১৪ ফেব্রুয়ারি হুগলির পোলবায় পুলকার দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিল কাউন্সিলর সন্তোষ সিংয়ের ছেলে ঋষভ। ধীরে ধীরে তার অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। সদ্য শৈশব পার করা ঋষভ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছে, চিকিৎসকরা তার জন্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। তবে শেষরক্ষা হল না। সকলের সব চেষ্টা থেমে যায় আজ ভোরে। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ঋষভ। আজ বেলা ১২ টা নাগাদ শেষবারের জন্যে বাড়ি ফেরে সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবার রওনা হয় শ্রীরামপুর কালীবাবু শ্মশানের উদ্দেশ্যে। ছোট ছেলেকে এভাবে হারিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ভেঙে পড়েছেন ঋষভের বাবা। শেষযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের বেশ কিছু নেতা-কর্মী। ছিলেন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সব জানেন, পুলকার নিয়ে সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।”
গত আটদিন নিজের ছেলে এবং মৃত্যুর মাঝে কার্যত ঢাল হয়ে দাড়িয়েছিলেন শ্রীরামপুরের তৃণমূল কাউন্সিলর সন্তোষ সিং। আজ লড়াই থামল তাঁরও। নিজের ছেলেকে দাহ করে আরও একবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন সন্তোষ। তিনি জানালেন, “ আমার ছেলেকে ফেরাতে পারলাম না। ওর বন্ধু দিব্যাংশ যেন ভালো হয়ে ফেরে। ও যেন সুস্থ হয়ে যায়”।
সন্তানশোকের ভার দুনিয়ার সব ভারের চেয়ে বেশি। সেই ভার সহ্য করতে পারছিলেন না পাপ্পু। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন মাঝেমধ্যেই। সেই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই… ওর বন্ধু যেন সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরে।” বাড়িতে সারাক্ষণ সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন ঋষভের মা। তিনি হৃদরোগী, তার উপরে এই ক’দিনে শরীর-মন ভেঙে গেছে। তিনি একরকম বাহ্যজ্ঞান শূন্যই ছিলেন।
তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত পাপ্পু। সেই সূত্রে তিনি ঋষভকে খুবই স্নেহ করতেন। এসএসকেএম হাসপাতালে তিনি ছিলেন। ঋষভের বাবাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে জল চলে আসে তাঁর চোখেও। তিনি বললেন, “ এতটুকু একটা বাচ্চার এভাবে চলে যাওয়া খুবই মর্মান্তিক। ঋষভের চলে যাওয়ার খবরে নিজের বাবা চলে যাওয়ার থেকেও বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি”।
সামলানো যাচ্ছিল না ঋষভের বছর বারোর দাদা আয়ুষও। কান্নায় ভেঙে পড়ে আয়ুষ তার বাবাকে শুধু একটা কথাই বলে চলেছিল, “ভাইকে এনে দাও… ভাইকে এনে দাও।” শিলিগুড়ির কনভেন্টে পড়া আয়ুষ মানতেই পারছিল না তার ছোট ভাই ঋষভ আর কোনও দিন তাকে দাদা বলে ডাকবে না। ঋষভের মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন এসএসকেএমে লড়তে থাকা দিব্যাংশের বাবা গোপীনাথ ভগত। তিনি বলেছেন, “ওরা দু’জনে একসঙ্গে ফিরলে ভাল হত।”
ঋষভের পাড়ায় মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছায় ভোরে। আজ সেখানে কোনও দোকানপাট খোলেনি। এলাকার লোকজন এদিন প্রশ্ন তুলেছেন পুলকার মালিক ও চালকদের দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে। আজ তাঁরা ফুঁসে উঠেছেন প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ তুলে। কোনও কিছুই আজ আর তাঁদের শোক ও ক্ষোভকে চাপা দিতে পারছিল না।
চুঁচুড়ার খাদিনা মোড়ে টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ পাবলিক স্কুলে পড়ত ঋষভ। সেই স্কুলের অধ্যক্ষা প্রদীপ্তা চট্টোপাধ্যায় ও অন্য শিক্ষিকারা এসেছিলেন ঋষভের শোকযাত্রায়। শ্রীরামপুরে কালীবাবু শ্মশানঘাট খুব বেশ হলে দেড় কিলোমিটার। রাস্তায় শোকার্ত মানুষের ঢল। সকলেই ধীরে ধীরে চলেছেন… ঋষভের পাশাপাশি। পাড়ার ছেলে শেষবার চলল যে পাড়া ছেড়ে…।