাইটে সেই ছবি পোস্ট করে ক্যাপশন দিয়েছিলেন, ‘এই ছবিটা আজ আঁকতাম না, কিন্তু সারাদিন ধরে ওয়ালে ওয়ালে সিক্স প্যাক আর মাসল যুক্ত শিবকে দেখে মনে হলো ভাষা দিবসে একটু জ্ঞান বিতরণ করি। বাঙালির শিব ঠাকুর কখনো মাসল ওয়ালা মস্তান নন বরং তিনি শান্ত, নম্র, গায়ের বর্ণ সাদা ও ছাই রঙের, মুখে গোঁফ আছে, মাথায় জটা, চেহারা একদম নাদুসনুদুস, ভুঁড়ি আছে, এবং তিনি সম্ভ্রান্ত চাষী, কৃষিকাজের মাঝে লাল শালু মুড়ে গঞ্জিকা সেবনে ব্যস্ত থাকেন, তিনি একাধারে প্রেমিক এবং সৎ অন্যদিকে দয়ালু পত্নীনিষ্ঠ ভদ্রলোক। ওই ভয়ংকর, সিক্স প্যাক শিব ওটা আমাদের বাংলা ও বাঙালির শিব নন, ওটা উত্তর পূর্ব থেকে এখানে আমদানি করা হয়েছে।’
আর এরপরেই তাঁকে সমর্থন করে ছবিতে বেড়েছে হু হু করে লাইক। পাল্লা দিয়ে হয়েছে শেয়ার। তবে এই ছবির জন্যই মৌলবাদীদের নজরে পড়েন তিনি। চলে রিপোর্ট। প্রথমে তাঁর আঁকা ছবি ফেসবুক থেকেই উড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর প্রোফাইলও মুছে দেওয়া হয় ফেসবুক থেকে। আর বর্তমানে তৌসিফ আর তাঁর আঁকা ছবি ঘিরে নেট দুনিয়া দু ভাগে বিভক্ত।
বাংলায় প্রাচীন শিব মোটা। ভুড়িওয়ালা। গোঁফ আছে। পুরাণের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য সেকথাই বলে। শিল্পী যামিনী রায়ের ছবিতেও তা ফুটে উঠেছে। আবার কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্যের মঙ্গলকাব্য ‘শিবায়ন’-এ ফুটে উঠেছে দেবাদিদেব চাষি। তবে বাংলার সংস্কৃতি আর উত্তর পূর্বের সংস্কৃতি আলাদা। সেখানে শিব পেশী বহুল।
শিল্প আসলে নিজেই ধর্ম। যে যার বিশ্বাস অনুযায়ী দেব-দেবী সেই রূপ পান। কিন্তু, এই অভিযোগও আছে, বাংলা আর বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি হিন্দি বলয়ের আগ্রাসনের শিকার। এর বিরুদ্ধেই সরব হয়েছিলেন সেই শিল্পী। তার ফলেই উড়িয়ে দেওয়া হলো তাঁর প্রোফাইল। করা হয়েছে, নোংরা ভাষায় আক্রমণ। ধর্ম নিয়েও শোনানো হয়েছে নানান কু-কথা। প্রতিবাদে সরব বাঙালিদের একাংশ ও বিভিন্ন সংগঠন।
বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ, শিল্পীর স্বাধীনতা নেই। মতের মিল না হলেই চলে কুৎসিত আক্রমণ। অন্ধকার যুগ চলছে। অপর দল বলছে, ‘মাস্তান’, ‘ভয়ংকর’, ‘ওটা উত্তর পূর্ব থেকে এখানে আমদানি করা হয়েছে’ বলাটা বাড়াবাড়ি। তবে বাঙালি শিল্পীদের একাংশের পাল্টা অভিযোগ, আগ্রাসন হলে পাল্টা দিতেই হয়। তৌসিফের ছবি ও প্রোফাইল মুছে দিলেও নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সেই ছবি। অনেকেই সমর্থন জানিয়ে নিজেদের প্রোফাইল পিকচার বা ওয়ালে পোস্ট করছেন সেই ছবি। এভাবেই প্রিয় শিল্পীর সমর্থনে চলছে ছবি, কার্টুন এঁকে, মিম বানিয়ে, লিখে প্রতিবাদ।