তখন দেশভাগ হয়ে গেছে। তিনি সপরিবারে এ পার বাংলায় চলে এসেছেন। কোথাও শান্তি নেই। দাঙ্গা লেগেছে। চোখের সামনে ঘটেছে অনেক হত্যালীলা। তিনি অনেক কষ্ট করে একটা বাড়ি ভাড়া পেলেন সুকিয়া স্ট্রিটে। একটা মাত্র ঘর, পুরো পরিবারের জন্য।তার পর? ম্যাজিক! কপর্দকহীন এক ঐন্দ্রজালিক, এক বছরের মধ্যে বাড়ি করলেন। যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। ছুঃ! বাড়ি হয়ে গেল! বালিগঞ্জে। ফুঃ আবার একটা বাড়ি! অন্য কোনও ব্যবসা নেই। ম্যাজিক দেখিয়ে, মানুষের মনোরঞ্জন করে, টিকিটের পয়সায়। ট্যাক্স মিটিয়ে। তিনি কারও তাঁবেদারি করেননি কখনও। কারও তোয়াক্কা করেননি।
দেশভাগের সেই সময়টায় তিনি ম্যাজিক করছেন, ব্যাপারটা তাঁর পিতার পছন্দ ছিল না। কিন্তু ম্যাজিক তাঁর পরিবারের রক্তে। তাঁর পিতা ম্যাজিক করতেন। আবার তাঁর পিতার পিতাও ম্যাজিক জানতেন। কিন্তু দেখাতেন না। বলতেন, ম্যাজিক জানাটা এক জিনিস। কিন্তু দেখাতে হলে দর্শককেও শিক্ষিত হতে হবে। নইলেই মুশকিল। ম্যাজিককে চট করে লোকে তুকতাক, ভূতপ্রেতের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে পারে। সেটা হলে কুসংস্কারকে তোল্লাই দেওয়া হয়। তাঁর পিতা তাঁকে বলতেন, “খুব সাবধানে চলতে হবে। ম্যাজিক শুধু মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য। শিক্ষার জন্যও। কিন্তু কোনও মতেই ‘বাবাগিরি’ চলবে না।”
তাঁর একটা বিখ্যাত খেলা ছিল। স্টেজ থেকে অদৃশ্য হয়ে দর্শকের মধ্যে হাজির হতেন। সেটা তো আর কোনও মন্ত্রে হওয়ার নয়, তাঁকে হেঁটেই আসতে হতো। স্টেজের মধ্যে তখন একজন ডামি তাঁর পোশাকটা পরে ঠেকনো দিতেন। দর্শক এত তন্ময় হয়ে দেখতেন যে, খেয়াল করতেন না। কিন্তু একবার ঘোর বিপত্তি ঘটল। তিনি অসমের এক জায়গায় শো করতে গিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র তখন তাঁর সহকারী। শো শেষ হওয়ার পরেও টুকটাক কাজ থাকে। সে সমস্ত সেরে দোকানে চা খাচ্ছিলেন তাঁর পুত্র। শুনতে পেলেন কতকগুলো স্থানীয় ছেলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, “জানিস … এখান দিয়ে যায়! ওই যে, ওটা ডামি। আজ আমি ধরব। তোরা আয় আমার সঙ্গে। দেখি কী করে বলে, ‘আই অ্যাম হিয়ার’!” শুনে তাঁর পুত্রের চা খাওয়া মাথায় উঠল! কারণ তাঁরা ঠিকই বলছিল। তিনি তাঁর পিতাকে গিয়ে বললেন। পিতা কিন্তু পাত্তা দিলেন না। পুত্রকে বললেন, “ও রকম অনেক বলে। আসলে কিছু করে না। আমি অনেক ফেস করেছি। তোমার চিন্তা নেই।”
পুত্রের কথা পিতা শুনছেন না, বুঝছেন না। সুতরাং পুত্রেরই একটা কিছু করতে হবে!
ওই ছেলেগুলো শুধু জানত জাদুকর কোন রাস্তা দিয়ে যান। কখন যাবেন, সেটা জানত না। কিন্তু পিতা ও পুত্র নিখুঁত সময় জানতেন, বাজনার মধ্যে ঠিক কোন সময়টা। পুত্র ড্রেসিংরুমে গিয়ে পিতার একটা পোশাক গায়ে চড়ালেন। অন্ধকারের মধ্যে পিতার আগেই, পিতাকে না বলে হাঁটা দিলেন। যথারীতি ছেলেগুলো খপাত করে পুত্রকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। নিয়ে গেল বাগানের মধ্যে। কয়েকটা কিল, ঘুসিও পড়ল পিঠে। পুত্রের মুখ চেপে ধরে ছিল তাঁরা। এমন সময় চিৎকার। আসল জাদুকর তখন দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছেন, “আই অ্যাম হিয়ার। আমি এখানে।” তাঁরা তখন থ! তা হলে এটা কে? শেষে পুত্রকে ছেড়ে দে দৌড়। ওরা সে দিন জীবনের সবচেয়ে বড় ম্যাজিক দেখেছিল। পুত্রও সবচেয়ে বড় ম্যাজিকটা দেখিয়েছিলেন। পিতাকে বলার পরে বকুনিও খেয়েছিলেন, আদরও। তাঁর পিতা পরে অনেককে গর্ব করে বলতেন ঘটনাটা।
১৯৫৬ সালের ৯ই এপ্রিল রাত সোয়া নয়টা। হঠাৎ শত শত দর্শকের টেলিফোনে বিবিসি’র স্যুইচবোর্ড কেঁপে উঠেছিল। যুক্তরাজ্যের এই দর্শকরা মনে করেছিলেন, তখনই তাঁরা তাঁদের টেলিভিশনের পর্দায় ভয়াবহ খুনের ঘটনা সরাসরি দেখলেন। তাঁরা ভড়কে গিয়েছিলেন। আতংকিত হয়ে তাঁরা টেলিফোন করছিলেন বিবিসিতে। ঘটনাটি ছিল, কসাইখানায় যেভাবে মাংস কাটা হয়, সে রকম একটি টেবিলে রাখা হয়েছিল সতেরো বছর বয়সী এক তরুণীকে। আর রহস্যময় চেহারার এক জাদুকর টেবিলের উপর ঐ তরুণীর শরীর ধারালো ব্লেড দিয়ে দ্বিখন্ডিত করে মাংস কেটেছিলেন! এই পরিস্থিতি এমন একটা উত্তেজনা তৈরি করেছিল যে, কিছু একটা ভুল হয়েছে বলে মনে করেছিলেন অনুষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্তরা। কারণ জাদুকর এবং তাঁর সহকারী ঐ তরুণীকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না।তরুনীর শরীর দ্বিখন্ডিত রেখেই জাদুকর তাঁর মুখ এবং মাথা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন। তখন উপস্থাপক রিচার্ড ডিম্বলবি ক্যামেরার সামনে এসে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন। এর ফলাফল যা দাঁড়িয়েছিল, তা হলো আতংকিত দর্শকদের টেলিফোনের ঝড় উঠেছিল। বিবিসি’ প্যানোরমা এই অনুষ্ঠানটি করেছিল। আর শ্বাসরুদ্ধকর সেই জাদু দেখাচ্ছিলেন ভারতের জাদুসম্রাট পি সি সরকার।পশ্চিমাদের কাছে এই অনুষ্ঠানকে পি সি সরকারের জন্য একটা অভ্যূত্থান বলা যায়। কারণ সে সময় লন্ডনের ডিউক অব ইয়র্ক থিয়েটার তিন সপ্তাহের জন্য ভাড়া নেয়া হয়েছিল পি সি সরকারের জাদু প্রদর্শনের জন্য। প্রথমে দর্শক পেতে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কিন্তু প্যানোরমার অনুষ্ঠানটি আলোড়ন সৃষ্টি করলে সেটি তাঁর জন্য একটা বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়। তিনিও সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন। আকস্মিকভাবে উপস্থাপক যে মাঝপথে অনুষ্ঠান শেষ করে দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছিল যে, বরাদ্দ করা বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মি: সরকার তাঁর জাদু শেষ করতে পারেননি। তাঁর জাদু অতিরিক্ত সময়ে চলে যাচ্ছিল। এই যুক্তি দিয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছিল, পরিস্থিতির কারণে ধারালো ব্লেড দিয়ে তরুনীর শরীর দ্বিখন্ডিত করার বিষয়টি সেভাবেই রেখে অনুষ্ঠান শেষ করা হয়েছিল। পরদিন লন্ডনে সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় খবর হয়েছিল যে, টিভি পর্দায় মর্মাহত করার মতো একজন তরুণীকে দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা দেখানো হয়েছে। কিন্তু পি সি সরকারকে যারা চিনতেন, তারা জানতেন যে, তিনি সময় মেনে চলতেন। নির্ধারিত সময়ের বাইরে তিনি কোনভাবে যেতেন না। তবে প্যানোরমা সেই অনুষ্ঠানের পর লন্ডনে পি সি সরকারের তিন সপ্তাহের শো’র সব টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
পি সি সরকার (সিনিয়র) ম্যাজিক শিখেছিলেন তাঁর পিতার কাছ থেকে। তাঁর পিতা আবার শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছ থেকে। সে দিক থেকে দেখতে হলে তাঁরা বংশপরম্পরায় ম্যাজিক শিখে আসছেন। কিন্তু প্রতুলচন্দ্র সরকারের পিতার সময় পর্যন্ত ম্যাজিক সে ভাবে সমাজে কদর পায়নি। জাদুবিদ্যাকে তখন এ দেশের সমাজে খুব একটা ভাল চোখে দেখা হত না। এটা নাকি নেহাতই অ-বিজ্ঞান, মনোরঞ্জনের জিনিস। প্রতুলচন্দ্র প্রথম প্রতিবাদ করলেন। বললেন, সমস্ত বিজ্ঞান। জানলে বিজ্ঞান, আর না জানলেই সেটা ম্যাজিক। শুধু মুখে বললেন না। তিনিই প্রথম রাস্তার মাদারির খেলা, বেদেদের খেলাকে মর্যাদা দিয়ে স্টেজে তোলার জন্য এগিয়ে এলেন। ভারতের নিজস্ব জাদুবিদ্যাকে গোটা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরলেন। অনুষ্ঠানটির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ইন্দ্রজাল’। নিছক ম্যাজিক নয়, তার সঙ্গে প্রতুলচন্দ্র জুড়লেন মঞ্চমায়া, সংগীত, আলোকসম্পাত, আর জাদুকরকে দিলেন একটা পোশাক। সে পোশাক পশ্চিমকে কপি করে ম্যানড্রেকের মতো কালো টুপি আর কোট-প্যান্ট নয়। সেটা আদ্যন্ত ভারতীয় পোশাক, রংচঙে ঝলমলে। প্রতুলচন্দ্র বলতেন, “আমি মানুষটাই রংচঙে। আমার পোশাকটাও তা-ই।” চিরাচরিত জাদুকরের পোশাকের বদলে মাথায় পাগড়ি-সমেত এমন পোশাক বেছে নেওয়ার পেছনে আবার একটা মজার গল্প আছে। প্রতুলচন্দ্রের এক জন ভাল বন্ধু ছিলেন— হনবন্ত সিংহ। তিনি তখন জোধপুরের মহারাজ। গান-বাজনা ভালবাসতেন, নাটক করতেন। সেই সঙ্গে প্রতুলচন্দ্রের কাছে অল্পবিস্তর ম্যাজিকও শিখতেন। এক বার তিনি ঠিক করলেন, বন্ধুদের সেই ম্যাজিক দেখাবেন। তাঁদের চমকে দেবেন। নেমন্তন্ন গেল শুধুমাত্র বাছাই করা রাজন্যবর্গের কাছে। এঁদের মধ্যে এমন কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁদের সব জেনেশুনে বেশ হিংসে হল। তাঁরা ঠিক করলেন, মহারাজকে জব্দ করতে হবে। নির্দিষ্ট দিনে ম্যাজিক দেখানো শুরু হল। কিন্তু দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যেই হনবন্তের খেলা দেখানো শেষ। যে সব ম্যাজিকে তিনি হাত পাকিয়েছেন, তাদের সংখ্যা বেশি নয়। বিরোধী পক্ষ এ বার গোলমাল শুরু করল। ‘আরও চাই।’ হনবন্ত তখন ফাঁপরে পড়েছেন। বললেন, ‘আমার হয়ে আমার বন্ধু প্রতুল খেলা দেখাবেন।’ বিরোধী পক্ষ ফের বাধা দিল। বলল, ‘এটা হবে না, আপনি তো শুধু রাজন্যবর্গের কথা বলেছেন। ইনি তো তা নন।’ হনবন্ত তখন প্রতুলচন্দ্রকে নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন। তাঁকে দিলেন চোস্ত পাজামা, শেরওয়ানি, নাগরাই, আর জয়পুরের প্রতীক-সাঁটা পাগড়ি। এবং সবার সামনে এসে বললেন, ‘এ অনুষ্ঠান শুধুমাত্র রাজন্যদেরই জন্য। নাউ আই প্রেজেন্ট দ্য মহারাজা অব ম্যাজিক।’ পি সি সরকার পেলেন তাঁর পোশাক, আর জাদুবিদ্যা পেল পি সি সরকারকে। প্রতুলচন্দ্র মারা যান জাপানে। একটা শহরে টানা শো চলার সময়ই। প্রদীপচন্দ্র সরকার (পিসি সরকার জুনিয়র) তখন কলকাতায়। পিতার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি জাপানে উড়ে গিয়েছিলেন। গিয়ে শুনেছিলেন, তাঁর পিতা বলে গিয়েছেন, শো যেন বন্ধ না হয়। তাঁর মৃত্যুর পর জাপানেই প্রদীপচন্দ্র ম্যাজিক দেখানো শুরু করেন। গায়ে ছিল সেই পোশাক।
প্রতুলচন্দ্র মানুষটা ছিলেন একেবারে ডালে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু মানসিকতায় বহু দূর এগিয়ে। সে আমলে মেয়েরা ম্যাজিকের স্টেজে নামবে, এমনটা ভাবাই যেত না। প্রতুলচন্দ্র উলটো গাইলেন। বললেন, ‘ম্যাজিকের শো সফল করতে হলে মেয়েদের তো স্টেজে আসতেই হবে।’ তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। বাসন্তী দেবী প্রতুলচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘তোমার নিজেরই তো দুটো মেয়ে। ওদের স্টেজে নিয়ে এসো।’ প্রতুলচন্দ্র তা-ই করেছিলেন।
অসম্ভব দারিদ্রে মানুষ হয়েছিলেন প্রতুলচন্দ্র। নিজেও খুব কষ্ট করে রোজগার করতেন। কিন্তু সন্তানদের কোনও দিন তা বুঝতে দেননি। তাঁর সন্তানরা ভাবতেন, প্রতুলচন্দ্রের আলমারিটা বোধহয় ম্যাজিক আলমারি। ভর্তি টাকা। তাঁর পুত্র প্রদীপ চন্দ্রের ভাষ্যে, “যখনই বাবা মায়ের কাছে টাকা চান, মা আলমারি খুলে বের করে দেন। এখন বুঝতে পারি, বাবা তাঁর রোজগারের পুরোটাই মায়ের হাতে তুলে দিতেন। আর মা প্রয়োজন মতো আলমারি খুলে টাকা বের করে বাবার হাতে দিতেন। আসলে বাবারও যে অভাব থাকতে পারে, আমরা জানতামই না। আমরা ভাইবোনেরা প্রত্যেকেই ভাল ভাবে পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। শুধু একটাই দুঃখ, খেটেখুটে ভাল রেজাল্ট করতাম, আর বন্ধুরা বলত, বাবা ম্যাজিক করেছে।”
একটা সময় প্রতুলচন্দ্র ডলারে টাকা রোজগার করেছেন। সে টাকার অনেকটাই দেশকে দিয়েছেন। আবার ঠিকমত ইনকাম ট্যাক্স ফাইল করেননি বলে লেট ফাইলিং-এর জন্য চিঠিও পেয়েছেন। এখানে ম্যাজিক চলেনি। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়েও রীতিমত আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দিতে হল। ভোজবাজিতে ভর করে পাত্র হাজির হল না। রোজকার জীবনে একেবারে আটপৌরে বাঙালি মানুষটার মধ্যে এক প্রচণ্ড আত্মাভিমানী ভারতীয় লুকিয়ে ছিল। যে কারণে নিজের নামের বানানটা ‘Sorcar’ করে নিয়েছিলেন। কারণ, ‘Sarkar’, ‘স্যারক্যার’— কেমন যেন ইংরেজদের চাপিয়ে দেওয়া পদবি মনে হয়। আবার পশ্চিম ভাবল, এটা নেওয়া হয়েছে ‘sorcery’ থেকে। ইংরেজিতে এর মানে ম্যাজিক। ফলে এই পদবি পরিবর্তনকে তিনি ও তাঁর পরিবার ভেবেছে ‘আমিত্ব’-র দিক দিয়ে, আর ইংরেজরা ভাবছে ম্যাজিক দিয়ে। দু’দিকটাই কিন্তু ঠিক।
প্রতুলচন্দ্র সরকার, যিনি হামেশাই বাইরে বাইরে ঘুরতেন, তাঁর বিরুদ্ধে কিন্তু তাঁর শাশুড়ীর ভয়ংকর অভিযোগ ছিল। প্রত্যেক বছর জামাইষষ্ঠী আসত, আর তিনি হা-হুতাশ করতেন, ‘প্রতুলকে এ বছরও খাওয়াতে পারলাম না।’ তিনি প্রচণ্ড ভাল রান্না করতেন। নিজে যেমন খেতেন, তেমনই খাওয়াতেন। আবার তাঁর শ্বশুর ছিলেন একনিষ্ঠ ডাক্তারমানুষ। শাশুড়ী বেহিসেবির মতো তেল-মশলা ঢেলে রান্না করতেন, আর শ্বশুর সেগুলো সমস্ত বাতিল করতেন। এক বার তিনি প্রতুলচন্দ্রের নাগাল পেলেন। সে বছর জামাইষষ্ঠীতে প্রতুলচন্দ্র এ দেশে। প্রতুলচন্দ্রেরও বোধহয় একটু অপরাধবোধ ছিল। নেমন্তন্নতে রাজি হয়ে গেলেন। পুত্র প্রদীপ চন্দ্র সরকারের ভাষ্যে, “দিদিমা খাওয়ার আগে মা’কে ইশারা করে দিলেন, প্রতুল কিন্তু একা খাবে। অর্থাৎ মনোযোগের সবটুকু যাতে প্রতুল একা পায়। কিন্তু ঠিক খাওয়ার আগে দাদু বাবার পাশটাতে একটা চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসলেন। খাবার এল। অ্যাত্ত বড় কাঁসার থালা। তাতে ভাত, ঠিক যেন একটা বৌদ্ধ স্তূপ। তার চার পাশে প্রচুর বাটি। এবং বাটির পর বাটি আসছে। বাবা আঁতকে উঠলেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আঁতকে উঠলেন দাদু, ‘প্রতুল, তুমি এটা খাবে না’, ‘ওটা খাবে না’। একের পর এক বাটি বাতিল। বাবার বোধহয় কয়েকটা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু স্বয়ং শ্বশুরমশাই বাদ দিলে কী করবেন? দিদিমা তো এই সব দেখে আঁচলে মুখ ঢেকে ভ্যাঁ করে কেঁদে সোজা রান্নাঘরে। আর বাবা দাদুর ইচ্ছেমত কয়েকটা পদ দিয়ে খাওয়া সেরে মুখ-হাত ধুয়ে বিশ্রাম নিতে গেলেন পাশের ঘরে। গিয়ে দেখেন, বাতিল হওয়া সব বাটি সেখানে সাজানো। এবং দিদিমা ফিল্ডে। বেচারা বাবাকে দ্বিতীয় বার খেতে হল।”
বাস্তব জীবনে কিন্তু প্রতুলচন্দ্র কড়া ধাতের মানুষ ছিলেন। প্রদীপ চন্দ্র সরকার যখন জাদুজীবন যখন শুরু করেন, তখন বিশ্ববাসীকে জানান দেওয়ার জন্য সেই বিখ্যাত বা কুখ্যাত খেলাটা দেখাবেন বলে ঠিক করেছিলেন— বাক্সবন্দি হয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ। তিনি তাঁর পিতাকে গোড়ায় এটা জানাননি। প্রতুলচন্দ্র এটা আনন্দবাজারে পড়ে আঁতকে ওঠেন। নিজের স্ত্রী কে তিনি বলেছিলেন, ‘ওকে এক্ষুনি এটা করতে বারণ করো।’ বাসন্তী দেবীর সঙ্গে প্রতুলচন্দ্রের এক প্রস্থ ঝগড়াই হয়ে যায় এটা নিয়ে। প্রতুলচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘তোমার প্রশ্রয়ে আমাদের বাড়িতে একটা বিরাট অমঙ্গল হতে চলেছে। ম্যাজিকটা দেখাতে গিয়ে এর আগে মোট বারো জন শিল্পী মারা গিয়েছেন। তুমি কি চাও তোমার ছেলে তেরো নম্বর হোক?’
পরের ঘটনা জানা যাক প্রদীপ চন্দ্র সরকারের ভাষ্য থেকে – “মা আমায় ডাকলেন। সরাসরি জানতে চাইলেন, ‘তোমার বাবা বলছেন এটা প্রচণ্ড বিপজ্জনক আর তুমি নাকি জেনেশুনে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করছ? তুমি কি পারবে?’ আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ পারব। সে জন্যই তো করতে যাচ্ছি।’ মা তখন বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনছ? ও বলছে ও পারবে।’ বাবা বললেন, ‘ঠিক আছে। তা হলে অনুমতিটা তুমি দাও তোমার দায়িত্বে।’ মা তখন আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘যদি পারো, তবে করো। আর যদি না পারো, ডুবে মরো। হেরো ছেলে আমি চাই না।’
পেরেছিলাম। ২৬শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯। রাত দেড়টা-দুটো নাগাদ ‘ইন্দ্রজাল’ বাড়ির সামনে বাস থেকে নামছি। দেখি সদর দরজায় বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর এবং আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী জাদুসম্রাট
পি সি সরকার (সিনিয়র)— আমার বাবা— একটা ফুলের মালা নিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমি প্রণাম করতেই বাবা মালাটা আমাকে পরিয়ে দেন। আমিও জাদুকরি ক্ষিপ্রতায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মালাটা তাঁর গলাতেই পরিয়ে দিই। বাবার চোখে জল। মালাটা খুলে বললেন, ‘আসল জায়গায় পরিয়ে দাও।’ পিছনে মা দাঁড়িয়েছিলেন। মালাটা আমি মায়ের পায়ে দিয়ে দিই।”
প্রতুলচন্দ্র সরকার নিজের পরিবারের ব্যক্তি কম অনেক বেশি জনগণের সম্পত্তি ছিলেন। তাঁর একটা বেশ বড় মানিব্যাগ ছিল। তিনি বাজার যেতেন। প্রদীপ চন্দ্র সঙ্গে যেতাম সেই ব্যাগ পাহারা দেওয়ার জন্য। কারণ যেখানে-সেখানে ব্যাগ ফেলে আসা প্রতুলচন্দ্রের একটা অভ্যেস ছিল। বড়বাজারে মনোহর দাস কাটরার গলিতে তিনি কাপড় কিনতে যেতেন। ঘিঞ্জি গলি। প্রদীপ চন্দ্রের দমবন্ধ হয়ে আসত। কিন্তু প্রতুলচন্দ্র নির্বিকার থাকতেন। গদিতে পা ঝুলিয়ে কাপড় পছন্দ করতেন। এক বার সেখানে দু’জনে গেছেন। দেখেন এক ভদ্রলোক কিছুতেই কী কিনবেন, যেন বুঝতে পারছেন না। ভারী ছটফট করছেন। হঠাৎ সেই ভদ্রলোক প্রদীপ চন্দ্রের দিকে চেয়ে বললেন, ‘ইনি কি পি সি সরকার?’ প্রদীপ চন্দ্র বললেন, ‘হ্যাঁ’। ‘আর আপনি?’ প্রদীপ বললেন ‘ছেলে’। তিনি যেন ভারী নিশ্চিন্ত হলেন। তারপরে সেই ভদ্রলোক খুব সংকোচের সঙ্গে প্রদীপ চন্দ্রের কানে কানে বলেছিলেন, ‘আমি এক জন পকেটমার। ওঁর ব্যাগটা সরিয়ে রাখুন। আশেপাশে আমার অন্য বন্ধুরা আছে। তারা তো ওঁকে চেনে না।’
আর এক বার নিউ মার্কেট থেকে ফিরে এসে প্রতুলচন্দ্র বাড়িতে চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন! দেখা গেল তাঁর গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। (সেই বিখ্যাত রংচঙে অ্যাম্বাসাডর। পার্কিং লটে খুঁজতে সুবিধে হবে বলে, যেটার অমন রং ছিল)। কাঁচ ভাঙা। ভাঙা কাঁচের ভেতর থেকে হাত ঢুকিয়ে চোর তাঁর গাড়িতে রেখে যাওয়া একটা ব্যাগ চুরি করেছে। ব্যাগে টাকাপয়সা তো ছিলই। আরও অনেক অমূল্য কাগজপত্র ছিল। প্রতুলচন্দ্র গুম হয়ে রইলেন। বললেন, ‘পুলিশে খবর দেব না। ওরা খুঁজে পাবে না। বড় ক্ষতি হল আমার।’ এমন সময় টেলিফোন। চোরের। সে বলল, ‘সরকারবাবু আমি আপনার ব্যাগ চুরি করেছি। জানতাম না, ওটা আপনার। বাড়ি এসে বুঝলাম। আমি বড্ড গরিব। টাকাটা খুব প্রয়োজন। ওটা নিয়েছি। কিন্তু বুঝলাম কাগজপত্রগুলো দরকারি। তাই ওগুলো-সমেত ব্যাগটা আপনার লেটারবক্সে ঢুকিয়ে এসেছি।’
আধুনিক জাদুর জনক প্রতুলচন্দ্র সরকার, যাঁর আবার ‘জাদু’ শব্দটাতেই ছিল আপত্তি। তিনি মনে করতেন এই শব্দটি বড় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ব্যবহৃত হয়। সেই ভাবনা থেকেই তাঁর মঞ্চ উপস্থাপনার নাম হয় ‘ইন্দ্রজাল’। সঙ্গে যোগ হয় বিনোদন। ছোটবেলায় দেখা পথচলতি মাদারির খেলা যে কী ভাবে মঞ্চের ম্যাজিক হল, এবং অবিভক্ত বাংলার প্রতুলই বা কী করে হয়ে গেলেন বিশ্বখ্যাত পি সি সরকার।
“ব্রহ্মা মুরারিত্রিপুরান্তোকারী ভানুঃ শশী ভূমিসুতো বু্ধশ্চ
গুরুশ্চ শুক্রঃ শনিরাহুকেতু কুর্দন্তু সর্বে মম সুপ্রভাতম্”
বাবার সকাল হত এই স্তোত্র পাঠ করে, তার পর নিজের দু’হাত দেখে দিন শুরু করতেন— সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছেন ইলাদেবী, জাদু-সম্রাট পি সি সরকারের জ্যেষ্ঠ কন্যা। সংস্কৃত ভাষার প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধা। তিনি বলতেন, ভারতের ঐতিহ্য ও দর্শন এই ভাষাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে, তাই সংস্কৃত ভাষা জানার প্রয়োজন খুবই। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ হেন এক জন মানুষ সংস্কৃত পণ্ডিত বা শিক্ষক না হয়ে ‘জাদু-সম্রাট’ হলেন কী করে? খুব সহজ ভাবে বলা যায়— তাঁর জন্মই হয়েছিল এই খেতাব অর্জন করার জন্য।
সমাজ তখন ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন, শ্রেণিবৈষম্যে বিভক্ত। তুকতাক, ঝাড়ফুঁক করে অসাধ্য সাধন বা মন্ত্রবলে স্বপ্নপুরণ হওয়ার পেছনে আসল রহস্য ধরে ফেলে জনৈক আত্মারাম। সহজ-সরল-নিরক্ষর মানুষকে তা বোঝাতে গেলে তাঁর প্রাণ নাশ হয় ‘মাদারি’ গোষ্ঠীর হাতে। কারণ এদের জীবনধারনের অন্যতম উপায় ছিল জাদু-বিদ্যা। উপস্থিত বুদ্ধি ও হাতের কারসাজি দিয়ে তিলকে তাল করে সাধারণ মানুষকে এক কল্পনা-জগতের ছায়া দেখাত এরা।
ছোট্ট প্রতুলের কিন্তু সেই মাদারিদের খেলা দেখতে বেশ লাগত। আগ্রহ তার এতটাই ছিল যে এক দিন তাদেরই একটা খেলা দেখিয়ে দিল সে। প্রথমে বিরক্ত হলেও, পরে তারা প্রতুলকে আরও অনেক খেলা শেখায়। এবং তখন থেকেই শুরু হয় তার জাদু-পথে পথ চলা।
অধুনা বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার আশেকপুর গ্রাম। সেখানে ভগবানচন্দ্র সরকার ও কুসুমকামিনীদেবীর প্রথম সন্তান প্রতুলের জন্ম হয় ১৯১৩ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি। চরম দারিদ্রের মাঝে বেড়ে ওঠা প্রতুল ছিল অত্যন্ত মেধাবী। বাবার ইচ্ছা ছিল ‘বুইড়্যা’ (ছেলের আদরের ডাকনাম বুড়ো) বড় হয়ে শিক্ষকতা করবে। কিন্তু ভাগ্যের লেখনী ছিল একেবারেই আলাদা। ভাই অতুলচন্দ্র ছিলেন ষোলো বছরের ছোট। দাদার প্রথম দিকের পেশাদার জীবনের সঙ্গী ছিলেন তিনি। পরে মতান্তর হওয়ায় একাই এই শিল্প মঞ্চস্থ করতেন, আলাদা ভাবে।
বাড়ির কাছেই শিবনাথ হাই স্কুলে পড়াশোনার শুরু প্রতুলের। যাতায়াতের পথে একটা ঝিলের দু’পাশে ছিল মাদারিদের বাস। তাদের কাছেই হয় প্রতুলের জাদুবিদ্যার হাতেখড়ি। পারিবারিক সূত্রে জাদু ছিল তার রক্তেই। সেই আত্মারাম থেকে শুরু হয়ে, ষষ্ঠ প্রজন্মের দ্বারকানাথ সরকার, অল্প-বিস্তর সকলেই ‘ম্যাজিক’ জানতেন। সপ্তম প্রজন্মের ভগবানচন্দ্রও বাবার কাছে এই বিদ্যা চর্চা করেন। কিন্তু তখনকার সমাজ জাদুকরদের খুব একটা সুনজরে দেখত না। তাই সরকার পরিবারের কেউই প্রকাশ্যে কখনও জাদু দেখাননি। তবে প্রতুল দেখাত— স্কুলের অনুষ্ঠানে, ক্লাসের বন্ধুদের।
১৯৩৩ সালে অঙ্ক নিয়ে কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে ‘মায়ার’ জগতে প্রবেশ করেন প্রতুল।
বাসন্তীদেবীর সঙ্গে বিবাহসূত্রে পাঁচ পুত্র-কন্যাকে নিয়ে পরবর্তী কালে বসবাস শুরু করেন কলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে।
স্কুলজীবনে বন্ধুদের সামনে জাদু দেখানো শুরু। অনেক সময় মাদারিদের সঙ্গে পথেও সেই কলার প্রদর্শনী করে হাত পাকায় প্রতুল। এর পর আইএ পড়ার সময় তাঁর আলাপ হয় জাদুকর গণপতি চক্রবর্তীর সঙ্গে। হাতেকলমে জাদুবিদ্যা শেখা ও চর্চার আরও সুযোগ হয় তাঁর। সঙ্গে দেশি-বিদেশি বই থেকেও চলতে থাকে জ্ঞান আহরণ।
১৯৩৪ সালে প্রথম বার বিদেশ সফর করেন। নিজের বাড়ি বন্ধক রেখে, সেই টাকাতেই বিশাল বাহিনী নিয়ে পৌঁছন হংকং। উদ্দেশ্য, বিশ্বখ্যাত জাদুকর লাইয়েল-এর সঙ্গে সম্মুখ সমর। তখন স্যুট-প্যান্ট পরেই ম্যাজিক দেখাতেন জাদুকররা। প্রতুলও তাই পরলেন। তিনি বলতেন, হিন্দু ধর্মে দেবরাজ ইন্দ্র হলেন মায়াবিদ্যার প্রতীক। সেই হিসেবে নিজের ‘শো’-এর নাম দিলেন ‘ইন্দ্রজাল’। একই দিনে দু’টি আলাদা প্রেক্ষাগৃহে দুই জাদুকরের খেলা শুরু হয়। কয়েক দিন যেতে না যেতেই, লাইয়েল বুঝলেন যে তাঁর হার নিশ্চিত। দিন এগোতে থাকে আর খালি হতে থাকে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকাসন। শেষে এক দিন বন্ধ হয়ে যায় তাঁর শো। এর পর আর থামেনি প্রতুলের জয়রথ। ফ্রান্স, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, মিশর, কেনিয়া, ইরাক, আরও কত দেশ ঘুরেছে সেই রথ! প্রতুল তখন বিশ্ববাসীর কাছে হয়ে উঠেছেন ‘জাদু-সম্রাট পি সি সরকার’।
যোধপুরের মহারাজা হনবন্ত সিংহ ছিলেন সখের জাদুকর। এক বার তিনি ঠিক করলেন তার নিকট আত্মীয়দের নিজেই জাদু দেখাবেন। প্রস্তুতি শেষে সেই বিশেষ দিনটি এলে রাজার মনে হয় তাঁর পরিবেশনে কোথায় যেন খামতি থেকে গেছে। ডাক পড়ে বন্ধু-জাদুকরের। কিন্তু তিনি রাজপরিবারের সদস্য না হওয়ায় সমস্যা দেখা দিল। তখন মহারাজা তাঁকে রাজপোশাক ও পাগড়ি পরিয়ে পরিচয় করালেন ‘জাদু জগতের মহারাজা’ হিসেবে। পরবর্তী কালে, সেই ঝলমলে রাজার পোশাকেই চির পরিচিত হয়ে ওঠেন জাদু-সম্রাট। “আক্ষরিক অর্থে তিনিই হলেন এই পোশাকের ‘ট্রেন্ড-সেটার।”’ বললেন নবম প্রজন্মের পি সি সরকার (মাস্টার), পৌরুষ।
তখন তিরিশের দশক। বিদেশে জাদুর মঞ্চে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ই। কিন্তু ভারতে তা ছিল কল্পানাতীত। আর কলকাতার বাঙালি পরিবারের মেয়েদের ঘরের বাইরে পা রাখাতেই ছিল নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু জাদুর মঞ্চে ঝকঝকে তরুণ-তরুণীর প্রয়োজন ছিল খুবই। তখন এই শহরে বসবাসকারী বেশ কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণীকে তাঁর দলে নেন পি সি সরকার। পরবর্তী কালে, নিজের দুই মেয়ে ও শ্যালিকাও অংশ নিয়েছিলেন তাঁর জাদুর খেলায়। সোর্ড-খেলা, এক্স-রে আইজ, ব্ল্যাক আর্ট, ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া, টেলিপ্যাথির খেলা, টেম্পল অব বেনারস, করাত দিয়ে মানুষ কাটা— তাঁর প্রদর্শিত কয়েকটি জনপ্রিয় ম্যাজিক।
ছোটবেলার সেই রাস্তার সামান্য জাদুকে মঞ্চের ম্যাজিক করার পথ খুব সহজ ছিল না। কিন্তু তাঁর উপস্থাপনার কারণে সেই প্রদর্শনী হয়ে উঠেছিল বিশ্ব বন্দিত। জমকালো রাজকীয় পোশাক, আবহ সঙ্গীত, মঞ্চসজ্জা, সর্বপরি যে দেশে ‘শো’ করতেন, সেখানকার সংস্কৃতিও মঞ্চে তুলে ধরতেন। মিশরে গিয়ে মঞ্চসজ্জায় প্রতিফলিত হয়েছিল পিরামিড, আবার কোথাও নাগাদের মতো তির-ধনুক নিয়ে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াত দলের অভিনেতারা। স্মৃতি হাতড়ে কথাগুলো বলে গেলেন ইলাদেবী। শোনালেন সোর্ড খেলার গল্প— তাঁকে সম্মোহন করে প্রথমে তিনটি তলোয়ারের উপর শুইয়ে দিতেন জাদু-সম্রাট। তার পর একে একে দু’টি সরিয়ে নিতেন। ইলাদেবী শায়িত থাকতেন মাত্র একটি তলোয়ারের উপর। “ম্যাজিক দেখানোর সময় বাবা যখন কথা বলতেন, দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন।”—সগর্বে পরে জানিয়েছিলেন জাদু-সম্রাটের কন্যা।
ব্ল্যাক আর্ট— মঞ্চের আলো আঁধারিতে শূন্যে ভেসে থাকা একটি মেয়ে ‘গিলি গিলি গিলি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কোথায় যেন ‘ভ্যানিস’ হয়ে যেত! দর্শকরা যত ক্ষণে ভাবতে আরম্ভ করত মেয়েটি কোথায়, আমি তত ক্ষণে ব্যাকস্টেজে— জানিয়েছিলেন পি সি সরকারের ছোট মেয়ে গীতা চৌধুরী, বাবার আদরের টম। “ছোটবেলায় আমাদের স্কুলে অন্য কেউ ম্যাজিক দেখাতে আসতেন না। কারণ আমি, জাদু-সম্রাটের মেয়ে পড়তাম সেখানে।” হাসতে হাসতে জানিয়েছিলেন গীতাদেবী।
‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’-র কথা অজানা নয় ‘জেনারেশন-ওয়াই’-এরও। কোনও শো-এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটি ছোট কমণ্ডলু থেকে অনবরত ভরে চলত গ্লাসের পর গ্লাস। “প্যারিসের ব্যস্ত রাস্তায় চোখ বেঁধে সাইকেল চালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বাবা।” – জানিয়েছিলেন প্রদীপ সরকার (পি সি সরকার-জুনিয়র)। তাও প্রায় ৬৩ বছর আগে। চোখ বেঁধে তাক লাগিয়েছিলেন তত্কালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক-কেও। তিনি মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন একটি সাদা কাগজে কিছু লিখতে। তার পর মন্ত্রী পারিষদদের বলেন ওই পাতার নীচে স্বাক্ষর করতে। সব হয়ে যাওয়ার পর পাতাটি হাতে নিয়ে হক সাহেব দেখেন সেটা তাঁর পারিষদদের ইস্তফাপত্র, এবং মুখ্যমন্ত্রী পদে নাম স্বয়ং পি সি সরকারের।
শুধু মাত্র ম্যাজিক দেখিয়েই যে তিনি তৃপ্ত ছিলেন, তা নয়। অসংখ্য বই লিখেছেন জাদুবিদ্যার উপর। কলেজে পড়াকালীন প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই ‘হিপনোটিজম’। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি— তিনটি ভাষাতেই প্রকাশ পায় তাঁর বই।
“তখন বুঝিনি মামাবাড়ির সামনের রাস্তায় এত মানুষ কেন জড় হয়েছিল! বাড়ির উপর থেকে দেখা অসংখ্য কালো মাথা— ওইটুকুই স্মৃতিতে আছে।” আক্ষেপে একদা সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ইলাদেবীর কন্যা, অন্নপূর্ণা। তখন তিনি বছর তিনেকের। আর দাদা অমিতাভর বয়স সাতের কাছাকাছি। “আমাদের প্রজন্মের আমরা দু’জনই শুধু পেয়েছিলাম ‘ম্যাজিক দাদু’কে। ছবিও আছে।” বলেছিলেন অন্নপূর্ণা। বাকি নাতি-নাতনিদের কাছেও তিনি ‘ম্যাজিক দাদু’।
“সময়-সুযোগ পেলেই বাবা আমাদের ইংরেজি সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন গ্লোব বা নিউ এম্পায়ারে।” সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন কনিষ্ঠ পুত্র প্রভাস সরকার (পি সি সরকার-ইয়ং)। “বাংলা সিনেমাও দেখতে গিয়েছি কয়েক বার, কিন্তু হিন্দি সিনেমা; নৈব নৈব চ।”
কর্মসূত্রে বছরের বেশির ভাগ সময়ই বাড়ির বাইরে থাকতেন জাদু-সম্রাট। কিন্তু সন্তানদের পড়াশোনা ও অন্যান্য প্রয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখেননি কখনও। স্ত্রী বাসন্তিদেবী কলকাতায় একা থাকতেন বলে ছেলেদের ভর্তি করিয়েছিলেন বাড়ির কাছেই একটি স্কুলে, সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন প্রভাসবাবু।
“বাবা ছিলেন ভীষণ পরিশ্রমী। কখনও বসে থাকতেন না। দুপুরে কখনও ওঁকে ঘুমোতে দেখিনি”— পি সি সরকারের সাফল্যের আরও এক দিকে আলোকপাত করেছিলেন গীতাদেবী। তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষ। এক বার একটি মেয়ের বিয়েতে উপহার দিয়েছিলেন খুব সুন্দর একটি সোনার হার। আমাকে অবাক হতে দেখে বলেছিলেন, “ওর তো বাবা নেই!”— সাম্প্রতিক অতীতে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ইলাদেবী।
আদতে গুরুগম্ভীর মানুষটির রসবোধ ছিল ষোলো আনা। জাপানে শো করতে গেলে একটি নির্দিষ্ট হোটেলেই বরাবর উঠতেন পি সি সরকার। এক বার হোটেলের জনৈক কর্মচারী ‘ইউ আর বিউটিফুল’ বাংলায় শিখিয়ে দিতে বলেন। জাদু-সম্রাট বুঝতে পারেন যে তাঁর দলের বাঙালি কোনও তরুণীর জন্যই এই ভাষা শেখার ধুম। তিনি খুব সরল ভাবে তাঁকে শিখিয়ে দিলেন, ‘তুমি খুব বিশ্রী’। পরে অবশ্য কী হয়েছিল তা আর জানা নেই!
তিনি ছিলেন পশুপ্রেমিক— ছোটবেলার দিনগুলি মনে করে সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন ইলাদেবী। বালিগঞ্জে তাঁদের প্রথম বসতবাড়ি, ঠিকানাটা ১২/৩ এ জামির লেন। তার ছাদেই থাকত পায়রার দল, বিশাল খাঁচার ভেতরে। আর ছিল খরগোশ, হাঁস। বাড়ির পাশে একটা সরু গলিতে চৌবাচ্চা বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই হাঁসগুলির জন্য। “আমরা তার নাম দিয়েছিলাম হাঁস-গলি।” শিশু সুলভ ভঙ্গিমায় জানিয়েছিলেন তিনি। টাইগার নামে জার্মান শেফার্ডটিও ছিল জাদু সম্রাটের একান্ত অনুগত।
পি সি সরকার বিদেশে সব থেকে বেশি শো করেন জাপানে— ৩৭ বার। এবং তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায় রচিত হয় ওই দেশেই। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে আরও এক বার জাপান সফরে গিয়েছিলেন তিনি। পরের বছর জানুয়ারির প্রথম দিকে এক দিন তিনি মঞ্চে ‘ইন্দ্রজাল’ বিস্তারে ব্যস্ত। মুগ্ধ দর্শকদের সামনেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মঞ্চ থেকে ‘অদৃশ্য’ হন, চিরকালের জন্য। তারিখ ছিল ১৯৭১ সালের ৬ই জানুয়ারি। এর তিন দিন পর সে দেশ আবার জাদুর খেলা দেখে। বাবার শূন্যস্থান পূরণ করে টানা পাঁচ মাস ইন্দ্রজালের সফর অটুট রাখেন জাদু-সম্রাটের যোগ্য উত্তরসূরি পি সি সরকার-জুনিয়র।
(তথ্যসূত্র:
১- আমার জীবন আমার ম্যাজিক, পি. সি. সরকার (জুনিয়র), দীপ প্রকাশন।
২- ইন্দ্রজাল, পি. সি. সরকার, দীপ প্রকাশন (২০১৪)।
৩- দেশে দেশে, পি. সি. সরকার, দীপ প্রকাশন।
৪- প্রদীপের পাঁচালি, পি. সি. সরকার, পত্র ভারতী (২০১৩)।
৫- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
৬- প্রতুলচন্দ্র সরকারের স্মৃতিচারণে ২৮শে জুন ২০১৫ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রদীপ চন্দ্র সরকার লিখিত প্রবন্ধ।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত