একসময় তিনি করেছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও! কিন্তু কেন? নিজের লেখা ‘ভ্রান্তি’ নাটকে ওঁর তৈরি চরিত্র রঙ্গলাল বোধ হয় তারই উত্তর দিয়ে দেয়, ‘‘সংসার যে সাগর বলে, এ কথা ঠিক, কূল-কিনারা নাই। তাতে একটি ধ্রুবতারা আছে— দয়া। দয়া যে পথ দেখায়, সে পথে গেলে নবাবও হয় না, বাদশাও হয় না, তবে মনটা কিছু ঠান্ডা থাকে।’’
দয়াহীণ জীবন যে কতটা নির্মম তা তাঁর মতো বুঝেছে ক’জনে!
দাই-মা’র বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছিলেন, এগারো বছরে মাকে হারিয়েছিলেন, চোদ্দোতে বাবা। তার পর একে একে বড় ভাই, প্রথম স্ত্রী প্রমোদিনী। দু-দুটি পুত্র সন্তান চলে গিয়েছিল। শহরের অলিগলি, শ্মশান, গঙ্গার ধারে ঘুরে বেড়াতেন। সারাটা জীবনই যেন প্রিয়জন-হারা মৃত্যু মিছিলে হেঁটেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রী সুরতও চলে গিয়েছিলেন। এর পর দুই কন্যা, শেষে এক পুত্রও।
চূড়ান্ত অর্থাভাবের মধ্যে পড়বেন জেনেও গ্রাসাচ্ছাদনের তোয়াক্কা করেননি। নামী কোম্পনির মোটা মাইনের চাকরি ছেড়েছিলেন। শুধু বাংলা থিয়েটারের বর্ণপরিচয় গড়তে খামতি দেবেন না বলে! সে পথও যে আবার মসৃণ, তা’ও নয়। তাতে কী…!
তিনি যে গিরিশচন্দ্র ঘোষ! গিরিশ বলতেন, ‘‘সংসার এক বৃহৎ থিয়েটার, রঙ্গালয় তার ক্ষুদ্র অনুকৃতি মাত্র।’’
নটি বিনোদিনীকে কেন্দ্র করেই জন্ম নিয়েছিল বাংলা নাটকের সম্ভবত উজ্জ্বলতম প্রোসেনিয়াম স্টার থিয়েটার। বহু টাকার ‘অফার’ ত্যাগ করেও যে বিনোদিনী দাসী স্টার থিয়েটারের জন্য সর্বস্ব দিয়েছিলেন, সেই স্টার থিয়েটারের নামও হতে দেওয়া হয়নি তাঁর নামে।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের দলের জন্য নাট্যশালা তৈরিতে সেই ১৮৮০-র দশকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলেন এক তরুণ মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী গুর্মুখ রায়। শর্ত ছিল, বিনোদিনীকে তাঁর ‘রক্ষিতা’ হতে হবে। গিরিশচন্দ্রই হাতে করে অভিনেত্রী করেছিলেন বিনোদিনীকে, সেই কৃতজ্ঞতায় বিনোদিনী রাজি হয়েছিলেন। কথা হয়েছিল, এই আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিতে নতুন নাট্যশালাটির নাম হবে ‘বিনোদিনী থিয়েটার’, নিদেনপক্ষে ‘বি থিয়েটার’। কিন্তু দাশু নিয়োগী, অমৃতলাল বসু, অমৃত মিত্র এবং গিরিশচন্দ্র ঘোষ রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে নাট্যশালাটির নাম পাল্টে দিলেন ‘স্টার থিয়েটার’। কারণ? এক ‘পতিতা’র নামে নাট্যশালার নাম দিলে ব্যবসা মার খাবে, সংস্কৃতিরও নাকি ক্ষতি হবে! সে স্টার থিয়েটার অবশ্য আজকের স্টার থিয়েটার নয়। ঠিকানা ছিল ৬৮ বিডন স্ট্রিট। সেখানেই ‘চৈতন্যলীলা’য় বিনোদিনীর অভিনয় দেখেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘তোর চৈতন্য হোক’।
বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যের ইতিহাসে ‘বি থিয়েটার’ না থাকলেও বিনোদিনী আছেন। আজও বাংলা রঙ্গমঞ্চ জানে, সেই ‘ক্যাপিটাল’ বি ফর বিনোদিনী, ‘বি’ ফর বিগিনিংও!
লোকটা আজ বেহেড মাতাল! কলকাতা শহরের বারাঙ্গনারাও তাঁকে দরজা খুলে দিতে নারাজ! কত গিলেছে কে জানে! মদ খেয়ে একেবারে টং! লাল চোখ। ওই দক্ষিণেশ্বরের কথা মনে পড়ল বুঝি। সে জানে সেখানে একজন আছেন, তিনি কখনও দরজা বন্ধ করেন না! যেমন ভাবা, অমনি জুড়ি গাড়িতে লাফিয়ে উঠল সে। নিজের লেখা পাহাড়ি পিলুতে খেমটা গাইতে গাইতে চলল। গঙ্গাপারের ভিজে হাওয়ায় ওই শোনা যাচ্ছে,
‘ছি ছি ছি ভালবেসে,
আপন বশে কি রয়েছো।’
তখন ঢের রাত। মন্দিরের চারপাশে নিকষ অন্ধকার। গাড়ি থামতেই, খোঁয়ারি জড়ানো গলায় লোকটা চিৎকার করল, ‘‘ঠাকুর, ঠাকুর!’’ বেরিয়ে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব! তিনি বুঝি অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ‘‘কাতর প্রাণে, এমন করে কে ডাকে? গিরিশ না!’’
ঠাকুরের ছোঁয়ায় যেন বিদ্যুৎস্পর্শ। সম্বিৎ ফিরে লজ্জায় নুয়ে পড়ল লোকটা। পরমহংস বললেন, ‘‘মদ খেয়েছিস তো কি, আমিও মদ খেয়েছি। ‘সুরাপান করি না আমি, সুধা খাই জয়কালী বলে, মন-মাতালে মাতাল করে, মদ-মাতালে মাতাল বলে।’’’ গান গাইতে গাইতে লোকটার হাত ধরে নাচতে লাগলেন ঠাকুর।
এই মোদো-মাতাল লোকটাই বাংলার রঙ্গমঞ্চ ও নাট্য ইতিহাসে তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ নট! গিরিশচন্দ্র ঘোষ।
গিরিশের জন্ম হয়েছিল বাগবাজারে। বাবা নীলকমল ঘোষ ছিলেন সওদাগরি অফিসের বুক-কিপার। মা রাইমণি। পাঠশালায় একদিন হাফ-আখড়াইয়ের আসরে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবর্ধনা দেখে, গিরিশের ইচ্ছে হল কবি হওয়ার। কিন্তু লেখা-পড়ায় মন কই ছেলের! সারা দিন টো টো। মাকে হারিয়ে ফেলল গিরিশ! ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাবা নীলকমলবাবু গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণে বের হলেন। হঠাৎ ঝড়। নৌকো ডুবে যায়-যায়! গিরিশ শক্ত করে বাবার হাতটা ধরল। মা নেই, কার হাতই বা ধরবে! ঝড় থামলে নীলকমল বললেন, ‘‘হাতটা ধরে ছিলিস, নিজের প্রাণ বড় না তোর? নৌকো ডুবলে কি ভাবছিস, তোকে বাঁচাবার চেষ্টা করতুম? যেমন করে পারি নিজেকেই বাঁচাতুম!’’ এ কী শুনল গিরিশ! সে বুঝল এ পৃথিবীতে বিপদে তার হাত ধরার কেউ নেই আর! ‘মা’ বলে কেঁদে ফেলল সে!
সারাজীবন এ ব্যথার উপশম মেলেনি তাঁর! দুঃখ ছিল নিত্য সহচর। যখন বয়স আট, এক দাদার মৃত্যু হল। চোদ্দো বছর বয়সে হারাল বাবাকে! বোনেদের মৃত্যুও দেখতে হয়!
বাবা মারা যাওয়ার পরে বিয়ে হয়ে গেল গিরিশের! বউ, শ্যামপুকুরের নবীন সরকারের মেয়ে, প্রমোদিনী।
বিয়ের পরে, গিরিশ ফের স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু পরীক্ষাই দিলেন না। চুকে গেল তাঁর স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক।
তাঁর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে ভয় পেয়ে গেলেন শ্বশুরমশাই নবীনচন্দ্র! তিনি জামাইকে ‘অ্যাটকিনশন টিলটন’ কোম্পানিতে শিক্ষানবিশি চাকরি জুটিয়ে দিলেন। গিরিশ হলেন ‘বুক-কিপার।’ এ বার তার মতি ইংরেজি সাহিত্যে। কিন্তু স্বস্তির জীবন যে নয় তাঁর!অফিস গেল উঠে।
১৮৭৪, ডিসেম্বরে মারা গেলেন স্ত্রী। রেখে গেলেন ছেলেমেয়ের পালনভার। গিরিশের সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। দিন কাটে তখন গঙ্গার ধারে। নেশার দিন। কবিতার দিন। বাগবাজার। কলুটোলা। কখনও ১৪৫ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটেও!
মৃত্যুর এই শমন একে একে কেড়ে নিয়েছে তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকেও! সব… সব হারিয়েছেন! মর্মশোকে কেবলই বলতেন, ‘সংসার বৃহৎ রঙ্গালয়। নাট্যরঙ্গালয় তাহারই ক্ষুদ্র অনুকৃতি।’ লাট খেতে খেতে গাইতেন,
‘জুড়াইতে চাই, কোথায় জুড়াই,
কোথা হতে আসি, কোথা ভেসে যাই।
ফিরে ফিরে আসি, কত কাঁদি হাসি,
কোথা যাই সদা ভাবি গো তাই।’
‘‘এত কষ্ট কেন? আয়, আমরা দু’জনে যেমন পারি, গান বাঁধি!’’ … ‘‘আমরা!’’ … ‘‘হ্যাঁ আমরা, কেন পারব না!’’
গিরিশের কথা শুনে হতবাক সহচর উমেশচন্দ্র চৌধুরী! দু’জন ফিরছিলেন সে যুগের গীতিকার প্রিয়মাধব বসু মল্লিকের বাড়ি থেকে। তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বাগবাজার শখের যাত্রাদল মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ পালা করবে। গান চাইতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গান দেননি প্রিয়মাধব। অগত্যা দু’জনেই গান বাঁধলেন। গিরিশ লিখলেন,
‘আহা! মরি! মরি!
অনুপমা ছবি, মায়া কি মানবী,
ছলনা বুঝি করে বনদেবী!’
সেই বয়স থেকেই এমন চট-জলদি লিখে ফেলায় গিরিশ ছিলেন তুখোড়।
একবার শনিবার রাতে মিনার্ভা থিয়েটারে ‘প্রফুল্ল’ হচ্ছে। ঠিক হল পরের শনিবার নতুন নাটক নামবে। গিরিশচন্দ্র ঠিক করলেন সেই রবিবারই তিনি নতুন নাটক লিখবেন! খবর দিলেন কলমচিকে। সে দিন ‘প্রফুল্ল’-তে যোগেশ চরিত্রে অভিনয় করেন আর গ্রিনরুমে এসে নতুন নাটকের কাহিনি-সংলাপ বলে যান। সেই রাতে গানও লিখলেন। ফিরলেন শেষ প্রহরে। লেখা হয়ে গেল ‘মণিহরণ।’ বলতেন, ‘‘চোখে না দেখে কিছু লিখিনি।’’ যাঁরা তাঁর কলমচি ছিলেন, দেখেছেন, তাঁর সেই ব্যথাকাতর সময়।
একবার তিনি মিনার্ভায়। স্বভাবমতো ঘুরতে ঘুরতে বলছেন। দ্রুত লিখে নিচ্ছেন কলমচি অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি পরে তাঁর জীবন লিখবেন। লেখার মাঝে প্রশ্ন করতেই গিরিশচন্দ্র বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন। রাগে কাঁপছেন! হাঁপানির জন্য কষ্ট হচ্ছে। শ্বাস নিতে কেঁপে কেঁপে উঠছেন! তবু নাটক লেখা চাই!হেমন্তকাল এলেই রোগ যেন বেড়ে যায়। সারা শীতকাল জুড়ে ভোগেন। কিন্তু কারও কথা শুনবেন না! লিখছিলেন, ‘সিরাজদ্দৌল্লা’। বুকে, গলায় হাত দিয়ে চেপে ধরে বলছিলেন,
‘ওহে হিন্দু-মুসলমান—
এস করি পরস্পর মার্জ্জনা এখন…।’
‘‘কী বললেন?’’ … ‘‘আহা! ভাবনার মাঝে প্রশ্ন করে কী ক্ষতি করলে জানো! কত বার বলেছি, তবু মনে রাখতে পারো না! লেখার মাঝে থামালে সব গোলমাল হয়ে যায়!’’
যাত্রার পরে নাটক নিয়ে পড়েন। ঠিক হল, দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’। চতুর্থ অভিনয়ের রাতে হাজির খোদ নাট্যকার। দীনবন্ধু মিত্র। জড়িয়ে ধরলেন গিরিশকে!
বাগবাজার ন্যাশনাল থিয়েটার ভেঙে গেলে হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার আর ন্যাশনাল থিয়েটারের জন্ম। তবে এই সময় গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের পত্তনের ইতিহাস একটু অন্যরকম। সে’ও এক গল্প!
বাগবাজারের তরুণ জমিদার ভুবনমোহন নিয়োগী বেঙ্গল থিয়েটারে গ্রিনরুমে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলেন। নিজেই থিয়েটার খুললেন। গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার।
গিরিশ বঙ্কিমের ‘মৃণালিনী’র নাট্যরূপ দিলেন। তিনি তখন চাকরিও করছেন – ইন্ডিয়ান লিগের হেড ক্লার্ক। এক বছর পরে গেলেন পার্কার কোম্পানিতে। তখন তাঁর দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছে, স্ত্রী’র নাম সুরতকুমারী। হঠাৎ অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনে গোল ছড়াল থিয়েটার পাড়ায়। বন্ধ হল শো! দেনার দায়ে ডুবে ভুবনবাবু গিরিশকে অনুরোধ করলেন থিয়েটার লিজে নিতে। গিরিশ রাজি হলেন। তবে ‘গ্রেট’ নয়, নাম দিলেন ‘ন্যাসান্যাল থিয়েটার।’ ঠিক করলেন প্রথম নাটক হবে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য।’ তত দিনে জোড়াসাঁকোর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মঞ্চনাটক ‘সরোজিনী’তে অভিনয় করে বিনোদিনীও গাইছেন রবিঠাকুর।
‘জ্বল জ্বল চিতা। দ্বিগুণ, দ্বিগুণ!’
… ‘‘কী রে বিনোদ এখান হইতে যাইলে তোর মন কেমন করিবে না?’’ … বিনোদিনী কী উত্তর দেবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তাঁর ছোটবাবু মানে বেঙ্গল থিয়েটারের শরৎচন্দ্র ঘোষের কথায় তিনি চুপ করে ছিলেন। কী’ই বা বলবেন! সামনে দাঁড়িয়ে গিরিশ ঘোষ! তাঁরা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন নতুন দলের জন্য। বিনোদিনী নিজের আত্মজীবনীতে লিখছেন,
‘‘গিরিশবাবুর সহিত থিয়েটার আরম্ভ করিয়া বিডন স্ট্রীটের ‘ষ্টার থিয়েটার’ শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি তাঁহার সঙ্গে বরাবরের কার্য্য করিয়া আসিয়াছি। কার্য্য ক্ষেত্রে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন এবং আমি তাঁহার প্রথমা ও প্রধানা শিষ্যা ছিলাম।’’
কেমন সম্পর্ক? বিনোদিনী লেখেন, ‘‘জোর জবরদস্তি, মান অভিমান, রাগ প্রায়ই চলত। তিনি আমায় অত্যধিক আদর দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন।’’
… ‘‘কী হল গিরিশবাবু! বারে, অমন করে তাকিয়ে থাকবেন!’’ … ‘‘বিনোদ! তোমাকে নিজের হাতে গড়ব। তুমি আমার সজীব প্রতিমা!’’
গিরিশের জীবনে যেন ঝেঁপে এলেন বিনোদিনী! তাঁর বিনি। মেয়ে লেখে,
‘প্রেমডোর দিয়ে তারে বাঁধি অনিবার
সে মালা কি ভালবাসা প্রাণেশ আমার?’
অমৃতলাল বসু ‘অমৃত মদিরা’য় সেই সব দিনের কথায় লিখছেন,
‘‘গিরিশের পদাবলী রোম্যান্সের মেলা
কবিতা লিখায়ে তাই বিনি করে খেলা
হাসির কথায় নিশ হয়ে গেছে ভোর
তথাপি ওঠে না কেহ ছাড়িয়া আসোর।’’
গিরিশ বিনোদকে খুব বিশ্বাস করতেন। বিনোদও মানুষটার সামনে তাঁর সব গ্রন্থি আলগা করে দেন। এক দিন বিনোদ চুপটি করে শোনেন হর-পার্বতীর গল্প। রাত বাড়ে। নেশা ভেজানো গলায় গিরিশ শোনান তাঁর নতুন নাটক ‘আগমনী।’
গিরিশের ভাগ্য বিড়ম্বিত! খরচের বোঝা বইতে বইতে একসময় ন্যাশনাল থিয়েটার বিকিয়ে গেল! কিনলেন প্রতাপচাঁদ মুহুরি। ১০০ টাকায় গিরিশ সেখানে ম্যানেজার! তখন দিন-রাত নাটক লিখছেন তিনি। অক্লান্ত! ’৮২-তে ৭টি পৌরাণিক নাটক! সঙ্গে চলছে আকণ্ঠ মদ্যপান। অমৃতলাল লিখছেন,
‘আমি আর গুরুদেব (গিরিশ) যুগল ইয়ার
বিনির (বিনোদিনী) বাড়িতে যাই খাইতে বিয়ার।’
শেষ হলে ফের আনা হয় ‘বি-ফাইভ ব্র্যান্ডি।’
হাঁটুতে মুখ রেখে স্থির হয়ে বসে আছেন বিনোদিনী। তাঁর চোখ লাল! খোলা চুল। এলোমেলো শাড়ির কুঁচি-আঁচল। থমথমে ঘর-দুয়ার। বিনোদ থিয়েটার ছেড়ে দিতে চান! গিরিশ আর অমৃত তাঁকে বোঝাচ্ছেন। কোনও কথাই যেন বিনোদের কানে ঢুকছে না। তাঁর কেবল মনে পড়ে যাচ্ছে প্রতাপ জুহুরির কুৎসিত ভাষা, চোখের ইঙ্গিত! বিনির কী দোষ! পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে কাশী গিয়েছিলেন। ফিরতে দেরি হয়েছে। তাই বলে ছুটির মাইনে দেবেন না! বিনোদিনীর সঙ্গে গিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন গিরিশও। প্রতাপকে বলেছিলেন, ‘‘মাইনে না দিলে বিনোদ কিন্তু কাজ করবে না!’’ … ‘‘মাহিনা কেয়া?’’ … গিরিশ হতবাক প্রতাপের কথা শুনে। ঘেন্নায় গা রি রি করছিল বিনোদের! বটে মাহিনা দেবে না! রাগে কাঁপতে কাঁপতে চলে এসেছিলেন বিনোদ। কিন্তু সে চলে গেলে এখন যে খুব বিপদ হয় গিরিশের। দলের সবার। গিরিশ বোতল নিঃশেষ করে বিনোদকে আদর করে বোঝাতে গেলেন, তিনি জানেন তাঁর কথা এই মেয়ে ফেলবে না! গিরিশবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে ‘না’ বলতে গিয়ে ঠোঁট কেঁপে উঠল বিনোদের! পারল না তাঁর বিনি! অমৃত মিত্র বললেন, ‘‘দেখ বিনোদ, এখন গোল করিস না। একজন মাড়োয়ারির ছেলে নতুন থিয়েটার করতে চায়। যত টাকা লাগে সে খরচ করবে। কিছু দিন চুপ করে থাক। দেখ কী হয়!’’ কিছু দিন পরে ন্যাশনাল ছেড়ে দিলেন গিরিশ। ছাড়লেন বিনোদিনীও।
কলকাতায় তখন নটী বিনোদিনীর ঢলঢলে রূপের বেশ কদর! সব পুরুষই তাঁকে ছুঁতে চায়। ছোঁয়া কী সহজ!
মুগ্ধ মাড়োয়ারি ঘরের ছেলে গুর্মুখ রায়। ৬৮ বিডন স্ট্রিটে লিজের জায়গায় তিনি তৈরি করলেন পাকা মঞ্চ। ঠিক ছিল নাম দেবেন, বিনোদিনীর নামে। কিন্তু হল কই! গড়ে উঠল স্টার থিয়েটার। সকাতরে বিনোদিনী দাসী লিখছেন স্টার-কথা,
‘‘সকলে চলিয়া যাইলে আমি নিজে ঝুড়ি করিয়া মাটী বহিয়া পিট, ব্যাক সিটের স্থান পূর্ণ করিতাম।… আমার সেই সময় আনন্দ দেখে কে?…সকলে আমায় বলেন যে, ‘এই যে থিয়েটার হাউস হইবে, ইহা তোমার নামের সহিত যোগ থাকিবে।’…কিন্তু কার্যকালে উঁহারা সে কথা রাখেন নাই কেন— তাহা জানি না!’’
বিনির মনখারাপ! সকলে ঠকিয়েছে তাঁকে! গিরিশ জানেন কী করে দুলালির মন ভাল করতে হয়। বিনোদকে ‘সতী’ চরিত্রে রেখে লিখলেন ‘দক্ষযজ্ঞ’। নিজে সাজলেন ‘দক্ষ।’ কিন্তু বেশি দিন সুখ সইল না।বিনোদিনীকে সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসাবে দাবি করে স্টারে টাকা ঢেলেছিল যে গুর্মুখ রায়, সেও সরে গেল। ভেঙে গেল ‘স্টার’-এর স্বপ্ন!
এগারো হাজার টাকায় স্টার হস্তান্তরের ব্যবস্থা করলেন দলের কয়েক জনের নামে। কিন্তু নিজে মালিক হলেন না। কেন না, অনুজ অতুলকৃষ্ণকে কথা দিয়েছিলেন, থিয়েটারে যত দিন থাকবেন, কখনও নিজে মালিক হবেন না! মালিকানা বদল হলেও নাটক থেমে রইল না। কিন্তু গিরিশের ভিতরে ভিতরে অস্থিরতা যেন বেড়েই চলেছে।
বুক জুড়ে জ্বালা! রোগে, শোকে দহিত তিনি! মুক্তি মেলে না! কালীঘাটে ফি সপ্তাহে শনি-মঙ্গলবার হাড়কাঠের কাছে বসে সারারাত্তির জগদম্বাকে ডাকতে থাকেন। উচ্চারণ করেন মাতৃনাম, ‘কালী করালবদনা।’ পথের লোককে জিজ্ঞেস করেন, ‘‘মুক্তি কীসে গা!’’
গিরিশের দিকে তাকিয়ে হাসছেন ঠাকুর। নাচতে নাচতেই হাসছেন! ভাব-কোমল নৃত্য! আর রাম দত্ত খোল বাজাচ্ছেন। আর পরমহংস নাচছেন। দু’হাত তুলে ঠাকুর গাইছেনও,
‘নদে টলমল করে গৌরপ্রেমের হিল্লোলে।
নদে টলমল…।’
গাইতে গাইতেই সমাধি নিলেন ঠাকুর।
তিনি চোখ খুলতে গিরিশ ঠাকুরকে ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমার মনের বাঁক যাবে?’’ ঠাকুর বললেন, ‘‘যাবে।’’ যেন বিশ্বাস হচ্ছে না গিরিশের! তিনি বার বার জিজ্ঞেস করছেন। ঠাকুর হেসে তিন সত্যি করলেন।
এ প্রথম নয়। গিরিশের যখন চল্লিশ, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা তাঁর।
এক সন্ধ্যায় পরমহংসকে বারবার ‘সন্ধে হল, সন্ধে হল’ জিজ্ঞেস করতে দেখে বলেছিলেন, ‘‘ঢং দেখো, সন্ধ্যা হইয়াছে, সম্মুখে সেজ জ্বলিতেছে, তবু উনি বুঝিতে পারিতেছেন না!’’
আরেক বার বলরাম বসুর বাড়িতে দেখে পালিয়ে এসেছিলেন!
ঠাকুরের তাঁর তৃতীয়বার দেখা ১৮৮৪-তে। ‘চৈতন্যলীলা’র অভিনয় দেখতে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব। স্টার থিয়েটার। ২০শে সেপ্টেম্বর। মঞ্চে চৈতন্যের ভূমিকায় বিনোদিনী বৈষ্ণবনৃত্যের পরে যখন ‘কৃষ্ণ কই-কৃষ্ণ কই’ বলে জ্ঞান হারালেন দর্শক বৃন্দাবনী প্রেমে ভাসল! নাটক শেষ। বিনোদিনীর ‘নিমাই’ দেখে তাঁর মাথায় হাত রেখে পরমহংস বললেন, ‘‘তোর চৈতন্য হোক।’
আর গিরিশের? দু’জনে বসে আছেন এক দিন দক্ষিণেশ্বরে। মন উচাটন গিরিশের! পরমহংস গিরিশকে বললেন, ‘‘এখন থেকে এদিক-ওদিক দু’দিক রেখে চল। তারপর যদি এই দিক ভাঙে তখন যা হয় হবে। সকালে-বিকালে স্মরণ-মননটা একটু রাখিস, পারবিনে?’’ গিরিশ চুপ করে থাকেন! ভাবেন এ কেমন বাঁধাবাধি! বলেন, ‘‘যদি কথা রাখিতে না পারি!’’ ঠাকুর বলেন, ‘‘তবে আমায় বকলমা দে। শ্রীভগবানে পাপ-পুণ্যের ভার দিয়ে সম্পূর্ণ আত্ম-সমর্পণ কর।’’ গিরিশ এ বার রাজি হলেন! ঠাকুরের অপার করুণায় চোখে জল গিরিশের! হাপুস নয়নে কাঁদছেন তিনি!
মেঘ যেন ঘনিয়ে এল ফের! ‘বেল্লিক বাজার’ নাটকের প্রথম রাতের অভিনয়ের পরে থিয়েটার ছেড়ে দিলেন বিনোদিনী! প্রিয়জনের ‘ছলনার আঘাত’ তিনি ভুলতে পারেননি! অন্য দিকে গোপাললাল শীল নামে এক ব্যক্তি স্টার থিয়েটারের জমি কিনে নিলেন! গিরিশের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন! ত্রিশ হাজার টাকায় পুরনো স্টারকে বিক্রি করে এ বার গিরিশ অনুগামীরা চলেন হাতিবাগানে। যেন পুনর্জন্ম স্টার থিয়েটারের!
সে সময় গোপাল লালের ‘এমারেল্ড’-এ গিরিশ মাসিক তিনশো পঞ্চাশ টাকার কাজ করেছেন। সে টাকাও তিনি পাঠাতেন পুরনো দলকে। প্রতিদানে কী পেলেন? কী-ই’বা পেতেন! মাসে একশো টাকা মাইনে। আর দৈনিক চার পয়সার তামাক। জুটল ক্ষত! প্রিয় শিষ্যদের কাছ থেকে জুটল লাঞ্ছনা-অপমান! স্টারে ফিরলে গিরিশ ঘোষকে তাড়িয়ে দিলেন তাঁরই শিষ্যরা। বরখাস্ত হলেন! মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে অঙ্গীকার করতে বাধ্য হলেন বৃদ্ধ নট, স্টারের শর্তে। গিরিশ কথা দিলেন, মাসে ১০০ টাকা পেনশনের বিনিময়ে আর কোথাও কখনও থিয়েটার করবেন না! কখনও না!
‘মমতা এস না বক্ষে মম
জ্বল জ্বল রে অনল/ প্রতিহিংসানল জ্বল হৃদে।’
পারলেন না! তিনি লিখলেন, ‘জনা’। ক্ষত মেটাতে ক্ষতিপূরণ দিয়ে তার আগেই জন্ম হল মিনার্ভার। অভিনয় হল অনুবাদে ম্যাকবেথ।
কিন্তু তিনি স্থির হতে পারছেন না! উইংসের আড়াল থেকে কে যেন তাঁকে ডাকছে! বিনোদ না! প্রতি মুহূর্তে নিজেরই তৈরি করা চরিত্রেরা বুঝি কথা বলছে ফিসফিস হাওয়ায়। তাদের সংলাপ, হাসি, কান্না ক্যাকফনি হয়ে মিশে যাচ্ছে গিরিশের বুকের জ্বালায়, হাহাকারে! আর্তরবে! থিয়েটার পাড়ার পথের হাওয়ায় তখন গিরিশকে নিয়ে স্টার থিয়েটারের হ্যান্ডবিল উড়ছে! ধুলোয় লাট খাচ্ছে কাগজগুলো। তাতে লেখা, ‘তোমার শিক্ষিত বিদ্যা দেখাব তোমায়।’ আর গিরিশ হাসছেন!
পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবন। কখনও লিখবেন না? হেসে উঠতেন নট। দমকা কাশি সামলে আত্মজীবনী লেখার অনুরোধ ফিরিয়ে দিতেন। বলতেন, ‘‘সে বড় সহজ কথা নয় হে। বেদব্যাসের মতো যেদিন অকপটে আত্মদোষ বলতে পারব, সেদিন লিখব।’’ শেষ কয়েক বছর কাটে ‘মিনার্ভা’, ‘ক্লাসিক’-এ। ‘ক্লাসিক’ থাকতেই একদিন চললেন তারকেশ্বর। মেয়ের জন্য পুজো দিতে। কলকাতায় যখন ফিরলেন, ততক্ষণে সব শেষ! শুনলেন দাহ হয়ে গিয়েছে মেয়ের দেহ! দুমড়ে উঠল বুক। কান্না হাহাকার হয়ে ভিজিয়ে দিল দু’চোখ! দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী চলে যাওয়ার পরে বহু কষ্টে-যত্নে-আদরে মানুষ করেছিলেন সেই শিশুটিও এভাবেই চলে গিয়েছিল! সারদামায়ের স্পর্শও তাকে ফেরাতে পারেনি! আর জীবনের এই অবেলায় চলে গেল মেয়ে! আর কত!
তাঁর শেষ অভিনয় করলেন ১৯১১-তে। নাটক ‘বলিদান’-এ করুণাময়ের চরিত্রে। সেদিন খুব বৃষ্টি। হাঁপের টান নিয়ে বার বার খালি গায়ে স্টেজে আসতে হচ্ছে গিরিশকে। অসুস্থ হলেন। রোগশয্যায় নিবেদিতাকে উৎসর্গ করে লিখলেন শেষ নাটক ‘তপোবল’।
বুকের জ্বালা যেন বেড়েই চলেছে। ঘুম নেই! সারাক্ষণ বসে থাকেন। আর বলেন, ‘‘প্রভু, আর কেন, শান্তি দাও, শান্তি দাও, শান্তি দাও!’’
চলেই গেলেন! ফেব্রুয়ারি, ১৯১২। বৃষ্টিতে ছেয়ে রয়েছে আকাশ। তার পেয়ে ফরিদপুর থেকে ফিরলেন ছেলে দানিবাবু। গহন রাত। মহল্লা মাতোয়ারা সংকীর্তনে। শেষ সময় গিরিশের মৃদু কণ্ঠে শোনা গেল শ্রীরামকৃষ্ণ-নাম!
(তথ্যসূত্র:
১- গিরিশচন্দ্র: নট-নাট্যকার ও ভক্তভৈরব, সুনীলময় ঘোষ, হরিহর গ্রন্থাগার (২০১১)।
২- গিরিশচন্দ্র, অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
৩- শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাধন্য গিরিশচন্দ্র, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশিং।
৪- আমার কথা, বিনোদিনী দাসী।
৫- পরমপুরুষ শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (২০১৪)।
৬- আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮শে জানুয়ারি ২০১৭ সাল।)
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত