‘‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।
শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যে দান।।’’
ভারতীয় ভাবনায় শিব দেবাদিদেব। ব্রহ্মা-বিষ্ণুর সঙ্গেই উচ্চারিত তাঁর নাম। এক দিকে মহাপ্রলয়ের দেবতা, অপর দিকে তিনি কল্যাণসুন্দর। পণ্ডিতদের মতে শিব প্রাগার্য সংস্কৃতির দেবতা। মহেঞ্জোদরোর একটি সিলে পশুপতির প্রতিকৃতি খোদিত দেখা যায়। আবার বৈদিক রুদ্র ছিলেন বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়ঝঞ্ঝার দেবতা। পরে শিবের সঙ্গে এই রুদ্র সম্ভবত মিলেমিশে যান। শিবপত্নী উমা-পার্বতী। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ আদর্শ। গুপ্ত-পাল-সেন পর্বে উমা-মহেশ্বরের যুগ্মমূর্তি জনপ্রিয় ছিল। বাংলার বিভিন্ন স্থানে এমন প্রস্তরমূর্তি অনেক পাওয়া গিয়েছে। বর্ধমান জেলার বিভিন্ন গ্রামে আজও হরগৌরীর প্রস্তরমূর্তি পূজিত হয়— যেমন কলিগ্রামে, মঙ্গলকোটের বনকাপাশি কিংবা কাটোয়ার বিকিহাট গ্রামে। আজও কুমারী মেয়েরা মনের মতো বরের কামনায় শিবপূজা করেন। শিব-পার্বতীর বিয়ের মূর্তিকে বৈবাহিক/ পাণিগ্রহণ/ কল্যাণসুন্দর মূর্তি বলা হয়। বিভিন্ন গুহাশিল্পে, মন্দিরগাত্রে কিংবা স্বতন্ত্র মূর্তিফলক হিসেবে এই মূর্তি পাওয়া গিয়েছে।
শিবপুরাণ, পদ্মপুরাণ, স্কন্দপুরাণ প্রভৃতি পুরাণে, মহাকাব্যে, প্রাচীন সাহিত্যে শিবের গার্হস্থ্য জীবন বর্ণিত হয়েছে। শিবের গলায় মালা দিয়েছিলেন দক্ষকন্যা সতী। শিব-বিরোধী দক্ষ এক বার শিবহীন যজ্ঞের আয়োজন করলেন। সেখানে সতীর উপস্থিতিতে শিবের নিন্দা শুরু হল। সতী, পতির অপমানে যজ্ঞকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। শিব এসে দক্ষযজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে প্রলয় নাচনে মেতে উঠলেন। সৃষ্টি বুঝি রসাতলে যায়। বিষ্ণু সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন বৃহত্তর ভারতবর্ষে। তার পরে মহাদেব গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন। এ দিকে, সতী জন্ম নিলেন হিমালয়কন্যা উমা রূপে। স্বর্গরাজ্য তখন অসুর, দানবদের করতলে। তারকাসুরকে বধ করতে চাই শক্তিশালী দেবসেনাপতি। ব্রহ্মা বললেন, যেমন করেই হোক উমার সঙ্গে মহেশ্বরের বিবাহ দিতে হবে। তবেই জন্ম হবে কার্তিকের। দেবতাদের প্রচেষ্টায় গৌরীর তপস্যায় মদন ভস্মের পরেই হরগৌরীর পরিণয় সুসম্পন্ন হয়।
পুরাণ-লোকশ্রুতি অনুসারে শিব-গৌরীর বিয়ের স্থানটি উত্তরাখণ্ডে রুদ্রপ্রয়াগ জেলার ত্রিযুগীনারায়ণ গ্রামে। মন্দাকিনী ও শোনগঙ্গার সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই পৌরাণিক জনপদটি ছিল হিমালয় রাজার রাজধানী। এই বিবাহ দিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। আর নারায়ণ গৌরীকে সমর্পণ করেন শিবের হাতে। চৈত্রে শিবগাজন উৎসব অনেকের মতে হর-কালীর বিয়ের অনুষ্ঠান। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি লিখেছেন, ‘‘শিবের গাজনের প্রকৃত ব্যাপার হর-কালীর বিবাহ। সন্ন্যাসীরা বরযাত্রী। তাহাদের গর্জন হেতু গাজন শব্দ আসিয়াছে। ধর্মের গাজনে মুক্তির সহিত ধর্মের বিবাহ হয়। দুই বিবাহ-ই প্রচ্ছন্ন।’’
তবে পৌরাণিক মতে, হরগৌরীর বিবাহ হয় শিবরাত্রির পুণ্যলগ্নে। অনেকেই বলেন, প্রতি কৃষ্ণপক্ষের চোদ্দোতম রাত্রিই শিবরাত্রি। কিন্তু ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চোদ্দোতম রাত্রি হল মহাশিবরাত্রি। এটিকে বছরের সবচেয়ে অন্ধকার রাত বলে মনে করা হয়। এই রাতেই মহাদেব গৌরীর পাণিগ্রহণ করেন। এ দিন দেশের বহু শিবমন্দিরে হরগৌরীর বিবাহের অনুষ্ঠান হয়। বর্ধমান জেলায় শিবরাত্রিতে হরগৌরীর বিবাহ উৎসব না হলেও মেলা বসে এবং বিশেষ পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিই সেই সময়, যখন বসন্ত ইউরোপে পাড়ি দেয়, তুষারকে গিয়ে বলে, এখন তোমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে; আর তার পরেই ফের ভারতে ফিরে আসে সসম্মানে। দু’টো উৎসবেরও মরশুম এটা, খ্রিস্টানদের ভ্যালেন্টাইন’স ডে আর হিন্দুদের শিবরাত্রি পালিত হয় এই সময়েই।
শিবরাত্রির দিনে হিন্দুরা মুখ্যত উদ্যাপন করে থাকেন শিবের বিয়ের উৎসব, কেননা এ দিনেই শিব পার্বতীকে বিয়ে করেছিলেন বলে কথিত। খ্রিস্টান চার্চ কিন্তু মধ্য-ফেব্রুয়ারির ভালবাসার উৎসবটিকে নিয়ে খানিক বিব্রত। প্রাচীন রোমানদের ‘লুপারকালিয়া’ নামের এই উৎসবকে বহু শতাব্দী ধরে গির্জাতন্ত্র দমিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। রোমানদের ওই উৎসবে নারী-পুরুষের যৌন স্বাধীনতার উদ্যাপন হত। দুই লিঙ্গের মানুষের অবাধ মেলামেশা স্বাভাবিক ভাবেই চার্চের চোখে ছিল চরম অনৈতিক। ‘জুনো ফেব্রুয়াটা’, যে দেবীর উদ্দেশে এই ‘প্রেম-জ্বর’ উৎসর্গীকৃত ছিল, চার্চ সেই দেবীকেও অস্বীকার ও বর্জন করে। অবশ্য পুরোপুরি পারেনি। বারবারা ওয়াকার লিখেছেন, ‘চার্চ সেই দেবীর পরিবর্তে নিয়ে এল এক শহিদ পুরুষের মিথ, তিনিই সন্ত ভ্যালেন্টাইন।’ ভ্যালেন্টাইনের পরিচয় নিয়ে মতান্তর আছে। একটা মত বলে, তিনি ছিলেন এক পবিত্র, সুদর্শন রোমান যুবা, যিনি নিজের প্রিয়তমার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। একটা উৎসবের কেন্দ্রীয় চরিত্র কী ভাবে নারী থেকে পুরুষ হয়ে গেল, তা লক্ষ করার মতো বিষয়। সমস্ত ধর্মেরই একটা চড়া দাগের পুরুষতান্ত্রিক রং আছে। তারই প্রভাবে নারী-পুরুষের মানুষী প্রেমের সম্পর্কটিকেও একটু বেশি শ্রদ্ধার, পুজো-পুজো রূপ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ভুক্ত বৈষ্ণব ও উত্তর ভারতের বহু কবির কথা, যাঁরা ঘোষণা করেছিলেন, রাধা-কৃষ্ণ আসলে বিবাহিত দম্পতি। পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল ধর্মবিশ্বাসগুলির কাছে ‘ভালবাসা’ ব্যাপারটা সব সময়েই সমস্যার, বিশেষ করে যদি সেই ভালবাসা বৈধ বিবাহ, জাতি বা শ্রেণির বাইরে ঘটে যাওয়ার মতো স্পর্ধা দেখায়। দক্ষের যজ্ঞে শিব-পার্বতীর ট্রাজেডি কী করে ভুলি, ভালবেসে বিয়ে করার জন্য তাঁদের কতটা মূল্য চোকাতে হয়েছিল! শিবরাত্রি পালনের প্রথাটি গত দু-তিন শতকে— ব্রিটিশদের হাতে মুসলমান শাসকের পরাজয়ের পরে বাংলায় ব্রাহ্মণ্যবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার পর— সুদৃঢ় হয়েছে। শিবরাত্রির দর্শনটি এমন: বিয়ে ব্যাপারটা এতই গুরুতর ও জটিল যে এটা বাবা-মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল, তাঁরা দেবদেবী, জাতপাত, কোষ্ঠী ইত্যাদি দেখেশুনে তাঁদের লক্ষ্মী মেয়েদের জন্য (যারা কিনা পুজো-উপোস ইত্যাদি করে) শিবের মতো বর খুঁজে আনবেন।
একই সঙ্গে আমরা দেখি, ইতিহাস ও কিংবদন্তির হাত ধরে সামাজিক, ভদ্রজনোচিত সম্মানের ধারণা কী ভাবে ভারতে ‘কাম’ ও ‘রতি’-র মতো বেয়াড়া চরিত্রকে এবং ইউরোপে ‘ইরোস’, ‘কিউপিড’, এমনকী ‘প্রায়াপুস’কেও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। কামদেব যেমন শুধু শিবের সঙ্গেই সম্পর্কিত নন, শিবপুরাণ মতে তাঁর যোগ আছে ব্রহ্মার সঙ্গেও, ব্রহ্মাই তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। ঋগ্বেদ, অথর্ববেদেও কামদেবের উল্লেখ আছে; বিষ্ণুপুরাণ মতে তিনি নারায়ণের অংশ, ভাগবতপুরাণ বলছে তিনি কৃষ্ণের এক রূপ। এ থেকে বোঝা যায়, তাঁর অস্তিত্ব ও প্রতীকবাদকে হিন্দুধর্মের প্রামাণ্য মতবাদগুলিও অস্বীকার করতে পারেনি। যে পুরাণগুলির নাম বললাম, যদি তাদের রচনাকাল দেখি তা হলে দেখা যাবে সেগুলি রচিত হয়েছে আড়াই হাজার বছর ধরে; খেয়াল করলে দেখব, কাম বা মদন নিয়ে চর্চা ভালই ছিল, ইন্দ্র বা বরুণের মতো তিনি হঠাৎ মানুষের পুজোর মঞ্চ থেকে বিদায় নেননি। আর কী আশ্চর্য, সেই সুদর্শন রোমান যুবা যাঁকে খ্রিস্টানরা ‘ভ্যালেন্টাইন’-এর রূপ দিলেন, তাঁরই মতো, কামদেবকেও কল্পনা করা হয়েছে এক রূপবান পুরুষ হিসেবে। তাঁর গাত্রবর্ণ শ্যাম, হাতের ধনুটি তৈরি ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, তাতে মধুকরের আনাগোনা। তাঁর তূণীরে সুরভিত পঞ্চশর, অশোক-মল্লিকার মতো পাঁচ রকমের ফুল দিয়ে বানানো। কোকিল, গুঞ্জরিত অলি, মৃদুমন্দ মলয়পবনের মতো বসন্ত-অনুষঙ্গ সঙ্গে নিয়ে তিনি আসেন। আরও অবাক করা ব্যাপার, হিন্দু ও গ্রিকো-রোমানের মতো বিস্তর দূরত্বের ব্যবধানে থাকা দুই সভ্যতায় ভালবাসার দেবতার প্রতীকটি একই— তিরধনুক। গ্রিকরা প্রেমের দেবতার নাম দিয়েছিল ইরোস, রোমানরা— কিউপিড। বস্তুত, প্রাচীন ইউরোপে কিউপিড আবির্ভূত হয়েছিলেন ডানাওয়ালা এক পুংদণ্ড রূপে, অনেক পরে রেনেসাঁর সময়কার শিল্পভাবনা তাঁকে নতুন এক রূপ দান করে— এক শিশু দেবদূত, ছোট্ট, মিষ্টি তিরধনুক নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ায় সে। প্রেমের তির-বেঁধা হৃৎপিণ্ড এখন ভালবাসার বিশ্ববিদিত অভিজ্ঞান, ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে এই প্রতীক আর ছবি-সম্বলিত কার্ড বিক্রি করে এক-একটি সংস্থা লক্ষ লক্ষ ডলার রোজগার করে। ভারতের কথায় ফিরে আসি, ইদানীং দেখতে পাচ্ছি ভ্যালেন্টাইন’স ডে-তে জনবহুল স্থানগুলিতে নারী-পুরুষ যুগলের উপর নজরদারি চালাচ্ছে উগ্র মতাদর্শবাদীরা, যারা নিজেদের ধর্মের শেকড়ই জানে না। দিনটার নাম পালটে ‘কাম-রতি দিবস’ দিলে হয়তো এই দুর্বলমনা মানুষগুলো খানিকটা নরম হবে, কে বলতে পারে!
গবেষকদের ধারণা, বৈষ্ণবরা ভালবাসার নানান সংকটের দিক আত্মস্থ করেছিলেন রাধাকৃষ্ণ ও বসন্তের মাদকতাময় হোলি উৎসবের মধ্য দিয়ে, আবার তাঁদের প্রতিযোগী শৈবরা বাসনার বিষয়টি সামলেছিলেন পৌরুষপূর্ণ দেবতা শিবের মধ্য দিয়ে— সেই শিব, যাঁর নিজেরও রসগল্পসম্ভার কম নয়। কিন্তু সমাজ তো শৃঙ্খলা, নিয়ন্ত্রণ, এ সব ছাড়া চলতে পারে না। মনে করা হয়ে থাকে, কামদেবকে শিবের শাস্তিদান আসলে অসংযতদের শিক্ষা দেওয়ারই নামান্তর। মৎস্যপুরাণে আছে ‘মদনভস্ম’ বা ‘কামদহন’-এর আখ্যান, যেখানে গভীর ধ্যানে মগ্ন শিবকে ছলাকলায় প্রলুব্ধ করার অপরাধে শিব কামদেবকে ভস্মীভূত করেন। হিন্দুধর্ম প্রকৃতপক্ষে বহুবিধ বৈপরীত্যকে বাঁধবার এক প্রয়াস, আর এই আখ্যানও তার ব্যতিক্রম নয়, কারণ কামদেবের ছলাকলা দিয়ে শিবকে ভোলানোর চেষ্টা নাকি আসলে পবিত্র এক কর্তব্য সাধন! অন্য সব দেবতা মিলে যুক্তি করেই তাঁকে শিবের কাছে পাঠিয়েছিলেন, যাতে শিব-পার্বতীর মিলন সম্ভব হয়, জন্ম নিতে পারে সুপারহিরো সুপুত্র কার্তিকেয়, এক ও একমাত্র যিনি বধ করতে পারেন ত্রিলোকত্রাস, অজেয় তারকাসুরকে। সুতরাং এক অর্থে কামদহন নয়, শিবরাত্রি নামের ধর্মীয় উৎসব ও তার ব্রত-উপবাস-আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই কামনা-বাসনার বিষয়টিতে নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করা হল। আখ্যানটির পরের পর্বেও বৈপরীত্যের চমক। মদনদেব মৃত, তাঁর স্ত্রী রতি হাহাকার করছেন। তার ফলে আর ফুল ফোটে না, পাখি ডাকে না। নতুন জীবন আসে না। সেই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে মদনের স্ত্রী রতির অনুরোধে শিব মদনকে পুনরুজ্জীবিত করলেন, তবে কায়াহীন রূপে। তাই কামদেবের আর এক নাম অনঙ্গ বা অতনু। বিশ্বপ্রকৃতি জুড়ে প্রেমের বিচরণ, আবার মানবপ্রকৃতিও কামপ্রভাবে তাড়িত। প্রসঙ্গত, শৈব ধর্ম যখন ভারতের বাইরে প্রচারিত হয়, কামদেব এবং অনেক চমকপ্রদ আখ্যান তার সঙ্গেই রফতানি হয়। জাভার হিন্দুরাও দ্বাদশ শতকে তাঁদের নিজস্ব ‘স্মরদহন’ কাব্যে মদনভস্ম ও তার পুনরুজ্জীবনের ঘটনা উদ্যাপন করেন। কাম ও তাঁর সঙ্গিনী রতিকে কাকাউইন কবিতায় ডাকা হয় কামজয় ও কামরতি নামে। পরবর্তী কালে ইন্দোনেশিয়ার ওয়াইয়াং-আখ্যানের পুতুলনাচেও কাম আর রতির সগর্ব সদর্প উপস্থিতি।
গ্রিসেও এক দেবতা পুজো পেতেন শিবের মতোই, শিবলিঙ্গের সমতুল্য প্রতীকে। তিনি ইরোস-এর ভাই, নাম প্রায়াপুস। মনে হয়, প্রায়াপুসের যাত্রা শুরু হয়েছিল এখনকার তুরস্ক থেকে; রোমান সাম্রাজ্যে তাঁকে ‘বণিকদের দেবতা’ হিসেবেও পুজো করা হত। খ্রিস্টধর্ম সব পেগান দেবদেবীদের সরিয়ে দেওয়ার, বা সন্ত হিসেবে জবরদখল করে নেওয়ার পরেও গ্রামীণ মানুষের মধ্যে এই দেবতাটির পুজোর চল থেকে গিয়েছিল। একই রকমের আরও লিঙ্গ-দেবতার উপস্থিতি পাই গ্রিসের ‘হারমিস’ ও রোমান ‘মিউটুনাস টিউটুনাস’ দেবতার মধ্যে। এঁদের কাজ ছিল বিবাহ-অনুষ্ঠানে সন্তুষ্টিবিধান। তারও আগে, মিশরীয়রা পুজো করতেন ‘আইসিস’ ও ‘মিন’-এর, নরওয়ের মানুষের আরাধ্য ছিলেন দেবতা ‘ফ্রের’। বলকান দেশগুলিতে চালু ছিল ‘কুকেরি’-র আরাধনা, জাপানেও আছে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’-এর মন্দির ও প্রতীকোপাসনা। ওয়ালিস বাজ-এর লেখায় স্পষ্ট পাওয়া যায়, ইউরোপে ‘সপ্তদশ শতক অবধি বিশালাকায় পুং-প্রতীককে সন্ত জ্ঞানে পুজো করা হত।’ তাঁর লেখায় সুদীর্ঘ এক তালিকাও মেলে। স্যর উইলিয়াম হ্যামিলটন আঠারোশো শতকে ‘কসমো’ নামের এক পুংপ্রতীকধর্মী সন্তের পূজনবিধির বর্ণনা দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বোমাবিধ্বস্ত ইংলিশ চার্চগুলি আবার গড়ে তোলা হচ্ছিল, তখন ‘রয়্যাল কমিশন অন হিস্টোরিক্যাল মনুমেন্টস’ মাটির নীচে বহু লিঙ্গমূর্তি খুঁজে পেয়েছিল। তাই শিবরাত্রির দিনে বা শ্রাবণ মাস-ব্যাপী শিব-আরাধনার রকমসকম দেখে ভারতে-আসা ইউরোপীয়রা যে অভিঘাত ও বিস্ময়ে অভিভূত হতেন, তার খুব একটা কারণ আছে বলে মনে হয় না।
প্রাচীন এক সভ্যতার ধারক হিসেবে হিন্দুধর্ম মানুষের সমস্ত রকমের প্রয়োজনের প্রতি দুর্দান্ত সহনশীলতা দেখিয়েছে। এটাই দুঃখের যে আজ এই সহিষ্ণুতার গায়ে আঁচড় পড়ছে। প্রাচীন ভারত জীবনের সর্বক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিল। সেই সহিষ্ণুতা আজ কারও কারও পছন্দসই নয়, এটাই দুঃখের। প্রাচীন ভারত জীবনকে ছুপিয়ে নিয়েছিল উৎসবের রঙে, পরিণত মানসিকতায় তার উদ্যাপন করেছিল খোলাখুলি, অলজ্জ ভাবে।
কোথাও পুণ্য সঞ্চয়ের অভিলাষ, কোথাও বা দীর্ঘলালিত মনোস্কামনা— এ সব নিয়েই আবালবৃদ্ধবনিতার ভক্তি আর বিশ্বাসে ফাগুনের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে পালিত হয় শিবরাত্রি। দোল কিংবা দীপাবলির মতোই সমগ্র ভারতে এটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। শিবরাত্রির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা কাহিনি এবং কিংবদন্তি। উৎসবের আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা রীতি রেওয়াজ। কোথাও শিব–পার্বতীর বিয়ে, কোথাও বা নানা উপচার-সহ রুদ্রাভিষেক। এ দিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সারা দিনের উপবাসের শেষে শিবের পুজো করে থাকেন পুণ্য লাভের আশায়। এমনটাই তো চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।
এই শিবরাত্রি নিয়ে শোনা যায় এক প্রচলিত কাহিনি। কাশীতে এক ব্যাধ বাস করত। সারা দিন বনে শিকার করে সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরত। এমনই এক বনে গিয়ে সারাদিন অনাহারে ক্লান্ত সেই ব্যাধ একটি গাছের নীচে বিশ্রাম নিচ্ছিল। যখন তার ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। ব্যাধ বুঝতে পারল সে দিন আর গভীর জঙ্গল অতিক্রম করে বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। তাই ঠিক করল একটি গাছের উপরে রাত কাটিয়ে পর দিন বাড়ি ফিরবে। কাছেই ছিল একটি প্রাচীন বেলগাছ। ব্যাধ তখন কাছেই একটি বেলগাছের ডালে শিকারগুলিকে বেঁধে রেখে নীচে একটি শক্ত ডালের উপরে বসে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেই বেলগাছের কাছেই একটি শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল। গাছের উপরে ব্যাধের নড়াচাড়ার ফলে একটি বেলপাতা সেই শিবলিঙ্গের উপরে গিয়ে পড়ে। সে দিন ছিল শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি। নিজের অজান্তেই উপবাসী থেকে বেলগাছের একটি পাতা শিবলিঙ্গের উপরে পড়ায় সেই ব্যাধের ব্রত পালন হয়ে গিয়েছিল। পর দিন বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে সে খেতে বসবে, এমন সময় তাঁর বাড়িতে অতিথি এসেছিল। ব্যাধ অতিথি সেবার রীতি মেনে খাওয়ানোরও ব্যবস্থা করল। ফলে নিজের অজান্তে সে ব্রতের সম্পূর্ণ ফল লাভ করেছিল। বহু বছর পরে ব্যাধের মৃত্যুর সময় এক দিকে যমদূতেরা, অন্য দিকে শিব দূতেরা তাকে নিতে উপস্থিত হল। এই নিয়ে যুদ্ধও বেঁধে গেল। অবশেষে যখন যমদূতরা কৈলাসে শিবের কাছে নালিশ করতে গিয়েছিল ঠিক তখনই শিবের প্রহরী নন্দী যমদূতদের বলেন, যেহেতু ব্যাধ শিবচতুর্দশীর ব্রত পালন করে পুণ্য অর্জন করেছে তাই তাকে যমদূতেরা নিয়ে যেতে পারেন না। যমদূতরা, যমরাজের কাছে গিয়ে যখন এ কথা জানাল যমরাজ নাকি বলেছিলেন, এই ব্রত যে পালন করবে তার উপর যমের কোনও অধিকার থাকবে না। এই ব্রত মানুষকে সর্ব পাপ থেকে উদ্ধার করে। সেই বিশ্বাস নিয়ে পুণ্যার্জনের আশায় নারী-পুরুষ যুগ যুগ ধরে এই ব্রতের পালন করে আসছে।
সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায় সিন্ধু সভ্যতার যুগেও বিক্ষিপ্ত ভাবে লিঙ্গ রূপে শিব পূজিত হতেন। পরবর্তী কালে বৈদিক যুগে রুদ্রের সঙ্গে তিনি মিলিত হলেন। তবে প্রাক আর্য যুগ থেকেই শিব ঊর্বরতা এবং প্রজননের দেবতা হিসেবে পূজিত হয়েছেন। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যান্য নানা গুণ। শিবের মধ্যে বরাবরই দুটি বৈপরীত্য বার বার ফুটে উঠেছে। এক দিকে তিনি শ্মশানবাসী। ভূত প্রেত তাঁর অনুচর এবং কাপালিক, অঘোড়িরা তাঁর উপাসক। অন্য দিকে সেই শিবই কৈলাসে পার্বতী এবং দুই পুত্র কার্তিক, গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। এ ভাবেই ভোলা মহেশ্বর যেন একেবারে বাঙালির ঘরের লোক হয়ে গিয়েছেন। পরে সুঙ্গ, কুষাণ, গুপ্ত যুগের শিল্পে ফুটে উঠেছে শিবের নানা রূপ। এমনকী, বাংলার পাল আমলে যখন বৌদ্ধ ধর্মের এত রমরমা তার মধ্যেও শিবের অস্তিত্ব কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি। আবার সেন যুগে যখন শৈব ও শাক্ত ধর্মের প্রাধান্য বাড়তে থাকে তখন লিঙ্গ রূপ ছাড়াও কখনও নৃত্যরত শিব, উমা মহেশ্বর, কখনও বা অঘোড়শিব রূপে তিনি পুজিত হয়েছেন। তবে পরবর্তী সময়ে সুলতানি যুগের শেষে সমাজে বৈষ্ণব ধর্মের প্রাধান্যের জন্য মূর্তির চেয়ে লিঙ্গ রূপেই শিবপুজোর প্রাধান্য বাড়ে।
কাশীর বিশ্বনাথ, গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরে কিংবা নেপালের পশুপতিনাথের মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়। এমনকী, পূজার্চনার ব্যতিক্রমী বিধি দেখা যায়। যেমন ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দিরে পুজোর শেষে মন্দিরের মহাদীপ স্থাপন এক বিশেষ ঐতিহ্য। মন্দিরের গা বেয়ে এক ভক্ত যখন উঠে চূড়ায় এই মহাদীপ স্থাপন করেন তখন হাজার হাজার মানুষ এই দৃশ্য দেখে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য উপস্থিত থাকেন। তেমনই উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরে এক কালে নানা পবিত্র বস্তু–সহ চিতাভষ্ম দিয়ে মহাদেবের ভষ্মাভিষেক করা হত। এখন তার অন্য বিকল্প ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও হয় বিশেষ শৃঙ্গার। যা দর্শন করতে কয়েক লক্ষ মানুষের আগমন হয়।
অন্যান্য প্রদেশের মতো বাংলার শিবরাত্রির রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। মন্দিরে মন্দিরে চার প্রহরে বিশেষ পূজার্চনার পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় বসে ঐতিহ্যবাহী মেলাও। যদিও মেলার সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে। বর্ধমানের ১০৮ শিবমন্দির, হুগলির তারকেশ্বর, চুঁচুড়ার ষাণ্ডেশ্বরতলা, নৈহাটির বুড়োশিবতলা, আতপুরের জোড়া শিবের মন্দির, হাটখোলার মহম্মদ রমজান লেনে প্রাচীন শিবমন্দির, কালীঘাটের নকুলেশ্বরতলা, কিংবা খিদিরপুরের ভূকৈলাস রাজবাড়ির শিবমন্দিরেও সাড়ম্বরে শিবরাত্রি পালিত হয়। ১৭৮১ নাগাদ রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল তাঁর প্রাসাদের সামনে শিবগঙ্গা নামে এক দিঘি খনন করান এবং তার উত্তর ও পূর্ব ভাগে দু’টি শিবমন্দির নির্মাণ করে সেখানে রক্তকমলেশ্বর ও কৃষ্ণচন্দ্রেশ্বর শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৭৮২-তে জয়নারায়ণ প্রাসাদের মধ্যেই পতিতপাবনীর (দুর্গা) মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে এক সময় এসেছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন। শোনা যায়, তিনি এই অঞ্চলটির নামকরণ করেছিলেন ভূকৈলাস। শিবরাত্রিতে বিশেষ পুজো ছাড়াও মাঝরাতে ১০৮ ঘড়া জলে শিবের অভিষেক ও বিশেষ পুজো হয়। মেলা উপলক্ষে কয়েকটা দিন এখানে বহু মানুষের আনাগোনা লেগে থাকে।
বর্ধমান জেলায়, বিশেষ করে কাটোয়া মহকুমার অনেক প্রাচীন গ্রামে শিবরাত্রির মেলা বসে। যেমন মঙ্গলকোট থানার চৈতন্যপুর গ্রামে রয়েছে অনাদি শিবলিঙ্গ শৈলেশ্বর। কাটোয়ায় সন্ন্যাস নিয়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু দিব্যোন্মাদে তিন দিন রাঢ় ভ্রমণ করেছিলেন। ফিরে আসার সময়ে এই জনপদে তাঁর পূর্বেকার স্মৃতি ফিরে পান। এই সূত্রে স্থানটির নাম হয় চৈতন্যপুর। এই গ্রাম থেকেই মিলেছে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকের বিষ্ণুর ব্যতিক্রমী আভিচারিক মূর্তি, বর্তমানে সেটি ভারতীয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত। চৈতন্যপুরের শৈলেশ্বরের পুজোয় মেলা বসে। গ্রাম-গ্রামান্তরের কুমারী মেয়েরা-সহ অনেকেই পুজো দিতে আসেন। কাটোয়ার ঘোষেশ্বরতলাতেও শিবরাত্রিতে অসংখ্য পুণ্যার্থী আসেন। পুইনি গীতগ্রাম সিঙ্গি প্রভৃতি গ্রামে শিবরাত্রিতে জাঁকজমক-সহ পূজা হয়। কেতুগ্রামের বিল্বেশ্বরে বাবা বিল্বনাথকে কেন্দ্র করে শিবরাত্রিতে মেলা বসে। নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। বসে লোকসংস্কৃতির বর্ণময় আসর।
মঙ্গলকোটের শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে শিবরাত্রিতে বিশেষ ভাবে পূজিত হন বাবা ন্যাংটেশ্বর। ইনি আদতে জৈন তীর্থঙ্কর শান্তিনাথ। এক সময় মঙ্গলকোট-সহ সমগ্র রাঢ় অঞ্চলে জৈনধর্মের প্রাধান্য ছিল। মঙ্গলকোটের রাইতো দিঘি থেকে আবিষ্কৃত, বর্তমানে শঙ্করপুর বাবলাডিহিতে পূজিত শান্তিনাথের বিগ্রহটি কালো কষ্টিপাথরে খোদিত। উচ্চতায় চার ফুট। চালিতে বিদ্যাধরের নীচে মূল মূর্তির পাশে আরও দু’জন তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে। পাদপীঠে সুসজ্জিত চামরধারীর পাশে আরও দু’টি তীর্থঙ্করের মূর্তি। মৃগ লাঞ্ছন দেখে বোঝা যায় এটি শান্তিনাথের বিগ্রহ। আনুমানিক দশম শতকের এই বিরল মূর্তিটি পঞ্চতীর্থক জৈনমূর্তির দৃষ্টান্ত। এই মূর্তিটিই শিবের ধ্যানে পূজিত হয় ন্যাংটেশ্বর নামে। বাৎসরিক উৎসব শিবরাত্রির সময়। মেলা বসে, নানা ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। ন্যাংটেশ্বরের মিলন মেলায় মেতে ওঠেন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এলাকার মানুষ।
গবেষণাপত্রের বাইরে আজ আর মেয়েলি ব্রত, ব্রতকথা এ সবের অস্তিত্ব আছে না কি? শিবরাত্রির উৎসব দেখলে অবশ্য এমন সন্দেহ মনে রাখার কোনও কারণ নেই। বাংলার গ্রামে-শহরে ছড়ানো হাজার হাজার শিবমন্দির যেন ফাল্গুন মাসে জেগে ওঠে শিবরাত্রি উপলক্ষে। শহরের অলিতে গলিতে অজস্র শিবমন্দিরের অস্তিত্ব হঠাৎ টের পাওয়া যায় তারস্বরে বাজানো চটুল গানের দৌলতে। হবে না-ই বা কেন, সব ব্রতের মধ্যে শিবরাত্রিকেই তো শ্রেষ্ঠ ব্রত বলে ধরা হয়। এই ব্রত পালন করলে নাকি নারীর সব কামনা পূর্ণ হয়ে যায়— পতিকামনা, পুত্রকামনা, বৈধব্য খণ্ডন ও সাংসারিক মঙ্গল। মধ্যযুগের যে সমাজে এই ব্রতের প্রচলন হয়, সেখানে মেয়েদের— তা সে কুমারী সধবা বা বিধবা যাই হোক না কেন— পরিবারের বাইরে অন্য কিছু চাইবার মতো কোনও ফাঁকই রাখা হয়নি। আজ পরদা সরেছে, কিন্তু সংস্কার কাটেনি, কিংবা সংস্কার— আরও অনেক সংস্কারের মতোই— হয়ে উঠেছে নিছক বাৎসরিক উৎসব।
ব্রতকথা অনুযায়ী, শিবরাত্রি ব্রতের ব্যাখ্যা করেন মহাদেব স্বয়ং। পার্বতী মহাদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, প্রভু, এমন এক সহজ ব্রত বলে দিন, যা সকলেই পালন করে পাপমুক্ত হতে পারে। মহাদেব বললেন, ‘ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে যে ভয়ানক অন্ধকার রাত্রি হয়, তা-ই শিবরাত্রি। শিবরাত্রিতে যে উপবাস করে, আমি তার উপর খুব সন্তুষ্ট হই।… শিবরাত্রিতে চার প্রহরে চারটি গঙ্গামাটির শিব গড়ে পূজা করবে।… ওই দিন রাত্রি জাগবে…’ পুজোর উপকরণ সরল, বেলপাতা আর গঙ্গাজলই যথেষ্ট। জটিল মন্ত্রতন্ত্র কিছু নেই, দীর্ঘ প্রস্তুতিরও প্রয়োজন নেই। সাধে কি আর সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রত, সহজে পাপমুক্তি আর সপরিবার মঙ্গলের ব্যবস্থা!
শুধু কি তাই? শিবরাত্রি মোটেই শুধু মেয়েদের পালনীয় ব্রত নয়। ছেলেরাও শিবরাত্রি করতে পারে। করেও। আসলে প্রথম শিবরাত্রি তো করেছিল এক জন পুরুষই! সে গল্পও শুনিয়েছেন শিব। বারাণসীর এক ব্যাধ— ধর্মকর্মের বালাই নেই, পশুহত্যাই তার জীবিকা। পাপের ভারা তাই কানায় কানায় পূর্ণ। সারা দিন শিকারের পর ক্লান্তিতে গাছতলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, সন্ধে হয়ে যাওয়ায় বাড়ি যেতে পারবে না ভেবে সে গাছের ডালেই রাতটা কাটিয়ে দেয়। গাছটা ছিল বেলগাছ, আর তলায় ছিল একটা শিবলিঙ্গ। ব্যাধের গায়ে লেগে একটা বেলপাতা শিশিরের জলের সঙ্গে মিশে শিবের মাথায় পড়ল। সেটা ছিল শিবরাত্রি, আর ব্যাধও ছিল উপবাসী। পর দিন বাড়ি ফিরে স্নান করে সে দেখে, এক অতিথি উপস্থিত। তাঁকে খাইয়ে তার পরেই ব্যাধ নিজে খেয়েছিল। ফলে তার ব্রত পালন ঠিকমতই সম্পন্ন হল। ব্যাধ মারা যাওয়ার পর শিবদূত আর যমদূতদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেষে শিবের দূতেরাই জয়ী হল, আর যমরাজও স্বীকার করলেন, শিবচতুর্দশী করলে তার উপর আর যমের অধিকার থাকবে না। মানুষকে পাপ থেকে উদ্ধারের এটাই একমাত্র উপায়, পার্বতীকে জানালেন শিব।
সত্যি, শিব তো আশুতোষ, খুব সহজেই তাঁর মন পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলায় তাঁর এত প্রভাব-প্রতিপত্তির উৎস কী? বাংলা এমনিতেই বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলের বাইরের দেশ ছিল। পালযুগের বাংলায় বৌদ্ধদের রমরমা, এমনকী বৌদ্ধ তন্ত্রেরও পীঠস্থান এই পূর্ব ভারত। তবে এরই মধ্যে পাল আমলের শেষ দিক থেকে সেন আমল জুড়ে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের জন্য রাজা এবং অভিজাতদের বিপুল পৃষ্ঠপোষণাও নজরে পড়ে। পরে সুলতানি শাসনের ধাক্কায় অনেক দিনের নিস্তব্ধতা। মধ্যযুগের শেষ পর্ব থেকে এক দিকে চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণবধর্ম, অন্য দিকে আধা-ব্রাহ্মণ্য আধা-লৌকিক শৈবধর্ম যে ভাবে ব্যাপ্ত হয় বাংলা জুড়ে, তাতে স্পষ্টই বোঝা যায়, এ জমি ‘অন্য’ মতবাদের জন্য কতটা উর্বর ছিল! অন্য সব দেবদেবীকে এ ব্যাপারে টেক্কা দিয়েছেন শিব। তিনি তো বৈদিক দেবতা নন, ঋগ্বেদে ‘রুদ্র’ ভয়ংকর দেবতা, কিন্তু শিবের কোনও উল্লেখ নেই, বরং সেখানে ‘লিঙ্গপূজক’ বিরোধী মনোভাবই নজরে পড়ে। ক্রমে শ্মশানবাসী শিব হিন্দু ধর্মের তিন প্রধানের অন্যতম হয়ে উঠলেন। ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের দেবতা বলে সাধারণ ভাবে চিহ্নিত করা হলেও, শিবভক্তরা শিবকেই সব কিছুর স্রষ্টা ও সংহারকর্তা বলে মানেন। পৌরাণিক নানা কাহিনিতে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর থেকে শিবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা হয়েছে। সব থেকে পরিচিত বোধহয় সেই স্তম্ভরূপী শিবের গল্প, যেখানে হংসের রূপ নিয়ে ব্রহ্মা স্তম্ভের শীর্ষ আর বরাহের রূপ নিয়ে বিষ্ণু তার তলদেশ নির্ণয়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, ব্রহ্মা আবার মিথ্যে করে বলেন, তিনি শীর্ষদেশ দেখতে পেয়েছেন, তাতে শিব অভিশাপ দেন— ভারতে আর ব্রহ্মার পূজা হবে না। শেষে ব্রহ্মা বিষ্ণু দুজনেই শিবকে স্রষ্টা হিসেবে মেনে নেন। শিবের লিঙ্গপূজা প্রচলনের গল্প আছে ‘কূর্মপুরাণ’-এ। দেবদারু বনে তপস্যারত মুনিঋষিরা ছদ্মবেশী শিব আর বিষ্ণুকে চিনতে পারেননি, নানা ঘটনার পর প্রকৃত রূপ দেখে তাঁর বন্দনা করেন এবং লিঙ্গপূজা প্রচলিত হয়। ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডলে নিজের জায়গা করে নিতে ভূতপ্রেত নিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করতে হয়েছিল শিবকে, নাচতে হয়েছিল প্রলয়নাচন। কিন্তু সব কিছু সত্ত্বেও শিবের মধ্যে সেই দ্বৈত সত্তাই থেকে গিয়েছে— এক দিকে তিনি শ্মশানের দেবতা, ভূতপ্রেত তাঁর অনুচর, কাপালিকরা তাঁর সাধক; অন্য দিকে তিনি কৈলাসে পার্বতী কার্তিক গণেশকে নিয়ে ঘোর সংসারী। আর এই সংসারী, সহজে সন্তুষ্ট, আলাভোলা শিবকে কাছের করে নিতে মধ্যযুগের বাঙালির কোনও অসুবিধেই হয়নি।
শিবকে ঘরের লোকে পরিণত করার কালিক প্রয়োজন ছিল, জমিও তৈরি ছিল। শেষ দিকের পালরাজাদের লিপি থেকে বেশ কিছু শিবমন্দির তৈরির কথা জানা যায়। প্রাচীন পাশুপত সম্প্রদায়ের শৈবদের জন্য রাজানুগ্রহের কথাও আছে সেখানে। সুন্দরবনে জটার দেউল, বর্ধমানের রাঢ়েশ্বর, বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর ষাঁড়েশ্বর শৈলেশ্বর-এর মতো আটশো-হাজার বছরের শিবমন্দির টিকে আছে এখনও। পাল-সেন যুগের বাংলায় শিবের যে সব মূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে লিঙ্গমূর্তি বাদ দিলে শিব-পার্বতীর মূর্তি, বিশেষত উমা-মহেশ্বরের সংখ্যা খুবই বেশি। অর্থাৎ বাঙালি মননে একক শিব নয়, হরগৌরীর কল্পনাই প্রাধান্য পেয়েছে। শিব ও শক্তির এই সব যুগ্মমূর্তির পিছনে সে কালের তন্ত্রচর্চার প্রভাব দেখেছেন কেউ কেউ। সে যাই হোক, শিব ও পার্বতীর পারিবারিক রূপ যে ভাবে পরে বাঙালির সমাজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল, তার সূত্র কিছুটা হলেও যে এর মধ্যে থেকে গিয়েছে, সন্দেহ নেই।
তেরো শতক থেকে পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। মুসলিম শাসন কায়েম হওয়ার পর প্রথম কয়েক শতক বিশাল মন্দির তৈরি দূরের কথা, বড় আকারের পাথরের মূর্তি তৈরির পৃষ্ঠপোষকও রইল না। আক্রমণের ভয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া হল দেবদেবীর মূর্তি, পুঁতে ফেলা হল মাটির নীচে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সমাজকে আবার ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু হল। দেখা গেল, দিনকাল বদলে গিয়েছে। যে বিষ্ণু বা সূর্যের মূর্তি এর আগে বাংলার সর্বত্র পাওয়া গিয়েছে, সেই দেবতাদের পূজা আর ফিরল না। মুঘল আমলে এক দিকে চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম যেমন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের আনুকূল্য নিয়ে সবাইকে টানল, তেমনই শিবের মাহাত্ম্য সবার মন জয় করে নিল। বাংলার প্রতি গ্রামে গড়ে উঠল ছোটবড় শিবমন্দির, পূজার চল হল লিঙ্গমূর্তিতে। দ্বাদশ শিব, ১০৮ শিবমন্দির তৈরি করে অভিজাতরাও পুণ্যের ভাগ নিতে এগিয়ে এলেন।
অন্দরমহলের দরজাও কি আর বন্ধ থাকে! ব্রতকথার মাধ্যমে শিব চলে এলেন ঘরের ভিতরে। কৃষিজীবী সমাজের প্রাত্যহিক যাপনেও মিশে গেল শিবের উৎসব— সারা বাংলা জুড়ে আজও চৈত্র-বৈশাখে ‘গাজন’ হয়, যে নাম নাকি এসেছে শিববিবাহের এই লৌকিক উৎসবে সমবেত মানুষের গর্জন থেকে।
রাঢ়ের সব থেকে বড় লোক-উৎসব গাজন, উত্তরবঙ্গে আবার তারই নাম গম্ভীরা। গাজনের গানে লৌকিক শিবের কত না কীর্তিকলাপ— চাষবাস শুরুর গল্প বোধহয় সব থেকে আগ্রহ জাগায়। ‘শিবায়ন’ কাব্যেও আছে এমন গল্প। পার্বতীর পরামর্শে শিব চাষে মন দিলেন। জমি কই? ইন্দ্রের কাছে শিব জমি চাইলেন। ইন্দ্র আদিগন্ত পতিত জমি দিলেন চাষের জন্য। যম দিলেন তাঁর মহিষ, শিবের ষাঁড় আর যমের মহিষ হাল চষবে। বিশ্বকর্মা চাষের যন্ত্রপাতি বানালেন, বীজ দিলেন কুবের। হাল চষার জন্য এলেন ভীম, দশমনি কাস্তে দিয়ে ফসলও কাটলেন। ধান হল মাত্র দু’হাল। শিব বললেন, ধান পুড়িয়ে দাও। ভীম ধানে আগুন দিয়ে ফুঁ দিলেন— ধান পুড়তে লাগল, পুড়তেই লাগল। এ থেকেই তৈরি হল নানা রঙের ধান। এ গল্পের নানা মাত্রা কল্পনা করা কঠিন নয়।
অর্থাৎ শুধু শিবরাত্রিতে শিবের মাথায় জল ঢেলে ভাল বর চাওয়া নয়, শিবের মহিমা মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত অনেকটাই ব্যাপক। গবেষকদের মতে, বাংলায় এর উৎস আরও দূর অতীতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক রজত সান্যাল দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন চন্দ্রকেতুগড় তিলপি তমলুক তিলদা মঙ্গলকোট— বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন প্রত্নস্থলে পাওয়া লিঙ্গবেষ্টনকারী বিচিত্র নারীমূর্তির ভাস্কর্যের দিকে। তাঁর কথায়, এখনও এগুলির উপযুক্ত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি, কিন্তু শৈব কাল্ট-এর সঙ্গে এর যোগ অস্বীকার করার উপায় নেই। আর তা হলে অবশ্যই এ বিষয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ আছে।
(তথ্যসূত্র:
১- Lord Siva and His Worship, Swami Sivananda, Divine Life Society (২০০৮)।
২- Siva: The Siva Purana Retold, Ramesh Menon, Rupa & Co (২০১০)।
৩- Shiva: Stories and Teachings from the Shiva Mahapuran, Vanamali, Simon & Schuster (২০১৩)।
৪- Nothing Exists That is Not Siva: Commentaries on the Śiva-sūtra, Vijñānabhairava, Gurugītā, and Other Sacred Texts, Swami Muktananda and Swami Shantananda, Siddha Yoga Publications (১৯৯৭)।
৫- Gods of Love and Ecstasy: The Traditions of Shiva and Dionysus, Alain Daniélou, Simon & Schuster (১৯৯২)।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা: ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল, ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সাল, ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সাল, ৪ঠা মার্চ ২০১৯ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত